চিতাবাঘের উৎপাত
কুট্টিমামা বললেন, তাই তো! আবার চিতাবাঘের উৎপাত শুরু হল।
সর্দার বললে, ওদিকের জঙ্গলে বাঘ বড় বেড়ে গেছে বাবু। মাসখানেক ধরেই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এখন একেবারে বাগানে ঢুকে পড়েছে। আর আসতে যখন শুরু করেছে। তখন সহজে ছাড়বে না!
কুট্টিমামা মাথা নেড়ে বললেন, দু-একটা মারলে চলছে না। আচ্ছা, এখন যাও। দেখি কাল সকালে কী করা যায়।
সর্দার চলে গেল। কুট্টিমামা বললেন, তোমরাও সব শুয়ে পড় গে। আর প্যালারাম—এবার ভালো করে জানালা বন্ধ করে দিয়ো।
আমরা সব চুপচাপ চলে এলুম। হাবুলের বকবকানি, টেনিদার চালিয়াতি আর ফুট কাটা একদম বন্ধ। সব একেবারে স্পিকটি নট। আর ছোট্টলাল? সে তো তক্ষুনি—আঁই দাদা হো–বলে একটা কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়েছে।
খড়খড়ি আর কাচের জানালা দুটোই বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি, ক্যাবলা বললে, খড়খড়িটা খুলে রাখ না প্যালা! বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ দেখা যাবে। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে রে!
আমি দাঁত-মুখ খুব বিচ্ছিরি করে বললুম, থাক—আর পাকিতিক দিরিশ্যি দেখে দরকার নেই! চাঁদের আলোয় খুশি হয়ে বাঘ এসে যদি জানালার বাইরে দাঁত খিঁচোয়?
—আমরাও বাঘকে ভেংচে দেব।
—আর যদি জানালা ভেঙে ঢোকে?
—আমরা দরজা ভেঙে পালিয়ে যাব!
দেখেছ ইয়ার্কিটা একবার! বাঘ যেন আমাদের পটলডাঙার একাদশী কুণ্ডু-পেছন থেকে হাঁড়ি ফাটল হাঁড়ি ফাটল বলে চেঁচিয়ে চটিয়ে দিলেই হল!
বললুম, বেশি ফেরেব্বাজি করিসনে ক্যাবলা, ঘুমোত বলে আমি দুটো জানালাই শক্ত করে এঁটে দিলুম। ঘুমোতে চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুম কি ছাই আসে? খালি বন্ধ জানালায় চোখ পড়ছে। এই মনে হচ্ছে বাইরের খড়খড়ি কেউ কড়কড় করে আঁচড়াচ্ছে, আবার যেন শুনছি ঘাসের উপর দিয়ে কী সব হাঁটছে হুমহাম করে কী একটা ডেকেও উঠল। এদিকে আবার নাকের ডগায় দু-তিনটে মশা বিন-বিন করছে। ক্যাবলাটা তো দেখতে-না-দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কী করি? মশারি একটা আছে—ফেলে দেব? কিন্তু মশারির ভেতরে আমি একদম শুতে পারি না—কেমন দম আটকে আসে।
তা হলে মশাই মারি—কী আর করা? কিন্তু চেষ্টা করে দেখলুম, কিছুতেই মারা যায় না। নাকের ওপর চাঁটি হাঁকড়েছি তো কানের কাছে গিয়ে পোঁ করে উঠল। আবার কণটি প্রদেশ আক্রমণ করেছি তো শত্রুবাহিনী নাসিকে এসে উপস্থিত। কাঁহাতক পেরে ওঠা যায়? আধঘণ্টা ধরে নিজেকে সমানে চাঁটিয়ে এবং ঘুষিয়ে-শেষতক হাল ছেড়ে দিলুম। বললুম, যাও না বাপুজঙ্গলে যাও না! বাঘ আছে-হাতি আছে, অনেক রক্ত আছে তাদের গায়ে। যত খুশি খাও গে! আমি পটলডাঙার প্যালারাম—সবে পালা-জ্বরের পিলেটা সেরেছে—আমার রক্তে আর কী পাবে? খানিক পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল বই তো নয়!
যেই বলেছি—অমনি কী কাণ্ড!
হুড়মুড়িয়ে জানালাটা ভেঙে পড়ল। আর কী সর্বনাশ! বাইরে বাইরে যে একটা হাতি! পাহাড়ের মতো প্রকাণ্ড-জমাট অন্ধকার দিয়ে তৈরি তার শরীর! দুটো কুতকুতে চোখে আমার দিকে খানিক তাকিয়েই কেমন যেন মিটমিট করে হাসল। তারপরেই করেছে কী—হাত-দশেক লম্বা একটা গঁড় বাড়িয়ে কপাৎ করে আমার একটা লম্বা কান টেনে ধরেছে।
এতক্ষণ তো আমি পান্তুয়ার মতো পড়ে আছি কিন্তু এবার আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া! বাপ-রে–মা-রে-মেজদা রে—পটলডাঙা রে–বলে রাম-চিৎকার ছেড়েছি।
আর তক্ষুনি কানের কাছে ক্যাবলা বললে, কী আরম্ভ করেছিস প্যালা? ভিতুর ডিম কোথাকার!
বললুম, হা-হা-হাতি!
ক্যাবলা বললে, গোদা পায়ের লাথি!
চমকে চোখ মেলে চাইলুম। কোথায় হাতি—কোথায় কী। ঘরভর্তি ঝকঝকে সকালের আলো। আর ক্যাবলা কোত্থেকে একটা পাখির পালক কুড়িয়ে এনে আমার কানের ভেতর দিতে চেষ্টা করছে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। আর পালকটা আমার কানে ঢোকাতে না পেরে ভারি। ব্যাজার হল ক্যাবলা। বললে, কোথায় রে তোর হা-হা-হাতি? স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি?
–বকিসনি! আমার কানে পালক দিচ্ছিলি কেন?
—তোকে জাগাবার জন্যে। কিন্তু পারলুম কই? তার আগেই তো জেগে গেলি—ইস্টুপিড কোথাকার!
—মারব এক থাপ্পড় বলে আমি রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম।
সকালের চা এবং সেইসঙ্গে লুচি-আলুভাজারসগোল্লার টা বেশ ভালোই হল তারপর কুট্টিমামা চলে গেলেন ফ্যাক্টরিতে। আমাদের বলে গেলেন, তোমরা বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াও—ভয়ের কিছু নেই। তবে জঙ্গলের দিকে যেয়ো না। চিতাবাঘের উৎপাত যখন শুরু হয়েছে, তখন সাবধান থাকাই ভাল।
টেনিদা বললে, হেঃ–বাঘ! জানো কুট্টিমামা–রাত্তিরেই কেমন একটু বেকায়দা হয়ে। যায়। কিন্তু দিনের বেলায় বাঘ একবার আসুক না সামনে। এমন একখানা আন্ডারকাট বসিয়ে দেব–
হাবুল বললে, আপনার কালীসিঙ্গির মহাভারতের ধিক্যাও জব্বর!
কুট্টিমামা অবাক হয়ে বললেন, আমার কালীসিঙ্গির মহাভারত। তার মানে?
হাবুল সবে বলতে যাচ্ছে; সেই যে মহাভারতের একখানা পেল্লায় ঘাও নি মাইর্যা—
আর বলতে পারল না। তার আগেই টেনিদা ওর পিঠে কটাং করে একটা জবরদস্ত চিমটি কেটে দিয়েছে।
হাবুল হাউ-মাউ করে উঠল : খাইসে, খাইসে। কুট্টিমামা আরও অবাক হয়ে বললেন, খাইছে। কীসে খেল তোমাকে?
-–টেনিদা!
টেনিদা তাড়াতাড়ি বললে, না মামা, আমি ওকে খাচ্ছি না। ওটা এত অখাদ্য যে বাঘে খেলেও বমি করে দেবে। ওর পিঠে একটা ডেয়ো পিঁপড়ে কামড়াচ্ছিল, সেটাকে ফেলে দিলুম কেবল। তুমি যাও–নিজের কাজে যাও।
খানিকক্ষণ কেবল বোকা-বোকা হয়ে তাকিয়ে দেখে কুট্টিমামা চলে গেলেন।
টেনিদা এবার হাবুলের মাথায় কুটু করে একটা ছোট্ট গাঁট্টা দিলে। বললে, তোকে ও-সব বলতে আমি বারণ করিনি? জানিসনে—নিজের বীরত্বের কথা বললে কুট্টিমামা লজ্জা পায়?
–আর তোমার সব চালিয়াতি ফাঁস হয়ে যায়! টুক করে কথাটা বলেই ক্যাবলা তিন হাত লাফিয়ে সরে গেল। টেনিদা একটা চাঁটি হাঁকিয়েছিল, সেটা হাওয়ায় ঘুরে এল।
যাই হোক, আমরা চার মূর্তি তো বাগানে বেরিয়ে পড়লুম। চমৎকার সকাল, মিঠে রোদুর, প্রাণজুড়োনো হাওয়া। দোয়েল শিস দিচ্ছে, বুলবুলি নেচে বেড়াচ্ছে। মাথার ওপর শিরিষ পাতার ঝিরিঝিরি। ঝুড়ি কাঁধে কুলি মেয়েরা টুকটুক করে পাতি তুলছে—বেশ লাগছে দেখতে।
পাতি তোলা দেখতে দেখতে কখন আমি দলছাড়া হয়ে অন্য দিকে চলে গেছি টেরই পাইনি। যখন খেয়াল হল, দেখি বাগানের বাইরে চলে এসেছি। সামনে মাঠ—তাতে কতগুলো এলোমেলো ঝোপ আর পাঁচ-সাতটা গাছ একসঙ্গে ঝাঁকড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। আরও তাকিয়ে দেখি কাছাকাছি কেউ কোথাও নেই।
কী সর্বনাশ–বাঘের মুখে পড়ব নাকি?
কিন্তু এখানে বাঘ! এমন সুন্দর রোদ্দুরে! এমনি চমৎকার সকালে! ধেৎ! আর গাছগুলো যে আমলকীর! কত বড় কী সুন্দর দেখতে! গোছায় গোছায় যেন মণিমুক্তোর মতো ঝুলছে।
নোলায় জল এসে গেল। নিশ্চয় গাছতলায় আমলকী পড়েছে! যাই—গোটাকয়েক কুড়িয়ে আনি। আমলকী দেখে বাঘের ভয়-টয় বেমালুম মুছে গেল মন থেকে।
গেলুম গাছতলায়? ধরেছি ঠিক। বড় বড় পাকা আমলকীতে ছেয়ে আছে মাটি।
বেছে বেছে কয়েকটা কুড়িয়ে নিলুম। তারপর পাশেই একটা সরু মতন লম্বা ডাল পড়ে আছে দেখে-বসলুম তার উপর।
কিন্তু একী! ডালটা যে কেমন রবারের মতো নরম!
আর তৎক্ষণাৎ ফোঁস করে একটা আওয়াজ। ডালটা নড়ে উঠল, বাঁকা হয়ে চলতে শুরু করে দিলে।
অ্যাঁ!
সাপ—অজগর!
বাপরে–গেছি! তড়াক করে এক লাফে আমি গিয়ে একটা কাঁটা-ঝোপের উপর পড়লুম। আর তক্ষুনি দেখলুম বরফির মতো একটা অদ্ভুত মাথা লকলক করে উঠেছে লম্বা জিভ—আর নতুন নয়া পয়সার মতো দুটো জ্বলজ্বলে চোখ ঠায় তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকেই।
.