৮৮তম অধ্যায়
মাতৃদ্বয়সহ বভ্রুবাহন-আগমন—পাণ্ডব-প্রীতি
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর মহাত্মা বভ্রুবাহন পিতামহী কুন্তীর ভবনে প্রবেশ করিয়া বিনয়পূৰ্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিলে, তাঁহার জননী চিত্রাঙ্গদা ও বিমাতা উলুপী উভয়ে কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য কৌরবকামিনীগণের নিকট সমুপস্থিত হইয়া বিনীতভাবে তাঁহাদিগের সহিত সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন এবং দ্ৰৌপদী, সুভদ্রা ও যদুবীরদিগের বনিতাগণ তাঁহাদিগকে বিবিধ ধনরত্ন প্রদান করিলেন এবং মনস্বিনী কুন্তী অর্জ্জুনের প্রীতিসাধনার্থ তাঁহাদিগের যথোচিত সমাদর করিয়া তাঁহাদের নিমিত্ত অতি উৎকৃষ্ট শয্যা ও আসন নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন। যশস্বিনী চিত্রাঙ্গদা ও উলুপী এইরূপে শ্বশ্রূকর্ত্তৃক সমাদৃত হইয়া তাঁহার আজ্ঞানুসারে তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাত্মা বভ্রুবাহন পিতামহী কুন্তীর গৃহ হইতে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সমুপস্থিত হইয়া বিনীতভাবে তাঁহাকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক যুধিষ্ঠির ও ভীমসেন প্রভৃতি পাণ্ডবগণের নিকট গমন ও তাঁহাদিগকে প্রণিপাত করিলেন। তখন পাণ্ডবগণ স্নেহভাবে প্রীতমনে তাঁহাকে আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক যথেষ্ট সম্মান করিয়া প্রভূত অর্থ প্রদান করিতে লাগিলেন। তৎপরে মহাবীর বভ্রুবাহন প্রদ্যুম্নের ন্যায় বিনীতভাবে বাসুদেবের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলে, তিনি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে এক হেমখচিতদিব্যাশ্বযুক্ত উৎকৃষ্ট রথ প্রদান করিলেন।
ব্যাসের আগমন—যজ্ঞ-আরম্ভ
অনন্তর তৃতীয় দিবসে সত্যবতীপুত্র মহাত্মা বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! যাজকেরা কহিতেছেন, এক্ষণে যজ্ঞীয় মুহূর্ত্ত উপস্থিত হইয়াছে। অতএব আজ অবধি তুমি অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ কর। তোমার এই যজ্ঞের যেন কোনরূপ অঙ্গহানি না হয়। এই যজ্ঞ বহুসুবর্ণ যজ্ঞ বলিয়া বিখ্যাত হইবে। ব্রাহ্মণেরাই যজ্ঞের প্রধান কারণ। যজ্ঞশেষে ব্রাহ্মণগণকে তিন-গুণ দক্ষিণা প্রদান করা তোমার কর্ত্তব্য। তুমি ব্রাহ্মণদিগকে তিন-গুণ দক্ষিণা দান করিলে, তোমার তিন অশ্বমেধের ফললাভ ও জ্ঞাতিবধজনিত সমুদয় পাপ হইতে মুক্তিলাভ হইবে। অশ্বমেধযজ্ঞান্তে স্নান করিলে যারপরনাই পবিত্রতা লাভ করা যায়।”
মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিলে ধর্ম্মপরায়ণ ধৰ্ম্মরাজ তাঁহার উপদেশানুসারে ঐ দিনই দীক্ষিত হইলেন। অনন্তর যজ্ঞনিপুণ বেদবেত্তা ব্রাহ্মণগণ সেই সুসমৃদ্ধ অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ করিয়া বিধিপূৰ্ব্বক স্ব স্ব কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। কোন কাৰ্য্যই স্খলিত বা অননুষ্ঠিত হইল না। সকল কাৰ্য্যই যথাক্রমে সম্পাদিত হইতে লাগিল। যজ্ঞকাৰ্য্যনিযুক্ত বিপ্রগণ যথাবিধি বহ্নিস্থাপনপূর্ব্বক সোমলতা হইতে রস নিষ্কাশন করিয়া শাস্ত্রানুসারে আনুপূর্ব্বিক যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করিতে লাগিলেন। উঁহাদের মধ্যে কেহই অল্পজ্ঞান ছিলেন না। সদস্যেরা সকলেই ষড়ঙ্গবেত্তা, ব্রতপরায়ণ, চরিতব্রহ্মচর্য্য ও তর্কবিতর্ক-সুনিপুণ ছিলেন। এইরূপে সেই যজ্ঞ আরম্ভ হইলে মহাবীর ভীমসেন ধৰ্ম্মরাজের আজ্ঞানুসারে প্রতিদিন সেই ভোজনার্থীদিগকে অনবরত ভোজন করাইতে লাগিলেন। ঐ সময় ঐ যজ্ঞদর্শনার্থ যেসকল লোক সমাগত হইয়াছিল, তাঁহাদের মধ্যে কেহই কৃপণ, দরিদ্র, ক্ষুধিত, দুঃখিত বা প্রাকৃত [বালকের ন্যায় অল্পবুদ্ধি] বলিয়া লক্ষিত হয় নাই।
অনন্তর ঘূপ উচ্ছ্রিত করিবার সময় সমুপস্থিত হইলে যাজকগণকর্ত্তৃক যজ্ঞভূমিতে ছয়টি বিশ্বনিৰ্ম্মিত, ছয়টি খদিরনিৰ্ম্মিত, ছয়টি পলাশনিৰ্ম্মিত, দুইটি দেবদারুনিৰ্ম্মিত ও একটি শ্লেষ্মাতক[শ্লেষ্মাতক বৃক্ষনির্ম্মিত]-নির্ম্মিত ঘূপ সমুচ্ছ্রিত হইল। তখন ভীমসেন ধৰ্ম্মরাজের আজ্ঞানুসারে শোভার নিমিত্ত তথায় অসংখ্য কাঞ্চনময় যূপ সংস্থাপিত করিলেন। ঐ সমুদয় যূপ বস্ত্রাচ্ছাদিত হইয়া সপ্তর্ষিপরিবেষ্টিত ইন্দ্রাদি দেবগণের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তৎপরে যাজকেরা তথায় কাঞ্চনময় ইষ্টকদ্বারা এক অষ্টাদশ হস্ত পরিমিত, চারি স্তবকে সুসজ্জিত, ত্রিকোণযুক্ত, গরুড়াকার স্থণ্ডিল [যজ্ঞীয় মণ্ডপ] প্রস্তুত করিয়া সুবর্ণ দ্বারা উহার পক্ষদ্বয় নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক চয়নক্রিয়া সম্পাদন করিলেন। ওই চয়নকাৰ্য্য দক্ষ প্রজাপতির চয়নকার্য্যের ন্যায় সুসম্পন্ন হইল। তখন মনীষী ঋত্বিকগণ [ব্ৰতী পুরোহিতগণ] শাস্ত্রানুসারে নানা দেবতার উদ্দেশ্যে নানাবিধ পক্ষী, বৃষ ও জলচরসমুদয়কে সংস্থাপন করিয়া যূপ-সমুদয়ে তিন শত পশুর সহিত সেই অশ্বকে নিবদ্ধ করিলেন।
ঐ সময় ধর্ম্মরাজের সেই যজ্ঞভূমি দেবর্ষি, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা, কিম্পুরুষ, কিন্নর, সিদ্ধ ও ব্রাহ্মণগণে পরিপূর্ণ হইয়া পরম শোভা ধারণ করিয়াছিল। সৰ্ব্বশাস্ত্রপ্রণেতা ব্যাসশিষ্যগণ সভামণ্ডপে উপবিষ্ট হইয়া নানা শাস্ত্রের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং প্রতিদিন যজ্ঞকাৰ্য্যাবসানে নারদ, তুম্বুরু, বিশ্বাবসু, চিত্রসেন ও অন্যান্য গন্ধৰ্ব্বগণ নৃত্যগীতদ্বারা ব্রাহ্মণগণের চিত্তবিনোদন করিয়াছিলেন।