৮. গোবিন্দ ঘোষ মন্টুরামকে হিংসে করে

গোবিন্দ ঘোষ যে মন্টুরামকে হিংসে করে, এটা মন্টুরাম অনেকদিন ধরেই জানেন। লোকে হিংসে করলে অবশ্য মন্টুরাম অখুশি হন না। বরং খুশিই হন। এত যে টাকা-পয়সা রোজগার করছেন, এই যে এত গাড়ি বাড়ি, সম্পত্তি করলেন, এই যে এত সোনাদানা, ঘরে দামি দামি সব জিনিস, এত কাজের লোক, এসব দেখে যদি লোকের হিংসেই না হবে তা হলে এত পরিশ্রমই তো বৃথা। লোকে হিংসে করে বলেই তো সুখ। কিন্তু হিংসে করতে গিয়ে গোবিন্দ ঘোষ যে তার ঘরে চোর ঢোকাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। গতকালই কানাই দারোগা গোবিন্দ ঘোেষকে পিলে-চমকানো জেরা করেছেন এবং তার ধারণা হয়েছে, এই চুরির সঙ্গে গোবিন্দর একটা সম্পর্ক আছে। তবে গোবিন্দকে গ্রেফতার করা হয়নি এখনও। আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলে সেটাও হবে।

ফলে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে মড়াকান্না উঠেছে। অরন্ধন চলছে। গোবিন্দ ভয়ে কাতর হয়ে শয্যা নিয়েছেন, কাজে বেরোচ্ছেন না। এসব খুবই আহ্বাদের খবর বলেই মন্টুরামের মনে হচ্ছে। বিস্তর সোনাদানা এবং মদন তপাদারের বাক্স চুরি হওয়ায় তার ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমুদ্র থেকে এক মগ জল তুললে কি সমুদ্র তা টের পায়? চুরিটা তাই তাকে বেশি দাগা দিতে পারেনি। বরং গোবিন্দ ঘোষের দুর্দশায় তার ভারী আনন্দ হচ্ছে।

কিন্তু মুশকিল হল, মন্টুরামের দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। একজন তাঁর বউ হরিমতী, অন্যজন দু’ নম্বর মন্টুরাম।

হরিমতী সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছেন, “ওগো, ওরা গরিব মানুষ, ওদের না আছে পয়সার জোর, না আছে ক্ষমতা। চোর ওদের বাড়ি বয়ে এসেছিল, তাতে ওদের দোষ কী বলল! গোবিন্দবাবু ভারী নিরীহ মানুষ, তুমি আর ওদের উপর চাপ দিয়ো না। লোককে ক্ষমাঘেন্না করতে শেখো৷”।

আর দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে সকাল থেকেই তার দফায় দফায় ঝগড়া চলছে।

বেলা আড়াইটেয় যখন মন্টুরাম তার অফিসঘরে বসে ব্যাবসার হিসেবপত্র দেখছেন, তখনই দু’নম্বর মন্টুরাম ফের হাজির হয়ে বলল, “মন্টুরাম, নিজেকে তুমি কী ভাবো বলল তো! তোমার টাকা আছে আর প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে বলেই কি তার জোরে তুমি সকলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসতে চাও? তুমি রাজা না উজির?”

“দ্যাখো দু’নম্বর, আমি আইন নিজের হাতে নিইনি। যা করার পুলিশ করছে, আর সেটা আইন মেনে।”

“কাকে ভাঁওতা দিচ্ছ? কানাই দারোগা তোমার অঙ্গুলিহেলনে চলেন, এ সবাই জানে। আইন-আদালত তো তোমার পকেটে! তুমি হলে একজন হৃদয়হীন পাষণ্ড। ভাল চাও তো গিয়ে গোবিন্দ ঘঘাষের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসো।”

মন্টুরাম অবাক হয়ে বললেন, “ক্ষমা চাইব কেন? গোবিন্দ ঘোষকে তো আমি অপমান করিনি।”

তার ম্যানেজার উমাপদ এসে পড়ায় ঝগড়াটা আর বেশি দূর চলল না বটে, কিন্তু দু’নম্বর মন্টুরাম ছাড়ার পাত্র নন। এবং মন্টুরাম জানেন, ক্রমে ক্রমে হরিমতী আর দু’ নম্বর মন্টুরাম মিলে তাকে একদিন পেড়ে ফেলবেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে ফেলবেন। আর এই কারণেই মন্টুরামের মনটা আজকাল বেজায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তিনি সারা দিনে অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঘণ্টায় অন্তত দশটা-বারোটা তো হবেই।

বিকেলের দিকটায় মন্টুরামের পেটে বায়ু হয়ে উদ্গার উঠতে লাগল। ভারী অসোয়াস্তি। অকারণে ঘামও হচ্ছে। নিজের নাড়ি দেখলেন মন্টুরাম। কিছু বুঝতে পারলেন না।

দু’নম্বর মন্টুরাম প্রম্পটারের মতো আড়াল থেকে বলল, “পেটে বায়ু তো হবেই হে মন্টুরাম, মানুষের অভিশাপও তো আছে। গিয়ে দেখে এসো, গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে আজ কেউ সঁতে দানাটাও কাটেনি। উপোস করে পড়ে আছে। লোকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, এরা হল চোরের মাসতুতো ভাই। কী অপমানটাই হচ্ছে ওদের!”

“তা কী করতে হবে?”

“গিয়ে একটু মিষ্টি কথা বলে এলেও তো হয়। তুমি মানী লোক, ওদের বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালে ওরা ধন্য বোধ করবে।”

মন্টুরাম খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “তাতে আমার পেটের বায়ু কমবে কি?”

“ওরে বাপু, ওইটেই তো তোমার বায়ুর ওষুধ!”

“আর আমার অত সোনাদানা যে চলে গেল! মদন তপাদারের বাক্সটা হাতছাড়া হল!”

“মন্টুরাম, ওই সোনাদানার নিরানব্বই ভাগই হল বন্ধকি সোনা। চড়া সুদে বন্ধক দিয়ে কয়েকশো লোক আর ছাড়াতে পারেনি। ওই সোনায় দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে। ও গিয়ে বেঁচে গিয়েছ হে। আর মদন তপাদারের বাক্স তো তোমার জিনিস নয়। দুঃখ করছ কেন?”

সন্ধের মুখে মন্টুরাম উঠলেন। দোকান থেকে এক হাঁড়ি ক্ষীরকদম্ব কিনে গুটিগুটি গোবিন্দ ঘোষের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেন।

দরজা খুলে গোবিন্দ হাঁ, “মন্টুরাম! তুমি?”

“মাফ করে দিয়ো ভাই। সকালে তোমার বড্ড হেনস্থা হয়েছে, ওসব মনে রেখো না। কাল আমার ছোট মেয়ের জন্মদিন, তোমাদের সকলের নেমন্তন্ন রইল।”

গোবিন্দ ঘোষ হাউহাউ করে কেঁদে মন্টুরামকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর চোখের জল মুছে বললেন, “এসো ভাই, গরিবের বাড়িতে অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যাও।”

মন্টুরাম অনুভব করলেন, তার পেটের বায়ু নেমে গিয়েছে। আর এটা তার চা খাওয়ারই সময়। তাই বললেন, “তা মন্দ কী! আজ বিকেলের চা-টা বরং তোমার সঙ্গেই হয়ে যাক।”

.

“বুরুচ, আমাকে চিনতে পারছ?”

“আমার অভিবাদন নাও হিরু তপাদার। তুমি বড় হয়ে গিয়েছ।”

“হ্যাঁ বুরুচ, আমি আর ছোট্ট খোকাটি নেই।”

“তাই দেখছি হিরু তপাদার। তোমার চোখে বুদ্ধির উজ্জ্বলতা। তোমার নির্ভীক মুখশ্রী। তুমি একজন ভাল মানুষ।”

“আমাকে এখন কী করতে হবে বুরুচ, তুমি বলে দাও।”

“মধ্যরাতে নীল আকাশ থেকে একটা বিদ্যুতের শিখা মাটিতে নেমে আসবে। চারদিক আলোয় আলোময় হয়ে যাবে। ভোর হয়েছে ভেবে পাখিরা ডাকাডাকি করে আকাশে উড়তে থাকবে। তোমাদের মন্দিরে যেমন ঘণ্টা বাজে, তেমনি এক ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাবে তুমি। কুয়াশা উঠে আসবে ঘাস থেকে, কুয়াশা নেমে আসবে আকাশ থেকে, এক মায়া আবরণে ঢেকে যাবে চারদিক। তখন আলোর ঘেরাটোপ থেকে আমাদের যোদ্ধারা বেরিয়ে আসবে।”

“তারা কি ভয়ংকর বুরুচ?”

“তারা ভয়ংকর। কিন্তু তোমার কাছে নয়। তারা জানে হিরু তপাদার একজন বন্ধুর নাম। হিরু তপাদার শত্রু নয়।”

দু’দিন পর এক মধ্যরাতে হিরুর গলার লকেটে একটা মৃদু কম্পন শুরু হল। ঘুম ভেঙে উঠে বসল হিরু। তবে কি সময় হয়েছে? হিরু কান পেতে শুনতে পেল, বহু দুর থেকে একটা বিষণ্ণ ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসছে। হিরু উঠে পড়ল। রাজবাড়ির সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশে আঙুরের থোকার মতো রাশি রাশি তারা ঝুলে আছে। চরাচর স্তব্ধ হয়ে আছে। ঝিঁঝিপোকারও শব্দ নেই। শুধু ঘণ্টা বাজছে দুরে।

হঠাৎ আলোর বল্লমের মতো এক তীব্র বিদ্যুৎশিখা অন্ধকার চিরে চোখ ধাঁধিয়ে নেমে এল নীচে। আর ঘাস থেকে, মাটি থেকে, আকাশ থেকে পুঞ্জ-পুঞ্জ কুয়াশা পাকিয়ে উঠতে লাগল চারদিকে। লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ। চারদিক এক রামধনু-কুয়াশায় ঢেকে গেল। চারদিকে পাখিদের ওড়াউড়ির শব্দ পাচ্ছে সে, ভোর ভেবে ডাকাডাকি করছে পাখিরা। বাগানে ভাঙা ফোয়ারার পাশে আলোর স্তম্ভটি স্থির হয়ে আছে।

আলোর আবরণ থেকে একে একে দশজন যোদ্ধা বেরিয়ে এল। বিশাল ধাতব শরীর ঝকঝক করছে। তারা এসে সিঁড়ির নীচে হিরুর মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর নতজানু হয়ে সকলে একসঙ্গে এক সুরেলা গলায় বলে উঠল, “আমাদের অভিবাদন হিরু তপাদার।”

হিরু জোড়হাতে বলল, “আমি সামান্য এক মানুষ। এই নাও তোমাদের জিনিস ফিরিয়ে দিলাম।”

সামনের অগ্রবর্তী যোদ্ধা তার ধাতব হাত বাড়িয়ে আয়না আর লকেটটা নিয়ে একটা ছোট বাক্স হিরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার জন্য উপহার হিরু তপাদার। দয়া করে গ্রহণ করো।”

যোদ্ধারা উঠে দাঁড়াল, একটু একটু করে পিছিয়ে আলোর স্তম্ভের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ দপ করে নিভে গেল আলো।

গোটা ঘটনাই যেন স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছিল হিরুর। এরা কারা? এরা কেমন মানুষ? সম্মোহিতের মতো নিজের ঘরখানায় ফিরে এসে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হাতের বাক্সটা খুলল। তারপর অবাক হয়ে দ্যাখে, বাক্সের মধ্যে অবিকল একই রকম আর একটা আয়না!

ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ আয়নাটার দিকে চেয়ে থেকে ঢাকনাটা খুলতেই একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী চমৎকার হেসে বলে, “সুপ্রভাত হিরু তপাদার। এই জাদু-আয়না তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। প্রথম কথা, এই আয়নাকে শুধু একটা আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারো। শুধু আয়না কথাটা উচ্চারণ করলেই এটা সাধারণ আয়না হয়ে যাবে। আর যদি অন্য কোনও জিনিসের সন্ধান চাও, তা হলে আয়না তারও সন্ধান দেবে। তুমি কি গুপ্তধন চাও? তা হলে একবার বলো, গুপ্তধন।”

বিস্মিত হিরু একটু হেসে বলল, “গুপ্তধন।” সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ছবি অদৃশ্য হল। তার বদলে ফুটে উঠল একটা আলোকিত গহ্বরের ছবি। নেপথ্যে সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর বলতে লাগল, “এই যে দেখছ, এটি হল রাজবাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভটি। ওর ভিতরটা ফাঁপা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কয়েকটা ইট সরালেই গহ্বরের সন্ধান পাবে। পনেরো ফুট নীচে ওই দ্যাখো বাক্সভরতি সোনার টাকা, সোনার তৈরি বাসন, সোনার কত গয়না!”

বাস্তবিকই আয়নায় বাক্সগুলো দেখা যাচ্ছে। তারপর ছবি বদলে গেল।

মেয়েটির গলা বলতে লাগল, “এবার বাগানের পিছন দিকে ভাঙা শিবের মন্দিরটা দ্যাখো। ওর পিছনের পুরু দেওয়ালটার ভিতরে রয়েছে তিনটি বড় বড় সোনার মূর্তি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এক-একটা মূর্তির ওজন এক মন করে।”

বাস্তবিকই আয়নায় পাশাপাশি তিনটি মূর্তি দেখা যাচ্ছে।

“এইবার চলো পুকুরের নীচে, জলের তলায়। ওই দ্যাখো, ঠিক মাঝখানে একটা শ্বেত পাথরের চাঙড় পড়ে আছে। ওটা সরালে …।”

শিহরিত এবং স্তম্ভিত হিরু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আয়না! আয়না!”

ছবি মিলিয়ে গেল। কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হল। আয়নায় ফুটে উঠল তার প্রতিবিম্ব। ঢাকনাটা বন্ধ করে বজ্রাহতের মতো বসে রইল হিরু। এ বড় সর্বনেশে জিনিস। গুপ্তধনের অতুল ঐশ্বর্যের অর্থ হল আবার লোভ জেগে ওঠা, হিংস্রতার উত্থান, ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার নতুন গল্প, হানাহানির বীজ বপন। মানুষের ভিতরকার রাক্ষসটাকে জাগিয়ে ভোলা কি ভাল?

ভোরবেলায় সামনের বারান্দায় নরম রোদে পা মেলে দিয়ে হরিশ্চন্দ্র প্রসন্ন মুখে বসে আছেন। শরৎ ঋতু যাই যাই করছে। একটু-একটু করে ঠান্ডা পড়তে লেগেছে। ক’দিন পরেই বাজারে নতুন ফুলকপি আর লাল আলু উঠবে। বড্ড দাম। তবে কয়েকটা গিনি লুকানো আছে। এক-আধদিন ফুলকপি আর আলু খেলে মন্দ হয় না। নতুন আলু আর ফুলকপির চিন্তায় যখন বিভোর হয়ে আছেন, তখন হিরু তপাদার এসে তাঁকে প্রণাম করে পায়ের কাছটিতে বসল।

“মহারাজ, এবার যে আমাকে বিদায় নিতে হবে।”

হরিশ্চন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলেন, “সে কী! এই তো সেদিন কাজে ঢুকলে! এখনও পয়লা মাসের বেতন পাওনি?”

হিরু হেসে বলে, “আপনার কাছ থেকে বেতনের চেয়েও অনেক বেশি কিছু পেয়েছি।”

হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা যাবেটা কোথায়?”

“আমি অনেক দূরে একটা গাঁয়ের স্কুলে ইংরিজি পড়াই। সেখানেই ফিরে যাব।”

হরিশ্চন্দ্র ভ্রু তুলে বললেন, “ইংরিজি পড়াও! বাঃ বাঃ বেশ।”

“একটা কথা মহারাজ। আপনার পিসিমাদের আয়না কেড়ে নেওয়ায় তারা খুব দুঃখ পেয়েছেন বলে শুনেছি।”

“সে আর বোলো না। শাপশাপান্ত করে শেষ করছেন।”

“তাদের এই আয়নাটা দয়া করে দিয়ে দেবেন।”

হরিশ্চন্দ্ৰ আঁতকে উঠে বললেন, “আবার আয়নার ফেরে ফেলতে চাইছ নাকি বাপু?”

“ভয় নেই মহারাজ, এটা কেউ ফেরত চাইবে না। তা হলে আমি মহারাজ যাই।”

“এসো গিয়ে।”

 হিরু তপাদার প্রণাম করে চলে গেল। হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার গমনপথের দিকে চেয়ে রইলেন। বাড়িটা একটু ফাঁকা লাগবে কি? তা ফাঁকা লাগার অভ্যেস তার আছে।

মাঝরাতে তিন পিসি আয়না পেয়ে এমন কোলাহল করে উঠল যে, হরিশ্চন্দ্রকে নিজের কানে হাতচাপা দিতে হল। কানা পিসি খলখল করে হেসে বলে, “ও হরি, দিলি নাকি আয়নাটা! দিলি?”

কুঁজো পিসি ফোকলা হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কী, বলে, “ও হরি, আর কেড়ে নিবি না তো বাবা? একেবারে দিলি তো?”

খোঁড়া পিসি চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলে, “হরি রে, তুই যে আমাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলি বাপ!”

কানা পিসি আয়নায় মুখ দেখে সে কী খুশি! বলে, “ওরে, দ্যাখ দ্যাখ, আমার বয়স যেন কয়েক বছর কমে গিয়েছে! মুখের কোঁচকানো ভাবটা যেন অনেক কম!”

“দেখি দেখি,” বলে কুঁজো পিসি আয়নায় মুখ গুঁজে বলে, “ওমা! তাই তো দিদি, আমার গালেও যেন একটু রাঙা রাঙা ভাব। শরীরটা কি একটু ফিরল তা হলে?”

খোঁড়া পিসি হামলে পড়ে বলল, “আ মোলো যা, আমাকেও একটু দেখতে দিবি তো। ওরেব্বাস রে, আমার চোখের কোলে কালিটা আর নেই তো! রংটাও যেন খুলেছে!”

হরিশ্চন্দ্র তিন পিসির কাণ্ড দেখে ভারী তৃপ্তি বোধ করছিলেন। কানা পিসি ঝনাৎ করে একটা থলি হরিশ্চন্দ্রের বিছানায় ফেলে দিয়ে বলল, “নে বাবা, ওতে এক হাজার ভরি গিনি আছে। প্রাসাদের পাঁচিলটা ভাল করে সারিয়ে ফেল তো। আর সিংহদরজায় ফটক লাগাস বাবা। বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকি।”

খোঁড়া পিসি বলে, “হ্যাঁ বাবা হরি, ফটকে একজন শক্তপোক্ত দরোয়ানও মোতায়েন করিস, তার মাইনে আমরা মাসে মাসে তোকে দিয়ে দেব। দেখিস বাবা, নাদু মালাকার যেন এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে না পারে।”

কুঁজো পিসি বলে, “শেষ বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে দিস বাবা। তোর হাজার বছর পরমায়ু হবে।”

কোলাহল করতে করতে পিসিরা উধাও হল।

মাঝেমধ্যে ট্রাপিজের খেলোয়াড়টিও হাজির হয়। এক ঝাড়বাতি থেকে আর এক ঝাড়বাতিতে ঝুল খেতে খেতে বলে,

“আমার ছেলেকে আপনার কেমন লাগল মহারাজ?”

হরিশ্চন্দ্র প্রাণ হাতে করে ওই বিপজ্জনক লাফঝাঁপ দেখতে দেখতে বলেন, “তোমার ছেলে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে হে তপাদার। তবে তোমার মতো প্রাণঘাতী লাফঝাঁপ করে বেড়ায় না।”

মদন তপাদার হাসতে হাসতে বলে, “আমি গরিব ছিলুম বটে মহারাজ, কিন্তু তোক ভাল ছিলুম।”

.

কালোবাবু ওরফে বাঁকা মহারাজ ওরফে খগেন নন্দী এখন পুলিশের হেফাজতে। সোনাদানা সব মন্টুবাবু ফেরত পেয়ে গিয়েছেন। সুধীর গায়েন বটতলায় তেলেভাজার দোকান খুলেছে এবং তার ব্যাবসা রমরম করে চলছে।

রাজবাড়ির পাঁচিল মজবুত করে সারানো হয়েছে, সিংহদরজায় লাগানো হয়েছে নতুন লোহার ফটক। একজন গোঁফ-চোমড়ানো তাগড়াই দরোয়ান দিনরাত পাহারা দিচ্ছে। এই দেখে নাদু মালাকার কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সেই যে ফিরে গিয়েছে, আর আসেনি।

হরিশ্চন্দ্র একজাড়া নরম বিদ্যাসাগরী চটি কিনেছেন, নতুন জরির একটা পোশাকও হয়েছে তার। আর আমসত্ত্ব দিয়ে দুধও খাচ্ছেন দু’বেলা। সঙ্গে নতুন আলু দিয়ে কচি ফুলকপির ঝোল।

মাঝে-মাঝে হরিশ্চন্দ্রের মনে হয়, না, তিনি সবটাই ভুল দ্যাখেন না, সবটাই ভুল শোনেন না, সবটাই ভুল বোঝেন না এবং সবটাই ভুল বলেনও না।