৮৯তম অধ্যায়
সমবেত কৌরবগণের অর্জ্জুন-আক্রমণ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় নভোমণ্ডল দেব, নাগ, অসুর, সিদ্ধ, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, রাক্ষস, অপ্সরা, গরুড়, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণে সমাকীর্ণ হইয়া অত্যন্ত শোভা ধারণ করিল। মানবগণ বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে আকাশপথ গীত, বাদ্য, স্তুতি, নৃত্য, হাস্য ও সুমধুর শব্দে পরিপূর্ণ দেখিয়া পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইল। তখন কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণ আহ্লাদিত হইয়া বাদিত্ৰশব্দ, শঙ্খনিঃস্বন ও সিংহনাদে ভূমণ্ডল ও দিঙ্মণ্ডল প্রধ্বিনিত করিয়া শত্রুপীড়ন করিতে লাগিল। বীরগণের শোণিতধারা অনবরত নিপতিত হওয়াতে সেই চতুরঙ্গিণী সেনা পরিবৃত, মৃতদেহপূর্ণ, শরশক্তি ঋষ্টিসঙ্কুল সমরাঙ্গন লোহিতবর্ণ হইয়া উঠিল। অনন্তর দেবাসুরযুদ্ধের ন্যায় কৌরব ও পাণ্ডবগণের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় ও কর্ণের সরল শরনিকরে উভয়পক্ষীয় সৈন্য ও সমুদয় দিগ্বিদিক্ সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তখন আর কাহারও কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। অন্যান্য বীরগণ ভয়াকুলিতচিত্তে মহারথ অর্জ্জুন ও কর্ণের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। তখন সেই মহাবীরদ্বয় অস্ত্রদ্বারা পরস্পরের অস্ত্র নিবারণ করিয়া কিরণজালবর্ষী অম্বরতলস্থ অন্ধকারাপহারী সমুদিত চন্দ্র-সূৰ্য্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর সেই বীরদ্বয় উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণকে পলায়ন করিতে নিষেধ করিলে তাহারা দেবতা ও অসুরগণ যেমন ইন্দ্রকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল, তদ্রূপ তাঁহাদিগের চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিতে লাগিল। ঐ সময় সমরাঙ্গনে ইতস্ততঃ মৃদঙ্গ, ভেরী, পণব ও আনকের নিঃস্বন এবং বীরগণের সিংহনাদ সমুত্থিত হইলে মহাবীর সূতপুত্র ও ধনঞ্জয় শব্দায়মান মেঘমণ্ডল পরিবৃত শশাঙ্ক ও সূর্য্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। সেই অরাতিনিপাতন অজেয় বীরদ্বয় শরাসন মণ্ডলাকার করিয়া অনবরত শর নিক্ষেপ করাতে তাঁহাদিগকে সচরাচর জগৎদহনে প্রবৃত্ত পরিবেষমধ্যস্থ ময়ুখ-পরিশোভিত প্রলয়কালীন সূৰ্য্যদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তখন তাঁহারা জিঘাংসাপরতন্ত্র হইয়া ইন্দ্র ও জম্ভাসুরের ন্যায় অশঙ্কিতচিত্তে পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং অনবরত মহাস্ত্রজাল বর্ষণ করিয়া পরস্পরকে নিপীড়িত ও উভয়পক্ষীয় অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গিণী সেনা সেই বীরদ্বয় কর্ত্তৃক পুনর্ব্বার নিপীড়িত হইয়া সিংহতাড়িত মৃগযূথের ন্যায় পলায়ন করিতে লাগিল।
“তখন দুৰ্য্যোধন, কৃতবর্ম্মা, শকুনি, কৃপ ও অশ্বত্থামা এই পাঁচ মহারথ শরীরবিদারণ শরনিকরে ধনঞ্জয় ও বাসুদেবকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন অরাতিশরে সমাহত হইয়া শরনিকরে তাঁহাদিগের শরাসন, তূণীর, ধ্বজ, অশ্ব, রথ ও সারথিকে এককালে ধ্বংস করিয়া দ্বাদশবাণে সূতপুত্রকে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর একশত রথী, একশত গজারোহী এবং অশ্বারোহী, শক, যবন ও কাম্বোজগণ অর্জ্জুনের বধাভিলাষে সত্বর তাঁহার প্রতি ধাবমান হইল। মহাবীর ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে সত্বর শরনিকর ও ক্ষুরদ্বারা সেই অশ্ব, হস্তী ও রথারোহী বীরগণের অস্ত্রশস্ত্র ও মস্তক ছেদন করিয়া তাঁহাদিগকে বাহনগণের সহিত ভূতলসাৎ করিলেন। তখন অন্তরীক্ষস্থিত দেবগণ অর্জ্জুনের পরাক্রম অবলোকন করিয়া সন্তুষ্টচিত্তে তূৰ্য্যনিঃস্বন, ধনঞ্জয়কে সাধুবাদপ্রদান ও তাঁহার মস্তকে সুগন্ধ পুস্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে সেই অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া সকল লোকেই বিস্ময়াপন্ন হইল, কিন্তু একমতাবলম্বী দুৰ্য্যোধন ও সূতপুত্ৰ কিছুমাত্র ব্যথিত বা বিস্মিত হইলেন না।
সন্ধির জন্য অশ্বত্থামার দুর্য্যোধন অনুরোধ
“অনন্তর দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দুর্য্যোধনের হস্ত ধারণপূর্ব্বক সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! এক্ষণে ক্ষান্ত হও; আর পাণ্ডবদিগের সহিত বিরোধে প্রয়োজন নাই। যুদ্ধে ধিক, এই সংগ্রামে আমার পিতা অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ ব্রহ্মসদৃশ দ্রোণাচাৰ্য্য ও ভীষ্মপ্রমুখ মহারথগণ নিহত হইয়াছেন। আমি ও আমার মাতুল কৃপাচার্য্য, আমরা উভয়ে অবধ্য, এই নিমিত্ত অদ্যাপি জীবিত আছি। অতএব এক্ষণে তুমি পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপনপূর্ব্বক পরমসুখে চিরকাল রাজ্যশাসন কর। আমি নিবারণ করিলে অর্জ্জুন সমরে ক্ষান্ত হইবে। জনার্দ্দনের বিরোধে বাসনা নাই; যুধিষ্ঠির নিয়ত প্রাণীগণের হিতসাধনে তৎপর; আর বৃকোদর এবং যমজ নকুল ও সহদেব ধর্ম্মরাজের বাধ্য; অতএব পাণ্ডবগণকে অনায়াসে শান্ত করা যাইবে। এক্ষণে তুমি ইচ্ছাপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করিলে প্রজাসকল ক্ষেমাবান্ হয়। অতএব তুমি সমরে ক্ষান্ত হও। হতাবশিষ্ট বান্ধবগণ স্ব স্ব গৃহে প্রতিগমন করুন এবং সৈনিকপুরুষেরাও যুদ্ধে নিবৃত্ত হউক। হে কুরুরাজ! যদি তুমি আমার বাক্যে কর্ণপাত না কর, তাহা হইলে নিশ্চয় বলিতেছি যে, তুমি এই যুদ্ধে নিহত হইবে। এক্ষণে তুমি এবং পৃথিবীস্থ অন্যান্য ব্যক্তিগণ তোমরা স্বচক্ষে দেখিলে যে, ইন্দ্র, যম, কুবের ও ভগবান্ বিধাতা যে কাৰ্য্যসম্পাদনে অসমর্থ হয়েন, অর্জ্জুন একাকী সেই কাৰ্য্য সাধন করিল। হে রাজন! ধনঞ্জয় এতাদৃশ গুণশালী হইয়াও কদাচ আমার বচন লঙ্ঘন করিবে না। সে সৰ্ব্বদা তোমার অনূগত হইয়া কালযাপন করিবে। অতএব তুমি প্রসন্ন হইয়া শান্তি অবলম্বন কর। তুমি আমাকে সম্মান করিয়া থাক এবং তোমার সহিত আমার অতিশয় সৌহার্দ্য আছে বলিয়া আমি এরূপ কহিতেছি। এক্ষণে তুমি ক্ষান্ত হইলে আমি সূতপুত্রকেও নিবারণ করিব। হে রাজন! বিচক্ষণ ব্যক্তিদিগের মতে বন্ধু চারি প্রকার;-সহজাত, সন্ধিজাত, ধনদ্বারা উপার্জ্জিত এবং উপবশতঃ স্বয়ং উপনীত। সহজাত অর্থাৎ স্বভাবসিদ্ধ বন্ধু; পাণ্ডবগণ তোমার স্বাভাবিক বন্ধু। এক্ষণে সন্ধিদ্বারা তাঁহাদিগের সহিত পুনরায় বন্ধুতা কর। সম্প্রতি তুমি প্রসন্ন হইয়া যদি পাণ্ডবগণের সহিত মিত্ৰতালাভে কৃতকার্য্য হও, তাহা হইলে তোমা হইতে জগতের বিলক্ষণ হিতসাধন হইবে।
সন্ধিসম্বন্ধে দুর্য্যোধনের দোষপ্রদর্শন
“হে মহারাজ! পরমাত্মীয় অশ্বত্থামা এইরূপ হিতকথা কহিলে আপনার পুত্র দুর্য্যোধন ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বিমনায়মান হইয়া কহিলেন, ‘সখে! আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সত্য বটে, কিন্তু আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। দুরাত্মা বৃকোদর শার্দুলের ন্যায় সহসা দুঃশাসনকে নিহত করিয়া আপনার সাক্ষাতেই যে সকল বাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, তাহা আমার হৃদয়ে গ্রথিত রহিয়াছে; অতএব এক্ষণে কিরূপে সন্ধিস্থাপন করিব; আর দেখুন, আমরা পাণ্ডবগণের সহিত বারংবার বৈরাচরণ করিয়াছি। তাহারা তৎসমুদয় স্মরণ করিয়া কখনই সহসা সন্ধিস্থাপনে সম্মত হইবে না। বিশেষতঃ এ সময় কর্ণকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। প্রচণ্ড বায়ু যেমন উন্নত মেরুপর্ব্বতকে ভগ্ন করিতে পারে না, তদ্রূপ মহাবীর অর্জ্জুনও কখনও কর্ণকে নিপাতিত করিতে সমর্থ হইবে না। হে গুরুপুত্র! আজ অর্জ্জুন সাতিশয় শ্রান্ত হইয়াছে, সূতপুত্র এখনই উহাকে বিনাশ করিবে।
“হে মহারাজ! আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন বিনয়পূর্ব্বক বারংবার আচাৰ্য্যতনয়কে এইরূপ কহিয়া স্বীয় সৈন্যগণকে কহিলেন, -‘বীরগণ! তোমরা কেন নিশ্চিন্ত রহিয়াছ? শীঘ্র বাণবর্ষণ করিয়া শত্ৰুদিগের প্রতি ধাবমান হও।’ ”