॥ ৮ ॥
হোটেলে ফিরে ঘরে ঢোকার আগেই নিরঞ্জনবাবু তাঁর ঘর থেকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘একটি ভদ্রলোক আপনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন।’
ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে দেখি একটি মাঝারি হাইটের কালো ভদ্রলোক, বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, ম্যানেজারের উলটো দিকে একটা চেয়ারে বসে আছেন। আমাদের দেখে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমার নাম মতিলাল বড়াল।’
‘আপনি কি জয়চাঁদবাবুর ভাই?’
‘খুড়তুতো ভাই। এখানে একটা সিনেমা হাউস আছে আমার।’
‘চলুন, আমাদের ঘরে চলুন। কথা হবে।’
আমরা চারজন আমাদের ঘরে এলাম। খাটে বসে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘মুক্তোটা এখন কোথায়? জয়চাঁদের কাছে?’
‘না।’
‘তবে?’
‘মগনলাল মেঘরাজের নাম শুনেছেন?’
‘বাবা! তেইশ বছর কাশীতে আছি, আর মগনলালের নাম শুনব না?’
‘মুক্তোটা তাঁরই কাছে আছে।’
‘কিন্তু তিনি ত মুক্তো জমান না। তিনি ত দালাল; কম দামে জিনিস কিনে বেশি দামে বেচেন।’
‘এবারেও তাই করবেন। ধরমপুরের সূরয সিংকে উনি মুক্তোটা বেচবেন।’
‘সূরয সিং এখানে আসছেন?’
‘না। উনি দিল্লিতে। আমার যতদূর ধারণা, মগনলাল দিল্লি যাচ্ছেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।’
‘আপনি কী করছেন?’
‘আমরাও দিল্লি যাবো—যদি তার আগে মুক্তোটা আদায় করতে পারি।’
‘মগনলাল যদি টাকা না পায়, তা হলে আমার ভাই পাবে ত?’
‘সূরয সিং যদি তাঁর কথা রাখেন তা হলে নিশ্চয়ই পাবেন।’
‘আশ্চর্য! এমন একটা ভ্যালুয়েবল জিনিস ফ্যামিলিতে রয়েছে এতকাল ধরে, আর জয় সে কথা একবারও বলেনি। ও একাই জিনিসটাকে আগলে রেখেছে।’
‘আপনি জানতেন না এতে আমার খুব অবাক লাগছে।’
‘আমি পনেরো বছর বয়স থেকে ঘর ছাড়া। তারপর আর সোনাহাটি যাইনি। কাগজে মুক্তোর কথাটা পড়ে জয়কে চিঠি লিখেছিলাম, যে বিক্রি যদি হয় তা হলে আমি যেন একটা শেয়ার পাই। ও লিখল আমি বিক্রি করব না। তারপর কাল একটা চিঠি পেয়েছি তাতে লিখেছে ও মাইন্ড চেঞ্জ করেছে, বিক্রি করবে। এই যে সেই চিঠি।’
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে দিলেন। ফেলুদা সেটা পড়ে ফেরত দিয়ে বলল, ‘আপনাকে ত বিশ হাজার অফার করেছে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট?’
‘আরেকটু বেশি হলে আরো খুশি হতাম, তবে নেই-মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। মুক্তোটা যে মগনলালের কাছে আছে সে বিষয়ে আপনি শিওর?’
‘আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
মতিলালবাবু একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি যদি মুক্তোটা চান, তা হলে ত আপনিই সেটা সূরয সিংকে বিক্রি করবেন?’
‘তা ত বটেই, এবং তা হলেই আপনি আপনার শেয়ার পাবেন।’
‘তা হলে প্রথম কাজ হচ্ছে মগনলালের কাছ থেকে মুক্তোটা আদায় করা।’
‘সে ব্যাপারে আপনি আমাকে হেল্প করতে পারেন?’
‘আপনার কী দরকার?’
‘বেপরোয়া কাজ করতে পারে এমন কিছু লোক।’
মতিলালবাবু কয়েক মুহূর্ত মাথা হেঁট করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘একটা কথা আপনাকে বলি, মিস্টার মিত্তির—আজকাল শুধু সিনেমা হাউস চালিয়ে সংসার চলে না। লোকেরা সব বাড়িতে বসে ছবি দেখে। তাই কিছু একস্ট্রা রোজগারের রাস্তা দেখতে হয়।’
‘মানে গোলমেলে কাজ?’
‘কিন্তু আইন বাঁচিয়ে।’
‘তার মানে আপনার হাতে লোক আছে?’
‘মগনলালের যে রাইট-হ্যান্ড ম্যান—মনোহর—সে আমার দিকে চলে এসেছে। তা ছাড়া আরো দু-একজন লোক আমি দিতে পারি।’
‘ভেরি গুড।’
‘আপনি বলুন কখন কী করতে হবে।’
‘আজ রাত বারোটা। জ্ঞান-বাপীতে চলে আসুন আপনার লোক নিয়ে। আমরা ওখানে থাকব।’
‘ঠিক আছে। রাত বারোটা।’
‘আপনি আবার গোঁয়ার্তুমি করছেন?’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। ফেলুদা তাতে কানই দিল না। সে মতিলালবাবুকে বলল, ‘মগনলালের কিন্তু একটি পালোয়ান ভৃত্য আছে। তার সঙ্গে মোকাবিলা করার কথাটা ভুললে চলবে না।’
মতিলালবাবু হেসে বললেন, ‘আমার মনোহরও পালোয়ান। তার উপরে মাথায় বুদ্ধি রাখে।’
‘তা হলে ওই কথা রইল। রাত বারোটা, জ্ঞান-বাপী।’
মতিলালবাবু উঠে পড়ে বললেন, ‘একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। মুক্তোটা ও কোথায় রাখে জানেন?’ ‘জানি। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘অল রাইট।’
ভদ্রলোক চলে গেলে ফেলুদাও বিছানা থেকে উঠে পড়ে বলল, ‘আমার নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে দু’ মিনিট দরকার আছে। সেটা সেরে দক্ষিণ হস্তের ব্যাপারটা সারা যাবে। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে।’