৮. কর্নেল অস্থির

০৮.

 কর্নেল অস্থির হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন অরিজিৎ লাহিড়ীর ছাদ থেকে নেমে এসে ফোন ধরেছিলেন। তারপর আর ছাদে ফেরেননি। তাহলে অমর্তের একই পরিণতি ঘটল! মডুস অপারেন্ডি–খুনের পদ্ধতি আগের মতোই। কোনো নির্জন জায়াগায় আচমকা মাথার পেছনে ভোতা শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত। অমর্তের বেলায় দুবার আঘাত করতে হয়েছে খুনীকে। অমর্ত্য ছিলেন বলবান লোক। তাই খুনী নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। তিনটি ক্ষেত্রেই খুনী এমন কিছু ফেলে যায়নি, যাতে ডগস্কোয়াডের সাহায্য নেওয়া যায়।

এদিকে রাখী ও সীমন্ত গতকাল যা বলে গেছে, তাতে এও স্বপনের কাজ বলে নিশ্চয়তা এসে যাচ্ছে। স্বপন সীমন্তকে অমর্ত্যের ভবিষ্যৎ পরিণাম সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছিল। নাঃ দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো নির্ভুল গাণিতিক সত্য, এ কীর্তিও স্বপনের। অথচ কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। সেটা তার পিতৃহত্যার ব্যাপারটাই কি?

স্বপনের মতো দুর্দান্ত ক্রিমিন্যালের পক্ষে পিতৃহত্যা হয়তো সম্ভবও। কিন্তু…

কর্নেল চোখ বন্ধ করে তার নির্বাচিত খুনীর দিকে তাকালেন। অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট আদল থেকে বারবার স্বপন ভেসে উঠছে। মিলিয়ে যাচ্ছে। ভেসে উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। অথচ, হাতের মার্ডার উইপনটা একই থাকছে। সেটার দিকে মনের চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকালেন এবার। তাকিয়ে রইলেন একই তীক্ষ্ণ অভিনিবেশে। তারপর চমকে উঠলেন। হাতের অস্ত্রটা হঠাৎ মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট হয়েই মিলিয়ে গেল। আশ্চর্য, সেটা একটা হাতুড়ি!

চোখ খুলে কর্নেল টের পেলেন, তার উরু দুটো ভারী হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সোফায় বসে পড়লেন।

হাতুড়ি! কেন একথাটা তার মাথায় আসেনি এতদিন? হাতুড়ি ছাড়া আর কী হতে পারে? আগের দুটো ডেডবডির মাথার পেছনে এক বর্গ ইঞ্চি গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। অমর্তের পোস্টমর্টেম এখনও হয়নি। কিন্তু আপাতদৃষ্টে তার মাথার পেছন দিকে দুটো একই পরিমাণ ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে। স্টেডিয়ামের দুদিকের সারবদ্ধ আসনের ফাঁকে মাঠের সমতলে যে প্যাসেজ, তা বড় জোর দেড় গজের বেশি চওড়া হতে পারে না। এমন সংকীর্ণ জায়গায় মোক্ষম। আঘাত হানতে হলে হাতুড়ি খুব কাজের জিনিস।

স্বপন ক্রিমিন্যাল। ড্যাগার বা পিস্তল তার স্বাভাবিক অস্ত্র। সে কেন হাতুড়ি ব্যবহার করছে? তা ছাড়া হাতুড়ি মেরে হত্যা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে হলে তাকে হাতুড়ির ব্যবহারও শিখতে হয়েছে। সে ছিল ফুটবলার। তারপর ড্যাগার পিস্তল চালিয়েছে। বোম মেরেছে। হাতুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতে পারে না। থাকতে পারে, তপনের।

তার ভাই তপন কারখানায় কাজ করে। হাতুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। হয়তো আছে। কিন্তু তপনের সঙ্গে এই কেসের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ধরা পড়েনি। পুলিস রেকর্ডে তার নাম নেই। এই কেসের তদন্তে কোনো সূত্রেই সে জড়িত হয়নি।

নাকি কোনো সূত্র আছে, যা এখনও চোখে পড়েনি। যে-সূত্র তপনের দিকে নিয়ে যাবে, সেই সূত্র কি এখনও অনাবিষ্কৃত?

কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, তপনের চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু তথ্য কর্নেলের হাতে আছে, তাতে তার আইডিয়ার খুনীর সঙ্গে আদপে কোনো মিল নেই। নরকতত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে একজন পরিণতবয়স্ক মানুষ। স্বপনের সঙ্গে যেমন তপনের সঙ্গেও এই ব্যাপারটাতে গণ্ডগোল বাধছে। দুজনেই তরুণ। অপরিণত মন দুজনেরই।

আবার চমকে গেলেন নিজের চিন্তার গতিপথ লক্ষ্য করে। একজন পরিণত বয়স্ক মানুষ! অমিয় বকসীর লাশ চিমনীর মধ্যে ঢুকিয়ে সে নিজের ধ্যানধারণার পরিষ্কার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিল।

কর্নেল আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। সোজা হয়ে বসলেন।

কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠীর পায়ের শব্দ হল বাইরের ঘরে। দরজা খোলার শব্দ হল। তারপর অরিজিৎ লাহিড়ী প্রবেশ করলেন গম্ভীর মুখে। কর্নেল বললেন, বস।

অরিজিৎ সিগারেট ধরালেন। তারপর আস্তে বললেন–এবারেও একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অমর্ত্য রায় রাত্রে কেন স্টেডিয়ামের ভেতর ঢুকেছিলেন! আর–

কর্নেল তাকালেন তার দিকে।

–আর স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে তারের বেড়ার ওধারে ব্যায়ামাগার। সামনে একটা সুইমিং পুল আছে। সেখানে একটা বল ভাসছিল।

–ভাসতেই পারে। প্লেয়াররা বলটা আলসেমি করে তোলেনি।

–না। বলটা বাইরের। অর্থাৎ ক্লাব যে বিশেষ কোম্পানির বল ব্যবহার করে, সেই বল নয়। জাস্ট বাজে ধরনের ফুটবল।

বাইরে তো ময়দান। অসংখ্য ছেলে খেলা করছে। কিক খেয়ে ভেতরে এসে পড়েছিল।

তাও নয়, কর্নেল। অরিজিৎ মাথা নাড়লেন। স্টেডিয়ামের পূর্বে, দক্ষিণে রাস্তা। পশ্চিমে টেনিস ক্লাব। উত্তরে অবশ্য মাঠ আছে। অন্যান্য ক্লাবের টেন্ট আছে। কিন্তু সেখান থেকে বল এলে কোনো সুপারম্যানের কিক দরকার। এখন প্রদীপ–মানে রাইট ব্যাক প্রদীপ মৈত্রের কথা বলেছিলুম আপনাকে। তাকে অমর্ত্যবাবুকে গার্ড দিতে বলেছিলুম, মনে আছে কি?

নিশ্চয় আছে।

–অমর্ত্যবাবু প্রদীপের অতি উৎসাহী হাবভাবে একটা কিছু আঁচ করে তাকে খুব থ্রেটন করেছিলেন গতকাল। ছেলেটা একটু বোকাও। কাল রাত নটা অব্দি সে স্টেডিয়ামের ভেতর বল প্র্যাকটিশ করছিল। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ছিল না। ওই যে বলা হয়েছে, তাকে অমর্ত্যবাবুর বডিগার্ড হতে হবে, অথচ উনি যেন টের না পান।

বুঝলুম। তারপর?

–অমর্ত্যবাবু তাকে অশ্লীল গাল দিয়ে প্রায় মারতে বাকি রাখেন। রাগ করে প্রদীপ চলে যায়। অমর্ত্যবাবু স্টেডিয়াম থেকে ফিরে টেন্টে ঢোকেন। পরিমল বলেছে, নিজের ঘরে শুয়ে পড়েন তারপর।

কর্নেল তাকালেন অরিজিতের দিকে। তাহলে আবার স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন?

তাই তো দেখা যাচ্ছে!

 বাইরের একটা বল সুইমিং পুলে ভাসছিল?

–হ্যাঁ।

–অরিজিৎ! মার্ডারার অতি ধূর্ত একজন পরিণতবয়স্ক মানুষ। সে কাল ক্লাব এরিয়ার ভেতর ছিল। প্রদীপের ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে সে। তারপর মোড্রস অপারেন্ডি তৈরি করে নিয়েছে। প্রদীপ অত রাতে স্টেডিয়ামের ভেতর বল প্র্যাকটিশ করছিল তো?

অরিজিৎ তাকিয়েছিলেন। বললেন, মাই গুডনেস। বুঝতে পেরেছি।

–খুনী দিনেও কাছাকাছি ছিল। প্রদীপ নিশ্চয় সারা বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত স্টেডিয়ামে বল প্র্যাকটিশ করছিল। অমর্ত্য তাকে থ্রেটন করেছেন। সেই দেখে তার মাথায় এসেছে।

কর্নেল! কাল ছিল ক্লাবের বিশ্রামদিবস।

–তবু প্রদীপ একা বল প্র্যাকটিশ করছিল। অমর্ত্য রাগ করতেই পারেন। খুনী ব্যাপারটা আঁচ করে একটা ফুটবল সংগ্রহ করে এনেছিল। প্রদীপ চলে যাওয়ার পর সে ফুটবলটা নিয়ে স্টেডিয়ামের ভেতর খেলার ভাণ করে। অমর্ত্য তেড়ে আসবেন সে জানে। সে ফাঁদ পেতে রেখেছিল, ডার্লিং! অমর্ত্য সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছেন।

অরিজিৎ একটু ভেবে বললেন–কিন্তু বাইরের লোক ক্লাব এরিয়ার ভিতর থাকলে কারুর না কারুর চোখে পড়ত।

–পড়েনি, এর কারণ হতে পারে, সে ক্লাবেরই লোক।

অরিজিৎ উদ্বিগ্নভাবে থেকেও একটু হাসলেন। কাল ছিল রেস্ট ডে। প্রদীপ ছাড়া কোনো প্লেয়ার আসেনি। বেলা দুটোয় লাঞ্চ-মিটিং ছিল কর্মকর্তাদের। তেরজন উপস্থিত ছিলেন।

–আনলাকি থার্টিন!

হু–বল।

–অমর্ত্য বাদে বাকি বারোজনও গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনটে নাগাদ তারা চলে যান। থেকে যান শুধু বালক দাশগুপ্ত। ফিল্ম ডিরেক্টার। তিনি ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা! টেন্ট মেরামতের প্রস্তাব নেওয়া হয়। বরাবর তিনিই এই দায়িত্ব নেন। সরল সেন নামে এক সিনেমা লাইনের কন্ট্রাক্টারকে দিয়ে এ সব কাজ করিয়ে নেন কম খরচে।

–ভেরি ইন্টারেস্টিং!

-সরলবাবুকে বালকবাবু ফোন করে আসতে বলে অপেক্ষা করছিলেন। কাজটা বুঝিয়ে দেবেন এবং এস্টিমেট চাইবেন বলে।

–এসেছিলেন সরলবাবু?

–হ্যাঁ। সাড়ে তিনটেয় সঙ্গে ইলেকট্রিসিয়ান এবং কাঠের মিস্তিরি নিয়ে তিনি আসেন। তারা সবাই মিলে ফিতে ধরে মাপজোক করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা পর্যন্ত ছিলেন তারা, কিংবা আরও একটু বেশি।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। চোখ খুলে বললেন–ইলেকট্রিসিয়ান এবং কাঠের মিস্তিরি?

অরিজিৎ কান না করে বললেন–এদিকে অমর্ত্য বেরিয়ে যান চারটের কাছাকাছি–একটু পরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গিয়ে এক কাণ্ড করেন তিনি।…

অরিজিৎ জেভিয়ার বুড়োর সঙ্গে অমর্ত্যের ঝগড়া ইত্যাদির পুরো বিবরণ দিয়ে বললেন কাজেই বুঝতে পারছেন, বাইরের লোক বলতে

কথা কেড়ে কর্নেল দ্রুত বললেন, ইলেক্ট্রশিয়ান এবং কাঠের মিস্তিরি!

–তারা কন্ট্রাক্টারের লোক। তার সঙ্গেই চলে গিয়েছিল।

–অরিজিৎ, ওই দুজনকে এক্ষুণি আটক কর। জেরার সময় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।

অরিজিৎ অবাক হয়ে বললেন–কেন, কী ব্যাপার?

কর্নেল অধীর হয়ে বললেন–এক মুহূর্ত দেরি নয়। যা বলছি, কর। এতদিনে এই কেসের সঠিক সূত্রের নাগাল পেয়েছি, অরিজিৎ! হাঁ করে কী দেখছ? নির্দেশ দাও তোমার লোকেদের। ওঠ!

অরিজিৎ পুতুলের মতো উঠে ফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল করে সাড়া পেয়ে চাপা গলায় কথা বললেন। তারপর ফিরে এসে তেমনি অবাক মুখে বসে পড়লেন।

কর্নেল বললেন–একটা হাতুড়ি, অরিজিৎ! আমি এত বোকা হয়ে গেছি কিংবা আমার চিন্তাশক্তি পোকামাকড় গাছপালার সাহচর্যে মানুষের স্বাভাবিক তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই মূল ব্যাপারটাতে দৃষ্টি রাখিনি। ডার্লিং! মার্ডার উইপনের কথা বলছি যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মার্ডার উইপন মার্ডারারের মানসিক প্রবণতার প্রতীক নয় কি? প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডে হত্যার জন্য কি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, এটা জরুরি। হত্যাকারীকে বুঝতে সাহায্য করে। একটা হাতুড়ি আমাকে অনেক কথা বলে দিচ্ছে এক্ষেত্রে।

অরিজিৎ একটু হাসলেন। ওক্কে, আই এগ্রি। তবে আপনি গোড়ায় আমাকে বলেছিলেন, যে খুন হয়েছে, তার লাইফ-হিস্ট্রি তলিয়ে দেখতে।

কর্নেল উত্তেজিতভাবে বললেন–দুটোই। মার্ডার উইপন এবং নিহতের লাইফ-হিস্ট্রি–দুটোই দেখছি এই কেসে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোড়ায় আমি একটু ভুল পথে চলে গিয়েছিলুম। কতকগুলো তথ্য আমাকে মিসলিড করেছিল। কিন্তু একটা হাতুড়ি আমাকে সঠিক পথে পৌঁছে দিল এতদিনে।

অরিজিৎ বললেন–হাতুড়িজাতীয় মার্ডার উইপনের কথা আমরাও ভেবেছি। ফরেন্সিক এবং মর্গের রিপোর্ট দুইয়েতেই মার্ডার উইপন সাজেস্ট করা হয়েছে। হাতুড়ি।

–হাতুড়ি সবাই ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু একটিমাত্র আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলে হাতুড়িতে অভ্যস্ত হওয়া দরকার নয় কি? ভেবে দেখ, একজন ইলেকট্রিশিয়ান যেমন, তেমনি একজন কাঠের মিস্ত্রী, দুজনেই হাতুড়ি চালনায় দক্ষ। এদেরই একজন হত্যাকারী, অরিজিৎ। আরও দেখ, এরা সিনেমা স্টুডিওর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। স্টুডিওর কাজও করে।

–অরিজিৎ তর্কের ভঙ্গিতে বললেন কিন্তু মোটিভ? স্বপনের মোটিভ যেখানে রীতিমতো এস্টাব্লিশড! একজন সিনেমা কন্ট্রাক্টারের দুজন সাধারণ কর্মচারীর কী মোটিভ থাকতে পারে?

–ওদের মুখে কি বেরোয়, দেখা যাক। তারপর আমি এবার পুরোপুরি নামব, ডার্লিং! কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–তুমি নিজে গিয়ে দেখ, ওদের গ্রেফতার করা হল কি না। দিস ইজ ভাইটাল। কারণ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এখনও আরও হত্যাকাণ্ডের সম্ভাবনা আছে। তোমাকে আগে বলেছিলুম, দি কিলার অ্যাট লুজ! আবার বলছি। হয়তো আরও কিছু মানুষের জীবন এখনও বিপন্ন। এই হত্যাকারী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের লোক। অসামান্য তার মোডুস অপারেণ্ডি–অতি দক্ষতাপূর্ণ তার হত্যা পরিকল্পনা। নিজেকে সে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে বেছে বেছে তার জানা পাপীদের শাস্তি দিতে নেমেছে। আমি কী বলছি বুঝতে পারছ? সে নিশ্চিতভাবে যাদের পাপকর্মের সাক্ষী কিংবা কোনো বিশ্বস্তসূত্রে সেই পাপের কথা জেনেছে, তাদেরই একে একে শাস্তি দিচ্ছে। তার ধারণা, এই পাপীদের নরকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেই অশান্ত চিত্তের শান্তি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার তৃপ্তি।

অরিজিৎ গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। ওকে। ওয়েট অ্যান্ড সি। বলে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত।…….

কর্নেল দুপুরে খেতে বসেছেন, তখন ষষ্ঠী ঘোষণা করল নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবের ফোং।

অরিজিৎ, বল!

কাঠের মিস্তিরিকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছিল। নাম হোসেন আলি। বয়স ষাটের ওধারে। হাঁপানি-রোগী। তার অবস্থা দেখে তক্ষুণি হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছে।

ইলেকট্রিশিয়ান?

–তার বয়সও নাকি ওইরকম। নাম বনবিহারী দাস। কাল ক্লাব থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া সেশনে ট্রনে চেপে দেশে গেছে–মেদিনীপুর গ্রামে। ছেলের অসুখের খবর এসেছিল সকালে। আগেই ছুটি চেয়ে রেখেছিল। গ্রামের ঠিকানা নিয়ে সেখানকার থানায় মেসেজ পাঠানো হয়েছে।

অরিজিতের কথার মধ্যে হাসির–বিদ্রুপাত্মক হাসির ঝাঁঝ ছিল। –ঠিক আছে। বলে ফোন রেখে কর্নেল ডাইনিং রুমে ফিরে গেলেন। হুঁ, ক্লাব থেকে বেরিয়েই বনবিহারী নাকি হাওড়া স্টেশন চলে যায়। অরিজিৎ পয়েন্টটা বোঝেনি।

ষষ্ঠী বলল–বাবামশাই, রান্না কি ভাল হয়নি আজ?

কর্নেল হাসবার চেষ্টা করলেন।– না রে! শরীরটা কেমন করছে! না না তেমন কিছু নয়! অমন করে না তাকিয়ে বসে পড়। একটু রেস্ট নিয়ে আমি বেরুব। আর শোন, বিকেলে কেউ এলে একটু অপেক্ষা করতে, বলিস! কারুর ফোন এলে জেনে রাখিস কোনো জরুরি কথা আছে নাকি।

তিনটেয় বেরিয়ে পড়লেন লাল ল্যান্ডরোভার নিয়ে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এখান থেকে মিনিট পনেরর রাস্তা। কিন্তু ইচ্ছে করেই গাড়ি নিলেন। গাড়িওয়ালা না হলে ও সব মহলে পাত্তা পাওয়া কঠিন।

পকেটে রোজি স্মিথের ঠিকানা লেখা ছিল। অরিজিৎ বলছিল, বাড়িটার মালিক মিসেস মিশেল। জেভিয়ার নামে রিটায়ার্ড রেলকর্মী তার সঙ্গে থাকে। জেভিয়ারই নাকি কন্টাক্টম্যান। তার হাতে অনেক মস্তান আছে।

বাড়িটা দোতলা? জরাজীর্ণ অবস্থা। গেট আছে। গেটের পর বারান্দায় ওঠার সিঁড়ি। দুধারে বুগানভিলিয়া লাল হয়ে আছে। গেটের সামনে যেতেই তার বয়সী কিন্তু রোগা হাড়জিরজিরে এক অ্যাংলো-সায়েব চোখে বিস্ময় ও সন্দেহ নিয়ে সিঁড়িতে আবির্ভূত হল। ট্যাস ইংরেজিতে বলল–কাকে চাই আপনার?

কর্নেল ভেতরে গিয়ে বললেন রোজি স্মিথকে।

–তাই বলুন। বলে সে কেমন হেসে নেমে এল। ওপরে দোতলার দিকে মুখ তুলে হাতছানি দিয়ে ডাকল–রোজি! রোজি।

জানলায় লালচে চুল, ফর্সা, লম্বাটে একটা মুখ পর্দা তুলে বলল কী হয়েছে খুড়ো (আঙ্কল)?

–এই ভদ্রলোক তোমাকে খুঁজছেন!

রোজি জোরালো চোখে কর্নেলের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল–আমি এখন ব্যস্ত।

বারান্দা থেকে শ্যামবর্ণ প্রকাণ্ড মোটা এবং গাউনপরা এক বৃদ্ধা কুৎসিত খিস্তি করল রোজির নামে চাপা গলায়। তারপর জেভিয়ার সায়েবের উদ্দেশে বলল–ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস কর, আর কাউকে চাই নাকি। কেটি এখন খালি আছে, কেটি ইজ ফ্রি নাও।

জেভিয়ারের চোখ থেকে সেই সন্দিগ্ধ ভাবটা ঘুচে গেছে। চোখে হাসি টলটল করছে। দাড়িওয়ালা তার বয়সী এক হুমদো বুড়ো তাদের মতোই ইংরেজি বলছে এবং পাক্কা ইউরোপীয়ের মতো ভাবভঙ্গি। নিশ্চয় বিদেশী— ইংলিশম্যান না তোক। সে মুচকি হেসে বলল–নিশ্চয় কলকাতার বাইরে থেকে?

–হ্যাঁ! বোম্বে।

কলকাতার তোক দেখলেই চেনা যায়। ইউ আর ওয়েলকাম জেন্টলম্যান!

বুড়ি গর্জন করল অশ্লীল ভাষায়। –কেটিকে ডাকছ না কেন? ড্যাম ফুল। ক্রিয়েটিং সিন এগেন। হেই ম্যান, ইউ কাম হেয়ার। কেটি! কেটি?

বুড়ির চিৎকার শুনে কানে তালা ধরে গেল। কিন্তু কেটি নেমে এল। পরনে হাতকাটা ম্যাক্সি। রোগা, নাক বেরিয়ে থাকা একটা মেয়ে। বয়স অনুমান করা কঠিন। কর্নেল বারান্দায় উঠে গেলেন। কেটি নির্বিকার দৃষ্টে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি কি পাদ্রী নাকি?

কর্নেল হাসলেন। কক্ষণো না। আমি ব্যবসায়ী। বোম্বেওয়ালা।

একশো টাকা।

–উহঁ পঁচিশ।

–পঞ্চাশ। শেষ কথা!

জেভিয়ার মধ্যস্থতা করল।–ওক্কে। তিরিশ দাও। ঝামেলা কর না।

কেটি বলল–তাহলে পঁয়ত্রিশ।

সে হাত বাড়াল। কর্নেলের মনের ভেতর অট্টহাসি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আর কখনও হয়নি। কিন্তু যত কদর্য হোক, এই পদ্ধতি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। টাকা দিয়ে কেটিকে অনুসরণ করলেন। ঘোরালো অন্ধকার সিঁড়ি। খদ্দেরের খাতিরে কেটি সুইচ টিপে আলো জ্বালল! মিটমিটে আলো। ওপরে গিয়ে কেটি একবার ঘুরে লাস্যের ভঙ্গিতে হাসল। –এস হে বুড়ো প্রেমিক (কাম অন মাই ওল্ড লাভার)!

পাশের দরজায় উঁকি মেরে রোজি একবার দেখেই শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। কর্নেল সেদিকে তাকিয়ে আছে দেখে কেটি বাঁকা হেসে বলল রোজিকে পঁয়ত্রিশে পাচ্ছ না ম্যান! তার দাম অনেক। পাশে দুটো জিরো যোগ কর।

কর্নেল ভেতরে ঢুকলেন। চারদিকের দেয়ালে অশ্লীল ছবি। টেবিলে বিদেশী সেক্সপত্রিকা। একটা জীর্ণ খাটের ওপর ছোবড়ার গদি। তার ওপরে সস্তা ধরনের বেডকভার চাপানো। কেমন একটা কড়া গন্ধ ঘরের ভেতর। গাঁজা কিংবা ওই জাতীয় কিছু। একপাশে যেমন তেমন সোফাসেট। একটা ছোট্ট কাঠের আলমারি। একটা ড্রেসিং টেবিল। টিফিন কেরিয়ার। একটা ছোট আলনায় কিছু পোশাক ঝুলছে। হয়তো আসবাবগুলো ভাড়া করা। মাথার ওপর নড়বড়ে ফ্যানটাও। চন্দ্রারও এই জীবন ছিল!

কেটি দরজা এঁটে কপাটে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। –ড্রিংক চাই না?

না। ধন্যবাদ।

–আমার যে চাই। টাকা দাও!

কর্নেল হাসলেন। তারপর আরও একটা দশটাকার নোট বের করে দিলেন। কেটি সব টাকা দেয়ালে ঝোলানো হ্যান্ডব্যাগে রেখে কাঠের আলমারি খুলে হুইস্কির বোতল বের করল। গ্লাসে ঢেলে খাটের তলা থেকে কুঁজোর জল মেশাল। চুমুক দিয়ে খাটে বসল। কর্নেল তখনও দাঁড়িয়ে। ভাবছেন হতভাগিনী চন্দ্রা এমনি একটা ঘরে থাকত। এই পরিবেশে মারা গেছে। হুঁ কেটি রঙিন জল খাচ্ছে। কর্নেল সোফায় বসে বললেন–কেটি, এখানে এস।

কেটি বললনাও গেট আনড্রেস ম্যান!

-আমি বুড়ো মানুষ, ডার্লিং! শুকনো মরুভূমি!

 –তাহলে আমার দিকে তাকাও। আমি তোমাকে সাহায্য করব।

কেটি ম্যাক্সির চেন টানতে গেলে কর্নেল দ্রুত বললেন–কেটি! আমি সেক্সের জুন্য আসিনি।

কেটি ভুরু কুঁচকে তাকাল। তাহলে কেন এসেছ?

–আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। শুধু কথা।

কথা! কেটি খুব অবাক হয়ে গেল! মাই গুডনেস! কে তুমি?

–বোম্বের ব্যবসায়ী। কর্নেল হাসলেন। আমার এই বাতিক, কেটি। কথা বললেই আমি আনন্দ পাই। তুমি কথা বল আমার সঙ্গে। জাস্ট কথা! বল, কথা বল!

কেটি খিলখিল করে হেসে উঠল।—ইউ ওল্ড পার্ভার্ট! আমি জানি দেখেছি। বুড়োরা কেউ কেউ এসে অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার করে। কিন্তু শুধু কথা বললে কেউ সেক্সের আনন্দ পাচ্ছে, তা দেখিনি। ওক্কে। বল, কী কথা বলব, কিন্তু মনে রেখো, ইতিমধ্যে দশ মিনিট হয়ে গেছে। আর কুড়ি মিনিট বাকি।

–চার মিনিটও হয়নি, ডার্লিং!

তর্ক কোরো না। আমি ঠিক বলেছি। হু, বল কী কথা বলব?

চন্দ্রার কথা।

কেটি চমকে উঠল। তার চোখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। সে গেলাস রেখে আস্তে বলল–তাহলে তুমি পুলিসের লোক? কাল পুলিস এসে খুব ঝামেলা করে গেছে। আবার আজ তুমি ডিটেকটিভ?

চন্দ্রার কথা বলার সঙ্গে পুলিসের কি সম্পর্ক, কেটি? কর্নেল শান্তভাবে হেসে চুরুট ধরালেন। –গতবছর আমি কলকাতা এসে চন্দ্রার সঙ্গে আলাপ করে গেছি। তখন আমার দাড়ি ছিল না। তাই তোমার মনে নেই। আমি এসেছিলুম ফুটবল কোচ অমর্ত্য রায়ের সঙ্গে। চন্দ্রা তখন অসুস্থ ছিল। পরে অমর্ত্য রায় আমাকে বলেছিল, চন্দ্রা মারা গেছে। এ লাভলি গার্ল! খুব মায়া হয়েছিল ওকে দেখে।

কেটি চোখ বড় করে শুনছিল। দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল–সত্যি তুমি পুলিসের লোক নও? দেখ, চালাকি কর না। পুলিসের সঙ্গে আমার খাতির আছে।

কর্নেল কান না করে বললেন–চন্দ্রার মৃত্যুর কথা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। তাই ওর কথা শুনতে চাইছি। রোজি ওকে পছন্দ করত না। কিন্তু রোজি ওর অনেক কথা জানে। তাই প্রথমে এসে রোজিকে খুঁজছিলুম।

কেটি ঠোঁট উল্টে বলল-রোজি একটা ডাইনি।

রোজির কথা কর্নেল আন্দাজে বলেছিলেন। দেখলেন, হিসেবে ভুল হয়নি। রোজির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী এই ব্রথেলে চন্দ্রাই ছিল। কাজেই রোজির তাকে পছন্দ করার কথা নয়। একটু হেসে বললেন–স্বপন নামে একটা ছেলের সঙ্গে চন্দ্রার গোপন সম্পর্ক ছিল। স্বপন ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইত। তাই নিয়ে অমর্ত্য রায়ের সঙ্গে তার ঝগড়া।

–তুমি তো দেখছি অনেক কিছু জান! কে তুমি?

–জানি, অমর্ত্য আমার বন্ধু যে!

–তার বয়স তোমার চেয়ে কম।

–তাতে কী? কর্নেল হো হো করে হাসলেন আমি দাড়ি কেটে ফেললে যতটা বুড়ো ভাবছ, এতটা দেখাবে না। হু, যা বলছিলুম। স্বপনকে আমি অবশ্য দেখিনি। তুমি নিশ্চয় দেখেছ।

কেটি শক্ত মুখে বলল–স্বপন মার্ডারার। তার ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। আমি দেখেছি। পুলিস ফ্রেন্ড আছে আমার। সে বলেছে। স্বপন কাকে খুন করে ফেরারি হয়েছে। তুমি তার ব্যাপারে এসে থাকলে ভুল করবে। স্বপন চন্দ্রার মৃত্যুর পর আর এখানে আসেনি।

–স্বপন নয়, চন্দ্রার কথাই জানতে চাইছি, ডার্লিং!

–চন্দ্রা বাঙালি হিন্দু মেয়ে ছিল। মিসেস মিশেল ওকে পিক-আপ করে এনেছিল কোথা থেকে।

অমর্তের কাছে শুনেছি, রাখী নামে ওর এক বন্ধু ছিল। সে এখানে আসত মাঝে মাঝে।

রাখী? ও নামে কেউ এখানে আসত না। নিশ্চয় করে বলতে পারি তোমাকে।

–তাহলে বাইরে বাইরে মিশত ওরা। তুমি কি জানো রাখী স্বপনের বোন?

আমার জানার কোনো দরকার নেই। বন্ধ কর এ সব কথাবার্তা। আমার ভাল লাগছে না।

চন্দ্রা কেন স্বপনের সঙ্গে চলে যায়নি, এটা ভাবতে অবাক লাগে।

 কেটি ঠোঁট বাঁকা করে বলব গিয়ে মরবে? এখন কী অবস্থা হত বেঁচে থাকলে চন্দ্রা? ওর বাবা এসে কতবার সাধাসাধি করত, পুলিসের নাম করে ভয় দেখাত, তাই যায়নি, তো কোথাকার কে স্বপন!

–ওর বাবা ছিল নাকি?

কেটি হেসে উঠল। –ম্যান! বাবা ছাড়া কেউ জন্মায় নাকি? বোকার মতো কথা বল না।

–কেটি! তোমার ড্রিঙ্ক শেষ। আবার ড্রিঙ্ক নাও। বলে কর্নেল আবার একটা দশ টাকার নোট দিলেন।

কেটি টাকাটা নিয়ে সেই হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে আলমারি খুলল। কর্নেল দেখলেন অন্য একটা বোতল থেকে হুইস্কি ঢালছে। সত্যিকার হুইস্কি বলে মনে হল। জল মিশিয়ে একটু গিলে সে হাসল–থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যান!

তাহলে চন্দ্রার বাবা এখানে আসত?

–না। ওই গেটে দাঁড়িয়ে ডাকত! মিসেস মিশেল ঢুকতে দিলে তো? একটা বাজে লোক, এ ম্যান ফ্রম দা স্ট্রিট। মিঃ জেভিয়ারের চাইতে রোগা। নোংরা পোশাক। জাস্ট এ ওয়ার্কম্যান! কলকারখানায় যারা কাজ করে, তাদের মতো।

কর্নেল উত্তেজনা চেপে বললেন–পুলিস দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইত?

–বোকার মতো কথা বল না! পুলিসের কর্তারা মিসেস মিশেলের ঘনিষ্ঠ লোক। মানে, মাসে মাসে প্রচুর টাকা দেয়। দাগী ক্রিমিন্যাল এসে পড়লে খবর দেয়। তা ছাড়া মিঃ জেভিয়ারকে দেখলে–তাকে যা ভাবছ, তা নয়। ওর একটা গ্যাং আছে।…বলে কেটি পা দুটো নাচিয়ে হাসল। পুলিসও তা জানে। তুমি পুলিস হও, বা ডিটেকটিভ হও, আমি গ্রাহ্য করি না।

চন্দ্রার কাছে ওর বাবা-মায়ের ছবি ছিল নিশ্চয়! কর্নেল স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে কথাটা বলে হেঁট হয়ে জুতোর ফিতে ঠিকঠাক করতে থাকলেন যেন উঠে পড়বেন এবার।

কেটি বলল–ছিল। আমি দেখেছি! আমাকে দেখাত। ওর ছোটবেলার ছবিও দেখেছি।

–ছবিগুলো নিশ্চয় মিঃ জেভিয়ার বা মিসেস মিশেলের কাছে আছে। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।

কেটি ব্যস্ত হয়ে বলল–চলে যাচ্ছ?

–এতক্ষণে আধঘণ্টা হল, ডার্লিং!

–কেটি পেছন পেছন আসছিল। সিঁড়ির মুখে এসে বলল–আবার এস। ডিটেকটিভ হও, আর যেই হও–আমি…একটা অশ্লীল কথা বলে সে হাসতে লাগল। শুধু কথা বলেই আজ কতগুলো টাকা পেয়েছে।

কর্নেল নিচে এসে দেখলেন, বুড়ো বুড়ি বসে আছে। তাকে দেখেই বুড়ো তড়াক করে উঠে ওপরে চলে গেল। কর্নেল কথা বলার সুযোগ পেলেন না। মিসেস মিশেল গম্ভীর মুখে পুরনো পত্রিকা পড়ছে। তাকালও না। কর্নেল নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে। গেট খুলে সোজা গাড়িতে উঠলেন। স্টার্ট দিয়ে আয়নায় দেখলেন, পানের দোকানের সামনে একটা লোক তার গাড়ির নম্বর টুকছে। অরিজিতের লোক। যাই হোক, রোজির চেয়ে কেটিই তাঁকে খুশি করতে পেরেছে।

ট্র্যাফিক জ্যাম সারাপথ। বরানগরে পারমিতার বাড়ি খুঁজে বের করতে অন্ধকার হয়ে গেল–লোডশেডিং। বাড়িটা হাউসিং এস্টেটের। সামনে লন কিছু গাছ, ছোট্ট পার্ক। বুগানভিলিয়ার ঝাপি ঠিক সিঁড়িতে ওঠার বড় দরজার মাথায়। দুদিক থেকে দুটো গাছ উঠেছে। পারমিতা চারতলার ফ্ল্যাটে থাকে। ঢুকতে গিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন কর্নেল। বরাবর এই ষষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধ কোনো বিপদের মুহূর্তে সজাগ করে দেয়। ঘুরেই অন্ধকারে বুগানভিলিয়ার ঝোপের মতে প্রকাণ্ড গুঁড়িটার আড়ালে বাঁদিকে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। সঙ্গ সঙ্গে টর্চ জ্বাললেন। দেখলেন মাথার একপাশে ব্যান্ডেজ বাঁধা একটা লোক। দুহাতে মুখ ঢেকে সে বলে উঠল–আলো নেভান! আমি স্বপন। রাখীর দাদা!

কর্নেলের টর্চ নিভে গেল। এখানে কী করছ?

–মিতুদির কাছে এসেছিলুম সব কথা বলতে। শুনলুম, আপনি আসছেন। বসে থেকে থেকে দেরি দেখে চলে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ গাড়িটা এল। তার ভেতর। আপনাকে দেখলুম।…স্বপন ফিসফিস করে কথা বলছিল। পা বাড়িয়ে ফের বলল–মিতুদির কাছে আপনার চেহারার ডেসক্রিপশান জেনে নিয়েছি। মুখে দাড়ি। ফর্সা সায়েবদের মতো রঙ।

কর্নেল উত্তেজনা দমন করে বললেন–এস।

স্বপন সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলল–বেশিক্ষণ থাকা ওর রিস্কি। প্লিজ, দেখবেন যেন।

–দেখব। তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?

–এটার জন্যই রিস্ক নিয়ে দৌড়ে এসেছিলুম। উনি আপনার কথা বললেন। অমিয়বাবু, বাবা আর গতরাতে অর্মত্যদাকে যে খুন করেছে, সে এবার আমাকে খুন করতে চায়। খুব বেঁচে গেছি কাল রাতে।

কর্নেল বললেন–চুপ। মিতার ঘরে বসে সব শুনব।…