৮. অবনী ঘোষালের স্নান-খাওয়া নেই

দু’ দিন হল অবনী ঘোষালের স্নান-খাওয়া নেই। না না, কথাটা ভুল হল। স্নান আছে, খাওয়া নেই। দুশ্চিন্তায় এবং দুর্ভাবনায় মাথাটা মাঝে-মাঝেই বড্ড গরম হয়ে যাচ্ছে বলে এই শরতের শুরুতে অষ্টপুরে একটু একটু ঠান্ডা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অবনী দিনে পাঁচ থেকে সাতবার ঠান্ডা জলে স্নান করছে। কিন্তু খেতে বসলেই মনে হয়, তার পাকস্থলীতে হরতাল চলছে, কণ্ঠনালীতে চলছে পথ অবরোধ। তেলালো মাছের কালিয়া, মুরগির মোগলাই, মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল, মুড়িঘন্ট, বিরিয়ানি বা পায়েস সব গলা পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসছে। তাঁর অরুচি দেখে শাশুড়ি আর্তনাদ করছেন, শ্বশুর দুশ্চিন্তায় ছাদে পায়চারি করছেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে কোষ্ঠ পরিষ্কারের ওষুধ গেলাচ্ছে। কিন্তু অবনীই একমাত্র জানে তার অরুচি কেন। কিন্তু কারণটা কাউকে লজ্জায় বলতেও পারছে না সে। নতুন জামাইকে যদি সবাই ভিতু ভাবে, তা হলে বড় লজ্জার কথা। এই তো মাত্র তিনদিন আগে সে অত বড় একটা বীরত্বের কাজ করেছে। সুখ্যাতিও হয়েছে মেলাই। সেই বেলুনটা চুপসে গেলে সে কি আর কোনওদিন শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে মুখ দেখাতে পারবে?

কিন্তু প্রাণের মায়া বড় মায়া। কদিন আগেও অষ্টপুরকে তার বড় ভাল লাগত। এখন মনে হচ্ছে, অষ্টপুরই যত নষ্টের গোড়া। নিতান্ত আহাম্মক ছাড়া অষ্টপুরে কেউ মরতে বিয়ে করতে আসে? বরং কেষ্টপুরে বিয়ে করলেই ভাল হত। অবনী রাতে চোখ বুজলেই দেখতে পায়, অষ্টপুরের গুন্ডা-বদমাশরা তাকে ঘিরে ধরে ডান্ডাপেটা করছে, রড দিয়ে হাত-পা ভাঙছে, চপার দিয়ে কোপাচ্ছে, দা দিয়ে টুকরো টুকরো করছে। সে আরও দেখতে পায়, তার বউ সজল চোখে তাকে বিদায় জানাচ্ছে আর বলছে ‘যেতে নাহি দিব’, তারপর অষ্টপুর শ্মশানে…ওঃ, আর ভাবতে পারে না অবনী। মাথা ঠান্ডা করতে মাঝরাতে উঠেও চান করতে হয় তাকে।

নিশুত রাতে জেগেই ছিল অবনী। দু দিন হল, ঘুমের সঙ্গে তার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। শুনশান মধ্যরাতে উঠে বসে তার মনে হল, অষ্টপুরের গুন্ডা-বদমাশদেরও কি আর রাতের ঘুম বা বিশ্রাম বলে কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। সুতরাং এই সময়ে যদি কালো পোশাকে, মুখে একটা কিছু ঢাকা-চাপা দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে, তা হলে কেমন হয়? রিস্ক হয়তো একটু আছে, কিন্তু ওখানে বসে থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনার চেয়ে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নেওয়াই উচিত।

অবনী সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না। মালপত্র আছে থাক। সকালে উঠে তাকে খুঁজে না পেলে শ্বশুরবাড়ির লোক এবং তার বউ দুশ্চিন্তা করবে সন্দেহ নেই। হয়তো ভাববে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছে, হয়তো ভাববে অপহরণ। কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তার। প্রাণ আগে, না লৌকিকতা আগে?

কালো না হলেও কালচে রঙের প্যান্ট-শার্ট পরে নিল অবনী। একটা মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। তারপর চুপিসারে দোতলা থেকে নেমে কম্পিত বক্ষে ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করতে করতে বেরিয়ে পড়ল। বারান্দায় শ্বশুরমশাইয়ের কয়েক গাছা লাঠি একটা স্ট্যান্ডে রাখা ছিল। তা থেকে একটা বেশ মজবুত লাঠিও সঙ্গে নিল সে। বিপদে পড়লে খানিকটা কাজে দেবে।

বাইরে নিকষ্যি অন্ধকার। অবনী নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

.

অন্ধকার হলেও রাস্তার একটা আন্দাজ আছে অবনীর। বাঁ হাতে খানিক হেঁটে ডান ধারে মোড় ফিরে গির্জা পর্যন্ত গেলেই বাঁ ধারে নীলকুঠির জঙ্গল। ফস্টারসাহেবের বাড়ির ধার ঘেঁষেই গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার রাস্তা। নিরিবিলি আছে, তোকজনের যাতায়াত বিশেষ নেই ওদিকে। মাইল দুই পথ মেরে দিলেই কুঁকড়োহাটি। তারপর আর পায় কে অবনীকে! বগল বাজিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে সে। এই পথটুকুই যা দুশ্চিন্তার।

অন্ধকার বলে পা চালিয়ে চলবার উপায় নেই। মোড় বরাবর যেতেই অনেকটা সময় গেল। তারপরও ঘাপটি মেরে থাকতে হল কিছুক্ষণ। রাতপাহারায় চৌকিদাররা হুইসল বাজিয়ে ডান ধার থেকে বাঁ ধারে গেল। রাস্তা ফাঁকা বুঝে সাবধানে মোড় পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরল অবনী।

ভারী বিনয়ী গলায় পাশ থেকেই কে যেন বলে উঠল, “জামাইবাবু কি মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন নাকি?”

মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা সাপ নেমে গেল অবনীর। হাত-পা ঠান্ডা। শরীর কাঠ। তোতলাতে তোতলাতে কোনওক্রমে বলল, “না, এই একটু…”

“বড় হুটোপাটি করে বেরিয়ে পড়েছেন মশাই, এই তো থানার ঘড়িতে মোটে রাত দুটো বাজল। এই সময়ে সব চোর ছ্যাচড়রা বেরোয়। এই তো দেখে এলুম, গড়ান সাধুখাঁ পালপাড়ার গৌরহরিবাবুর ঘরের গ্রিল কাটছে। পবন সাউ চৌপথীর কাছে পাইপ বেয়ে গিরিধারীবাবুর দোতলায় উঠছে। বিপিন দাসকে তো দেখলুম সুখেন গোসাঁইয়ের বাড়ি থেকে এককাড়ি বাসনকোসন আর একগাদা জামাকাপড় নিয়ে পিছনের জানলা গলে বেরিয়ে এল। নিতাই মোদক বাজারের মহাজনের গুদোমে এই বড় সিঁদ কেটে ফেলেছে।”

গলাটা চিনতে পেরে একটু ধাতস্থ হল অবনী। ভয়ের তেমন কিছু নেই, এ হল ঘণ্টাপাগলা। একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে সে বলল, “তা তুমি ঘুমোওনি?”

ঘণ্টা অবাক হয়ে বলে, “আমি ঘুমোব কী মশাই, আমার কি ঘুমোলে চলে? এই গোটা অষ্টপুর তা হলে দেখাশোনা করবে কে? আমি ছাড়া আর কার গরজ আছে বলুন। সব কিছু তো আমাকেই দেখেশুনে রাখতে হয়!”

“তা অবশ্য বটে।”

“এই গোটা অষ্টপুরের সব খবর আমার নখদর্পণে। কোন গাছের ক’টা পাতা খসল, ক’টা গজাল, নন্দবাবুর গোরুটা যে বাছুর বিয়াল, সেটা এঁড়ে না বকনা, শচীপিসির বাঁ হাঁটুতে বাত না ডান হাঁটুতে, পোস্ত খেলে যে পাঁচকড়ির পেটে ব্যথা হয়, এসব খবর আর কে দেবে আপনাকে বলুন তো!”

“তাই তো হে! এসব গুরুতর খবর তো আমার জানা ছিল না।”

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘণ্টা বলল, “তবু অবিচারটা দেখুন, অষ্টপুরে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু আমিই টের পেলুম না।”

“কী ঘটনা বল তো!”

“প্রাণপতি দারোগার জায়গায় যে নতুন দারোগা এসেছে জামাইবাবু।”

“তাই নাকি?”

“কেমন নরমসরম ভোলাভালা দারোগাটা ছিল আমাদের। তার বদলে এসেছে এক বদরাগী, মারমুখো দারোগা। কটমট করে তাকায়, দাঁত কড়মড় করে কথা কয়, গাঁক গাঁক করে চেঁচায়।”

“তা হলে তো ভয়ের কথা!”

“আজ্ঞে, খুবই ভয়ের কথা। তবে কিনা অষ্টপুরে ভয়-ভীতির অনেক জিনিস আছে। কিন্তু ভয় পেলে কি আমার চলে বলুন! তা হলে অষ্টপুরের দেখাশুনো করতে পারতুম কি?”

“সে তো ঠিকই।”

“তা জামাইবাবু, একটা কথা বলব?”

“বলে ফ্যালো।”

“আপনি কেন লাঠি হাতে নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়েছেন, তা কিন্তু আমি জানি।”

অবনী একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “কী বলো তো!”

“আপনি চোর-ডাকাত ধরতে বেরিয়েছেন, তাই না? অষ্টপুরের সবাই বলে, আচার্যিবাবুর ছোট জামাইটা খুব বাহাদুর আছে।”

অবনী আঁতকে উঠে বলে, “ওরে বাবা! না হে বাপু, আমি মোটেই চোর-ডাকাত ধরতে বেরোইনি। ও কথা শোনাও পাপ। আমি বাপু, একটু হাওয়া খেতেই বেরিয়েছি।”

“আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল। আমারও ভয়ডর নেই কিনা।”

“না হে বাপু ঘণ্টা, আমার মোটেই তোমার মতো সাহস নেই।”

“কী যে বলেন জামাইবাবু, সবাই জানে আপনি অষ্টপুরের সব গুন্ডা-বদমাশদের একদিন ঠান্ডা করে দেবেন।”

“ওরে বাপ রে, ও কথা বলতে নেই হে ঘণ্টা। অষ্টপুর খুব ভাল জায়গা। এখানে মোটেই গুন্ডা-বদমাশ নেই। আমি বরং এগিয়ে যাই, একটু তাড়া আছে হে।”

ঘণ্টা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, আমি আপনাকে অষ্টপুরের সব কটা চোর-ডাকাত গুন্ডা আর বদমাশকে চিনিয়ে দেব।”

অবনী দু হাতে দু’ কান চাপা দিয়ে একরকম দৌড়তে লাগল। অষ্টপুরে আর তিলার্ধ থাকা চলবে না। সামনে বড়ই বিপদ। কী কুক্ষণে যে ঘণ্টার সঙ্গে দেখা হয়েছিল!

.

কোন কয়েদির না ছাড়া পেতে ভাল লাগে? বিশেষ করে ফাঁসির আসামির!

কিন্তু রাত বারোটার একটু আগে যখন প্রাণপতি, পলু পাকড়াশি ওরফে নবীন দাসের লকআপে গিয়ে উঁকি দিলেন, তখন নবীন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

প্রাণপতি গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর হে পল্টু?”

ছেলেটা তার দিকে চেয়ে কঁপা গলায় বলল, “বড়বাবু, আমাকে বাঁচান। পল্টু পাকড়াশি, চণ্ডী আর বগা তিনজন আমাকে খুন করতে এসেছে। একটু আগেই আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে এসে দেখে গিয়েছে আমায়।”

“পল্টু পাকড়াশি! সে তো তুমিই হে!”

“না বড়বাবু। আমি তো নকল পল্টু। আমি আসল পল্টুর কথা বলছি।”

“তুমি আসল নও?”

“আজ্ঞে, না বড়বাবু। আমি মাধবগঞ্জের নবীন দাস। সবাই জানে।”

“বগা আর চণ্ডী কে?”

“তারা নগেন পাকড়াশির লোক।”

“তারা তোমাকে মারতে চায় কেন?” মাথা নেড়ে নবীন বলে, “তা জানি না। পল্টুর চোখ দেখে আমি বড় ভয় পেয়েছি বড়বাবু। আমার বড় শীত করছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।”

প্রাণপতি গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুঁ, বুঝলাম। কিন্তু পল্টুর হাত থেকে বাঁচলেও ফাঁসির দড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

নবীন হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

“কাঁদলে কি বাঁচতে পারবে?”

গারদের চাবিটা খুলে প্রাণপতি বললেন, “উঠে এসো। তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”

কম্বল মুড়ি দিয়েই উঠে এল নবীন। তাকে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে প্রাণপতি বললেন, “ওই তিনজনের মধ্যে একজন কি খুব লম্বা, রোগাপানা, মাথায় টাক, চোখদুটো কটা আর গায়ে আলখাল্লার মতো পোশাক?”

নবীন অবাক হয়ে বলল, “না তো!”

“ভাল করে ভেবে বলো।”

“আজ্ঞে না। ওদের মধ্যে ওরকম তোক কেউ নেই।”

“এরকম চেহারার কোনও লোককে চেনো?”

নবীন একটু ভেবে বলল, “চিনি না। তবে সেদিন ওরকম চেহারার একজনকে গির্জা ঝাট দিতে দেখেছিলাম।”

“গির্জা!”

“হ্যাঁ। শীতলসাহেবের গির্জা।”

“ওই গির্জা বহুকাল ব্যবহার হয় না। পুরনো ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে বলে বন্ধ রয়েছে। বিপজ্জনক বাড়ি, যে-কোনওদিন ভেঙে পড়তে পারে। ওই গির্জায় কে ঝট দিতে আসবে!”

নবীন মাথা নেড়ে বলে, “আমি অতশত জানি না। গির্জার দরজাটা একটু ফাঁক করেছিলাম, তখন দেখি, ঠিক ওইরকম চেহারার একজন লোক খুব যত্ন করে ডান্ডি লাগানো বুরুশ দিয়ে ধুলো-ময়লা সাফ করছে।”

“খুবই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। এরকম ঘটার কথা নয়। ওই গির্জায় কেউ থাকে না। তবে পুরনো গির্জা ভেঙে আবার নতুন করে গির্জা তৈরির তোড়জোড় চলছে। তুমি ভুল দেখোনি তো!”

“কী জানি বড়বাবু, ভুলও দেখতে পারি। তখন ভয়ে, দুশ্চিন্তায় মাথার কি ঠিক ছিল?”

“মুশকিল হল, এই গাঁয়ের আরও দু’জন মানুষও লোকটাকে দেখেছে। লোকটা কে হতে পারে তাই ভাবছি। এখন তোমাকে যা বলছি, তা মন দিয়ে শোনো৷”

“আজ্ঞে, বলুন।”

“তোমাকে আজ রাত ঠিক বারোটায় আমি ছেড়ে দেব।”

“ছেড়ে দেবেন! বাপ রে! তা হলে যে ওরা আমাকে জানে মেরে দেবে বড়বাবু!”

.

হোঁচট খেয়ে গদাম করে একটা আছাড় খাওয়ার পর সংবিৎ ফিরে পেল অবনী। এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে অচেনা জায়গায় দৌড়নো তার ঠিক হয়নি। পড়ে গিয়ে হাঁটু জ্বালা করছে, হাতের তেলো ছড়ে গিয়েছে এবং মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। সে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে একটু কষ্ট করেই উঠে দাঁড়াল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিপজ্জনক অষ্টপুর ছেড়ে তার না পালালেই নয়। কিন্তু দৌড় দিতে গিয়ে এবং আছড়ে পড়ে তার মাথা গুলিয়ে গিয়েছে। কোন দিকে যাবে, তা বুঝতে পারছে না।

পিছনে কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কি? একটু কান পেতে শোনবার চেষ্টা করল অবনী। হা, পায়ের শব্দই বটে। একজন নয়, অন্তত তিন-চারজনের।

অবনীর আর দাঁড়ানোর সাহস হল না। সে ফের ছুটবার একটা মরিয়া চেষ্টা করল। এবং টের পেল সে একটা জংলা জায়গায় ঢুকে পড়েছে। জঙ্গল এক রকম মন্দ নয়। তাতে খানিক আড়াল হবে। কিন্তু জায়গাটায় খানাখন্দ আছে। দু’-তিনবার ছোট ছোট গর্তে পা পড়ে গেল।

একটু ঘন গাছপালার আবডাল পেয়ে দাঁড়াল অবনী। পিছনে যারা আসছিল, তারা আরও কাছে এসে পড়েছে। তাদের হাতে টর্চ জ্বলছে এবং নিভছে। কাছাকাছি আসবার পর অবনী দেখল, তিনটে লোক একজন লোককে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। দৃশ্যটা ভারী অস্বস্তিকর। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লোক তিনটের মতলব ভাল নয়।

সেটা আরও ভাল করে বোঝা গেল, টর্চের আলোয় একজনের হাতে একটা ছোরা ঝিকিয়ে উঠবার পর।

না, অষ্টপুর জায়গাটা সত্যিই যাচ্ছেতাই। ভদ্রলোকের বসবাসের যোগ্য নয়। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখাটা ঠিক হবে কি না সেটাই ভাবতে লাগল অবনী।

লোকগুলো মাত্র কয়েক হাত দূর দিয়ে ডানধারে চলে যাচ্ছিল। অবনী শুনতে পেল, কে যেন কাতর স্বরে বলছে, “আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমার তো ফাঁসিই হবে।”

জবাবে কে যেন বলল, “ফাঁসির আগে যে অনেক কথা ফাঁস হয়ে যাবে বাবা।”

টর্চের আলোয় ছেলেটার মুখটাও এক ঝলক দেখতে পেল অবনী। সর্বনাশ! এ তো সেই পল্টু পাকড়াশি! অবনীর বীরত্বে যে হাটুরে মার খেয়ে ধরা পড়েছিল! না! আর এক মুহূর্তও অষ্টপুরে নয়। জীবনে সে আর কোনও বীরত্বের কাজও করতে যাবে না। আর অষ্টপুরের গুন্ডারা যতদিন না তাকে ভুলে যায়, ততদিন অবনী অষ্টপুরে আসবেও না। গুন্ডাগুলো যেদিকে গেল, তার উলটোবাগে পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগল অবনী।

.

থানা থেকে বেরিয়ে নিজের গাঁয়েই ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিল ভুবন। কিন্তু পল্টু পাকড়াশি যে ধরা পড়েনি, এই চিন্তাটাও বড় উচাটন করছিল তাকে। আজকের দিনটা ভাল নয়। প্রাতঃকালেই মা মনসার জীবটাকে মারতে হল। কী হয় কে জানে।

উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে ভুবন একটা নিরিবিলি জায়গায় পুরনো শ্যাওলাধরা গির্জা দেখতে পেয়ে দাঁড়াল। জরাজীর্ণ অবস্থা বটে, কিন্তু নোংরা নয়। সে পায়ে-পায়ে গিয়ে সামনের ছোট্ট চাতালটায় বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।

মেজাজটা ভাল নেই ভুবনের। সকালে যে স্বপ্নটা দেখল, তারও মাথামুন্ডু বুঝতে পারেনি সে। স্বপ্নটগ্ন বড় একটা দেখে না ভুবন। সারাদিন খেতখামারে অসুরের মতো খেটেপিটে এসে এক থালা ভাত মেরে দিয়ে মোষের মতো ঘুমোয়। বহুদিন পর আজ স্বপ্ন দেখল। লম্বা একটা টেকো লোক কী সব ভাল ভাল কথা বলছিল যেন! কিন্তু ভাল কথা দিয়ে কি জীবন চলে! কিন্তু তার সন্দেহ হচ্ছে, স্বপ্নটার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কিছু যোগাযোগও থাকতে পারে। তবে বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। পল্টুর বদলে অন্য একটা লোককে ধরে আটকে রাখা হয়েছে কেন, তাও সে বুঝতে পারছে না। পল্টু কি তা হলে পালিয়েছে? ভুবন জানে, তার বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। সে একজন বোকা চাষা মাত্র। ভাবনাচিন্তা তার আসে না। সেই অনভ্যাসের কাজটা করতে গিয়ে তার মাথাটাই গুলিয়ে যাচ্ছে।

মিঠে হাওয়া দিচ্ছিল খুব। চারদিকে গাছগাছালির ঝিরিঝিরি ছায়া। শরীরেরও ধকল গিয়েছে মন্দ নয়। ভুবন ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখে, সামনে একটা লোক পঁড়িয়ে তাকে খুব ঠাহর করে দেখছে। মুখে দাড়িগোঁফ আছে, রোগাপানা, পরনে লুঙ্গি আর কামিজ। তাকে চোখ চাইতে দেখে বলল, “নতুন লোক দেখছি যে!”

ভুবন একটা হাই তুলে শুধু বলল, “হুঁ।”

“অষ্টপুর গাঁয়ে বাইরের মানুষের আনাগোনা বিশেষ নেই। গতকাল থেকে দেখছি, খুব বাইরের লোক এসে ঢুকে পড়েছে।”

ভুবন বলে “কেন, বাইরের লোক এলে কী হয়?”

লোকটা সিঁড়ির একটা ধাপে বসে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলে, “ভালটা কী হচ্ছে বলল! এই তো আজ সকালে দারোগাবাবুর মেয়েটা চুরি হয়ে গেল।”

ভুবন সটান হয়ে বসে বলল, “অ্যাঁ!”

“তবেই বোঝো, বাইরের লোকের আনাগোনা হচ্ছে কেন।”

“কে চুরি করল?”

“সে কি আর তার নাম, ধাম, ঠিকানা লিখে রেখে গিয়েছে বাপু?”

ভুবন খুব চিন্তিত মুখে বলল, “হুঁ।”

“তোমার কোথা থেকে আগমন হচ্ছে?”

“তা দূর আছে।”

“মতলব কী?”

“একজনের খোঁজ করতে আসা। তার নাম পল্টু পাকড়াশি।”

“ও বাবা! সে তো শাহেনশা লোক! দেখা পেলে?”

মাথা নেড়ে ভুবন বলে, “না। থানায় যে আটক আছে, সে পল্টু নয়। পল্টু কাছেপিঠে থাকলে পাপের গন্ধ পাওয়া যায়।”

“গন্ধটা কি পাচ্ছ?”

“মনে হয় পাচ্ছি।”

“তা হলে চলো, কাছেই আমার কুঁড়ে। পান্তা চলে তো?”

“পান্তা খেয়েই তো এত বড়টি হলুম।”

“তা হলে চলো।”

.

বিশু গায়েন নিজের চোখকে বিশ্বাস করবে কি না ভেবে পাচ্ছিল না। পাকা খবর পেয়েই এসেছে যে, পল্টু পাকড়াশি অষ্টপুর থানায় ধরা পড়ে আটক রয়েছে। সদর থেকে পুলিশ ফোর্স আসছে তাকে নিয়ে যেতে। তবু সন্দেহের শেষ রাখতে নেই বলে, সে অষ্টপুরে এসে তার খাতক মহাদেব সরকারের গদিতে উঠেছে।

সব শুনে মহাদেব বলল, “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার জামাইয়েরও খুনি ধরা পড়েছে, ফাঁসিতে সে ঝুলবেই। আমাদের চোখের সামনেই তো ঘটনাটা ঘটল। অবনী ঘোষালের মানিব্যাগ চুরি করে ধরা পড়ল, তারপর সে কী হাটুরে মার বাবা! মরেই যাওয়ার কথা। কিন্তু মরতে মরতেও জোর বেঁচে গিয়েছে।”

বিশু গায়েনের ধন্ধটা এখানেই। পল্টু পাকড়াশিকে সে ভালই চেনে। মানিব্যাগ চুরি করার মতো ছোটখাটো কাজ করার লোক সে নয়। দরকার পড়লে গলায় ছুরি দিয়ে ছিনতাই করবে, আর হাটুরে মার খাওয়ার আগে অন্তত আট-দশজনকে ঘায়েল না করে ছাড়বে না। তাই তার অঙ্কটা মিলছে না। মনটা খুঁতখুঁত করছে। সুতরাং মহাদেবের সঙ্গে সে একদিন থানার লকআপে আসামিকে দেখতে গিয়েছিল। আর দেখে তার চক্ষুস্থির! নবীন দাসকে সে ভালই চেনে। নবীনের বাবা মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের সঙ্গে তার একসময় দহরম-মহরম ছিল।

বেরিয়ে এসে সে মহাদেবকে বলল, “কথাটা ফস কোরো না, কিন্তু কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। এ ছেলেটা পল্টু পাকড়াশি নয়।”

“অ্য। তবে এ কে?”

“মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের ছেলে নবীন।”

“হ্যাঁ বটে, শুনেছি ছোঁড়া নাকি নিজের ওই নামটাই বলছে। কেউ অবশ্য বিশ্বাস করেনি।”

“পল্টুর সঙ্গে বেচারার খুব মিল আছে। তাই ভাবছি ব্যাপারটা কী!”

“তা ছোঁড়াটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।”

“সেপাইটা তো কথাই কইতে দিল না, দেখলে তো! বড়বাবুর নাকি নিষেধ আছে।”

“তা হলে কী করবে?”

“ক’টা দিন থাকতে হবে এখানে। কাণ্ডটা কী হয়, তা না দেখে যাচ্ছিই না।”

“সেই ভাল। চেপে বসে থাকো।”

আর গতকাল সকালেই কাণ্ডটা ঘটেছে। সাইকেলটায় পাম্প করাতে বটতলা ছাড়িয়ে মদনের সাইকেলের দোকানে গিয়েছিল বিশু। নিচু হয়ে যখন হাওয়া টাইট হয়েছে কি না দেখছিল, তখনই হঠাৎ নজর পড়ল, তিন জোড়া পা তার পিছন দিকে বাঁ থেকে ডাইনে যাচ্ছে। আড়চোখে তাকাতেই বিশু চমকে গেল। একজন নগেন পাকড়াশির পোষা গুন্ডা চণ্ডীচরণ, তার সঙ্গে ভাড়াটে খুনে বগা, আর তিন নম্বর লোকটা দাড়ি-গোঁফওয়ালা, চোখে রোদচশমা আর মাথায় টুপি থাকায় চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু ওই হাঁটার কায়দা আর ঘাড়ের উপর দিকে একটা কাটা দাগ দেখে পল্টুকে চিনতে তেমন অসুবিধেই হল না তার। অবিশ্বাস্য! নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবিকল সাপের মতোই একবার ফোঁস করল সে।