সেদিনকার ডঃ সুন্দরম নন। একেবারে ভিন্নমূর্তি বলা চলে। ঝোড়ো কাক কিংবা কাকতাড়ুয়ার মতো দেখাচ্ছে। ফোঁসফোঁস শব্দে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন–আমি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী কর্নেল সরকার! বুঝতেই পারছেন কী বিপজ্জনক জায়গায় চাকরি করি। মালিকের হুকুমমতো কাজ না করে উপায় থাকে না। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আর মিঃ চৌধুরী, আপনার কাছেও ক্ষমাপ্রার্থী।
কর্নেল বললেন-বনানী আপনাকে সব বলেছে?
–অফিসে এসেই বলেছে। শুনেই আমি অফিস থেকে ছুটে আসছি। প্লিজ কর্নেল সরকার! ইন্দ্রজিতের চিঠিটা আমাকে ফেরত দিন।
ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তো আপনার দেখা হয়েছিল। আর চিঠিটার কী দাম?
–আপনিই তো বনানীকে বলেছেন ওটা কারুর হাতে পড়লে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পারে।
–তা নিশ্চয় পারে। কাজেই চিঠিটা আপনার সামনে আমি পুড়িয়ে দিচ্ছি বরং!
ডঃ সুন্দরম আমতা-আমতা করে বললেন–পুড়িয়ে দেওয়ার আগে আমি একবার দেখতে চাই, ইন্দ্রজিৎ কী লিখেছিল।
–ইন্দ্রজিৎ লিখেছিল, গাফে যুদ্ধ আসন্ন মনে হচ্ছে। যুদ্ধ সত্যি বাধলে সে কয়েক কোটি টাকার কারবারের সুযোগ পাবে। আপনি যেন আগে থেকে খদ্দের দেখে রাখেন। খদ্দের যেন বিদেশি হয়। একটা বিদেশি ফার্মের একজন এজেন্ট কলকাতায় আছেন। তার সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।
ডঃ সুন্দরম ব্যস্তভাবে বললেন–চিঠিটা প্লিজ আমাকে দেখতে দিন।
–আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, ডঃ সুন্দরম!
–তবু একবার দেখতে চাই কর্নেল সরকার!
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনি কি একটা কোড নাম্বার দেখতে চাইছেন? কেন? ইন্দ্রজিৎ আপনাকে কোড নাম্বারটা দেয়নি গালফ থেকে এসে?
ডঃ সুন্দরম গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন।
–আমার প্রশ্নের উত্তর দিন ডঃ সুন্দরম!
–আসলে…..
বলুন!
–কোড নাম্বারটার কপি ইন্দ্রজিৎ গালফ থেকে পালানোর সময় হারিয়ে ফেলেছিল। কম্পিউটার সিস্টেমের কোডনাম্বার মুখস্থ রাখা কঠিন।
–কোড নাম্বারটা কিসের ডঃ সুন্দরম?
ডঃ সুন্দরম আড়ষ্টভাবে একটু হাসলেন–সেই বিদেশি ফার্মের কলকাতার এজেন্টের। নাম্বারটা পেলে আমি তার নামঠিকানা খুঁজে পাব। ওটা ইন্দ্রজিৎকে সেই ফার্মই দিয়েছিল। ওরা সরাসরি নাম ঠিকানা জানায় না। তাতে বিপদ আছে। কোড নাম্বারটা পেলে আমি কম্পিউটারে অ্যানালিসিস করব। প্রকৃত নামঠিকানা পেয়ে যাব।
–পেয়ে আপনার কী লাভ হবে?
–খুলেই বলছি কর্নেল সরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে চোরাই জুয়েলসের কারবারে দালালি করি। ইন্দ্রজিৎ আমার সহযোগী ছিল। এখন ইন্দ্রজিৎ বেঁচে নেই। আমার দালালি কারবারের মোটা টাকা সেই বিদেশী কোম্পানির কাছে পাওনা আছে। গাফে যুদ্ধের জন্য টাকাটা আটকে গেছে। কাজেই তাদের কলকাতার এজেন্টকে চাপ দিতে পারব, যদি তার নাম-ঠিকানা পাই। বলতে পারেন এই ধরনের কারবার বেআইনি। কেন আমি বেআইনি কাজে লিপ্ত আছি? তার উত্তরে আমার বলার কথা একটাই। যেভাবে হোক, দৈবাৎ এইসব চক্রে জড়িয়ে গেলে আর বেরিয়ে আসার পথ থাকে না। সরকারের সাধ্য নেই আমাকে রক্ষা করে। এটাই সমস্যা। কর্নেল সরকার! এই চক্রটা আসলে চেইন অব ব্ল্যাকমেলিং। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে ব্ল্যাকমেল করে বেঁচে আছি। ইন্দ্রজিতের চিঠিটা হাতে পেলে একটা লোক আমাকে ব্ল্যাকমেলের সুযোগ পেত। আর আমি কোডনাম্বারটা পেলে কোনও একটা লোককে কার্যত ব্ল্যাকমেইল করব। অকপটে বলছি কর্নেল সরকার! এ-ও একধরনের ব্ল্যাকমেলিং! কিন্তু আমার পাওনা আদায় করার আর কোনও পথ তো আপাতত নেই।
ডঃ সুন্দরম রুমালে মুখ মুছে ফের বললেন–আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। এবার আপনার বিচারে যা হয় করুন।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন ইন্দ্রজিৎকে কি আপনি বলেছিলেন, যে এজেন্টের কোডনাম্বার সে পাঠিয়েছিল, তার কোম্পানির কাছে আপনার অনেক টাকা পাওনা আছে?
বলেছিলাম। বনানী সাক্ষী আছে। আপনি জেনে নিতে পারেন বনানীর কাছে।
–একটা শর্তে চিঠিটা দিচ্ছি। আপনি সেই এজেন্টের নামঠিকানা আমাকে দেবেন। না দিলে আপনি বিপদে পড়বেন। কারণ এটার একটা জেরক্স কপি আমার কাছে আছে। কোডনাম্বারটাও আছে। একটু ইতস্তত করে ডঃ সুন্দরম বললেন–ঠিক আছে। নামঠিকানা দেব। তবে, দয়া করে যেন এমন কিছু করবেন না, যাতে আমি বিপদে পড়ি। অর্থাৎ আমিই যে নামঠিকানা দিয়েছি, এটা যেন গোপন রাখবেন।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই ভাঁজ করা হলুদ চিঠিটা বের করে ওঁকে দিলেন। ডঃ সুন্দরম চিঠিটা পড়ে নিয়ে নোটবইয়ে নাম্বারটা টুকে নিলেন। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে পকেটে ভরলেন।
ডঃ সুন্দরম চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেই সময় কর্নেল, বললেন–একটু বসুন ডঃ সুন্দরম! কথা আছে।
ঘড়ি দেখে উঃ সুন্দরম বললেন–আমার তাড়া আছে। যাই হোক, বলুন।
–আপনি বসুন।
অনিচ্ছার ভঙ্গিতে মুক্তা বিশেষজ্ঞ বসলেন। বললেন–যা বলার একটু তাড়াতাড়ি বললে ভাল হয়। প্রসাদজি আজ আমাকে অফিসে না পেলে রাগ করবেন। জরুরি কনফারেন্স আছে সওয়া এগারোটায়।
কিছুক্ষণ আগে প্রসাদজি আমার কাছে এসেছিলেন।
ডঃ সুন্দরম আস্তে বললেন–জানি। আমাকে রিং করে জানিয়ে ছিলেন।
–আগের দিন প্রসাদজি পাঠিয়েছিলেন প্রাইভেট সেক্রেটারি যোগীন্দ্র শর্মাকে। আমি পাত্তা দিইনি।
তাও আমি জানি। প্রসাদজি আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করেন না। আমার প্রতি ওঁর অগাধ আস্থা আছে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–ইন্দ্রজিতের চিঠিটা সেই আস্থা ভেঙে দিত। তাই না?
ডঃ সুন্দরম চাপা স্বরে বললেন–ঠিক তাই। কিন্তু আস্থা ভাঙার ফলটা হত আমার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। প্রসাদজি দরকার হলে নির্বিকারভাবে কাউকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে পারেন। আমি ওঁকে ভীষণ ভয় পাই। বনানীর মুখে কথাটা শোনার পর সেইজন্যই ছুটে এসেছিলাম আপনার কাছে। এবার প্লিজ বলুন, কী কথা আছে আপনার?
ইন্দ্রজিতের চিঠিটা আপনি ছিঁড়ে ফেললেন। কিন্তু ছেঁড়া কুচিগুলো পকেটে রাখলেন কেন ডঃ সুন্দরম? কর্নেল তার পাশের টেবিলের তলায় ওয়েস্টপেপার বাস্কেট দেখিয়ে বললেন–আপনি যেখানে বসে আছেন, সেখান থেকে এটা চোখে পড়ার কথা।
ডঃ সুন্দরম আগের মতো গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমতা-আমতা করে বললেন–আসলে আমি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে পকেটে ঢোকাইনি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে
–ডঃ সুন্দরম! শুধু কোড নাম্বারটাই যদি আপনার দরকার ছিল, তাহলে সেটা টুকে নিয়ে চিঠিটা আমার হাতে ফেরত দেওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তারপর আপনি দেখতেন, চিঠিটা নিয়ে আমি কী করছি। আমি ওটা নষ্ট না করে ফেললে আপনি আমাকে নষ্ট করে দিতে বলতেন। হা–এটাই স্বাভাবিক হত।
–কিন্তু আপনার কাছে জেরক্স কপি আছে বললেন! ডঃ সুন্দরম অপ্রস্তুতভাবে হাসবার চেষ্টা করলেন কাজেই আমি তো আপনার হাতে ধরা থেকে গেলাম।
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন–নাহ। জেরক্স কপিতে ইন্দ্রজিতের আসল মেসেজ থাকার কথা নয়। কোডনাম্বারটা অবশ্য আছে। কিন্তু আসল মেসেজ আছে প্রতি দুলাইনের মাঝখানে, যা জেরক্স কপিতে অদৃশ্যই থেকে যাবে। কারণ প্রকৃত মেসেজ অদৃশ্য কালিতে লেখা। বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে সেটা উদ্ধার করা যায়। আমি লক্ষ্য করেছি, চিঠিটা আপনি যেভাবে ছিড়লেন, তাতে কুচিগুলো সহজে জোড়া দেওয়া যায়।
ডঃ সুন্দরম গলার ভেতর বললেন–আপনি কি প্রকৃত মেসেজটা পড়তে পেরেছেন?
–পেরেছি। কর্নেল শান্তভাবে বললেন।–একথা ঠিকই যে, ব্ল্যাকমেলার আপনাকে চিঠিটার সাহায্যে ব্ল্যাকমেল করতে পারত।
কিন্তু চিঠিতে যা লেখা আছে, তা দিয়ে নয়। প্রসাদজির মতো লোকের পক্ষে আপনার ব্যক্তিগত গোপন কারবারের কথা জানা সম্ভব। ওতে তার মাথাব্যথা থাকতে পারে না। কিন্তু অদৃশ্য কালিতে লেখা প্রকৃত মেসেজ প্রসাদজির পক্ষে ক্ষতিকর হত। তাই সেটা আপনাকে ব্ল্যাকমেলের সাংঘাতিক অস্ত্র। আমি আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী ডঃ সুন্দরম! আপনার কাছে সহযোগিতা চাইছি।
ডঃ সুন্দরম মুখ নিচু করে বললেন–সহযোগিতা করতে আমি রাজি।
–তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আশা করি আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না।
বলুন।
–আপনি চিঠিটা পাননি জেনে ইন্দ্রজিৎ কী বলেছিল আপনাকে?
–একটু ইতস্তত করে ডঃ সুন্দরম বললেনবনানীর বাবার নাকি মেয়ের চিঠি খুলে পড়ার বদঅভ্যাস আছে। চিঠিটা বনানীর বাবাই হয়তো ছিঁড়ে ফেলেছেন। কাজেই ও নিয়ে ভাববার কিছু নেই।
–অদৃশ্য কালিতে লেখা প্রকৃত মেসেজ কী ছিল, ইন্দ্রজিৎ নিশ্চয় তা বলেছিল আপনাকে?
বলেছিল। আপনি ওটা পড়েছেন যখন, তখন বুঝতেই পারছেন ঘটনাটা কোনও তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারলে আমাকে সহজে বিপদে ফেলতে পারত।
–পারত। তবু আপনি ওই মারাত্মক চিঠি ছিঁড়ে টুকরো করে পকেটে নিয়ে যাচ্ছেন! এ কি নিছক কৌতূহল?
-হ্যাঁ। তাছাড়া ইন্দ্রজিৎ যা বলেছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার ইচ্ছাও ছিল। ডঃ সুন্দরম প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালেন।–ঠিক আছে। আপনি বলছেন যখন, তখন এগুলো আমি নিয়ে যেতে চাই না। আপনি ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলার কথা বলছিলেন। বরং আপনি এগুলো পুড়িয়ে ফেলুন।
চিঠির টুকরোগুলো বের করে উনি কর্নেলকে দিলেন। এবার লক্ষ্য করলাম, চিঠিটা বেশ কৌশলে ভেঁড়া হয়েছে, যাতে সহজে জোড়া দেওয়া যায়। ধুরন্ধর বৃদ্ধ রহস্যভেদীর দৃষ্টি এড়ানো সত্যিই কঠিন। তিনি সেগুলো দেখে মিলিয়ে নেওয়ার পর তাঁর প্রকাণ্ড অ্যাশট্রেতে পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–এক মিনিট। আপনার কৌতূহল মেটানোর জন্য অদৃশ্য কালিতে লেখা আসল চিঠিটা নিয়ে আসছি।
ড্রয়িং রুমের কোণ থেকে একটা লকার খুলে একটা সাদা কাগজ নিয়ে এলেন কর্নেল। ইজিচেয়ারে বসে বললেন–আগে বলুন ইন্দ্রজিৎ কী মেসেজ পাঠিয়েছে বলেছিল?
ডঃ সুন্দরম শুকনো ঠোঁট জিভের ডগায় ভিজিয়ে ফ্যাঁসফেসে গলায় বললেন–ও নাকি লিখে পাঠিয়েছিল, মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির বিদেশি বেনামী ইউনিটগুলোর নামঠিকানা আমি দিতে পারলে একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা প্রচুর টাকাকড়ি দেবে। আমি এই অফারটা নিতে রাজি থাকলে শিগগির যেন ওকে জানাই। তো তারপর গালফওয়ার বেধে গেল। কাজেই অফারটা চাপা পড়ে গেছে।
কর্নেল বললেন–এটা দেখে নিয়ে আপনি আমাকে ফেরত দিন।
ডঃ সুন্দরমের হাত স্পষ্টত কাঁপছিল। কাগজটা দেখে নিয়ে কর্নেলকে ফেরত দিলেন। বললেন–আমার অনুরোধ, এটাও পুড়িয়ে ফেলুন।
কর্নেল কাগজটা ছিঁড়ে অ্যাশট্রেতে পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর হাঁকলেন– ষষ্ঠী! কফি!
ডঃ সুন্দরম বললেন–আমি কফি খাব না। উঠি।
–আপনাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন। ততক্ষণে আর দু-একটা জরুরি কথা সেরে নিই।
ডঃ সুন্দরম চাপা শ্বাস ফেলে বললেন বলুন!
–প্রসাদজির সঙ্গে চন্দ্র জুয়েলার্সের সম্পর্ক কেমন?
–ভীষণ খারাপ। আন্তর্জাতিক বাজারে পরস্পর শত্রুতার সম্পর্ক আছে।
–আপনার সঙ্গে?
আগেই বলেছি, অনেক কোম্পানির সঙ্গে আমার গোপন ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। এর বেশি কিছু আমাকে দয়া করে জিগ্যেস করবেন না।
–আপনি কি জানেন হরনাথ চন্দ্রকে কারা কিডন্যাপ করেছে?
বনানী আমাকে বলেছে। শুনে আমার খুব ভয় হচ্ছে। বানী আপনার কাছেই এ কথা শুনেছে?
–হ্যাঁ। কাল সন্ধ্যায় ওকে কথাটা বলেছি। আপনি ইন্দ্রজিতের জ্যাঠামশাইকে চেনেন?
–মুখোমুখি পরিচয় হয়নি। ইন্দ্রজিতের কাছে তার কথা শুনেছিলাম।
–সুপর্ণা ব্যানার্জি ওরফে মিমিকে আপনি চেনেন?
–কে সে?
বনানীর বন্ধু। ওরা একসময় ধানবাদে পাশাপাশি বাড়িতে থাকত।
না।
–গৌরচন্দ্র রায় নামে কেউ আপনাদের এজেন্সিতে চাকরি করে?
–হ্যাঁ। মস্তানটাইপ ছোকরা। যোগীন্দ্র শর্মা তাকে জুটিয়েছিল এজেন্সিতে।
এইসময় আমি বলে উঠলাম–কর্নেল! একি সেই গৌর, যে মিমিদের পাড়ায় থাকে? সেদিন সন্ধ্যায় মিমির অপেক্ষায় সে গলিতে দাঁড়িয়েছিল। তাই না?
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ইন্দ্রজিতের ডেডবডি মর্গ থেকে আনতে গিয়েছিল।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। ডঃ সুন্দরম কফি খাবেন না বলেছিলেন। কিন্তু আগ্রহের সঙ্গে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। কর্নেল অনবরত কফি খান। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আবার কফি খেতে হল আমাকে। গৌরের প্রসঙ্গটা তুলব ভাবছিলাম। মনে পড়ছিল, সেদিন সন্ধ্যায় মিমির গৌরদা সম্পর্কে কর্নেলকে আমি বলেছিলাম, বাজি রেখে বলতে পারি, ও মিমির প্রেমিক। সেই গৌর মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে চাকরি করে, কর্নেল সে-খবর সম্ভবত কাল সন্ধ্যায় জোগাড় করেছেন। ডঃ সুন্দরম বললেন–যোগীন্দ্র শর্মার সঙ্গে শুধু কলকাতা নয়, বোম্বেরও আন্ডারওয়ার্ল্ডের যত দুবৃত্তের যোগাযোগ আছে। তাই প্রসাজি কাকেও খতম করতে হলে তার সাহায্য নেন।
কর্নেল বললেন–প্রসাদজি বলছিলেন ইন্দ্রজিতের সুপারিশে বনানীকে তিনি চাকরি দিয়েছিলেন। এদিকে বনানী বলেছে, সে-ই নাকি প্রসাদজির সঙ্গে ইন্দ্রজিতের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। কার কথা সত্য? ডঃ সুন্দরম বললেন– দুজনের কথাই সত্য, যদি তাদের নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা বিচার করেন। ইন্দ্রজিৎ আমার পুরনো বন্ধু। তার সঙ্গে বনানীর সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে বনানীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তখন সে কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমি ইন্দ্রজিৎকে বলেছিলাম, বনানীর এই এজেন্সিতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ আছে। বনানী তখনও জানত না ইন্দ্রজিতের সঙ্গে প্রসাদজির সম্পর্ক আছে। তারপর বনানী আমার কাছে প্রায়ই আসত চাকরির আশায়। আমি তার কথা প্রসাদজিকে বলেছিলাম। উনি দেখব-দেখছি করে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ দেখলাম বনানীর চাকরি হয়ে গেল। আমি অবশ্য এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–তখন গৌর কি এজেন্সিতে চাকরি করত?
–হ্যাঁ। গৌরের চাকরি হয়েছে একবছর আগে। বনানীর চাকরি হয়েছে মাত্র ছমাস আগে। ডঃ সুন্দরম আড়ষ্টভাবে হাসলেন।–এমন তো হতেই পারে, বনানী জানত না ইন্দ্রজিতের সঙ্গে প্রসাদজির আগে থেকে আলাপ আছে। বনানী আপনাকে কি বলেছে কীভাবে এবং কোথায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে প্রসাদজির আলাপ করিয়ে দিয়েছিল?
বলেছে। হোটেল কন্টিনেন্টালে একটা পার্টি হয়েছিল। সেখানে বনানী ইন্দ্রজিৎকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়। সে প্রসাদজির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ করিয়ে দেয়। পার্টিটা দিয়েছিল দেশের এক্সপোর্ট এজেন্সিগুলির একটা ফেডারেশন। সেখানে অনেক বিদেশি প্রতিনিধিও ছিলেন।
ডঃ সুন্দরম বললেন–আমি উঠি কর্নেল সরকার! দরকার হলে আমাকে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করবেন।
উনি কর্নেলকে একটা নেমকার্ড দিয়ে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি বললাম–এই ব্যাপারটা কি গুরুত্বপূর্ণ কর্নেল?
কর্নেল চোখ বুজে অভ্যাসমতো দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। বললেন– কোন ব্যাপারটা?
বনানীর চাকরি হওয়া বা ইন্দ্রজিতকে প্রসাদজির সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দেওয়ার সত্যমিথ্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ কী?
–কারণ আছে। প্রসাদজি, বনানী এবং ডঃ সুন্দরমের স্টেটমেন্ট থেকে একটা চিত্র ফুটে উঠল। আমার মতে, তিনজনই সত্য কথা বলেছেন। ইন্দ্রজিৎ বনানীর অজ্ঞাতসারে তার চাকরির জন্য প্রসাদজিকে সুপারিশ করেছিল। ডঃ সুন্দরম বনানীর জ্ঞাতসারে সুপারিশ করেছিলেন। এদিকে বনানী জানত না ইন্দ্রজিতের সঙ্গে প্রসাদজির আগে থেকেই পরিচয় আছে। তারপর বনানীর হঠাৎ চাকরি হয়ে যায়। তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে?
কিছু দাঁড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
জয়ন্ত, একটু বুদ্ধি খাটাও। বনানীর চাকরিটা হঠাৎ হয়েছিল। ডঃ সুন্দরমের মুখে হঠাৎ শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে কি তুমি বুঝতে পারছ না বনানীর চাকরি হয়েছিল কোনও তৃতীয় ব্যক্তির গোপন সুপারিশে?
একটু অবাক হয়ে বললম–গৌরচন্দ্রের সুপারিশে নয় তো?
–আমি জেনেছি, বনানী কাল সন্ধ্যা অব্দি জানত না গৌর মিমিদের পাড়ায় থাকে, মিমির সঙ্গে তার প্রেম-ট্রেম আছে। কাজেই গৌরের সুপারিশের প্রশ্ন ওঠে না। বিশেষত সে সাধারণ কর্মী।
তা হলে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি কে?
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন–সমস্যা হল, বনানীর ধারণা, তার চাকরি হয়েছিল ডঃ সুন্দরমেরই সুপারিশে। তাই নাকি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে ডঃ সুন্দরমের কথামতো গোপনে চন্দ্র জুয়েলার্সকে তথ্য পাচার করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার চাকরির পিছনে অন্য লোকের হাত আছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, বনানীকে সে মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে হঠাৎ ঢোকাল কোন উদ্দেশ্যে?
-আপনি বনানীর কাছে তেমন কোনও আভাস পাননি?
–কী আভাস?
ধরুন, তাকে কেউ তার অজ্ঞাতসারে নিজের কাজে লাগাচ্ছে, এমন কোনও সন্দেহ বনানীর মনে জেগেছে কি না?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আজ তুমি বাংলাদেশের ইলিশ খাচ্ছ।
প্লিজ কর্নেল! আজ অফিসে মুখ না দেখালে চাকরি যাবে।
–তোমার চিফকে জানিয়ে দেব, তুমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার একটা রোমাঞ্চকর স্টোরির জন্য লড়ে যাচ্ছ। চলো, বেরুনো যাক। বলে কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী! জয়ন্ত ইলিশ খাবে। আমরা বেরুচ্ছি।
সিঁড়িতে নামার সময় বললাম–তা হলে দেখা যাচ্ছে, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আপনার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–কী পয়েন্ট?
–আমি যেই বলেছি, বনানীকে কেউ হয়তো তার অজ্ঞাতসারে নিজের কাজে লাগানোর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, অমনি আপনি ব্যস্ত হয়ে আমাকে বাংলাদেশের ইলিশ খাওয়াতে চাইলেন এবং বেরিয়ে পড়লেন।
–হুঁ। তোমার পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে
কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলে বললাম–তবে কী?
বনানীকে ডঃ সুন্দরমের মাধ্যমে কাজে লাগিয়েছেন চন্দ্র জুয়েলার্সের হরনাথবাবু। যিনি কিনা প্রসাদজির ঘোর শত্রু। বনানী নিয়মিত চন্দ্র জুয়েলার্সে গোপন তথ্য পাচার এসেছে।
–সে তো বনানী নিজের জ্ঞাতসারেই করেছে।
–কিন্তু ডঃ সুন্দরম এমন সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন কোন সাহসে? এটাই প্রশ্ন।
–প্রসাদজির অগাধ আস্থা তার প্রতি। শেষ সুযোগটা ডঃ সুন্দরম নিয়েছিলেন।
–তবু ঝুঁকিটা সাংঘাতিক। কাজেই ডঃ সুন্দরমকে গার্ড দেওয়ার মতো কেউ ট্রেডিং এজেন্সিতেই আছে, যার সঙ্গে হরনাথের গোপন বোঝাপড়া হয়েছিল। এই আমার সিদ্ধান্ত।
–তা হলে ডঃ সুন্দরম তাকে চেনেন।
–চিনলে আমার কাছে কবুল করতেন। না করার কারণ ছিল না। আমার ধারণা, সতর্কতার দরুন হরনাথ তার নাম জানাননি ডঃ সুন্দরমকে। এবং এখন বুঝতে পারছি, সেই হচ্ছে তৃতীয় ব্যক্তি, যার সুপারিশে বনানীর চাকরি হয়েছিল। ডঃ সুন্দরম শুধু জানতেন, তাঁকে গার্ড দেওয়ার লোক আছে, এই যথেষ্ট। তাই তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
কর্নেল! আমার পয়েন্টটা ভুলে যাচ্ছেন! সেই তৃতীয় ব্যক্তি হরনাথের সঙ্গে গোপনে বোঝাপড়া করেছিল, সে কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার বক্তব্য, তার নিজস্ব কোনও পৃথক স্বার্থেও বনানীকে সে ব্যবহার করেছে। বনানীর অজ্ঞাতসারেই করে এসেছে। আপনি স্বীকার করেছেন, আমার এই পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ।
কর্নেল হাসলেন।–গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরোক্ষে। আশাকরি কিছুক্ষণ পরে সেটা বুঝতে পারবে।
দুজনে গাড়িতে উঠলাম। স্টার্ট দিয়ে বললাম–আমরা যাচ্ছি কোথায়?
–যতীনবাবুর কাছে।
আর কোনও প্রশ্ন তুললাম না। সারা পথ যানজট। গত রাত্রে শ্যামপুকুর পার্কের কাছে যেখানে বনানীকে নামিয়ে দিয়েছিলাম, সেখানে পৌঁছে কর্নেল বললেন–গাড়ি এখানেই রাখো। বাড়িটা কাছাকাছি হওয়াই সম্ভব।
রাস্তার ধারে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা ছিল। সেখানেই গাড়ি রেখে দুজনে একটি সংকীর্ণ রাস্তার মোড়ে গেলাম। কর্নেল একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানে খোঁজ নিলেন। পাঁচতলা বাড়িটা নতুন। দোকানটার উল্টোদিকে এপ্রিলের উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে তার স্থাপত্যশ্রী।
দোতলার পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেলের সুইচ টিপলেন কর্নেল। একটু পরে দরজা খুলে যতীনবাবু উঁকি দিলেন। মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখে-মুখে একটা চমক খেলে গেল। গলার ভেতর বললেন–ভেতরে আসুন।
ঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন কয়েকটি জরুরি কথা বলতে এসেছি, যতীনবাবু!
যতীনবাবু উদ্বিগ্ন মুখে বললেন–জরুরি কথা? ঠিক আছে। বসুন।
আমরা সোফায় বসলাম। মোটামুটি ছিমছাম সাজানো গোছানো ঘর। একালের মধ্যবিত্ত বাঙালির বসার ঘর যেমন হয়। তবে বনানীর মার্জিত রুচিবোধের ছাপ আছে। শুধু প্রশ্ন জাগে, মার্জিত রুচিবোধসম্পন্ন একটি শিক্ষিত মেয়ে কেন তার অফিসের গোপন তথ্য পাচারের কাজে লিপ্ত হয় এবং ইন্দ্রজিতের মতো একটা লোকের প্রেমে পড়ে? নাকি এই যুগটাই এমন যে সুনীতি-দুর্নীতি একাকার হয়ে গেছে, ভাল-মন্দের ভেদরেখা গেছে ঘুচে এবং তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষকে অন্ধ করে ফেলেছে?
যতীনবাবু কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন। কর্নেল বললেন–কাল রাতের ঘটনা আপনার মেয়ের কাছে তো শুনেছেন?
যতীনবাবু শুধু মাথা দোলালেন।
–আচ্ছা যতীনবাবু, মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে বনানীর চাকরি কী সূত্রে হয়েছিল?
যতীনবাবু কর্নেলের দিকে একটুখানি তাকিয়ে থাকার পর বললেনবনি নিজেই যোগাযোগ করেছিল।
–ওই এজেন্সি আসলে একটা আন্তর্জাতিক চোরাচালানি চক্র। ওখানে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। ওরা বিশ্বস্ত সূত্রে সুপারিশে চাকরি দেয়।
–আমি জানি না।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–ইন্দ্রজিতের সঙ্গে বনানীর মেলামেশা আপনি পছন্দ করতেন না। তাই সুযোগ পেলে ইন্দ্রজিতের চিঠি বনানীকে আপনি দিতেন না। তাই না?
যতীনবাবু আবার মাথা দোলালেন।
–কিন্তু চিঠিগুলো কি আপনি সত্যি ছিঁড়ে ফেলতেন?
–হ্যাঁঃ।
নাহ্। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।
যতীনবাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন–আপনি কী বলতে চান বুঝতে পারছি না।
–মিমিরা ধানবাদে আপনার প্রতিবেশী ছিল। কলকাতা আসার পর সেই সূত্রে বনানী মিমির জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি যাতায়াত করত। কলকাতা আসার পর একই কলেজে ওরা পড়াশোনাও করত। আপনিও মাঝেমাঝে মিমির কাছে যেতেন। মিমি আমাকে বলেছে। পরমেশবাবুর সঙ্গে সে আপনার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
–দিয়েছিল।
–আপনি মিমির কাছে কথা প্রসঙ্গে বলতেন, বনানী কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়েছে। কিন্তু কোথাও চাকরি পাচ্ছে না, তাই না?
বলে থাকব।
–মিমি আপনাকে গৌর নামে একটা ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। গৌর মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে চাকরি করে। সেখানে কম্পিউটার সিস্টেম আছে। এর পর বনানীর হঠাৎ চাকরি হয়ে যায়। কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন–এবার বাকি অংশটা আপনার কাছেই জানতে চাই, যতীনবাবু! তারপর কী হয়েছিল মিমি জানে না।
যতীনবাবু মুখ নামিয়ে বললেন–আমাকে বিপদে ফেলে আপনার কী লাভ?
–আমি আপনাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যই এসেছি। কারণ এবার আপনি সত্যি বিপন্ন যতীনবাবু! কাজেই সব কথাগুলো বলা আপনার উচিত।
–কেন আপনি আমাকে বিপন্ন বলছেন, বুঝিয়ে বলুন।
–আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, যদি সব কথা খুলে বলেন।
যতীনবাবুকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। একটু পরে বললেন–গৌর আমাকে মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে বলেছিল, বনি যেন কিছু জানতে না পারে।
–গৌর কার কাছে নিয়ে গিয়েছিল আপনাকে?
–ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের প্রাইভেট সেক্রেটারি যোগীন্দ্র শর্মার কাছে।
এরপর যতীনবাবু যা বললেন, তা ভারি অদ্ভুত। যোগীন্দ্র তাকে প্রথমেই বলেছিলেন, বনানীকে তিনি চেনেন। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তার এমোশনাল সম্পর্কের কথাও জানেন। ইন্দ্রজিৎ নাকি এজেন্সিকে ঠকাচ্ছে তাই বনানীর চাকরি হতে পারে একটা শর্তে। শর্তটা অদ্ভুত মনে হয়েছিল যতীনবাবুর। গালফ থেকে ইন্দ্রজিৎ বনানীকে যে সব চিঠি লেখে, সেই সব চিঠি যতীনবাবু যদি গোপনে হাতিয়ে শর্মার কাছে গৌরের মারফত পাঠান, তা হলে বনানীর চাকরি হবে–শুধু তা-ই নয়, যতীনবাবুও সেজন্য নিয়মিত টাকা পাবেন। তাই যতীনবাবু তার কথায় রাজি হন। মেয়ের একটা হিল্লে হবে এবং তিনিও টাকা পাবেন। কিন্তু বনানী যেন ঘৃণাক্ষরে এসব জানতে না পারে। তারপর বনানীর। চাকরি হল এবং সুযোগ পেলেই যতীনবাবু বনানীকে লেখা ইন্দ্রজিতের চিঠি গৌরের মারফত পাঠিয়ে দিতেন। কোনও চিঠি খুলে পড়তেন না।
শোনার পর কর্নেল বললেন–কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটা চিঠি আপনি খুলেছিলেন। সেটা শর্মার কাছে পাঠাননি। কেন?
যতীনবাবু বললেন–ক্রমশ আমার কৌতূহল জেগে উঠেছিল। এ কথা ঠিক যে, ইন্দ্রজিৎকে আমি পছন্দ করতাম না এবং বনি তার সঙ্গে মেলামেশা করুক, এ-ও আমি চাইতাম না। বনিকে সে নিয়মিত চিঠি লিখছে, এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগত। তাই শর্মা ভদ্রলোকের শর্ত মেনে নিতে ইতস্তত করিনি। আমি ভেবেছিলাম ইন্দ্রজিৎ আর বনির মধ্যে এর ফলে একটা ভুল বোঝাবুঝি ঘটবে। সম্পর্কটা ছিঁড়ে যাবে।
বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপর একসময় আপনার কৌতূহল জাগল কেন?
যতীনবাবু একটু বিরক্ত হলেন এবার।–জাগরে না? ইন্দ্রজিতের চিঠি কেন যোগীন্দ্র শর্মার এত দরকার এবং চিঠিতে এমন কী আছে, তা জানার জন্য কৌতূহল জাগা কি স্বাভাবিক নয়?
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–স্বাভাবিক। কিন্তু বিচিত্র ব্যাপার, আপনি যে চিঠিটা অবশেষে কৌতূহলী হয়ে খুলেছিলেন এবং শর্মাকে দেননি, সেটাই ছিল যোগীন্দ্র শর্মার টার্গেট। তার মানে, এই চিঠিটার জন্যই যোগীন্দ্র আপনাকে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু তার বরাত মন্দ। সেই চিঠিটাই তার হাতছাড়া হয়ে গেল।
আমি বললাম–আপনি নিশ্চয় ডঃ সুন্দরমকে লেখা চিঠিটার কথাই বলছেন?
হ্যাঁ। বনানীকে লেখা ইন্দ্রজিতের চিঠির সঙ্গে এমন একটা চিঠি থাকবে, যোগীন্দ্র শর্মা কোনও সূত্রে তার আভাস পেয়েছিল।
–কিন্তু ডঃ সুন্দরমকে ইন্দ্রজিতের লেখা চিঠিটার সাহায্যে সে ব্ল্যাকমেল। করত। ব্ল্যাকমেল করে বড়জোর কিছু টাকাকড়ি আদায় করত। নেহাত কিছু। টাকাকড়ি আদায়ের জন্য এত আয়োজন? মশা মারতে কামান দাগা?
–মশা নয়, জয়ন্ত!
ঠিক আছে। ধরে নিচ্ছি, ডঃ সুন্দরমকে সে এজেন্সি থেকে সরাতে চেয়েছিল। প্রসাদজির অগাধ আস্থা ভেঙে যেত। হয় তো প্রসাদজি ডঃ সুন্দরমকে সেই শংকর হাজরার মতো খতম করে ফেলতেন। এতে গোগীন্দ্র শর্মার কী লাভ হত?
কর্নেল আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দিলেন না।
যতীনবাবু বললেন কর্নেল সায়েব! বনির কাছে শুনলাম, সেই হলুদ কাগজে লেখা চিঠিটা যে নিতে এসেছিল, তাকে পুলিশ অ্যারেস্টও করেছে। আপনাদের কথাবার্তা শুনে বুঝছি, সে যোগীন্দ্র শর্মারই লোক। চিঠিটা বেহাত হওয়ার জন্য যোগীন্দ্ৰ শৰ্মা আমার ওপর রেগে গেছে। সেজন্যই কি আপনি আমাকে বিপন্ন বলছেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–হ্যাঁ। আপনি সাবধানে থাকবেন। অচেনা লোককে এড়িয়ে চলবেন।
যতীনবাবু খুব ভড়কে গেলেন এবার। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আপনি ওই শয়তান যোগীকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
–যোগীকে পুলিশ খুঁজছে।
অবাক হয়ে বললাম–খুঁজছে মানে? কাল সে আপনার কাছে এসেছিল।
কর্নেল বললেন–গত রাতে লোকটা ধরা পড়ার পর পুলিশ যোগীন্দ্রের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। বাড়ির লোক বলেছে, যোগীন্দ্র বিকেলের ফ্লাইটে বোম্বে গেছে। দমদম এয়ারপোর্টের ওই ফ্লাইটলিস্টে তার নাম আছে এবং ওই নামের একজন যাত্রী সত্যি বোম্বে গেছে। বোম্বে পুলিশকে যথারীতি সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। বলে কর্নেল উঠলেন। যতীনবাবু আড়ষ্টভাবে বললেন– তা হলে পুলিশ ওকে ধরে ফেলবে।
কর্নেল তার দিকে ঘুরে বললেন–তবু আপনি সাবধানে থাকবেন। বিশেষ করে গৌর যদি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাকে পাত্তা দেবেন না। তাকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না।
দরজার কাছে যতীনবাবু বললেন–গৌর হারামজাদাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন।
–পুলিশ তার দিকে নজর রেখেছে। তবু আপনি সাবধানে থাকবেন।
বনির কোনও বিপদ হবে না তো?
বনানী অফিস যাবার সময় আপনাকে কিছু বলে যায়নি?
বলে গেছে, অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে ওখান থেকে ফরাক্কায় মাসির বাড়ি যাবে। সেইজন্যই ভয় হচ্ছে।
–সকালে বনানী আমাকে রিং করেছিল। তখন আমিই ওকে কোথাও গিয়ে কয়েকটা দিন থাকার পরামর্শ দিয়েছি। আপনি বনানীর জন্য চিন্তা করবেন না। সময় হলে সে বাড়ি ফিরবে।
বলে কর্নেল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বললাম– আমার প্রশ্নটা আবার তুলছি। হলুদ চিঠিটায় যোগীন্দ্র শর্মার কী লাভ হত? ডঃ সুন্দরমকে ব্ল্যাকমেল করে কিছু টাকা আদায় কিংবা প্রসাদজির আস্থা ভেঙে দেওয়া। তাই বলছিলাম, এটা মশা মারতে কামান দাগা। আপনি শুধু বললেন, মশা নয়। তা হলে কী? ডঃ সুন্দরমকে রাগের বশে প্রসাদজি খতম করলেই বা যোগীন্দ্র শর্মার কী লাভ হত? যোগীন্দ্র শর্মার সঙ্গে ডঃ সুন্দরমের কিসের শত্রুতা ছিল?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–অদৃশ্য কালিতে লেখা মেসেজটা সম্পর্কে যখন ডঃ সুন্দরমকে জিজ্ঞেস করলাম ইন্দ্রজিৎ ওভাবে কী লিখেছিল আপনাকে বলেনি? তখন ডঃ সুন্দরম কী বললেন, তুমি শুনেছ।
শুনেছি। বিদেশে প্রসাদজির বেনামী এজেন্সিগুলোর নামঠিকানা জোগাড় করে দিলে একটি বিদেশি গোয়েন্দাসংস্থা প্রচুর টাকাকড়ি দেবে।
–কিন্তু আমি যখন অদৃশ্য কালিতে লেখা মেসেজটা ডঃ সুন্দরমকে পড়তে দিলাম, তুমি কি ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলে? স্মরণ কর জয়ন্ত।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম–ওঁর হাত কাঁপছিল। উনি পড়মাত্র কাগজটা আপনাকে পুড়িয়ে ফেলতে বললেন।
–হ্যাঁ। কিন্তু জয়ন্ত, তুমি সাংবাদিক হিসেবে আবার দেখছি নিজের অযোগ্যতা প্রমাণ করছ। বরাবর তোমাকে বলে আসছি, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি না থাকলে দক্ষ রিপোর্টার হওয়া যায় না। মুখ জয়ন্ত! মানুষের মুখই হল মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রথম এবং স্বাভাবিক মাধ্যম। তুমি ওঁর মুখের দিকে তাকাওনি। তাকিয়েছিলে চিঠির দিকে। তাই শুধু ওঁর হাতের কাঁপুনি তোমার চোখে পড়েছিল।
অবাক হয়ে বললাম–মেসেজে অন্য কিছু ছিল?
গাড়ির কাছে পৌঁছে কর্নেল হঠাৎ বাইনোকুলারে এদিক-ওদিক দেখে নিলেন। আমি গাড়ির লক খুললাম। তারপর কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন– ইন্দ্রজিৎ তার গোপন মেসেজে সত্যিই কী ছিল ডঃ সুন্দরমকে কলকাতায় এসে আর তা জানাতে চায়নি। সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছিল। এর একটাই কারণ থাকা সম্ভব। সে ততদিনে অন্য একটা পার্টির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছিল। মেসেজটা যখন ডঃ সুন্দরম পাননি এবং বনানীর কথামতো যতীনবাবুর সেটা নষ্ট করে ফেলারই কথা, তখন ইন্দ্রজিতের পক্ষে ডঃ সুন্দরমকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ ছিল।
অস্থির হয়ে বললাম–আহা! মেসেজে কী ছিল বলুন!
–গাড়ি স্টার্ট দাও। লাঞ্চের দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইলিশ, ডার্লিং!
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম–কথাটা না বললে কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশ আমি খাব না।
কর্নেল একটু পরে বললেন–ইন্দ্রজিৎ মেসেজটা পাঠিয়েছিল ইরাকের কুয়েত দখলের মাত্র কিছুদিন আগে। সে ডঃ সুন্দরমকে অদৃশ্য কালিতে লিখেছিল, যুদ্ধ বাধবে বলে তার ধারণা। ইরাকের গোপন রাসায়নিক অস্ত্রকারখানার ঠিকানা এবং ম্যাপের খোঁজ সে পেয়েছে। কিন্তু সেটা হাতাতে পারলেও গালফ অঞ্চলে থেকে ইরাকের শত্রুপক্ষকে বিক্রি করার ঝুঁকি আছে। বরং ভারতে গিয়ে ইরাকের শত্রুপক্ষের কোনও দূতাবাসের মাধ্যমে দরাদরি করা নিরাপদ। ডঃ সুন্দরম যেন এখনই কোনও পশ্চিমী দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাখেন। জয়ন্ত! বাহারিনের সেখ জুবাইর আল-সাবার দশ লক্ষ ডলার দামের মুক্তো আসলে একটি গোপন দলিল–যাতে ইরাকের গোপর্ন রাসায়নিক অস্ত্রকারখানার ঠিকানা এবং ম্যাপ আছে।…