৮৪তম অধ্যায়
ভীমকর্ত্তৃক দুঃশাসনের রক্তপান
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর আপনার পুত্র দুঃশাসন সেই সমরাঙ্গনে নিদারুণ যুদ্ধ করিয়া একশরে ভীমসেনের শরাসন ছেদনপূর্ব্বক ষষ্টিশরে তাঁহার সারথিকে ও নয়শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহার উপর অসংখ্য উত্তম উত্তম সায়ক নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন অসামান্য পরাক্রমশালী মহাবীর বৃকোদর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দুঃশাসনের প্রতি এক সুতীক্ষ্ণ শক্তি প্রয়োগ করিলেন। আপনার পুত্র প্রজ্বলিত মহোল্কার ন্যায় ভীষণ শক্তি সহসা সমাগত হইতেছে দেখিয়া আকৰ্ণ-সমাকৃষ্ট দশশরে উহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই আহ্লাদিত হইয়া। তাঁহার সেই মহৎ কাৰ্য্যের প্রশংসা করিতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর ভীমসেন আপনার পুত্রের শরাঘাতে ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে বীর! তুমি ত’ আমাকে বিদ্ধ করিলে, এক্ষণে আমি গদা প্রহার করিতেছি, সহ্য কর।’ ভীমসেন এই বলিয়া ক্রোধভরে দুঃশাসনের বিনাশ বাসনায় সেই দারুণ গদা গ্রহণ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে দুরাত্মান্! আজ আমি রণস্থলে তোমার শোণিত পান করিব।’ মহাবীর দুঃশাসন ভীমকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সাক্ষাৎ মৃত্যুস্বরূপ এক ভীষণ শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিলেন। তখন ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া স্বীয় ভীষণ গদা পরিত্যাগ করিলেন। ভীমনিক্ষিপ্ত গদা দুঃশাসনের শক্তি ভগ্ন করিয়া তাঁহার মস্তকে নিপতিত হইয়া তাঁহাকে রথ হইতে দশ ধনু অন্তরে নিপাতিত এবং তাঁহার রথ, অশ্ব ও সারথিকে চূর্ণিত করিল। মহাবীর দুঃশাসন সেই বেগবতী গদার প্রহারে কম্পিতকলেবর ও বেদনায় নিতান্ত কাতর হইয়া ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ তদ্দর্শনে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন; বীরবর বৃকোদরও দুঃশাসনকে পাতিত করিয়া মহা আহ্লাদে দশদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া গৰ্জন করিতে লাগিলেন। পার্শ্ববর্তী লোকসকল তাঁহার সিংহনাদশব্দে মূর্চ্ছিত হইয়া রণস্থলে নিপতিত হইল। তখন অচিন্ত্যকর্ম্মা মহাবীর ভীমসেন রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া মহাবেগে দুঃশাসনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তৎকালে সেই বীরজনভূমিষ্ঠ ঘোরতর সংগ্রামস্থলে দুঃশাসনকে নিরীক্ষণ করিবামাত্র আপনার পুত্রগণ যে যে প্রকারে পাণ্ডবগণের সহিত শত্রুতা করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় এবং পতিপরায়ণা ঋতুবতী দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, বস্ত্রাপহরণ ও অন্যান্য দুঃখসকল বৃকোদরের স্মৃতিপথে সমুত্থিত হইল; পরে ক্রোধে হুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া তিনি কর্ণ, দুৰ্য্যোধন, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মাকে কহিলেন, ‘হে যোধগণ! আজ আমি পাপাত্মা দুঃশাসনকে যমালয়ে প্রেরণ করিব, তোমাদের সাধ্য থাকে ত’ উহাকে রক্ষা কর।’
“বলবান্ বৃকোদর এই বলিয়াই তৎক্ষণাৎ দুঃশাসনের বিনাশ বাসনায় ধাবমান হইয়া দুৰ্য্যোধন ও কর্ণের সমক্ষেই কেশরী যেমন মহামাতঙ্গকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক রথ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। অনন্তর তিনি সোৎসুকনয়নে [উৎসাহসমন্বিত নেত্রে] ক্ষণকাল দুঃশাসনকে নিরীক্ষণ করিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা সত্য করিবার মানসে শিতধার অসি সমুত্থিত করিয়া কম্পিত কলেবরে তাঁহাকে পদদ্বারা আক্রমণপূর্ব্বক বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া ঈষদুষ্ণ শশাণিত পান করিলেন এবং তাঁহাকে অবিলম্বে ভূতলে নিপাতিত করিয়া সেই খড়্গে তাহার মস্তক ছেদনপূর্ব্বক পুনরায় বারংবার ঈষদুষ্ণ রক্তপান করিয়া কহিলেন যে, ‘মাতৃস্তন্য, ঘৃত, মধু, সুরা, সুবাসিত উৎকৃষ্ট জল, দধি, দুগ্ধ, এবং উত্তম তক্র [ঘোল] প্রভৃতি যে সকল অমৃতরসতুল্য সুস্বাদু পানীয় আছে, আজ এই শত্রুশোণিত তৎসর্ব্বাপেক্ষা আমার সুস্বাদু বোধ হইল। ক্রুরকর্ম্মা ক্রোধাবিষ্ট ভীমসেন এই কথা বলিয়া দুঃশাসনকে গতাসু নিরীক্ষণপূর্ব্বক হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘রে দুঃশাসন! এক্ষণে মৃত্যু তোমাকে রক্ষা করিয়াছেন, আর আমি তোমার কিছুই করিতে পারিব না।’ হে মহারাজ! ঐ সময়ে যেসকল বীর শোণিতপায়ী হৃষ্টচিত্ত ভীমসেনকে অবলোকন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ ভয়ার্ত্ত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিলেন; কাহারও কাহারও হস্ত হইতে অস্ত্রসকল পরিভ্রষ্ট হইল এবং কেহ কেহ অস্ফুটস্বরে চীৎকার করিয়া সঙ্কুচিতনেত্রে চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। সৈন্যগণ ভীমসেনকে দুঃশাসনের রক্ত পান করিতে অবলোকন করিয়া ‘এ ব্যক্তি মনুষ্য নয়, অবশ্য রাক্ষস হইবে’, এই বলিতে বলিতে চিত্রসেনের সহিত ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল।
চিত্রসেনবধ–দুঃশাসন-প্রতি ভীমের আক্রোশ
“ঐ সময়ে নৃপতনয় যুধামন্যু সৈন্যসমভিব্যাহারে পলায়মান চিত্রসেনের অভিমুখে ধাবমান হইয়া নির্ভয়ে নিশিতসাতশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর চিত্রসেন যুধামন্যুর শরাঘাতে পাদস্পৃষ্ট লেলিহান ভীষণ ভুজঙ্গমের ন্যায় ক্রুদ্ধ ও প্রতিনিবৃত্ত হইয়া যুধামন্যুকে তিন ও তাঁহার সারথিকে সাতশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর যুধামন্যু ক্রুদ্ধ হইয়া আকর্ণপূর্ণ সুন্দর পুঙ্খযুক্ত সুশাণিত শরে চিত্রসেনের মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। চিত্রসেন নিহত হইলে মহাবীর কর্ণ স্বীয় পুরুষত্ব প্রদর্শনপূর্ব্বক পাণ্ডবসৈন্য বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর নকুল অবিলম্বে তাঁহার প্রত্যুদগমন করিলেন।
“এদিকে মহাবীর ভীমসেন রোষপরায়ণ হইয়া নিহত দুঃশাসনের রুধিরে অঞ্জলি পরিপূর্ণ করিয়া বীরগণের সমক্ষে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, ‘রে পুরুষাধম! এই আমি তোর কণ্ঠ হইতে রুধির পান করিতেছি, এক্ষণে পুনরায় হৃষ্টচিত্তে ‘গরু গরু’ বলিয়া উপহাস কর। সে সময়ে যাহারা আমাদিগকে ‘গরু গরু’ বলিয়া উপহাসপূর্ব্বক নৃত্য করিয়াছিল, এখন আমরা তাহাদিগকে ‘গরু গরু’ বলিয়া উপহাস করিয়া নৃত্য করিব। রে দুঃশাসন! আমরা দুৰ্য্যোধন, শকুনি ও সূতপুত্রের কুমন্ত্রণাতে যে প্রমাণকোটিনামক প্রাসাদে শয়ন, কালকূট ভোজন, কৃষ্ণসর্পের দংশন, দ্যূতে রাজ্যাপহরণ, দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, জতুগৃহে দাহ, অরণ্যে নিবাস, সংগ্রামে অস্ত্রাঘাত এবং স্বগৃহে ও বিরাটভবনে বিবিধ ক্লেশপরম্পরা সহ্য করিয়াছি, তুই সে সকলের মূল। আমরা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার পুত্রগণের দৌরাত্ম্যে চিরকাল দুঃখভোগ করিতেছি, কখন সুখের লেশমাত্র জানিতে পারি নাই।
“হে মহারাজ! রক্তাক্তকলেবর, লোহিতাস্য ক্রোধপরায়ণ বৃকোদর জয়লাভের পর এই সকল কথা বলিয়া হাস্য করিয়া কেশব ও অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক পুনরায় কহিলেন, ‘হে বীরদ্বয়। আমি দুঃশাসননিধনার্থ যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, আজ রণস্থলে তা সফল করিলাম; এক্ষণে অবিলম্বে এই সংগ্রামরূপ মহাযজ্ঞে দুৰ্য্যোধনরূপ দ্বিতীয় পশুকে সংহার করিব। আমি নিশ্চয়ই কৌরবগণের সমক্ষে গদাঘাতে ঐ দুরাত্মার মস্তক বিমর্দ্দনপূর্ব্বক উহাকে বিনাশ করিয়া শান্তিলাভ করিব।’ হে মহারাজ। রুধিরাক্তকলেবর মহাবীর বৃকোদর এই বলিয়া বৃত্রাসুরনিপাতন সুররাজ পুরন্দরের ন্যায় হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।”