হোটেল শিলটনের বহিরঙ্গে তেমন একটা দেখনদারি নেই। তিনতলা ব্রিটিশ স্থাপত্যের বিল্ডিংটায় বয়সের ছাপ পড়েছে। তবে ছোট্ট সবুজ লনখানি যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মিতিন লাউঞ্জ আর রিসেপশন কাউন্টারটিও মোটামুটি ছিমছাম। মোটা-মোটা গথিক থামে, দীর্ঘকায় দরজা-জানলায়, কারুকাজ করা কাঠের সানশেডে একটা বনেদিয়ানার গন্ধও পাওয়া যায় যেন।
রিসেপশনের বাঁ দিকে মালিকের ঘর। ভিতরে ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে অপেক্ষা করছিল মিতিন। দরজার পিতলের নেমপ্লেটখানা পড়তে পড়তে টুপুর ফিসফিস করে বলল, ভদ্রলোকের ভাল নামটা কী খটোমটো গো?
মিতিন নিচু গলায় বলল, এ আর কঠিন কী। হ্যারোতিউন থেকে হ্যারি। আর্মেনিয়ানদের নাম এরকমই হয়।
ইউনিফর্ম পরা কর্মচারীটি ঘর থেকে বেরিয়েছে। হাত দেখিয়ে বলল, আপনারা যেতে পারেন।
ভিতরে চড়া ঠান্ডা। কম্পিউটার শোভিত প্ৰকাণ্ড টেবিলের ওপারে মাঝবয়সি হ্যারি। ঘুরনচেয়ারে আসীন। গোলগাল মুখ, ভালমানুষ-ভালমানুষ চেহারা। গায়ের রং ফরসা হলেও মোটেই সাহেবদের মতো নয়। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। চকচকে কামানো গাল। পরনে ঝকঝকে সুট-টাই।
ঠোঁটে হাসি টেনে মিতিন বলল, গুড আফটারনুন মিস্টার আরাকিয়েল।
হ্যারির মুখমণ্ডলে তেমন কোনও অভিব্যক্তি ফুটল না। বিনা সৌজন্যেই বললেন, বসুন। জানতাম আজ-কালের মধ্যেই আসবেন।
গদিমোড়া চেয়ারে বসে মিতিন বলল, তদন্তের খবর কে দিল আপনাকে জেসমিন? নির্মলা? না ইসাবেল আন্টি?
সেটা খুব ইম্পৰ্ট্যান্ট নয় ম্যাডাম। হ্যারির স্বর অসম্ভব শান্ত, শুধু ভাবছি, আর কত মানসিক অত্যাচার আমার কপালে আছে। এখন তো মনে হচ্ছে আঙ্কলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে যাওয়াটা সেদিন উচিত হয়নি।
ওভাবে ধরছেন কেন মিস্টার আরাকিয়েল? আপনি তো কর্তব্য পালন করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই রাত্তিরে একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এবং ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, আপনি তাতে জড়িয়ে পড়েছেন।
হুম। সেই অ্যাঙ্গেলেই তো দেখার চেষ্টা করছি। টেবিলের কাচে পেপারওয়েট ঘোরাচ্ছেন হ্যারি। থেমে বললেন, ও কে কী কী জানতে চান বলুন? বাইশে ডিসেম্বরের রাতের ডিটেলটা আর একবার বলতে হবে নিশ্চয়ই? যাতে আমার বক্তব্যের অসঙ্গতি থেকে ধরতে পারেন হিরেটা আমি কখন সরিয়েছি?
হ্যারির বাচনভঙ্গিতে টুপুর থ। মহা ঝানু লোক তো! বিকার নেই, উত্তেজনা নেই, দিব্যি কেমন চিবিয়ে-চিবিয়ে ইংরেজিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন মিতিনমাসিকে।
টুপুরকে আরও অবাক করে দিয়ে মিতিনও হাসছে মিটিমিটি। কোনও রকম পাঞ্জা কষাকষিতে না গিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, তার আর প্রয়োজন নেই মিস্টার আরাকিয়েল। মোটামুটি সকলের স্টেটমেন্ট তো নিলাম, ওগুলো ঘেঁটেঘঁটেই যা পাওয়ার পেয়ে গিয়েছি।
এবং নিশ্চিত হয়েছেন হিরে আমিই নিয়েছি, তাই তো? হ্যারির স্বরে ব্যঙ্গ, কিন্তু ম্যাডাম, জিনিসটা খুঁজে না বের করলে তো অপরাধ প্রমাণ হবে না। তা কোথা থেকে সার্চ শুরু করবেন? আমার বাড়ি? অফিস? ব্যাঙ্কের লকার? আপনি একাই খুঁজবেন, নাকি পুলিশ সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসছে?
দেখা যাক কী হয়। মিতিন হ্যারির চোখে চোখ রাখল, আগে তো বোঝার চেষ্টা করি, হিরে আপনি নেবেন কেন?
আমি আপনাকে লিড দিতে পারি ম্যাডাম ডিটেকটিভ। হোটেল শিলটন এখন ভাল চলছে না। তাই হয়তো হোটেল আর হিরে বেচে বাকি জীবনটা আমি বসে-বসে খাব। কিংবা সপরিবার কেটে পড়ব অস্ট্রেলিয়ায়।
উহুঁ, কারণটা তেমন জোরালো লাগছে না।
কেন নয়? ওই হিরের দাম আপনি জানেন?
আন্দাজ করতে পারি। টাকার হিসেবে অন্তত দু কোটি। মিতিনের চোখে স্নিগ্ধ হাসি, কিন্তু এও জানি, হিরেটা আপনার কাছে টাকার চেয়ে অনেক অনেক বেশি মূল্যবান।
এতক্ষণে হ্যারির মুখে যেন সামান্য ভাঙচুর। ঘুরনচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আপনাকে তো যথেষ্ট ইন্টেলিজেন্ট মনে হচ্ছে।
উহুঁ, বুদ্ধিমতী নই, যুক্তিবাদী। আমি কার্যকারণে বিশ্বাস করি।
হ্যারির চোখের মণি পলকের জন্য স্থির। তারপর থেমে-থেমে বললেন, দেখুন ম্যাডাম, হিরে আমি নিয়েছি কি নিইনি, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে পুলিশের লোক নন বলেই আপনাকে বলছি, ওই হিরেতে আমার কাকার যতটা অধিকার ছিল, আমারও ঠিক ততটাই আছে। ওটা কখনওই কাকা বা তাঁর পরিবারের একার প্রাপ্য নয়। আমার বাবাকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
অন্যায়ভাবে বলছেন কেন? আপনার ঠাকুরদা যদি তাঁর ছোট ছেলেকেই দিয়ে যান, কার কী বলার আছে?
না ম্যাডাম, তা তিনি পারেন না। হিরেটা ঠাকুরদা অর্জন করেননি। ওটা আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি। একজন ভারতীয় হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করার জন্য বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুরদা।
আপনার মা…?
মরাঠি। শোভা দেশপান্ডে। হিন্দু বলেই ঠাকুরদা তাঁকে মানতে পারেননি। চেয়ারের ঘূর্ণন থামিয়ে হঠাৎই ঝুঁকেছেন হ্যারি। ব্যথিত মুখে বললেন, দুঃখের কথা কী জানেন, আমার ঠাকুরদা ছিলেন অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ, অথচ উনি একবারও ভেবে দেখেননি আমাদের আর্মেনিয়ানদেরই অনেকের পূর্বপুরুষ ছিলেন হিন্দু।
টুপুরের গলা দিয়ে বিস্ময়ে ঠিকরে এল, ওমা, আর্মেনিয়ানরা কী করে হিন্দু হবেন?
ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি ভারী অদ্ভুত ম্যাডাম। হ্যারির ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি, আপনারা হয়তো খবর রাখেন না, এক সময় ভারতের সঙ্গে আর্মেনিয়ার নিয়মিত ব্যবসাবাণিজ্য চলত। শুধু তাই নয়, যিশু খ্রিস্টের জন্মের দেড়শো বছর আগে দুজন হিন্দু রাজকুমার পাকাপাকিভাবে আর্মেনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। আর্মেনিয়ান ভাষায় তাঁদের একজনের নাম জেসান্নি, অন্যজনের নাম ডেমেটার। ভারতীয় ভাষায় নাম দুটো শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। কৃষ্ণ আর জগন্নাথ। কনৌজের রাজা দীনাক্ষীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাঁরা। প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আর্মেনিয়ায় আশ্রয় নেন। আর্মেনিয়ার রাজা তাঁদের থাকতে দিয়েছিলেন তারোনে। পরে আরও অনেক হিন্দু সেখানে গিয়ে একটা বড়সড় শহর গড়ে তুলেছিল। তার প্রায় পাঁচশো বছর পর আর্মেনিয়ার এক খ্রিস্টান রাজার সঙ্গে হিন্দুদের যুদ্ধ হয়। হেরে গিয়ে হিন্দুরা সদলবলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে।
মিতিন বলল, ইন্টারেস্টিং!
আরও ইন্টারেস্টিং কী জানেন? আর্মেনিয়ায় এখনও এক হিন্দু বীরের মূর্তি আছে। স্থানীয় ভাষায় সেই যযাদ্ধার নাম আর্টজান। অর্থাৎ আপনাদের অৰ্জুন। এবার বলুন, এই সব হিন্দুর কেউ যে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন না তা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়?
তা বটে। মিতিন চেয়ারে টানটান হল, আপনার ঠাকুরদা সত্যিই কাজটা ঠিক করেননি। কিন্তু একেবারেই কি কিছু দেননি আপনাদের?
অতি সামান্য, অতি সামান্য। শুধু প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের এই বাড়িটা, যেখানে বাবা কষ্টেসৃষ্টে এই হোটেলটা বানিয়েছিলেন। আর নগদ মাত্র এক লাখ টাকা।
হুম, আপনার ক্ষোভের কারণটা বোঝা গেল।
ক্ষুব্ধ হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক, ম্যাডাম? হ্যারি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন, এখনও যে কত রকম বঞ্চনা আমাকে সহ্য করতে হচ্ছে।
যেমন?
আমার কাকার কাণ্ডটাই দেখুন না। ঠাকুরদা নয় অবুঝ ছিলেন, কিন্তু কাকা? তিনি তো আমায় খুব ভালবাসতেন বলেই জানতাম। আমিও কখনও কর্তব্যে গাফিলতি করিনি। সময় পেলেই কাকাকাকিমাকে দেখে আসতাম, নিয়মিত খোঁজখবর রাখতাম…। নিজের যখন ছেলেমেয়ে নেই, কাকার কি উচিত ছিল না সম্পত্তির খানিকটা অন্তত আমায় দিয়ে যাওয়া? কিন্তু একটা উইল করে গোটা সম্পত্তিটা উনি কাকিমাকে দিয়ে গেলেন।
মিস্টার আরাকিয়েলের উইল ছিল?
তবে আর বলছি কী। উইল যদি আদৌ না থাকত, অন্তত সম্পত্তির একটা ভাগ তো আমি পেতাম। খ্রিস্টানদের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী। অথচ সেটুকুও উনি করলেন না। …আর কাকিমা যা করলেন…।
ইসাবেল আন্টি? তিনি আবার কী করলেন?
ভাবতেও পারবেন না ম্যাডাম। আত্মীয়স্বজনের ব্যাপার বলতেও লজ্জা করে। হিরে নিয়ে আমার পিছনে পুলিশ তো লাগিয়েছেনই, আমি আর আমার স্ত্রী জেরায় জেরবার হয়ে গিয়েছি। তার মাঝেই খবর পেলাম তড়িঘড়ি করে কাকিমা উইলের প্রোবেটও নাকি নিয়ে ফেলেছেন।
তাই নাকি? কবে? কদ্দিন আগে?
কাকা গত হওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই। জানুয়ারি মাসে।
আপনি জানলেন কোথা থেকে? অ্যালবার্ট…?
হ্যারি ঈষৎ থতমত, না… মানে… বোধ হয় অ্যালবার্টই…
অ্যালবার্টের সঙ্গে আপনার খুব ভাব, তাই না?
ভাব বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝলাম না। হ্যারি ফের সপ্রতিভ, আল মাঝে-মাঝে প্রোফেশনাল কারণে আমার কাছে আসে, দেখা-সাক্ষাৎ হলে কথাবার্তা বলি।
প্রোফেশনাল কারণটা কী?
অ্যাল এখন গাইডের কাজ করে। অফিশিয়াল লাইসেন্স ওর নেই, তবে চালাকচতুর ছেলে তো, যোগাযোগ ঠিক তৈরি করে ফেলে। আর ওই সব ফরেন টুরিস্টদের আমাদের হোটেলে এনে তুললে কিছু কমিশনও পায়।
ব্যস, এইটুকুই ব্যবসায়িক সম্পর্ক? মিতিনের চোখ সরু, নাকি হোটেল শিলটনের বেআইনি জুয়ার বোর্ডেও নিয়মিত আসে অ্যালবার্ট?
হ্যারির শান্ত চোখ দুটো আচমকাই জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তে আবার হিমশীতল। কেটে-কেটে বলল, আপনি কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন ম্যাডাম ডিটেকটিভ। ভদ্রতা করে কথা বলছি বলে যদি ভেবে থাকেন আপনি যা খুশি প্রশ্ন করবেন, তা হলে কিন্তু ভুল করছেন। আপনার একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।
দেবেন না। মিতিন কাঁধ ঝাঁকাল, তবে বাইশে ডিসেম্বর রাতে অ্যালবার্ট চলে যাওয়ার পর আপনি সত্যি-সত্যি ঘুমোচ্ছিলেন, নাকি কাকার ঘরে গিয়ে সিন্দুকটা পরখ করছিলেন, এ ব্যাপারে পুলিশের কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
হ্যারি দু-এক সেকেন্ড নিশ্চুপ। তারপর মুখে একটা ধূৰ্ত হাসি ফুটে উঠেছে, গোড়াতেই একটা গলদ করে ফেললেন ম্যাডাম। অ্যাল চলে যাওয়ার পর আমি ঘুমাইনি, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর অ্যাল গিয়েছে। সত্যি বলতে কী, অ্যাল কখন চলে গিয়েছিল, আমি জানি না।
সরি। মানতে পারলাম না। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে মিসগাইড করছেন।
যা খুশি ভাবতে পারেন। আমার কিছু যায়-আসে না। হ্যারির স্বরে ওঠাপড়া নেই, আগেই তো বললাম, ওই হিরেতে আমার যথেষ্ট অধিকার আছে। যদি নিয়ে থাকি, বেশ করেছি। পারলে খুঁজে বের করুন।
বেশ। দেখি চেষ্টা করে। মিতিন উঠে পড়ল, আজ তা হলে চলি মিস্টার আরাকিয়েল। আশা করছি শিগগিরই আমাদের আবার দেখা হবে।
শিলটন হোটেল থেকে বেরিয়ে টুপুর বলল, মিস্টার হ্যারি কিন্তু বেশ পিকিউলিয়ার, তাই না?
মিতিন কী যেন ভাবছিল। অন্যমনস্কভাবে বলল, কেন?
বা রে, যাকেই হিরে নিয়ে ক্রস করা হচ্ছে, সে-ই হাউমাউ করে উঠছে। একমাত্র মিস্টার হ্যারিরই কোনও হেলদোল নেই! কেমন বুক বাজিয়ে বলে দিলেন, নিয়ে থাকলে বেশ করেছি।
হুম।
তোমার কী ধারণা? মিস্টার হ্যারিই কালপ্রিট?
তোর কী মনে হচ্ছে?
আমার মনে হয়…। টুপুর মাথা চুলকোল, হ্যারির সঙ্গে অ্যালবার্টের যোগসাজশ আছে। এই দুই মক্কেলের উপর রাউন্ড দ্য ক্লক নজর রাখলে হিরের হদিশ মিলতেও পারে। অবশ্য থ্রু অ্যালবার্ট যদি কোনও বিদেশির কাছে পাচার হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে আর কিছু করার নেই।
বলছিস?
হা গো। আমার মন বলছে সেরকমই কিছু ঘটেছে। এবং সেই কারণেই মিস্টার হ্যারি এত বেশি কনফিডেন্ট।
আর হিরের বদলে য়ে টাকাটা এল, সেটা মিস্টার হ্যারি কোথায় রাখতে পারেন?
জায়গার অভাব? হোটেলের লনেই তো পুঁতে রাখা যায়।
হুম।… নে, এবার একটা ট্যাক্সি ধর। বাড়ি গিয়ে আরতিকে ছাড়তে হবে।
বিকেলবেলা থিয়েটার রোড থেকে ট্যাক্সি পেতে খুব অসুবিধে নেই। সিটে বসে টুপুর বলল, মাটিতে টাকা পুঁতে রাখার থিয়োরিটা কি তোমার পছন্দ হল না?
অপছন্দ হল তো বলিনি। মিতিন হাসল, আমি কোনও সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দিচ্ছি না। আবার একটা লাইন ধরে একবজ্ঞা ভাবতেও রাজি নই। তবে হ্যারির কাছে এসে একটা মস্ত লাভ হল।
টুপুর চোখ কুঁচকোল, কী লাভ?
প্রথমত, মানুষটাকে খানিকটা চেনা গেল। সেকেন্ডলি, অনেক ইনফরমেশনও মিলল।
কী ইনফরমেশন? আর্মেনিয়ানদের গল্প?
জবাব দেওয়ার আগেই মিতিনের মোবাইল বেজে উঠেছে। নম্বরটা দেখেই মিতিনের ভুরু জড়ো, ইয়েস?
ব্যস, আর কথা নেই মিতিনের মুখে, কানে যন্ত্র চেপে একটানা শুধু শুনে যাচ্ছে, মোবাইল অফ করার আগে একবারই মাত্র স্বর ফুটল, ও কে।
টুপুর আলগাভাবে জিজ্ঞেস করল, কে গো?
মিস্টার কুরিয়েন।
আঁ? মিস্টার কুরিয়েন হঠাৎ? কী বলছেন?
বললেন, গোটা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডই আদতে একটি মহাশূন্য। কী বুঝলি?
টুপুর ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। কী যে হেঁয়ালি করে না মিতিনমাসি।
.
০৮.
হেঁয়ালি ক্রমেই বাড়ছিল। বাড়ি ফিরে গোটা সন্ধেটা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল মিতিনমাসি। রাতে খেতে বসেও আনমনা। মুরগির ঠ্যাং চিবোতে-চিবোতে আর্মেনিয়ানদের সম্পর্কে অজস্র জ্ঞান বিতরণ করল পার্থমেসো। রেজাবিবির সমাধিটাকে যদি হিসেবে না ধরা হয়, তা হলে কলকাতায় পা রাখার ঢের আগেই নাকি চুঁচুড়ায় ঘাঁটি গেড়েছিল আর্মেনিয়ানরা। তারপর চন্দননগরে। তারপর মুর্শিদাবাদের লাগোয়া সৈদাবাদে। মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের ফরমান নিয়ে সৈদাবাদে নাকি জমিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল আর্মেনিয়ানরা। অবশ্য প্রথম গির্জাটি নাকি গড়ে উঁচুড়ায়। আমাদের বঙ্গদেশে সেটাই নাকি দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা। পার্থমেসোর এমন লম্বা বক্তৃতাও চুপচাপ গিলে নিল মিতিনমাসি, একটাও টীকাটিপ্পনী জুড়ল না। এমনটা কালেভদ্রে ঘটে। মিতিনমাসির মগজে যখন জট পড়ে যায়, শুধু তখনই। কেসটা কি তবে, টুপুর যেমনটা ভাবছিল, তত সরল নয়? মিস্টার কুরিয়েনই বা কী এমন সংবাদ শোনাল টেলিফোনে? দুয়ে-দুয়ে চার কি তবে হচ্ছে না?
পরদিন সকালেও মিতিনমাসি ঝিম মেরে বসে। পার্থমেসো কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই সালোয়ার-কামিজ পরে তৈরি। আরতিকে বলল, আমি আর টুপুর একটু বেরোচ্ছি। ফিরতে দেরি হতে পারে। বুমবুমকে খাইয়ে দিয়ো।
বিস্মিত মুখে টুপুর বলল, কোথায় যাবে?
মারকুইস স্ট্রিট।
কেন গো?
কয়েকটা গিঁট খুলতে হবে। জেসমিন আর ইসাবেল আন্টিকে একবার মিট করা দরকার।
জেসমিনও মিতিনদের দেখে অবাক। বলল, কী ব্যাপার ম্যাডাম? ফোনটোন না করেই হঠাৎ..?
চলে এলাম। মিতিন একগাল হাসল, অসুবিধে করলাম কি?
তা নয়… তবে আমি যে একটু বেয়োব এখন…।
একদম সময় নেই?
না না, আছি কিছুক্ষণ। আসলে বারোটায় এক পার্টিকে টাইম দিয়েছি তো…।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই আপনাকে ছেড়ে দেব।
আহা, এত ইতস্তত করছেন কেন? আসুন তো।
ড্রয়িংরুমে মিতিনদের বসিয়ে নির্মলাকে শরবত তৈরির নির্দেশ দিয়ে এল জেসমিন। মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, কদ্দুর এগোলেন?
সামান্যই। অন্ধকার সুড়ঙ্গে হাঁটছিলাম, সবে যেন একটু আলোর দিশা পাচ্ছি।
জেসমিনের চোখ জ্বলজ্বল, হিরেটা তা হলে পাওয়া যাবে?
সম্ভাবনা আছে।
থ্যাঙ্ক গড। আন্টি তা হলে প্রাণ ফিরে পাবেন।
আন্টি এখন আছেন কেমন?
একই রকম। ওষুধ তো চলছে, তবে তেমন উন্নতি হচ্ছে না। হিরেটা পেলে হয়তো শকটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, শরীরটাও ফিরবে।
হুঁ। মিতিন মাথা নাড়ল, এবার তা হলে কাজের কথায় আসি?
বলুন?
মিস্টার আরাকিয়েলের মৃত্যুর পর মিস্টার হ্যারি তো আর এ বাড়িতে আসেননি, তাই না?
তা কেন, আসছিল তো। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর থেকে আর যোগাযোগ রাখছে না। একমাত্র ফিউনারেল ডিনারের দিন সপরিবার এসেছিল। ঘন্টাখানেকের জন্য।
আন্টিকে টেলিফোনও করছেন না?
উঁহু। পিসি তো সে জন্যও খুব আপসেট।
ফিউনারেল ডিনারের দিন মিস্টার হ্যারির মুড নিশ্চয়ই ভাল ছিল না?
একেবারেই না। প্রায় কারওর সঙ্গেই কথা বলেনি।
আচ্ছা, মিস্টার হ্যারি কি শুধু পুলিশের ব্যাপারেই আহত? নাকি অন্য কোনও কারণ আছে?
আর কী কারণ থাকবে?
শুনলাম মিস্টার আরাকিয়েল উইল করে যাবতীয় সম্পত্তি ইসাবেল আন্টিকে দিয়ে গিয়েছেন। সেই কারণেও কি মিস্টার হ্যারি…?
জেসমিন ক্ষণিকের জন্য থতমত। অস্ফুটে বলল, আপনি হ্যারির কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যা। মনে হল ওঁর কিছু এক্সপেক্টেশন ছিল।
আশ্চর্য, আঙ্কলের প্রপার্টি আন্টি পাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। হ্যারি আশা করে কোন মুখে?
কারণ, সম্পত্তির অনেকটাই যে বংশগত। এমনকী হারানো হিরেটাও। সুতরাং, মিস্টার হ্যারির যে একটু হলেও দাবি নেই, একথা বোধ হয় আইনও বলবে না।
দেখুন ম্যাডাম, আইনি কুটকাচালি আমি একদম বুঝি না। আঙ্কল যদি তাঁর স্ত্রীকেই সব দিয়ে যান, কার কী বলার আছে?
তা তো বটেই। …আচ্ছা, মিস্টার হ্যারি কি আগে শুনেছিলেন উইলের কথা?
জানার তো কথা নয়। আমাকেও আঙ্কল কখনও বলেননি। আন্টিকেও না।
ও।… আপনারা জানলেন কবে?
ফিউনারেল ডিনারের পর। আঙ্কলের সলিসিটর আমাদের জানালেন। উইল তো ওঁদের কাছেই গচ্ছিত ছিল।
মানে সলিসিটার ফার্মে?
হ্যা। রয় অ্যান্ড সেন। তিন নম্বর ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট।
কে কে সাক্ষী ছিল উইলের?
একতলার সিনিয়র ডিসুজা। আই মিন, পিটার আঙ্কল। আর আমাদের হাউস ফিজিশিয়ান, যিনি সেরাত্রে আঙ্কলকে দেখতে এসেছিলেন।
ও। কবে নাগাদ উইলটা করা হয়েছিল?
ডেট তো দেখলাম বছর তিনেক আগের। জেসমিনকে ঈষৎ অসহিষ্ণু দেখাল, কিন্তু হিরে চুরির সঙ্গে উইলের কী সম্পর্ক ম্যাডাম?
হয়তো কিছুই না। তবু বুঝে নিতে দোষ কী? আলোচনার মাঝে নির্মলা নিঃশব্দে শরবত রেখে গিয়েছিল, চুমুক দিয়ে মিতিন বলল, আচ্ছা… একটা কথা। আন্টি এত তড়িঘড়ি উইলের প্রোবেট নিতে গেলেন কেন?
আমিই অ্যাডভাইস করেছিলাম। হিরে মিসিং হওয়ার পর আমার খুব নার্ভাস লাগছিল। মনে হয়েছিল, সম্পত্তিটা এক্ষুনি এক্ষুনি পিসির নামে করে নেওয়া উচিত। তা ছাড়া আঙ্কলের শেয়ার সার্টিফিকেটগুলোর নাম ট্রান্সফারও তো জরুরি ছিল।
ভাল করেছেন। ঠিকই করেছেন। ইসাবেল আন্টির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দিকটাও তো ক্লিয়ার থাকা দরকার। মিতিন সামান্য হাসল, প্রপার্টি এখন তা হলে ইসাবেল আন্টির নামেই, কী বলেন?
হ্যাঁ। ওটা নিয়ে আর কেউ ট্যাঁফোঁ করতে পারবে না।
আচ্ছা জেসমিন, হিরের সম্পর্কে উইলে কোনও উল্লেখ ছিল কি?
আলাদাভাবে থাকবে কেন? স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে তো হিরেটাও…। জেসমিনের চোখ সহসা স্থির, হিরেটা কি তবে হ্যারিই সরিয়েছে?
আরও দু-একটা দিন যাক, সব জেনে যাবেন। মিতিন আবার হাসছে, শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাকে অগ্রিম দেওয়াটা আপনার বৃথা যাবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
ইউ আর ওয়েলকাম। শরবত শেষ করে মিতিন গ্লাস টেবিলে রাখল, আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন… যেতে পারেন এবার।
আপনারা?
আর-একটু বসি। ইসাবেল আন্টির সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।
এখন কথা বলবেন? জেসমিন দু-এক সেকেন্ড ভাবল, বেশ তো, নির্মলাকে ডেকে দিচ্ছি। ও আপনাদের আন্টির রুমে নিয়ে যাক।
ইসাবেল বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন। নির্মলা ধরে বসিয়ে দিতেই চোখ ঘষে বললেন, ওমা, তোমরা কখন এলে?
এই তো… টুপুরকে নিয়ে মিতিন খাটের ধারটায় বসল, কী বই পড়ছেন আন্টি?
মঁপাসার ছোট গল্প।
আপনি বুঝি মঁপাসার ভক্ত?
ভীষণ। গল্পগুলো তো বারবার পড়ি। তবে এখন চোখের যা হাল, দু-চার পাতা পেরোতে না-পেরোতে অক্ষরগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে যায়।
ছানি আসেনি তো? ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?
আর আমার ডাক্তারে কাজ নেই। রোগ ধরতে পারে না, শুধু গাদাগাদা ওষুধ দেয়। আমি আর ওষুধও খাব না। ছোট্টখাটো শান্ত ইসাবেল গজগজ করে উঠলেন, ভাবছি এবার ধ্যান করাটাও ছেড়ে দেব।
কেন আন্টি? ধ্যান কী ক্ষতি করল?
ধ্যানই তো যত নষ্টের গোড়া। যেদিন থেকে জোসেফের ছবির সামনে বসছি, সেদিন থেকেই জোসেফ আমায় ডাকাডাকি করছেন। শরীরও বিগড়োচ্ছে দিনদিন। যখনই ধ্যান সেরে উঠি, মনে হয়, আরও যেন কমজোরি হয়ে গেলাম, হাত-পায়ের কাঁপুনি যেন বেড়ে গেল। আরে বাবা, টেনে নিতে হয় তো টেনে নাও, এরকম দগ্ধে-দগ্ধে মারা কেন? ইসাবেল আবার দুহাতে চোখ রগড়ালেন, যাক গে, আমার কথা ছাড়ো। হিরের কী খবর?
প্রাণপণ চেষ্টা করছি আন্টি। মনে হয় শিগগিরই পেয়ে যাবেন।
মনে হয়-ফয় নয়। ওই হিরে আমার চাইই চাই। আরাকিয়েল বংশের গুড লাক যদি না মেলে, এই বুড়ি তা হলে আর বাঁচবে না।
ওসব অলক্ষুনে কথা মুখেও আনবেন না। মিতিন ঝুঁকে ইসাবেলের হাতে হাত রাখল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব আন্টি?
বলো।
আপনি কি কখনওই আঙ্কলকে সিন্দুক থেকে হিরেটা বের করতে দেখেননি?
সেদিন তো বললাম, সিন্দুক খোলার সময় উনি আমাকেও ঘরে থাকতে দিতেন না।
হুঁ। … আজ আর-একবার সিন্দুকটা দেখতে পারি?
দ্যাখো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নির্মলাকে চাবির গোছা বাড়িয়ে দিলেন ইসাবেল, যা, খুলে দে।
সিন্দুকের অভ্যন্তর সেদিনের মতই ফাঁকা-ফাঁকা। ভেলভেটের ফাঁকা বাক্স খোলা পড়ে। ডায়েরি আর টুকরো টুকরো কাগজ যেখানে ছিল সেখানেই। বাক্সখানা আবার ভাল করে পরখ করে ডায়েরিটা হাতে নিল মিতিন। উলটোচ্ছে পৃষ্ঠা। সময় নিয়ে নিয়ে। হঠাৎই বাড়িয়ে দিয়েছে টুপুরকে। চাপা গলায় বলল, লাস্ট পেজটা দ্যাখ।
ডায়েরিটা সংখ্যায় সংখ্যায় ঠাসা। পাতায়-পাতায় হিসেব। একদম শেষ পৃষ্ঠায় লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা, GOLD 13578.
টুপুরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, গোল্ড তেরো হাজার পাঁচশো আটাত্তর? এর মানে কী?
উত্তর না দিয়ে মিতিন ডায়েরি রাখল স্বস্থানে। নির্মলাকে সিন্দুক বন্ধ করতে বলে ফিরেছে ইসাবেলের কাছে।
ইসাবেল জিজ্ঞেস করলেন, ফের দেখে লাভ হল কিছু?
লাভ-লোকসানের হিসেব কি সহজে করা যায় আন্টি? মিতিন মৃদু-মৃদু হাসছে, মিস্টার আরাকিয়েলের উইলের বলে বিশাল সম্পত্তি আপনি পেয়ে গেলেন। এটা আপনি কী মনে করেন? লাভ? না লোকসান?
পুরোটাই লোকসান, বাছা। সেই মানুষটাই আর রইলেন না… তাঁর সম্পত্তি নিয়ে এই বয়সে আমি কী করব?
তবু তো তাড়াহুড়ো করে উইলের প্রোবেটটা নিলেন।
জেসমিন বলল যে। না নিলে নাকি অসুবিধে হতে পারে। কেন, ভুল করেছি?
না না, ভুল কীসের।
আমার কিন্তু কেমন যেন খচখচ করছিল। মনে হচ্ছিল, বড় বিষয়ী হয়ে যাচ্ছি। তারপর থেকেই তো ধ্যানে মন দিলাম।
হুঁ। তা আপনি উইল করার কথা ভাবছেন না?
ভাবছি তো। জোসেফের কয়েকটা ভুল তো শোধরাতে হবেই।
কীরকম?
জোসেফের খুব ইচ্ছে ছিল আর্মেনিয়ান অ্যাকাডেমিকে কিছু দান করার। হয়তো উইলটা উনি বদলাতেন। কিন্তু সময় তো পেলেন না। ভাবছি, টাকাকড়ি যা আছে তার একটা মোটা অংশ অ্যাকাডেমিকে দিয়ে যাব। এই বাড়ি আর কিছু টাকা পাবে জেসমিন। বলতে বলতে ইসাবেল ফিরেছেন নিৰ্মলার দিকে, আমার এই মেয়েটাকেও ফেলব না। এর জন্য বাড়ির একখানা ঘর আর আজীবন মাসোহারার বন্দোবস্ত অন্তত করে যাব।
টুপুর ফস করে বলে উঠল, আর হিরে?
আগে খুঁজে তো পাওয়া যাক। তারপর ভেবে দেখব।
ইসাবেলের গলায় সংশয়ের সুর। টুপুর হাসল মনে-মনে। এই প্ৰবীণা মহিলা জানেন না, মিতিনমাসি যখন একবার কেসটা হাতে নিয়েছে, ওই হিরে উদ্ধার হবেই। যদি হিরে পাচারও হয়ে গিয়ে থাকে, তাও মিতিনমাসি এ কদিনে টের পেতই। শুধু উইল নিয়ে এত পুছতাছ কেন, সেটুকুই টুপুরের বোধগম্য হচ্ছে না। ওই আজব লেখাটাই বা হঠাৎ দেখাল কেন? সোনার সঙ্গে হিরের কী সম্পর্ক ১৩৫৭৮-এরই বা মানে কী?
ভাবনাটাকে বেশি খেলানোর অবকাশ পেল না টুপুর। গাড়িবারান্দার ছাদটা একবার ঘুরে এসে ইসাবেলের কাছ থেকে বিদায় নিল মিতিন। দরজা বন্ধ করতে নির্মলাও এসেছে পিছনপিছন। হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে মিতিন তাকে বলল, আন্টির ঠিকমতো খেয়াল রাখছ তো?
নির্মলা নীরস গলায় বলল, দেখাশুনো করাটাই তো আমার কাজ।
বিনিময়ে তো পাচ্ছও অনেক কিছু। আন্টি তো তোমার সারা জীবনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
আন্টির করুণা। আমার ভাগ্য।
তুমি কিন্তু আন্টির ভালবাসার পুরো মর্যাদা দাওনি নির্মলা।
একথা কেন বলছেন?
বাইশে ডিসেম্বরের রাতটা ভাবো, তা হলেই জবাব পেয়ে যাবে।
পলকে নির্মলার মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে। মাথা নিচু করে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু…।
নিৰ্মলা থেমে গেল। দু-চার সেকেন্ড তীক্ষ চোখে নির্মলাকে দেখল মিতিন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গেল নীচে।
টুপুর কৌতূহলে টগবগ করে ফুটছিল। একতলায় এসে বলল, মিস্টার হ্যারি আর নির্মলা কি আঁতাত করে…?
এখন কোনও প্রশ্ন নয়। চল, জেসমিনের মোমবাতির কারখানাটা একবার দেখে যাই।
কেন?
বললাম যে, নো প্রশ্ন। জাস্ট ফলো মি।
গিয়ে অবশ্য লাভ হল না। বাড়ির পিছনের গ্যারাজ ঘরটা বন্ধ। তালামারা পুরনো আমলের কাঠের পাল্লা ঠেলেঠুলে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল মিতিন। কিছুই বোধহয় গোচরে এল না। হতাশ হয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছে। হঠাৎই হনহন করে চলে গেল পাঁচিলের ধারের ঝোপটায়। ছোট্ট একটা কাগজের বাক্স কুড়িয়ে দেখছে ভুরু কুঁচকে। বাক্সটা ফেলে দিয়ে টুপুরকে বলল, দাঁড়া এখানে। আমি আসছি।
বলেই দুদ্দাড়িয়ে আবার দোতলায়। টুপুর হতবাক। গিয়ে বাক্সটা তুলে দেখল একবার। কী কাণ্ড, এ যে এক ডজন থার্মোমিটারের বাক্স। এটা দেখে মিতিনমাসি অত উত্তেজিত হয়ে পড়ল কেন? কী ছাই রহস্য পেল বাক্সটায়?
মিনিট পাঁচেক পর ফিরেছে মিতিন। আর-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না, টুপুরকে ডেকে নিয়ে সোজা গেটের বাইরে। বাহাদুর যে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে, সেদিকেও নজর নেই যেন।
লম্বা-লম্বা পায়ে হাঁটছিল মিতিন। তাল মেলাতে টুপুরের গলদঘর্ম দশা। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মুখে এসে মিতিন ট্যাক্সি ধরতে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে টুপুর জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারখানা কী? আবার ওপরে ছুটলে কেন?
ব্যাগ খুলে মিতিন একটা আধপোড়া লাল বাটি-মোমবাতি বের করে দেখাল, এটা আনতে।
টুপুরের গুলিয়ে যাচ্ছিল সব কিছু। মোমের মধ্যে হিরে আছে নাকি?