ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৮. আবার দ্বৈরথ

৮. আবার দ্বৈরথ

সম্রাট আলেকজান্ডার তার শিবিরের মধ্যে কাষ্ঠাসনের উপর তাকিয়া হেলান দিয়ে অর্ধশয়ান অবস্থায় পানভোজন করছিলেন। ওই কাষ্ঠের আসনের সামনেই আর একটি কাষ্ঠনির্মিত আধারের উপর সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ফল ও শূল্যপক্ক মেষমাংস। সম্রাটের সম্মুখে নৃত্য করছে এক নর্তকী আর একটু দূরে গালিচায় বসে তারের বাদ্যযন্ত্র মধুর সুরের ঝংকার তুলছে এক তরুণ বাদক। সম্রাট নৃত্য ও গীত উপভোগ করছেন এবং মাঝে মাঝে কিছু খাদ্য মুখে তুলছেন। অর্ধশয়ান অবস্থায় গ্রীকরা পানভোজন করতে শিখেছিল প্রাচ্যের পারস্য প্রভৃতি দেশ থেকে, স্বয়ং গ্রীকসম্রাটও পূর্বোক্ত প্রাচ্যদেশীয় পদ্ধতিতে অবসর যাপন করতেন সানন্দে। সম্রাটের আসন থেকে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে দুই সশস্ত্র দেহরক্ষী…

এমন সময়ে এক গ্রীক সেনানায়কের সঙ্গে সম্রাট-শিবিরে প্রবেশ করল সুবন্ধু। সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে সেনানায়ক বললেন, সুবন্ধু নামে এক আর্যযোদ্ধা আজ সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় জানালে তাকে আপনি সম্রাট–সমীপে উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই সেই যুবক এখন আপনার কী আদেশ?

পার্মেনিও!আলেকজান্ডার বললেন, আপাততঃ তুমি এই শিবিরেই অবস্থান করো। আশা করি আমাদের ভারতীয় অতিথি তোমার সম্মুখে তার বক্তব্য প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হবে না।

–সম্রাট! পূর্বেও বলেছি, এখনও বলছি আমার বক্তব্য গোপনীয়।

-যতই গোপনীয় হোক, আমার অন্তরঙ্গ বান্ধব ও অন্যতম সেনানায়ক পার্সেনিওর কাছে সব কথাই খুলে বলতে পারো। আমার দুই দেহরক্ষী অত্যন্ত বিশ্বস্ত, তারাও এখানে উপস্থিত থাকবে। এই তিনজন ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তি এখানে থাকবে না।

সম্রাটের ইঙ্গিতে নর্তকী ও বাদক বস্ত্রাবাস ত্যাগ করে অন্তর্হিত হল।

আলেকজান্ডার বললেন, এইবার তোমার গোপন কথা তুমি প্রকাশ করতে পারো। তার আগে তোমার সম্পূর্ণ পরিচয় আমি জানতে চাই।

–সম্রাট! আমি মগধশাসিত পিপ্পলীবনের এক নগন্য নাগরিক। রথচালনা ও যুদ্ধ আমার পেশা।

-তোমার নাম?

আমার নাম আপনি পূর্বে শুনেছেন। তবে ফাল্গুনী-পূর্ণিমার রাত্রে দ্বন্দ্বযুদ্ধের উত্তেজনায় সেই তুচ্ছ নামটি আপনি বিস্মৃতি হয়েছেন। সম্রাট! আমার নাম সুবন্ধু।

-মিথ্যা কথা।

 সুবন্ধু বিস্মিত কণ্ঠে বলল, আমি সত্য বলছি সম্রাট।

–তুমি পিপ্পলীবনের নাগরিক একথা অসত্য নয়। পেশা সম্পর্কে তুমি সত্যভাষণ করেছ। কিন্তু তোমার প্রকৃত নাম তুমি গোপন করেছ।

আমি প্রকৃত নাম গোপন করেছি এমন অনুমানের কারণ?

নাম বলার আগে তুমি মুহূর্তমাত্ৰ ইতস্ততঃ করেছ। তাতেই তুমি ধরা পড়ে গেছ। শোন যুবক! বিগত রাত্রে মৃত্যুপণ যুদ্ধে তোমার সাহস ও বীরত্ব আমায় মুগ্ধ করেছে। কিন্তু মিথ্যাভাষণ আমি পছন্দ করি না। আমি তোমার প্রকৃত নাম ও পরিচয় জানতে চাই।

–সম্রাট! রাজনীতিতে মিথ্যাভাষণের অনুমোদন আছে। তবে সম্রাটের কাছে আমি সত্য গোপন করব না। আমার নাম চন্দ্রগুপ্ত। কিন্তু সম্রাটের কাছে আমার অনুরোধ তিনি যেন সুবন্ধু নামেই আমায় সম্বোধন করেন।

—তুমি প্রকৃত নাম গোপন করতে চাও কেন?

আমার পিছনে গুপ্তঘাতক ঘুরছে। তাদের মধ্যে অনেকেই স্বচক্ষে আমায় দর্শন করে নি, কিন্তু আমার নাম তারা সকলেই জানে।

-এই গ্রীক শিবিরে কোনো গুপ্তঘাতক তোমায় অঙ্গস্পর্শ করতে পারবে না।

-এ কথা সত্য। কিন্তু লোকের মুখে মুখে আমারই অজান্তে আমার সত্য পরিচয় প্রকাশ পেতে পারে এবং গ্রীকশিবিরের বাইরে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে- সেই আশঙ্কায় আমার প্রকৃত নাম জনারণ্যে প্রকাশ করতে আমি অনিচ্ছুক।

-তোমার যুক্তি অস্বীকার করতে পারি না। সুবন্ধু! এখন বলো, তুমি আমার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছ কেন? কী তোমার গোপন কথা, যা সর্বসমক্ষে বলা চলে না।

–সম্রাট! আমি শুনেছি আপনি মগধ জয় করতে চান। আমি আপনাকে মগধ-অভিযানে সাহায্য করতে পারি।

–আমার সেনাদলে যোগ দিলেই আমার সাহায্য করা হবে।

–সাধারণ সৈনিকের ন্যায় আমি গ্রীকবাহিনীতে যোগ দিতে চাই না। সম্রাটের পার্শ্বচর হয়ে আমি গ্রীকশিবিরে বাস করব। সম্রাট ও তার বিশ্বস্ত কয়েকজন সেনাপতি ছাড়া কেউ আমার সত্য পরিচয় ও কার্যকলাপ জানতে পারবে না। আমি আপনাকে শত্রুর দুর্বল স্থান দেখিয়ে দেব। কখন কোন সময়ে আঘাত করলে আপনি মগধের অধিপতি নন্দরাজকে পরাস্ত করতে পারবেন তা আমি জানি।

সুবন্ধুর বক্তব্য শেষ হল। আলেকজান্ডার নীরব। নতমস্তকে তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, সারি সারি কুঞ্চনরেখা পড়েছে তাঁর ললাটের সুবন্ধু কিছুক্ষণ উদবিগ্নচিত্তে সম্রাটের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল, তার পর তাকে নীরব দেখে মৌনভঙ্গ করার উদযোগ করল।

কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই সম্রাট মুখ তুললেন, তার তীব্রদৃষ্টি নিবদ্ধ হল সুবন্ধুর দিকে, যুবক! কাল রাত্রে যুদ্ধের সময়ে তুমি বাহ্লিকরাজ্যের রাজপুরোহিতকে জানিয়েছিলে তোমার দেহে রাজ রক্ত আছে প্রমাণস্বরূপ মগধের রাজচিহ্ন অঙ্কিত অঙ্গুরীয় পুরোহিত প্রদর্শন করেছিলে। আমি ওই চিহ্নের সঙ্গে পরিচিত নই, কিন্তু রাজপুরোহিত পূর্বোক্ত প্রমাণেই সন্তুষ্ট হয়েছিল। তাহলে বোঝা গেল তুমি মগধের রাজকুলে জন্মগ্রহণ করেছ। মগধ আক্রমণে তোমার সমাধিক উৎসাহ আমাকে বিস্মিত ও সন্দিগ্ধ করে তুলেছে মনে হচ্ছে গ্রীকবাহিনীর সাহায্যে তুমি মগধের সিংহাসন অধিকার করতে চাইছ। যদি তোমার উচ্চাশা পূরণ হয়, তাহলে পরবর্তীকালে তুমি যে গ্রীকবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না, এমন কথা জোর করে বলা যায় না। অতএব তোমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমি ফাঁদে পড়তে রাজি নই। তোমার সাহায্য ছাড়াই আমি মগধরাজ্য জয় করতে পারব। তুমি ইচ্ছা করলে গ্রীকবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সেনাদলের অন্যতম সেনানায়ক হয়ে আমার বাহিনীতে যোগ দিতে পারো। তোমার মতন দূর্ধর্ষ যোদ্ধা আমার বাহিনীতে যোগ দিলে আমি খুবই খুশি হব, কিন্তু গ্রীকবাহিনীর প্রথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা মন্ত্রীর পদে তোমাকে আমি নিযুক্ত করব না।

–আমার শর্তে রাজি না হলে আমি গ্রীকবাহিনীতে যোগ দেব না। সম্রাট! মনে রাখবেন আমার সাহায্য ছাড়া মগধ অভিযানে অগ্রসর হলে আপনার পরাজয় নিশ্চিত। যদি সত্যই মগধ জয় করতে চান, তবে আমার আরোপিত শর্তে আপনাকে রাজি হতেই হবে।

আলেকজান্ডার এতক্ষণ তাকিয়ায় হেলান নিয়ে বসেছিলেন; হঠাৎ তিনি সোজা হয়ে বসলেন, তাঁর দুই চোখে জ্বলে উঠল অবরুদ্ধ রোষের অগ্নি, যুবক! তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। তুমি আমার ভীতি প্রদর্শন করছ?

-আমি ভীতি প্রদর্শন করিনি। বাস্তব সত্যকে প্রকাশ করেছি। তাতে সম্রাট যদি ক্রুদ্ধ হন, তাহলে আমার কিছু করার নেই। আমি সম্রাটের স্তাবক হয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না।

সম্রাট তাঁর দুই দেহরক্ষীর মধ্যে একজনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন, হেরস! এই ধৃষ্ট যুবককে শিখিয়ে দাও কেমন করে সম্রাটের সঙ্গে কথা কইতে হয়।

হেরস নামক দেহরক্ষী এগিয়ে এসে সুবন্ধুর সামনে দাঁড়াল, এই মুহূর্তে সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করো।

–অসম্ভব প্রস্তাব। তুমি তো তুচ্ছ ব্যক্তি, সমগ্র গ্রীকবাহিনী একত্র হয়েও আমাকে নতজানু করতে পারবে না। অবশ্য তোমারা সবাই মিলে আমাকে হত্যা করতে পারো বটে।

সম্রাট! হেরস সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে কটিবন্ধে কোষবন্ধ অসিতে হাত রাখল, এই দুর্বিনীত যুবককে হত্যা না করে অথবা অঙ্গহানি না করে শায়েস্তা করা যাবে না।

-অস্ত্রের ব্যবহার না করে এই যুবককে যদি সমুচিত শাস্তি দিতে পারো, তাহলে আমি যৎপরোনাস্তি সুখী হব।

যথা আজ্ঞা, হস্ত প্রসারিত করে হেরস অগ্রসর হল, উদ্ধত যুবক! তোমার ঔদ্ধত্যের দন্ড গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হও।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে হেরসের সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করল সুবন্ধু তার প্রতিদ্বন্দ্বী দীর্ঘদেহী না হলেও তার পেশল বক্ষপট ও স্কন্ধের বিস্তার, পেশি স্ফীত বাহু ও নিরেট নিম্নাঙ্গ জানিয়ে দিচ্ছে লোকটি প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই শুধুমাত্র দৈহিক শক্তির সাহায্যে সে মানুষকে নিহত বা আহত করতে পারে।

ঈষৎ নত হয়ে সে প্রতিপক্ষকে দ্বৈরথে আহ্বান করল, আমি দন্ডগ্রহণে প্রস্তুত।

আলেকজান্ডার জানতেন কোনো কোনো যুদ্ধব্যবসায়ী পেশাদার সৈনিক অসিযুদ্ধে হেরসের সমকক্ষ হলেও মল্লযুদ্ধে তার প্রতিদ্বন্দীর দুর্লভ– অতএব উদ্ধত আর্যযোদ্ধাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্যই তিনি পূর্বোক্ত দেহরক্ষীকে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তারপর যা ঘটল, সেই অভাবনীয় দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না সম্রাট

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুহূর্তের জন্য আলিঙ্গনে বদ্ধ হল, পরক্ষণেই হেরসের গুরুভার দেহ সবেগে ও সশব্দে ছিটকে পড়ল ভূমিপৃষ্ঠে! একবার কাতর শব্দ করে ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করেও বিফল হল হেরস। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সে উঠে দাঁড়াতে সমর্থ হল বটে, কিন্তু যন্ত্রণাকাতর মুখে যে ভাবে সে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত ও ডান পায়ের পরিচর্যা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাতে বোঝা গেল পুনরায় মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা বা উৎসাহ তার নেই।

সম্রাটকে বিনীতভাবে অভিবাদন জানিয়ে সুবন্ধু বলল, আপনার আদেশ পালিত হয়েছে। সম্রাট!

সম্রাটের মুখের ক্রোধ ও বিস্ময়ের ছায়া পড়ল, তারপরই হঠাৎ প্রচণ্ড অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন তিনি, সুবন্ধু! তুমি কেবল অসিচালনায় পটু নও, মল্লযুদ্ধেও বিলক্ষণ দক্ষ!

হাস্যের বেগ কমে গেলে সম্রাট বললেন, তুমি রাজরক্তের অধিকারী এবং অসাধারণ বীর্যবান পুরুষ। এস, সুবন্ধু! এখন গ্রীকসম্রাটের আতিথ্য উপভোগ করো।

কাষ্ঠাধারের উপর বিভিন্ন খাদ্য ও সুরাপূর্ণ ভৃঙ্গারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন সম্রাট এবং ইঙ্গিতে তার পাশেই আসন গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।

উপস্থিতি দুজন দেহরক্ষী ও গ্রীক সেনাধ্যক্ষ আশ্চর্য হয়ে গেলেন সম্রাটের সঙ্গে একাসনে বসে পানাহারের অধিকার স্বল্প-সংখ্যক গ্রীক সেনানায়কের মধ্যে সীমাবদ্ধ এক উদ্ধত আর্যযোদ্ধার প্রতি সম্রাটের এই উদার দাক্ষিণ্যে হেরস পর্যন্ত এমন বিস্মিত হয়ে গেল যে, আহত দেহের যন্ত্রণাও সে ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তবে আলেকজান্ডারের সেনাদলের সকলেই জানতো সম্রাট-চরিত্রের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য- কখনো তিনি নির্মম নিষ্ঠুর, আবার কখনো বা উদার দাক্ষিণ্যে মমতাময় কোমল। তাই আর্যযযাদ্ধার প্রতি তার মনোভাবের পরিবর্তন তাদের বিস্মিত করলেও খুব বেশি বিচলিত করতে পারে নি কিন্তু সম্রাট-চরিত্রে অনভিজ্ঞ সুবন্ধু চমকে গিয়েছিল দস্তুরমতো!

অবশেষে স্বস্তির শ্বাস ফেলে সুবন্ধু নির্দিষ্ট স্থানে আসন গ্রহণ করল। ক্ষুধার্ত হলেও তার আহারের প্রবৃত্তি ছিল না, শুধু সম্রাটের মান রাখার জন্যই সে দুই আঙুলে একটি ফল তুলে নিল। সম্রাট স্বহস্তে ভৃঙ্গার থেকে পানপাত্রে মদ ঢেলে এগিয়ে দিলেন সুবন্ধুর দিকে, তারপর সুরাপূর্ণ পাত্র তুলে ধরলেন নিজের মুখে…

সম্রাট লক্ষ্য করলেন উপবিষ্ট আর্যযোদ্ধা দুএকটি ফল মুখে দিলেও সুরা স্পর্শ করে নি একবারও। পূর্ণ পাত্র নিঃশেষ করে সম্রাট বলে উঠলেন, সুবন্ধু! তুমি সুরাপান করছ না কেন?

সুবন্ধু সম্রাটের দিকে চাইল, সম্রাট! আমি কখনো মদ্যপান করিনি।

 বলো কী! সবিস্ময়ে বললেন আলেকজান্ডার, তুমি সুদক্ষ যোদ্ধা– অসি, ধনুর্বাণ ও মল্লযুদ্ধে পারদর্শী রাজবংশের পুরুষ তুমি কখনও মদ্যপান করে নি?

-না, সম্রাট!

-যে পুরুষ মদ্যপান করে না, সে পুরুষ নামের অযোগ্য। তোমাকে আজ আমি পৌরুষের দীক্ষা দেব। নাও, সুরার পাত্রে চুমুক দাও।

–আমায় ক্ষমা করবেন সম্রাট!

কাষ্ঠধারের উপর প্রচণ্ডবেগে মুষ্টাঘাত করে গর্জে উঠলেন সম্রাট, তোমায় সুরাপান করতেই হবে। সুরার উপর বিতৃষ্ণা পুরুষের শোভা পায় না।

সম্রাট! সুরাপান না করেও পৌরুষের যৎকিঞ্চিৎ প্রমাণ আমি বিগত রাত্রে দিয়েছি। কিছুক্ষণ আগেও সম্রাট আমার পৌরুষের কিছু প্রমাণ পেয়েছেন। সেই প্রমাণের ধাক্কায় ওইখানে দাঁড়িয়ে আহত অঙ্গের পরিচর্যা করছে আপনার দেহরক্ষী হেরস। এইবার আমাকে নিষ্কৃতি দিন।

এত সহজে তুমি নিষ্কৃতি পাবে না, আলেকজান্ডার বললেন, চন্দ্রগুপ্ত বা সুবন্ধু যা-ই তোমার নাম হোক, সুরাপান না করলে তোমার মুক্তি নেই।

তাহলে বাধ্য হয়েই আপনার আদেশ পালন করব। একপাত্র সুরা নিঃশেষ করে আমি বিদায় নেব। সম্রাটের মূল্যবান সময়ের অপচয় আমি করব না।

-আমার সময়ের মূল্য তোমাকে নির্ণয় করতে হবে না। একপাত্র সুরা নয়, আমার সঙ্গে তোমার সুরাপানের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। আমাদের মধ্যে যে সুরার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে নিদ্রায় ঢলে পড়বে, সে হবে পরাজিত অপর ব্যক্তি যদি মদের প্রভাবকে তুচ্ছ করে জাগ্রত থাকতে পারে, তাহলে তাকেই জয়ী বলে ঘোষণা করা হবে। এস সুবন্ধু! পৌরুষের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তুমি সসম্মানে মুক্তি পাবে; আর যদি পরাস্ত হও, তাহলে আজীবন আমার বন্দি থাকতে হবে তোমায়।

-সম্রাট! যে ব্যক্তি কখনো মদ্যপান করে নি, তার পক্ষে আপনার ন্যায় অভ্যস্ত মদ্যপায়ীকে মদ্যপানের প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করা সম্ভব নয়।

আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার শর্তে রাজি না হলে এখনই তোমায় বন্দি করব। যে সুযোগ তুমি পেয়েছ, সেই সুযোগ আর কখনো পাবে না। আজীবন তুমি বন্দি থাকবে আমার কাছে। এখান থেকে তোমায় শৃঙ্খলাবদ্ধ করে নিয়ে যাব মিশর, পারস্য– তারপর ম্যাসিলডোনিয়ায়। বলো সুবন্ধু, তুমি কী করবে?

কয়েক মুহূর্ত নীরবে চিন্তা করল সুবন্ধু, তারপর দৃঢ়স্বরে বলল, আমি প্রস্তুত। সম্রাট! সুরা পরিবেশনের আদেশ দিন।

সম্রাটের আদেশে পার্মেনিও নামে সেনানায়ক এগিয়ে এসে দুটি পাত্রে সমান মাপে মদ ঢেলে দিলেন। পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে সুরাপাত্র মুখে তুললেন সম্রাট আলেকজান্ডার ও

প্রভাত আসন্ন। অন্ধকারের বুকে খেলা করছে আলোকের ক্ষীণ ইশারা। সম্রাট আলেকজান্ডার তর কাষ্ঠাসনের উপর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। নিদ্রিত সম্রাটের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে উঠে দাঁড়াল সুবন্ধু, পরিবেশনকারী সেনানায়ক পার্সেনিওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি এখন যেতে পারি?

স্তম্ভিত সেনানায়ক বললেন, যুবক! গ্রীকশিবিরে মধ্যপানের প্রতিযোগিতায় কেউ সম্রাটকে পরাস্ত করতে পারে নি। তুমি অসাধ্য সোধন করেছ। তুমি কি সত্যই পূর্বে কোনোদিন সুরাপান করো নি?

সুবন্ধু হাসল, আজ রাত্রেই প্রথম সুরার আস্বাদ গ্রহণ করলাম। আপনার অনুমতি পেলে এখন বিদায় গ্রহণ করতে পারি।

মস্তক হেলিয়ে অনুমতি দিলেন সেনানায়ক পার্মেনিও। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে শিবির ত্যাগ করে বাইরে এল সুবন্ধু, সেখানে অপেক্ষা করছিল তার প্রিয় অশ্ব অঞ্জন। একলাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে সুবন্ধু বাহনকে চালনা করল দ্রুতবেগে…

বহুযুগের ওপার হতে ভেসে আসে ঘোড়র পায়ের আওয়াজ… মনশ্চক্ষে দেখতে পাই পর্বত ও অরণ্যবেষ্টিত শিলাকীর্ণ বন্ধুর পথে ছুটে চলেছে এক অশ্বারোহী মনে তার অখণ্ড ভারত- গঠনের স্বপ্ন, বুকে অদম্য সাহস, পেশিমণ্ডিত দীর্ঘ দেহের রক্তে দুঃসাহসী যৌবনের জোয়ার!– তার ইচ্ছা কি পূর্ণ হবে? বিদেশী হানাদারের কবল থেকে মুক্ত করে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতভূমিকে এক অখণ্ড রাজ্যে পরিণত করতে সমর্থ হবে কি সে?…

বর্তমান কাহিনির নায়ক কেমন করে তার উচ্চাশা পূরণ করল, তার রোমাঞ্চকর বিবরণ দেবে পরবর্তী কাহিনি– শায়ক!