।। আট ।। – গভীর রাতে পড়া মুখস্থ?
সকালবেলায় পাড়ার উমেশ সান্যাল এলেন। বললেন, খুব বেঁচে গেলেন মশাই। টবটা যদি কারো মাথায় পড়ত তাহলে আর রক্ষে থাকত না। বড়োলোকদের যে কী ফ্যাশান হয়েছে ছাদের আলসেতে, বারান্দায় ফুলের টব ঝুলিয়ে রাখা। কারো মাথায় পড়তে পারে এ কাণ্ডজ্ঞান নেই!
একটু থেমে বললেন, আজকের কাগজ দেখেছেন?
বললাম, দেখেছি। তবে ভালো করে পড়া হয়নি। বললাম না যে ভয়ে এখন কাগজ পড়ি না।
সুখবর আছে। বলে ঝুলি থেকে সেদিনের কাগজটা বের করে দেখালেন।
‘জীবন্ত কঙ্কাল অদৃশ্য’ হেডিং দিয়ে—যে খবরটা ছাপা হয়েছে তা এইরকম—ইস্টার্ন বাইপাসের মুখ থেকে সল্টলেকের প্রায় প্রতিটি পথে পুলিশ সারা রাত্রি টহল দিয়েও জীবন্ত কঙ্কালটিকে দেখতে পায়নি। বোধ হয় ওটি অদৃশ্য হয়েছে।
বাঁচলাম মশাই। বাড়িতে সবাইকে রেখে কাশীতে যে মহাযোগ হতে যাচ্ছে সেখানে এবার নিশ্চিন্তে যেতে পারব। দেশ—বিদেশ থেকে কত সাধু—সন্ন্যেসী কলকাতা হয়ে যাবেন। সে এক দেখার জিনিস মশাই। একবার যদি তেমন কোনো সাধুর দর্শন পাই তাহলে তাঁর পা দুটো আঁকড়ে ধরব। বুঝলেন না ওখানে যেসব সাধু—সন্ন্যেসীরা যান তাঁরা হেঁজিপেঁজি ভণ্ড সাধু নন। কি বলেন?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আমার মনে তখন শুধু একটাই কথাই ঘুরছিল, সত্যিই কি রাজু ফিরে গেছে?
সেদিন বিকেল পর্যন্ত প্রণবেশ দু—বার ফোন করেছিল। বিশেষ কাজে আটকে গেছে বলে আসতে পারছে না। জানতে চেয়েছিল ভয় পাচ্ছি না তো?
বলেছিলাম, না। তবে টবটা পড়ে গেছে। ও যেন সে কথায় কোনো গুরুত্বই দিল না।
ক্রমে গোটা সল্টলেকের ওপর সন্ধের অন্ধকার পায়ে পায়ে নেমে এল। আজ আর বিকেলে বেরোতে ইচ্ছে করেনি। তাড়াতাড়ি সব জানলা—দরজা বন্ধ করে দিলাম। ব্যস! রাতের মতো ঘরে বন্দি হয়ে রইলাম।
আজও রাত নটার মধ্যে খেয়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। এত সকাল সকাল শোওয়া আমাদের অভ্যেস নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম।
ভাবতে ভাবতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকাই। ঘরের মধ্যে অসহ্য গুমোট। চারিদিকের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। আর তখনই শুনতে পেলাম জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ পথের ওপর একটা অস্পষ্ট শব্দ খট—খট—খট।
কেউ যেন রক্তমাংসশূন্য হাড়ের পা ফেলে হাঁটছে। শব্দটা ক্রমে এগিয়ে এল আমাদের বাড়ির কাছে। আজই তা হলে সেই রাত। ও এসে পড়েছে। আমি বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা বের করে উঠে বসলাম।
শব্দটা থেমে গেল।
কোনো সন্দেহ নেই কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির কাছে। আমি বিছানায় বসেই কাচের শার্সির মধ্যে দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না।
তার একটু পরেই আমি আঁতকে উঠলাম। দেখলাম আমার মাথার কাছে জানলার ওপাশে একটা ভয়ংকর মূর্তি—যেন কাঠের তৈরি খসখসে একটা মুখ—নারকেলের মতো ছোট্ট মাথা—খাড়াখাড়া চুল—দুটো চোখ—হ্যাঁ, চোখই। তবে টর্চের বাল্বের মতো নয়, চোখ দুটো ওল্টানো। শুধু চোখের সাদাটা দেখা যাচ্ছে। এইভাবেই এক—এক সময়ে সুব্বা হরিদেবপুরের বাড়িতে তাকাত।
সেই মুহূর্তে আমি কী করব ভেবে পেলাম না। দেখলাম ক্ষীণ কঙ্কালসার দেহটা জানলাটা খোলবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাচের শার্সি কিছুতেই ছুঁতে পারছে না।
আমি হঠাৎ লাফিয়ে হুংকার দিয়ে জানলার দিকে ছুটে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
এবার আমি আলো জ্বেলে পাশের ঘরে গেলাম। দেখি মশারির মধ্যে আমার স্ত্রী নোটনকে বুকে আঁকড়ে ধরে গোঙাচ্ছেন। আমাকে দেখে সাহসে ভর করে বিছানায় উঠে বসলেন। কোনোরকমে বললেন, সুব্বা ওঁদের জানলার কাছেও এসে দাঁড়িয়ে ছিল।
ভোরবেলায় ফোন পেয়েই প্রণবেশ জিপ নিয়ে চলে এল। সব কথা শুনে ওর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তখনই দার্জিলিঙে ফোন করল। কিন্তু অম্বুজ লাহিড়িকে পাওয়া গেল না। তিনি দার্জিলিঙের বাইরে কোথায় গেছেন কয়েক দিনের জন্যে।
প্রণবেশ বলল, ঘাবড়িও না। রাত্রে আমিও এখানে থাকব।
শুনে বাঁচলাম। বিপদের সময়ে সঙ্গে একজন সাহসী সঙ্গী থাকা দরকার। দরকার পরামর্শ করবার।
সন্ধের আগেই প্রণবেশ চলে এল। সঙ্গে কিছু ওষুধ—পত্তর এনেছে। বলা যায় না রাত্তিরে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন কাজে লাগবে। কোনোরকমেই দরজা খুলে বাইরে বেরোনো তো চলবে না।
রাত দশটার মধ্যে খেয়ে—দেয়ে শুয়ে পড়া গেল। যে প্রণবেশ এত ফুর্তিবাজ—এত গল্প করে সেইই আজ যেন বোবা হয়ে গেছে। সব সময়েই কী যেন চিন্তা করছে।
ও আর আমি এক বিছানায় শুয়েছি।
কোনো বাড়ির দেওয়ালঘড়িতে ঠং—ঠং করে দুটো বাজল। সেই শব্দটুকু থেমে যেতে—না—যেতেই নিস্তব্ধ রাস্তায় কোথায় যেন শব্দ হল খট—খট—খট—
প্রণবেশকে ঠেলা দিতেই ও গম্ভীর গলায় বলল, শুনছি।
ক্রমে শব্দটা আগের দিনের মতোই বাড়ির কাছে এসে থামল। কিন্তু আজ আরও একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছিল। মানুষের গলা। কোনো বয়স্ক লোক যেন পড়া মুখস্থ করছে। এত রাত্রে কে কোথায় কী পড়ছে ভেবে ওঠার আগেই পাশের ঘর থেকে নোটনের মা চিৎকার করে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজনে ছুটে গেলাম ওদের ঘরে। আমাদের দেখেই আমার স্ত্রী আঙুল তুলে জানলাটা দেখিয়ে উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ওই—ওই— ওইদিকে।
সেই নিষ্প্রাণ কালো মুখটাকে মুহূর্তের জন্যে দেখলাম সরে যেতে। তারপর আমার স্ত্রী যা বললেন তা এই—
একটা কেমন ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই দেখেন মূর্তিটা বাইরে দাঁড়িয়ে জানলাটা ধরবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। যতই পারছে না ততই রাগে ঘোঁত ঘোঁত করছে। কিন্তু এ যেন হরিদেবপুরের সে রাজু নয়। তার চেয়ে ঢের ভয়ংকর—ঢের বেশি হিংস্র।
আমরা ঠিক করলাম বাকি রাতটুকু মশার কামড় সহ্য করেও এ ঘরে বসে কাটিয়ে দেব। সেইমতো দুটো চেয়ার নিয়ে এসে গায়ে চাদর জড়িয়ে আমরা বসলাম।
প্রণবেশ সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে হঠাৎ মনে হল বাড়িটা যেন কাঁপছে। তারপরেই ছাদের ওপর কে যেন ভারী পায়ে চলে বেড়াচ্ছে। এইরকম চলল ঘণ্টাখানেক। অথচ আমাদের কারুর কিছু করার নেই। বেরোনো চলবে না। ভোরের দিকে শব্দটা থেমে গেল।
সকালে ছাদে উঠে দেখলাম টবগুলো কে ভেঙেচুরে সারা ছাদে ছড়িয়ে রেখে গেছে।
চা খাবার পর আমরা আলোচনায় বসলাম। যে ভুলটা আমাদের হয়েছিল সেটা বললাম। লালবাজারে একটা ফোন করে দিলেই হতো। আমাদের না হয় ঘর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না। কিন্তু পুলিশ তো ছাদে উঠতে পারত।
এটা যে মস্ত ভুল প্রণবেশও তা স্বীকার করল। সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার—ওই সময়ে কাছাকাছি কোথাও কে পড়া মুখস্থ করছিল? না, তারও উত্তর তখনই খুঁজে পাওয়া গেল না।