০৮. মতবিরোধ

. মতবিরোধ

সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি তবু বেশ অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম, বহুকাল এভাবে শুয়ে থাকি নি। একসময় লোকজনের গলার আওয়াজ আসতে থাকে, একজন মেয়ের গলাও পেলাম, নিশ্চয়ই নীষা এসেছে। আমি তখন আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লাম।

পাশে একটা ছোট বাথরুম, আমার কাপড়জামা সেখানে পাট করে সাজানো। আমি নিজেকে পরিষ্কার করে, ধোয়া কাপড় পরে বেরিয়ে আসি। গলার শব্দ অনুসরণ করে খানিকদূর যেতেই একটা বড় ঘরে এসে হাজির হলাম. ঘরটিতে যে-পরিমাণ যন্ত্রপাতি আমার মনে হয় না পথিবীর আর কোথাও এত অল্প জায়গায় এত যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে। ঘরের এক কোনায় একটা ছোট টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার, তার দু’টিতে নীষা আর লুকাস বসে কথা বলছে, আমাকে দেখে দু’ জনেই ঘুরে তাকায়। লুকাস হাত নেড়ে বলল, আসুন কিম জুরান,পনার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

হ্যাঁ, অনেকদিন পর ভালো ঘুম হল। আমি চারদিকে অসংখ্য ইলেকট্রনিক মডিউল দেখতে দেখতে বললাম, এ-কি সর্বনাশা যন্ত্রপাতি, কী এটা?

জানবেন, সময় হলেই জানবেন।

গোপন কিছু নাকি?

আমরা যেহেতু বেআইনি মানুষ, আমাদের সবকিছুই গোপন। আপনার কাছে অবশ্যি গোপন করার কিছুই নেই।

নীষা জিজ্ঞেস করল, সকালে কিছু খেয়েছেন?

না, খাইনি। ভোরে অবশ্যি এমনিতেই আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।

লুকাস মাথা নেড়ে বলল, রবোট হলে এই হচ্ছে মুশকিল, নিজের খেতে হয় না বলে মনেই থাকে না যে অন্যদের খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। দাঁড়ান, আপনার খাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। লুকাস উচ্চস্বরে ডাকে, ভিকি, ভিকি—

ভিকি ঘরে এসে আমাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলল, রক্তপাত বন্ধ হয়েছে?

হ্যাঁ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

লুকাস বলল, ভিকি খাবারের ব্যবস্থা কর।

খাবার? ভিকি বিচলিত হয়ে বলল, খাবার কী জিনিস?

লুকাস ধৈর্য না হারিয়ে বলল, মানুষ যেসব জিনিস খায়, যেগুলো না খেলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। আছে সেসব?

ও, সেইসব? অবশ্যি আছে। কী আনব?

নীষা জানতে চায়, কী কী আছে?

লাল বাক্স, সবুজ বাক্স আর নীল বাক্স। ছোট, বড় আর মাঝারি। ভেতরে আছে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আর তরল। ট্যাবলেট–

নীষা বাধা দিয়ে বলল, থাক আর বলতে হবে না।

কোনটা আনব?

তোমার আনতে হবে না, আমরা নিজেরা ব্যবস্থা করে নেব। কিম জুরান, চলুন রান্নাঘরে বসে কথা বলা যাবে, লুকাস, তুমিও আস।

হ্যাঁ, চল।

রান্নাঘরে টেবিলে নাস্তা করতে করতে কথা হচ্ছিল। লুকাস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছিল, আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব?

করুন।

আমাকে বাঁচানোর জন্যে তোমরা এত কষ্ট করলে কেন?

কৃতজ্ঞতা বলতে পারেন।

কৃতজ্ঞতা?

আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, আমি তাই যেটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি। আপনার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।

আমি লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, মানুষ বহুকাল থেকে মিথ্যে কথা বলে আসছে, তাই তারা যখন মিথ্যে বলে, ধরা খুব কঠিন। কিন্তু রবোটেরা মিথ্যে কথা বলা শুরু করেছে মাত্র অল্প কিছুদিন হল, তারা যখন মিথ্যে কথা বলে, ধরা খুব সহজ।

লুকাস সরু চোখে বলল, কেন, আমি কি মিথ্যে কথা বলেছি?

আমি তোমাকে আরো একবার এই প্রশ্ন করেছিলাম, মহাকাশযানে রুকুন গ্রহপুঞ্জে যাবার সময়, তখন তুমি অন্য উত্তর দিয়েছিলে।

আমি কী বলেছিলাম?

বলেছিলে তুমি আমাকে বাঁচাতে এসেছ, নীষার অনুরোধে। আমার জন্যে নীষার মায়া হয়েছিল—

লুকাস বাধা দিয়ে বলল, সেটা সত্যি। নীষা আমাকে অনুরোধ করেছিল; আমার নিজেরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটা সুযোগ হল।

আমি মাথা নাড়লাম, না, কোথায় জানি হিসেব মিলছে না। এত কষ্ট করে আমাকে বাঁচালে, এত বড় বড় ঝুঁকি নিলে দু জনে, শুধু মায়া আর কৃতজ্ঞতাবোধে হয় না,–

লুকাস বাধা দিয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, নীষা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, লুকাস, সত্যি কথাটা বলে দাও।

লুকাস চমকে নীষার দিকে তাকায়, খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই, তারপর এটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, আপনার কাছে সত্যি কথাটি গোপন করার জন্যে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাকে কী জন্যে আমরা এত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি।

হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, যে-কারণটির জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল ঠিক সেই কারণে আমি তোমাদের কাছে মূল্যবান। ঠিক?

ঠিক।

তোমরা জানতে চাও আমি কীভাবে গো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে তার ভেতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করেছিলাম।

হ্যাঁ।

সেটি গোপন করছিলে কেন?

লুকাস কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে। নীষা আস্তে আস্তে বলল, কারণটা খুব সহজ, রবোটেরা সব সময়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তারা কখনোই ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন মানুষ তাদের কোনো ধরনের অভ্যুথানে সাহায্য করবে।

আমি নীষার দিকে তাকিয়ে বললাম, নীষা, পৃথিবীর কিছু মানুষ হয়তো আমার উপর অবিচার করেছে, কিন্তু সে জন্যে আমি সব মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে রবোটের অভ্যুথানে সাহায্য করতে পারি না।

রবোটের অভ্যুত্থান হলেই সেটা মানুষের বিরুদ্ধে হবে কেন ধরে নিচ্ছেন?

তাহলে কার বিরুদ্ধে হবে?

রবোটের অ্যুথান হবে অন্য রবোটের বিরুদ্ধে, ক্রুগো কম্পিউটারের বিরুদ্ধে।

আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললাম, ক্রুগো কম্পিউটারের উপর আমার নিজের যত ব্যক্তিগত আক্রোশই থাকুক না কেন, তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না সেটা তৈরি করেছে মানুষ, মানুষকে সাহায্য করার জন্যে। আমি কখনোই কিছু রবোটকে সেটা

ধ্বংস করতে দেব না।

নীষা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি সবকিছু জানেন না কিম জুরান। যদি জানতেন—

আমি মাথা নেড়ে বললাম, পৃথিবীর কেউ সবকিছু জানে না নীষা, বেঁচে থাকতে হলে সবকিছু জানতে হয় না। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানলেই হয়। রবোটের প্রয়োজন আর মানুষের প্রয়োজন এক নয়, তাই রবোটের যেটা জানতে হয়, মানুষের সেটা জানার প্রয়োজন নাও হতে পারে।

নীষা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আমি কী বলতে চাইছি, আপনি একবার শুনবেন না?

না। আমি কঠোর গলায় বললাম, না। তোমরা আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করাতে পারবে না। আমি কঠোর স্বরে বললাম, তোমরা কীভাবে আশা করতে পার যে আমি তোমাদের বিশ্বাস করব? ঐ ঘরের বড় যন্ত্রপাতি কি আমার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার জন্যে তৈরি হয় নি?

নীষা আর লুকাস দু’ জনেই চমকে ওঠে। নীষা কাতর গলায় বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, তার প্রয়োজন হবে না, আমার সব কথা শুনলে আপনি নিজেই। সাহায্য করবেন। আপনি বিশ্বাস করুন—

আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমি রবোটকে বিশ্বাস করি না।

নীষা আহত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।

লুকাস এতক্ষণ একটি কথাও না বলে চুপ করে ছিল। এবারে আস্তে আস্তে বলল, আমার খুব আশাভঙ্গ হল কিম জুরান। আমার আশা ছিল আপনি হয়তো সব শুনে আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু আপনি করলেন না। এখন আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।

আমার মুখে একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে ওঠে। লুকাস সেটা লক্ষ না করার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু আমরা আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করব না। একজন মানুষের উপর এত অবিচার করা যায় না।

তাহলে কী করবে?

এখনো ঠিক করি নি। আমাদের নিজেদের ক্রুগো কম্পিউটারের সংকেত বের করতে হবে, সে জন্যে সময় লাগবে।

আমাকে কী করা হবে?

আপনাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।

কিন্তু আমাকে কি এখন খোঁজাখুজি করা হচ্ছে না? আমি মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামী, সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেছি, আমার কি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উপায় আছে?

লুকাস পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বের করে বলল, আপনাকে আর কখনো কেউ খোজ করবে না। এই দেখেন।

আমি কাগজের উপরে ঝুঁকে পড়ি। মাঝের পাতায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। নিচে লেখা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর শোচনীয় মৃত্যু। খবরে লেখা যে, মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার পর আমি নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টা করার পর গুলিবিদ্ধ হই। সেই অবস্থায় একটা গাড়ি থামিয়ে সেখানে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে গাড়িকে দুর্ঘটনার মুখে ফেলে দিই। ফলে গাড়ির চালক আর আমি দু’ জনেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছি। গাড়ির চালককে শনাক্ত করা যায় নি, কিন্তু আমার চুল এবং পোশাকের কিছু অংশ থেকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা গেছে।

খবরটি পড়ে আমি অবাক হয়ে লুকাসের মুখের দিকে তাকালাম, এটা কীভাবে সম্ভব?

লুকাস কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, সবই সম্ভব, ঠিক করে পরিকল্পনা করতে হয়। আমাদের একটা গাড়ি নষ্ট হয়েছে, কিন্তু গাড়ির অভাব কী? তাই বলছিলাম আপনাকে আর কেউ খোজ করবে না, আপনি এখন নূতন জীবন। শুরু করতে পারবেন।

আমি খবরের কাগজটি দেখিয়ে বললাম, আমি পুড়ে মারা গেছি, এখন যখন দেখবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি—

লুকাস মাথা নেড়ে বলল, দেখবে না। আপনাকে নৃতন একটা পরিচয় দেয়া হবে। চোখের আইরিশ পাল্টে আপনার পরিচয় পাল্টে দেয়া হবে।

কিন্তু চোহারা? এই চেহারা?

খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ তো চেহারা দিয়ে পরিচয় রাখে না। আপাতত আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ কারো কাছে যাচ্ছেন না। মানুষের চেহারা খুব সহজে পাল্টে দেয়া যায়, তাই তার সত্যিকার পরিচয় চোখের আইরিশে, চেহারায় নয়। কাজেই আপনাকে কেউ কোনোদিন শনাক্ত করতে পারবে না, আপনি নিশ্চিত থাকেন।

লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অবশ্যি আপনি নিজে যদি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে সবকিছু স্বীকার করেন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমি আশা করছি আপনি সেটা করবেন না, আপনার যদিও ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে খানিকটা শান্তা আছে, আপনার জন্যে তার বিন্দুমাত্র মমতা নেই।

আমি লুকাসের খোঁচাটা হজম করে চুপ করে থাকি। লুকাস আবার বলে, কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে আপনার পরিচয় দেয়ার আমি কোনো কারণ দেখছি না। নৈতিক কর্তব্য বিবেচনা করে আপনি যদি আমাদের যড়যন্ত্রের কথা বলে দিতে চান, বলতে পারেন। ক্রুগো কম্পিউটারের কাছে সেটা নুতন খবর নয়, সে অনেকদিন থেকে আমাকে খুজে যাচ্ছে। গত রাতে আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং বন্ধ করিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করার পর নীষার পক্ষে তার পুরান কাজে ফিরে যাওয়া বিপজ্জনক; সে আর সেখানে যাবে না। আপনি তাই তাকেও ধরিয়ে দিতে পারবেন না। আমি আশা করছি আপনার নিজের প্রাণের মায়ায় আপনি এ-ধরনের চেষ্টা করবেন না।

লুকাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার জন্যে আমরা শহরতলিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করেছি। আজ বিকেলেই আপনি সেখানে উঠে যাবেন, এখানে থাকাটা আপনার জন্যে বিপজ্জনক। এরপর আপনি আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমরা অবশ্যি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। আমি আশা করছি কোনোদিন আপনি ক্রুগো কম্পিউটারের সত্যিকার পরিচয় জানবেন, তখন আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হবেন।

লুকাস মাথা নেড়ে আমাকে অভিবাদন করে বের হয়ে গেল। আমি আর নীষা চুপচাপ বসে রইলাম, কোথায় জানি সুর কেটে গেছে, আর সহজ স্বাভাবিক কথা বলা যাচ্ছে না। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, তোমরা আমাকে বাঁচানোর জন্যে যা করেছ আমি তার জন্যে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সে জন্যে আমি তো মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।

নীষা কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে।

তুমি ক্ৰগো কম্পিউটার নিয়ে কিছু-একটা কথা বলতে চাইছিলে, আমি শুনতে রাজি হই নি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কেন? কারণ তোমরা যাই বল, আমার পক্ষে সেটা বিশ্বাস করা সম্ভব না। আমি মানুষ, এ ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য জিনিস আমি শুধু মানুষের মুখ থেকে শুনতে পারি।

নীষা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তার মুখে হঠাৎ একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠেছে, আস্তে আস্তে বলল, আমি যদি বলি আমি রবোট্রন নই, আমি মানুষ?

কিন্তু তুমি জান সেটা প্রমাণ করা কত কঠিন।

নীষা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, জানি।

তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, নীষা।

না, ভুল বুঝব না। সে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়।

এই সময়ে ভিকি এসে হাজির হল, কিম জুরান।

বল।

লুকাস বলেছে আপনার আইরিশ পাল্টে দিতে। আপনি আসুন আমার সাথে।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, ব্যথা করবে না তো?

ব্যথা? সেটা কী?

আমি হাল ছেড়ে দিলাম।

 

গাড়ি চালাচ্ছে নীষা, আমি পাশে চুপচাপ বসে আছি। দু’ জন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকা খুব কষ্টকর। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, চেষ্টা করেও আর কথা বলতে পারছি না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীষা বলল, আপনার চোখে এখনো ব্যথা আছে?

না, নেই। আমি জানতাম না ব্যাপারটা কষ্টকর।

ইচ্ছে করলে চোখ অবশ করে নেয়া যায়, সাধারণত করা হয় না।

ও। দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কি?

না। হঠাৎ করে আলো এসে পড়লে একটু অস্বস্তি হয়।

ঠিক হয়ে যাবে। নীষা আবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে চুপ করে যায়।

গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে নীষা আবার কথা বলে, আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিংএর ডিস্কটা দেখছিলাম, আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।

আমি ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, কিসের ডিস্ক?

আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার সময় আপনার স্মৃতি একটা ম্যাগনেটিক ডিস্কে জমা রাখা হয়েছিল। সেটাকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেখা যায়। আমি খানিকটা দেখেছি, একটা দৃশ্যে ছিল আপনাকে আপনার মা ঘুম পাড়ানোর জন্যে গান গাইছেন, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। খুব মধুর একটা দৃশ্য। আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।

আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার মা খুব শৈশবে মারা গেছেন, তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই আমার স্মৃতি খুব বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল; স্ক্যানিং করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন আমার আর মায়ের কথা মনে নেই।

নীষা আস্তে আস্তে বলল, আমি খুব দুঃখিত কিম জুরান। অনেক চেষ্টা করেও আমি আপনার শৈশবের স্মৃতিটুকু রক্ষা করতে পারি নি।

তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই।

নীয়া অন্যমনস্ক স্বরে বলল, একজনের জীবনের সবচেয়ে মুধুর স্মৃতি তার শৈশবের, সেটা যদি হারিয়ে যায় তাহলে থাকল কী?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নীম্ন তাহলে সত্যিই মানুষ। রবোট্রনের কোনো শৈশব নেই, কোনো বার্ধক্য নেই। শুধু মানুষের শৈশব আছে, শুধু মানুষ জানে শৈশবের স্মৃতি খুব মধুর স্মৃতি। নীষা রবোট্রন হলে কখনো জানত না শৈশবের স্মৃতি হারিয়ে গেলে সেটা খুব কষ্টের একটা ব্যাপার।

আমি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এই সময় গাড়ির ভেতরে বিবি করে একটা শব্দ হল। নীষা সুইচ টিপে কী-একটা চালু করে দিতেই লুকাসের গলা শুনতে পেলাম। লুকাস বলল, নীষা, একটা ঝামেলা হয়েছে।

কি ঝামেলা? কত বড় ঝামেলা?

অনেক বড়। চার মাত্রার।

নীষা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, চার মাত্রা?

হ্যাঁ, সাবধান। তুমি সাত নম্বরে যোগাযোগ কর। নয় নম্বরে এসো না।

আচ্ছা।

আর শোন, আট নম্বর শেষ।

নীষার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, শেষ?

হ্যাঁ।

সবাই?

হ্যাঁ। রাখলাম নীষা।

নীষা পাথরের মতো মুখ করে সুইচ টিপে ফোনটা বন্ধ করে দিল। আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে নীষা?

নীষা কষ্ট করে একটু হাসে, আমরা ধরা পড়ে গেছি কিম জুরান। আমাদের এখন অনেক বড় বিপদ।

আমার ইচ্ছে হল নীষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই নীষা, আমি তোমাকে রক্ষা করব। আমি জানি তুমি আমার মতো মানুষ, আমার মতো তোমার দুঃখ-কষ্ট আছে, ভয়-ভীতি আছে, আমি তোমাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করব কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।

গাড়িটি একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। নীষা আমার হাতে একটা চাবি দিয়ে বলল, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট তেত্রিশ তলায়, রুম নাম্বার সাত শ’ এগার। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে পৌছে দেব, প্রথম দিন একা একা অচেনা জায়গায় যেতে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এখন আর পারব না। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।

আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

আমাকে?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তোমাদেরকে?

নীষা ম্লান মুখে বলল, আমি ঠিক জানি না আপনি কোন ধরনের সাহায্যের কথা বলছেন, কিন্তু সম্ভবত আপনার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।

তবু যদি আমার কিছু করার থাকে, আমাকে জানিও।

জানাব।

আমার দিকে হাত নেড়ে নীষা গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়, তারপর চোখের পলকে সামনের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকি, অকারণে আমার মন-খারাপ হয়ে যায়।