৮. অবাক হয়েছে কিশোর

এতটাই অবাক হয়েছে কিশোর, কথাই সরল না কয়েক সেকেণ্ড। তারপর কোনমতে বলল, আ-আমি কিছু জানি না….আপনার জিনিস আমার ঘরে গেল কি করে?…আশ্চর্য!

দুর থেকে দেখেই কিছু সন্দেহ করেছিল রবিন আর মুসা, এগিয়ে এল শোনার জন্যে। সব শুনে রেগে গিয়ে রবিন বলল, কিশোর চোর না! ওকে যে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মিসেস ব্যানার। তারপর পার্স আর মানিব্যাগের টাকা আর জিনিসপত্র দেখে নিয়ে বলল, সব ঠিকই আছে মনে হয়। যাই হোক, একথা আমি ভুলব না। মানিব্যাগটা স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখ, ঠিক আছে কিনা।

টাকা গুনে নিয়ে মাথা কাত করল মিস্টার ব্যানার, ঠিকই আছে।

ওরা দুজন চলে গেলে লিলি বলল, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কে ঘটাচ্ছে এসব ধরতেই হবে। পিঠ সোজা করে হেঁটে চলেছে মিস্টার আর মিসেস ব্যানার, সেদিকে তাকিয়ে বলল, এমন কাণ্ড এই র‍্যাঞ্চে কোনদিন হয়নি। কিছু বুঝতে পারছি না। 

আমি পারছি, মুসা বলল। নিশ্চয় সত্যের খুব কাছাকাছি চলে গেছে কিশোর, তাই তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা চলছে।

কিশোরের বাহুতে হাত রাখলেন কেরোলিন, বিশ্বাস করো, তোমাকে দোষ দিইনি আমি। আমিও বিশ্বাস করি না তুমি একাজ করেছ।

হাসল কিশোর। আমি কিছু মনে করিনি। তবে যে একাজ করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। ধরবই।

তাই কর, লিলি বলল।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন কেরোলিন, সর্বনাশ! এখুনি গিয়ে রান্না বসাতে হবে, নইলে রাতে ঠিকমত খাবারই দিতে পারব না।

সাহায্য-টাহায্য লাগবে আজকে? কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করল রবিন। তাহলে আমি আর মুসা করতে পারি…

বাধা দিয়ে মুসা বলল, আসলে, আমার আজ…

  করতে ভাল লাগছে না তো? মুসার ইচ্ছে বুঝতে পেরে হাসলেন কেরোলিন। কিন্তু বাবা, আজকে যে আমার সাহায্য দরকার। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বেতার ওপর স্পেশাল একটা ডিশ করতে যাচ্ছি। একা সামলাতে পারব না। একজন অন্তত এসো।

এই অনুরোধের পর আর কথা চলে না। রবিন, মুসা দুজনেই চলল কেরোলিনের সঙ্গে। ওরা রওনা হয়ে গেলে ডেকে বলল কিশোর, যাও তোমরা। আমিও আসছি।

লিলি বলল, মিসেস ব্যানারের ব্যবহারটা দেখলে? কিশোর বলল, ওরকম চুরি হলে আমিও করতাম। তাকে দোষ দিতে পারছি না। আমার কথা ভেবে যদি লজ্জা পেয়ে থাকেন, ভুলে যান। এসব অভ্যাস আছে আমার। এর চেয়ে বেশি অপমানও হয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত জবাব দিয়ে তারপর ছেড়েছি। এবারেও তাই করব। আসলে, কারও বিপদের কারণ হয়ে উঠেছি আমি। সেজন্যেই চাইছে না আমি তদন্ত করি। ভয় পেয়ে গেছে। থামাতে চাইছে। ইউনিকর্নকে কে পালাতে সাহায্য করে থাকতে পারে কিছু আন্দাজ করতে পারেন?

ও একা একা পালিয়েছে এটা মেনে নিতে পারছ না?

আপনি পারছেন?

শ্রাগ করল লিলি। না, আমিও অবশ্য পারছি না। তবে পুরো ব্যাপারটাই যেন কেমন! কোন চিহ্ন নেই, কিছু নেই…একেবারে হাওয়া!

বনবন করে ঘুরছে যেন কিশোরের মগজের চাকাগুলো। দুটো ব্যাপার হতে পারে। হয় আপনাআপনিই পালিয়েছিল ইউনিকর্ন, সেটাকে কাজে লাগিয়েছে যে ওকে চুরি করেছে। পালানর পর কোনভাবে ধরে তার পিঠে চেপেছে। নয়তো পালাতে সাহায্য করেছে প্ল্যান করেই।

কাকে সন্দেহ করছ? ব্রড জেসন? নিচের ঠোঁটে কামড় দিল লিলি।

হতে পারে। কিংবা এমন কেউ হতে পারে, যে আপনাকে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিওতে শরিক হতে দিতে চায় না। আমার ধারণা, ইউনিকর্নের পালান আর হারিকেনের খেপে যাওয়ার পেছনে একই কারণ। দুটো ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক। আছে।

কি?

এখনও জানি না। কিন্তু ইউনিক আর হারিকেনকে ছাড়া আপনি না পারবেন ঘোড়ার বাচ্চা বিক্রি করে টাকা দিতে, না পারবেন রেডিওতে জিতে টাকা জোগাড় করতে। ধার আর শোধ করা হবে না আপনার। ধার যাতে শোধ করতে না পারেন তার জন্যেও এসব করা হয়ে থাকতে পারে।

হু, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি।

বেড়ায় হেলান দিল কিশোর। পাইককে বলতে শুনেছি, যেভাবেই হোক, র‍্যাঞ্চটা আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেবেই। নিরেকের কাছে বলেছে।

সে-ই এর পেছনে নয় তো?

সরাসরি হ্যাঁ না বলে কিশোর বলল, ওর সম্পর্কে আরও জানতে হবে আমাকে।

মুখ বাঁকাল লিলি। আমি আর জানতে চাই না। যত কম জানি ততই ভাল। আমার জন্যে। ওই লোকটাকে দেখলেই ভয় লাগে আমার। কেঁপে উঠল সে। কোনদিনই র‍্যাঞ্চ আমি ওর কাছে বেচব না। আকাশের দিকে তাকাল। এক রত্তি মেঘ নেই কোথাও। আজ রাতেই আমি ঘোষণা করে দেব, আবার রোডিও খেলব। আমি। এখন কেবল ইউনিকর্নকে দরকার আমার। ওকে পেতেই হবে।

পাব। খুঁজে বের করব, কথা দিল ওকে কিশোর। ডবসি কুপারের র‍্যাঞ্চে যাব। আমি। তাকে জিজ্ঞেস করব সত্যিই ইউনিকর্নকে দেখেছে কিনা।

আমার বিশ্বাস হয় না, লিলি বলল। অন্য কোন ঘোড়া দেখেছে কুপার। ইউনিককে নয়।

তবু, কথা আমি বলতে যাবই।

যাওয়ার দরকার নেই। আজ রাতে বারবিকিউ পার্টিতে দাওয়াত করেছি, আসবে। বেড়ার ওপরের রেইলে চাপড় মারল লিলি। যাই, কাজ করিগে। পরে কথা হবে।

বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। কিছুদূর যাওয়ার পর আস্তাবলের দিক থেকে ব্রডকে যেতে দেখে সেদিকে এগোল। কাঁধের ওপর দিয়ে একবার ঘুরে তাকিয়ে গিয়ে একটা স্টেশন ওয়াগনে উঠে চালিয়ে নিয়ে চলে গেল লোকটা। আরেকবার আস্তাবলের ভেতরে দেখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

আস্তাবলের ভেতরে অন্ধকার, শান্ত, কেমন একটা তেলতেলে গন্ধ। ঘোড়াগুলো সব বাইরে। সোজা ইউনিকনের স্টলের দিকে এগোল কিশোর। সব আগের মতই রয়েছে, কিছুই বদল হয়নি। খড় ছড়ানো, খাবারের বাক্সটা অর্ধেক ভরা, হুকে ঝোলান পানির বালতি, দরজার পাল্লা ভাঙা। মেরামত করা হয়নি। একবার দেখে। ঘুরতে যাবে এই সময় মনে হলো কি যেন একটা বাদ পড়েছে। কিংবা কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, সব ঠিকঠাক নেই। ভাল করে আরেকবার দেখল সে। কই, সবই তো ঠিক আছে? সত্যিই আছে তো?

আনমনেই একবার ভ্রূকুটি করে হারিকেনের স্টলের দিকে তাকাল সে। ওটাও একই রকম রয়েছে, কেবল খড়ের রঙটা অন্য রকম লাগছে। বদলানো হয়েছে। বোধহয়।

কিশোরের মন বলছে, মূল্যবান একটা সূত্র রয়েছে আস্তাবলের ভেতরে। নজরে পড়ছে না। গভীর ভাবনায় ডুবে থেকেই আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল সে, রওনা হল বাড়ির দিকে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল কাজ করছে মুসা আর রবিন।

ময়দা মাখাচ্ছে মুসা। রবিন পেঁয়াজ কুচি করছে। সসপ্যানে মাংস ভাজছেন। কেরোলিন।

আমি কোন সাহায্য করতে পারি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নিশ্চয়, জবাব দিল রবিন। বাকি পেঁয়াজগুলো যদি কেটে দিতে… চোখ ডলতে লাগল সে। লাল হয়ে গেছে। পানি বেরোচ্ছে পেঁয়াজের ঝাঁজে।

মাংসে টমেটো সস আর বীন মেশাতে মেশাতে কেরোলিন অনুরোধ করলেন, কনগুলো যদি পরিষ্কার করে আন, খুব ভাল হয়।

যাচ্ছি। প্যানট্রিতে এসে ঢুকল কিশোর। কর্ন বের করার জন্যে হাত বাড়াতেই ঠেলা লেগে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা খবরের কাগজ। পুরানো হতে হতে হলদে হয়ে গেছে।

দূর! কাগজগুলো আবার তুলে ঠিক করে রাখতে লাগল সে।

আধ ঘন্টা পরে ডিনার তৈরি হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ঢুকল লুক বোলান। থমথমে চেহারা। জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?

মনে হয় দোতলায়, কেরোলিন বললেন।

না, এই তো, দরজার কাছ থেকে বলল লিলি। পরনে কালো জিনস, গায়ে লাল-সাদা চেক শার্ট, মাথায় টকটকে লাল হ্যাট।

খারাপ খবর আছে, লুক বলল। ইউনিককে পাইনি। মনে হয়, চিরকালের জন্যেই গেল।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল লিলি। বিড়বিড় করে বলল, বিশ্বাসই করতে পারি না!

বিশ্বাস তো আমিও করতে পারছি না, লুক বলল। শেষ পর্যন্ত শেরিফকে জানাতে বাধ্য হয়েছি। দশ মাইলের মধ্যে পাড়াপ্রতিবেশী যত আছে, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ দেখেনি ওকে।

লুকিয়ে রয়েছে হয়তো কোথাও, কিশোর বলল।

কোথায়? ভুরু কোঁচকাল লুক। কোনখানে?

এখনও জানি না। তবে কেউ ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছে ওকে।

পাগল! ফেটে পড়ল লুক, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ছেলে! শহরে তোমরা কিভাবে গোয়েন্দাগিরি কর, জানি না, তবে এখানে আমরা কোন কিছু চুরি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তারপর চোরকে ধরার চেষ্টা করি।

কিশোর তো সেটাই করতে চাইছে, লিলি বলল। ওর ধারণা, ইউনিককে চুরি করা হয়েছে।

হায় হায়, বলে কি! চোখ বড় বড় হয়ে গেল কেরোলিনের।

লুকের চোখে অবিশ্বাস ফুটল। এসব অতি কল্পনা। ঘোড়াটা পালিয়েছে, এটাই সহজ জবাব।

 তাহলে পাচ্ছি না কেন ওকে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। আটকে রাখা না হলে ও এতক্ষণে চলে আসত। গৃহপালিত কোন জানোয়ারই বাড়ি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে না।

পাগল হয়ে গেছে! মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল লুক।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন কেরোলিন। তারপর বললেন, এখানে আমিই সামলাতে পারব। তোমরা গিয়ে ঘরটর গোছগাছ কর।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অ্যাপ্রন খুলতে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। তবে রবিন বলল, তোমরা যাও। আমি আসছি।

ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল কিশোর। এসে বসল মুসার বিছানায়। বলল, সেই অনুভূতিটা হচ্ছে আবার আমার। কোন কিছু মিস করলে, ধরি ধরি করেও ধরতে না পারলে যেটা হয়। জরুরী কোন একটা সূত্র।

কি? মুসা জিজ্ঞেস করল।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। হাতের তালুতে থুতনি রাখল কিশোর। যদি খালি বুঝতে পারতাম কে ইউনিকর্নকে চুরি করেছে আর ব্যানারদের জিনিসগুলো। আমার ব্যাগে রেখেছে…।

এবং কে হারিকেনকে ওষুধ খাইয়েছে,মুসা বলল। এই তো?

যদি খাইয়ে থাকে। যাই হোক, এই মুহূর্তে এটাও প্রমাণ করতে পারছি না। আমরা।

তারমানে যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি, এগোতে পারিনি একটুও?

আলমারির আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আনমনে মাথা দোলাল, অনেকটা সেই রকমই।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল রবিন। চকচক করছে। চোখ। চিৎকার করে বলল, পেয়ে গেছি। ধরে ফেলেছি ব্যাটাকে!

সতর্ক হল কিশোর। আহ, আস্তে! দরজা লাগাও!

দরজাটা লাগিয়ে দিল রবিন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, কে সব কিছুর পেছনে বুঝে ফেলেছি!