০৮.
কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার অবনীবাবু? কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?
অবনী তান্ত্রিক হাসল। মা আমাকে সারাক্ষণ গার্ড দিচ্ছেন। গণ্ডগোল করে কার সাধ্য? একটা সুখবর দিতে এলাম। আপনার চলে আসার পর ধ্যানে বসেছিলাম। ভোররাত্রে গোপাকে খুঁজে বের করলাম।
বলেন কী! কোথায়?
দিল্লিতে।
আপনি দিল্লি মন্ত্রবলে উড়ে গিয়েছিলেন বুঝি?
ধুর মশাই! তন্ত্রের আকর্ষণ। ট্রাঙ্ককলে নিজেই সাড়া দিল। বলল, আমেরিকা ফিরে যেতে চেয়েছিল। প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে। আজ কিংবা কালই কলকাতা আসছে। আমি যেন কথাটা আপনাকে জানিয়ে দিই।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ভাল। ভবতারণের খোঁজ পাননি এখনও?
হুঁ। পেয়েছি। ব্যাটাছেলে চণ্ডীতলা আশ্রমে গেছে।
ধ্যানে খোঁজ পেলেন তা হলে?
তান্ত্রিক অদ্ভুত শব্দে হাসতে লাগল। ভাবার জন্য ধ্যানে বসতে হবে? ধ্যান অত শস্তা? শিবু উকিলের মুহুরি কালীবাবুর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলো। বললাম, ভবার খবর জানো কালীদা? কালীদা বলল, বাবু ওকে চণ্ডীতলা আশ্রমে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটা বুঝলেন?
না তো!
অবনী মৈত্র চোখ নাচিয়ে বলল, ব্রহ্মানন্দকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে–কাম অন! অল ক্লিয়ার হুঁ! আসুক না কেউ! পেটে ত্রিশূল বিধিয়ে দেব। গোপা প্রপার্টির মালিক। আমি উইলের সাক্ষী। শিবু উকিল ফ্যাকড়া বাধালে রঞ্জুবাবুকে লড়িয়ে দেব।
কে তিনি?
শিবু উকিলের বৈমাত্রেয় দাদা। বাঘা উকিল। দুজনের মুখ দেখাদেখি নেই। কেস দিলে লুফে নেবে। বুঝলেন তো?
কর্নেল চোখ তুলে বললেন, আচ্ছা অবনীবাবু, আপনি তো আপনার পিসেমশাইয়ের ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন। কী কাজ করতেন?
কাজ মানে ওভারঅল সুপারভিশন।
কিছু মনে করবেন না। আপনার পড়াশোনা কতদূর?
অবনী তান্ত্রিক যথারীতি কারণবারি পান করেছে সকালে। কথাবার্তার সুরেই তা বোঝা যাচ্ছিল। বলল, ছোটবেলা থেকে পিসেমশাইয়ের কাছে মানুষ। মা বাবার মুখ মনে পড়ে না। পিসেমশাই খোঁচা মেরে মেরে বি. এস-সি পর্যন্ত তুলেছিলেন। কিন্তু মা আমাকে অন্যদিকে টানছিলেন। টানাটানিতে শেষে মায়েরই জয় হলো। তারা! ব্রহ্মময়ী! মাগো! এবার উঠি মশাই! গঙ্গাস্নান করেই চলে এসেছি।
আচ্ছা অবনীবাবু! আপনার পিসেমশাইকে পুলিশ কী কেসে আরেস্ট করেছিল?
অবনী বাঁকা মুখে বলল, আপনাকে কাল রাত্রেই বলেছি পিসেমশাই খুব বাজে লোক ছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে আদিবাসী মুলুকে ওদের টোটকা জড়িবুটি কিনতে যেতেন। তবে মাথা ছিল মশাই! নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল।
হু। কিন্তু পুলিশ কেন ওঁকে আরেস্ট করেছিল?
অবনী তান্ত্রিক চাপাস্বরে বলল, নিজের নামে একটা ওষুধ তৈরি করেছিলেন। সদানন্দ বটিকা। সব কৌটোর গায়ে লেখা থাকত স্নায়ুদৌর্বল্যের ওষুধ। কিন্তু কিছু কিছু কৌটোর গায়ে লাল যুক্তচিহ্ন থাকত। সেগুলো কিন্তু সাংঘাতিক ড্রাগ। মিলিয়ে-মিশিয়ে কৌটোগুলো প্যাকেটভর্তি চালান যেত দেশবিদেশে। ব্যস্! তারপর কেউ ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আন্টিড্রাগ সেল থেকে অফিসাররা পুলিশ নিয়ে এসে পিসেমশাইকে পাকড়াও করল। শেষ শিবু উকিল বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সেই ড্রাগের ফর্মুলা সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না মশাই! আমার ড্রাগট্রাগ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মায়ের কৃপায় কারণবারিই যথেষ্ট। তবে লুকোব না। রাত্রিবেলা বাবার সেবাও একটুখানি করি। বাবাকেও তো দেখতে হবে। বাবার প্রসাদ খাই।
ভাং?
হ্যাঁ।
গোপা আপনাকে সদানন্দ বটিকা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
কই না তো! তারা! ব্রহ্মময়ী! মা গো! উঠি কর্নেলসাহেব!
অবনী তান্ত্রিক উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বলল আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। আপনারা যেন আর আমাদের তল্লাটে যাবেন না মশাই। শিবু উকিলের মুহুরি কালীদা আমাকে বলছিল, বাবুর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে কে জানো অবু? আমি চেপে গেলাম। তখন কালীদা বলল, বাবু গোয়েন্দা দুটোকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন। বাবুর পোষা গুণ্ডারা ওত পেতে আছে। বুঝলেন তো?
সে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে জপতে বেরিয়ে গেল। ষষ্ঠীচরণ দরজা বন্ধ করতে গেল।
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন, তা হলে গোপা ফিরে আসছে। দিল্লি গিয়ে হঠাৎ প্ল্যান বদলানোর কারণ কী হতে পারে? স্পষ্টই সে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দিল্লি গিয়ে হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠল। শিবপদবাবুর যা মনোভাব জেনেছি, তাতে গোপার সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। গোপার জীবনের ঝুঁকিও আছে। ঝুঁকি নিয়েই সে ফিরে আসছে।
বললাম, দিল্লিতে গিয়ে হয় তো সে তার গ্রুপের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ওদের নেটওয়ার্ক সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ফর্মুলা উদ্ধার করার জন্যই গোপাকে কলকাতা ফরতে হচ্ছে।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমাকে খবর দিতে বলার কারণ কী?
জাস্ট এ ফরম্যালিটি! আপনি ওর ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাই
নাহ্ জয়ন্ত! আমি গোপার চ্যালেঞ্জের গন্ধ পাচ্ছি।
আপনাকে চ্যালেঞ্জ? গোপা আপনাকে ভালই জানে।
নেচার পত্রিকার প্রবন্ধের তলায় দু-চার কথায় লেখা আমার পরিচিতি থেকে আমাকে তত বেশি জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। বলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! ব্রেকফাস্ট।
ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, সব রেডি বাবামশাই!
কর্নেল উঠলেন। কুইক জয়ন্ত! ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বেরুব। না– গাড়িতে নয়। ট্যাক্সি করে শেয়ালদা স্টেশন। তারপর ট্রেনে।
চণ্ডীতলা আশ্রমে যাবেন?
হ্যাঁ। সুদর্শনের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।..
.
ট্রেনে কৃষ্ণনগর পৌঁছুতে প্রায় সওয়া একটা বেজে গিয়েছিল। একটা হোটেলে খেয়ে নিয়ে আমরা বাসস্টপেজে গেলাম। তিনটের আগে বাস নেই। তা-ও বাসস্টপ থেকে নেমে নাকি প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তার চেয়ে এক্কাগাড়ি ভাল। একেবারে আশ্রমে পৌঁছে দেবে। মোটে ছকিলোমিটার দূরত্ব।
কর্নেলের পোশাক টুরিস্টের। মাথায় টুপি। কাঁধে কিটব্যাগ এবং প্রজাপতিধরা নেট। গলায় ঝুলন্ত বাইনাকুলার এবং ক্যামেরা। আমার পরনে শুধু প্যান্টশার্ট। এক্কাগাড়ির কোচোয়ান মওকা বুঝে তিরিশ টাকা হাঁকল।
রোগা টিঙটিঙে টাটুঘোড়া সম্ভবত কর্নেলের ওজনের চাপে কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। বেহদ্দ পিচ রাস্তার পর মোরামবিছানা রাস্তা। তার অবস্থাও শোচনীয়। তবে আশ্রমযাত্রীদের ভিড় দেখার মতো। ওই এক চিলতে রাস্তায় কী কৌশলে আরও এক্কা, গোরু-মোষের গাড়ি, সাইকেল রিশো এবং প্রাইভেট কার পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, তাও দেখার মতো। সরকারি বনসৃজন প্রকল্পের রূপায়ণ, মরসুমি ধানখেত, ইটখোলা, একটা ছোট্ট গ্রাম। তারপর অদূরে নদীর বাঁক দেখা গেল। কর্নেল সারাপথ চোখে বাইনাকুলার রেখে পাখি দেখছিলেন। মাঝে মাঝে সাদা বক ছাড়া আমার চোখে আর কোনও পাখি পড়ল না।
আশ্রমের গেটের সামনে দু ধারে খলপা আর চটের ছাউনি দেওয়া কয়েকটা দোকান। ভিড় গিজগিজ করছে। এক্কা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কর্নেল এগিয়ে গেলেন।
জুতো পরে আশ্রমে ঢোকা যাবে না। কর্নেল গেটের প্রহরী একজন ভক্তকে জিজ্ঞেস করলেন, আশ্রমের স্কুল খোথায়?
সে বলল, ডানদিকে ঘুরে চলে যান।
আশ্রমের পাঁচিল নিচু। কিন্তু পেরে কাঁটাতারের বেড়া। ঘন গাছপালা দেখা যাচ্ছিল ভেতরে। মন্দির, নাটমন্দির, সারবন্দি কুটির এবং মাইকে সংকীর্তন। স্কুলের গেটটা ছোট। ভেতরে ফুলবাগিচা ঝলমল করছে। এদিকটা মোটামুটি শান্ত এবং নিরিবিলি। মাইকের আওয়াজ এদিকে না পৌঁছানোর কারণ দোতলা একটা লম্বা বাড়ি। বাড়িটার চেহারা দেখে বোঝা যায় খুব পুরনো। সম্ভবত কোনও বড়লোক বা জমিদারের বাড়ি। আশ্রমকে দান করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে : কর্মশালা।
প্রাঙ্গণে একদল ছাত্রী বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে কসরত করছে। একজন শিক্ষিকা সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমরা অফিসঘরে ঢুকলাম। নীল পাড়ে সাদা শাড়ি পরা তিনজন মহিলা একসঙ্গে মুখ তুললেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমরা করুণাময়ী দেবীর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
একজন মহিলা বললেন, হেডমিস্ট্রেস তো অসুস্থ। স্কুলে আসেননি কাল থেকে।
আমরা কলকাতা থেকে আসছি। যদি ওঁর কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দেন, বাধিত হব।
উনি কি দেখা করবেন? ভীষণ অসুস্থ।
কর্নেল পকেট থেকে কার্ড বের করে বললেন, এই কার্ডটা ওঁকে দিলে আশা করি উনি দেখা করবেন।
লক্ষ্য করলাম, কর্নেলের এই কার্ডটা অন্য কার্ড। সাধারণ কার্ডে নামের নিচে শুধু লেখা থাকে নেচারিস্ট। এই কার্ডের নামের নিচে লেখা আছে, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।
মহিলা কার্ডটি দেখে বললেন, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার মানে?
মানে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না প্লিজ! করুণাময়ী দেবী ঠিকই বুঝবেন।
মহিলা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, চলুন।
স্কুলবাড়ির পেছনে গাছপালার ভেতর সারবন্দি একতলা ঘর দেখা যাচ্ছিল। তার উল্টোদিকে একটা আলাদা একতলা বাড়ি। বাড়ির পাশেই একটা ছোট মন্দির। এক টুকরো ফুলবাগান। বাড়িটার বারান্দায় তেমনি নীলপাড়ের সাদা শাড়িপরা এক তরুণী দাঁড়িয়েছিল। সে আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আমাদের সঙ্গিনী মহিলা বললেন, শুভা! মাসিমা কেমন আছেন রে? এঁরা কলকাতা থেকে মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
শুভা আস্তে বলল, মাসিমা শুয়ে আছেন।
মহিলা পর্দা তুলে সামনেকার ঘরে ঢুকে গেলেন। শুভা কর্নেলকে দেখছিল। কর্নেল মিষ্টি হেসে বললেন, আপনি টিচার?
শুভা মাথা দোলাল। আমি নার্স।
আশ্রমে হাসপাতাল আছে বুঝি?
হ্যাঁ।
এইসময় সেই মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, ভেতরে যান আপনারা। শুভা! আমি যাই রে! তুই তো আছিস।
ভেতরে ঢুকে দেখি, সাদামাঠা বিছানায় প্রৌঢ়া এক মহিলা বসে আছেন। পরনে সাদা থান। চেহারায় রুক্ষ ভাব। চশমার ভেতর চোখদুটি তীক্ষ্ণ। রোগাটে গড়ন। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। কার্ডটা ওঁর হাতের মুঠায় ধরা। বললেন, বসুন।
ঘরে আসন বলতে একটা মোড়া এবং একটা চৌকো টুল। দুটোই অবশ্য গদি আঁটা। সম্ভবত এই আশ্রমেরই তৈরি। কর্নেল মোড়ায় বসে বসলেন, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
আপনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি কী ইনভেস্টিগেট করেছেন?
আপনার ছেলে সুদর্শনের মৃত্যু সম্পর্কে।
খোকা সুইসাইড করেছে। আমাকে ওর দুঃখের কথা বলতে এসেছিল। আমি ওকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি।
সুইসাইডের খবর আপনাকে ভবতারণ দিয়ে গেছে। তাই না?
হ্যাঁ। সে কাল এসেছিল। রাত্রে আশ্রমে থেকে সকালে ফিরে গেছে। আমার সঙ্গে দেখা করে যায়নি। তবে ভবতারণ খোকার বউ সেজে থাকা মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে, এটুকুই যা সান্ত্বনা। ওই মেয়েটাই খোকার আত্মহত্যার জন্য দায়ী। খোকা আমাকে বলেছিল। কিন্তু আমি কী করতে পারি? যা-ও বা পারতাম, সময় পেলাম না। খোকা বরাবর হঠকারী স্বভাবের ছেলে ছিল।
আপনি সদানন্দবাবুর উইলের কথা জানেন?
গুরুজির কাছে শুনেছি।
প্রপার্টি আপনাদের আশ্রম পাবে। তাই না?
করুণাময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গুরুজিকে বলে রেখেছি, ওই পাপের সম্পত্তি যেন না নেন।
কর্নেল হাসলেন। বললেন, পাপের সম্পত্তি পুণ্যের কাজে লাগানো উচিত।
না। আমি গুরুজিকে বলেছি, উনি ওই সম্পত্তি নিলে আমি আশ্রম ছেড়ে চলে যাব।
গুরুজি কী বলেছেন?
আমাকে ভেবে দেখতে দুদিন সময় দিয়েছেন। কিন্তু আমার এক কথা।
কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, ক্ষমা করবেন। একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।
করুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি।
সদানন্দবাবুর সঙ্গে আপনার লিগ্যালি ডিভোর্স হয়েছিল কি?
আমরা কোর্টে যাইনি। গুরুজির আদেশে আমাদের সেপারেশন হয়েছিল। করুণাময়ী ঠোঁটের কোনা কামড়ে ধরে যেন আত্মসম্বরণ করলেন। তারপর বললেন, খোকার মৃত্যু সম্পর্কে আপনি তদন্ত করছেন কেন? কে আপনাকে তদন্তের ভার দিয়েছে? ওই বজ্জাত মেয়েটা?
না। আমার ব্যক্তিগত কিছু হবি আছে। আসলে আমি একজন রহস্যভেদী।
করুণাময়ী আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকালেন। খোকার মৃত্যুতে কি কোনও রহস্য আছে?
আছে। তাকে কেউ মার্ডার করেছে।
কী বললেন?
মার্ডার। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা। আপনার ছেলের মানসিক অসুখ ছিল। সে আত্মহত্যার কথা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল। এমনকি একটা সুইসাইডাল নোটও লিখেছিল। কিন্তু ওটা তার অবচেতন অভিমানেরই প্রকাশ মাত্র। সুইসাইড সে শেষ পর্যন্ত হয়তো করত না। আমি হয়তো বলছি। কারণ সে ঠিক করেনি কখন আত্মহত্যা করবে। আমার ধারণা, সে এইভাবে তার স্ত্রী গোপার মনোযোগ দাবি করেছিল এই মাত্র। গোপা–শুধু গোপা তাকে সুস্থ করে তুলতে পারত। কিন্তু গোপা তা করেনি। কেন করেনি, এখনও আমি জানি না। তবে কেউ এই সুযোগটা নিয়েছে। সুইসাইডাল নোট চুরি করেছে। তারপর তার কাপে পটাসিয়াম সায়নায়েডের বডি রেখে দিয়েছে। ভোরে কফি খাওয়ার অভ্যাস ছিল সুদর্শনের। খুনী তা জানত। গ্যাসওভেনের কাছে একটা কাপে বড়িটা ছিল। জায়গাটা আমি দেখেছি। সেখানে সরাসরি আলো পড়ে না। সাদা কাপের তলায় সাদা বড়ি! চিন্তা করুন! অভ্যাসমতো সুদর্শন তাতে কফি ঢেলেছে এবং কফিতে চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়েছে। খুনী তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে এবং টেবিলে সুইসাইডাল নোটটা পেপারওয়েট চাপিয়ে রেখে দিয়েছে। গ্যাসের ওভেনের তলা থেকে ভাঙা কাপের টুকরোও কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের টেবিলের নিচে ফেলেছে।
দুহাতে মুখ ঢাকলেন করুণাময়ী। শরীর কেঁপে উঠল।
প্লিজ মিসেস সান্যাল, একটু শান্ত হোন।
করুণাময়ীর চোখে জল। রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বললেন, আমি মিসেস সান্যাল নই।
আইনের চোখে আপনি এখনও মিসেস সান্যাল! প্লিজ ফেস দা রিয়্যালিটি।
করুণাময়ী একটু পরে আস্তে আস্তে বললেন, কে খুন করল খোকাকে? কেন খুন করল?
আপনার কী ধারণা আমি জানতে চাই। তাছাড়া আপনার সাহায্যও পেতে চাই।
আপনি পটাসিয়াম সায়নায়েড বললেন। তাই না?
হ্যাঁ। পটাসিয়াম সায়নায়েড।
করুণাময়ী খুব চাপা স্বরে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কলকাতা যাব।
বেশ তো!
করুণাময়ী ফিসফিস করে বললেন, আপনারা গিয়ে মেইন গেটের বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি যাচ্ছি।…