৮. মুখোমুখি

৮. মুখোমুখি

রিহান মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বড় একটা ট্রাকে হেলান দিয়ে একজন প্রহরী ঝিমুচ্ছিল, সে চমকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তাক করে বলল, কে? কে যায়?

রিহান হাঁটার গতি এতটুকু না কমিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমার নাম রিহান।

দাঁড়াও। দাঁড়াও না হলে গুলি করে দেব।

রিহান মুখে হাসি টেনে বলল, কেন খামোখা গুলি করে একটা বুলেট নষ্ট করবে। আমি এমন কিছু ভয়ংকর মানুষ নই।

মানুষটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে, কী বলবে বুঝতে পারে। রিহান মুখের হাসিটা ধরে রেখে বলল, এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে? আমি তো এখানেই ছিলাম। মনে নেই?

মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রি–হান? তুমি?

হ্যাঁ। তোমরা সবাই আমাকে ধরার জন্যে গিয়েছিলে খবর পেয়েছি। খুব দুঃখিত আমি ছিলাম না। খবর পেয়েই চলে এসেছি।

তুমি কেন এসেছ?

তোমাদের কাছে ধরা দিতে। রিহান দুই হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও বেঁধে ফেলো।

মানুষটি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, এক সেকেন্ড দাঁড়াও

মানুষটি তার অস্ত্র নিয়ে ভিতরে ছুটে যেতে থাকে। রিহান মুখে কৌতুকের এক ধরনের ভাব ধরে রেখে ইতস্তত পায়চারি করতে থাকে। একসময় সে এখানেই ছিল, এলাকাটা বেশ ভালো করে জানে, কোন ট্রাকে কে থাকে, কোন লরিটি কোন পরিবারের এখনো মনে আছে, ইচ্ছা করলেই কোথাও গিয়ে সে দরজায় শব্দ করে বলতে পারে, এই যে, আমি রিহান, তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।

কিন্তু সে কিছুই করল না, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণের ভিতর গ্রাউস এবং তার সাথে আরো তিন–চার জন সশস্ত্র মানুষকে দেখা গেল, মানুষগুলো দ্রুত রিহানকে ঘিরে ফেলল। গ্রাউস রিহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, রিহান!

হ্যাঁ গ্রাউস। ভালো আছ?

গ্রাউস প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, তুমি কেন এসেছ?

প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।

গ্রাউস চমকে উঠে বলল, কী বললে?

বলেছি প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে।

গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার সাহস খুব বেশি হয়েছে রিহান?

মনে হয় আগের থেকে একটু বেশি হয়েছে। মনে আছে তুমি আগেরবার যখন প্রভু ক্লডের কাছে পাঠাচ্ছিলে তখন আমি কী ভয় পেয়েছিলাম? এখন আমি নিজেই দেখা করতে চাইছি! খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভঙ্গি করে রিহান হা–হা করে হাসতে লাগল।

তুমি কেমন করে জান প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করবেন?

আমি জানি। সবাই আমাকে দেখতে চায়। তোমরা কয়েক হাজার মানুষ কি আমার খোঁজে যাও নি?

গ্রাউস কোনো কথা না বলে ক্রোধের এক ধরনের শব্দ করল। রিহান সেটা না শোনার ভান করে বলল, যদি প্রভু ক্লড দেখা করতে না চান তাকে বলো তার জন্যে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এনেছি।

কী তথ্য?

যেমন মনে কর আলোর ব্যাপারটি। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। তার গতিবেগ সেকেন্ডে তিন শ হাজার কিলোমিটার।

গ্রাউস কিছু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান সহৃদয় ভঙ্গি করে হেসে বলল, কিংবা মনে কর নিউক্লিয়ার রি–এক্টরের ব্যাপারটি। এর ভেতরে কী হয় তুমি জান? ফুয়েল রডে কী থাকে তুমি জান? নিশ্চয়ই জান না। আমি কিন্তু জানি! প্রভু ক্লডকে আমি এই তথ্যগুলো দিতে চাই। গ্রাউস, এসব ব্যাপারে তোমার কোনো কৌতূহল না থাকতে পারে, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল। কেন জান?

গ্রাউস রিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। রিহান হাসি হাসি মুখ করে বলল, প্রভু ক্লডের অনেক কৌতূহল, কারণ তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো এইসব কথা জানার কথা না। কিন্তু তুচ্ছ মানুষ হয়ে আমি এসব জেনে গেছি!

ঠিক এরকম সময়ে দেখা গেল একজন মানুষ ছুটতে ছুটতে আসছে, কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহামান্য গ্রাউস। প্রভু ক্লড এই মুহূর্তে রিহানকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।

রিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, দেখেছ গ্রাউস, আমি তোমাকে বলেছিলাম না! প্রভু ক্লড আমাকে না দেখে থাকতেই পারবেন না।

আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে তাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। রিহান তখন এগিয়ে যেতে রু করে, কোথায় যেতে হবে কীভাবে যেতে হবে সে জানে। রিহান হেঁটে যেতে যেতে বুঝতে পারে আশপাশের সব ট্রাক লরি থেকে মানুষজন বের হয়ে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যে মানুষটি ঈশ্বরের মৃত্যুদণ্ডকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর ভয় না করে সেই মৃত্যুদণ্ড নিতে নিজে থেকে ফিরে আসে তাকে নিয়ে সবার যে এক ধরনের কৌতূহল হতে পারে তাতে অবাক হবার কী আছে?

.

রিহান সোজা হয়ে প্রভু ক্লডের দিকে তাকিয়ে রইল। এই অল্প কয়েকদিনে মনে হয় প্রভু ক্লডের মুখে বয়সের একটি ছাপ পড়েছে। প্রভু ক্লড তীব্র দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হিংস্র গলায় বললেন, তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাইছ!

হ্যাঁ।

কেন?

আমি ঈশ্বরী প্রিমার খোঁজ নিতে এসেছি। তিনি কেমন আছেন জানতে এসেছি।

তুমি একজন মানুষ হয়ে ঈশ্বরীর খোঁজ নিতে এসেছ, তোমার এত বড় দুঃসাহস?

রিহান তরল গলায় বলল, আমার দুঃসাহসের জন্য ক্ষমা চাই প্রভু ক্লড। তবে আমার কারণে ঈশ্বরী প্রিমা শাস্তি পাচ্ছেন সেজন্যে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

প্রভু ক্লড কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ চোখে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিহান বলল, আমি এখন আমার শাস্তির জন্যে এসেছি। ঈশ্বরী প্রিমাকে কি তার কমিউনে ফিরে যেতে দেবেন?

সেই সিদ্ধান্ত নেব আমি।

অবশ্যই। অবশ্যই প্রভু ক্লড। রিহান কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ঈশ্বরী প্রিমা এখন কোথায় আছেন?

তোমার সেটি জানার কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি কি তা হলে অন্য একটি জিনিস জানতে পারি?

কী জানতে চাও?

আমি কেন সাধারণ মানুষ আর আপনি কেন ঈশ্বর?

প্রভু ক্লডের মুখ হঠাৎ ভয়ংকর হিংস্র হয়ে ওঠে, তিনি চিৎকার করে বললেন, বেশি দুঃসাহস দেখিও না ছেলে।

আপনি যে তথ্যটুকু পান, হঠাৎ করে সেই তথ্য যদি বন্ধ হয়ে যায় তা হলে আপনি কি সাধারণ মানুষ হয়ে যাবেন?

তুমি কী বলতে চাইছ?

আপনি যে তথ্যটুকু পান, আমরা সবাই যদি সেই তথ্য পেতে শুরু করি তা হলে কি আমরা সবাই ঈশ্বর আর ঈশ্বরী হয়ে যাব?

ভয়ংকর ক্রোধে প্রভু ক্লডের মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে, তিনি চিৎকার করে বললেন, কে আছ? নিয়ে যাও একে এই মুহূর্তে নিয়ে যাও।

প্রায় সাথে সাথে দুইজন মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে আসে। দুই পাশ থেকে তাকে দুজনে ধরে ফেলে, রিহান ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু ছাড়াতে পারল না। প্রভু ক্লড চিৎকার করে বললেন, বাইরে নিয়ে যাও একে। গুলি করে হত্যা কর সবার সামনে। এই মুহূর্তে।

মানুষ দুইজন মাথা নিচু করে বলল, আপনার যেরকম ইচ্ছে প্রভু ক্লড।

.

সবার সামনে কাউকে গুলি করে হত্যা করার জন্যে খানিকটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কমিউনে বহুদিন কাউকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় নি–ঠিক কীভাবে সেটা করা হয় সেটাও ভালো জানা নেই। রিহানের সামনেই যখন ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ঠিক তখন এক কোনা থেকে নিউক্লিয়ার রি–এক্টর থেকে এলার্মের শব্দ শোনা গেল। বিপদের মাত্রা অনুযায়ী এলার্মের শব্দের তারতম্য হয়, এই এলার্মটি সর্বোচ্চ বিপদের। মুহূর্তের মাঝে পুরো কমিউনে একটি আতঙ্কের শিহরন বয়ে গেল। ঘরের দরজা খুলে চিৎকার গ্রতে প্রতে লোকজন বের হয়ে ছোটাছুটি ক্ষ করে দেয়। গ্রাউস দুই হাত তুলে তাদের থামানোর চেষ্টা করে, বলতে থাকে, শান্ত হও। সবাই শান্ত হও। ভয় পাবার কিছু নেই। প্রভু কড এক্ষুনি সব নিয়ন্ত্রণ করে দেবেন–

সবাই তার কথা শুনতে পেল না, যারা শুনতে পেল তারাও খুব শান্ত হল বলে মনে হল। এই কমিউনে বেঁচে থাকার অংশ হিসেবে তাদেরকে এই এলার্মের শব্দগুলোর সাথে পরিচয় করানো হয়েছে।

গ্রাউস একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও। প্রভু ক্লডের নির্দেশ নিয়ে এস। এক্ষুনি যাও।

মানুষটি প্রভু ক্লডের আর. ভি. এর দিকে ছুটে যেতে থাকে। রিহান মুখে এক ধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, গ্রাউসকে ডেকে বলল, গ্রাউস! আমার একটি কথা শুনবে?

কী কথা?

যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, পালাও।

তুমি কী বলতে চাইছ?

এই এলার্মটি হচ্ছে কোর মেন্টডাউনের এলার্ম। কিছুক্ষণের মাঝে মেল্টডাউন হবে, রেডিয়েশনে কেউ বেঁচে থাকবে না।

গ্রাউস ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। প্রভু ক্লড তার সমাধান দেবেন।

দেবেন না।

কী বলতে চাইছ তুমি?

তোমাদের প্রভু ক্লড যে তথ্যের সরবরাহ পেয়ে ঈশ্বর হয়েছিলেন তার সেই সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রভু ক্লড এখন আর ঈশ্বর নেই। তিনি এখন আমাদের মতো মানুষ!

গ্রাউস অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমি এমন অনেক জিনিস জানি যেটা তোমরা কেউ জান না! আমার কথা বিশ্বাস না হলে প্রভু ক্লডের কাছে যাও। নিজের কানে শুনে এস। নিজের চোখে দেখে এস।

গ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

মানুষজন হইচই করে ছোটাছুটি করছে তার মাঝে ভয়ংকর শব্দ করে এলার্ম বাজতে থাকে, কে কী করবে বুঝতে পারছে না। ছোট বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে, অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে। গ্রাউস যে মানুষটিকে প্রভু ক্লডের কাছে পাঠিয়েছিল হঠাৎ করে দেখল সে বিবর্ণ ফ্যাকাসে মুখে ছুটতে ছুটতে আসছে। গাউসের কাছে এসে বলল, গ্রাউস!

কী হয়েছে?

প্রভু ক্লড কিছু বলছেন না—

কিছু বলছেন না মানে?

মানে কিছু বলছেন না। তার কাছে কোনো সমাধান নাই।

গ্রাউস আর্তচিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি পাগলের মতো?

আমি ঠিকই বলছি। বিশ্বাস না হলে তুমি যাও। তুমি শুনে এস।

গ্রাউস ভয়ার্ত মুখে একবার চারদিকে তাকাল, তাকে কেমন জানি অসহায় দেখায়। রিহান গলা উঁচু করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল গ্রাউস?

গাউসের চোখ–মুখ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে, সে রিহানের কাছে ছুটে এসে বলল, তুমি কিছু একটা করেছ! তুমি?।

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, আমি? আমি তুচ্ছ মানুষ ঈশ্বরের কাজে বাধা দেব? কী বলছ তুমি গ্রাউস?

মানুষ ছুটোছুটি করে গ্রাউসের কাছে ছুটে আসতে থাকে, দেখতে দেখতে সবাই তাকে ঘিরে ফেলে, ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, আমরা কী করব গ্রাউস? এখন আমরা কী করব?

গ্রাউস আমতা–আমতা করে বলল, আমি জানি না

কী বলছ তুমি জান না? প্রভু ক্লড কী বলেছেন?

প্রভু ক্লডও জানেন না।

গ্রাউসকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছোট একটা বাচ্চাকে শক্ত করে বুকে ধরে রাখা মা ভয় পাওয়া গলায় বলল, তা হলে কে জানে?

রিহান গলা উঁচু করে বলল, আমি জানি।

একসাথে সবাই তার দিকে ঘুরে তাকাল। রিহান বলল, হ্যাঁ, আমি জানি। এই এলার্ম সর্বোচ্চ বিপদের এলার্ম। এর অর্থ নিউক্লিয়ার রি-একটরের কোর গলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই অচিন্তনীয় পরিমাণ রেডিয়েশন বের হবে। তোমরা অর্ধেক মানুষ সাথে সাথে মারা যাবে, বাকি অর্ধেক মারা যাবে আগামী তিন মাসের মাঝে। তারপরেও যারা বেঁচে থাকবে, তারা ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মারা যাবে।

কয়েকজন চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমরা কী করব?

তোমরা পালাও।

পালাব?

হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ট্রাকে উঠে পালাও। বাতাসের বিপরীত দিকে পালাও, কারণ কোর মেন্টডাউন হলে বাতাসে রেডিয়েশন ভেসে আসতে পারে!

একজন ভয়ার্ত মুখে বলল, কিন্তু প্রভু ক্লডের আদেশ ছাড়া আমরা পালাব?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল, তোমাদের প্রভু ক্লডও তোমাদের সাথে পালাবেন। তিনি আর ঈশ্বর নন, তিনি এখন সাধারণ মানুষ! সত্যি কথা বলতে কী সাধারণ মানুষ তবু কোনো না কোনো কাজে লাগে, একজন ঈশ্বর যখন সাধারণ মানুষ হয়ে যায় সে কোনো কাজে আসে না

উপস্থিত মানুষজন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে রিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন কাঁপা গলায় বলল, তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। তোমাদের প্রভু ক্লড যে তথ্য দিয়ে ঈশ্বর হয়েছিল, সেই তথ্য তার কাছে আর আসছে না। তার কাছে আর কখনো আসবে না।

কিন্তু–কিন্তু তুমি কেমন করে জান?

বেঁচে থাকলে আমরা সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাব, এখন পালাও। দেরি কোরো না!

জরুরি এলার্মটা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে শুরু করেছে। শব্দের সাথে সাথে লাল আলো জ্বলতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে পুরো পরিবেশটা ভয়ংকর হয়ে উঠল। রিহান দেখতে পেল তার কথা শুনে ট্রাকে করে মানুষজন পালাতে শুরু করেছে। একটি ট্রাককে চলে যেতে দেখে সবাই ছুটোছুটি করে অন্য ট্রাকে উঠতে রু করেছে। দেখতে দেখতে পুরো এলাকাটি ফাঁকা হয়ে যেতে শুরু করে, শুধু ভয়ংকর এলার্মটি তীক্ষ্ণ কর্কশ শব্দ করে বাজতে থাকে।

যে দুজন মানুষ রিহানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করার জন্যে এনেছিল তাদেরকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, তারা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। রিহান তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা পালাবে না?

তোমাকে কী করব?

প্রভু ক্লড গুলি করে মারতে বলেছে, গুলি করে মার।

মানুষ দুজন একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল, এর আগে তারা কখনো কাউকে এত সহজে নিজেকে গুলি করার কথা বলতে শোনে নি। রিহান চোখ মটকে বলল, যেটা করতে চাও, তাড়াতাড়ি কর।

কেন?

রিহান হা–হা করে হেসে বলল তোমরা যে প্রভু ক্লডের ওপর ভরসা করে আছ ঐ যে তাকিয়ে দেখ সেও তোমাদের ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে!

মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি আতঙ্কিত প্রভু ক্লড তার আর. ভি. থেকে বের হয়ে এসেছেন, কী করবেন বুঝতে না পেরে খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছেন।

রিহান বলল, আমাকে মারার অনেক সুযোগ পাবে। যাও, আগে এই বুড়ো মানুষটাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য কর। ধরে কোনো একটা ট্রাকে তুলে দাও।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাত বদল করে বলল, কিন্তু তুমি

আমি যদি তুমি হতাম তা হলে আমাকে ঘাটাতাম না! কারণ কী জান?

কী?

তোমার প্রভু ক্লড আর কোনোদিন তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না। যে তথ্য দিয়ে সে তোমাদের সাহায্য করত সেই তথ্য বন্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু আমি এখনো তোমাদের সাহায্য করতে পারব। শুধু আমি জানি কেমন করে এই নিউক্লিয়ার রি-এক্টর রক্ষা করা যায়।

মানুষগুলো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান নিচু গলায় বলল, আর দেরি কোরো না, যা করার তাড়াতাড়ি কর। কিছুক্ষণের মাঝে রেড এলার্ট শুরু হয়ে যাবে, তখন আর কিছু করা যাবে না।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মানুষ দুটো নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলল, তারপর এগিয়ে এসে রিহানকে খুলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমরা তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।

চমৎকার। তোমাদের ধন্যবাদ।

তুমি চেষ্টা করে দেখো রি-একটর মেন্টডাউন বন্ধ করতে পার কি না!

দেখব। তোমরা এখন পালাও।

রিহান কিছুক্ষণের মাঝেই দুটো শক্তিশালী মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পায়। মানুষ দুটো এই কমিউন ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুভয় খুব বড় ভয়।

.

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে প্রভু ক্লডের বাসভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুরো কমিউনের সবাই সরে গেছে এখানে এখন আছে শুধু রিহান এবং প্রিমা। প্রিমাকে খুঁজে বের করতে হবে, সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে অধীর হয়ে আছে।

রিহান যখন প্রিমার হাত এবং পায়ের শেকল খুলছে তখন নিউক্লিয়ার রি–এক্টরের কোর মেন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে, রেড এলার্ট হিসেবে ভয়ংকর সাইরেন বাজছে, ভয়ংকর। রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়তে রু করেছে। প্রিমা ভয়ার্ত গলায় রিহানের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, আমাদের কী হবে রিহান?

রিহান হেসে বলল, কিছু হবে না।

কোর মেল্টডাউন হচ্ছে, রেডিয়েশনে মারা যাব আমরা।

না, আমরা মারা যাব না।

প্রিমা অবাক হয়ে বলল, কেন মারা যাব না

কারণ এখানে কিছু হচ্ছে না, শুধু প্রচণ্ড শব্দে একটা এলার্ম বাজছে।

শুধু এলার্ম বাজছে? সেটি কীভাবে সম্ভব?

খুব সম্ভব। এটা একটা হাস্যকর খেলনা যন্ত্র–ভয়ংকর এলার্ম বাজিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে দেয়। আসলে কিছু না।

কিন্তু কিন্তু

কিন্তু কী?

কেউ সেটা বুঝতে পারছে না কেন?

কারণ প্রভু ক্লডের তথ্য পাওয়ার জন্যে যোগাযোগ মডিউলে যে হলোগ্রাফিক ইন্টারফেস ছিল সেটা আর কাজ করছে না। তার বোঝার কোনো উপায় নেই। এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত প্রত্ ক্লড। প্রভু ক্লড যখন অচল হয়ে যায় সবকিছু অচল হয়ে যায়।

প্রিমা চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। আমি ঠিকই বলছি। যে যন্ত্রের ওপর ভরসা করে সবাই ঈশ্বর হত সেই যন্ত্র আর কোনোদিন কাজ করবে না। পৃথিবীতে আর কেউ ভবিষ্যতে ঈশ্বর হতে পারবে না।

কেন?

সেটি অনেক বড় কাহিনী।

আমি সেটি শুনতে চাই।

রিহান হেসে বলল, তার চাইতে ভালো একটা কাজ করা যায়।

কী করা যায়?

তোমাকে সেটা দেখানো যায়।

কী দেখানো যায়?

আমি সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না প্রিমা। সেটা বিশ্বাস করতে হলে তোমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি নিজের চোখে দেখেও সেটা বিশ্বাস করবে না।

প্রিমা অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ ছটফট করে বলল, আমাকে দেখাও। এক্ষুনি দেখাও।

হ্যাঁ দেখাব, কিন্তু তার আগে চল এই এলার্মটা বন্ধ করে দিই। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।

.

কিছুক্ষণের ভেতরেই দেখা গেল রিহান শক্তিশালী মোটরবাইকে করে মরুভূমির পাথুরে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। পিছনের সিটে বসে প্রিমা রিহানকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিরাপত্তার জন্যে যতটুকু শক্ত করে ধরা দরকার প্রিমা তার চাইতে অনেক শক্ত করে ধরেছে। তাকে দেখলে মনে হয় সে ভাবছে এই মানুষটিকে ছেড়ে দিলেই বুঝি সে হারিয়ে যাবে। সে কিছুতেই এই মানুষটিকে হারাতে চায় না। কিছুতেই না।