৮. একটি কলঙ্ক একটি প্রেমের প্রয়াস

আট – একটি কলঙ্ক একটি প্রেমের প্রয়াস

আফতাব দারোগা মনে মনে খচে যায় হান্টার সায়েবের ওপর। আচ্ছা, দেখা যায়েগা পিছে। তাকে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে লড়িয়ে দিয়ে সারাপথ ঘোড়ার পিঠে গুম হয়ে থাকে—অবশ্য সেটা মনে মনে। হান্টার লড়বেন হ্যারিসনের সঙ্গে, এটা কি সোনার পাথরবাটি বোঝবার মতন মূর্খ নয় সে। তাই রাঙামাটির ঘাটঅব্দি পথ সে মনশ্চক্ষে অবলোকন করে দুটি তেজি মারকুট্টে মোরগের জোর লড়াই। তোফা, তোফা! গোঁফ পাকিয়ে দাড়ি চুমরে দারোগা ফিক ফিক করে হাসে। আর সেই সময় বুঝি ঘোড়াটারও সাধ যায় জিগ্যেস করে, দারোগা সায়েব হাসলেন কেন?

কিন্তু ঘোড়াটা নিতান্ত নাদান বেঅকুফ। দারোগা ভাবল, তার চাচাতো ভাইয়ের ফুফুতো দাদার বাবা নিশ্চয় গোরাংবাবুর ঘোড়ার চাচাতো ভাইয়ের ফুফুতো দাদার কেউ না কেউ হবে—তা না হলে আচমকা সামনের টিলার কাছে গিয়ে যেই দেখেছে গোরাংবাবুর হারিয়ে যাওয়া টাট্টুটা চরছে, অমনি আচমকা লাফিয়ে উঠে চিঁ—হি—হি—হি বলে ওঠে?

দারোগাসায়েব পড়ে যায় আর কী, চরণ চৌকিদার দৌড়ে গলার চামটি টেনে ধরল। তারপর আড়চোখে পেটের তলা দিয়ে দেখে নিল দারোগাবাবুর ইনি স্ত্রীজাতীয় প্রাণী। সুতরাং সে হাসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অকুতোভয়ে বলে উঠল—’দারোগাসায়েব, হাসলেন ক্যানে?’ চরণ ভেবেছিল, সে নিজে যে যৌনতাঘটিত কারণে হেসেছে—দারোগাও তাই।

এই বাক্যটা পরে কীভাবে চালু হয়ে যায় এলাকায়। ‘দারোগাসায়েব, হাসলেন ক্যানে’ শেষঅব্দি ‘দারোগাবাবু, হাসলেন ক্যানে’ থেকে ‘ও দারোগা, হাসলে ক্যানে’তে পৌঁছায়। রহস্যময় প্রসঙ্গের সূত্রেই মাঠের রাখাল চাষাভুষো থেকে বাবু ভদ্রলোক মিয়াপণ্ডিত অর্থাৎ ইতরভদ্র সবাই ওটি ব্যবহার করতে থাকে। তারপর তো এমন হল, লোকে রহস্য টের পেলেই বলে, ‘ওহে, এর মধ্যে দারোগার হাসি আছে।’ কচি ছেলেমেয়েরা সুর ধরে গায়—স্ত্রীলোকেরাই সম্ভবত তাদের ছড়া বানিয়ে দিয়েছে, হয়তো কোনো সন্তানসুখী মা আদর করতে করতে দোল দিতে দিতে বলেছে, এবং পরে তাই রীতিমতো ছড়া হয়ে কর্ণসুবর্ণ তল্লাট ছড়িয়ে চলে যায় চতুর্দিকে—

ও দারোগা, হাসলে ক্যানে

ও দারোগা হাসলে ক্যানে

দারোগাবাবু হাসে

মিচিক মিচিক হাসে

বাঁজা মেয়ের ছেল্যা হবে

গেল—ফাগুন মাসে।।

‘গেল—ফাগুন’ মানে গত ফাগুন। ওমর শেখ চাঁদপাড়া জামাইবাড়ি এসে সেই ছড়া শিখে নেয়। পরে হান্টারসায়েবকে বলেছিল, ‘ভেরি গুড সং স্যার, ভেরি পপুলার সং। দারোগাবাবু মিচিক মিচিক লাফিং।’

আফতাব খাঁ হান্টারসায়েবের ওপর খচেছিল, কারণ এক ‘মৌগি ছেনাল কুত্তিন’কে শাস্তি দেওয়া যায়নি—হান্টারসায়েব এসে পড়েছিলেন তক্ষুনি। গোরাং ডাক্তারকেও কিছু গুঁতো দেবার শখ ছিল, হয়নি। তবে এখন সামনে অঢেল সময়। আজ শালাকে নৌকোয় ফেলে—আচ্ছা, দেখা যায়েগা পিছে। এখন হাতেম ব্যাপারী বামুনভোগ চালের ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে ঝিলের ঘাটে অপেক্ষা করছে। মনে প্রচুর সুখ দারোগার। সুখে গুম হয়ে মোরগ—লড়াই দেখতে গিয়েই ঘোড়াটা নড়েছে আচমকা।

কুতকুতে চোখে ডাক্তারের ঘোড়াটা দেখে দারোগা হুকুম দেয়, ‘পাকড়ো শালাকো!’ গোরাংবাবু আর হেরু পাশাপাশি যাচ্ছে। শক্ত দড়িদড়া দিয়ে দুজনের কোমর বাঁধা, হাতে হাতকড়া। টিলায়—টিলায় ভিড় জমেছে। কারও কাছে আসার সাহস নেই। কেউ ভয় পেয়ে দেখছে, কেউ খুশি হয়ে দেখছে। তবে সবার মনেই একটা আশা—আশঙ্কা গুরু গুরু করে বেড়াচ্ছে। হেরু ডাকাত এখন ইচ্ছে করলেই তো ঝড় যেমন পটাপট দড়িদড়া ছিঁড়ে নৌকো টালমাটাল নিয়ে পালায় অথৈ উত্তাল জলে, মেঘ তেমন ডুকরে ওঠে ঝিলিক ছেড়ে দ্যায় গাছপালার ওপর, যেমন কিনা রেলগাড়ির কালো এনজিনটা ঝাঁ ঝাঁ গাঁ গাঁ করে ছুটে যায় একদিক থেকে অন্যদিকে—হেরু নিমেষে ছুটে যেতে পারে সব অস্বীকার করে। বন্দুকের গুলির মতন ফুটে বেরোতে পারে। দারোগা আর সেপাই আর চৌকিদার দফাদার বন্দুক সবকিছু শুকনো পাটকাঠির মতন মটামট ভেঙে উধাও হয়ে যেতে পারে আঁরোয়া জঙ্গল ছাড়িয়ে অবাধ কাশকুশময়, হিজলবিলের দুর্গমতায়। কেন তা করছে না হেরু? ওরে শালা বাউরি, হল কী তোর? তুই বানের মতন ভাঙ, পাড়ের মতন ধসে পড়। শালার ব্যাটা শালা, বাঘের মতন ডাক, ষাঁড়ের মতন গুঁতো!…

হ্যাঁ, এইসব মার—মার তেড়ে আসা অথচ গভীর নিঃশব্দ চিৎকার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জনতায় তখন সঞ্চারিত—এবং দারোগা গর্জায়, ‘পাকড়ো শালাকো!’ সব ভিড় পলকে ছত্রভঙ্গ হয়। দুদ্দাড় পালাতে থাকে। মেয়েরা কেউ কেউ শুকনো কাঠকুটো কুড়োবার ভান করে। সবাই ভাবে, পুলিশেরা কি মনের লেখনও পড়ে নিতে পারে মুখ দেখেই? পারে বইকি—পুলিশ তো ছাই দিয়ে দড়ি বানাতে জানে, একথা গ্রাম্য ডাকপুরুষের বচন। সুতরাং সবাই খড়ি—খড়ি কাকতাড়ুয়ার মতন নড়বড় করে পালাতে থাকে।

কিন্তু দেখা যায়, গোরাংবাবু যখন মুখ তুলে নিজের প্রিয় ঘোড়াটা দেখছেন এবং দুচোখে আলো জ্বলছে, যখন প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন আর কী, তখন দুজন সেপাই, তিনজন চৌকিদার আর একজন মাত্র দফাদার দৌড়ে যাচ্ছে ঘোড়াটার দিকে। ওখানে ভিড় তখন থমকে দাঁড়ায়।

ঘোড়াটা অমনি চার ঠ্যাং তুলে হ্রেষাধ্বনি করে লাফিয়ে ওঠে। আক্রমণকারীরা দাঁড়িয়ে যায়। বিবেচনা করে হয়তো, দারোগাসায়েব ঘোড়াটাকেও সত্যি—সত্যি গ্রেপ্তার করতে বললেন নাকি।

মারমূর্তি দারোগা লক্ষ্য করে নিজের মাদিটার শরীর অব্যক্ত চঞ্চলতা—নাকি নিজেরই মনুষ্যমতির ভ্রম। সে আরও রেগে গর্জায়—’ফায়ার! ঘোলি করো ঘোলি করো!’

দেখতে না দেখতে একজন সেপাই বন্দুক ছোঁড়ে—গুড়ুম! প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যায় টিলা থেকে টিলায়। একঝাঁক ঝিলগামী কাক কলরব করে গতি বদলায়। বাজপড়া ন্যাড়া তালগাছ থেকে চিলটা পড়ি—কি—মরি করে পালিয়ে যায় দূর স্টেশনের দিকে। জনতাও পালায় ফের। ক্রমাগত কুলক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পুলিশের বন্দুক ফুটতে তারা কেউ শোনেনি এযাবৎ কাল।

আর শ্রীমান ‘চৈতক’ কি না অমনি হরিণদৌড়ে টিলায় উঠে ওপাশে ঢালুতে অদৃশ্য হয়। সবকিছু ভুলে গোরাং ডাক্তার হো হো করে হেসে ওঠেন।… ‘বাহাদুর ব্যাটা। বলিহারি, বলিহারি!’

আফতাব দারোগা টেরচা তাকিয়ে বলে, ‘চো—ও—প!’

গোরাং ডাক্তার শিশুর মতন ছড়া কাটেন—

 এক দুই তিন

 চলল ঘোড়া ফতেসিং।।

গোরাংবাবু বলেন, ‘বুঝলেন খাঁসায়েব? আমার ঘোড়া এখন ফতেসিং চলল। ফতেসিং পরগনার নাম শুনেছেন? আঁরোয়া পেরোলেই পরগনা ফতেসিঙের মাটি, পাটন বিল ছাড়িয়ে বর্ধমানের সীমানা, পাটন বিলের জলে চাঁদ সদাগরের নৌকোর দাগ আছে খাঁসায়েব—পড়েছেন মনসামঙ্গল? বলে, জলে দাগ থাকে না—থাকে গো থাকে! দারোগাসায়েব! পশ্চিমে বীরভূম জেলা, উত্তরে মহালন্দী পরগনা—এই হল ফতেসিং সুবা। রাজা ছিল তার ফতেসিং—জেতে হাড়ির ছেলে। বুকের পাটা করে বলে, কে রে, দিল্লির বাদশা আকবর শাহ, কে চেনে তাকে? বাদশা পাঠালে সেনাপতি মানসিংকে—আভি শির মাংতো উও হাড়িকা বাচ্চার! মানসিং এল। ফতেসিঙের রক্তে আজকের কান্দী মহকুমা লাল হয়ে গেল। বুঝলে খাঁ সায়েব। সেই ফতেসিং পরগনার মানুষ আমি।’ যেন এসব বলে ভয় পাইয়ে দিতে চান বিহারি ডনকুইকজোটটিকে।

দারোগা বলে, ‘এই রঘুয়া, আবে ক্যা দেখতা? মূহমে ডাণ্ডা মার—মার ডাণ্ডা শালাকো মূহমে!’

রঘুয়া লাঠি তুললে চরণ চৌকিদার জোড় হাতে সামনে দাঁড়ায়।…’হুজুর, হুজুর মাবাপ! আমার খাতির—মানী মানুষ!’

দারোগা হাসে। ধূর্ত মানুষ আফতাব খাঁ। হান্টারের কানে তুললে বলা যায় না কোনদিকে গড়ায়—কারণ আগেভাগে সাবধান করে দিয়েছে গোরা রেলবাবুটা। ওদিকে সদরে কোন কোন অফিসার ওর দোস্তইয়ার বা কুটুম্ব, দারোগা জানে না। একটা ব্যাপার শুধু জানে সে—গোরা সায়েবরা পরস্পর পেটে—পেটে এক, মুখেমুখেও এক রা। তাই সে বলে, ‘ঠিক হ্যায়!’

সেপাই—চৌকিদার—দফাদার একসঙ্গে বলে, ‘সব ঠিক হ্যায়।’ বিচিত্র মিছিলটা আবার সরু পথ ধরে এগোয়। হেরুর চোখ ভিজে। পিটপিট করে অনবরত। রাঙা রসাল মাটিতে তার হাঁটু অব্দি রাঙিয়ে দ্যায়। গোরাংবাবুর পায়ে জুতো আছে। জুতোও লাল। তবে বর্ষার সময় বলে ধুলো প্রায় নেই—ই। তিনি হাসিমুখেই হাঁটেন। কিন্তু মাঝে মাঝে দূরবর্তী ওই ভিড়ের ইচ্ছের মতন তাঁরও ইচ্ছে করে—হেরু বাউরি আচমকা খেপে উঠুক! তারপর আড়চোখে তার ভাবগতিক লক্ষ্য করে মনে মনে তাকে গাল দেন, মাগির হদ্দ গুয়োটা। এই তোর মুরোদ রে মামদোব্যাটা?

ঘাটের ওপর বিত্তবান সম্ভ্রান্ত মানুষদের একটা ভিড় অপেক্ষা করছিল। হেরুকে ধরতে পারার দরুন তারা প্রায় ফুলটুল মালা নিয়ে অপেক্ষা করার মতন দাঁড়িয়ে ছিল। আগে দারোগার ঘোড়া পৌঁছয়। ওরা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সেলাম হুজুর, সেলাম দারোগাসায়েব!’ পঞ্চমুখে প্রশংসা কাটে। দারোগা বেল্ট খুলে কোমর ঢিলে করে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। হাতেম ব্যাপারী করজোড়ে সামনে আসে। চেয়ার আসে। দারোগা বসলে সেরাজুল হাজি পাখা পাখা বলে চেঁচায়। এবং পাখা এলে নিজেই দোলাতে থাকে দারোগার মুখের ওপর। তার কাঁচাপাকা চুল দাড়ি গোঁফে বর্ষার স্নিগ্ধ বাতাস আচমকা—অনিচ্ছাসত্ত্বেও আঙুল বোলাতে বাধ্য হয়। দারোগা হাঁটুদুটো ধীরে দোলায়।

তারপর আসামিদ্বয় পৌঁছলে সেই অন্য জাতের ভিড় হেরুর বাপান্ত করতে থাকে মুখোমুখি। হাতেম গোরাংবাবুকে শুধু বলে, ‘ধিক, ডাক্তারবাবু, ধিক আপনাকে!’

ঘটকঠাকুর বলে, ‘আপনার কীসের অভাব ছিল ডাক্তারবাবু, যে ওই কুকম্মের জুটি হলেন? এত অভাব যদি, বললেই পারতেন—আমরা চাঁদা করে পয়সা দিতুম!’

আরেকজন বলে, ‘ওই মতলবেই তো পিতাপুরুষের ভিটে ছেড়ে ইস্টিশানে এসে আড্ডা গেড়েছিল ডাক্তার! তখনই আমার সন্দ হয়েছিল, বুঝলে কিনা?’

এবং একসঙ্গে অজস্র নিন্দা পচাটে গন্ধে ভরে তোলে জায়গাটা। অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে থাকে অপমানের নোংরা বৃষ্টি। যেন দেহ বেয়ে পড়ে, ভিজে যায়—কিন্তু গোরাং ডাক্তারের মন ছোঁয় না। মিটিমিটি হাসেন। কখনও বলেন, ‘যা বলছ, বলে নাও, বলে নাও। এমন দিন আর পাবে না!’

সেই সময় আফতাব দারোগা কী বলবে, ত্বরিতে কারা গর্জায়—’চোওপ চোওপ! দারোগাসায়েব কথা বলবেন—হুজুর কথা বলবেন।’ প্রতিধ্বনি ও ধ্বনি, ফের প্রতিধ্বনি বিলিতি অরকেস্ট্রার মতন দারুণ দ্বিগুণ, বেজে ওঠে—’দারোগাসায়েব কথা বলবেন—হুজুর কথা বলবেন।’

ভিড় চুপ হলে সে বলে, ‘আরে, তুমলোক সবকছু সমঝিয়েছে—তো এক ছোটা চিজ নেহি সমঝিয়েছে?’

অনেকগুলো মাথা দোলে। দুবার দোলে। তিনবার এবং চারবারও।

‘তো ইয়ে বাত হ্যায় কী—উও শালা ডাগদার ঘরমে এক শের পালা হ্যায়। কিস লিয়ে? না—উও শের শিকার লিয়ে আসবে। হাঁ—তো উও শেরকো মর্জি ঠিক রাখতে হোবে—নেহি তো কুছ সুবিস্তা হোবে না—কৈ বাত শুনবে না। ঠিক বোলা হাম?’

‘ঠিক বোলা হুজুর, বিলকুল ঠিক।’ ঠিক ঠিক শব্দটা বৃষ্টির মতন পড়ে যায়।

‘তো উও শেরকা কুছ—কুছ গোস্ত খিলাতে হোবে?’ (সহাস্যে)

‘আলবাত খিলাতে হবে।’ এবং প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যায় রাজশশাঙ্কের রাজধানী জুড়ে।

‘তো শালা ডাগদারবাবুকা বাহারসে গোস্ত খরিদ করনা পড়ে।’

‘হ্যাঁ হুজুর।’ এবং একসঙ্গে নাকাড়া বাজতে থাকে হ্যাঁ হুজুর, হ্যাঁ হুজুর, হ্যাঁ হুজুর!

‘তো বাহারমে কেঁও যায়ে গা? ঘরমে যব বহৎ খপসুরুত গোস্তদেনেওয়ালি হ্যায়!’

দারোগা দুর্ধর্ষ হাসতে থাকেন। ভিড়ও হাসে। তুমুল কলরব ওঠে। আরে কী অবাক, এত জলের মতন সহজ ব্যাপারটা কারও মাথায় আসেনি। গোরাং ডাক্তার নিজের বিধবা যুবতী মেয়ের মাংস হেরুকে খেতে দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছিল। হুঁ, এটাই তো স্বাভাবিক। তা না হলে হেরুর মতন দানো পোষ মেনে থাকে? তাই—ই তো!

আর সেই কথা শুনতে শুনতে অসহায় গোরাংবাবু হেরুর দিকে তাকাচ্ছিলেন, একটা কিছু আশা করছিলেন ওর কাছে—এটার মতন চরমমুহূর্ত আর আসতে পারে না। অথচ হেরু উবু হয়ে বসে ভিজে চোখে মাটি খুঁটছে। হাঁটুর ওপর দিকে গাছের ডালের মতন মস্ত দুটো হাত নেমেছে—যে হাত দিয়ে সে অনেককিছু করতে পারে। ইচ্ছে করলেই লোহার হাতকড়িটা দুটুকরো করতে পারে। তারপর দারোগার মুণ্ডুতে এক ফুট গর্ত খুঁড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু শালা বাউরি কিচ্ছু করল না। নিঃশব্দে চিৎকার উঠল গোরাংবাবুর মধ্য থেকে—ওরে হেরু, বল এসব মিথ্যে। হেরু, তোর দোহাই বাবা, একবার বল, ‘না—না—না’।

হেরু বলে না। বলবে না—সে তো জানাই। ও একটা নিষ্ঠুর অন্ধ নির্বোধ শক্তি। ইয়াকুবের প্রেত, ‘চ্যাড়া’র মতন। গোরাংবাবু কাঁপেন। কাঁপন মুখে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং প্রচণ্ড মাথা নেড়ে কেঁদে ওঠেন—না—না—না!’

দারোগা উঠে এসে বুটশুদ্ধ পা তুলে বলে, ‘খবর্দার! চো—ও—প!’

* * * *

এই ব্যাপারটা যখন চলছে, তখন হান্টারসায়েব স্বর্ণকে কী কী করতে হবে বোঝাচ্ছিলেন। নতুন এ এস এম সুধাময়ও ছিল সেখানে। হান্টারের চিঠি নিয়ে স্বর্ণ যাবে সদরে। ঘুরপথে যাবে। ট্রেনে চেপে পরের স্টেশনে নামবে—তারপর পাকা রাস্তা ধরে মাইলটাক গিয়ে গঙ্গা পেরোলে বহরমপুর। গোরাবাজারের কমলাক্ষ মোক্তার, পুলিশ ইনসপেকটর হেরম্ব ব্যানার্জি, এই দুজনের সঙ্গে দেখা করলেই কাজ হবে। পরে ব্যবস্থা হবে। গোরাংবাবুর ছাড়া পেতে দেরি হবে না।

স্বর্ণ আগাগোড়া আগুন হয়ে ধোয়াচ্ছিল, তখন কিন্তু শান্ত এবং ভিজে। এই গোরাসায়েব তাকে শেকসপিয়ারের গল্প শোনায় ভাঙাবাংলায়। এ তাকে গতকাল নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে। স্বর্ণ মনে মনে বলে, ‘তুমিও আমার বাবা—আরেক জন্মের বাবা, সায়েব!’ এবং যখন মনে পড়ে, গতকাল ঝোঁকের বশে মারা পড়লে বাবার এই দশা কিছু হয়তো জানা যেত না, তখন সে মৃত্যু সম্পর্কে প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়ে। সে মনে মনে ফের বলে, ‘আর কখনো মরার নাম করব না—যত কষ্টই হোক—যত দুঃখ আসুক। আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। এ অপমানের শোধ আমি নেব—তবে আমি বাবার মেয়ে স্বর্ণলতা।’

সুধাময় মৃদুভাষী যুবক। সে বিনীতভাবে বলে, ‘কিন্তু আপনি কি একা যেতে পারবেন? গেছেন কখনও বহরমপুরে?’

স্বর্ণ নতমুখে বলে, ‘গেছি—কম বয়সে। আর একবার…’

সুধাময় বলে, ‘তাহলে অবশ্য অসুবিধে হবে না।’

স্বর্ণ জের টেনে বলে, ‘আর একবার গিয়েছিলুম বিয়ের পর—হাসপাতালে।’

‘হাসপাতালে?’

‘হ্যাঁ। আমার স্বামী ছিল—পেটে ঘা। ওখানেই তো মারা যায়।’

‘তাই বুঝি?’

‘তখন আমার বয়স কম। কিছু বুঝতে পারিনি।’

হান্টার কী ভাবছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ান। ‘আমি যাই, মা। কোনো ভয় করবে না। আমি থাকল, সুধাবাবু থাকল। চাঁদঘড়িকে বলে যাব, রাতে তোমার বাড়ি থাকবে। আচ্ছা, আমি যাই?… বলে বারান্দায় গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ান।… টাকা দরকার আছে তো বলো, মা! দেব?’

স্বর্ণ বলে, ‘না। আছে!’

‘আমি কাল এগেন মরনিঙে আসব।’

‘আচ্ছা।’

‘ভেরিওয়েল! গুডবাই সুধাবাবু!’… টুপি নাড়িয়ে হান্টার চলে যান।

সুধাময় বলে, ‘আচ্ছা—আপনার শ্বশুরবাড়িতে একটা খবর পাঠাব?’

স্বর্ণ একটু হাসে। ‘উহুঁ। কেউ আসবে না।’

‘আপনাদের অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন কোথায় আছেন?’

‘গোকর্ণে বাবার খুড়তুতো দাদারা আছেন। সব জ্ঞাতিশত্রু। ওঁদের জন্যেই তো বাবা এখানে চলে এসেছিলেন।’

‘আর কোথাও আপনার মায়ের পক্ষের কেউ নেই?’

‘আমি জানি না। বাবা কিছু বলেননি কখনও।’

‘আশ্চর্য তো!’

‘আমার মাকেই আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না মাস্টারবাবু।’

‘আপনি আমাকে মাস্টারবাবু বলছেন কেন?’ সুধাময় হাসে।

‘বলছি।’…বলে স্বর্ণ আনমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।

সুধাময় একটু ইতস্তত করে বলে, ‘তাহলে আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?’

স্বর্ণ সোজাসুজি ওর দিকে তাকায়।…’আপনি যাবেন?’

‘হ্যাঁ—যেতুম। যাওয়া তো উচিত। আপনি মেয়ে হয়ে অসুবিধেয় পড়তে পারেন—পৃথিবীটা খুব ভালো জায়গা তো নয়।’

স্বর্ণ চুপ করে থাকে—কিন্তু দৃষ্টিতে প্রার্থনা টলটল করে।

সুধাময় ব্যস্তভাবে ওঠে।…’আপের সময় হয়ে এল—শিগগির তৈরি হয়ে আসুন। আমি ততক্ষণে এস এমকে ম্যানেজ করে নিই। ব্যাটা নতুন এসেছে এদেশে—সবসময় ভয়ে চমকায়। তাতে আমার অবশ্য ভালোই হয়েছে। যা বলি, না করে না। বলে কী জানেন? আমি তোমার খুব ভালো বন্ধু!’… হাসতে হাসতে সুধাময় চলে যায়।

খানিক পরে ট্রেনে যখন ওরা চেপেছে, তীব্র হুইসল দিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে—স্বর্ণর বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে। অনেকদিন বাদে এই দ্বিতীয়বার ট্রেনে চাপা হল, গতির পুলক তার রক্তে মৃদু চাপ দিচ্ছিল—কিন্তু এই প্রথম একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে তার ভ্রমণ। আর, এই পুরুষটি যুবক। পুরুষ সম্পর্কে পার্থক্যবোধ অবচেতনায় ছিল, সেটা থাকেই জৈবিক নিয়মে—কিন্তু এখবর বারবার স্বর্ণর মনে নির্দেশকারী একটি আঙুল ভেসে এল। ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষের মতন সেই আঙুলের গুরুতর খেলায় স্বর্ণ জড়োসড়ো হল। সে বাইরের প্রবহমান মাঠ গাছপালা ঝোপঝাড় দেখতে থাকল। কঠিন বস্তুরাজি কীভাবে তরল হয়ে পড়ছে, এঁকেবেঁকে এলোমেলো ছত্রখান হচ্ছে, দীর্ঘ আলগুলো ধূসর মাটির টুকরো বুকে নিয়ে লাটিমের মতন ঘুরতে ঘুরতে নেপথ্যে সরে যাচ্ছে—কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল সে। টেলিগ্রাফের তারগুলো বারবার উঁচু আর নিচু হচ্ছে কেন, খুঁজতে ব্যস্ত হল সে। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে সেই মারাত্মক আঙুলটা তাড়াতে পারল না। তখন সে চাকার শব্দের দিকে কান পাতল। টিকিটবাবুর কত টাকা, টিকিটবাবুর কত টাকা, নাকি একধামা চাল তিনটে পটল, একধামা চাল তিনটে পটল, কী বোল বলছে রেলগাড়ি? হঠাৎ মনে পড়ল জুহা মৌলবির বয়ান।…নরক থেকে নরকে…দোজখ থেকে দোজখে…নরকে—নরকে নরকে—নরকে…। অমনি সাঁৎ করে ঘুরে বসল সে। ঠোঁটে চুইয়ে পড়ল অজ্ঞাতসারে সন্দিগ্ধ হাসি।…’মাস্টারবাবু, রেলের বুলি শুনছেন না?’

সুধাময় ফুটবল সিগারেটের প্যাকেট বের করছিল। স্বর্ণর মুখে পল্লিবালিকার আদল তখন স্পষ্ট দেখে সিগারেট জ্বালতে সে আনমনা হয়। খুব কম পরিচয় মেয়েটির সঙ্গে—তবে বেশ খানিকটা অন্যরকম মেয়ে, নিঃসঙ্কোচ, এবং অনায়াসে এর সঙ্গে অনেক আবোল তাবোল কথা বলা যায়। হ্যাঁ, এটাই এর পক্ষে স্বাভাবিক যে বাবা যখন দজ্জাল দারোগার হাতে বন্দি, চারদিকে ঢিঢি পড়ে গেছে, কেলেঙ্কারী ছুটেছে, তখন রেলগাড়ির চাকার শব্দ নিয়ে ভাবতে পারে। সুধাময় হাসে।…’শুনছি তো।’ বলে সিগারেট ধরায়।

‘সিগারেটের গন্ধ কেমন যেন। সায়েবরা খায়—বেশ লাগে।’ স্বর্ণ বলে।

সুধাময় বার দুই টান দিয়ে বলে, ‘অমন করে জানলায় ঝুঁকবেন না। চোখে কয়লা পড়বে।’

বলতে বলতেই কী আকস্মিক যোগাযোগ, স্বর্ণ ত্বরিতে চোখ কচলাতে ব্যস্ত হয়। ঠোঁট ভেঙে শব্দহীন হাসি, ঝকঝকে সাদা দাঁত কয়েকটা, অস্ফুট স্বরে বলে সে—’পড়ত না। আপনার কথায় পড়ল!’

সুধাময় উদ্বিগ্নমুখে তাকিয়ে থাকে। কামরাটা ছোট। আর কোনো যাত্রী নেই। মেঝের জলের ছোপ এখনও শুকোয়নি। বেঞ্চের এককোণে, দূরত্ব রেখে, সাবধানে বসেছিল সে। এবার একটু যায় যায়। ঝুঁকে পড়ে।…’বেরোল? বেরোয়নি? ভাবছিলুম, সাবধান করে দেব—তা…’

স্বর্ণ আঁচলের খুঁট কাঠির মতন পাকিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করতে যায়, পারে না—বুজে আসে। সে উদভ্রান্ত হাসে। ফের চেষ্টা করে।

সুধাময় আরও ঝুঁকে থাকে, আরও ব্যস্ত হয়।…’আমি—আমি দেখব?’

‘দেখুন না! স্বর্ণ আঁচলের কাঠিটা সাবধানে ওকে দ্যায়। তারপর দুহাতের দুটো আঙুলে বাঁ চোখটা ফাঁক করে একটু।

কী লাল ভয়ঙ্কর চোখ এখন স্বর্ণর! সুধাময় সাবধানে অদ্ভুত সলতের মতন কাঠিটা বাগিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কোথায় সেই কালকুট্টে দুষ্টুটা। ‘দেখতে পাচ্ছি না তো।’

‘নেই?’

‘কই?’

‘তবে থাক।’

‘থাকবে? অবশ্য জলের মধ্যে তাকালে খসে পড়ে। গঙ্গা পেরোবার সময় দেখা যাবে?

‘কিন্তু জ্বলছে যে! ফেট। আপনাদের রেলগাড়িগুলো কী যেন!’

‘আরেকবার দেখি।’

‘ও আপনার কর্ম না।’ স্বর্ণ ভুরু কুঁচকে বলে। তারপর একটা পা সামনের বেঞ্চে তুলে দিলে হাঁটুর নিচে কিছু নীল লোম আর একটা কাটা দাগ বেরিয়ে পড়ে। আলগোছে ঢেকে সে ফের বলে, ‘কাপড়টা ছাড়বেন তো?’

সুধাময় দেখে যে সে আঁচলের কাঠিটা ধরে আছে তখনও। দ্রুত ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে সরে আসে। কিন্তু মনে মনে একটু আহতও হয়। তাই হাসি মিলিয়ে যেতে দেরি হয় না।

স্বর্ণ লাল চোখটা একহাতে চেপে ধরে মাঝে মাঝে। বাইরেটা দেখে নেয়। সুধাময় চুপচাপ সিগারেট খায়। এবং এটা ঠিকই যে এসময় অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা খড়কুটোর মতন উড়ছিল। দুজনের মধ্যে, একটু উত্তেজনাও থরথর করছিল—অন্তত সুধাময় টের পাচ্ছিল, সে যথেষ্ট ক্লান্ত, ঊরদ্বয় ভাঙা গম্বুজের মতন দেহের নিচে পড়ে আছে।

স্বর্ণ হঠাৎ বলে, ‘মাস্টারবাবু, রাগ করলেন নাকি?’

‘আরে না না! কেন? যান কী যে বলেন!’

একটু চুপ করে থেকে স্বর্ণ বলে, ‘আপনি তো বিয়ে করেননি—বিধবাদের ছুঁতে নেই আপনার।’

‘ছুঁতে নেই? যাঃ! কে বলল?’… সুধাময় গলগল করে হাসে।

‘কেউ বলেনি। আমার মনে হয়।’…

রেলগাড়ি তখন একটা পাকা রাস্তার ফটক পেরোচ্ছে। স্টেশন দেখা যাচ্ছে। সুধাময় ওঠে গিয়ে দরজা খোলে। ডাইনে কিছুদূর সমান্তরাল পাকা সড়কে অনেকগুলো গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় গাছের মাথায় রোদের পালিশ ঝকমক করছে। আকাশ অনেকটা ফাঁকা, অনেকটা সাদা পুরু মেঘ। বৃষ্টি হতেও পারে—নাও পারে। হলে মন্দ লাগবে না—অন্তত ফেরার সময় ট্রেনে ওঠার পর। মালকোঁচা করে পরা, প্রায় কাবুলি সালোয়ারের মতন ধুতি, গায়ে সাদা হাফশার্ট—হাতগুটানো, রেলকোট সুধাময় নেয়নি—স্যান্ডেল ঠুকে অকারণ ধুলোময়লা ঝাড়ে। আর স্বর্ণর মনে হয়, একটা বোকা—বোকা চেহারার মদ্দা সাদা ঘোড়া পা ঠুকছে আস্তাবলের দরজায়।

হাঁটে না সুধাময়—ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে। শার্টের ঘড়িপকেট থেকে ঘড়ি বের করে বেলা দেখে। তখন সামনাসামনি বসে থাকা স্বর্ণ ঝুঁকে বলে, ‘ঘড়িটা দেখি! বাবারটা এর চেয়ে পুরনো। কোথায় কিনেছেন? কাটোয়ায় তো?’

সুধাময় বলে, ‘না বর্ধমানে।’

ঘড়িটা স্বর্ণ নিলে কালো কারে টান পড়ায় সুধাময়কে ঝুঁকতে হয়। স্বর্ণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, না অন্য কিছু এবং দেখতে দেখতে হঠাৎ হেসে ওঠে।…’মাস্টারবাবু আমার চোখের কুটো সরে গেছে!’

সুধাময় বলে, ‘সেই তো দেখছি।’

ঘোড়ার নালে, ছিটকে পড়া রাস্তার পাথরকুচির শব্দ, ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ মাঝে মাঝে ঘণ্টার ধ্বনি টং লং…টং লং, দুধারে বিশাল গাছের খসখসে গুঁড়ি শ্যঁ শ্যঁ করে করে সরে যায়। স্বর্ণ কী খোঁজে ঘড়ির অমলধবল মুখে—সময়ের প্রতিবিম্ব, কিংবা কারিগরি কুশলতা, সহকারী স্টেশন মাস্টার এবার খুব খুঁটিয়ে স্বর্ণকে দেখতে থাকে। অমূলক এবং উদ্দেশ্যহীন ক্রোধে তার মাথায় ক্রমশ খুন চড়ে যায়। সে ভাবে, শিগগির একটা কিছু করা দরকার।…