০৮.
আবার অশরীরী আত্মার আবির্ভাব
কর্নেলের আর পাত্তা নেই সে বেলার মতো। বিকেলে অগত্যা জয়ন্তী আর আমি বেড়াতে বেরোলুম। মোল্লার দৌড় মসজিদ–আমাদের ওই ভূতের পাহাড়। স্বীকার না করে উপায় নেই, অত সুন্দর পাহাড় আর এলাকায় দুটি নেই। তাছাড়া কী এক গভীর রহস্যময় আকর্ষণ আছে যেন ওটার, বার বার যেতে ইচ্ছে করে। ভয় পেলেও ভালো লাগে ওখানে গিয়ে বসে থাকতে। চারদিকের দৃশ্যাবলীর তো তুলনাই নেই!
আমরা আজ প্রস্রবণটা আবিষ্কার করে ফেললুম। তারপর অনেকটা ঘুর পথে চুড়োর দিকে উঠতে শুরু করলুম। উত্তরের খাড়াই ভেঙে ওঠা সম্ভব ছিল না। কিন্তু অভিজ্ঞা জয়ন্তী কর্নেলের আবিষ্কৃত পথটা খুঁজে বের করল। আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু জয়ন্তী অক্লেশে উঠে যাচ্ছিল আর আমার অসহায় দশা উপভোগ করছিল।
একখানে খানিকটা ঢালু চাতাল টালি বা করগেট শিটের চালের মতো নেমে গেছে। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে জয়ন্তী তরতর করে সেখানে চলে গেল। তারপর ঘুরে ফিরে এদিক-ওদিক দেখে হাত ইশারায় ডাকল। খুব সাবধানে গেলুম ওর কাছে। গিয়ে দেখি, চাতালটার সবখানে ছোট বড় অনেক গর্ত রয়েছে। গর্তগুলোর ব্যাস কমপক্ষে এক ফুট থেকে দেড় ফুট। গভীরতা আন্দাজ তিন থেকে চার ফুটের কম নয়। মনে হল, কারা যেন শামিয়ানা খাটাবার জন্য প্রকাণ্ড সব খুঁটি পুঁতেছিল–কিংবা এঞ্জিনিয়াররা এখানে কোন কারখানা বানাবার জন্যে কংক্রিট থাম তৈরি করতে চেয়েছিল–অর্থাৎ একটা বাড়ির আয়রন স্ট্রাকচারের আয়োজন করা হয়েছিল। পরে যেন কোন কারণে তা বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু গর্তগুলো রয়ে গেছে।
অবাক হয়ে বললুম–এ গর্তগুলো কিসের হতে পারে? ভারি অদ্ভুত তো!
জয়ন্তী বলল–ভূতের পাহাড়ে সবই অদ্ভুত হবে, এতে আশ্চর্য কিছু নেই। …বলে সে হাঁটু দুমড়ে একটা গর্তের কিনারায় বসল। তারপর মাথা নামিয়ে গর্তের ধারে কান পাতল।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। জয়ন্তীর বালিকাপনা দেখছি।
সে হাত তুলে ডাকল–এই, শোন। এখানে কান পাতো!
-কেন? বলে ওর কথামতো বসে পড়লুম। তারপর কান পাততেই একটা অদ্ভুত চাপা আওয়াজ পেলুম। টেলিগ্রাফের খুঁটিতে কান পাতলে একধরনের শোঁ-শোঁ আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু এই গর্তের আওয়াজ একেবারে অন্যরকম। ভুতুড়েই বলা যায় বরং। মনে পড়ে গেল গতকাল সন্ধ্যায় ঝড়ের সময় যে বিকট আঁ-উ-উ-উ শুনেছিলুম, অবিকল তারই একটা খুদে নমুনা। মনে হল, পাহাড়ের ভিতরে গভীর কোন জায়গায় কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী আটকে পড়ে একটানা গর্জন করছে।
জয়ন্তী বলল–তাহলে একটা রহস্যের সমাধান হল! আওয়াজটা কোত্থেকে আসছিল বোঝা গেল। এখন বাতাস কম, তাই গর্তে কান না পাতলে শোনা যায় না। কিন্তু বাতাস বাড়লে আওয়াজ বাড়ে। আর ঝড়ের সময় কী ঘটে, তা তো কাল সন্ধ্যায় শুনেছি আমরা। প্রচণ্ড বাতাসের স্রোত গর্তের ওপর দিয়ে যাবার সময় ভয়ঙ্কর হুইসিল হয়ে বেজে ওঠে।
বললুম–হ্যাঁ, তাই বটে। কিন্তু গর্তগুলো কিসের বল তো?
জয়ন্তী কিনারার পাথর খামচানোর চেষ্টা করতেই তা সুরকির মতো গুড়ো হয়ে গেল। অমনি হেসে উঠল সে। –আরে, এই পাথর আসলে মুচমুচে হয়ে রয়েছে। বেলে পাথর আছে একধরনের। সহজেই গুঁড়ো করা যায়। এই চাতালটা স্রেফ সেই জাতের পাথরের, বুঝেছ? সম্ভবত সারা শীতকাল উত্তরের প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় এইসব গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এলাকার লোকেরা বড় বোকা তো! এসে কেউ ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করেনি কখনো!
বললুম–সব কিংবদন্তির উদ্ভব প্রাচীন যুগে। সময় এগিয়ে যায়, কিন্তু কিংবদন্তি টিকে থাকে। যাক গে, চলো–ওপরে গিয়ে বসি।
একটু পরেই সেই রিঙ্গেল ঝোপগুলো পেরিয়ে আমরা চুড়োয় উঠলুম। আজ কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে জনপ্রাণীটি দেখতে পেলুম না।
হঠাৎ জয়ন্তী বলল বাঃ! হেলিকপ্টার যে! দেখ, দেখ!
উত্তরপূর্ব দিকে একটা হেলিকপ্টার দেখলুম। সেটা একটু পরেই একটা উঁচু পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হল। বললুম–হেলিপ্যাড তৈরি হয়ে গেছে তাহলে। নেমে পড়ল মনে হচ্ছে।
জয়ন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল-তাহলে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ এতক্ষণে। চালু হল বলা যায়। কিন্তু এবার আমার সামনে ভয়ঙ্কর এক সময় আসছে। শ্যামলীর বাড়িতে খবর দিতে হবে। কেমন করে মুখ দেখাব ওঁদের কাছে! ওর বডিটারই বা কী হবে?
ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠল। ওকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত হলুম!…
কিছুক্ষণ পরে পশ্চিম আকাশে আজও মেঘের আভাস লক্ষ্য করে নীচে নামলুম। পথে যেতে যেতে বাতাসে বেড়ে গেল হঠাৎ। হোটেলে পৌঁছে দেখি, কর্নেল ব্যস্তভাবে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। বললেন–এখন ঘরে নয়। আমরা শ্রীমতী মালহোত্রার বাড়িতে যাব। আর সবাই চলে গিয়েছেন। আমি তোমাদের নিয়ে যাব বলে দাঁড়িয়ে আছি।
জয়ন্তী বলল কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে!
–ঝড় কোথায়? এমন আবহাওয়া এখানে এখন প্রতিদিনই পাবে। চলো, দেরি করা যাবে না।
তিনজনে পথে নামলুম যখন-তখন আকাশের অবস্থা ভয়াবহ। ঘড়িতে সময় সবে ছটা কুড়ি। শ্রীমতী মালহোত্রার বাড়ির গেটে ঢোকার সময় প্রচণ্ড শব্দে কোথায় বাজ পড়ল। তারপর শুরু হল মেঘগর্জন। বাতাসও খেপে গেল। আমরা সোজা গিয়ে ডাইনিং হলে ঢুকে পড়লুম।
ভিতরে চাপা আলো জ্বলছে। কোনার সোফায় বসে আছেন ডঃ পট্টনায়ক, আর এক অচেনা ভদ্রলোক। মাঝামাঝি জায়গায় একটা চেয়ারে চুপচুপ গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন রঘুবীর জয়সোয়াল। আর অধ্যাপক দ্বিবেদী ও শ্ৰীমতী মালহোত্রা ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে কী সব আলোচনা করছেন।
আমাদের দেখে শ্রীমতী মালহোত্রা মৃদু হেসে আপ্যায়ন জানালেন। আমরা তিনজনে গিয়ে বসলুম ডঃ পট্টনায়কের কাছে। অচেনা ভদ্রলোকটির বয়স সত্তরের কম নয়। সাদা চুল, আর মস্তো গোঁফ। তিনি কর্নেলের দিকে বাও করে বললেন–হ্যালো।
কর্নেলও বললেন–হ্যাল্লো।
কিন্তু আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না ভদ্রলোকের। এই সময় শ্ৰীমতী মালহোত্রাকে কিচেনের দরজায় ঢুকতে দেখলুম। অধ্যাপক পায়চারি শুরু করলেন। ঘরে অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। ব্যাপারটা কী?
বাইরে যথারীতি প্রচণ্ড ঝড় আর মেঘের তাণ্ডব চলেছে। অস্বস্তিতে মনে মনে অস্থির হচ্ছিলুম। জয়ন্তীর মুখে একটা উৎকণ্ঠা জড়িয়ে আছে মনে হল। সে। মুখ নিচু করে নিজের কড়ে আঙুলে কিছু দেখছে।
কিচেন থেকে গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে লছমন আর সরযূ। ওদের হাতে ট্রে। নিঃশব্দে সকলের ট্রে ধরলে প্রত্যেক কাপ তুলে দিলেন। সরযূ চমৎকার কফি করে।
যতক্ষণ কফি খাওয়া হল, কেউ কোন কথা বললেন না। এই সময় সদর দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে মনে হল। লছমন এগিয়ে যাচ্ছিল, শ্রীমতী মালহোত্রা কড়া স্বরে বলে উঠলেন–লছমন! বরাবর বলেছি না, রাত্রিবেলা ওভাবে কক্ষনো ঝোঁকের মাথায় দরজা খুলবে না! চলে এসো। ও কেউ না–এমনি আওয়াজ! ও কিছু না।
ডঃ পট্টনায়ক বললেন–এমনি আওয়াজ! বলেন কী মিসেস মালহোত্রা!
–হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে দরজা খুলে দেখতে পারেন আপনারা। ঝড়ের রাত্রে বরাবর এমন হয়। সে রাতে বদ্রী যদি নিষেধ মেনে দরজা না খুলত, কোন বিপদ ঘটত না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমার মনে হয় ম্যাডাম, আপনার ও দরজার কপাটের গঠনে ত্রুটি আছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। জোরে বাতাস বইলে এমন শব্দ হাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
শ্রীমতী মালহোত্রা গম্ভীর হয়ে গেলেন। –আপনি অভিজ্ঞ মানুষ কর্নেল। অনেক ব্যাপারে আপনার মতামতের মূল্য আছে নিশ্চয়। কিন্তু মনে রাখবেন, অপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব সহজে উড়িয়ে দেওয়া যা না। যাক গে, প্রায় সাতটা বাজে। এবার আমরা আসরে গিয়ে বসতে পারি।
আসর! আমি জয়ন্তীর দিকে সপ্রশ্ন তাকালুম। জয়ন্তী চোখ নামাল। মুখটা উৎকণ্ঠায় ভরে আছে এখনও!
শ্ৰীমতী মালহোত্রা পা বাড়িয়ে বললেন–প্লিজ, আপনারা আর দেরি করবেন না। এমন সময় তো প্রতিদিন পাওয়া যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই চমৎকার সুযোগ আমাদের ব্যর্থ হতে দেওয়া উচিত নয়।
তাহলে আবার অশরীরী আত্মার কারবার! অস্বস্তিটা বেড়ে গেল। এসব হচ্ছেটা কী! কর্নেলের দিকে তাকালুম। উনি বললেন–চলো জয়ন্ত ওঠ। ডঃ পট্টনায়ক! আপনার মাননীয় বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসুন তাহলে।
স্টাডির চাবি আজ শ্রীমতী মালহোত্রার কাছে। তিনি দরজা খুলে দিলেন এবং একধারে দাঁড়িয়ে কপাটটা আটকে থাকলেন সেদিনকার মতো। আমরা একে একে ঢুকে পড়লুম।
সেই মারাত্মক ঘর আর সেই আটটা চেয়ার, মধ্যে সেই গোল টেবিলটা। পকেটে হাত ভরে রিভলবারটার অস্তিত্ব অনুভব করলুম। কিন্তু যদি সত্যি আজও কোন মারাত্মক ঘটনা ঘটে, আমি কি এই অস্ত্রটা দিয়ে তা আটকাতে পারব? অবিকল সেদিনকার মতো বসে পড়লুম সবাই। আমার ডাইনে রইল জয়ন্তী, বাঁদিকে কর্নেল। আর শ্যামলীর চেয়ারে বসলেন সেই আগন্তুক ভদ্রলোক। ওই বুড়োই কি আজকের আসরের মিডিয়াম?
উজ্জ্বল আলোটা নিবিয়ে তক্ষুনি হালকা নীল আলো জ্বাললেন শ্ৰীমতী মালহোত্রা। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিনকার মতো বক্তৃতা শুরু করলেন।–বন্ধুগণ! আজ আমার দীর্ঘ সারগর্ভ বক্তৃতার প্রয়োজন আশা করি হবে না। আজকের আসরে যিনি মিডিয়াম হতে চান তিনি ডঃ সীতানাথ পট্টনায়কের বন্ধু, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হরগোবিন্দ সিং। উনি আজ বিকেলেই হেলিকপ্টারে সরকারি ত্রাণ দফতরের প্রতিনিধি হিসেবে বাণেশ্বরে এসে পড়েছেন। আমার মতোই ওঁর প্রেতচর্চার আগ্রহ খুব প্রবল, তা আমি ডঃ পট্টনায়কের কাছেই শুনেছি। শোনামাত্র আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আপনারা জানেন, খুব সূক্ষ্ম সংবেদনশীল মন ও অনুভূতির প্রখরতা যাদের আছে, একমাত্র তারাই মিডিয়াম হবার উপযুক্ত। স্থল মন, অনুভূতির বালাই নেই, সূক্ষ্ম গভীর ভাবনা ভাবতে অপটু, এমন কোন মানুষের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুপ্রবাহে ভাসমান সেই বিমূর্ত চিন্তাতরঙ্গ ও চেতনা, যা বস্তুর নিয়ম মেনে চলে না, তা ধরা সম্ভবই নয়। আনন্দ ও আশার কথা, আমাদের নবাগত বন্ধু মিঃ সিং একজন শৌখিন মিডিয়াম হিসেবে অনেকখানি অভিজ্ঞতা রাখেন। জানি না, এই আকস্মিক যোগাযোগের পিছনে আমাদের বিপরীত জগতের সেই অশরীরী বাসিন্দাদের কতখানি হাত আছে–তবে ডঃ পট্টনায়কের কাছে ওঁর পরিচয় পেয়েই আমি সঙ্গে সঙ্গে এই আসরের প্রস্তাব দিয়েছিলুম। এখন কথা হচ্ছে, আজ এই আসরের মুখ্য উদ্যোক্তা হিসেবে আমি প্রস্তাব করছি, হতভাগিনী শ্যামলী সেনের আত্মাকে উনি আজ আহ্বান করুন।
অধ্যাপক দ্বিদেবী বলে উঠলেন–কিন্তু উনি তো চিনতেনই না শ্যামলীকে।
জয়সোয়ালজি বাঁকা মুখে হাসলেন শুধু।
কর্নেল বললেন–তাও তো বটে!
শ্ৰীমতী মালহোত্রা কী বলতে যাচ্ছিলেন, মেজর জেনারেল ভদ্রলোক একটু কেশে বিনীতভাবে বললেন–শ্যামলী সেন আমার সুপরিচিত। মানালি অভিযানের সময় আমি ওঁর দলকে ট্রান্সপোর্টের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলুম। জয়ন্তীদেবীর আশা করি মনে আছে?
জয়ন্তী কিছু বলতে যাচ্ছিল। কর্নেল আমার পায়ের ওপর দিয়ে একটা পা বাড়িয়ে মৃদু ধাক্কা দিলেন–ব্যাপারটা আমি আর জয়ন্তী ছাড়া কেউ টের পেল না। জয়ন্তী অমনি আমতা-আমতা করে বলে উঠল–হ্যাঁ, হা-আপনিই তো! মনে আছে বৈকি। খুব মনে আছে।
কিন্তু জয়ন্তীর চোখের বিস্ময়টুকু আমার চোখ এড়িয়ে গেল না।
শ্ৰীমতী মালহোত্রা বললেন–তাহলে এবার আলো নেভাই। অনুগ্রহ করে কেউ যেন কোন শব্দ করবেন না। রেডি-ওয়ান…টু….থ্রি…
আলো নিভে যাবার মুহূর্তে জয়সোয়ালজিকে অস্ফুটস্বরে বলতে শোনা গেল–পাগলামি!
ঘন অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছি তো আছি। কোন শব্দ নেই ঘরে। কিন্তু বাইরে ঝড় ও মেঘের হাঁকডাক সমানে চলছে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছিল। আজও কোন অঘটন ঘটবে না তো? কর্নেল কেন এসব ঘটতে দিচ্ছেন? আমার অস্বিস্তিটা বেড়ে ডেতে লাগল ক্রমশ। কিন্তু না–এখন অন্য কোন ভাবনা নয়, শ্যামলীর কথা ভাবা উচিত। তার আত্মাকেই আজ আনা হবে। কাজেই স্থির মনে তার কথা ভাবা যাক।
ভাবতে গিয়ে সে রাতের সব ঘটনা আগোগোগাড়া মনে পড়তে লাগল। হ্যাঁ, আমি এত অবাক হয়েছিলুম যে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলুম ঝোঁকের বশে। ভূতপ্রেতে একতিল বিশ্বাস আমার নেই। তাই পরীক্ষা করে দেখতে যাচ্ছিলুম, যদি সত্যি ভূতপ্রেত শ্যামলীকে ভর করে থাকে তাহলে আমার এই গতিবিধি টের পাবে এবং অবশ্যই এর একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে। কিন্তু ধুরন্ধর কর্নেলের জন্যে সেটায় বাধা পড়েছিল। আমার কোটে টান পড়া মাত্র ছিটকে নিঃশব্দে চেয়ারে এসে বসেছিলুম। আজ কিন্তু সে ঝোঁক আর আমার নেই। …আচ্ছা, একটা কথা–আমার বাঁদিকে ছিলেন কর্নেল, তার বাঁদিকে ডঃ পট্টনায়ক। তাহলে ডঃ পট্টনায়ককে ডিঙিয়ে কীভাবে কর্নেল টের পেলেন যে জয়সোয়ালজির চেয়ার খালি? ..হ্যাঁ, কর্নেলও চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন তাহলে। কেন উঠেছিলেন? আমি যেজন্যে কৌতূহলী হয়েছিলুম, উনিও কি সেজন্যেই?…আর একটা কথা, শ্যামলী কি ইচ্ছে করেই এমন বিকৃত দুর্বল স্বরে কথা বলছিল?
আমার চিন্তাসূত্রকে মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন করে দিলে একটা ভাঙা খ্যানখেনে স্বর। সেই মুহূর্তে বাজ পড়ল বাইরে কোথাও। ঘরটা জোরে কেঁপে উঠল। টেবিলটাও একবারের জন্যে নড়ে গেল যেন।–আমি আছি….আমি আছি….আমি আছি!…এই ঘরে আছি। এই বাড়িতে আছি। এই পাহাড়ে আছি। জঙ্গলে আছি। রাস্তায় আছি…। আছি….আছি…আছি…।
ও কি মেজর জেনারেল হরগোবিন্দ সিংয়ের কণ্ঠস্বর? অসম্ভব। আছি শব্দটা ক্রমাগত শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকল। মনে হল সারা অন্ধকার ঘরে আটকে পড়া কী একটা শক্তি পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। আই একজি আই একজিস্ট।…
(এখানে একটা কথা বলা দরকার, বাণেশ্বরে অন্য লোকের সঙ্গে কিংবা শ্ৰীমতী মালহোত্রার বাড়িতে আমরা সবাই ইংরেজিতে কথা বলেছি বা বলি। মিডিয়ামও তাই ইংরেজিতেই কথা বলবে, এটা স্বাভাবিক। শ্যামলীও বলেছিল।)
এবার ভেসে উঠল শ্ৰীমতী মালহোত্রার কণ্ঠস্বর। ..হু আর ইউ? কে তুমি?
অন্তত তিনবার প্রশ্নের পর জবাব শোনা গেল–আমি শ্যামলী, আমি শ্যামলী, আমি শ্যামলী….
বোঝা যাচ্ছিল প্রশ্ন না করলে অশরীরীর কথা কিছুতেই থামবে না। প্রশ্ন করতে শুনলুম জয়ন্তীকে। শ্যামলী, শ্যামলী! তোকে কে মেরেছে রে?
–তুই কি জয়ন্তী, তুই (ইউ) জয়ন্তী, তুই কি জয়ন্তী?….
–হ্যাঁ, আমি জয়ন্তী। তোকে কি মোহন পারেখের আত্মা খুন করেছিল সে রাতে?
–বলব না, বলব না, বলব না—
–শ্যামলী, বল, তাকে আমরা শাস্তি দেব!
জয়ন্তীর এই কথার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী মালহোত্রাও প্রশ্ন করলেন–কে মেরেছিল মোহন পারেখকে? তার সঙ্গে অধ্যাপক দ্বিবেদীর ভীতু গলার প্রশ্ন যোগ দিল বলুন, বলুন, মোহন পারেখ কাকে চিনতে পেরেছিল? কে সে?
শ্ৰীমতী মালহোত্রা অমনি চাপা গলায় গর্জালেন–চুপ! কেন কোন প্রশ্ন নয়। আমাকে প্রশ্ন করতে দিন।
ওদিকে এইসব হট্টোগোলের মধ্যে কিন্তু সমানে সেই খ্যানখেনে স্বরের আওয়াজটা একটানা শোনা যাচ্ছে–বলব না, বলব না, বলব না..
শ্ৰীমতী মালহোত্রা তীক্ষ্ণস্বরে বললেন–শ্যামলী, মোহন পারেখ কাকে চিনতে পেরেছিল?
–মহাবীর সিংকে…মহাবীর সিংকে…মহাবীর সিংকে….
কীভাবে মোহনের মৃত্যু হল?
–ফোনে ডেকেছিল। ভূতের পাহাড়ে যেতে বলেছিল।
–কেন?
–নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিল। টাকা দেবে বলেছিল। ফোটো চেয়েছিল।
–বোঝা যাচ্ছে না। খুলে বলো!
বলব না, আর বলব না।
–প্লিজ, শ্যামলী!
–পারেখ সাহস করে ফটো নিয়ে যায়নি সঙ্গে। আমার কাছে রাখতে দিয়েছিল।
কার ফোটো, শ্যামলী? কার ফোটো?
সেকথার জবাব নেই। শ্যামলীর আত্মা বলে উঠল, ভূতের পাহাড়ে পারেখ গেল। আমাকে জানিয়ে গেল। আপনাকে জানতে বললুম–সে আপনার বাড়ি হয়ে গেল। আপনি ছিলেন না। সুমিত্রাজীর বাড়ি গিয়েছিলেন। তখন আমি চুপি চুপি ওকে অনুসরণ করে ব্যাপারটা দেখতে পেলুম। পাথরের আড়ালে বসে দেখলুম মহাবীর সিং ধাক্কা মেরে পারেখকে ফেলে দিল। আমি ভয় পেয়ে পালিয়ে এলুম। জয়ন্তীকে বললুম না–ও আমাকে খুব বকবে বলে ভয় হয়। জয়ন্তীকে আমার গার্জেন বলে সমীহ করতুম…তারপর..
আচমকা জোরালো টর্চ জ্বলে উঠল, সেইসঙ্গে কর্নেলের গর্জন শোনা গেল-খবর্দার মহাবীর সিং!
টর্চের আলোয় দেখা গেল, মেজর জেনারেল সেই মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে এবং তাঁর ডাইনের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন রঘুবীর জয়সোয়াল-আর মেজর জেনারেল চোখের পলকে তার বুকে ঘুষি মারলেন। জয়সোয়ালজি চেয়ারসুদ্ধ পড়ে গেলেন সশব্দে। অমনি উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল ঘরে।
তারপর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেখি, বুকসেলফ আর উঁচু আলমারির পিছন থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলেন মিঃ খান্না আর ব্রিজেশ সিং। দুজনের হাতেই রিভলবার। খান্না জয়সোয়ালজির জামার কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করালেন।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এসব ঘটে গেল।
এবার দেখলুম, কর্নেল আর ডঃ পট্টনায়ক মেঝেয় কী খুঁজে বেড়াচ্ছেন ব্যস্তভাবে। জয়ন্তী আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। চেয়ার থেকে ওঠার কথা ভুলেই গেছি। ওদিকে শ্রীমতী মালহোত্রা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তখন চার-পাঁচজন পুলিস এসে ঢুকে পড়ল। তারপর জয়বোয়ালজিকে ধরল। তখন খান্না ওঁর হাতে একটা হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। জয়সোয়ালজি একটা কথাও বললেন না।
তাহলে জাঁদরেল রিটায়ার্ড পুলিশ সুপার রঘুবীর জয়সোয়ালই হত্যাকারী! আমি সন্দিগ্ধদৃষ্টে জয়ন্তীর দিকে তাকালুম। আর এতক্ষণে জয়ন্তীর যেন সংবিৎ ফিরল। সে উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল–চলো জয়ন্ত, আমরা বেরিয়ে ওঘরে যাই। আমার বুক কাঁপছে।
দুজনে বেরিয়ে ডাইনিং হলের কোনায় সোফায় গিয়ে বসে পড়লুম। কী বলব পরস্পর, ভেবে পাচ্ছিলুম না। আমি চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকলুম, জয়ন্তী একবার অস্ফুটস্বরে বললভীষণ মাথা ধরেছে, তারপর মাথাটা হেলিয়ে বসে রইল। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে শুনতে পাচ্ছিলুম। মাঝে মাঝে মেঘ ডেকে উঠছে।
একটু পরে স্টাডির দরজা খুলে গেল। প্রথমে ব্রিজেশ সিং ও সেই পুলিসবাহিনী জয়সোয়ালজিকে নিয়ে বেরোলেন। ডাইনিং হল পেরিয়ে সদর দরজা খুলে ওঁরা বৃষ্টির মধ্যেই অদৃশ্য হলেন। পরক্ষণে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। আসামী নিয়ে ওঁরা থানায় চলেছেন।
এবার বেরোলেন হাসিখুশি মুখে অধ্যাপক অরিন্দম দ্বিবেদী। খুব চঞ্চল দেখাচ্ছিল ভদ্রলোককে। হনহন করে এসে আমাদের পাশে বসে পড়লেন। তারপর একটু কেশে বললেন–কথাটা হচ্ছে, আমি সব টের পেয়েছিলুম, জানেন? কিন্তু প্রাণের ভয়ে বলিনি। বললেই বা কে বিশ্বাস করতে বলুন? ওরে বাবা, রিটায়ার্ড পুলিসসুপার–অত দাপট আছে নামের! থানা আমাকে পাত্তা দিত ভাবছেন? উলটে আমাকেই খুনী সাব্যস্ত করে কেস সাজাত। বাস্! রক্ষে করো বাবা!
জয়ন্তী হঠাৎ উঠল। –এই, কফি বলে আসি সরযূকে। আর দেখি ট্যাবলেট পাই না কি।
সে কিচেনের দিকে চলে গেলে অধ্যাপক ফিসফিস করে বললেন–জয়ন্তী দেবী কিন্তু আমার ব্যাপারটা টের পেয়েছিলেন, জানেন?
তাকালুম ভদ্রলোকের দিকে। তাতে যেন উনি ঘাবড়ে গেলেন। থতমত খেয়ে ফের বললেন–বরাবর মিঃ চাউড্রি, শিক্ষক হিসেবে আমার একটা কঠোর আদর্শ আছে। সেটা মেনে চলি। দুর্নীতি বা অন্যায় দেখলেই সাধ্যমতো বাধা দেবার চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমার শারীরিক সামর্থ্য ততটা নেই। তাই অনেক সময় পিছিয়ে আসতে হয়। যেমন ধরুন, মোহন পারেখের ব্যাপারটা…
বললুম, মোহন পারেখকে আপনি চিনতেন নাকি?
–আলবাৎ চিনতুম। ও তো মাস্তানটাইপ ছোকরা, মশাই। দিল্লীতে এসে গত বছর যা সব কাণ্ড করেছিল, ভাবতে পারবেন না। আর আজকালকার মেয়েগুলোর কী ব্যাপার দেখুন! ছ্যা ছ্যা ছ্যা! পারেখকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তক্ষুনি! তা বুঝলেন মিঃ চাউড়ি? মিসেস মালহোত্রা যখন কথায় কথায় সেদিন আমাকে বললেন, এবারও প্ল্যানচেটের আসর করব এবং মোহন পারেখ মিডিয়াম হবে–তাকে আনতে টেলি করেছি, আমার খুব রাগ হল। খবর নিলাম, গ্রিন ভিউয়ে ওর জন্যে ঘর বুক করা হয়েছে। জয়ন্তী দেবী আর শ্যামলী দেবীর মতো দুটি ফুলের মতো মেয়েকে পারেখ সামনে পেলে কী ঘটবে, ভাবতে বুক কেঁপে উঠল। ভাবলুম, ওঁদের সতর্ক করে দেওয়া দরকার। সোজাসুজি সামনাসামনি বললে তো অপমানিত হবার ভয়! তাই লাধিয়া নদীর ধারে একটা গুহার মধ্যে সুযোগ পেয়ে একটা চিরকুটে লিখে দিলুম।….
বাধা দিয়ে বললুম–জানি। আরো জানি, আজ ওই গুহার অন্ধকারে আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছিলেন। চিরকুটটা আবার কী হাঙ্গামায় ফেলে ভেবে ওটা খুঁজতে গিয়েছিলেন!
অধ্যাপক হাসলেন।জানেন? তা কাণ্ড দেখুন। একালের মেয়েদের সত্যি বোঝা যায় না, মশাই। সেদিন ওটা পেয়ে ওরা মোটেই চমকালেন না, ভয় পেলেন না। বরং উলটে আমাকে দেখিয়ে-দেখিয়ে পারেখের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করলেন। আমার আবার ওই এক বাতিক। যাঃ, বেটাচ্ছেলে কখন নিষ্পাপ মেয়ে দুটোর সর্বনাশ করবে কে জানে। খুব তক্কে তক্কে রইলুম। দেখলুম, পারেখের সঙ্গে শ্যামলী দেবীরই জমে উঠেছে। জয়ন্তী দেবী যেন অভিমানে দূরে দূরে ঘুরছেন। ৭ তারিখ বেলা এগারোটা নাগাদ পারেখের ঘরের দিকে নজর রেখেছি, দেখলুম বেটা বেরিয়ে এসে লাউঞ্জে গিয়ে দাঁড়াল তারপর শ্যামলী এল নেমে। আমি ওঁদের ঢলাঢলি দেখেই বুঝলুম, আজই সর্বনাশটা ঘটবে। তাই অমনি পারেখের ঘরে ঢুকে ওয়ার্লোবের পিছনে লুকিয়ে থাকলুম। যদি সত্যি দেখি, বেটা মেয়েটির সর্বনাশ করতে যাচ্ছে-তাহলে আমার একদিন কী ওর একদিন! কান পেতে অপেক্ষা করছি, এমন সময় দুজন ঢুকল। তারপর চাপা গলায় কথা বলা শুরু হল। শুনেই পিলে চমকে গেল আমার। এ যে। সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলছে! পারেখ বলছে, মহাবীর সিং নামে একজনের সঙ্গে ও ভূতের পাহাড়ে দেখা করতে যাচ্ছে–খুব গোপনীয় ব্যাপার। আর এই খামটা ওঁকে দেয়। খামটা খুব দামী। লুকিয়ে রাখতে হবে। ফোনে পারেখ জেনেছে, মিসেস মালহোত্রা এখন বাড়ি নেই। তাহলে তাকেই দিত। শ্যামলী বলল–সকালে তো উনি এসেছিলেন, তখন দিলেন না কেন খামটা? পারেখ বলল–তখন দেওয়ার কোন প্রশ্ন ওঠেনি। তাছাড়া ওটা বিশেষ করে শ্রীমতী মালহোত্রাকে সে দেবার কথা ভাবতেও পারে না! যাই হোক,
শ্যামলীকে তার ভাল লেগেছে। তাকে সে বিশ্বাস করে বলেই রাখতে দিচ্ছে। শ্যামলী খামটা বুকে ভরে ফেলল দেখলুম। তারপর দুজনে বেরিয়ে গেল। এবার আমার অবস্থা বুঝুন! বেরবো কীভাবে? দরজা তো লক করে দিয়ে গেল। মনে পড়ল, ঠিক তিনটেয় সুইপার আসে ঘর সাফ করতে। সর্বনাশ!
–তাহলে ওইদিন আপনি তিনটে অবধি পারেখের ঘরে বন্দী থাকলেন?
–হ্যাঁ। কী দুরবস্থা বুঝুন! কর্নেলকে মিথ্যা বলতে হল যে জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলুম।
–বেরোলেন কীভাবে?
–পারেখের বিছানায় শুয়ে সময় কাটাচ্ছিলুম। মশাই, বেটাচ্ছেলে মরে গেছে। সেই সময় ওর বিছানার তলায় যা সব ছবি পেয়েছিলুম, ছ্যাছা! খিদে ভুলিয়ে দিয়েছিল।
–আহা, বেরোলেন কী করে?
দরজা দিয়ে। সুইপার ঢুকল হোটেলের চাবিতে দরজা খুলে। আমি বেরিয়ে গেলুম। ব্যাটা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ভাবল, পারেখের কুটুম্ব হবেন! যাক গে, খুনী ধরা পড়ল। এখন দেখা যাক, বিচারে কী হয়। দেখবেন– প্রমাণাভাবে খালাস হয়ে যাবে। আজকাল তো বিচার নয়–প্রহসন! প্রহসন!
এতক্ষণে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, মেজর জেনারেল হরগোবিন্দ সিং, ডঃ সীতানাথ পট্টনায়ক, শ্রীমতী সরোজিনী মালহোত্রা আর খান্না সায়েব বেরোলেন। ডঃ পট্টনায়কের হাতে একটা কাগজের মোড়ক।
তারপর জয়ন্তী আর সরযূ বেরিয়ে এল কিচেন থেকে দুজনেরই হাতে ট্রে। সরযূ চলে গেল। জয়ন্তী কফি তৈরি করতে থাকল। কর্নেলরা এসে ভিড় জমালেন।
আমি কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। প্রথামতো তাঁর এবার-একটা দীর্ঘ ভাষণ দেবার কথা। রহস্যের সমাধান ও চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকবে তাতে। একটু পরেই কফিতে চুমুক দিতে দিতে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত উসখুস করছে। ওর দুচোখে কৌতূহল ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই হত্যাকাণ্ডে বিশেষ কোন রহস্য নেই। এত প্রাঞ্জল ব্যাপার আমার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম।
তাহলে একেই বলে সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কি রামের মাসী? প্রাঞ্জল ব্যাপার মানে? এমন জটিল গোলমেলে ধাঁধাঁয় ভরা হত্যাকাণ্ড কে কোথায় শুনেছে? আমি অবাক হয়ে তাকালুম ওঁর দিকে।
কর্নেল বললেন–প্রথম কথা, শ্ৰীমতী মালহোত্রার বিশ্বাসে আমি আঘাত করতে চাইনে–যা ঘটেছে, উনিও জানেন। আমি শুধু সংক্ষেপে তথ্যগুলো সাজিয়ে দিতে চাই। আমাদের দ্বিতীয় মিডিয়াম যে উদ্দেশ্যে অভিনয় করেছেন, শ্যামলীও তা করেছিল। উদ্দেশ্য, প্রেতাত্মার অছিলায় একটি হত্যাকাণ্ড ফাঁস করে দেওয়া। শ্যামলী সম্ভবত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড ভয়ও পেয়েছিল। এই বিদেশে তারা দুটি মাত্র মেয়ে, চারপাশে অনাত্মীয় সদ্য চেনা মানুষ। আজকাল পুলিসেও লোকের বিশ্বাস নেই। তাই তার পক্ষে এই বিভ্রান্তি খুবই স্বাভাবিক। অবশ্য জয়ন্তীকে সে বলতে পারত। বলেনি, পাছে জয়ন্তীর যা অতি সাহসী চালচলন এবং বেপরোয়া মনোভাব–সে হইচই বাধিয়ে বসে এবং পরিণামে মহাবীরের হাতে তারা বিপদগ্রস্ত হয়। আবার, শ্ৰীমতী মালহোত্রাকেও সে বলেনি। সেও একই কারণে সম্ভবত। আমার ধারণা, মোহন পারেখ বিস্তারিত তথ্য তাকে জানায়নি। তাই শ্যামলী ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, কী করা উচিত। সে সময় নিচ্ছিল ভাবতে–অথবা এড়িয়ে যেতে চাইছিল। ভেবেছিল, থাক, নাক গলিয়ে লাভ নেই।
জয়ন্তী বলে উঠল–ঠিক তাই। সেদিন আপনাদের সঙ্গে আসতে আসতে সে বলেছিল, পরদিনই ভোরের বাসে চলে যাবে। জায়গাটা অসহ্য লাগছে। আমি অবাক হয়েছিলুম। কিন্তু ও যা অভিমানী আর জেদি, তাই হা-না কিছু বলিনি।
কর্নেল বললেন–ঘটনাচক্রে শ্রীমতী মালহোত্রার প্ল্যানচেটের আসরে সে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেল। তখন সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইল। ভাবল, প্রেতের ঘাড়েই দায়টা চাপাবে। খুবই স্বাভাবিক শোনাবে হত্যাকাণ্ডের খবর। সে যদি নিপুণ অভিনয় করতে পারে, হত্যাকারীও ভয় পেয়ে ভাববে, প্রেতেরই কীর্তি! এ সবই অনভিজ্ঞ শ্যামলীর বালিকাসুলভ আচরণের পরিচয়। সে ভাবল–এমনিভাবে বিবেকদংশনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে, আবার মাথাও, বাঁচাতে পারবে। কী বলেন ডঃ পট্টনায়ক?
ডঃ পট্টনায়ক বললেন–আপনার হাইপোথিসিস যুক্তিসিদ্ধ কর্নেল।
–আমার ধারণা, হত্যাকারীর নামটা সে হয়তো বলত না। অতটা সাহস তার ছিল না। সে বার বার বলব না বলছিল মনে পড়ছে? কিন্তু হত্যাকারী তো অন্তর্যামী নয়। সে আর এক সেকেন্ডেও রিস্ক নিতে চাইল না। ভাবল, বাঃ! চমৎকার হল। প্রেতের ঘাড়েই চলে যাবে হত্যাকাণ্ডটা। কারণ, এই অদ্ভুত বিষের কথা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান জানবে কেমন করে? বিশেষ করে শ্যামলীর মুখের বীভৎসতা আশা করি মনে পড়ছে আপনাদের। মৃতের মুখের অমন চেহারা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে একেবারে অপরিচিত সিপ্টম! কাজেই ডাক্তাররা হাল ছেড়ে বলবেন, মৃত্যুর কারণ দুজ্ঞেয়। তার মানে– প্রেতের হত্যাকাণ্ড বলে বিশ্বাস করানো তখন বেশ সহজ হয়ে উঠবে!
ডঃ পট্টনায়ক বললেন–দেখুন না, অজ্ঞাত কিছু ইঞ্জেকশান করা হয়েছে। বুঝতে পেরেছিলুম। অথচ সেই চিহ্ন খুঁজতে স্বভাবত আমরা দেহের অন্যান্য অংশ খুঁজেছি। মাথা খুঁজিইনি। যখন কর্নেল বললেন, প্যাথোজেনের প্রথম পর্যায়ের কলোনি কোথায় রয়েছে–তখন মাথায় সূক্ষ্ম দাগ চোখে পড়ল। কারণ মাথাতেই সেই কলোনির খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন–এই মহাবীর সিং ওরফে জাল পুলিস সুপার রঘুবীর জয়সোয়াল হল উদয়াদ ঝুনঝুনওয়ালা–যে ছিল হরিহরপ্রসাদ মালহোত্রার ব্যবসায়ের পার্টনার, সে একসময় দক্ষিণ আমেরিকায় ছিল। ওর আদি কীর্তির কথা কাস্টমস, সি-বি-আই, আর বোম্বে পুলিসের নথিভুক্ত হয়ে রয়েছে। শ্ৰীমতী মালহোত্রার কাছে এসব তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। ওর খপ্পরে পড়ে দেনায় ডুবে যেতে থাকেন হরিহরজি। তখন ওরই পরামর্শে নির্বোধের মতো বিস্তর বে আইনি পথে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন। এর ফল হল আরো গুরুতর। উল্টে মহাবীর সিং তাকে ব্ল্যাকমেল শুরু করল। তখন হরিহরজি একদিন ঝোঁকের মাথায় আত্মহত্যা করলেন। জিপসুদ্ধ ঝাঁপ দিলেন দিল্লী থেকে নৈনিতাল আসার পথে এক বাহাড়ী খাদে। এবার এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। সরোজিনী দেবী উচ্চশিক্ষিত মহিলা–নৈনিতাল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে রাবার তার বনিবনা ছিল না। স্বামীর করিবার এবং চালচলন মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি থাকেন নৈনিতালে, হরিহরজি দিল্লীতে। তিনি ভুলেও আনকালচার্ড স্বামীর কাছে যেতেন না। স্বামী আসতেন কদাচিৎ। তাই স্বামীর পার্টনারটিকে তিনি জানতেন না–চিনতেও না। এমনকি স্বামীর ব্যবসায়ে এত সব গুরুতর কাণ্ডেরও খবর রাখতেন না। এবার আসি মোহন পারেখের প্রসঙ্গে। মোহন হরিহরজির বাল্যবন্ধুর ছেলে। আজীবন মালহোত্রা পরিবারে তার যাতায়াত ছিল। নিঃসন্তান স্বামী ও স্ত্রী দুজনের কাছেই। সে স্নেহাস্পদ হয়ে উঠেছিল। বোম্বেতে ভাগ্যান্বেষণে গেলে মোহনকে বরাবর হরিহরজি টাকা পাঠাতেন। সরোজিনীও কখনও সখনও পাঠাতেন। হরিহরজি যখন ক্রমাগত উদয়চাঁদ বা মহাবীরের হাতে শোষিত হচ্ছেন, তখন স্ত্রীকে ভয়ে বা সংকোচে সব জানাতে না পেরে পুত্ৰাধিক প্রিয় মোহন পারেখকে এক দীর্ঘ চিঠিতে তা জানিয়ে দিলেন এবং আত্মহত্যার সঙ্কল্পটাও গোপন রাখলেন না। সে চিঠি আমরা পেয়েছি সরোজিনী দেবীর কাছে। যাইহোক, চিঠি পেয়ে তক্ষুনি প্লেনে দিল্লী এল মোহন। এসে শুনল, হরিহরজি নৈনিতাল রওয়া হয়ে গেছেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে মোহনও রওনা হল। তখন দেরি হয়ে গেছে। পথে জিপ দুর্ঘটনা দেখতে পেল সে। নৈনিতাল পৌঁছে সরোজিনীকে সব জানাল। তারপর বলল–পিতাজির এই অসহায় মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবেই। কিন্তু তখন কোথায় সেই উদয়চাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা? দিল্লী থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। অবশেষে মোহন শরণাপন্ন হল বোম্বের এক প্রাইভেটে ডিটেকটিভ এজেন্সির। দিনে দিনে এজেন্সি তাকে উদয়চাঁদের তথ্য জানাল। তখন সে দিল্লীতেই জয়পুরের রিটায়ার্ড পুলিস সুপার রঘুবীর জয়সোয়াল সেজে বাস করছে। কিন্তু তার আদি অকৃত্রিম নাম মহাবীর সিং। অনেক বছর আগে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় বোম্বেতে তার জেল হয়। কয়েদী হিসেবে থাকার সময় জেলের পোশাকপরা তার একটা ছবি জেলকর্তৃপক্ষ সরকারি প্রয়োজনে তুলে রেখেছিলেন। একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি সেই ছবির নেগেটিভই ঘুষ দিয়ে কীভাবে হাতায় এবং মোহনকে দেয়। সেই সঙ্গে মোহনকে এজেন্সি জানাল, মহাবীর সিং জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। পুলিস তাকে খুঁজছে পাত্তা পায়নি। যাইহোক, এতদিনে সে দিল্লীতে নিজেকে জয়পুরের রিটায়ার্ড পুলিস সুপার বলে পরিচয় দিয়ে বাস করছিল। আসল রঘুবীর জয়সোয়াল কবে মারা গেছেন।
এবার শ্রীমতী মালহোত্রা চোখের জল মুছে বললেন–আমার স্বামীর পার্টনারকে কখনও আমি দেখিনি। ওরর ওই জাল নামগুলো মোহন আমাকে পরে সব জানিয়েছিল। কিন্তু বেচারা মোহন নিজেই এক লোভে পড়ে গেল। ওর মাথায় ফিল্ম প্রডিউস করার ঝোঁক চেপেছিল। তাই মালহোত্রাজির মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার ছলে শুরু করল রঘুবীর জয়সোয়ালকে ব্ল্যাকমেলিং।
জয়ন্তী বলল ব্ল্যাকমেলিং?
অধ্যাপকও বললেন–কী কাণ্ড!
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, মোহন ওর কাছে টাকা আদায় শুরু করল। সেই নেগেটিভ থেকে পজিটিভ প্রিন্ট দেখিয়ে সহজেই কাবু করল তাকে।
জয়ন্তী বলল–৭ই জুন দুপুরে ভূতের পাহাড়ে তা হলে মোহন পারেখ টাকা আনতে গিয়েছিল?
–হ্যাঁ। টাকা আনতে তো বটেই, হয়তো আরও কোন প্রলোভন দেখিয়েছিল মহাবীর। একটু বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছিল মোহন পারেখ। ফলে প্রাণ হারাতে হল। মহাবীর মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবার।
মেজর জেনারেল হরগোবিন্দ সিং বললেন মিসেস মালহোত্রা, আপনি তো উদয়চাঁদ ওরফে মহাবীরকে কখনও দেখেননি। কিন্তু এখানে কেমন করে চিনেছিলেন ওকে? মোহনকেই বা তার আসার অত আগে টেলিগ্রাফ করেছিলেন কেন? কেমন করে জানলেন মহাবীর ওরফে জয়সোয়াল এখানে আসবে?
শ্ৰীমতী মালহোত্রা বললেন–এখানকার সবকটা হোটেলে বাইরের লোক সিজুনে বেড়াতে এলেই আমি যেচে গিয়ে আলাপ করি। আমন্ত্রণ করে আসি। এ আমার বরাবরকার অভ্যাস। সোসাইটি ছাড়া আমার দম আটকে যায়। এমনকি কারা কারা আসবনে, অগ্রিম কারা ঘর বুক করেছেন–সে খোঁজও নিই। গ্রিন ভিউ হোটেলে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, এক রিটায়ার্ড পুলিস সুপার রঘুবীর জয়সোয়ল অগ্রিম বুক করেছেন দিল্লী থেকে–অমনি চমকে উঠি। মোহনকে টেলি করে দিই তক্ষুনি। মোহন এসে পৌঁছায় –৬ই জুন রাত্রে। ৭ই জুন সকালে ওর সঙ্গে পরামর্শ করি। ঠিক হয় যে প্ল্যানচেটের আসর বসাব এবং মোহনকে মিডিয়াম করে ওর মুখ দিয়ে মহাবীর সিংয়ের কীর্তি ফাঁস করে দেব। ডিটেলস সব বলে যাবে মোহন। আমার স্বামীর আত্মা যেন কথা বলছেন মিডিয়ামের মুখ দিয়ে–এভাবেই সব আয়োজন করেছিলুম। কিন্তু মোহন– বেচারা মোহন! বেটা আমার!
বলতে বলতে হঠাৎ কেমন আস্বাভাবিক হয়ে গেল শ্ৰীমতী মালহোত্রার দৃষ্টি। নাসারন্ধ্র কাঁপতে থাকল। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। তারপরই উঠে দাঁড়ালেন। বিকৃত গলায় পেঁচিয়ে উঠলেন–আমি ওর কলজে উপড়ে খাব। ওর চোখ দুটো গেলে দেব। ওর নাড়িভুড়ি টেনে বের করে ফেলব।
জয়ন্তী ওঁকে ধরতে যাচ্ছিল, তার আগেই উনি আমাকে সোফাসুদ্ধ উলটে ফেলে দিলেন। তারপর ঘরময় ছোটাছুটি শুরু করলেন! দমাদ্দম সব ভাঙচুর করতে থাকলেন।
কয়েকটি সেকেন্ডে এই উপদ্রব ঘটে গেল। তখন লছমন আর সরযূ দৌড়ে এসে ওঁকে ধরল। অধ্যাপক, মেজর জেনারেল আর আমিও গিয়ে যোগ দিলুম। শ্ৰীমতী মালহোত্রা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সরযূ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
ওঁকে ধরাধরি করে সবাই ওঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলুম। ডঃ পট্টনায়ক শুশ্রূষা করতে ব্যস্ত হলেন।
বাইরে বেরিয়ে কর্নেল বললেন–মানুষের জীবনে এমন কত ট্রাজেডি যে ঘটে। হতভাগিনী শ্রীমতী মালহোত্রার পরিণতি ভেবে আমি শিউরে উঠছি। আমি ডাক্তার নই জয়ন্ত, কিন্তু অভিজ্ঞতার বিচারে টের পেয়ে গেছি, ভদ্রমহিলা বাকি জীবন এভাবেই বেঁচে থাকবেন। সারাজীবন স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না বুঝতে পারেননি কী হারাচ্ছেন। একদা স্বামীর ওই নিষ্ঠুর আত্মহত্যার ঘটনা তার অবচেতনায় তীব্র আঘাত দিল। তারপর এই বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতায় ক্রমশ টের পেলেন, কী থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তখন ধীরে ধীরে দীর্ঘসঞ্চিত অতৃপ্তি, আত্মগ্লানি, অনুশোচনা আর ক্রোধ একসঙ্গে বিষাক্ত স্ফোটকের সৃষ্টি করল অবচেতনায়। আমরা যা দেখছি, তা তারই কিছু প্রকাশ মাত্র। কিন্তু না–এর জন্যে উনি নিজেও হয়তো দায়ী নন। কিছুটা দায়ী মহাবীর সিংও বটে। আর কিছুটা দায়ী অন্য একজন–তাকে, আমি এক অলৌকিক শক্তিই বলব। এই প্রচ্ছন্ন গভীরতর নেপথ্যচারী শক্তি যেন মানুষের প্রকৃত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছে আবহমানকাল। তার হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। হ্যাঁ, জয়ন্ত, কিছু অলৌকিক আছেই আড়ালে।
কর্নেল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি ও জয়ন্তী কোন কথা বললুম না। একটু পরে গ্রিন ভিউয়ের লনে পৌঁছে কর্নেল জয়ন্তীর দিকে ঘুরে বললেন– ইয়ে জয়ন্তী ডার্লিং, শুনে খুশি হবে যে মেজর জেনারেল হরগোবিন্দজি তার হেলিকপ্টারে শ্যামলীর বডিটা দিল্লী পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছেন। বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বডিটা এখন ডঃ প্রসাদের জিম্মায় রয়েছে। তবে ডার্লিং আমার এই তরুণ বন্ধুটির মনে কষ্ট হলেও উপায় নেই, কাল সকালেই তোমাকে শ্যামলীর বডি নিয়ে মেজর জেনারেলের সঙ্গে হেলিকপ্টারে রওনা হতে হবে। তৈরি হয়ে থেকো ….