৮১তম অধ্যায়
উলুপীর মুখে অর্জ্জুনের পরাজয়কারণ-প্রকাশ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, তখন মহাবীর ধনঞ্জয় নাগকন্যা উলুপীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! তুমি কি নিমিত্ত এই সমরক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়াছ, আর বভ্রুবাহন-জননী চিত্রাঙ্গদাই বা কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন তাহা পরিজ্ঞাত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। তুমি কি আমার অথবা বৎস বভ্রুবাহনের মঙ্গলকামনায় এই স্থানে আগমন করিয়াছ? আমি বা আমার পুত্র বভ্রুবাহন আমরা কেহ ত’ অজ্ঞানবশতঃ তোমার কোন অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করি নাই? তোমার সপত্নী রাজপুত্রী চিত্রাঙ্গদা কি তোমার নিকট কোন অপরাধ করিয়াছেন?”
মহাত্মা ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে নাগেন্দ্রদুহিতা উলুপী হাস্যমুখে তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “নাথ! আপনি আমার নিকট কোন অপরাধেই অপরাধী নহেন এবং বৎস বভ্রুবাহন ও উহার জননী চিত্রাঙ্গদাও আমার নিকট কোন অপরাধ করেন নাই। প্রিয়সখী চিত্রাঙ্গদা সর্ব্বদা আমার আজ্ঞানুবর্ত্তিনী হইয়া থাকেন। এক্ষণে আমি প্রণিপাতপূৰ্ব্বক আপনার নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি যে, আমার পরামর্শানুসারে বভ্রুবাহন আপনার সহিত যুদ্ধ করিয়া আপনাকে পরাজিত করিয়াছিল বলিয়া আপনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হইবেন না। আমি আপনার হিতসাধনার্থই বভ্রুবাহনকে সমরে প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলাম। আপনি ভারতযুদ্ধে অধৰ্ম্মপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক মহাত্মা ভীষ্মকে নিপীড়িত করিয়া যে পাপসঞ্চয় করিয়াছিলেন, এক্ষণে বভ্রুবাহনের হস্তে পরাজিত হওয়াতে আপনার সেই পাপ হইতে নিষ্কৃতিলাভ হইল। আপনি শিখণ্ডীর সহিত সমবেত হইয়া মহাত্মা শান্তনুতনয়কে সংহারপুৰ্ব্বক মহাপাপে লিপ্ত হইয়াছিলেন; যদি ঐ পাপের শান্তি না হইতে হইতেই আপনার প্রাণবিয়োগ হইত, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই নিরয়গামী হইতেন। এক্ষণে আপনি পুত্রের নিকট পরাজিত হওয়াতে আপনার সেই পাপ বিনষ্ট হইল। অতঃপর আর আপনাকে নরকগামী হইতে হইবে না। পুৰ্ব্বে ভগবতী ভাগীরথী ও বসুগণ আপনার পাপশান্তির এই উপায় নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছেন।
“শান্তনুতনয় মহাত্মা ভীষ্ম সংগ্রামশায়ী হইলে সমুদয় দেবতা ও বসুগণ গঙ্গাতীরে গমন ও স্নান করিয়া ভাগীরথীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবি! মহাত্মা ভীষ্ম যুদ্ধে বিরত হইলে সব্যসাচী অর্জ্জুন অন্য ব্যক্তিকে সহায় করিয়া তাঁহাকে নিহত করিয়াছে। অতএব আপনি আজ্ঞা করুন, আজ আমরা উহাকে শাপ প্রদান করি।’ বসুগণ এই কথা কহিলে ভাগীরথী তৎক্ষণাৎ তথাস্তু বলিয়া তাঁহাদের বাক্যে অনুমোদন করিলেন। ঐ সময়ে আমিও তথায় উপস্থিত ছিলাম; বসুগণ আপনাকে শাপ প্রদান করিতেছেন, দেখিয়া ব্যথিতচিত্তে পিতৃভবনে প্রবেশপুৰ্ব্বক পিতার নিকট ঐ বৃত্তান্ত নিবেদন করিলাম। পিতা আমার মুখে ঐ সংবাদ শ্রবণমাত্র নিতান্ত বিষণ্ন হইয়া বসুদিগের নিকট গমনপূর্ব্বক বারংবার আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। তখন বসুগণ ভাগীরথীর অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক আমার পিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘নাগরাজ! অর্জ্জুনের পুত্র মণিপুরাধিপতি বভ্রুবাহন উহাকে সংগ্রামস্থলে শরনিকরে নিপাতিত করিলেই তাঁহার শাপ হইতে মুক্তিলাভ হইবে। এক্ষণে তুমি স্বস্থানে প্রস্থান কর।’
“বসুগণ এই কথা কহিলে আমার পিতা তাঁহাদিগের এই বাক্য-শ্রবণে প্রীত হইয়া স্বীয় ভবনে আগমনপূৰ্ব্বক আমার নিকট উহা ব্যক্ত করিলেন। আমি সেই নিমিত্তই এক্ষণে বভ্রুবাহনকে আপনার সহিত যুদ্ধ করিতে অনুরোধ করিয়া আপনাকে শাপ হইতে বিমুক্ত করিলাম। বোধ হয়, এ বিষয়ে আমার কিছুমাত্র অপরাধ নাই। আপনি ঐ পাপ হইতে বিমুক্ত না হইলে নিশ্চয় আপনাকে নরকভোগ করিতে হইত। এক্ষণে আপনি বভ্রুবাহনের নিকট পরাজিত হইয়াছেন বলিয়া কিছুমাত্র লজ্জিত হইবেন না। দেবরাজ ইন্দ্রও আপনাকে সংগ্রামে পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। পুত্র আত্মস্বরূপ, এই নিমিত্ত আপনি পুত্রের নিকট পরাজিত হইলেন।”
পত্নী-পুত্রের সম্ভাষণান্তে অর্জ্জুনের প্রস্থান
নাগনন্দিনী উলুপী এই কথা কহিলে মহাত্মা ধনঞ্জয় প্রীতমনে তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “প্রিয়ে! তুমি এইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া আমার মহোপকার করিয়াছ।” এই বলিয়া তিনি উলুপী ও চিত্রাঙ্গদার সমক্ষে মণিপুরাধিপতি বভ্রুবাহনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! মহাত্মা যুধিষ্ঠির আগামী চৈত্র পুর্ণিমাতে অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ করিবেন। ঐ দিবস তুমি তোমার মাতা চিত্রাঙ্গদা ও বিমাতা উলুপীকে লইয়া অমাত্যগণ সমভিব্যাহারে হস্তিনায় গমন করিও।”
তখন মহাত্মা বভ্রুবাহন অশ্রুপূর্ণনয়নে অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “পিতঃ! আমি আপনার আজ্ঞানুসারে অশ্বমেধযজ্ঞে উপস্থিত হইয়া দ্বিজাতিগণের পরিবেশনকার্য্যে নিযুক্ত হইব। এক্ষণে আপনি অনুগ্রহপূৰ্ব্বক আমার মাতা ও বিমাতার সহিত আপনার এই মণিপুরের ভবনে প্রবেশপূৰ্ব্বক আজিকার রাত্রি অতিবাহিত করুন। কল্য প্রাতে অশ্বের অনুসরণ করিবেন।”
মহাত্মা বভ্রুবাহন এই কথা কহিলে, মহাবীর অর্জ্জুন হাস্যমুখে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! আমাকে যেরূপ নিয়ম পালন করিতে হইতেছে, তাহা তোমার অবিদিত নাই। আমার এই যজ্ঞীয় অশ্ব-ইচ্ছানুসারে নানা স্থানে বিচরণ করিতেছে। এ যে স্থলে গমন করিবে, আমাকে সেই স্থানেই গমন করিতে হইবে; সুতরাং আজ আমি কোনক্রমেই তোমার পুরমধ্যে প্রবেশ করিতে পারি না। এক্ষণে তোমার মঙ্গললাভ হউক; আমি চলিলাম।” মহাত্মা ধনঞ্জয় পুত্রকে এই কথা কহিয়া তৎকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া প্রিয়তমা উলুপী ও চিত্রাঙ্গদাকে সম্ভাষণপূৰ্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করলেন।