৮২তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্রস্থান
বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর সেই যজ্ঞীয় অশ্ব সসাগরা পৃথিবী পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক হস্তিনাভিমুখে প্রত্যাগমন করিতে করিতে সহসা মগধপুরে সমুপস্থিত হইল। মহাবীর অর্জ্জুনও উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তথায় গমন করিলেন। তখন মগধাধিপতি সহদেবতনয় মেঘসন্ধি ঐ যজ্ঞীয় অশ্ব স্বীয় অধিকারমধ্যে সমাগত হইয়াছে শ্রবণ করিবামাত্র রথারোহণ ও সশরশাসন ধারণপূর্ব্বক পুর হইতে নির্গত হইয়া ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং অচিরাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া বালস্বভাবসুলভ চপলতানিবন্ধন ধনঞ্জয়কে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “পাণ্ডুনন্দন! তোমার এই যজ্ঞীয় অশ্বকে অবলাজনকর্ত্তৃক রক্ষিত বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। আমি আজ অবলীলাক্রমে ইহাকে অপহরণ করিব, তুমি ইহার মোচনবিষয়ে যত্নবান হও। আমার পূর্ব্বপুরুষগণ তোমার সহিত যুদ্ধ করেন নাই বটে, কিন্তু আমি আজ সমরাঙ্গনে তোমার উপর যথোচিত পরাক্রম প্রকাশ করিব। এক্ষণে আমি তোমাকে অস্ত্রপ্রহার করিতেছি, তুমি আমাকে অস্ত্রপ্রহার কর।”
বলদর্পিত মেঘসন্ধি এই কথা কহিলে মহাবীর অর্জ্জুন ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, “রাজন্! যাহারা আমার অশ্ব গ্রহণ করিবে, আমি তাহাদিগকে নিবারণ করিব, জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠির আমাকে এইরূপ নিয়ম নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছেন। বোধ হয়, উহা তোমারও অবিদিত নাই। এক্ষণে তুমি সাধ্যানুসারে আমার উপর অস্ত্র প্রহার কর; আমি তাহাতে কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ নহি।”
মহাবীর অর্জ্জুন এই কথা কহিলে, দেবরাজ ইন্দ্র যেমন বারিবর্ষণ করেন, তদ্রূপ মগধরাজ মেঘসন্ধি ধনঞ্জয়ের উপর সহস্র শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন অৰ্জ্জুনও গাণ্ডীব-নিক্ষিপ্ত শরনিকরে মগধরাজের সেই শরসমুদয় ছেদনপূৰ্ব্বক সদয়হৃদয়ে তাঁহাকে ও তাঁহার সারথিকে শরাঘাত না করিয়া তাঁহার ধ্বজ, পতাকা, রথ, যন্ত্র ও অশ্বের উপর প্রদীপ্তাস্যসম্পন্ন [জ্বলিত বদনযুক্ত—বিষজ্বালায় অগ্নিতুল্য মুখ] পন্নগের ন্যায় শরনিকর নিক্ষেপ করিলেন। এইরূপে ধনঞ্জয় অনুগ্রহ করিয়া মেঘসন্ধিকে কলেবরে রক্ষা করিলে, তিনি স্বীয় বাহুবলে উহা রক্ষিত হইল বিবেচনা করিয়া অর্জ্জুনের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। কপিকেতন [বানরধ্বজ অর্জ্জুন] তাঁহার শরনিকরে নিতান্ত আহত হইয়া বসন্তকালীন পুষ্পিত পলাশবৃক্ষের ন্যায় সুশোভিত হইলেন।
মহাবীর অর্জ্জুন এতাবৎকাল মেঘসন্ধিকে নিপীড়িত করিতে ইচ্ছা করেন নাই বলিয়াই সহদেবতনয় তাঁহার সম্মুখে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহার উপর অসংখ্য শরনিক্ষেপ করিলেও তিনি তাহাতে কিছুমাত্র ক্রূদ্ধ হয়েন নাই। কিন্তু এক্ষণে তিনি সেই বালককে বারংবার অত্যাচার করিতে দেখিয়া আর উহা সহ্য করিতে পারিলেন না। তখন তিনি রোষাবিষ্ট হইয়া শরাসন আকর্ষণপুৰ্ব্বক শরনিক্ষেপ করিয়া এককালে তাঁহার অশ্বগণের প্রাণসংহার, সারথির মস্তকচ্ছেদন, শরাসনকৰ্ত্তন এবং শরামুষ্টি ধ্বজ পতাকাসমুদয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
মগধরাজ মেঘসন্ধি এইরূপে অশ্ব, সারথি ও শাসনবিহীন হইয়া সুবর্ণময় গদা গ্রহণপূৰ্ব্বক মহাবেগে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহাকে গদাগ্রহণপূৰ্ব্বক আগমন করিতে দেখিয়া, অচিরাৎ সেই গদার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিলেন। গদা অর্জ্জুনের সেই ভীষণ শরাঘাতে খণ্ড খণ্ড হইয়া ভূজঙ্গিনীর ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। তখন ধীমান ধনঞ্জয় মগধপতিকে রথ, শরাসন ও গদাবিহীন দেখিয়া আর তাঁহাকে প্রহার করিতে সম্মত হইলেন না; প্রত্যুত তাঁহাকে নিতান্ত দুঃখিত দেখিয়া সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “তুমি বালক হইয়াও ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সমরাঙ্গনে যেরূপ কাৰ্য্য করিয়াছ, তোমার পক্ষে উহা যথেষ্ট হইয়াছে; অতএব এক্ষণে গৃহে প্ৰতিগমন কর। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাকে নরপতিদিগকে সংহার করিতে নিষেধ করিয়াছেন; এই নিমিত্তই তুমি অপরাধী হইলেও আমি তোমাকে বিনাশ করিলাম না।”
মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে, মগধপতি মেঘসন্ধি আপনাকে পরাজিত বিবেচনা করিয়া ধনঞ্জয়ের নিকট গমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহাত্মন্! আমি আপনার নিকট পরাজিত হইলাম; আর আমার যুদ্ধ করিবার বাসনা নাই। এক্ষণে আমাকে কোন কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে, হইবে, তাহা আদেশ করুন।” তখন অৰ্জ্জুন তাঁহাকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, “রাজন্! তুমি চৈত্রী-পূর্ণিমাতে নরপতি ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞস্থলে সমুপস্থিত হইবে।” মহাত্মা অর্জ্জুন এইরূপে মগধরাজকে নিমন্ত্রণ করিলে, তিনি তাঁহার বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহাকে ও তাঁহার সেই যজ্ঞীয় অশ্বকে যথাবিধি পূজা করিলেন। অনন্তর সেই অশ্ব পুনরায় সমুদ্রতীর দিয়া বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কোশলদেশ অতিক্রম করিতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয়ও স্বীয় গাণ্ডীবধনুপ্রভাবে বঙ্গাদিদেশীয় ম্লেচ্ছদিগকে ক্রমশঃ পরাস্ত করিতে লাগিলেন।