০৮.
বারান্দায় একটা টেবিল আনা হয়েছে বাংলোর ভেতর থেকে। চেয়ারও আনা হয়েছে কয়েকটা। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর শর্মার রাশভারী চেহারা আরও গম্ভীর হয়েছে। রুটিন ওয়ার্কস হলেও প্রত্যেকটা কাজে তিনি নিষ্ঠা দেখাচ্ছেন প্রচুর। কনেলের স্টেটমেন্ট নেবার জন্যেই বস্তুত অফিস সাজিয়ে বসেছেন। ইতিমধ্যে লাশ চলে গেছে। গোয়েন্দা দফতরের আর সব অফিসার পোড়ো বাংলোর ভেতরটা প্রায় চষে ফেলেছেন। সন্দেহজনক যা কিছু পেয়েছেন, এনে টেবিলে রেখেছেন। বিছানাটা গুটিয়ে মিঃ শর্মার পায়ের কাছে রাখা হয়েছে। ফরেসিক পরীক্ষার জন্যে পাটনা পাঠানো হবে।
শর্মা প্রথমে একটু ভূমিকা করে নিলেন। বললেন–দুঃখের বিষয়, আজ আমাদের এমন একজনের স্টেটমেন্ট নিতে হচ্ছে, যিনি দেশ-বিদেশে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর এবং ক্রিমিনোলজিস্ট হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর সাহায্য আমরা স্বভাবত চাইছি। আশা করি তিনি আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলবেন না এবং তুরুপের তাসটি লুকিয়ে রাখবেন না। অর্থাৎ আমরা কর্নেলের সহযোগিতাই আশা করব। ….
কর্নেল বললেন–অবশ্যই, অবশ্যই।
শর্মা বললেন–আপনি সত্যভবন থেকে রাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিয়ে। এই বাংলোর দিকে ছুটে এলেন। বলে এলেন, দুর্লভ প্রজাতির পাখি উড-ডাক দেখতে পেয়েছেন। এ কি সত্য, কর্নেল সরকার? প্রশ্নটা করে তিনি স্টেনোর দিকে ঘুরলেন।
স্টেনো কাজ শুরু করেছে দেখে খুশি হলেন। কর্নেল জবাব দিলেন– শতকরা একশো ভাগই সত্য। ওই আমগাছে উড-ডাক দেখেছিলুম।
–কোন আমগাছ?
–যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কাছ থেকে আন্দাজ ফুট কুড়ি দূরেবাংলোর উত্তরদিকের দরজার সামনাসামনি। ক্লিয়ার?
–যথেষ্ট। ধন্যবাদ। …শর্মা একটু ঝুঁকে বললেন–কিন্তু আপনাকে আমরা বাংলোর ভেতর পেলুম। এর সঙ্গত ব্যাখ্যা দেবেন? নিশ্চয় আপনার উড ডাককে ফলো করে ঢোকেননি?
কর্নেল হাসলেন। বললেন, না। আমগাছের কাছে আসার পর হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে আবছা মনে হল, কে যেন বাংলোর এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল–আমার সাড়া পেয়ে ঢুকে গেল। তাছাড়া দরজাটা খোলা। এদিকে আপনারা বলেছিলেন, এখানে কেউ থাকে না। পোভড়া বাড়ি। তাই আমি ভেতরে ঢুকলাম।
–ঢুকে কী দেখলেন?
–প্রথম ঘরে একটা বিছানা পাতা রয়েছে। দেয়ালের হুকে একটা কিটব্যাগ ঝুলছে।
–এই বিছানাটা তো?
–হ্যা!
–এবং এই কিটব্যাগ?
হ্যাঁ
বিছানায় অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়েছিল?
–না।
–কিটব্যাগে হাত দিয়েছিলেন কি? খুলেছিলেন?
না।
–বেশ তারপর কী করলেন?
–কোন লোক সত্যি দেখেছি, এ ধারণা দৃঢ় হল! কিন্তু সে আমার সাড়া পেয়ে লুকিয়ে পড়ল কেন এই ভেবে আমি ভেতরে ডানদিকের দরজায় গিয়ে পাশের ঘরটা দেখে নিলুম। জানালা বন্ধ ছিল। আবছা অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। তখন বললুম কে আছ ঘরে? কোন সাড়া পেলুম না। তখন আরও ভেতরে চলে গেলুম।
–কোন ঘরে?
–যে ঘরে লাশটা পড়েছিল।
–গিয়ে কী দেখলেন?
–কোনার দিকে একটি যুবক জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
–সে আপনাকে আক্রমণ করতে এল?
–মোটেই না। আমি তাকে চার্জ করলুম–এখানে সে কী করছে এবং আমাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার কারণ কী? সে বলল…
–এক মিনিট, কর্নেল সরকার। তখনও ডেডবডি দেখতে পাননি?
না। বাইরে থেকে ঘরে চোখের দৃষ্টি খোলে না কিছুক্ষণ, তাই না?
–ঠিক কথা। …বলে শর্মা স্টেনোকে ইশারা করলেন। হুঁ, তারপর?
সে বলল, গতকাল সন্ধ্যায় এই বাংলোয় দূর থেকে সন্দেহজনক ব্যাপার দেখেছিল। ভূতের বাংলো বলে বদনাম থাকায় সে তখন আসতে সাহস পায়নি। তাই, এখন এসেছে। এসে দরজা খোলা এবং ভেতরে বিছানা দেখে আমি যা। যা করেছি, সেও তাই করেছে। তারপর ওই লাশটা চোখে পড়েছে। …তো কথা শুনে তাকাতেই লাশটা আমারও চোখে পড়ল। ওকে জেরা শুরু করলুম। সেইসময় আপনারা এসে গেলেন।
শর্মা বললেন–দেখুন কর্নেল সরকার, আপনার এই স্টেটমেন্ট কোর্ট এভিডেন্স বলে আমরা পেশ করব। হিয়ারসে এভিডেন্স গ্রাহ্য হবে না–অর্থাৎ অপরের কাছে বলতে শুনে আপনি তার কথা যা বলছেন, তার মূল্য আইনত গ্রাহ্য নয়। তবে তদন্তের সুবিধের জন্যে আমরা আপাতত তা শুনতে রাজি। এখন বলুন, ওর কোন পরিচয় আপনাকে দিল কি না?
–হ্যাঁ। বলল তার নাম অভ্র। কলকাতায় থাকে। এক আত্মীয়ের সঙ্গে এখানে গতকাল সকালে এসেছে। চাকরির খোঁজেই এসেছে।
–গত সন্ধ্যায় সে সন্দেহজনক কিছু দেখেছিল বলেছে আপনাকে। আপনি কি জানতে চাননি যে কী সন্দেহজনক ব্যাপার সে দেখেছিল?
–অবশ্যই।
—তার জবাবে কী বলল আপনাকে?
বলল এই ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছিল।
–শুধু এটুকুই?
–হ্যাঁ এটুকুই।
–আলো দেখেই তার সন্দেহজনক ব্যাপার মনে হয়েছিল এবং আপনি তার এই ব্যাখ্যা বিশ্বাস করেছেন?
করেছি। কারণ, কোন পোড়ো ভুতুড়ে বাংলোর মধ্যে আলো দেখলে আমারও সন্দেহ হবে-ওখানে কেউ বা কারা খারাপ মতলবে ঢুকেছে।
শর্মা হাসলেন। দ্যাটস রাইট। আমরা অভ্রের কাছে এবার সব জানতে চেষ্টা করব। কাজেই ও নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। ঘণ্টা দু-তিন পরে আপনার স্টেটমেন্ট আমরা টাইপ করে পাঠাব। পড়ে দেখে সই করে দেবেন।
কর্নেল বললেন–আমি যা বলেছি, তাতে সই না করার কারণ নেই। …
শর্মা স্টেনোকে নির্দেশ দিলেন তাহলে তুমি অফিসে চলে যাও। টাইপ করে ফেলে। স্টেনো যুবকটি চলে গেল। তারপর শর্মা কর্নেলের দিকে ফের ঘুরে বললেন–যাক গে, অফিসিয়াল রুটিন আপাতত শেষ। এবার আসুন কর্নেল সরকার, আমরা বেসরকারিভাবে কিছু আলোচনা করি। আপনি এসব ব্যাপারে শুনেছি একজন বিশেষজ্ঞ। আপনার সহযোগিতা অবশ্যই চাই।
কর্নেল এতক্ষণে চুরুট বের করে ধরালেন। তারপর বললেন বলুন মিঃ শর্মা আপনার জন্য কী করতে পারি?
শর্মা বললেন–আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, বিছানার তলা থেকে কিছু কাগজপত্র আমরা পেয়েছি। সেগুলো আপনাকে দেখাতে পারছি না বলে দুঃখিত। তবে..
মুকেশ সিং বললেন–না দেখানোর কী আছে মিঃ শর্মা? কোন আইনঘটিত বাধা কি আছে?
শর্মা পুলিশসুপারের কথায় বিব্রতবোধ করে বললেন–স্যার, আমরা তো অফসিয়ালি ওঁকে কোন দায়িত্ব দিইনি। তাই বাধা আছে বৈকি। তবে যদি অফিসিয়ালি ওঁর সাহায্য চাওয়া হয়, সব সিক্রেট ডকুমেন্টস–এমন কি ইনফরমেশনও দেখাতে বাধা থাকবে না।
মুকেশ কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল হাত তুলে বললেন, না মিঃ সিং। আমার পক্ষে অফিসিয়ালি কোন কাজের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয় এ কেসে। কারণ আমার মোহনপুরে আসার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিছক ব্যক্তিগত। তাছাড়া এ বয়সে আর ঝামেলাও বরদাস্ত হয় না।
শর্মা হো হো করে হাসলেন। মুকেশ চুপ করে থাকলেন। তারপর শর্মা বললেন–যাক গে। উনি যখন না করছেন, তখন আর ওঁকে বিব্রত করা কেন? আমি শুধু জানতে চাইছিলুম, বিছানা হাতড়ে যে কয়েকটি কাগজ পাওয়া গেছে–তাতে সুনীথ ব্যানার্জি নামে কাবাডিয়া লাখোটিয়াদের কলকাতা অফিসের এক অফিসারের নাম পাওয়া গেছে। অভ্র কি কর্নেলের কাছে ওই ভদ্রলোককে চেনে না বলেছে? দ্যাট ওয়াজ মাই কোশ্চেন।
কর্নেল বললেন–না! বলেনি।
–আর এই দেখছেন একটা জিনের বোতল। আর দুটো গ্লাস খালি রয়েছে। এ সম্পর্কে কি অভ্র কিছু বলেছে আপনাকে?
-না।
ওপাশে বসেছিলেন ডাক্তার দুনিরাম ত্রিবেদী। বললেন–আমি এবার উঠি মিঃ শর্মা। বডি চলে গেছে–আর বসে থেকে কী করব?
শর্মা বললেন–অলরাইট। আসুন।
কর্নেল বললেন–ডঃ ত্রিবেদী! আনঅফিসালি একটা প্রশ্ন–নিছক কৌতূহল।
ডাঃ ত্রিবেদী শর্মার দিকে তাকালেন। শর্মা চোখের কোনায় কী ইশারা দিলেন কর্নেল নিজের চুরুটের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। তারপর ডাঃ ত্রিবেদী বললেনবলুন কর্নেল!
–আপাতদৃষ্টিতে মৃত্যুর কারণ কী বলে মনে হল আপনার?
–ছোরা দিয়ে গলা কাটার ফলে মৃত্যু হয়েছে, তা নিশ্চয় বলব না। কারণ তাতে যতটা রক্ত পড়া দরকার পড়েনি। তার মানে, ডেডবডিতেই ছোরা চালিয়েছে। রাইগর মৰ্টিস শুরু হবার পরই চালিয়েছে। এর উদ্দেশ্য সম্ভবত পুলিশকে বিভ্রান্ত করা।
–আপাতদৃষ্টে মৃত্যুর সময় আন্দাজ করতে পেরেছেন?
–আমার ধারণা, এখন থেকে কুড়ি-একুশ ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে।
তার মানে গতকাল বিকেল চারটের কাছাকাছি?
দ্যাটস্ রাইট।
–মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পেরেছেন কি?
–সম্ভবত পয়েজনিং। গ্লাসটা ফরেনসিক টেস্টে গেলে বোঝা যাবে।
–অনেক ধন্যবাদ ডাঃ ত্রিবেদী! কৌতূহল নিবৃত্ত হয়েছে। আর আমার কোন প্রশ্ন নেই। আচ্ছা মিঃ শর্মা, এবার আমি কি উঠতে পারি?
শর্মা ঘড়ি দেখে বললেন–সরি। আপনাকে আটকে রেখে লজ্জিত বোধ করছি। আপনি রাত জেগে এসেছেন–ক্লান্তির কথা বিবেচনা করা উচিত ছিল।
–ও কিছু না। ..বলে কর্নেল উঠলেন। নিচে আমগাছের তলায় জয়ন্ত দাঁড়য়েছিল। তাকে ডেকে নিয়ে কর্নেল এগোলেন।
পূর্বদিক ঘুরে গেটের কাছে গেছেন, এমন সময় পিছন থেকে মুকেশ সিং ডেকে বললেন-কর্নেল! এক সেকেন্ড। কর্নেল দাঁড়ালেন। মুকেশ কাছে এসে চাপা গলায় বললেন–আশা করি, বুঝতে পেরেছেন যে মিঃ শর্মা এ কেসে আপনাকে এগোতে দিতে চাইছেন না। কিন্তু আমার স্ট্যান্ডপয়েন্ট আলাদা। আপনি প্লিজ ভুল বুঝবেন না। দেখা যাক, শর্মা কতটা কী করতে পারেন। তারপর বরং অফিসিয়ালি আপনার সাহায্য চাইব। শর্মা লোকটি কেমন জানেন? নিজের বুদ্ধির প্রতি বেশি আস্থাশীল। তো কথায় বলে, অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি।
কর্নেল ও মুকেশ হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন–এজন্যে আপনার বিব্রত হবার কারণ নেই। এর জন্যে আমাদের বন্ধুত্বের কোন হানি নিশ্চয় ঘটবে না।
নিশ্চয় না।
–দেন, অ রিভোয়া। আবার দেখা হবে।..
.
সত্যভবনে গিয়ে জয়ন্ত মুখ খুলল। বলল কী কাণ্ড! এই শর্মা ভদ্রলোক আপনাকে কেমন ইনসালটিং টোনে প্রশ্ন করছিল, লক্ষ্য করেছেন? যেন সবজান্তা ভগবান! যত্তোসব।
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন-জয়ন্ত খিদে পেয়েছে। তুমি দেখ, খাবার ব্যবস্থা কতদূর এগোল। আমরা ঝটপট খেয়ে নিয়ে বেরুব।
জয়ন্ত গেলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন। স্নান সেরে নিলেন। …
আধ ঘণ্টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ হল। তারপর জয়ন্তকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। কর্নেলের মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। উত্রাইয়ের রাস্তা যেখানে সমতলে নেমেছে, সেখানে চৌমাথা। রিকশো করে সেখান থেকে উত্তরে চললেন বাজার ও পুরনো বসতি এলাকার দিকে। জয়ন্ত দু-একবার প্রশ্ন করেছিল, কোথায় যাচ্ছি আমরা? জবাব পায়নি।
জয় মা কালী হোটেলের সামনে কর্নেল রিকশো দাঁড় করালেন। রিকশো থেকে নেমে বললেন–জয়ন্ত, তুমি দোতালায় পাঁচ নম্বর ঘরের এক বুড়ো ভদ্রলোককে পাও কি না দেখে এস! জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। নাম তারকনাথ রায়। ঝটপট যাও।
একটু পরে জয়ন্ত হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বলল–আপনার তারকবাবু নাকি সকালে বেরিয়েছেন, ফেরেননি। এদিকে পুলিশ এসে ওর ঘর সার্চ করে গেছে। মালিক ভদ্রলোক বাঙালি। নিজের পরিচয় দিতে হল। তখনই সব বললেন। তারকবাবুর সঙ্গে এক যুবক কলকাতা থেকে–সে নাকি পোড়োবাংলোয়..
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–ছেড়ে দাও। এস, আমরা স্টেশনের দিকে যাই।
–কেন?
–এসই না। কোন প্রশ্ন কোর না এখন। …
দুজনে আবার রিকশো করে স্টেশনে গেলেন। মোটামুটি বড় স্টেশন। ভিড় আছে। কর্নেল কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বললেন–না, তেমন কাকেও দেখতে পাচ্ছি না।
কাকে?
কর্নেল জবাব না দিয়ে বললেন–চলো, রেলকলোনি থেকে ঘুরে আসি।
রেলকলোনি সামান্য দূরে। কর্নেল নোটবই খুলে একটা নাম্বার দেখে নিলেন। তারপর একটা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। একটি কিশোরী মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, কাকে চাই?
–জগমোহনবাবু আছেন কি?
দাদু আছেন। ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে জগমোহনবাবু বেরোলেন। বেরিয়েই সায়েব দেখে হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তিনি ইংরেজ আমলের রেলকর্মী। সেলাম দিতে ভুললেন না। তারপর ইংরেজিতে বললেন–কী ব্যাপার স্যার?
কর্নেল হেসে বাংলায় বললেন–আমি আপনার কাছে এসেছি তারকবাবুর খোঁজে। তিনি আছেন এখানে?
–আপনি কি বাঙালি স্যার?
–আমি তারকবাবুর কথা বলছিলুম জগমোহনবাবু! আমার সময় কম।
–উনি এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন।
–কোথায় গেলেন কিছু বলে গেলেন?
–না তো। উনি উঠেছিলেন এখানেই। তারপর বোধ করি অসুবিধে দেখে জয় মা কালী হোটেলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে একবার এসে গল্পটল্প করে গেলেন। আমার অনেক দিনের বন্ধু স্যার। কিন্তু আপনারা ওঁকে খুজছেন কেন, জানতে পারি স্যার?
বলছি। উনি এখানে হঠাৎ কেন এসেছেন, আপনি কি জানেন? বলেছেন কিছু আপনাকে?
না তো!
কর্নেল বললেন–প্লিজ, লুকোবেন না জগমোহনবাবু। আমরা পুলিশের লোক নই। বন্ধু বলেই মনে করবেন। তারকবাবু আমারও বন্ধু। আমি ওঁকে সাহায্য করতেই এসেছি।
–স্যার…..মানে…
–হ্যাঁ, ওঁর মেয়ে গার্গীর খোঁজেই উনি আমার সাহায্য চেয়েছিলেন।
–আপনি আপনারা কে স্যার?
আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেল এন. সরকার। এর নাম জয়ন্ত চৌধুরী কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার!
জগমোহন তক্ষুনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আপনারা অনুগ্রহ করে ভেতরে এসে বসুন স্যার! এভাবে কি কথা বলা উচিত? না-না, ভেতরে আসুন।
–সময় কম, জগমোহনবাবু। তারকবাবু এখন আপনাকে কী বলে বেরিয়েছেন অন্তত এটুকু জানালেই চলবে। ওঁকে আমার খুবই দরকার।
জগমোহনবাবু চাপা গলায় বললেন-তারকবাবু সাড়ে বারোটার ট্রনে কলকাতায় ফিরে গেলেন। মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই গেছেন।
কর্নেল ও জয়ন্ত একসঙ্গে বলে উঠলেন–গার্গীকে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। গার্গী হঠাৎ বেলা এগারোটা আন্দাজ সময়ে আমার এখানে এল। উসকো-খুসকো চেহারা। আমরা তো হতভম্ব! এত চেষ্টা করেও কিছু বের করা গেল না মুখ থেকে। বলল, অশোকদা আমাকে কলকাতা পৌঁছে দিয়ে আসুন। অশোক আমার ছেলের নাম। অশোক তখন খেতে এসেছে। তারকবাবু আমাদের। সব বলেছিলেন কিনা। অশোক বলল, ঠিক আছে। ব্যস্ত হয়ো না। তবে তোমার বাবাকে খবর দিই। ওঁকে স্টেশনে বসে থাকতে দেখেছি। যাই হোক, অশোক গিয়ে খবর দিল তারককে। তারক তক্ষুনি চলে এল। তারপর সাড়ে বারোটার ট্রেনে কলকাতা চলে গেল। অশোক সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমিও গিয়েছিলুম স্টেশনে।
ধন্যবাদ জগমোহনবাবু। আসি তাহলে!
তারক বা তার মেয়ের কোন বিপদ হবে না তো স্যার?
না, না। বিপদ কিসের? …বলে জয়ন্তের কাঁধে হাত রাখলেন। যাক গে। এস জয়ন্ত।
জগমোহন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাড়ির ভিতর ঢুকলেন।
কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন–গার্গী ফাঁদটা টের পেয়েছিল মনে হচ্ছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। নয়তো এবার ছিল তার পালা।
জয়ন্ত চমকে উঠল। তার মানে?
–গার্গীকে হত্যা করা হত।
–কিন্তু ব্যাপারটা কী?
–ডার্লিং একটু ধৈর্য ধরো। এবং এসো এবার আমরা কাবাডিয়া-লাখোটিয়াদের কারখানাটা দেখে আসি।
জয়ন্ত বলল–আমাদের ঢুকতে দেবে কি? পুলিশ ততো ইতিমধ্যে ওখানে তদন্ত শুরু করেছে। তখন মিঃ শর্মা বললেন না যে থানার ও.সি. ওই কারখানায় রয়েছেন?
–হ্যাঁ। মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন মিঃ শর্মা। তবে চিন্তার কারণ নেই।
দুজনে আবার রিকশো করলেন। রিকশোয় যেতে যেতে জয়ন্ত বলল–শুধু একটা প্রশ্নের জবাব দিন এখন। তারকবাবু–মানে গার্গীর বাবার খবর কে বলল আপনাকে?
-অভ্র।
–তাহলে অভ্র পুলিশকেও এতক্ষণ সব বলে ফেলেছে।
না বলাই উচিত। ওকে আমি সব শিখিয়ে দিয়েছি কী বলবে বা না বলবে।
বলা কঠিন। পুলিশের জেরার চোটে বলে ফেলতে পারে।
–অভ্রকে যতটা বুঝেছি, ও দুর্বলচেতা নয়। সুশিক্ষিত। ওর বাবা পুলিশের একজন বড় অফিসার। এখন রিটায়ার্ড। অভ্রকে বলেছি, নাম-ধাম বলার সময় ওটা বিশেষভাবে উল্লেখ করবে। তাতে কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস আছে। শর্মা একটু ভড়কে যাবে।
–কিন্তু আপনার স্টেটমেন্টে বললেন, অভ্র এক আত্মীয়ের সঙ্গে এসেছে। এতে তারকবাবু জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। পুলিশ জয় মা কালী হোটেল সার্চ করে গেছে।
কর্নেল হাসলেন। –উপায় ছিল না। অভ্র কোথায় উঠেছে, তা ওকে বলতেই হবে এবং সেখানে গিয়ে খোঁজ করলেই পুলিশ জানতে পারবে সব। কাজেই তারকবাবুকেও জড়াতে হয়েছে। কিন্তু শর্মা এখন আর ওঁকে পাচ্ছেন কোথায়? কলকাতায় হানা দেবার আগেই এ কেসের রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। প্রকৃত খুনী ধরা পড়বে।
জয়ন্ত অবাক হয়ে বলল–তার মানে আপনি রহস্যের চাবিকাঠি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে?
না ডার্লিং। এখনও কয়েকঘণ্টার দরকার হবে চাবিকাঠি পেতে। ধৈৰ্য্য ধরে থাকো। কারও সামনে আমাকে বোস প্রশ্ন করে বসো না!
করেছি কি?
না। তবে আগে থেকে সাবধান করিয়ে দেওয়া ভাল। ..
রিকশো বাঁদিকে উত্রাইয়ে নামল। প্রচণ্ড জোরেই চাকা গড়াচ্ছিল। সমতলে পৌঁছে রিকশোওলা বলল কাবাডিয়া লাখোটিয়া কারখানা এহি সাব!
কর্নেল রিকশো থেকে নেমে ভাড়া মেটালেন। জয়ন্ত বলল–বিরাট কারখানা দেখছি!
-হ্যাঁ। এখন একটা কথা শোন জয়ন্ত। তোমার কাছে আইডেনটিটি কার্ড আছে?
–আছে কেন?
–তুমি রিপোর্টার হিসেবেই ঢুকবে। কোন অসুবিধে নেই তোমার! কাবাডিয়াদের কলকাতায় হেড অফিস রয়েছে। স্বভাবত তুমি ওঁদের প্রডাকশান এবং বিদেশে রফতানির তথ্যগুলো নিয়ে ফিচার লিখতে পারো। বুঝলে তো?
বুঝলুম। কিন্তু আপনি?
কর্নেল হেসে বললেন–আমি একজন বিদেশী সাংবাদিক। ক্যামেরা আছে সঙ্গে। লনডন টাইমস্ পত্রিকা থেকে এসেছি। কেমন?
জয়ন্ত উদ্বিগ্ন মুখে বলল–কিন্তু….
–ভয় নেই ডার্লিং। আমার চেহারা, হাবভাব, ইংরেজি উচ্চারণ সম্পর্কে তোমার কি সংশয় হচ্ছে?
–মোটেও না। আপনাকে সায়েব বলেই তো মনে করে সবাই।
–তাহলে চলো।….
গেটে গিয়ে জয়ন্ত তার কার্ড পাঠাল। কার্ড নিয়ে একজন দারোয়ান ভেতরে চলে গেল। সিকিউরিটি ঘরে ঢুকলো সে। তারপর ফিরে এসে বলল–আইয়ে।
দুজনে ভেতরে ঢুকল। সিকিউরিটি-অফিসে মোটে একটা টেবিল এবং একজন মাত্র লোক বসে ছিল। সে ইংরিজিতে বলল–আপনারা দুজনেই কি একই পেপারের লোক?
জয়ন্ত বলল–না। উনি লনডন টাইমস্ থেকে এসেছেন।
শোনামাত্র সায়েবভক্ত লোকটি ফোন তুলে ছোট্ট একটা নাম্বার ডায়াল করল। তারপর কী শুনে নিয়ে ফোন রেখে বলল–আপনারা ভেতরে যান। ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ সুরেশ পটবর্ধন আপনাদের রিসিভ করবেন।
একজন সিকিউরটি গার্ড পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। একদিকে কারখানা অন্যদিকে অফিস। মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সবুজ ঘাস ও ফুলবাগিচা রয়েছে।
সুরেশ পটবর্ধন মধ্যবয়সী লোক। খুব অমায়িক এবং হাসিখুশি মানুষ। কর্নেলের দিকেই মনোযোগটা বেশি দিলেন। খুব কৃতার্থ হয়ে গেছেন, এভাবে কফির অর্ডার দিলেন। ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকল। তারপর এক্সপোর্টের অবস্থা, বিদেশী বাজারে কোথায় ভারতের কী অসুবিধা–এইসব অজস্র ধানাইপানাই শেষ হতে ঘণ্টাখানেক লাগল। জয়ন্ত এবং কর্নেল দুজনেই গম্ভীর মুখে নোট নিলেন। তারপর মিঃ পটবর্ধন বললেন, এবার তাহলে আপনাদের প্রডাকশান সেকশনে নিয়ে যাই। আসুন।
কর্নেল বললেন, আমি কিন্তু আপনাদের এক্সপোর্ট-ওরিয়েন্টেড সাইডটাই দেখতে আগ্রহী। তবে প্রথমে ডিটেলস ফিগার টুকে নিতে চাই। আপনাদের খাতাপত্র থেকে ফিগার পেলেই ভাল হয়। ফিগার কীভাবে ডকুমেন্টেড হয়, তাও দেখতে চাই।
মিঃ পটবর্ধন একটু ভেবে বললেন–তাহলে তো অফিসেই যেতে হয়। আসুন।
পাশের বাড়িটি অফিস। অফিসের একটি চেম্বারে এক্সপোর্ট প্রমোশন অফিসার মিঃ হরাদিত্য কৃষ্ণান এবার রিসিভ করলেন ওঁদের। মিঃ পটবর্ধন ব্যস্ত মানুষ। মিঃ কৃষ্ণানের ওপর সব ভার দিয়ে চলে গেলেন।
কর্নেল ও জয়ন্ত বসল। মিঃ কৃষ্ণান খুশি হয়ে বললেন–আমাদের কলকাতা সদর দফতরের এক্সপোর্ট প্রমোশন অফিসারও এখানে উপস্থিত আছেন! আলাপ করিয়ে দিই। মিঃ সুনীথ ব্যানার্জি। আর মিঃ ব্যানার্জি, ইনি দৈনিক সত্যসেবকের জয়ন্ত চৌধুরী আর…ইয়ে…ইনি লন্ডন টাইমসের মিঃ..
নির্দ্বিধায় কর্নেল বললেন–মিঃ স্ট্যানলি ডেভিস।…