আমি মিত্তিকার হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে তার মাথার কাছে রাখা বায়ো জ্যাকেটটি চালু করে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই বায়ো জ্যাকেটের ছোট পাম্পটি গুঞ্জন করে ওঠে। আমি মনিটরে দেখতে পেলাম তার রক্তের মাঝে দ্রবীভূত হয়ে থাকা নিহিলা গ্যাসটুকু পরিশোধন করতে শুরু করে দিয়েছে। আমি মিত্তিকার মাথার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, মেয়েটি সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী, চেহারার মাঝে একধরনের সারল্য রয়েছে যেটি সচরাচর দেখা যায় না। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না যে মিত্তিকাকে আরেকটু হলে ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন ঘাঘু অপরাধীতে পাল্টে দিতে চাইছিল।
আমি মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, খুব ধীরে ধীরে তার দেহে প্রাণের চিহ্ন ফিরে আসছে, মিত্তিকার মুখে গোলাপি আভা ফিরে এল, সে হাত-পা নাড়ল এবং একসময় ছটফট করে মাথা নাড়তে শুত্র করল। আমি তার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে ডাকলাম, মিত্তিকা, চোখ খুলে তাকাও মিত্তিকা।
মিত্তিকা মাথা নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে কাতর গলায় কিছু একটা বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। মিত্তিকার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে আমি আবার ডাকলাম, মিত্তিকা। মিত্তিকা—
মিত্তিকা হঠাৎ চোখ খুলে তাকাল, তার দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো বিভ্রান্ত। আমাকে দেখে সে চিনতে পারল বলে মনে হলো না। মিত্তিকা অসহায়ের মতো চারদিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ করে আমার দুই হাত জাপটে ধরে বলল, আমি কোথায়? আমার কী হয়েছে?
তোমার কিছু হয় নি মিত্তিকা। আমি মিত্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তোমার যেখানে থাকার কথা ছিল তুমি সেখানেই আছ।
মিত্তিকার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল, আর্তচিৎকার করে ভয়ার্ত গলায় বলল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস?
আমি হেসে বললাম, তোমার কোনো ভয় নাই মিত্তিকা। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে নিয়ে আর কোনো ভয় নাই।
মিত্তিকা আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস?
এসো আমার সাথে, দেখবে।
না। মিত্তিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, দেখব না, আমি দেখব না।
দেখতে না চাইলে দেখো না, কিন্তু আমার মনে হয় এখন যদি তাকে দেখো তোমার খুব খারাপ লাগবে না।
কেন?
কারণ সে আর হাইব্রিড মানুষ নেই। তার ভেতরের যেটুকু অংশ যন্ত্র ছিল সেটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যেটা একসময় তার শক্তি ছিল এখন সেটা তার দুর্বলতা।
মিত্তিকা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো সে আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কে তাকে ধ্বংস করল? কীভাবে করল? কখন করল?
সে অনেক বড় ইতিহাস। আমি একটু হেসে বললাম,তুমি আমার সাথে চলো নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
মিত্তিকা অপারেশন থিয়েটার থেকে নেমে এল। আমি তার হাত ধরে তাকে নিয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকলাম।
ক্লদ এবং মুশ আলাদা আলাদা দুটি চেয়ারে বসেছিল, তাদের হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা। আমাকে দেখে ক্লদ বলল, মহামান্য অধিনায়ক, আমার হাত দুটো খুলে দেবেন?
কেন?
অনেকক্ষণ থেকে আমার নাকের উপরের অংশ চুলকাচ্ছে।
আমি রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকা এই মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করলাম, একসময়ে নিশ্চয়ই তারা চমৎকার মানুষ ছিল, ম্যাঙ্গেল কাস তাদেরকে আধা-মানুষ আধা-জন্তুতে পরিণত করে দিয়েছে। আমি জানি না তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা আবার ঠিক করে দিয়ে আবার তাদের স্বাভাবিক মানুষে তৈরি করে দেয়া যাবে কি না।
ক্লদ আবার অনুনয় করে বলল, মহামান্য অধিনায়ক ইবন, আপনি কি আমার হাত দুটি খুলে দেবেন?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না ক্লদ। সেটি সম্ভব নয়। আমি ঠিক জানি না তোমরা ব্যাপারটির গুর ত্বটুকু ধরতে পেরেছ কি না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস তোমাদের মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার করে তোমাদের স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা অনেকটুকু নষ্ট করে দিয়েছে। আমার পক্ষে এখন কোনো ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
ক্লদ কাতর মুখে বলল, আপনি বিশ্বাস কর ন মহামান্য ইবান আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না।
মুশও গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমিও ক্ষতি করব না।
আমিও মাথা নাড়লাম, আমি দুঃখিত ক্লদ এবং মুশ, তোমাদের আরো একটু কষ্ট করতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মাঝে তোমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করব।
ক্লদ এবং মুশ নেহায়েৎ অপ্রসন্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলাম, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের একেবারে কোনার দিকে আমি ম্যাঙ্গেল কাসকে বেঁধে রেখেছি। তাপ পরিবহনের টিউবগুলো যেখানে ঘরের মেঝেতে নেমে এসেছে সেখানে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দুটি হাত ছড়িয়ে আলাদা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে, আমি সেখানেও কোনো ঝুঁকি নিই নি, দুটি পা শক্ত করে বেঁধে রেখেছি। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে দেখে মিত্তিকা আতঙ্ক চিৎকার করে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা, ভয় পাবার কিছু নেই। যখন তাকে ভয় পাবার কথা ছিল তখন যেহেতু তাকে ভয় পাও নি এখন ভয় পেয়ো না।
মিত্তিকা ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু, দেখো কী বীভৎস! কী ভয়ানক!
আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বীভৎস, সত্যিই ভয়ানক। একটি চোখ খুলে ঝুলছে, চোখের গর্ত থেকে কিছু ফাইবার বের হয়ে আছে, মুখের ভেতর থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের হয়ে আসছে, কিছু গালের চামড়া ফুটো করে ফেলেছে। হাত এবং পায়ের নানা অংশ থেকে ধাতব অংশ শরীরের চামড়া ফুটো করে বের হয়ে এসেছে, সেসব জায়গা থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস যখন হাইব্রিড় মানুষ ছিল তখন তার যন্ত্র এবং মানব-অংশের মাঝে চমৎকার একটি সমন্বয় ছিল, এখন নেই। এখন দেখে ভিতরে একটি আতঙ্ক হতে থাকে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ভালো চোখটি দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল, একটি যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, ইবান, আমি তোমাকে বলছি আমাকে কীভাবে হত্যা করতে হবে। সে কথাগুলো বলল খুব কষ্ট করে তার উচ্চারণ হলো অস্পষ্ট এবং জড়িত।
আমি বললাম, আমি সেটা জানতে চাই না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অনুনয় করে বলল, একটা চতুর্থ মাত্রার অস্ত্র নিয়ে আমার চোখের ফুটো দিয়ে উপরের দিকে লক্ষ্য করে গুলি করলে মস্তিষ্কটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে মিত্তিকা শিউরে উঠল, আমি তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস, আমি তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে হত্যা করাই যদি আমার উদ্দেশ্য হতো আমি তাহলে তোমাকে ঐ উপগ্রহটিকে তোমার মৃত বন্ধুদের সাথে রেখে আসতে পারতাম।
তুমি তাহলে আমাকে কী করতে চাও?
তোমাকে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাই।
আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো মানুষ। তুমি কাউকে কষ্ট দিতে চাও না।
আমি আসলেই কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।
তাহলে কেন তুমি আমাকে হত্যা করছ না?
কারণ আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের খোঁজ রাখি নি হয়ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে, হয়ত তারা তোমার মস্তিষ্ক সারিয়ে তুলতে পারবে, তুমি হয়ত আবার একজন সাধারণ মানুষ হয়ে যাবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার বিচিত্র যান্ত্রিক মুখ দিয়ে অবিশ্বাসের মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, তুমি সত্যিই সেটা বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ করি।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু তাহলে সেই মানুষটি তো ম্যাঙ্গেল ক্বাস থাকবে না, সেটি হবে অন্য একজন মানুষ। আমি কি অন্য মানুষ হতে চাই?
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুই অনুচর ক্লদ এবং মুশকে তাদের ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে, দেহগুলোকে শীতল করে দীর্ঘসময়ের জন্যে সংরক্ষণ করতে আমার এবং মিত্তিকার দীর্ঘ সময় লেগে গেল। সত্যি কথা বলতে কি মিত্তিকা না থাকলে আমার একার পক্ষে এ কাজগুলো করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। ক্লদ এবং মুশ খুব সহজেই তাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল কিন্তু ম্যাঙ্গেল কাসের জন্যে সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। ক্যাপসুলের কালো ঢাকনাটি যখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল তখনো সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় তাকে হত্যা করার জন্যে অনুরোধ করে যাচ্ছিল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস বুঝতে পারছিল না যে আসলে তার মৃত্যু ঘটে গেছে। একজন মানুষ যখন এভাবে মৃত্যু কামনা করে তখন তার বেঁচে থাকা না-থাকায় আর কিছু আসে যায় না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আর তার দুজন অনুচরকে নিরাপদে সংরক্ষণ করার পর আমি প্রথমবার ফোবিয়ানের দিকে নজর দিলাম, নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণ থেকে বের হয়ে আসার জন্যে যে প্রচণ্ড শক্তিক্ষয় হয়েছে তার চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণের মূল অংশটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জরুরি অংশটি কোনোভাবে কাজ করছে। তাপ। সঞ্চালনের অনেকগুলো টিউব দুমড়ে মুচড়ে ফেটে গেছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একটি বড় অংশ অচল হয়ে আছে। ফোবিয়ানের দেওয়ালের কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, ভেতর থেকে বাতাস বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় ফোবিয়ানের অনেকগুলো অংশের জরুরি চাপ নিরোধক দরজা পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে আছে। যোগাযোগ মডিউলের কিছু অংশও অকেজো হয়ে আছে, গন্তব্য স্থানে নিয়মিত যে সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছিল সেটি বন্ধ হয়ে গেছে, সেটি আবার চালু করে না দিলে মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ধারণা করতে পারে ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের আকর্ষণে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন প্রচুর কাজ। কিছু কিছু এই মুহূর্তে শুরু করতে হবে।
কিন্তু সব কাজ শুরু করার আগে আমার মিত্তিকাকে তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। এই মহাকাশযানটিতে শুধুমাত্র তার অধিনায়কের থাকার কথা— এটি সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে আমার মিত্তিকাকে শীতল ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না— ইচ্ছে করছিল তাকে আমার পাশাপাশি রেখে দেই, কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। সে মহাকাশযানের একজন যাত্রী তাকে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হবে। একজন যাত্রীকে সারাক্ষণ তার শীতল ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে থাকার কথা, আর এখন এই মহাকাশযানের মোটামুটি বিপজ্জনক পরিবেশে তাকে বাইরে রাখা বেআইনি এবং বিপজ্জনক; একজন মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে আমি কোনো অবস্থাতেই সেটি করতে পারি না। মিত্তিকা নিজেও সেটা জানে কাজেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার দুজন অনুচরকে ঘুম পড়িয়ে দেয়ার পর সে আমাকে বলল, এবার আমার পালা।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ।
মহাকাশযানের যে অবস্থা আমার মনে হচ্ছে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে হতো কিন্তু তুমি তো জান আমি মহাকাশযানের কিছুই জানি না।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আমি জানি। তোমার জানার কথা নয়। আমাকে দীর্ঘদিনে এসব শিখতে হয়েছে।
মিত্তিকা চোখে একটু দুশ্চিন্তা ফুটিয়ে বলল, তুমি কি একা এইসব কাজ শেষ করতে পারবে?
আমার ইচ্ছে হলো বলি, না, পারব না। তুমি আমার পাশে থাকো কিন্তু আমি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম। বললাম, পারব মিত্তিকা। আমাকে সাহায্য করার জন্যে সাহায্যকারী রবোটগুলি চালু করে দেব। নিউরাল নেটওয়ার্কে সব তথ্য রাখা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।
মিত্তিকা কিছু বলল না একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, এই মহাকাশযানের যাত্রী হওয়ার কারণে তোমার অনেক দুর্ভোগ হলো মিত্তিকা। ফোবিয়ানের অধিনায়ক হিসেবে আমি আন্তরিকভাবে তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। তুমি যদি চাও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারি।
মিত্তিকা শব্দ করে হেসে বলল, এর প্রয়োজন নেই ইবান, অধিনায়ক হিসেবে তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পার— কিন্তু আমি কী করব? আমার তো কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা নেই, আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাব?
ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই মিত্তিকা। আসলে আমরা খুব সৌভাগ্যবান তাই এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর রাখা কোয়ার্টজের গোলকের ভিতরে সৌভাগ্য-বৃক্ষটিকে দেখিয়ে বললাম, এই সৌভাগ্য-বৃক্ষে এতক্ষণ ফুল ফুটে যাওয়া উচিৎ ছিল।
ঠিকই বলেছ। আমরা যে সৌভাগ্যবান সেটা জানার জন্যে আমাদের যেটুকু সময় বেঁচে থাকার দরকার ছিল তুমি থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।
আমি কোনো কিছু না বলে একটু হাসলাম। মিত্তিকা একটু এগিয়ে এসে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার কাছে আরো একটি ব্যাপারে কৃতজ্ঞ ইবান।
কী ব্যাপার?
আমি তোমার কাছে প্রথম দেখতে পেয়েছি যে অন্য মানুষের জন্যে ভালোবাসা থাকতে হয়। নিজের ক্ষতি করে। হলেও অন্যের ভালো দেখতে হয়!
আমি শব্দ করে হেসে বললাম, আমার মা আমার এই সর্বনাশটি করে গেছেন! বিশ্বজগতের সব মানুষ যখন বুদ্ধি প্রতিভা সৌন্দর্য, শক্তি সৃজনশীলতা নিয়ে জন্ম হচ্ছে তখন আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে!
সত্যি?
হ্যাঁ, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে শুধুমাত্র এই একটি জিনিসই আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার জন্ম হয়েছে। একজন দুর্বল মানুষ হয়ে, আমি বড় হয়েছি দুর্বল মানুষ হিসেবে!
মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে বলল, ভালোবাসা দুর্বলতা নয় ইবান। তোমার মা চমৎকার একজন মানুষ নিজের সন্তানকে এর চাইতে ভালো কী দেয়া যায়?
আমি মাথা নাড়লাম, যখন বড় হওয়ার জন্যে আমি কষ্ট করেছি তখন এই গুণটি আমার খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় নি।
তোমার মা এখন কোথায় আছেন?
তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে রিশি নক্ষত্রের কলোনির কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমি আসলে সেজন্যেই যাচ্ছি, মায়ের সাথে দেখা করব! এই সৌভাগ্য- বৃক্ষটা আমি মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।
ইশ! কী মজা।
হ্যাঁ, আমি খুব অপেক্ষা করে আছি। ফোবিয়ানের যোগাযোগ মডিউলটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেল— এটা ঠিক করে আমি চারপাশে ট্রেসার পাঠানো শুরু করব। খুঁজে বের করতে হবে আমার মা কোথায় আছেন।
মিত্তিকা সুন্দর করে হেসে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, তুমি খুব সৌভাগ্যবান ইবান, তোমার একজন প্রিয় মানুষ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার কেউ নেই।
আমার হঠাৎ করে বলার ইচ্ছে করল, মিত্তিকা আমি আছি, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব। কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন প্রিয়জন পাবে মিত্তিকা। নিশ্চয়ই পাবে।
মিত্তিকা কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে হাসল। তার সেই হাসি দেখে হঠাৎ কেন জানি আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।
মিত্তিকা তার নিও পলিমারের পোশাক পরে কালো ক্যাপসুলে শুয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নিচে নামিয়ে আনলাম, মিত্তিকা শেষ মুহূর্তে ফিসফিস করে বলল, ভালো থেকো ইবান।
আমিও নরম গলায় বললাম, তুমিও ভালো থেকো মিত্তিকা।
মিত্তিকা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, বিদায়।
বিদায় মিত্তিকা।
আমি ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নামিয়ে সুইচটা স্পর্শ করতেই স্বয়ংক্রিয় জীবন রক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেটের হালকা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। ক্যাপসুলের স্বচ্ছ ঢাকনা দিয়ে আমি মিত্তিকাকে দেখতে পেলাম খুব ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ। হয়ে আসছে। ক্যাপসুলের মাঝে শীতল একটি প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন। হয়ে পড়বে। আমি একদৃষ্টে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, মনে হলো এই সাদামাটা সরল মেয়েটি আমার জীবনের বড় একটা অংশকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেল।
শীতল কক্ষ থেকে বের হয়ে আমি ফোবিকে ডাকলাম। ফোবি সাথে সাথে উত্তর দিল, বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
ফোবিয়ান তো প্রায় ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বলা যায় একটি বিপজ্জনক অবস্থা।
আপনি ঠিকই বলেছেন।
সবচেয়ে জরুরি কাজ কোনটি? কোন কাজটা দিয়ে শুরু করব?
সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক করা। ত্বরণের প্রথম ধাক্কাটা লাগার সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝাকুনিতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা এখান থেকে কোনো সংকেত যায় নি। মহাজাগতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের লোকজন ভাবতে পারে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি!
বেশ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে এটা দিয়েই শুরু করা যাক।
আপনি এটা দিয়ে শুরু করতে পারবেন না মহামান্য ইবান। মূল নিয়ন্ত্রণটি না সারিয়ে আপনি কিছুতেই যোগাযোগ মডিউল সারাতে পারবেন না। আবার মূল নিয়ন্ত্রণ সারিয়ে তোলার আগে দেওয়ালের সূক্ষ্ম ফাটলগুলো বন্ধ করতে হবে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার রবোট ছেড়ে দাও, কাজে লেগে যাই।
আমি প্রায় একডজন ইঞ্জিনিয়ার রবোট নিয়ে কাজে লেগে গেলাম। মহাকাশযানের বাইরে থেকে মাইক্রো স্ক্যানার দিয়ে সূক্ষ্ম ফাটলগুলো খুঁজে বের করে ইঞ্জিনিয়ার রবোটদের নিয়ে সেগুলো ওয়েল্ড করে সারিয়ে তুলতে লাগলাম। প্রায় একটানা কাজ করে যখন দেখতে পেলাম শরীর আর চলছে না তখন আমি মহাকাশযানের ভিতরে ফিরে এলাম, এসে দেখি মহামান্য রিতুন ক্লিস আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি?
হ্যাঁ! তোমার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।
বিদায়?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটি তুমি চমৎকারভাবে গুছিয়ে নিয়েছ। আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনার প্রয়োজন কখনোই ফুরাবে না মহামান্য রিতুন। আপনি সাহায্য না করলে আমি কখনোই এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতাম না।
রিতুন ক্লিস হেসে বললেন, সেটি সত্যি নয়। যেটি করার সেটি তুমি নিজেই করেছ।
কিন্তু কী করতে হবে আমি জানতাম না। তুমি জানতে ইবান।
তুমি এখনো জানো। নিজের উপরে বিশ্বাস রেখো।
রাখব।
রিতুন ক্লিস কাছাকাছি এসে বললেন, আমি সত্যিকারের মানুষ হলে তোমাকে স্পর্শ করতাম। সত্যিকারের মানুষ নই বলে স্পর্শ করতে পারছি না।
আমি বললাম, আমার কাছে আপনি তবুও সত্যিকারের মানুষ।
শুনে খুশি হলাম। রিতুন ক্লিস আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবার আগে একটা শেষ কথা বলে যাই?
বলুন।
আমি সত্যিকারের মানুষ নই। যারা সত্যিকারের মানুষ তাদের নিয়ে কখনো নিজের সাথে প্রতারণা কোরো না।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনি কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মহামান্য রিতুন।
বুঝতে না পারলে কথাটি তোমার জন্যে নয় ইবান। কিন্তু কখনো যদি বুঝতে পারো কথাটি মনে রেখো। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আমাকে বিদায় দাও ইবান।
বিদায়। বিদায় মহামান্য রিতুন।
বিদায়– আমার একটু ভয়-ভয় করছে ইবান। ভয় এবং দুঃখ। তার সাথে একটু আনন্দ– তোমার মতো। একজন চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হলো সেই আনন্দ।
আমারও খুব সৌভাগ্য মহামান্য রিতুন যে আপনার সাথে আমার পরিচয় হলো। আমার মা এখানে থাকলে খুব খুশি হতেন।
রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর নিচু এবং বিষণ গলায় বললেন, যদি তার সাথে দেখা হয় তাকে আমার ভালোবাসা জানিও। তাকে বলবে তিনি ঠিক কাজ করেছিলেন, সন্তানের বুকের মাঝে সবার আগে ভালোবাসা দিয়েছিলেন।
বলব।
রিতুন ক্লিস একটি হাত উপরে তুলে হঠাৎ করে মিলিয়ে গেলেন, আমার মনে হলো আমি মৃদু একটা আর্তচিৎকার শুনলাম তবে সেটি আমার মনের ভুলও হতে পারে। ঘরের ফাঁকা জায়গাটিতে তাকিয়ে আমি বুকের ভিতরে একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। আমার মা সত্যি কথাই বলেছিলেন, রিতুন ক্লিস সত্যিই চমৎকার একজন মানুষ। ফোবিয়ানে আমার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সময় রিতুন ক্লিস না থাকলে কী সর্বনাশই-না হতো। পুরো গল্পটা যখন আমার মাকে শোনাবো আমার হাসিখুশি ছেলেমানুষি মা নিশ্চয়ই কী আগ্রহ নিয়েই-না শুনবেন। ব্যাপারটি চিন্তা করেই একধরনের আনন্দে আমার চোখ ভিজে ওঠে।
যোগাযোগ মডিউলটি ঠিক হওয়ার সাথে সাথে আমি মহাজাগতিক মূল কেন্দ্রে যোগাযোগ করার জন্যে তথ্য পাঠাতে শুরু করলাম। এপর্যন্ত যা ঘটেছে তার পুরো বর্ণনা দিয়ে আমি আমার মায়ের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। তার আন্তঃগ্যালাক্টিক পরিচয়-সংখ্যা দিয়ে তিনি কোথায় আছেন সেটি খুঁজে বের করার জন্যে একটি অনুরোধ পাঠালাম। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি অনুরোধ হলেও পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এটি একটি নির্দেশ হিসেবেই বিবেচনা করার কথা। মহাজাগতিক মূল কেন্দ্র থেকে খবর ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে, আমি তার মাঝে ফোবিয়ানের অন্যান্য সমস্যাগুলো সারতে শুরু করে দিলাম।
বিদ্যুৎ সঞ্চালনের অংশটুকু সেরে তুলতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। কাজটি সহজ হলেও বেশ সময়সাপেক্ষ, অভিজ্ঞ রবোটগুলি পুরো সময়টুকু একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছোটাছুটি করছিল। মহাকাশযানের ভেতরে সারাক্ষণই এক। ধরনের ছোটাছুটি এবং বিদ্যুতের ঝলকানি এবং তার সাথে হালকা ওজোনের গন্ধ। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজটুকু শেষ হওয়ার পর আমি তাপ পরিবহনের অংশটুকুতে হাত দিলাম, তাপ সুপরিবাহী বিশেষ সংকর ধাতুর উজ্জ্বল টিউবগুলো অনেক জায়গাতেই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে, ভেতরে তাপ পরিবাহী ত্বরণগুলো নানা জায়গাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলো পরিষ্কার করে টিউবগুলো পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করতে হলো। ফোবিয়ানের মূল পাম্পের বিভিন্ন অংশ থেকে টিউবগুলোর ভেতর দিয়ে তরলগুলো মহাকাশযানের নানা অংশে পাঠিয়ে পুরো পদ্ধতিটি বারবার পরীক্ষা করে দেখতে হলো।
ফোবিয়ানকে পুরোপুরি দাঁড় করানো বিশাল কাজ করতে করতে আমার সময়ের জ্ঞান ছিল না, ফোবিয়ানের অনুরোধে মাঝে মাঝে খেয়েছি মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছি। গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে আমি মহাকাশযানটিকে তার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই।
এরকম সময়ে ফোবি আমাকে জানাল মূল মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে আমাদের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চমৎকার! তাদের প্রতিক্রিয়া কীরকম?
ফোবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য ইবান।
আমি হাতের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রেখে মনিটরের দিকে তাকালাম, মহাজাগতিক কেন্দ্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হাত-পা নেড়ে ফোবিয়ানে যা ঘটেছে সেটা নিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হড়বড় করে কথা বলছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো বড় একজন অপরাধীকে সার্বিকভাবে পরীক্ষা না করে ফোবিয়ানে তুলে দেয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। উপগ্রহটিতে সেই বিচিত্র প্রাণীদের নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে এবং তাদের নিয়ে গবেষণা করার বিস্তারিত পরিকল্পনার বর্ণনা দিতে শুরু করেছে। ফোবিয়ানকে নিউট্রন স্টারের প্রবল মহাকর্ষ বল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্যে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে— আমি একধরনের কৌতুকমিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে তার কথা শুনতে লাগলাম। উচ্চপদস্থ কর্মচারীর দীর্ঘ বক্তব্য একসময় শেষ হলো এবং আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে বলল, অধিনায়ক ইবান, তুমি একজন মহিলার খোঁজ নেয়ার জন্যে যে ট্রেসার পাঠিয়েছিলে সেটি ফিরে এসেছে। আমি সেসংক্রান্ত তথ্য তোমাকে পাঠালাম।
আমি চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলাম, আমার মা সম্পর্কে তথ্য এসেছে যার অর্থ তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আমার বুক আনন্দে ছলাৎ করে ওঠে। মনিটরে কিছু অর্থহীন সংখ্যা এবং বিচিত্র প্রতিচ্ছবি খেলা করতে লাগল এবং হঠাৎ করে মনিটরে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে দেখতে পেলাম। মানুষটির বিষণ্ণ একধরনের চেহারা। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অধিনায়ক ইবান, আমি ঠিক কীভাবে খবরটি দেব বুঝতে পারছি না।
আমি চমকে উঠলাম, মানুষটি কী বলতে চাইছে?
তোমার মা খবর পেয়েছিলেন তুমি ফোবিয়ানে করে আসছ। তুমি কবে পৌঁছাবে সেটি জানার জন্যে তিনি মহাজাগতিক কেন্দ্রের সাথে প্রায় প্রতিদিন যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং সেটিই হয়েছে কাল।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে সেখানে বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম হলো এবং হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আধিনায়ক ইবান, তোমার মা যখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আমরা তখন তাকে জানিয়েছিলাম যে নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে ফোবিয়ান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে– আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান, এই খবরটিতে তোমার মায়ের বুক ভেঙে গেল। তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসতেন, তিনি কিছুতেই সেই ভয়ংকর আশাভঙ্গের দুঃখ থেকে উঠে আসতে পারলেন না। একদিন রাতে যখন জোড়া উপগ্রহ থেকে উথালপাথাল জোৎস্নার আলো, কালো সমুদ্রে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ছুটে এসেছে, তোমার মা তখন হেঁটে হেঁটে সেই সমুদ্রের ফুসে ওঠা পানির মাঝে হেঁটে গেলেন। সমুদ্রের পানি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি খুব দুঃখিত অধিনায়ক ইবান পরদিন তার দেহ যখন বালুবেলায় ফিরে এসেছে সেটি ছিল প্রাণহীন।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বিষণ্ণ চোখে তাকাল, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মা মৃত্যুর আগে একটা ছোট ভিডিও ক্লিপ রেখে গিয়েছেন। আমরা তোমার কাছে সেটা পাঠালাম।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বিষণ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনিটর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার হঠাৎ করে মনে হলো বুকের ভিতরটি ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, ফোবিয়ানের বিশাল কক্ষ জটিল যন্ত্রপাতি উজ্জ্বল আলো, গোল জানালা দিয়ে বাইরের কালো মহাকাশ এবং উজ্জল নেবুলা এবং মনিটরের উপর সাজিয়ে রাখা আমার মায়ের জন্যে সৌভাগ্য-বৃক্ষ সবকিছু কেমন জানি অর্থহীন মনে হতে থাকে। আমার চোখের সামনে সবকিছু কেমন জানি অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে, নিশ্চয়ই চোখ ভিজে আসছে। আমি হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মনিটরে তাকালাম সেখানে আমার মায়ের ভিত্তি ও ক্লিপটি দেখা যাচ্ছে আমি হাত বাড়িয়ে সেটি স্পর্শ করতেই হঠাৎ করে ঘরের মাঝখানে আমার মা জীবন্ত হয়ে উঠলেন, তার কালো চুল বাতাসে উড়ছে, আকাশের মতো দুটি নীল চোখে গভীর বেদনা। আমার মা ঘুরে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আমি আর পারছি না, খুব আশা করেছিলাম যে ছেলেটাকে দেখব, বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাব। হলো না। এক নিঃসঙ্গ একটি মহাকাশযানে আমার সোনার টুকরো ছেলেটি নিউট্রন স্টারের প্রবল আকর্ষণে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেল। প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর একজন মানুষ আকাশের নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকে। আমারও সেটা খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে আমার সোনামনি ইবান আকাশের একটি নক্ষত্র হয়ে বেঁচে আছে।
আমার মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার সোনামনি ইবানের কাছে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। আমিও সেই নক্ষত্রের পাশাপাশি অন্য একটি নক্ষত্র হয়ে থাকব। উথালপাথাল জোছনায় একটু পরে যখন কালো সমুদ্রের পানি ফুসে উঠবে আমি তখন তার মাঝে হেঁটে হেঁটে যাব। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
আমার মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন, সমুদ্রের বাতাসে তার চুল উড়তে লাগল, তার উজ্জ্বল চোখ দুটো গভীর বেদনায় নীল হয়ে রইল। আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ পানিতে ভরে উঠল, আমার মা অস্পষ্ট হয়ে এলেন। ঠিক তখন শুনতে পেলাম কেউ একজন আমাকে ডাকল, ইবান।
আমি ঘুরে তাকালাম। ফোবিয়ানের দরজা ধরে মিত্তিকা দাঁড়িয়ে আছে। সে শান্ত পায়ে হেঁটে এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল, বুড়োমতো একজন মানুষ আমাকে জাগিয়ে তুলে বলেছে তুমি ইবানের কাছে যাও। আজ তার জন্যে খুব দুঃখের দিন। কী হয়েছে ইবান? আজ কেন তোমার জন্যে দুঃখের দিন?
আমার মা মারা গেছেন মিত্তিকা।
মারা গেছেন? তোমার মা?
হ্যাঁ।
কেমন করে মারা গেলেন?
আমার মা ভেবেছিলেন ফোবিয়ান নিউট্রন স্টার ধ্বংস হয়ে গেছে, আমিও ধ্বংস হয়ে গেছি। সেটা ভেবে আমার মা এত কষ্ট পেলেন যে–
যে?
আর বেঁচে থাকতে চাইলেন না। আমার মা সমুদ্রের পানিতে হেঁটে হেঁটে চিরদিনের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মিত্তিকা একধরনের বেদনার্ত মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত ইবান। আমি খুব দুঃখিত।
আমি মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তার নীল দুটি চোখে এক আশ্চর্য গভীর বেদনা— ঠিক আমার মায়ের মতন। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ভিতরে এক বিচিত্র আলোড়ন অনুভব করলাম, এক বিচিত্র নিঃসঙ্গতা হঠাৎ করে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার রিতুন ক্লিসের কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন আমি যেন নিজেকে প্রতারণা না করি। আমি করলাম না, মিত্তিকার হাত ধরে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা
কী হয়েছে, ইবান?
আমি— আমি বড় একা।
মিত্তিকা গভীর মমতায় আমার হাত ধরল। আমি কাতর গলায় বললাম, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মিত্তিকা।
মিত্তিকা গভীর ভালোবাসায় আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, যাব না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না ইবান।
হঠাৎ করে ঘরের মাঝামাঝি একটা ছায়া পড়ল, আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে রিতুন ক্লিস দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গিয়েছেন রিতুন ক্লিস।
হ্যাঁ আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে একা ফেলে যেতে পারছিলাম না ইবান।
ধন্যবাদ রিতুন ক্লিস। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আমি তাই মিত্তিকাকে জাগিয়ে দিলাম। মনে হলো মিত্তিকা হয়ত তোমার পাশে থাকতে পারবে। মানুষের অবলম্বন লাগে— মানুষ যত শক্তই হোক তার একজন অবলম্বন দরকার, তার পাশে একজনকে থাকতে হয়।
আমার জন্যে আপনার ভালোবাসা আমি কখনো ফিরিয়ে দিতে পারব না।
তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ ইবান। আমি তাই এখন যেতে পারব। তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারব। রিতুন ক্লিস তার বিষণ্ণ মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, বিদায় ইবান। বিদায় মিত্তিকা!
আমি আর মিত্তিকা হাত নাড়লাম, বললাম, বিদায়।
রিতুন ক্লিসের ছায়ামূর্তি খুব ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। চিরদিনের মতোই।