শঙ্করবাবু, তেরো তারিখে বিকেলবেলা ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আপনার হোয়ার অ্যাবাউটস কী ছিল?
অ্যাম আই এ সাসপেক্ট?
এভরিওয়ান ইজ এ সাসপেক্ট। বলুন।
ইউজুয়ালি ছ’টার পর আমার মিটিং থাকে।
সেদিনও ছিল?
ছিল।
কার সঙ্গে এবং ক’টা থেকে ক’টা পর্যন্ত?
শব্দহীন নিজস্ব মস্ত চেম্বারে আরামদায়ক একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে শঙ্কর একটু ভাবল। উলটোদিকে বসা মাঝারি চেহারার শবর দাশগুপ্ত লোকটিকে তার ভাল লাগছে না। এ একজন অল্প বেতনের গোয়েন্দা। এর কি তার সঙ্গে ওপরওয়ালার মতো কথা বলার স্পর্ধা থাকা উচিত?
শঙ্কর বলল, মনে নেই। আমার সেক্রেটারি হয়তো জানে।
আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি। দরকার হলে সেক্রেটারির সঙ্গে পরে কথা বলা যাবে।
সরকার যে কেন এইসব পাতি গোয়েন্দাদের হাতে এত ক্ষমতা দেয় তা বোঝে না শঙ্কর। সে অত্যন্ত তেতো গলায় বলল, মনে না থাকলে কী করা যাবে? আমি ব্যস্ত মানুষ, রোজই মিটিং টিটিং করতে হয়–
আপনি কতটা ব্যস্ত সে খবর আমার জানা আছে। এত বড় একটা কোম্পানির আপনি রিজিওন্যাল ম্যানেজার, ব্যস্ত তো থাকারই কথা। তবু তেরো তারিখটা একটু মনে করার চেষ্টা করুন। সেদিন সল্টলেকে আপনাদের একটা নেমন্তন্ন ছিল।
হ্যাঁ।
ওই অকেশনটা থেকে চিন্তাকে একটু পিছিয়ে নিতে থাকুন, মনে পড়বে।
শঙ্কর একটু ভাবল। তারপর বলল, সেদিন আমার ড্রাইভার ছিল না। তাই আমি বোধহয় একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে যাই।
ড্রাইভারের কী হয়েছিল?
কী একটা দরকারে ছুটি নিয়েছিল।
ইট ক্যান বি ক্রস চেকড। যা বলার ভেবেচিন্তে বলুন।
তাই তো বলছি।
একটু আগে বেরিয়ে গিয়ে কী করলেন?
একটা উপহার কেনার দরকার ছিল। তাই—
উপহার কার জন্য?
আমার শালির মেয়ের জন্য। ওর জন্মদিন ছিল।
আপনারা স্বামী-স্ত্রী কি দুতরফা উপহার দিয়েছিলেন?
তার মানে?
আপনার স্ত্রীও সেদিন উপহার কিনেছিলেন বলে আমাকে বলেছেন।
ওঃ!
উপহারটা কোথা থেকে কিনলেন?
নিউ মার্কেট।
কী কিনেছিলেন?
ঝুটো গয়না।
বাসুদেব সেনগুপ্তকে আপনি কতকাল চেনেন?
অনেকদিন।
কীরকম লোক ছিলেন তিনি?
সেটা উহ্যই থাকা ভাল।
তেরো তারিখে আপনি ক’টার সময় অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন?
ছ’টা–না আরও পরে।
ঘড়ি না দেখে বেরোবার মানুষ তো আপনি নন।
বলেছি তো, ভাল মনে পড়ছে না।
নিউ মার্কেটের কোন দোকান থেকে গয়না কিনেছিলেন মনে আছে?
দোকানের নামটাম জানি না। না, মনে নেই।
ইতিমধ্যে আমি সল্টলেকে আপনার শালির বাড়িতে খোঁজখবর নিয়েছি। ওঁরা জানিয়েছেন, ওঁদের মেয়ের জন্মদিনে তাকে আপনারা পাঁচশো টাকার একটা গিফট চেক দিয়েছেন। সেই চেকটা কেনা হয়েছিল বারো তারিখে।
ওঃ।
শঙ্কর বড্ড অপ্রতিভ বোধ করতে লাগল। নিজেকে এমন বোকা তার বহুকাল লাগেনি। গোয়েন্দারা কীভাবে কাজ করে এবং কত দূর অবধি খোঁজখবর নেয় সে সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল না। সে শবর দাশগুপ্তর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলের দিকে চেয়ে রইল।
এবার বাসুদেব সেনগুপ্তর প্রসঙ্গ। মিস্টার বোস, আমার কাছে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, আমি আপনার স্ত্রী ও বাসুদেববাবুর সম্পর্কের কথা জানি। আমার প্রশ্ন হল, আপনি যখন দেখলেন ওঁরা পরস্পরের প্রেমে পড়েছেন, তখন আপনি আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স না দিয়ে তার অবৈধ প্রেম মেনে নিলেন কেন?
এটা খুবই ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। আপনি ঠিক বুঝবেন না।
আমি এও শুনেছি, আপনি আপনার স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসেন। এতটাই সেই ভালবাসা যে, তার সমস্ত অন্যায় ও ব্যভিচার অম্লান বদনে মেনে নেন। সত্যিই কি তাই?
শঙ্কর একটু লাল হয়ে বলল, হয়তো ভালবাসাটা একটা যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নয়। তবুবলি, কথাটা সত্যি। আমি আমার স্ত্রীকে প্রবলভাবে ভালবাসি।
ভালবাসা ইউজুয়ালি পজেসিভ। আপনার স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখেও আপনি তেমন কোনও ব্যবস্থা নেননি। কেন তা বলতে পারেন?
কী ব্যবস্থা নেব? আমার তো কিছু করার ছিল না।
আপনি আপনার স্ত্রী বা বাসুদেবকে কখনও চার্জ করেননি?
করে কী হবে? দে ওয়্যার ইন লাভ, আমার কিছু করার ছিল না।
সাধারণত প্রেমিক পুরুষেরা জেলাস হয়। স্ত্রীর প্রেমিককে তারা বড় একটা ক্ষমা করে না। বাসুদেবকে আপনি কিছুই করেননি। মারপিট না হোক একটা শো-ডাউন বা একটা ঝগড়া তো করবার চেষ্টা করতে পারতেন।
তাতে লাভ হত না।
আপনি কি মোর ক্যালকুলেটিভ দ্যান ইমোশনাল?
আমি আমার ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারি।
তাই যদি হয় তা হলে আপনি আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স না করার জন্য কান্নাকাটি এবং সাধাসাধি করলেন কী করে? দ্যাট ইজ ইমোশন। তাই না?
এসব কথা আপনাকে কে বলল? আমার স্ত্রী?
তা ছাড়া আর কে হতে পারে?
রীণা যদি ও কথা বলে থাকে তবে খুব একটা ভুল বলেনি। হ্যাঁ, আমি ওকে ছাড়তে চাইনি। সেই সময়ে আমি আবেগে খানিকটা ক্যারেড হয়ে গিয়েছিলাম–সত্যি কথা।
বাসুদেব সেনগুপ্তকে কি আপনি ভয় পেতেন?
হঠাৎ শঙ্কর রাগে লাল হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, স্টপ ইট। কেন–কেন আমি সেই স্কাউন্ড্রেলটাকে ভয় পাব? আমি ওকে ঘেন্না করতাম।
প্লিজ! ওরকম হেস্টি হবেন না। এসব অনভিপ্রেত প্রশ্ন আমাদের বাধ্য হয়েই করতে হয়। আপনি নিজেই বলেছেন যে, আপনি আপনার ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে পারেন।
সরি। বলুন।
ভয়ের প্রশ্নটা উঠছে তার কারণ বাসুদেব সেনগুপ্ত খুবই মারকুট্টা এবং অ্যাগ্রেসিভ লোক ছিলেন। খেলার মাঠেও ওঁর মারাকু বলে বদনাম ছিল। নিজের পরিবারের কাছেও ছিলেন একজন ভীতিপ্রদ মানুষ।
তা জানি।
এবার বলুন ওঁর সঙ্গে লাইন অফ কলিশনে আসতে কি আপনার একধরনের উইকনেস ছিল?
সামান্য সাদা মুখে কিছুক্ষণ বসে রইল শঙ্কর। তারপর জোর করে মাথা নেড়ে বলল, না।
ওই আকস্মিক রক্তহীনতা শবর চেনে। ঘোষালবাবুর ঠিক ওরকমই হয়েছিল। তবে শবর পয়েন্টটা নিয়ে আর চাপাচাপি করল না।
এবার একটু সেনসিটিভ প্রশ্নে যাচ্ছি।
শঙ্কর একটা শ্বাস ফেলে বলে, গো অ্যাহেড।
রিগার্ডিং অজাতশত্রু বসু।
হ্যাঁ। অজু বাসুদেবের ছেলে।
সেটা এখন অনেকেই জানে। প্রশ্ন হল, এ ছেলেটির প্রতি আপনার মনোভাব কেমন?
কীরকম হওয়া উচিত?
আমার প্রশ্ন হল, বাসুদেব অন্যায়কারী হলেও ছেলেটি তো ইনোসেন্ট।
শুনুন, আমি রক্তমাংসের মানুষ, পাথর নই। আমি আমার স্ত্রী আর বাসুদেবের অনেক অন্যায় সহ্য করেছি বটে, তা বলে বাসুদেবের ছেলেকে মাথায় করে নাচবার তো কিছু নেই।
তা বলছি না। আমার প্রশ্ন, ছেলেটার প্রতি আপনার এত তীব্র বিদ্বেষ ছিল কেন, যার জন্য ছেলেটা কখনও আপনার সামনে আসার সাহস পেত না?
আপনার নিজের জীবনে এরকম ঘটনা ঘটলে বুঝতেন আমি কতটা মানসিক সাফারার।
কখনও প্রতিশোধ নেওয়ার কথা মনে হয়নি?
প্রতিশোধ! প্রতিশোধ কীভাবে নেব তা আমি ভেবে পেতাম না।
প্রতিশোধের কথা ভাবতেন তো? বাসুদেবকে খুন করার ইচ্ছে কখনও হয়নি?
ফের উত্তেজিত হয়ে শঙ্কর বলে ওঠে, আর ইউ হিন্টিং সামথিং?
ঠান্ডা গলায় শবর বলল, এরকম ইচ্ছে তো হতেই পারে। বিশেষ করে যারা অসহায় আর দুর্বল, যারা ভিতু তাদের মনেই জিঘাংসা থাকে বেশি। যেহেতু তারা ঘটনা ঘটাতে পারে না সেইহেতুই তারা মনে মনে খুনটুনের কথা ভাবে। শুধু ভাবেই, তার বেশি কিছু নয়।
আপনি আমাকে দুর্বল আর ভিতু বলে ব্র্যান্ডেড করছেন নাকি? আর ইউ শিয়োর?
শবর মাথা নেড়ে বলে, না। আই অ্যাম নট শিয়োর। কিন্তু এবার একটা আরও সেনসিটিভ প্রশ্ন আছে। ভয় হচ্ছে প্রশ্নটা করলে আপনার ভায়োলেন্ট রি-অ্যাকশন হতে পারে। করব কি?
ইফ দ্যাট ক্লিয়ার্স মি ফ্রম দিস হিনিয়াস অ্যাফেয়ার্স দেন শুট।
দেন পুল ইয়োরসেলফ টুগেদার। প্রশ্নটার জবাব ইচ্ছে করলে আপনি নাও দিতে পারেন।
গো আহেড।
আপনার যৌন ক্ষমতা কি কিছুটা কম ছিল?
চেয়ারের দু’হাতলে শঙ্করের দু’হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। মুখটা হয়ে গেল পাথরের মতো। দুই চোয়ালে দুটো ঢিবি। চাপা হিংস্র গলায় সে বলল, হোয়াট ডু ইউ মিন? এটা কী ধরনের–
রিল্যাক্স। আই হ্যাভ গট দি মেসেজ।
হোয়াট মেসেজ, ইউ বাস্টার্ড?
শবর একটু হাসল। ঠান্ডা নরম গলাতেই বলল, ইট হার্টস আই নো।
ক্লান্ত শঙ্কর নিজের ব্যবহারে সামান্য লজ্জিত হয়ে বলে, এসব অবান্তর প্রশ্ন করছেন কেন?
অবান্তর নয় বলেই করছি। আমি হোমওয়ার্ক না করে আপনার কাছে আসিনি।
কীসের হোমওয়ার্ক?
রসকো ক্লিনিকের ডাক্তার চৌধুরী আমাকে জানিয়েছেন, আপনি তার রেগুলার ক্লায়েন্ট। একসময়ে আপনি তার কাছে হরমোন ট্রিটমেন্টের জন্য গিয়েছিলেন।
শঙ্করের মুখটার বয়স যেন চোখের পলকে দশ বছর বেড়ে গেল। স্তম্ভিত এবং হতশ্বাস একটা চেহারা। ঢাকা দেওয়া গেলাস তুলে খানিকটা জল খেল ঢক ঢক করে।
এতে লজ্জার কী আছে? এরকম তো হতেই পারে। সকলের কি সব দিক পারফেক্ট থাকে?
প্লিজ! আজ আপনি আসুন।
কেন উত্তেজিত হচ্ছেন? আমি পুলিশে চাকরি করি বলেই মায়াদয়াহীন নই। কিন্তু সত্যের ভিতরে পৌঁছোতে হলে এসব বিচ্ছিরি প্রসঙ্গ না তুলেও উপায় থাকে না।
আমি ইম্পোটেন্ট নই।
ইম্পোটেন্ট বলিনি।
তা হলে?
ডাক্তার চৌধুরী আমাকে বলেছেন, ইউ ওয়্যার নট এ ভেরি উইলিং অ্যান্ড অ্যাগ্রেসিভ লাভার। ওঁর একটা ব্যাখ্যা আছে।
কী সেটা?
আপনি আপনার সুন্দরী স্ত্রীকে অত্যধিক ভালবাসতেন। এতটা ভালবাসতেন বলেই আপনি তাকে সেয়ালি খুশি করতে পারবেন কি না তা নিয়ে আপনার টেনশন থাকত। এটা একধরনের ভয়। এই ভয় এতটাই তীব্র যে ইন রিয়ালিটি আপনি দুর্বল হয়ে পড়তেন। স্ত্রীকে তৃপ্ত করা আপনার পক্ষে সম্ভব হত না।
শঙ্কর মুখটা নামিয়ে চুপ করে বসে রইল।
খুব সরু এবং নিচু গলায় শবর বলল, এই সুযোগটাই কি বাসুদেব নিতেন?
প্লিজ! প্রসঙ্গটা আমার সহ্য হচ্ছে না।
কেন মিস্টার বোস, আমি তো বন্ধুর মতোই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। আমি আপনার শত্রু নই। আমি আপনার প্রবলেমগুলো নিয়ে ভেবেছি বলেই এত খবর নিয়েছি। ডাক্তার চৌধুরী আপনাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও পাঠিয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
মিস্টার বোস, সেক্সের শতকরা আশি-নব্বই ভাগই হল মানসিক, দশ বা কুড়ি পারসেন্ট হল শরীর। একটা মোটিভেশন থেকেই ওটা হয়ে ওঠে।
ক্লান্ত শঙ্কর বলল, আপনি কি আমাকে যৌনশিক্ষার পাঠ দিচ্ছেন?
শবর একটু হাসল, বলল, না। লেট ইট গো। আপনি একজন অপমানিত, লাঞ্ছিত মানুষ। আপনার স্ত্রী এবং বাসুদেব মিলে আপনাকে একসময়ে সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছিল। আপনার স্ত্রী আপনাকে একরকম জানিয়েই বাসুদেবের সন্তান ধারণ করেন। আপনি সবই মেনে নিয়েছিলেন, সহ্য করেছিলেন। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটা একটা মহত্ত্বের ব্যাপার। অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে, পৌরুষের অভাব।
ধরুন তাই। নাউ লেট মি গো হোম।
শঙ্কর উঠতে যাচ্ছিল। শবর ঠান্ডা এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমার কথা এখনও শেষ হয়নি৷
শঙ্কর গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে বলল, ইউ আর গোয়িং টু ফার।
আমি সেটা জানি। আপনি হয়তো তখন প্রতিশোধ নেননি, কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে বাসুদেবের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছেন।
কী বলছেন আপনি? শঙ্কুর ফের সাদা মুখে বলল। তার হাত ফের চেয়ারের হাতলে শক্ত।
শবর হাসল, নানারকম সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। এরকম নাও হতে পারে। তেরো তারিখে বিকেল ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা অবধি আপনার হোয়ারঅ্যাবাউটস জানাটা সেজন্যই জরুরি।
বললাম তো!
কিছুই বলেননি। যা বলেছেন তা ভাসাভাসা। ইনি ডিটেলস যদি বলতে না পারেন তবে ইউ আর ইন এ স্যুপ।
মাই গড!
শঙ্কর দৃশ্যতই ভেঙে পড়ার ভঙ্গি করে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।
শবর মৃদুস্বরে বলল, কোথায় ছিলেন?
আই হ্যাড অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
কার সঙ্গে?
সেটা বলা যাবে না।
দরকার হলেও না?
এখনও দরকারটা বুঝতে পারছি না।
শবর উঠল। বলল, ওকে। লেট আস কল ইট এ ডে!
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় একবার ফিরে চাইল শবর। দেখল, যেন নিজেরই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে আছে শঙ্কর বসু।
রাত ন’টায় হাসপাতালে হানা দিল শবর। ভিজিটিং আওয়ার অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন হাসপাতালটা বেশ শান্ত।
ঘোষাল বিছানায় উঁচু বালিশে হেলান দিয়ে বসে গীতা পড়ছিল। তাকে দেখে ছোট বইটা বালিশের পাশে রেখে উঠে বসে হাসল।
শবর বিছানারাই এক ধারে বসে বলল, শুনলাম আপনার রিলিজ অর্ডার কালই হয়ে গেছে। তবু আপনি বাড়ি যাচ্ছেন না কেন?
মায়ার বন্ধন একটু আলগা করার চেষ্টা করছি।
বুঝিয়ে বলুন মশাই।
আমি এসেনশিয়ালি একজন ফ্যামিলিম্যান। ছেলেবউ এদের নিয়ে জড়িয়ে জেবড়ে থাকতে ভালবাসি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই অত্যধিক মায়ার বন্ধনটা পৌরুষের পক্ষে ক্ষতিদায়ক। আমার ইদানীং হোমসিকনেসটাও বেড়ে গিয়েছিল খুব। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে তর সইত না। তাই ভাবছি আরও দু-চার দিন ফ্যামিলি থেকে একটু তফাত থাকি।
এ কি গীতা পাঠের ফল নাকি?
ঘোষাল হাসল, তাও বলতে পারেন, অ্যাকচুয়ালি তাই।
ভাল। কিন্তু তার চেয়েও ভাল কাজেকর্মে নেমে পড়া। কর্মের মতো মুক্তির পথ আর নেই।
তা বটে। সেটাও ভাবছি। আপনার কেসটার খবর কী?
সেই সেনগুপ্ত মার্ডার কেস?
হ্যাঁ। কিন্তু কাগজে তো দিচ্ছে না কিছু।
কাগজে দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়। সূক্ষ্ম ব্যাপার, রগরগে ঘটনা তো নয়। এখনও খুবই গোপন তদন্ত চলছে।
কেন?
শবর একটু হাসল, কারণ আছে। এ কেসটা থেকে কী বেরোয় তা আমিও জানি না।
ফ্যাক্টসগুলো আমাকে বলুন না। খানিকটা শুনেছি। বাকিটাও শুনি। একটা জিগস পাজল খেলি।
শুনবেন?
হ্যাঁ। বলুন।
শবর গোটা ঘটনাটা বলল। প্রায় কিছুই বাদ দিল না। খুব মন দিয়ে শুনল ঘোষাল।
শোনার পর ঘোষাল হঠাৎ বলল, রীণা বোসকে ফোনটা কে করছে বলে মনে হয়?
শবর একটু হাসল, আপনিই বলুন।
ঘোষাল একটু হাসল। বলল, ডিডাকশন করলে যা দাঁড়ায় তাতে একজনই হতে পারে। লাভ-হেট রিলেশনে যে লোকটা বরাবর.দু’ভাগ হয়ে ছিল। কখনও ভালবেসে, কখনও ঘেন্না করে। দুটোই তীব্রভাবে করে। লোকটা শঙ্কর বসু।
এই তো মস্তিস্ক চমৎকার কাজ করছে!
শঙ্কর বসুর অ্যালিবাই আছে?
না, কারও কোনও ফুলপ্রুফ অ্যালিবাই নেই।
ছেলেটা?
তারও নেই। মাণ্ডবী বলে তার একটি ফুটফুটে বান্ধবী আছে। শি উইল ভাউচ ফর হিম।
ঘোষাল একটু হাসল, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ইউ নো সামথিং। অ্যালিবাই নেই বলে নিশ্চিন্ত থাকতেন না, ক্র্যাকডাউন করতেন। আপনার লাইন অফ অ্যাকশন আমি জানি।
শবরের মুখ থেকে হাসিহাসি ভাবটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। চুপ করে একটু ভাবল সে। তারপর বলল, লোক দুটো কে হতে পারে বলুন তো।
কোন দুটো লোক?
যারা লিফট সারানোর নাম করে বাসুদেব সেনগুপ্তকে সিঁড়ি ভাঙতে বাধ্য করেছিল।
ঘোষাল মিটিমিটি একটু হেসে বলল, আপনি ইচ্ছে করলেই তাদের খুঁজে বের করতে পারেন।
কী করে বুঝলেন?
আপনার মুখ দেখে। আপনি তেমন চিন্তিত নন। কেন নন মিস্টার দাশগুপ্ত?
শবর একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, ঘোষালবাবু, ইউ আর এ ভেরি কানিং কপ। কেন যে অমন গুটিয়ে গিয়েছিলেন।
বললাম তো, মায়া। মায়া থেকে স্নায়ুদৌর্বল্য। স্নায়ুদৌর্বল্য থেকে ত্রাস। ত্রাস থেকে কর্মনাশ।
দু’জনেই হাসল।
শবর বলল, এখন কী মনে হচ্ছে?
নিজেকে সবসময়েই বলছি, ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্বিষ্ঠ পরন্তপ।
আপনার ছেলেটা আপনার খুব ন্যাওটা, না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ভাবছি, আমার ছেলে বলি বটে, কিন্তু ও তো আমার ক্রিয়েশন নয়। আমার ভিতর দিয়ে সৃষ্ট হয়েছে মাত্র, আমি সৃষ্টি করিনি। আসলে ও কার
ছেলে শবরবাবু? আমরা কার ছেলে?
শবর হাসল, গীতা পড়ে তো বিপদ করলেন মশাই! এ যে তীব্র বৈরাগ্য। ঘোষাল মাথা নেড়ে বলল, সিরিয়াসলি বলছি, বড্ড মায়ায় মাখামাখি হয়ে আছি যে। সত্যটা কী বলুন তো!