৮. লাল হেলমেটটা যেখানে ছিল

লাল হেলমেটটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই পড়ে আছে। একটু উঁচু ঢিবির ওপরে। জায়গাটা খুব সুনসান, নির্জন। চারদিকে ভয়ঙ্কর আগাছা দিয়ে ঘেরা। এখানকার বাঘা বিছুটির খুব বদনাম, তার ওপর বাবলার ঝোঁপঝাড়ও বেশ ঘন। এদিকপানে তাই কেউ আসে না।

ভুতো একটু দূর থেকে একটা গাছের ডালে উঠে হেলমেটটা দেখতে পেল। কিন্তু সেটা উদ্ধার করা যায় কীভাবে তা তার মাথায় এল না। উদ্ধার করার কাজটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। তার ওর ওটা হচ্ছে ভূতের সর্দারের সিংহাসন। উদ্ধার করতে গেলে কোন্ বিপত্তি ঘটে কে জানে। উদ্ধার না করলেও নয়। পরিদের দেশ থেকে ওইরকমই হুকুম পেয়েছে সে।

যে গাছটায় উঠেছে ভুতো সেটা একটা পুরনো শিশু গাছ। বেশ ঝুপসি। মেলা পাখির বাসা আছে। আর বাবুইয়ের বাসার মতো কীসব যেন ঝুলছেও ডাল থেকে। অথচ ঠিক বাবুইয়ের বাসাও নয়।

ভুতোর মাথার ওপরেই একটা ঝুলে আছে। ভুতো হাত পাড়িয়ে সেটা একটু ছুঁয়ে দেখল। কিছু বুঝতে পারল না। ধরে একটু টানাটানিও করল সে।

আচমকাই জিনিসটা ডাল থেকে খসে পট করে নীচে পড়ে গেল। আর তারপরই ধোঁয়ার মতো একটা বস্তুকে দেখা গেল নীচে। পাক খেয়ে ওপরে উঠে আসছে।

কিছু বোঝবার আগেই মাথায় খটাং করে একটা গাট্টা লাগল। ভুতো “বাবা রে” বলে এক হাতে মাথাটা চেপে ধরল। কিন্তু পর-পর আরও গোটাকয় রাম গাঁট্টা এসে জমল মাথায়।

গাঁট্টার চোটে হাত ফসকে নীচে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল ভুতোর। সে তাড়াতাড়ি নামবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু গাঁট্টা সমানেই চলছে। কে যে গাঁট্টা মারছে তা দেখা যাচ্ছে না।

গাঁট্টার চোটে অস্থির ভুতো চেঁচিয়ে উঠল, “কে রে তুই, পাজি হতচ্ছাড়া?”

কানের ওপর আর একটা গাঁট্টা এসে পড়ল, সেই সঙ্গে শোনা গেল একটা হেঁড়ে গলা, “আমি কে সেটা জানতে চাস? কেন, টের পাচ্ছিস না?”

ভুতো চেঁচিয়ে বলল, “ওঃ ভুতুড়ে গাঁট্টা মেরে খুব কেরানি দেখানো হচ্ছে? সাহস থাকলে সামনে আয় না। আমিও গাঁট্টা মারতে জানি।”

কথা শুনে কে যেন খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠল, “বটে! তুইও গাঁট্টা মারবি? জানিস, আমার মতো গাঁট্টার ওস্তাদ ভূ-ভারতে নেই! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আদর করে আমার কী নাম দিয়েছিল জানিস? গেঁটে বাঁটুল।”

ভুতো বলল, “ওঃ, তুমি তো তা হলে পুরনো ভূত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তো আর আজকের লোক নন।”

“তা তো বটেই। তোর ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদারও অনেক বড়। গাঁট্টা মেরে লোককে ঢিট করতুম বলে মহারাজ আমাকে তাঁর সভায় চাকরি দিয়েছিলেন।”

“বটে?”

“বটেই রে। তবে কিনা লোকে ভারতচন্দ্র আর গোপালভাঁড়ের কথাই জানে, আমাকে কেউ চেনে না।”

গাঁট্টা থেমেছে। ভুতো মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতেও বলল, “তুমি গোপালভাঁড় আর ভারতচন্দ্রকে দেখেছ?”

“দেখব না মানে? রোজ দু’বেলা দেখা হত। কত গল্প হত, হাসিঠাট্টা হত।”

“তোমার গাঁট্টার বেশ জোর আছে বলতেই হবে। তবে কী জানো বাঁটুলদা, তুমি যে এখানে আছ, তা তো আমি জানতুম না।”

হেঁড়ে গলাটা এবার একটু নরম হল, “খুব লেগেছে নাকি তোর? তা কী করব বল। কয়েকশো বছর ধরে গুটি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছি। আরও হাজারখানেক বছরের আগে জাগবার ইচ্ছেই ছিল না। কাঁচা ঘুমটা ভাঙালি বলে চট করে মেজাজটা চড়ে গেল।”

“আমি ভেবেছিলুম বাবুইয়ের বাসা।”

বাঁটুল আর একটু নরম হয়ে বলল, “ঠিক আছে, গাঁট্টার যখন প্রশংসা করেছিস, তখন তোর কিছু উপকারও করব। বল, কী করলে তুই খুশি হোস!”

ভুতো হাতে চাঁদ পেল। একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বলল, “ওই যে ওখানে একটা লালমতো হেলমেট পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছ?”

“খুব পাচ্ছি।”

“ওইটে আমার চাই।”

“এই কথা! দাঁড়া এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।”

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। তারপরই দেখা গেল লাল হেলমেটটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে ভুতোর একেবারে হাতের নাগালে এসে গেছে।

ভুতো ইতিমধ্যেই মাটিতে নেমে দাঁড়িয়েছে। হেলমেটটা আঁকড়ে ধরে বলল, “বাঁটুলদা, বড্ড উপকার করলে আমার।”

বাঁটুল একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ রে ছোঁড়া, ওই হেলমেটটা তুই চাইলি কেন বল তো! জিনিসটা তো ভীষণ বিচ্ছিরি। ওটা কেউ মাথায় পরে নিলে যে আমার গাঁট্টাতে কোনও কাজই হবে না। পেল্লায় শক্ত।”

“এসব তোমার আমলে ছিল না কিনা।”

বাঁটুল গম্ভীর হয়ে বলল, “থাকলে খুব খারাপ হত। আমাকে আর গাঁট্টার কারবার করে খেতে হত না।”

“তুমি গাঁট্টা মেরে খেতে?”

“তা খেতুম না? কৃষ্ণচন্দ্রের চাকরিতে ঢোকার আগে তো যত চোর-জোচ্চোর ডাকাতকে গাঁট্টা দিয়ে ঢিট করেছি। গাঁয়ে খুব খাতির হত তখন। বিনে পয়সায় কলাটা-মুলোটা জুটত। তা তোদের আমলে কি সবাই ওই টুপি পরে থাকে নাকি?”

“না, না, তোমার ভয় নেই।”

“তোরও ভয় নেই। আমি তোকে আর গাঁট্টা মারব না। ওটা পরে আসার দরকার নেই। যাই, আমি ঘুমোই গে।”

বাঁটুল ঘুমোতে যাওয়ার পর ভুতো হেলমেট বগলে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। মনে হাজার চিন্তা।

বাড়ি এসে হেলমেটটা লুকিয়ে রাখল ঘরে। তারপর চারপাশ উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে এল। দুলালবাবু পেল্লায় ভোজের পর নরম বিছানায় লেপ গায়ে ঘুমোচ্ছেন। তাঁর শাগরেদ পাঁচু মোদককে দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাওয়ার কথাও নয়। গাছের মগডাল থেকে নামতে সময় লাগবে।

ভুতো ঘরের দরজা বন্ধ করে তার কৌটো বের করল।

“শুনতে পাচ্ছ?”

কৌটোর ভেতর দিয়ে বহু দূরের এক জগৎ থেকে পরিদের গলা ভেসে এল।

“কী চাও ভুতো?”

“আমি হেলমেটটা উদ্ধার করেছি।”

“বেশ ভাল কাজ।”

“এটা দিয়ে এখন আমি কী করব?”

“এখন তোমাদের ওখানে কী দুপুর?”

“হ্যাঁ। তবে শেষ দুপুর।”

“তা হলে এখন নয়। রাত যখন গম্ভীর হবে তখন হেলমেটের ভেতরে নীল বোতামটা টিপে দাও। তারপর ওটা পরে নিও মাথায়।”

“তা হলে কী হবে?”

“হেলমেটটা সামান্য জিনিস ভেবো না। ওটা হল অতি-মস্তিষ্ক। তোমার জানা নেই এমন অনেক কিছু তোমাকে জানিয়ে দেবে।”

“ভূতের সদার এটাকে সিংহাসন বানিয়েছিল। তারা যদি এসে হেলমেট কেড়ে নিতে চায়?”

“তা হলে হেলমেটের ভেতরকার সাদা বোতামটা টিপে রাখো।”

“তা হলে কী হবে?”

“হোমেটের রং আর গন্ধ বদলে যাবে। ভূতেরা দেখলেও চিনতে পারবে না।”

“আমাদের বাড়িতে দুটো লোক খারাপমতলব নিয়ে ঢুকেছে। তাদের কী করব?”

“হেলমেটই তোমাকে বুদ্ধি জোগাবে। তবে ওটা বেশি ব্যবহার করো না।”

“কেন?”

“সুপার ব্রেন যত বেশি ব্যবহার করবে, তত তোমার নিজের মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে যাবে।”

“ও বাবা।”

“একবার-দু’বার ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বেশি। নয়। মানুষেরা কত বেশি যন্ত্র ব্যবহার করে।”

“একবার-দু’বার ব্যবহারের পর কী করব এটা নিয়ে?”

“যেখান থেকে এনেছ আবার সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। ওটা ভূতের সিংহাসন হয়েই থাকুক।”

“এটা কে পৃথিবীতে ফেলে গেল?”

“সেটা জেনে তোমার লাভ নেই। যে ফেলে গেছে, তার কোনও উদ্দেশ্য আছে। এরকম অনেক জিনিসই পৃথিবীতে তারা ফেলে রেখেছে নানা জায়গায়।”

“ওগুলো দিয়ে কী হবে?”

“ওগুলো যদি কেউ কাজে লাগাতে পারে তো তার অনেক কাজ হবে। যে কাজে লাগাতে পারবে না তার হবে না। ওটাই তো মজা। তোমাদের নন্দবাবুও তো এই হেলমেটটা পেয়েছিলেন। কাজে লাগাতে পারেননি। ভূতের ভয়ে এটা ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।”

“তাই নাকি? কিন্তু এরকম আর কী কী জিনিস কোথায় আছে?”

“বলে লাভ নেই। ধরো, আমেরিকার এক জঙ্গলে একটা গর্তের মধ্যে আছে। একটা বল। হিমালয়ে আছে একটা পেনসিল। প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় আছে একটা বোতল। চিনে এক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পোঁতা আছে একটা প্রদীপ। আরও কত কী?”

“এসব দিয়ে কী কাজ হয়?”

“বলটা আসলে শব্দধারক যন্ত্র। মহাকাশে যেখানে যতরকম শব্দহচ্ছে সবধরতে পারে। পেনসিলটা আসলে একটা অফুরন্ত ব্যাটারি। নিউ ইয়র্কের মতো বড় একটা শহরকে চিরকাল বিদ্যুৎ জোগাতে পারে। বোতলটা হল মহাকাশ-ঢিল। ওটা তুমি ইচ্ছে করলে সৌরলোকের যে-কোনও গ্রহে পাঠাতে পারো। ওটা সেখানে গিয়ে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে মাত্র কয়েক মিনিটে। প্রদীপটার কথা তুমি গল্পে পড়েছ। ওটা ঘষলেই চলে আসবে একটা মস্ত রোবট- তোমার সব হুকুম তামিল করবে।”

একটু থেমে ভুতো বলল, “আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ?”

“ঠিক তাই।”

“ইস্। প্রদীপটা যদি পেতুম।”

“পেয়ে লাভ নেই। যারা পেয়েছে তাদের জীবনের আনন্দই নষ্ট হয়ে গেছে। এইসব দেখে আমরা মজা পাই। সেইজন্যই তোমাকে সুপার ব্রেন বেশি ব্যবহার করতে বারণ করছি। ওটা বেশি ব্যবহার করলে তুমি আর নিজের মাথা খাটাতে চাইবে না। সেটা কিন্তু ভীষণ খারাপ। তোমর নিজের মস্তিষ্কও যে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সেটা তুমি বুঝতেও পারবে না কোনওদিন।”

“এবার বুঝেছি।”

“যদি বুঝে থাকে তা হলে আমাদের কথা মেনে চলো। তোমাকে আমরা খুব ভালবাসি।”

‘দুলালবাবু আর পাঁচু মোদকের কাণ্ডকারখানার কথা কি আপনি জানেন?”

না তো! তারা কারা?”

“একজন মাস্টারমশাই, আর একজন চোর?”

“তারা কী করেছে?”

“অনেক কাণ্ড। মাস্টারমশাই ভারি ভাল ভানুষ, নিরীহ, রোগা। কিন্তু হঠাৎ রাতারাতি তিনি একদম পালটে গেছেন। গায়ে ভীষণ জোর, চুরি করে বেড়াচ্ছেন। লোককে ঠকাচ্ছেন…”।

“ওটা কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন। হেলমেট ওর সমাধান বলে দেবে।”

“আচ্ছা।”

কৌটোর স্বর বিদায় নিল।

ভুতে হেলমেটটা তুলে নিয়ে ভেতরটা দেখল। সত্যিই ভেতরে অনেক রকমের বোম রয়েছে। সাদা বোতামটা টিপতেই ঝাঁ করে হেলমেটটা একদম নীল হয়ে গেল। এরকম অদ্ভুত কাণ্ড সে আর দ্যাখেনি।

.

সারাটা দুপুর কাগজ কলম নিয়ে বিস্তর ধস্তাধস্তির পর ভুবনবাবু দেড়খানা কবিতা মাত্র নামাতে পারলেন। আর তাতেই তাঁর এই শীতের দুপুরেও ঘাম হতে লাগল। মাথাটাও বেশ বনবন করে ঘুরছে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে রামলালকে ডেকে পাঠালেন।

রামলাল এলে বললেন, “ওহে রামলাল, তোমার প্রেডাকশন কেমন হচ্ছে?”

রামলাল মাথা চুলকোতে লাগলেন। ভুবনবাবুকে যথেষ্টই ভয় খান রামলাল। কিন্তু সেই ভয়ের চোটেও তাঁর মাথা থেকে কবিতা বেরোচ্ছে না, আমতা-আমতা করে বললেন, “আজ্ঞে, এখনও তেমন জুত করে উঠতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি।”

ভুবনবাবু একটু বিরস মুখে বললেন, “প্রথমটায় হয়তো একটু অসুবিধে হবে। তা সেটা ইয়ে, আমারও হচ্ছে। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে তো হবে না। লোকটাকে আমি সাতদিন আমাদের বাড়িতে থাকতে বলেছি।”

রামলাল চোখ বড় করে আতঙ্কের গলায় বললেন, “সাতদিন!”

ভুবনবাবু বললেন “থাকতে কি চায়! কেবল বলে, মশাই, আমরা কবি খুঁজতে বেরিয়েছি, সঙ্গে মেলা টাকা। এক জায়গায় থাকার হুকুম নেই। আমি অতি কষ্টে রাজি করিয়েছি। এই সাতদিনে যদি শতখানেক কবিতাও ওঁর হাতে তুলে দেওয়া যায়, তা হলে খুব কম হবে না। দু’শো টাকা দরে প্রায় বিশ হাজার টাকা।”

‘‘তা বটে।”

“কিন্তু প্রেডাকশনটা তো বাড়াতে হচ্ছে। এই রেটে চললে সাতদিনে একশো কবিতা সাপ্লাই দেওয়া যাবে না। তোমার মাথায় কবিতা খেলছে না কেন বলো তো?”

“আজ্ঞে, মাথাটা কোনও দিকেই ভাল খেলে না।”

ভুবনবাবু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আত্মবিশ্বাসের অভাবই অনেক মানুষের পতনের কারণ। নিজের ওপর আস্থা চাই। নইলে ভারি মুশকিল। লোকটার কাছে আমার মান-ইজ্জত থাকবে না। যাও, আর সময় নষ্ট না করে বসে পড়োগে। আর হ্যাঁ, একটা কথা।”

“যে আজ্ঞে, বলুন।”

“কলমের সঙ্গে কী মেশানো যায় বলো তো।”

“কলম? আজ্ঞে, এ তো সোজা মলম।”

“মলম! কিন্তু মলম আসছে কোত্থেকে? বাণী বিদ্যাদায়িনীর পদস্পর্শে পবিত্র কলম, নিঝরের স্বপ্নভঙ্গে জাগিয়েছে … না হে, মলম এখানে লাগানোই যাবে না। আর কিছু মনে আসছে না?”

রামলাল সবেগে মাথা চুলকোতে লাগলেন, “কলম! কলম! ইয়ে, খড়মটা অনেক কাছাকাছি আসছে।”

“খড়ম! খড়মই বা লাগাই কী করে? অন্য কিছু ভাবো তো!”

“খড়ম যদি সুবিধের না হয়, তা হলে বড্ড মুশকিল হবে।”

‘মুশকিল মনে করলেই মুশকিল। আত্মবিশ্বাসের অভাবটাকে অত প্রশ্রয় দাও কেন? সব-সময়ে বুক চিতিয়ে ভাববে, সব হবে। যাও, বাংলা ডিকশনারিটা খুলে কলমের সঙ্গে একটা জুতসই মেলানো শব্দ বের করো। কবিতাটা ওই একটা শব্দে আটকে আছে। আমি যাই, দেখি গে, ভ ভদ্রলোকদের চা-টায়ের বন্দোবস্ত হয়েছে কি না। মানী লোক এঁরা, অযত্ন হওয়াটা ঠিক হবে না।”

“যে আজ্ঞে” বলে রামলাল ব্যাজার মুখে অভিধান খুলে বসলেন।

ভুবনবাবু ঘর থেকে বেরোতেই একটা ন্যাড়া মাথা গোঁফওয়ালা লোককে দেখে অবাক হলেন। লোক্টা বিগলিত মুখে দাঁড়িয়ে।

“কী চাই?”

“প্রতি মিল দু’টাকা করে যদি দেন তো কলম-টলম সব মিলিয়ে দেব। ও নিয়ে আর ভাবতে হবে না।”

“আপনি কে?”

“আজ্ঞে, আমি একারবারই করি। মিল বেচি, ছন্দ বেচি, কবিতাও বেচি। তবে গোটা কবিতার দাম কিছু বেশি পড়বে। চতুর্দশপদী, হাইকু, দীর্ঘ কবিতা, ছড়া কাহিনী কাব্য, মহাকাব্য সব আছে। ফলো কড়ি, মাখো তেল।”

ভুবনবাবু বুকটা একটু চিতিয়ে বললেন, “এ যে মায়ের কাছে মাসির গল্প হয়ে যাচ্ছে মশাই। আমাকে আর কবিতা শেখাতে হবে না। আমার মধ্যে কবিতার সমুদ্র রয়েছে। তবে ইয়ে, ওই মাঝে-মাঝে মিলটিল নিয়ে একটু ভাবতে হয় আর কি। তা মিল কত করে বললেন?”

দু’টাকা। খুবই শস্তা। জলের দর। বছরের এই সময়টায়, অর্থাৎ বসন্তকালে আমরা একটা সেল দিই তো। নইলে তিন টাকার একটি পয়সা কম হত না।”

“বটে! তা কলমের সঙ্গে কী মেলানো যায় বলুন তো?”

“ও-নিয়ে ভাববেন না। আমরা হিমালয়ের সঙ্গে মেলাচ্ছি, তুচ্ছ কলম আর এমন কী! টাকাটা ফেলুন আগে।”

ভুবনবাবু বিরক্ত মুখে দু’টো টাকা লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, “এবার বলুন।”

লোকটা ভারি বিগলিত হয়ে বলল, “বছরের চুক্তি করে নিলে কিন্তু আরও শস্তা হয়ে যাবে। এই ধরুন দেড়-টাকার মতো। আর মিলও পাবেন জব্বর।”

ভুবনবাবু হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “কিন্তু কলমের সঙ্গে মেলানো শব্দটার কী হলো?”

লোকটা বিগলিত মুখেই বলল, “আজ্ঞে, বলম বলম বাহু বলম।”

“তার মানে?”

“কলমের সঙ্গে মেলালেই বুঝবেন কী জিনিস। কবিতার লাইনে ফেলে দেখুন।”

ভুবনবাবু আপনমনে কিছুক্ষণ বাহু বলম, বাহু বলম, করলেন। তারপর লোকটাকে একেবারে জাপটে ধরে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে বলে উঠলেন, “তাই তো হে, তোমার তো দারুণ মাথা! মিলে গেছে, এক্কেবারে মিলে গেছে।”

লোকটা ভুবনবাবুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “আমাদের সাবেক কারবার, আজেবাজে জিনিস দিই না কিনা। তা বাবু, শুনতে পাচ্ছি, এখানে নাকি কবিতা কেনার লোক ঘুরঘুর করছে! সত্যি, নাকি?”

ভুবনবাবু লোকটার দিকে সন্দিহান চোখে চেয়ে বললেন, “সে খবরে তোমার কী দরকার?

“আজ্ঞে, আমার প্রায় চার বস্তা কবিতা পড়ে আছে। বাজারটা মন্দা ছিল বলে এতদিন ছাড়িনি। তা ভাল দর পেলে ভাবছি ছেড়ে দেব।”

ভুবনবাবু লোকটার কাঁধে হাত রেখে ভারি নরম গলায় বললেন, “আহা, কবিতা কেনার জন্য তো আমিই আছি। একটু সুবিধে করে যদি দাও তো ওই চার বস্তাই কিনে নেব’খন।”

লোকটা ভারি খুশি হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমারও খুচরো বিক্রি পোষাবে। চার বস্তা নিলে ওই পাইকারি দরেই পাবেন। কিছু আগাম পেলে একেবারে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এনে ফেলব।”

“হবে’খন। তোমাকে বাপু আর কবিতার দালাল খুঁজতে হবে না। কাল সকালের দিকে চলে এসো।”

“আজ্ঞে আগামটা?”

“এই পঞ্চাশটা টাকা রাখো। বাকিটা একেবারে নগদা-নগদি।”

“দরটা জানলেন না? গোনা বাছা না করলে পাঁচশো টাকা প্রতি বস্তা। আর যদি গোনা বাছা করেন তা হলে কিন্তু দর ছ’শো হয়ে যাবে।”

“ওরে বাবা, গোনা বাছার কথাই ওঠে না। তুমি কি আর আমাকে ঠকাবে?

আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালবাসি।”

লোকটা পায়ের ধুলো নিয়ে বিদেয় হল।

ভুবনবাবু হাসি-হাসি মুখে গিয়ে কবিতার পাইকারের ঘরে উঁকি দিলেন, “উঠেছেন নাকি আজ্ঞে?”

লোকটা একটা হাই তুলে পাশ ফিরে বলল, “উঠেছি। তবে যা খাইয়েছেন তাতে আরও ঘুমনো যেত।”

“এবার একটু যদি চা ইচ্ছে করেন।”

“চা! আমার আবার খালি পেটে চা চলে না।”

“খালি পেটে! বলেন কী? খালি পেটে চা খাওয়ানোও যে পাপ! এক্ষুনি ব্যবস্থা হচ্ছে। তা লুচি-টুচি চলবে তো! নাকি কড়াইশুটির কচুরি? সঙ্গে খানকয়েক চপ টপ যদি হয়? আর ধরুন একটু ভাল রাবড়িও আনানো আছে।”

 “তা চলতে পারে। কিন্তু কবিতার কতদূর কী করলেন বলুন তো? কবিতার জন্যই তো আসা। খাওয়াটা তো বড় কথা নয়।”

“যে আজ্ঞে। কবিতার কথাই বলছি। আগে খাবারের কথাটা বলে দিয়ে আসি? বাড়ির মেয়েরা ময়দা মেখে বসে আছে।”

“যান যান, ওসব সেরে চট করে চলে আসুন।”

ভুবনবাবু শাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই ধাঁ করে ফিরে এলেন। বললেন, “হ্যাঁ, কবিতারও বেশ এগোচ্ছে। মনে হচ্ছে কাল সকালের মধ্যে হাজারখানেক কবিতা আপনার হাতে তুলে দিতে পারব।”

লোকটা অবিশ্বাসের চোখে বলল, “বলেন কী মশাই! একদিনে এক হাজার?”

“তার বেশিও হতে পারে।”

লোকটা মৃদু মৃদু মাথা নেড়ে বলল, “আপনাকে পুরুষই বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথও পারতেন না এরকম। তা সে যাই হোক। কবিতা ফেললেই একেবারে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যাব। ভাববেন না।”

ভুবনবাবু হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “যে আজ্ঞে।”

লোকটা আর-একটা হাই তুলে বলল, “আপনাদের এ-জায়গার বাতাসে কবিতার জীবাণু আছে মশাই। মনে হয় এখানে খুঁজলে আরও কবি বেরোবে।”

ভুবনবাবু বিবর্ণ মুখে বললেন, “আজ্ঞে না, এখানে কবি বলতে তো শুধু

আমি আর আমার ছেলেরা। আর তো কেউ…”

লোকটা ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু উঁহু। মানতে পারছি না মশাই। একটু আগে আমার শিয়রের জানালায় একটা লোক এসে দাঁড়াল। তার মাথাটা ন্যাড়া, বেশ জমপেশ গোঁফ আছে। বলব কী মশাই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা চারেক কবিতা আউড়ে গেল। দিব্যি কবিতা। যেমন ছন্দ, তেমনি মিল।”

ভুবনবাবু প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললেন, “ওঃ, ও তো আমারই লোক কি না।”

“তার মানে?”

“আজ্ঞে, ও আমার সব কবিতা মুখস্থ করে পাঁচজনকে শুনিয়ে বেড়ায়।”

“বটে! তাই বলুন। আমি তো কবিতা শুনে ভারি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলুম। কিনব বলে তাড়াতাড়ি উঠে মানিব্যাগ খুঁজছিলাম, সেই ফাঁকে কোথায় কেটে পড়ল।”

“আজ্ঞে, ওসব নিয়ে ভাববেন না। কাল সকালে ওসব কবিতা আমি আপনার হাতে পৌঁছে দেব।”

“তা হলে তো চমৎকার। হাজারখানেক পেলে আমাদের পত্রিকার মালিকও খুশি হবেন, আর আমাকেও বেশি ছোটাছুটি করতে হবে না। বাঁচালেন মশাই।”

ভুবনবাবু চারদিকে চেয়ে বললেন, “আপনার সঙ্গীটিকে তো দেখছি না।”

“ও একটু পাগলা লোক। কোথাও গেছে-টেছে। এসে পড়বে।”

“কিন্তু ওঁর খাবারদাবার।”

“নিয়ে আসুন। এলে খাবে, নইলে আমিই ওর ভাগেরটা খেয়ে নেব।”

“যে আজ্ঞে।”

ভুবনবাবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বেরোলেন। বেরিয়েই দেখলেন, ন্যাড়ামাথা লোকটা বারান্দায় এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

ভুবনবাবু সোজা গিয়ে লোকটাকে ঘ্যাঁচ করে ধরলেন, “আজ এক্ষুনি গিয়ে চার বস্তা কবিতা নিয়ে এসো।”

“আজ্ঞে মশাই, তার হ্যাপা আছে।”

“কত টাকা চাই?”

“দু’হাজার পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

“দিচ্ছি।” বলে ভুবনবাবু মহাব্যস্ত, তখন অন্যদিকে ল্যাবরেটরির ঘরে তিনজন গভীর পরামর্শে মগ্ন। তিনজন হল ভুতো, রামলাল আর নন্দলাল।

ভুতো পুরো কাহিনীটা বলে একটু দম নিচ্ছিল।

রামলাল ভাবিত মুখে বললেন, “তা হলে এই হল ব্যাপার।”

নন্দলালের মুখও ব্যাজার। তিনি বললেন, “সবই তো বুঝতে পারছি। কিন্তু বাবাকে ঠেকানোই সে সমস্যা। ওঁর মাথায় একবার যেটা ঢুকবে সেটাকে তো আর বের করা যাবে না।”

রামলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “দুলালবাবু এই রূপান্তর তা হলে একটা সায়েন্টিফিক অ্যাকসিডেন্ট? কিন্তু ভুতো, তোর ভূতের গল্প আমার তেমন বিশ্বাস হচ্ছে না। তোর পরির গল্পও না।”

ভুতো খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “বিশ্বাস না করতে চাইলে আর কী করব বলো। তবে কর্তাবাবু যে আকাশে উঠে গেলেন, সেটা কী করে হল তা বলবে

নন্দবাবু ভূত-ভক্ত লোক। দাদার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “তুমি দু’পাতা বিজ্ঞান পড়ে ধরাকে সরা বলে ভাবছ কেন? আর বিজ্ঞান পড়ে তোমার ক’টা ডানাই বা গজাল? বাবা তো বিজ্ঞান-টিজ্ঞান বিশেষ জানেন না, কিন্তু তোমাকে টেক্কা দিয়ে রোজ নানারকম আবিষ্কার করে ফেলতেন কী করে বলো। ভুতুড়ে কাণ্ড নয়?”

রামলাল মাথা চুলকোলেন। তারপর বললেন, “সব ব্যাপার এখনও ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু খুঁজলে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবেই। তবে বাবার আবিষ্কারের কথা যা বলছিস, তা কিন্তু ঠিক নয়। বাবা এ-যাবৎ কিছুই আবিষ্কার করেননি। তবে তাঁর সঙ্গে তো তর্ক করা যায় না, আমি ভয়ে-ভয়ে সব মেনে নিয়েছি। সে যাকগে, এখন কী করা যায় সেটাও হল চিন্তার বিষয়।”

ভুতে তার হেলমেটটা টেবিলের তলা থেকে এনে বলল, “তোমাদের কিছুই করতে হবে না। দু’জনে যেমন বসে আছে, তেমনই চুপটি করে বসে থাকো। যা করার আমি করছি।”

রামলাল আর নন্দলাল সভয়ে চেয়ে দেখলেন, ভুতো হেলমেটটার মধ্যে কী একটু কারিকুরি করে সেটা মাথায় পরে নিল, ধীরে ধীরে ভুতোর মুখশ্রী পালটে যেতে লাগল। গম্ভীর মুখ, ধ্যানমগ্ন চোখ। ফিসফিস করে মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব ফরমুলা আউড়ে যাচ্ছে।

ভাগ্য ভাল যে, ভুবনবাবুর আদেশমতো ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র এখনও সব সরিয়ে ফেলা হয়নি। দু-একদিনে তা সম্ভবও নয়।

ভুতো নানারকম কেমিক্যাল মেশাতে লাগল টেস্টটিউবে। তারপর বার্নার জ্বেলে তা গরম করতে লাগল। একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে।

খানিকক্ষণ বাদে ভুতো নন্দলালের দিকে চেয়ে বলল, “দুলালবাবুকে একবার এই ঘরে আনতে হবে। এক্ষুনি। আর তোমরা ল্যাবরেটরির বাইরে থাকবে।“

নন্দলাল আর রামলাল দু’জনেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।

কিন্তু মুশকিল হল, দুলালবাবুর মতো ষণ্ডা-গুণ্ডা লোককে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধরে ল্যাবরেটরিতে আনা যায় কীভাবে? ভুবনবাবুও হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না।

দুই ভাই তাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।

এদিকে দুলালবাবু খালি পেটে চা খাবেন না বলে কচুরি, আলুর দম এবং আনুষঙ্গিক বিশাল ভোজ নিয়ে বসে গেছেন। সামনে বিগলিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ভুবনবাবু।

দুই ভাই কঁচুমাচু ঘরে ঢুকতেই ভুবনবাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী চাই?”

নন্দলাল মাথা চুলকে হঠাৎ বলে ফেললেন, “বাড়িতে পুলিশ এসেছে।”

“পুলিশ!”

“যে আজ্ঞে। তারা ওঁকে খুঁজছে।”

ভুবনবাবু যেমন হাঁ, দুলালবাবুও তেমনই হাঁ।

ভুবনবাবু বললেন, “ওঁকে খুঁজবে কেন? উনি কী করেছেন?”

নন্দবাবুর সঙ্গে এবার রামলালও যোগ দিয়ে বললেন, “ওদের মতলব বিশেষ ভাল ঠেকছে না। বলছে, সাপ্তাহিক নবযুগ থেকে যে-লোকটা কবিতা কিনতে এসেছে, সে একজন ক্রিমিনাল।”

ভুবনবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “আর তোমরা সে কথা বিশ্বাস করলে?”

দু’ভাই একসঙ্গেই মাথা নাড়লেন। রামলাল বললেন, “আমরা পুলিশের কথায় মোটেই বিশ্বাস করিনি। বরং বলেছি, উনি এ বাড়িতে নেই। তবে আমাদের কথায় তারা কান দিচ্ছে না। বাড়িতে ঢুকে নিজেরা দেখতে চাইছে।”

“চলো, আমি গিয়েই দেখছি।” বলে ভুবনবাবু আস্তিন গোটাতে লাগলেন। তবে তার গায়ে ফুলহাতা জামা নেই, একটা ফতুয়া রয়েছে। তাই আস্তিন না পেয়ে তিনি কাল্পনিক আস্তিনই গোটালেন।

রামলাল আর নন্দলাল সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা থাকতে আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন?”

“তোমরা কী করতে চাও?”

রামলাল সবিনয়ে বললেন, “উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ বাড়িটাই শুধু খুঁজবে। ল্যাবরেটরিটা একটু তফাতে, ওটাতে যাবে না। সুতরাং আধঘণ্টার মতো ল্যাবরেটরিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলে কোনও চিন্তা নেই।”

“ল্যাবরেটরিতে যে যাবে না তা কী করে বুঝলে?”

রামলাল কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ওরা নিজের মুখেই বলল কিনা। শুধু ঘরগুলো দেখে যাবে। তাছাড়া ইদানীং ল্যাবেরেটরিতে নানা ভুতুড়ে কাণ্ড হওয়ায় ওটাকে সবাই ভয় খায়।”

দুলালবাবু নিবিষ্ট মনে খেতে-খেতে কথাগুলো শুনছিলেন। তত পাত্তা দিচ্ছিলেন। খাবার শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন ভুবনবাবু? পুলিশ-টুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না। এই তো সেদিন বাজারে মধ্যে সোনার দোকান লুঠ করতে ঢুকেছিলুম। পাঁচুর আহাম্মকিতে কাজ প্রায় কেঁচে গিয়েছিল আর কি। তারপর দারোগা এসে হাজির। এমন প্যাঁচ কষলুম যে, দারোগাবাবাজি চিতপটাং! হেঃ হেঃ, ওসব আমার কাছে নস্যি।”

ভুবনবাবু চোখ গোল থেকে গোলতর হয়ে উঠছিল। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। অস্ফুট গলায় বললেন, “বলেন কী!”

দুলালবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “এ আর এমন কী আরও যেসব কাণ্ড করেছি তা শুনলে মূর্ছা যাবেন। তবে যা-ই বলুন, এস চুরি-জোচ্চুরির লাইনটা ভারি ইন্টারেস্টিং। আর লোকজনও ভারি বোকা।”

রামলাল আর নন্দলাল পরস্পরের দিকে চেয়ে নিলেন। তারপর রামলাল গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “তা হলে যে একবার উঠতে হচ্ছে দুলালবাবু।”

দুলালবাবু চা শেষ করে উঠে বললেন, “ভুবনবাবু, আমি সারা শহর ঘুরে দেখলুম, আপনার মাথাতেই বুদ্ধিটা সবচেয়ে কম।”

“অ্যাঁ! বলেন কী?”

“আজ্ঞে, ঠিকই বলছি। আচ্ছা, গুডবাই। ভয় নেই। পুলিশ আমাকে ধরতে পারবে না।

এই বলে দুলালবাবু ঘর থেকে বেরোতে যেতেই নন্দলাল আর রামলাল দু’দিক থেকে তার দু’পায়ে ল্যাং মারলেন। ভুবনবাবু ঘরের কোণ থেকে তার লাঠিটা নিয়ে এসে দমাস করে এক ঘা কষিয়ে দিলেন দুলালবাবুর পিঠে।

দুলালবাবু যে তাতে বিশেষ কাহিল হয়েছেন তা মনে হল না। পড়ে গিয়ে এবং লাঠির ঘা খেয়েও টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে তিন রদ্দায় তিনজনকে ছিটকে দিয়ে ঘরের বাইরে এসে পড়লেন। মুখে দিব্যি হাসি-হাসি ভাব।

দুলালবাবুকে বেরোতে দেখেই পাঁচু টপ করে উঠে পড়ল। কাণ্ডখানা সেও আড়াল থেকে দেখেছে। এ বাড়িতে তাদের আর জারিজুরি খাটবে না। তারা ধরা পড়ে গেছে। তবে দুলালবাবুর যা এলেম দেখছে পাঁচু, এ-বাড়ি হাতছাড়া হলেও ক্ষতি নেই। কত বাড়ি শহরে, আছে আরও কত আহাম্মক।

পথে এসে সে দুলালবাবুর সঙ্গ ধরে ফেলে একগাল হেসে বলল, “আগেই বলেছি কিনা আপনাকে কোনও ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নেই। কবিতা নিয়ে আপনি কী কাণ্ডই না করলেন। গেল দাঁওটা ফসকে।”

দুলালবাবু মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বললেন, “একেবারে যে বুঝি না তা নয় হে, তবে কিনা আমি এলাইনে নতুন তো, সবে দাঁত উঠেছে, এখন যা দেখি তাই কামড়াতে ইচ্ছে যায়। তবে ভুবনবাবু লোকটা একেবারেই আহাম্মক। অথচ এ-লোকটাকে সবাই ভারি খাতির করে, ভয়ও খায়। কেন বলো তো!

“তা জানি না। আমি আবার সবাইকেই ভয় খাই কিনা, আলাদা করে কারও কথা বলতে পারব না।”

“তা এখন কী করা যায় বলো তো পাঁচু। বসে বসে সময় কাটানো তো আমার ধাত নয়। আমার কাজ চাই, যে কাজে বিপদ আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে, নতুনত্ব আছে।”

পাঁচু দুলালবাবুর কাঁধে হাত রেখে বলল, “সে কথাই তো ভাবছি, চলুন ডেরায় ফিরে দুজনে মিলে একটু ভেবেচিন্তে শলাপরামর্শ করে ঠিক করি। হুটহাট নানা কাণ্ড বাধিয়ে কাজ পণ্ড হচ্ছে।”

দুলালবাবু একটু গুম মেরে গেলেন। দু’জনে বাকি পথটা আর বিশেষ কথাবার্তা হল না। ভৌত ক্লাবের পাশ কাটিয়ে তারা যখন পোড়াবাড়িটার ভিতরে ঢুকলেন, তখন সন্ধে হয়ে আসছে। চারদিকে কুয়াশায় মাখা ভুতুড়ে একটা আলো। যে-কোনও মানুষের গা ছমছম করবে। তবে দুলালবাবু বা পাঁচুর সেবালাই নেই।

ঘরে ঢুকে পাঁচু তার লণ্ঠন জ্বালল। বলল, “সন্ধেবেলাটা কাজ কারবারে পক্ষে বেজায় খারাপ। এই সময়টায় একটু জিরিয়ে নিন। রাত নিশুত হলে বেরনো যাবে।”

এই বলে পাঁচু তার বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

দুলালবাবুর অবশ্য ঘুম এল না। তিনি সহজে ক্লান্ত হন না। তার ওপর শরীরটা যেন কিছু করার জন্য সর্বদাই টগবগ করছে।

দরজায় কাঁচ করে একটা শব্দ হল। তা ওরকম হয়। দরজা বলতে একটা মাত্র পাল্লা, তাও একটা কবজা ভাঙা বলে কাত হয়ে ঝুলে থাকে। সারাদিনই বাতাসে নড়ে আর কাঁচকোচ শব্দ করে।

দুলালবাবু পাঁচুর দেখাদেখি জিরনোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন, শরীরটা যেন জিরোতে চাইছে না। কাজ করতে চাইছে। পাঁচুর বয়স হয়েছে, তাকে সব সময়ে সঙ্গে টানাটা ঠিক নয়। বেচারার ভারি কষ্ট হয় বোধ হয়। দুলালবাবু ঠিক করলেন, আজ একাই বেরিয়ে পড়বেন। আর এক্ষুনিই।

ভেবেই তড়াক করে উঠে বসলেন তিনি। তারপরই ভারি অবাক হয়ে চেয়ে দেখলেন, তাঁর সামনেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। ছেলেটার মাথায় একটা সাদা হেলমেট।

দুলালবাবু হাতে হাত ঘষে ভারি আমুদে গলায় বললেন, “কাজ শিখতে চাও? তা শেখাব। চুরি-জোচ্চুরি ডাকাতি যা চাও সব শেখাতে পারি।”

ছেলেটা দু’পা কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আমি একটা ফর্মুলার অর্থ করতে পারছি না। করে দেবেন?”

দুলালবাবু হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “ফর্মুলা? সে আবার কী জিনিস?”

“আপনি একসময়ে ফর্মুলায় পণ্ডিত ছিলেন।”

দুলালবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “ছিলুম নাকি? তা হবে। ওসব আমি এখন ভুলে মেরে দিয়েছি। এখন চুরি-ডাকাতি করে বেড়াই আর তাতে ভারি আনন্দ। লোকগুলোও ভীষণ বোকা।”

‘আপনি একটু চেষ্টা করলে ফর্মুলাটার মানে কিন্তু বলতেপারবেন। দেখুন একটা চেষ্টা করে।” দুলালবাবু ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বললেন, “না, না। ওসব আমি জানি না।”

ছেলেটা করুণ মুখ করে বলল, “কিন্তু সবাই যে বলে এ-ফর্মুলার অর্থ একমাত্র দুলাল-সার ছাড়া কেউ করতে পারবে না।”

“বলে নাকি? ভারি মজার ব্যাপার তো!”

“আপনার মনে নেই সার, সেই যে ইস্কুলে পড়ানোর সময়…”

‘ইস্কুল! ও বাবা! ওসব কথা উচ্চারণও কোরো না। ইস্কুল খুব খারাপ জিনিস।”

“খারাপ কেন সার?”

“ইস্কুলে সব ভাল-ভাল কথা শেখায়। সেগুলো আসলে খুব বাজে জিনিস, তাতে কোনও মজা নেই। আসল মজা হল চুরি করা, বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলে মানুষকে বোকা বানানো, মারপিট করা। বুঝলে? ইস্কুল-টিস্কুলে কক্ষনো যাবে না।”

ছেলেটা ভারি উৎসাহ পেল যেন। একগাল হেসে বলল, “আর মাস্টারমশাইরা খুব মারেও সার। গাঁট্টা খাওয়ার ভয়ে এই দেখুন না আমি মাথায় শক্ত টুপি পরে আছি।”

“খুব বুদ্ধির কাজ করছে।” তা হবে নাকি আমার শাগরেদ? দু-চার দিনেই সব শিখিয়ে দেব। ওই পাঁচু মোদকটাকে নিয়ে কাজ হচ্ছে না। বড় কুঁড়ে, আর একটু পরিশ্রমেই ভারি হেদিয়ে পড়ে।

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “আপনার শাগরেদ হওয়া তো ভাগ্যের কথা সার।”

“তা হলে চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।”

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, “চলুন সার। যেতে-যেতে ফর্মুলাটা কি একবার শুনে নেবেন?”

“ফর্মুলা! হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি একটা ফর্মুলার কথা বলছিলে বটে। কিন্তু ওসব শক্ত আর গুরুগম্ভীর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার কী আমাদের? চুরি-ডাকাতিতে ঢের মজা।”

“সে তো জানিই। কিন্তু ফর্মুলার ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে। না গেলে অন্য কাজে মন দেব কী করে?”

দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তা অবশ্য ঠিক কথা। তা বলো শুনি।”

ছেলেটা গড়গড় করে একটা প্রায় দেড় ফুট লম্বা ফর্মুলা মুখস্থ বলে গেল।

দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “উহঁ অত তাড়াতাড়ি নয়। ভেঙেভেঙে বলো। এ তো মনে হচ্ছে অনেক উলটোপালটা জিনিস মেশানো হয়েছে। এ তো ঠিক ফর্মুলা নয়, পাগলামি। তবু আস্তে-আস্তে বলো।”

ছেলেটা এবার আস্তে-আস্তে বলতে লাগল।

দুলালবাবু মাথা নেড়ে-নেড়ে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে বললেন, “সোডিয়াম আয়োডাইড…উঁহু মিলছে না…যা বললে আর-একবার বলো তো!”

ছেলেটা ফের বলল।

দুলালবাবু একটা কাগজ আর কলম খুঁজতে লাগলেন ঘরময় বললেন, “দাঁড়াও লিখে নিই। তা না হলে বোঝা যাবে না। কিন্তু পাঁচুর ঘরে কি আর কাগজ কলম পাওয়ার জো আছে। ব্যাটা বোধ হয় লেখাপড়াই জানে না।”

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা একত্সারসাইজ বুক আর পেনসিল বের করে দিয়ে বলল, “এই যে সার, এটাতে লিখুন।”

দুলালবাবু খাতাটা সাগ্রহে নিয়ে ফর্মুলাটা লিখে ফেললেন। তারপর বিস্মিতভাবে সেটার দিকে চেয়ে বললেন, “এটার তো কোনও মানেই পাচ্ছি না। এ ফর্মুলা তোমাকে কে দিয়েছে?”

“তিনি মস্ত বড় বিজ্ঞানী।”

দুলালবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “আমাদের সময়ে তো এই ফর্মুলা ছিল না। যাই হোক, হয় এটা একটা পাগলামি, না হয় তো খুব উঁচুদরের সায়েন্স।

“উঁচুদরের বিজ্ঞানই সার। খুব উঁচুদরের।”

“ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যাল না করলে বোঝাও যাবে না। কিন্তু তার অসুবিধে আছে। এখাতে তত ভাল ল্যাবরেটরি নেই।”

“কেন সার, ভুবনবাবুর ল্যাবরেটরি তো ফাঁকা পড়ে আছে। গেলেই হয়।”

“কিন্তু ভুবনবাবু আমাকে ঢুকতে দেবেন না।”

ভুবনবাবু, রামলাল ও নন্দলাল খানিকক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে রইলেন। পরস্পরের দিকে চেয়ে তারা বাক্যহারা।

খানিকক্ষণ বাদে ভুবনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওরে রামলাল, কবিতা-টবিতা অতি যাচ্ছেতাই জিনিস। তাই না?”

“যে আজ্ঞে। কথাটা আমিও আপনাকে বলব বলব করছিলাম।”

ভুবনবাবু খুবই ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “কবিতা নিয়ে যে এতসব জোচ্চুরি হয়, তাই বা কে জানত! যাকগে, তোমাদের আর কবিতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”

রামলাল ও নন্দলাল একথা শুনে খুবই উজ্জ্বল হলেন। ঘামদিয়ে তাদের যেন জ্বর ছেড়ে গেল।

রামলাল হাসিমুখে বললেন, “যে আজ্ঞে।”

নন্দলাল বললেন, “আপনারও আর কবিতা লেখার দরকার আছে বলে মনে হয় না।”

ভুবনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “লিখলে অবশ্য বাংলা সাহিত্যের একটা উপকারই হত। কিন্তু দেখছি তা আর হওয়ার নয়। তা ইয়ে, রামলাল, তুমি কি ল্যাবরেটরিটা তুলে দিয়েছ নাকি?”

“আজ্ঞে, এখনও দিইনি। তবে দেব-দেব করছিলাম।”

“আমি বলি কি, কবিতার ভূত ঘাড় থেকে নামানোর জন্য কয়েকদিন এখন কষে বিজ্ঞানচর্চা করলে কেমন হয়? বিজ্ঞান খুব প্র্যাকটিকাল জিনিস, মাথা থেকে ভাবের ভূত একেবারে ঝেড়ে নামিয়ে দেয়।”

“যে আজ্ঞে।”

“তুমি কী বলো হে নন্দলাল?”

নন্দলালবাবু মাথা চুলকে বললেন, “বিজ্ঞানে আমার তেমন শ্রদ্ধা নেই।”

ভুবনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “বলো কী হে! শ্রদ্ধা নেই! এটা যে বিজ্ঞানেরই যুগ তা জানো?”

“আজ্ঞে জানি। তবে বিজ্ঞান তো ভগবান মানে না, ভুত বিশ্বাস করে না। সেইজন্যেই বিজ্ঞানের ওপর আমার আস্থা নেই।”

ভুবনবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তা হলে তো তোমার আরও বেশি বিজ্ঞান চচা করা উচিত। তুমি ভগবান মানো, ভূতে বিশ্বাস করো, ভাল কথা। সেগুলোকে বিজ্ঞান দিয়েই যদি প্রমাণ করতে পারো, তা হলে সকলেরই উপকার হয়। ধরো, এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করলে যা দিয়ে ভগবানের সঙ্গে কথা বলা যায়, তা হলে কেমন হয়? ধরো যদি ভূতকে ঘরে টেস্টটিউবে বন্ধ করে পাঁচজনকে দেখিয়ে দিলে, তা হলে তো একটা নামও হয়।”

“যে আজ্ঞে। তবে কি কাজটা ভারি শক্ত।”

“আহা, শক্ত মনে করলেই শক্ত। কাজে নেমে পড়লে আর শক্তটা কী? আমি যে ভৌত-চশমা বের করেছি, সেটাও পরীক্ষা করে দেখতে পারো। চমৎকার জিনিস। চোখে দিলেই দেখবে চারিদিক ভূতে একেবারে থিকথিক করছে।”

“যে আজ্ঞে।”

“তা হলে চলো সবাই মিলে আজ বিজ্ঞানের একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলি। আমার মাথার মধ্যে এখনও কবিতার পোকা নড়াচড়া করছে। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। এখন বিজ্ঞান নিয়ে না পড়লে পোকাটাকে জব্দ করা যাবে না।”

কাঁচুমাচু মুখে দুই ভাই অগত্যা ভুবনবাবুর পিছুপিছু ল্যাবরেটরির দিকে রওনা হলেন।

কিন্তু ল্যাবরেটরির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ভুবনবাবু দরজা ঠেলে বললেন, “কে আবার ঢুকল এর মধ্যে?”

রামাল তাড়াতাড়ি বললেন, “আজ্ঞে ভুতো।”

“ভুতো! তার ঘাড়ে আবার বিজ্ঞান ভর করল কবে? ভুতো! অ্যাই ভুতো!”

কিন্তু ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভুবনবাবু বাক্যহারা হয়ে গেলেন। যা দেখলেন, তা প্রত্যয় হয় না।

অনেকক্ষণ বাদে ফিসফিস করে বললেন, “সর্বনাশ!”

রামলাল আর নন্দলাল শ্রদ্ধাভরে একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রামলাল উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “কিসের সর্বনাশ দেখলেন আজ্ঞে?”

“সেই গুণ্ডা লোকটা যে এখানেও ঢুকে পড়েছে!”

“কোন গুণ্ডা?”

“দুলালবাবু, সঙ্গে ভুতোকেও দেখা যাচ্ছে। দু’জনে কী করছে বলে তো?”

রামলাল উঁকি মেরে দেখে বললেন, “তাই তো! একটা কিছু এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে বলে মনে হয়।”

“তা হলে কী হবে? দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দাও। এসব আমার একদম ভাল ঠেকছে না।”

কিন্তু ধাক্কা আর দিতে হল না। হঠাৎ ভিতর থেকে একটা আলোর ঝলকানি আর সেইসঙ্গে বিস্ফোরণের শব্দ এল। ঘরের ভিতরটা নীলবর্ণ ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল। একটা কটু গন্ধ বেরোতে লাগল ঘর থেকে।

ভুবনবাবু বির্বণ মুখে বললেন, “এ কী?”

রামলাল চিন্তিতভাবে বললেন, “একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।“

নন্দলাল দশ হাত পিছিয়ে গিয়েছিলেন। একটু কম্পিত গলায় বললেন, “আমি আগেই বলেছিলুম কিনা যে, বিজ্ঞান খুব খারাপ জিনিস!”

তিনজন খানিকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রসলেন। ধীরে ধীরে ভিতরকার ধোঁয়াটে ভাবটা কেটে ঘরটা আবার পরিষ্কার হয়ে এল।

দরজা খুলে হেলমেট পরা ভুতো বেরিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, “দুলালবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তবে ভয় নেই।”

বনবাবু ভারি রেগে গিয়ে বললেন, “ভয় নেই মানে? বিজ্ঞান কি ছেলেখেলা নাকি? এ খুব বিপজ্জনক জিনিস। কী থেকে কী হয় তা আমার মতো পাকা সায়েন্টিস্টও সবসময় ঠাহর পাই না। চলো তো দেখি লোকটার কী হল।”

দুলালবাবু মেঝের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছেন। জ্ঞান নেই, তবে নাড়ি চলছে। শ্বাসও বইছে। মুছে চোখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ঝাঁপটা দেওয়া হল। পুরনো জুতো এনে শোঁকানো হল। চিমটি কাটা হল। কাতুকুতু এবং সুড়সুড়িও দেওয়া হল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর দুলালবাবু মিটমিট করে চাইতে লাগলেন।

ভুবনবাবু একটু ভয়ের গলায় বললেন, “ইয়ে রামলাল, দড়িটড়ি যা পাও নিয়ে এসো। লোকটা যদিও আমাদের সেই দুলালবাবু বলেই মনে হচ্ছে, তবু সাবধানের মার নেই। ভাল করে জ্ঞান ফেরার আগেই হাত-পা বেঁধে ফেলল। নইলে আবার হয়তো বিপদ ঘটাবেন।”

ভুতো মাথা নেড়ে বলল, “আমার তা মনে হয় না। দুলাল-সারের যে অসুখ হয়েছিল তা বোধ হয় সেরে গেছে।”

দুলালবাবু ভুবনবাবুকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন, তারপর হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে ভারী নিরীহ মুখে নরম গলায় বললেন, “ভালো আছেন তো?”

ভুবনবাবু একটু ভড়কে গিয়ে বললেন, “তা ভালই বলা যায়। কিন্তু আপনি কেমন আছেন?”

দুলালবাবু চারদিকে চেয়ে বললেন, “আমি বোধ হয় অসময়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। মাফ করবেন।”

সবাই বুঝতে পারছিল, সেই আগের দুলালবাবুই আবার ফিরে এসেছেন।

ভুবনবাবু একটু অভিমানের গলায় বললেন, “ইয়ে, আপনি কিন্তু আমাকে বিশেষ রকমের অপমান করেছেন।”

“অপমান!” বলে দুলালবাবু ভারি ভিতু চোখে চেয়ে রইলেন। ভুবনবাবু বললেন, “আপনি বলেছেন যে, আমি এই শহরের সবচেয়ে বোকা আর আহম্মক লোক।”

দুলালবাবু তাড়াতাড়ি নিজের কান দু হাতে চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন, “ছিঃ ছিঃ ওরকম কথা কানে শোনাও যে পাপ।”

“আমি তা হলে আহাম্মক নই?”

দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে কথাও আমি বলতে পারব না। আমি সামান্য মানুষ, বড় বড় মানুষেরা কে কেমন তার কী জানি?”

“আপনি কবিতা কেনার নাম করে আমাকে ঠকিয়েছেন। ঠিক কিনা? অনেক চুরি, মিথ্যে কথা আর ডাকাতিরও অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আছে।”

দুলালবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। মুখে বাক্য সরল না।