॥ ৮ ॥
দু’দিন পরে অর্থাৎ রবিবার, টাইম্সে ফেলুদার বিজ্ঞাপন বেরোল। আর আশ্চর্য ব্যাপার—তার পরদিনই বিজ্ঞাপনের ফল পাওয়া গেল। সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় ফেলুদার ফোন বেজে উঠল। মিনিটখানেক কথা বলে ফেলুদা ফোনটা রেখে বলল, ‘অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজের লোক। নাম আর্চিবল্ড ক্রিপ্স। বলল ওর কাছে পিটার ডেক্সটরের খবর আছে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই এসে যাচ্ছে লোকটা। রগড় হতে পারে। তুই লালমোহনবাবুকে খবর দে।’
লালমোহনবাবু তৈরি ছিলেন, এসে বললেন এত তাড়াতাড়ি রেজাল্ট পাওয়া যাবে সেটা উনি ভাবতেই পারেননি।
সোয়া ন’টার সময় দরজায় টোকা পড়ল। মৃদু নয়, বেশ জোরে। আমি দরজা খুললাম। রুক্ষ গলার সঙ্গে মানানসই রুক্ষ চেহারাওয়ালা একজন ভদ্রলোক ঢুকে এলেন। তাঁর দৃষ্টি প্রথমে গেল জটায়ুর দিকে।
‘আর ইউ মিস্টার মিটার?’
‘নো নো। হি, হি।’
লালমোহনবাবু ফেলুদার দিকে দেখিয়ে দিলেন। ক্রিপ্স সাহেব একটা চেয়ার টেনে এনে তাতে বসে ফেলুদার দিকে কঠোর দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট পিটার ডেক্সটর?’
‘প্রথমত, সে এখন কোথায়?’
‘হি ইজ ইন হেভ্ন।’
‘তার মৃত্যু হয়েছে শুনে আমি দুঃখিত। কবে হল?’
‘আজ নয়। অনেক কাল আগে। হোয়েন হি ওয়জ ইন কেমব্রিজ।’
‘উনি কেমব্রিজে পড়তেন?’
‘হ্যাঁ, আর মূর্খের মতো ক্যাম নদীতে নৌকো চালাতে গিয়েছিল।’
‘মূর্খের মতো কেন?’
‘কারণ ও সাঁতার জানত না। নৌকো উলটে গিয়ে জলে পড়ে তার মৃত্যু হয়।’
‘ওঁরা ত শুনেছি অনেক ভাইবোন ছিলেন।’
‘ফাইভ ব্রাদার্স অ্যান্ড টু সিসটারস। তার মধ্যে শুধু দু’জনের খবর জানি—বড় ছেলে জর্জ আর ছোট ছেলে রেজিন্যাল্ড। জর্জ আর্মিতে ছিল, ইন্ডিপেন্ডেন্সের পর এখানে চলে আসে। বলত শিখ আর গুর্খা ছাড়া ও দেশের সবাই হয় বদমাইস না হয় অকর্মণ্য। ডেক্সটরদের কেউই ইন্ডিয়ান নিগারদের পছন্দ করে না।’
‘নিগার? নিগার ত ভারতবর্ষে নেই। ইন ফ্যাক্ট, আমেরিকাতেও আজকাল নিগ্রোদের আর কেউ নিগার বলে না।’
ফেলুদার মুখ গম্ভীর। বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভারতীয়দের সম্বন্ধে আপনার ধারণাও ডেক্সটরদের মতোই।’
‘তাত বটেই। একশোবার।’
‘তা হলে আপনার কাছ থেকে আর কোনো ইনফরমেশন আমি চাই না। যেটুকু দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।’
এই গরম কথাগুলো শুনে ক্রিপ্স সাহেব যেন একটু নরম হলেন। বললেন, ‘আই অ্যাম সরি ইফ আই হ্যাভ অফেন্ডেড ইউ। রেজিন্যাল্ডের কথাটা বলেই আমি উঠছি। রেজিন্যান্ড ওদের ছোট ভাই। সে ইন্ডিয়াতে একটা চা বাগানে আছে, কিন্তু বেশিদিন থাকবে না।’
ফেলুদা চেয়েই রয়েছে ভদ্রলোকের দিকে, মুখে কিছু বলছে না।
‘বিকজ হি হ্যাজ ক্যানসার,’ বলে চললেন ক্রিপ্স। ‘ও গিয়েছিল শুধু পয়সা রোজগারের জন্য। ভারতবর্ষের উপর ওর কোনো মমতা নেই।’
ফেলুদা উঠে দাঁড়াল।
‘থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার ক্রিপ্স। আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।’
ক্রিপ্সও কেমন যেন বোকা-বোকা ভাব করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হঠাৎ ‘গুড ডে’ বলে সটান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
‘কী জঘন্য লোক মশাই,’ দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন লালমোহনবাবু। ‘তবে আপনি লন্ডনে বসে একজন সাহেবকে যে ভাবে দাবড়ানি দিলেন, তার কোনো জবাব নেই।’
‘যাই হোক,’ বলল ফেলুদা, ‘এর কাছ থেকে অন্তত একটা জরুরি তথ্য পাওয়া গেল। পিটার ডেক্সটর কেমব্রিজে ছিলেন এবং নৌকোডুবি হয়ে মারা যান।’
‘এখন কী করা?’
‘সময় হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে,’ বলল ফেলুদা। ‘পরশু আমাদের ফেরার দিন, ভুলবেন না। আজই দুপুরে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সরে কেমব্রিজ যাত্রা।’
আমরা দেড়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
পিকাডিলি সার্কাস থেকে প্রথমে লিভারপুল স্ট্রীটে গিয়ে সেখানকার রেল স্টেশন থেকে সাধারণ ট্রেন ধরে যেতে হয় কেমব্রিজে। পৌঁছতে লাগে এক ঘণ্টা। এখানে ট্রেন খুব দ্রুত চলে, আর চড়েও আরাম কারণ কামরাগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।
সুন্দর শহর কেমব্রিজ, তার মধ্যে ইউনিভার্সিটি দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে। পাশাপাশি অনেকগুলো কলেজ আছে—ফেলুদা বলল আটশটা—তবে নিশানাথবাবু বলে দিয়েছিলেন রঞ্জন মজুমদার ট্রিনিটি কলেজে পড়তেন, তাই আমরা সেখানেই খোঁজ করলাম। জানা গেল যে ১৯৫১-তে রঞ্জন মজুমদার ইতিহাস পড়তে ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন, এবং তার সঙ্গে একই ক্লাসে ছিল পিটার ডেক্সটর।
‘এই পিটার ডেক্সটর ত নৌকাডুবি হয়ে মারা যান?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। যে ভদ্রলোক আমাদের সাহায্য করছিলেন—নাম মিস্টার টেলর—তিনি বললেন যে তিনি মাত্র সাত বছর হল জয়েন করেছেন, কাজেই পুরোন ঘটনা কিছুই জানেন না।
‘তবে এখানে একজন খুব পুরোন গার্ডনার আছে, চল্লিশ বছর হল এখানে কাজ করছে, নাম হুকিন্স। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’
ফেলুদা বাগানেই হুকিন্সকে পাকড়াও করল। গায়ের চামড়া এখনো বেশ টান-টান, তবে চুল সব সাদা। তাও দিব্যি কাজ করে চলেছে।
‘তুমি এখানে অনেকদিন আছ, তাই না?’ ফেলুদা মোলায়েম সুরে প্রশ্ন করল।
‘ইয়েস,’ বলল হুকিন্স। ‘তবে আর বেশিদিন নয়, কারণ আমার রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেছে। আমার বয়স তেষট্টি হল, কিন্তু এখনো পরিশ্রম করতে পারি। আমার বাড়ি চ্যাটওয়র্থ স্ট্রীটে—এখান থেকে দু’ মাইল। রোজ হেঁটে আসি, হেঁটে ফিরি।’
‘ছাত্রদের সঙ্গে তোমার কিরকম সম্পর্ক?’
‘খুব ভালো। দে অল লাভ মি। আমার সঙ্গে এসে গল্প করে, ঠাট্টা তামাসা করে, আমাকে সিগারেট দেয়, বিয়ার দেয়। আই গেট অ্যালং ভেরি ওয়েল উইথ দেম।’
‘পুরোন ঘটনা মনে থাকে তোমার? স্মরণশক্তি কেমন?’
‘হালের ঘটনা ভুলে যাই, কিন্তু পুরোন কিছু কিছু মনে আছে। অবিশ্যি কত পুরোন তার উপর নির্ভর করে।’
‘মনটাকে চল্লিশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?’
‘হোয়াই?’
‘তোমাদের এখানে ক্যাম নদীতে নৌকো চালায় না ছেলেরা?’
‘শুধু ছেলেরা কেন, মেয়েরাও চালায়।’
‘কোনো নৌকোডুবির ঘটনা মনে পড়ছে?’
হুকিন্স মাথা নেড়ে গলাটাকে ভারি করে বলল, ‘ইট্স এ স্যাড স্টোরি, স্যাড স্টোরি। একটি ইংরেজ ছেলে, নাম মনে নেই। নৌকো উলটিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। সাঁতার জানত না।’
‘সে কি একাই ছিল?’
‘একা? না বোধহয়। সঙ্গে বোধহয় আরেকজন ছিল।’
‘ঠিক করে ভেবে বলত।’
‘অত দিন আগের কথা ত—তাই ভালো মনে পড়ছে না।’
‘ওই ইংরেজ ছেলেটির একজন ভারতীয় বন্ধু ছিল না?’
‘আই থিংক হি হ্যাড।’
‘একটু চেষ্টা করে মনে করে দেখ ত—সেই ভারতীয় ছেলেটিও নৌকোয় ছিল কি না।’
‘মে বি হি ওয়াজ—মে বি হি ওয়াজ…’
‘ওই ঘটনার সময় তুমি কোথায় ছিলে?’
‘আমি একটা ঝোপের ধারে বসে বিশ্রাম করছিলাম। হয়ত সিগারেট খাচ্ছিলাম।’
‘ঘটনাটা তুমি দেখেছিলে?’
‘হেল্প-হেল্প চিৎকার শুনে আমি নদীর ধারে যাই। গিয়ে দেখি এই কাণ্ড।’
‘তা হলে ত তোমার মনে থাকা উচিত নৌকোতে আর কেউ ছিল কি না।’
হুকিন্স মাথা হেঁট করে যেন ভাববার চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘নাঃ—এর বেশি আর মনে করতে পারছি না। আই অ্যাম সরি। এইটুকু যে মনে আছে তার একটা কারণ ওই একই দিনে আমি বিয়ে করি। ম্যাগি। দ্য বেস্ট ওয়াইফ ওয়ান কুড হ্যাভ।’