৮. নিরঞ্জনবাবু

॥ ৭ ॥

বেনারসে দ্বিতীয়বার এসেও সেই প্রথমবারের মতোই চমক লাগল। এবারও দশাশ্বমেধ রোডে ক্যালকাটা লজেই উঠলাম। ম্যানেজারও একই রয়েছেন—নিরঞ্জনবাবু। ঘর আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘আপনাদের জন্য ঘর সব সময়ই আছে। ক’দিন থাকবেন?’

‘সেটা আগে থেকে বলতে পারছি না,’ বলল ফেলুদা।

আমরা আগেরবারের মতোই একটা চার বেডের ঘর পেয়ে গেলাম।

ব্রেকফাস্ট বক্সারেই সারা হয়ে গিয়েছিল, তাই খাবার তাড়া নেই। ফেলুদা বলল, ‘আগে কর্তব্যটা সেরে নিই, তারপর খাবার কথা ভাবা যাবে।’

‘আপনি কি একেবারে বাঘের খাঁচায় গিয়ে ঢোকার কথা ভাবছেন?’ লালমোহনবাবু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনি যদি হোটেলে থাকতে চান ত থাকতে পারেন।’

‘না না, সে কি হয়? থ্রী মাস্কেটিয়ার্স—ভুলে গেলে চলবে কেন?’

মগনলালের বাড়ি বিশ্বনাথের গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। আমরা বারোটা নাগাদ রওনা দিয়ে দিলাম। আবার সেই দৃশ্য, সেই শব্দ, সেই গন্ধ। মনে হল এই ক’বছরে একটুও বদল হয়নি, আর কোনোদিনও হবে না। কয়েকজন দোকানদারের মুখও যেন চিনতে পারলাম।

ক্রমে মন্দির ছাড়িয়ে আমরা গলির একটা মোটামুটি নিরিবিলি অংশে পৌঁছে গেলাম। সব মনে পড়ছে। এর পরে ডাইনে ঘুরতে হবে, তারপর বাঁয়ে মোড় নিয়েই আমরা পৌঁছে যাবো মগনলালের বাড়ির রাস্তায়।

‘আপনি কী বলবেন সেটা ঠিক করে নিয়েছেন?’ লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

ফেলুদা বলল, ‘আমি যে সব সময় আগে থেকে ভেবে কাজ করি তা নয়। একেকটা বিশেষ মুহূর্তে একেকটা বিশেষ আইডিয়া এসে যায়। তখন সেইটে প্রয়োগ করি।’

‘এর বেলাও তাই করবেন?’

‘সেই রকমই ত ইচ্ছে আছে।’

মগনলালের বাড়ির সদর দরজার দু’পাশে এখনো তলোয়ারধারী দুই প্রহরীর ছবি, এই ক’বছরে রঙটা একটু ফিকে হয়ে গেছে।

আমরা দরজা দিয়ে ঢুকে একতলার উঠোনে পৌঁছলাম। কেউ কোথাও নেই। দু’বার ‘কোই হ্যায়’ বলেও ফেলুদা জবাব পেল না।

‘চলুন উপরে,’ বলল ফেলুদা। ‘লোকটার সঙ্গে যখন দেখা করতেই হচ্ছে, তখন নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ত কোনো লাভ নেই।’

আবার সেই ছেচল্লিশ ধাপ সিঁড়ি, আবার সেই তিন তলায়।

দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকতে একজন লোক সামনে পড়ল। সে খৈনি ডলছিল, আমাদের দেখে একটু অবাক হয়ে হিন্দিতে প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কাকে চাইছেন?’

‘মগনলালজী আছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘আছেন, তবে উনি এখন খেতে বসেছেন। আপনারা ওঁর ঘরে অপেক্ষা করুন। চলুন আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।’

আমরা আবার অনেকদিন পরে মগনলালের ঘরে এসে ঢুকলাম। এই ঘরেই লালমোহনবাবুকে নাকাল করেছিলেন ভদ্রলোক। সে ঘটনা কোনোদিনও ভুলব না। লালমোহনবাবুকে নিয়ে রগড় করার একটা বাতিক লোকটার মজ্জাগত।

কাঠমাণ্ডুতেও লালমোহনবাবুর চায়ে এল. এস. ডি. মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে অবিশ্যি লালমোহনবাবুর খুব ক্ষতি হয়নি, কিন্তু হবার সম্ভাবনা ছিল পুরোমাত্রায়।

আমরা তিনজন সোফায় বসার পরেই জটায়ু চাপা স্বরে বললেন, ‘কী বলবেন ঠিক করে ফেলুন মশাই। এইবেলা ঠিক করে ফেলুন। আমার মাথায় ত কিছুই আসছে না।’

‘আপনার মাথা দিয়ে ত আর এ মামলা চালাচ্ছি না আমি। আপনি চুপচাপ দেখে যান।’

‘ইয়েটা সঙ্গে আছে?’

ইয়ে মানে ফেলুদার রিভলভার সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না।

‘আছে। নার্ভটাকে ঠাণ্ডা করুন। এসব সিচুয়েশনে সঙ্গে একজন নাভার্স লোক থাকলে বড় অসুবিধা হয়।’

কোত্থেকে যেন একটা ঢোলকের শব্দ আসছে, ঘরের দেয়াল-ঘড়ি টিক্ টিক্ করছে, নাকে রান্নার গন্ধ এসে ঢুকছে, আমরা চুপচাপ বসেই আছি ত বসেই আছি।

‘একটা লোকের খেতে এত সময় লাগে?’ বিড়বিড় করে বললেন লালমোহনবাবু।

কথাটা বলার মিনিট খানেকের মধ্যে একজন লোক এসে ঘরে ঢুকল। সে যে মুগুর ভাঁজা পালোয়ান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ফেলুদার সামনে গিয়ে বলল, ‘খাড়া হো জাইয়ে।’

‘কিঁউ?’ ফেলুদার প্রশ্ন।

‘সার্চ হোগা।’

‘কে হুকুম দিয়েছে তোমায়?’

‘মালিক।’

‘মগনলালজী?’

‘হাঁ’

ফেলুদা তবু বসে আছে দেখে লোকটা তার দু’হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে অনায়াসে তাকে দাঁড় করালো। ফেলুদা আর কোনো আপত্তি করল না, কারণ এ লোকটার সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠা পাঁচটা ফেলুদারও সাধ্যি নেই।

লোকটা চাপড় মেরে প্রথমেই ফেলুদার রিভলভারটা বার করল। তারপর মানি ব্যাগ আর রুমাল।

এবার ফেলুদাকে ছেড়ে লোকটা লালমোহনবাবুকে ধরল। লালমোহনবাবু অবিশ্যি ফেলুদার সার্চ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছেন হাত মাথার উপর তুলে।

আমাদের তিনজনের সার্চ শেষ হবার পর লোকটা রিভলভার ছাড়া আর সব কিছু ফেরত দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপরেই বাইরে থেকে একটা গলা খাঁকরানির আওয়াজ পেলাম। এ আমাদের খুব চেনা গলা।

‘এ ভাবে আমার পিছে লাগলেন কেন, মিস্টার মিটার?’ গদিতে বসে মগনলাল প্রশ্ন করলেন। ‘আপনার এখুনো শিকষা হয়নি? কী লাভ আছে আমার পিছে পিছে ঘুরে? আপনি ত সে মোতি আর ফিরত পাবেন না।’

‘আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করেন—তাই না, মগনলালজী?’

‘সে ত আপনিও করেন। বুদ্ধি না থাকলে আর এতদিন বেওসা চালাচ্ছি? বুদ্ধি না থাকলে আর আপনার ঘর থেকে মোতি বার করে আনতে পারি?’

‘কী মোতি?’

‘পিংক পার্ল!’ মগনলাল চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘কী মোতি সেও কি আপনাকে বলে দিতে হবে?’

‘কে বলল পিংক পার্ল?’ ধীর কণ্ঠে বলল ফেলুদা। ‘ইট্‌স এ হোয়াইট পার্ল। তাও খাঁটি মুক্তো নয়, কালচারড পার্ল—যার দাম অনেক কম। আপনাকে ভাঁওতা দেবার জন্য ওতে পিংক রং করা হয়েছে। আসল মুক্তো চলে গেছে যার জিনিস তার কাছে। অত বেশি বুদ্ধিমান ভাববেন না নিজেকে, মগনলালজী।’

আমি অবাক হয়ে ফেলুদার কথা শুনছি। ও কী করে এত সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে? কোত্থেকে ওর এত সাহস হচ্ছে? লালমোহনবাবু দেখলাম মাথা হেঁট করে রয়েছেন।

‘আপনি সচ বলছেন?’

‘আপনি কীভাবে যাচাই করতে চান করে দেখুন।’

মগনলাল তার সামনে রাখা একটা রুপোলি কলিং বেলে চাপড় মারলেন। পর মুহূর্তেই সেই পালোয়ান লোকটা আবার এসে ঢুকল।

‘সুন্দরলালের দোকান থেকে ওকে ডেকে আনো। বলো মগনলালজী ডাকছেন। তুরন্ত্‌।’ ভৃত্য চলে গেল।

কিছুক্ষণ সকলেই চুপ। মগনলাল একটা পানের ডিবে থেকে পান নিয়ে মুখে পুরলেন। তারপর ডিবে বন্ধ করার সময় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।

‘রবীন্দরনাথ টেগোরের গান আপনি জানেন?’

এবার মগনলালের চাউনি থেকে বুঝলাম প্রশ্নটা করা হয়েছে জটায়ুকে।

‘কী আঙ্কল? জবাব দিচ্ছেন না কেন? আপনি বাঙালি আর আপনি টেগোর সং জানেন না?’

লালমোহনবাবু মাথা নেড়ে না বোঝালেন।

‘সচ্‌ বোলছেন?’

এবারে মাথা নড়ল উপর-নিচে। অর্থাৎ হ্যাঁ। ভদ্রলোক এখনো মাথা তুলতে পারছেন না।

এবার ফেলুদা বলল, ‘উনি গান করেন না, মগনলালজী।’

‘করেন না ত কী হল? এখুন করবেন। দশ মিনিট লাগবে সুন্দরলালের এখানে আসতে। সেই টাইমে টেগোর সং হবে। আঙ্কল উইল সিং। আসুন আঙ্কল—গদিপর বসুন। সোফায় বসে কি গান হয়? গেট আপ, গেট আপ! না গাইবেন ত বড় মুশকিল হবে।’

‘আপনি বার বার ওঁকে নিয়ে এমন তামাসা করেন কেন বলুন ত?’ বেশ রেগে গিয়েই বলল ফেলুদা। ‘উনি আপনার কী ক্ষতি করেছেন?’

‘নাথিং। দ্যাট ইজ হোয়াই আই লাইক হিম। উঠুন আঙ্কল। উঠুন, উঠুন!’

নিরুপায় হয়ে লালমোহনবাবু সোফা ছেড়ে উঠে গদিতে বসলেন।

‘ভেরি গুড। নাউ সিং।’

আর কোনোই রাস্তা নেই। তাই ভদ্রলোক সত্যিই গান ধরলেন। ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।’

মগনলাল তাকিয়ায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে পাশে রাখা ক্যাশবাক্সের উপর তাল ঠুকে তারিফ করতে লাগলেন। এই অদ্ভুত গানের তারিফ হতে পারে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

প্রায় পাঁচ মিনিট একটানা গেয়ে লালমোহনবাবু আর পারলেন না। বললেন, ‘বাকিটা জানি না।’

‘দ্যাট ইজ এনাফ,’ বললেন মগনলাল। ‘এবার সোফায় গিয়ে বসুন।’

লালমোহনবাবু সোফায় বসতেই ঘরে লোকের প্রবেশ হল—সেই পালোয়ান চাকর, আর একজন পুরু চশমাপরা বুড়ো।

‘আইয়ে সুন্দরলালজী,’ বললেন মগনলাল। ‘আপনি এত বুঢ্‌ঢা হুয়ে গেছেন এই ক’বছরে তা ভাবতে পারিনি। একটা কাজের জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।’

সুন্দরলাল গদিতে বসলেন। মগনলাল তাঁর ক্যাশবাক্স খুলে তার থেকে ভেলভেটের বাক্সটা বার করলেন। তারপর বাক্স থেকে মোতিটা বার করে সুন্দরলালকে প্রশ্ন করলেন, ‘গুলাবী মোতি হয় সেটা আপনি জানেন?’

‘গুলাবী মোতি?’

‘হা।’

‘সেরকম ত শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখিনি।’

‘আপনি পঞ্চাশ বছর হল দোকান চালাচ্ছেন আর গুলাবী মোতি চোখে দেখেননি? দেখুন এইটে দেখুন। দেখে বলুন ত এটা সচ্চা না ঝুঠা?’

সুন্দরলাল মুক্তোটা হাতে নিলেন। দেখলাম তাঁর হাত কাঁপছে। চোখের খুব কাছে এনে মুক্তোটাকে মিনিটখানেক ধরে দেখে সুন্দরলাল বললেন, ‘হাঁ, এতো সত্যিই দেখছি গুলাবী মোতি। অ্যায়সা কভী নেহি দেখা।’

‘তা হলে এটা খাঁটি?’

‘ওইসাই তো মালুম হোতা।’

‘এবার মোতিটা দিয়ে দিন আমাকে।’

সুন্দরলাল মুক্তোটা ফেরত দিয়ে দিল।

‘এবার আপনি যেতে পারেন।’

সুন্দরলাল ঘর থেকে বেরোনর পর মগনলাল ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি ঝুট বাত বলেছেন, মিস্টার মিটার। এই পার্ল জেনুইন।’

‘এটা কি আপনি সূরয সিংকে বিক্রি করতে চান?’

‘আমি কী করি না-করি তাতে আপনার কী?’

‘আপনি ত এখান থেকে দিল্লি যাবেন?’

‘হাঁ, যাবো।’

‘ওখানে ত সূরয সিং রয়েছেন।’

‘সে খবর আমি পেপারে পড়েছি।’

‘আপনি কি বলতে চান তাঁর সঙ্গে আপনার কোনো কারবার নেই?’

‘আমি কিছুই বলতে চাই না, মিস্টার মিটার। দ্য পিংক পার্ল চ্যাপটার ইজ ক্লোজড। আমি ওই নিয়ে আপনার সঙ্গে আর কোনো কথা বলব না।’

‘ঠিক আছে, আমি উঠছি। আমার যে জিনিসটা আপনার কাছে রয়েছে সেটা দয়া করে ফেরত দিন।’

মগনলাল আবার কলিং বেল টিপলেন। পালোয়ান এসে দাঁড়াল।

‘এঁকে এর রিভলভার ওয়াপিস দিয়ে দাও।’

পালোয়ান আজ্ঞা পালন করল, ফেলুদা আর আমরা দু’জন উঠে পড়লাম।

মগনলালের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেমন লাগছে?’

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ‘লোকটা কী করে যে একটা মানুষের উইক পয়েন্ট ধরে ফেলে! —পাঁচ মিনিট ধরে একটানা রবীন্দ্রসংগীত জীবনে এই প্রথম গাইলাম।’

একতলায় এসে ফেলুদা বলল, ‘আজকে যে একটা খুব জরুরি কাজ হয়ে গেল সেটা কি বুঝতে পেরেছেন, লালমোহনবাবু?’

‘জরুরি কাজ?’ ভদ্রলোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘ইয়েস স্যার,’ বলল ফেলুদা। ‘জেনে গেলাম ও মুক্তোটা কোথায় রাখে।’

‘আপনি কি ওটা আবার আদায় করার তাল করছেন?’

‘ন্যাচারেলি!’