০৭.
পুলিশ আর গোয়েন্দায় ছেয়ে গেছে ঘটনাস্থল। হোমিসাইড স্কোয়ার্ডের লোকেরা খুব সতর্কতার সঙ্গে আর সযত্নে নিজের নিজের কাজ বহাল তবিয়তে করে যাচ্ছে জুনিয়ার হেসের বালি খুঁড়ে পাওয়া সেই অজ্ঞাত অপরিচিত মৃতদেহকে কেন্দ্র করে। ডাক্তার লোইসও পরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন তার ডাক্তারি সাজ সরঞ্জাম নিয়ে। মিঃ টেরেল, বেইগলার আর হেস একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করছিলেন তার অভিনব কর্মপ্রণালী।
একসময়ে বেইগলার, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টেরলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, মৃত মেয়েটির মুখের যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ওকে সনাক্ত করা একটু কঠিন তো হবে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে, হয় খুনি ওর সমস্ত পোশাক-আসাক সঙ্গে নিয়ে গেছে। আবার এও হতে পারে কোথাও পুঁতে ফেলেছে যাতে না সহজে ওর সনাক্তকরণ কোনভাবে সম্ভব হতে পারে।
–হুম! আপাততঃ রিপোর্ট শোনা যাক। তারপর হেড কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে, আগামীকালের সংবাদপত্র, রেডিও আর টিভিতে এই মেয়েটির একটা সাধারণগোছের বর্ণনা দিয়ে খবর প্রচারের সমস্ত দায়িত্ব আমি তোর্মর জিম্মায় সঁপে দিলাম, জো।
-ও, চীফ। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেইগলার বলে উঠলেন, সমুদ্রের এই উত্তাল হাওয়ায় আশেপাশে যে রকম বালি উড়ছে তাতে কোন পদচিহ্ন পাওয়ার আশা একেবারেই বৃথা। খুনী লাশ গুম করার অভিপ্রায়ে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই আসরে নেমেছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মোটরে চেপেই এসেছিল।
সে চায়নি যে মেয়েটার পরিচয় সর্বসমক্ষে প্রকাশ পাক, তাই চলে যাবার সময়ে তার শিকারকে সম্পূর্ণরূপে বস্ত্রহীন করেই রেখে গিয়েছিল। বোধহয় তার মনে শঙ্কা ছিল যে, মেয়েটার পরিচয় প্রকাশ পেলে সেও আর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবেনা পুলিশের। তার মানে শিকার আর শিকারী দুজনেই দুজনের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিল।
টেরেল এবং হেস উভয়েই বেইগলারের যুক্তিকে সমর্থন করল।
ইতিমধ্যে নিজের কাজ সেরে ডাক্তার লোইস এসে যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। মিঃ টেরেল, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে ডাক্তার জানালেন : মার্ডার…জোর জুলুম করে শ্বাস রোধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। দেড়মাসের আগের ঘটনা। মুখের যেটুকু অংশ এখানে আবিষ্কৃত তাতে আঘাত ও কালশিরার দাগই বেশী। তার মানে মেয়েটাকে খুব সহজে বশীভূত করা যায়নি। মেয়েটি সম্পর্কে যাবতীয় ডিটেস্ দিতে পারব ডেডবডি মর্গে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষার পর পরই।
মেয়েটি কী ধর্ষিতা হয়েছিল?
–না।
ডাক্তারের জবাব শুনে তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। তার মানে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কারণ আছে। লালসার বলি সে হয়নি।
বয়স কত হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
–১৭ থেকে ১৯ এর মাঝামাঝি।
–শরীরের কোথাও কোন আইডেন্টিফাইং মার্কস আপনার চোখে পড়েছে?
—না।
–মেয়েটি কী ন্যাচারলি ব্লন্ড? না, রঙ করা চুল?
–ন্যচারলি ব্লন্ড।
–ভার্জিন? না কি পুরুষ সংসর্গে কখনো জড়িয়ে ছিল?
–না, ভার্জিন। আর কোন প্রশ্ন আছে?
আপাততঃ নয়। আপনি কাইন্ডলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্টটা পাঠিয়ে দেবেন আমাকে।
-ও-কে। চলে গেলেন ডাক্তার তার নিজের মোটরের দিকে।
টেরেল বললেন,শোন জো, তুমিও তোমার কাজে নেমে পড়। মিয়ামি পুলিশের কাছে খোঁজ খবর নাও, দেড় মাস পূর্বে তাদের কাছে কেউ এই বয়সের কোন মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট দায়ের করেছে কি না।
তেমন কোন সংবাদ যদি না থেকে থাকে তবে আরো অনেক দূর আমাদের জাল বিছোতে হবে। এই ঘটনা তার সমক্ষে যত পাবলিসিটি সংগ্রহ করতে পারবে ততই আমাদের কাজে আরো সুবিধা হবে এই মৃতা মেয়েটির সনাক্তকরণে।
বেইগলার চলে গেলেন। এগিয়ে এলেন হেস। তবে একটা কথা চীফ।
—বলো।
–জায়গাটার আশেপাশে পরীক্ষা করে আমার মনে হচ্ছে-খুন এখানে হয়নি। কাউকে নাকে-মুখে আঘাত করে, শ্বাস রোধ করে মারতে উদ্যত হলে কিছু না কিছু রক্তক্ষরণ হবেই। কিন্তু রক্তপাতের এখানে কোন চিহ্নমাত্র নেই। আমাদের ঐ সমস্ত গাছপালায় পরিবেষ্টিত জায়গার অনুসন্ধান করতে হবে।
–ঠিক আছে ফ্রেড, আমি ফিরে গিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের সঙ্গে কথা বলে, তাদের যে জোরালো আর্ক ল্যাম্প আছে তা পাঠাবার না হয় ব্যবস্থা করছি। তুমি পুরোদমে তোমার কাজ চালিয়ে যাও।
রাত, তখন নটা বেজে গেছে। ডিটেকটিভ রুমে বসে বেইগলার, লেপস্কি আর জ্যাকবির সঙ্গে আজকের ঘটনা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছিলেন টেরেল, এমন সময়ে ঘরে পা রাখলেন। হেস। ক্লান্ত চোখে মুখে খুশির ছাপ তখন স্পষ্ট। তিনি টেবিলের ওপর একটা হাল্কা নীলরঙের প্লাস্টিক ফ্রেমের চশমা আর একটি কাগজের মোড় রাখলেন। চশমাটির ডানদিকের পরকলা বেপাত্তা আর বাঁদিকের পরকলাটি চিড় খাওয়া।
হেস বললেন, মেয়েটাকে কোথায় মারা হয় তার সন্ধান আমি পেয়েছি চী। যেখানে সে মৃতা অবস্থায় পড়েছিল তার থেকে ফুট তিনেক ব্যবধানে এটা আমি উদ্ধার করেছি। রক্তের সন্ধানও মিলেছে। আর সেইসঙ্গে পেয়েছি খুনীর জুতোর দাগ। প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে ছাঁচ তোলারও ব্যবস্থা করে এসেছি জ্যাকের মাধ্যমে।
টেরেল নিবিষ্ট মনে উল্টে পাল্টে দেখছিলেন সেই ভঙ্গুর চশমা আর তার পরকলারটিকে। বললেন, টম! এই চশমা আর পরকলাটা নিয়ে পুলিশ ল্যাব-এ যাও। আমার মন বলছে এর লেন্স কোন সাধারণ লেন্স নয়। এর মধ্যে কোথাও একটা বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে। তারপর ফ্রেম থেকে যতটা সংবাদ যা পাওয়া যায়।
–ওকে চীফ। চশমা আর পরকলাটা নিয়ে লেপস্কি চলে গেলেন।
.
০৮.
এডরিসের ঘুম যখন ভাঙল সকাল তখন সাড়ে আটটা।শয়নকক্ষ থেকে শোনা যাচ্ছিল ফিল এর সুগভীর নাসিকা গর্জন। বসবার ঘরে সোফাকাম-বেড এ পড়ে পড়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। মিসেস গ্যারল্যান্ডের চাবির ছাপ নিয়ে কাল গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাকে।
চাবিটার কথা মনে উদয় হতেই এডরিসের সারা দেহ মন চনমন করে উঠল। কাল রাত্রে লা কোকাইল রেস্তোরাঁয় মিঃ গ্যারল্যান্ডের বন্ধু বান্ধবদের এই কথা বলতে সে.শুনেছে: গ্যারল্যান্ড নাকি আগের দিন রাত্রে ক্যাসিনোয় গিয়ে জুয়া খেলে বেশ মোটা মূল্যের দাও মেরেছেন লাখখানেক ডলারের কম তো নয়ই।
কাজেই মিসেস গ্যারল্যান্ড যদি ইরার হাত দিয়ে তার অর্ধেকও ব্যাঙ্কে জমা রাখেন এত ঝুঁকি নেওয়া তবেই সার্থক।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল এডরিস। তারপর প্রাতঃকৃত্যাদি সম্পন্ন করে, দাঁড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে, পোশাক পাল্টে সদর দরজা খুলে সেদিনের সংবাদপত্র আর দুধের বোতল সংগ্রহ করল, তখন ঠিক নটা। ততক্ষণে ফিলের ঘুম ভেঙেছে।
তাকে উঠতে দেখে এডরিস কিচেনে গিয়ে সুইচ অন করে পার্কোলেটারে প্লাগ দিয়ে দুজনের মতো কফির জল বসিয়ে দিল পটে। নিজস্ব কৃতিত্বে হাতের এক ঝটকায় খুলে ফেলল খবরের কাগজের ভাঁজ। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ছানাবড়া হয়ে হতবাক মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল আপনা থেকে। বুকের মধ্যে কেউ যেন দুরমুশ পেটাতে লাগল। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ছবি সমেত বড় বড় হরফে ব্যানার লাইনে লেখা রয়েছে : কোরাভ কোভ-এ জনৈকা অজ্ঞাত পরিচয় তরুণীর মৃতদেহ আবিষ্কার।
শ্বাস রুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু!
নীচে ছোট ছোট অক্ষরে সংবাদদাতার রিপোর্ট।
রিপোর্টটা একবার নয়, দুবার-তিনবার এক নাগাড়ে পড়ে গেল এডরিস। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে এক লহমায় তাকাল ছাপা ছবিখানার দিকে বিশেষ করে জুনিয়ার হেসের ছবিটার দিকে। তারপর পার্কোলেটারের সুইচ অফ করে, গুরু গম্ভীর মুখে হাজির হলো বসার কক্ষে। তার চোখ মুখের ভাবগতিক দেখে ফিল একটু ঘাবড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল : কী ব্যাপার?
এডরিস প্রত্যুত্তরে সকালের সংবাদপত্রটা বাড়িয়ে ধরল তার মুখের সামনে–নিজেই পড়ে চক্ষু সার্থক কর।
কাগজের বড় বড় অক্ষরের হেডলাইন দেখে সেও চমকে উঠল। তারপর রিপোর্ট পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ভয়ে শুকিয়ে একেবারে বিবর্ণ রূপ ধারণ করল।
–জুডাস! ওরা ওর সন্ধান পেয়ে গেছে তাহলে! কিন্তু আমি তো ভালোভাবেই তাকে কবর দিয়েছিলাম।
–তোমার ভালোভাবের নিকুচি করেছে অপদার্থ কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল এডরিস, এমনই নিখুঁতভাবে পুঁতেছিলে যে, আটবছর বয়সী একটা বাচ্চা ছেলেরও সেটা খুঁজে বার করতে কোন বেগ পেতে হয়নি। আমার কী ইচ্ছা করছে জান? ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে তোমায় গুলি করে মারতে। আমাদের এতোদিনের স্বপ্নটাকে তুমি তোমার অপদার্থতা আর অযোগ্যতার দরুণ ভেঙে চুরমার করে দিলে। তোমার ওপর দায়িত্ব না দিয়ে যদি নিজে হাতেই কাজটা করতাম, আজকে আর এই দুর্দিনের মুখোমুখি হতে হতো না। আফসোস আর নিরাশায় এডরিসের কণ্ঠ শেষ দিকে একেবারে বুজে এল।
এক পেগ হুইস্কি পেটে পড়তেই কিছুটা সামলে নিল পরিস্থিতিকে এডরিস। সে আর একবার কাগজের রিপোর্টটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে, কিছুটা আশাব্যঞ্জক সুরে সুর মিলিয়ে ফিলকে বলল, দেখ ফিল, খবরের কাগজে লিখছে–এখনও ওর সম্বন্ধে কোন তথ্য পুলিশের হাতে এসে পৌঁছয়নি। শুধু তাই নয় খুনীর কোন কুও পায়নি। তাই ইরা যতদিন তার অভিনয় চালিয়ে যেতে পারবে, ততদিন পুলিশ কেমনকরে আন্দাজ করবে যেলাশ আসলে নোরেনার?আমরা এখনও পর্যন্ত তেমন কোন বিপদের সম্মুখীন হইনি। আমরা আমাদের পূর্ব ছকে কাজ চালিয়ে যাব। ছবিটা ভালো করে একবার লক্ষ্য করো ফিল, মুখের অর্ধেক পোকার গহ্বরে চলে গেছে আর অবশিষ্ট অংশটা গলে পচে বিকৃত অবস্থা। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা নিরাপদ। ঐ ছবি দেখে ওর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বার করা একেবারেই দুঃসাধ্য।
–কিন্তু যতোই সান্ত্বনা দাও টিকি, আমার বুকের ধুকধুকুনি এখনও পূর্বের মতোই সচল। তোমার চাইতে পুলিশকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। তাই তাদের চেনার অভিজ্ঞতা আমার একটু বেশী বলতে পার। তারা প্রেস রিপোর্টারকে যতোটা বলে, ঠিক ততটাই আবার চেপে রাখে সযত্নে নিজেদের অন্তরে। কে বলতে পারে, এখানেও হয়তো সেই কৌশলটা কাজে লাগিয়েছে কিনা? তোমার সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হয়ে ভাগে যে বিশ হাজার ডলার আমার মুঠিতে এসেছে তাই যথেষ্ট। এদেশে থাকার কোন প্রবণতা আমার আর নেই। আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটেই কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।
ফিলের কথা শুনে এডরিস ভেতরে ভেতরে একটু দমে গেল। কেননা সে চলে গেলে চাবির ডুপ্লিকেট তৈরী করতে কে আর এগিয়ে আসবে? একাজে ফিলের অবদান ইরার চেয়ে কিছু কম নয়। তাই মনের ভাব মনেই চেপে এডরিস মুখে শুধু বলল, আজ বিকেলেই চলে যেতে চাও?
আগামীকাল গ্যারল্যান্ডের ভল্ট খুলে টাকার ভাগ না নিয়েই চলে যেতে চাও? জান কত টাকা মজুত আছে ঐ সেফে? এক লাখ ডলার!
গ্যারল্যান্ডের বন্ধুবান্ধবের মুখ থেকে আমার নিজের কানে শোনা! এতটুকু মিথ্যে নয়। সেই টাকার প্রাপ্য ভাগ তুমি না নিয়েই চলে যেতে চাইছ? তোমার পকেটের ঐ বিশ হাজার ডলার আর কতদিন চলবে? সারাজীবন ধরে চলবে কী ওতে?
সোফার ওপর এবার নড়ে চড়ে বসল ফিল। এডরিস এটা বেশ সহজেই বুঝে নিল যে : মাছ অবশেষে টোপ গিলেছে। কিন্তু ওর সম্বন্ধে সাবধান হওয়ার সময় এবার উপস্থিত। যখন একবার ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে, তখন ভয় পেয়ে ভুল পদক্ষেপ ফেলে অনেক কিছু অঘটনই ঘটে যেতে পারে। আগে ভাগে টাকাটা একবার বার করিয়ে নিই গ্যারল্যান্ডের সেফ থেকে, তারপর ওর ভাগ্যে যা লেখা আছে তার শেষ রফা আমি করে দেব, তা হলো-রিভলবারের একটি কি দুটি গুলি। মনে মনে সেরকমই একটা ফন্দি আঁটল এডরিস।
রবিবার। ছুটির এই দিনটি কারো কাছে কেটে যায় স্রোতের মতো, আবার কারো কাছে ঐ দিনটি কাটানো যেন দুরূহ ব্যাপার হয়ে ওঠে–এমনই শামুকের মতো গুটিগুটি ভাবে বহে চলে ঘণ্টা মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটাগুলো। ইরাও একই পথের পথিক। মনে তার চিন্তার শেষ নেই। নয় নয় করে আরো বারোটা দিন ধরে তাকে সমানে অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আর কোন দুর্ভাবনা নেই। যেখানে যেমনভাবে সম্ভব হবে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে সে চালিয়ে দেবে। কিন্তু এই গৃহের গৃহকর্তা মহান হৃদয় মালিকটিকে ছেড়ে যেতে হবে বলে তার কান্না যেন বুক ঠেলে উপরে উঠছে। এতো আরাম আর অফুরন্ত স্নেহ এর আগে সে কোনদিন কারো কাছ থেকে পায়নি। এডরিস আর ফিলের মতন নামকরা দুজন শয়তান পাপীকে এরকম অন্যায়ভাবে দিনের পর দিন মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকা যুগিয়ে যেতে হচ্ছে।
বারোদিন ধরে তাদের এই নির্যাতন সহ্য করে যেতে হচ্ছে বলে তার অনুশোচনার কোন অন্ত ছিল না। সেএখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত যোগানের এই ভয়াল স্রোত থামবে না। কিন্তু দিন যে আর কাটতেই চায় না।
রবিবারটা, ফিলেরও ইরার মতো একই দশা, দিনটা কাটতেই চায় না। রেডিও খুলে যতবারই সে কোরলে কোভে ডেডবডি পাবার আর তার সনাক্তকরণের জন্য জনসাধারণের কাছে পুলিশের তরফ থেকে এই ঘোষণা শুনেছে ততবারই ভয়ে চমকে উঠেছে…নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে আর মনে মনেকঠিন অভিশাপ বর্ষণ করেছে এডরিসকে। অনেক ভাবনা-চিন্তা আর জল্পনা-কল্পনার জাল বুনল বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের শেষ সীমারেখায় পৌঁছে আর নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে মিয়ামি এয়ারপোর্টে ফোন করে সোমবার বিকেলের ফ্লাইটের হাভানাগামী প্লেনে একটা সীটও বুক করে ফেলল।
ইরা আর ফিলের তুলনায় নার্ভের জোর আর আত্মবিশ্বাস এডরিসের দুই-ইছিল অনেক বেশী। ফিল যখন এয়ারপোর্টে ফোন করতে ব্যস্ত, সেই সময়ে তার দিকে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি হেসে অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। কর্মস্থলে গিয়ে সে দেখা করল ফ্লোর ম্যানেজার লুইসের সঙ্গে।
তাকে জানাল : তার পুরনো আর ঘনিষ্ট বন্ধু রোগে মৃত্যুশয্যায়, তাকে একবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েছে, তার দিন দশেকের ছুটির প্রয়োজন। একথা শুনে লুইস গম্ভীরমুখে জবাব দিল–সে নিশ্চিন্তে যেতে পারে তবে ছুটির মাইনে সে পাবে না।
–কি আর করা যাবে, তাই সে লুইসের কথা শুনে তার মুখে থুতু ছিটিয়ে দেবার দুরন্ত লোভ সামলে নিল। ভাল মানুষের মতন এডরিস বলে উঠল, চেষ্টা করব আরো তাড়াতাড়ি ফিরতে, না আসা পর্যন্ত একটু কষ্টে-শিষ্টে কাজ চালিয়ে নেবেন। শত হলেও মরণাপন্ন বন্ধু মানুষ, তার অনুরোধ যতই হোক একেবারে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি না, আর্থিক দিক থেকে আমার না হয় একটু লোকসান হবে।
হোমিসাইড স্কোয়াডের লোকজনদের কিন্তু রবিবার এই দিনটা কেটে যাচ্ছিল খুব দ্রুতগতিতে। বিশেষ করে কোরাল কোভ মার্ডার কেস নিয়ে যারা আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে পড়েছিল, তাদের। ভাঙা চশমা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যতল্লাসের জন্য বেশ কিছু লোক ছোটাছুটি করে চলছিল বিভিন্ন জায়গায় জায়গায়।
সকাল, পৌনে আটটা। কিন্তু অত সকালেই মিঃ টেরেলের অফিস ঘরে মিঃ টেরেল শুধুই একা। বেইগলার আর হেস দুজনে একত্রে হাজির হয়েছেন।কফি খেতে খেতে আলোচনা চলছিল। তাদের মধ্যে। পুলিশ ল্যাব থেকে পাঠানো ভঙ্গুর চশমার রিপোর্টটা–এই নিয়ে মোট তিনবার পড়লেন টেরেল। রিপোর্টে যা লেখা আছে সেটুকু বাদে যা উল্লেখ নেই তা নিংড়ে বার করার চেষ্টাতেই রত ছিলেন তিনি। রিপোর্টে লেখা হয়েছে : এই চশমা যে পরত সে অ্যাকিউট অ্যাসটিগম্যাটিজিম রোগে আক্রান্ত ছিল। তাই চশমাবিহীন সে একেবারেই অন্ধ। সবসময়ের জন্য তাকে চশমা পরে থাকতে হবে। তবে তার বাঁ চোখের চাইতে ডান চোখ অনেক বেশী আক্রান্ত।.মিঃ টেরেল লেখা লাইনগুলো মনে মনে বারংবার আউড়ে কণ্ঠস্থ করে ফেলতে লাগলেন। তার মনে হচ্ছিল : সাফল্য যদি আসে তবে এই সূত্রধরে আসতে বাধ্য। তাই তিনি তার তিনজন সহকর্মীর উদ্দেশ্যে এই আদেশ দিয়েছিলেন : তারা যেন একশো মাইল পরিধির মধ্যে যেখানে যত হোলসেল চশমার দোকানের দেখা মিলবে…সেগুলির প্রত্যেকটিতে অবশ্যই চুঁ মারবে। তিনি এতেই ক্ষান্ত হননি, তাদের প্রতি কড়া হুকুম জারি করেছিলেন এই বলে :হোক রবিবার, চশমার পরকলা তৈরীর ফ্যাক্টরির মালিকের সন্ধান করে যে কোন উপায়ই অবলম্বন করতে হোক না কেন জোর করে ফ্যাক্টরি খোলাবে। শুধু তাই নয়, এও জানার প্রয়াস করবে যে এই ধরণের পরকলা সে কাদের কাছে সাপ্লাই দিয়েছে। আমি আজ বিকেলের মধ্যেই এর সব রিপোর্ট চাই।
জ্যাকবির ওপর আদেশ ছিল : টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে যতজন আই স্পেশালিস্ট-এর এবং যতগুলো হাসপাতাল–তা জেনারেলই হোক আর স্পেশাল বিষয়ই হোক,–এর নাম আছে, তাদের প্রত্যেকটির কাছে ঐ একই সংবাদ জানাতে হবে।
আরও তিনজনকে পাঠিয়েছিলেন যারা এই ধরণের প্লাস্টিকের চশমার ফ্রেম বানায়, তাদের নিকটে। যদিও তিনি জানতেন,রবিবারে এদের সম্পর্কে কুল কিনারা করা সত্যিই কঠিন, তবু তাদের মধ্যে একজনকেও হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রয়োজনে পুলিশীশক্তি আর অধিকারের সদব্যবহার করতে ঢালাও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
টেরেল এবার আরও একটি রিপোর্ট নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। রিপোর্টটা ছিল এই রকম: ঘটনাস্থলে পাওয়া একজোড়া জুতোর গোড়ালির ছাপ সংক্রান্ত। ল্যাব বলছে যে, যে ব্যক্তি ঐ জুতোর অধিকারী, সেলম্বায় ছফুটের কাছাকাছি, ওজনে ১৯০ পাউন্ডের মতন।জুতোর গোড়ালির ছাপ ১০ নং মাপের জুতোয়।
সাপ্লাই করেছে দি ম্যানসশপ–প্যারাডাইস সিটিরই একজন দোকানদার। সেখানেও একজন পুলিশ আর কর্মচারীকে পাঠিয়ে ছিলেন টেরেল…তারা খুব সম্প্রতি কাদের এই জুতো বিক্রী করেছিল, জানতে। কারণ জুতোজোড়ায় নতুনত্বের ছাপ তখনও স্পষ্ট।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে মিঃ টেরেল এসে বসলেন তার টেবিলে। ইতিমধ্যে হেস আর বেইগলারও সেখানে উপস্থিত। হেস এর মুখ থমথমে কঠিন, তার মানে কোরাল কোভ-এ এই কয়েকঘণ্টার মধ্যেও কোন কু হাতে এসে পড়েনি যার দ্বারা অনুসন্ধান কোন নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। বেইগলারের মুখ জুড়ে বিরক্তির ছাপ। তিনি জানালেন : ঐ ধরণের রুগী আর ঐ ধরণের চশমা পরে এমন ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সীবত্রিশজন মেয়ের সন্ধান করতে আমরা পেরেছিচী। মজার কথা এই যে, তারা কেউ কিন্তু নিরুদ্দিষ্ট নয়। তবে শুধুমাত্র এ ব্যাপারে একটা সংবাদ দিতে এখানে সে জানাচ্ছে : গতমাসের ১৭ই মে নাকি একটি মেয়েকে সকাল ৮টা নাগাদ কোরাল কোভ-এর দিকে গাড়ি করে যেতে দেখেছিল।
খবরটা কানে যেতেই খুশিতে টেরেলের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি সহর্ষে বলে উঠলেন, লোকটা এখানে এলেই আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।
ডিটেকটিভ রুমে বসে সামনে লিস্ট রেখে লেপস্কি, বেইগলার আর জ্যাকৰি যে যাঁর ন্যস্ত কাজে ব্যস্ত ছিলেন টেলিফোন কানে লাগিয়ে।
একসময় লেপস্কি বললেন : ওহে জো! চশমাধারিনী কন্যাদের লিস্টে মেল ডেভনের কন্যার নামও আছে, খেয়াল করেছ?
হ্যাঁ, এতে আর কী এসে গেল? সে তো আর নিজের গা বাঁচিয়ে পালিয়েও যাইনি আর খুনও হয়নি। তবে?
না, তা নয়, আমার বলার উদ্দেশ্য হলো–সে কিন্তু চশমা চোখে লাগায় না।
সো হোয়াট? দয়া করে তুমি ভাই তোমার কাজ কর আর আমাকে আমার কাজ নিয়েই থাকতে দাও। মেল ডেভনের মেয়েকে অযথা ঘাটিও না।
লেপস্কি কিন্তু বেইগলারের মুখের বলা মন্তব্যে রাগ করলেন না। যথারীতি ভঙ্গিমায় শান্ত কণ্ঠে বললেন, নিজের কাজই তো করছি। আর সেই কাজ করতে গিয়েই তো স্মরণে এল:মিস নোরেনা ডেভনের চোখে চশমা নেই। কেননা, এই দেড় মাসের মধ্যে আমি তাকে ৪/৫ বার মোটর হাঁকিয়ে যেতে দেখেছি, সতর্ক হয়েই লক্ষ্য করেছি–সে চশমা পরে না।
এবার কথাটার গুরুত্ব অনুধাবন করলেন বেইগলার। তার দৃষ্টি ভরে ফুটে উঠল কৌতূহলের ছাপ। তিনি চট করে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে টেবিলের ওপর চশমা সম্পর্কে ল্যাব-রিপোর্টের কপিখানায় চোখ বুলিয়েছিলেন সেটা তুলে নিয়ে দ্রুত মনঃসংযোগ করলেন। তারপর লেপস্কির দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন, তার মুখেও মৃদু হাসির রেখা।
বেইগলার বললেন, রিপোর্ট লিখছে, চশমার মালিককে সর্বক্ষণ চোখে চশমা পরে থাকতে হবেনইলে অন্ধত্ব তাকে ঘিরে ধরবে। আর তুমি বলছু, ডঃ উইডম্যান তার চশমাধারিনী রুগিনীদের নামের যে লিস্ট সাপ্লাই করেছেন তাতে নোরেনা ডেভনের নামেরও উল্লেখ আছে–তোমার বক্তব্য মতো সে বিনা চশমাতেই প্যারাডাইস সিটির রাস্তায় দিব্যি গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হতে পারে? ডাক্তার এ বিষয়ে কোন ভুল রায় দেননি তো? আমি, এক্ষুনি একবার ডাক্তারের ফোন লাগাচ্ছি। এই বলে বেইগলার দ্রুত ডঃ উইডম্যানের নাম্বারে ডায়াল করলেন। কিন্তু ডাক্তারকে পাওয়া গেল না। তার চেম্বারে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি জানাল :রাত নটার আগে চেম্বারে তাকে পাওয়া যাবে না।
হতাশ হয়ে বেইগলার ফোন নামিয়ে রাখলেন কিন্তু এতসহজে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। তিনি লেপস্কিকে ডেকে তাঁকে স্বয়ং সেখানে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করার ব্যাপারে অনুরোধ করলেন। লেপস্কি আর বিন্দুমাত্র দ্বিরুত্তি না করে তক্ষুনি রওনা হলেন।
একটু পরেই এসে হাজির হলেন সেই সংবাদ প্রদানকারীভদ্রলোক।নাম হেনরি টালাস, পেশায় মুদিখানার মাল সরবরাহকারী। তাকে নিয়ে যাওয়া হল চীফ টেরেলের কাছে।
হেনরী টালাস বললেন, আজ সকালে রেডিওতে আপনাদের ঘোষণা শুনলাম। মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। তাই ভেবে দেখলাম : যা দেখেছি তা আপনাদের কাছে উপস্থাপনা করতে ক্ষতি কী? অবশ্য এতে যদি কোন আসল কাজ হয়ে যায়।
চীফ টেরেল তার এই নাগরিকতা বোধের জন্য একপ্রস্থ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। টালাস শুরু করলেন তার কাহিনী।
গত মাসের সতেরো তারিখে আমি সীকোষ-এ চলেছিলাম কয়েকজন কাস্টমারের কল অ্যাটেন্ড করতে। আমার গাড়ির আগে আগেই যাচ্ছিল একটা রোডমাস্টার বুইক কনভার্টিব। হুড খোলা। তাতে দুজন আরোহী। একজন মাঝবয়সী পুরুষ, বয়স প্রায় ৩৮/৪০ আর সোনালী কেশ এক তরুণী। বয়স আন্দাজ সতেরো/আঠারো হবে। পরনে সাদা রঙের সার্ট, মাথায় ঘোট কালো রঙের টুপি, চোখে নীল ফ্রেমের চশমা।
(এইখানে টেরেল এবং বেইগলার পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।)
টালাস তার বক্তব্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন–যদি না বুইকটা হঠাৎ হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে কোরাস কোভ-এ যাবার সরু পথটায় ঢুকত তবে ভুলে বসতাম ওদের প্রসঙ্গ। কিন্তু অসময়ে পিকনিকের সাজ-ঘর সরঞ্জাম ছাড়াই তাদের ঐ পথের দিকে এগোতে দেখে কম অবাক হইনি আমি।
যাইহোক, যে কথা বলছিলাম, সীকোষ-এ আমার কাজকর্ম সেরে ফেরার মুখে বাস টার্মিনাসের কাছে একটা পাম্পে এসে গাড়িতে গ্যাসোলিন ভরছি, একই সময় আবার সেই বুইকটা এসে দাঁড়াল একটু দূরে। সেই লোকটা তারপর গাড়ি থেকে নেমে ঐ বাস টার্মিনাসের একটা বেঞ্চে বসে থাকা একজন মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল।
–তোমার দেখা সেই আগের মেয়েটাই কী?
-না, অন্য একজন। টালাস একটু থামলেন, তারপর লাজুক হাসি হেসে বললেন, তিন ছেলে মেয়ের বাপ আমি..ঘরে স্ত্রী আছে…বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করে গেছি, কিন্তু নিজের মুখে আর কী বলব আপনাদের, মেয়েটার যা চাবুকের মতো দেহের গড়ন…এক লহমায় বুকের রক্ত যেন চলকে উঠল। আগে ওকে দেখিনি, বুইকের লোকটাকে দেখতে গিয়েই ওর দিকে দৃষ্টি পড়ল। দুজনের মধ্যে কী সব কথা হল।
–গাড়িটার নাম্বার প্লেট লক্ষ্য করেছিলেন?
-না স্যার,আবার পূর্বের সেই লাজুক হাসির ঝলক টালাসের মুখে।-সত্যি কথা বলতে কি, মেয়েটির রূপ যৌবন দুচোখ ভরে উপভোগ করতে গিয়ে গাড়িটার নাম্বার প্লেট দেখার কথা আমার মাথায় আসে নি। তবে এটুকু বলতে পারি গাড়িটা ছিল দুরঙা,লাল ও নীল। বছর দেড় দুইয়ের মতো পুরোনো হবে।
-আর সঙ্গের লোকটি?
লোকটি?গলা চুলকে টালাস আবার তার কথা শুরু করলেন, আন্দাজ ছফুট মতো লম্বা, চওড়া কাঁধ দুশো পাউন্ডের কম ওজন কখনোই হবে না। সুদর্শন, তামাটে মুখ, সোনালী চুল, সরু গোঁফ, মাথায় ব্রাউন রঙের স্ট্র হ্যাট, পরণে ফন কালারের সুট।
লোকটির বর্ণনা টালাসের মুখ থেকে শোনার পর বেইগলার সহসা নড়ে চড়ে উঠলেন। তার স্মৃতির দুয়ারে এই বর্ণনা যেন হালকা হলেও বেশ কয়েকবার করাঘাত করে গেল।
তিনি এতক্ষণ ধরে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন, এবার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, মিঃ টালাস! লোকটির মুখের চেহারায় আর কোন বিশেষত্ব ছিল যা আপনার চোখে ধরা পড়ে নি?
বিশেষত্ব বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না, তবে থুতনিটা ছিল চেরা কতকটা…এই ফিল্মস্টার ক্যারী গ্রান্টের মতন।
এই পর্যন্ত শুনেই বেইগলার উত্তেজিত হয়ে টেরেলের টেলিফোনটা টেনে নিয়ে রিসিভার তুলে একটু দম নিয়ে বললেন, কে ম্যাক্স? শোন, কিছুদিন আগে নিউইয়র্ক পুলিশ ফিল অ্যালগিরের যে ছবিটা আমাদের কাছে পঠিয়েছে, যত তাড়াতাড়ি পার সেটা পাঠিয়ে দাও।কুইক।তারপর রিসিভার রেখে টেরেলকে বললেন, আমার ভুলও হতে পারে তবে বর্ণনার অনেকটাই বহু খাপ খেয়ে যাচ্ছে ফিল অ্যালগিরের চেহারার সঙ্গে, চীফ। তাই একটা চান্স নিয়ে দেখতে ক্ষতি কী! মিঃ টালাস, ছবি আসতে আসতে আপনি ঐ দ্বিতীয় রমণীর চেহারার একটা বর্ণনা দিতে পারেন কি?
কেন পারব না বল? আমি খুব ভালভাবে দুচোখ ভরে তাকে দেখেছিলাম। লোকটি যদি ক্যারী গ্রান্ট হয় তো মেয়েটি ছিল মেরিলিন মুনরো। তবে কাঁচা বয়স,বছর ১৮/১৯…লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতন…চমৎকার দেহের শরীরী গড়ন, পরনে ছিল গাঢ় সবুজ রঙের সোয়েড জ্যাকেট আর কালো রঙের টাইট-প্যান্ট মাথায় ছিল সাদা রঙের হেডস্কার্ফ।
–সে এয়ারপোর্ট বাসে এসেছিল?
–হ্যাঁ। আমি যে মুহূর্তে পাম্পে এলাম আর সেও পদার্পণ করল বাস থেকে, তার পর এগিয়ে আসন সংগ্রহ করল বাস-টার্মিনাসের একটা বেঞ্চে।
ইতিমধ্যে জ্যাকবি ফিল অ্যালগিরের একখানা ছবি নিয়ে সেখানে হাজির হল।
ছবিখানা নিয়ে মিঃ টালাসের হাতে দিয়ে বেইগলার জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, এই সেই লোক। কিনা দেখে বলুন তো।
মনযোগ সহকারে দেখার পর টালাস জানালেন তার চিনতে এতোটুকু ভুল হয়নি, হ্যাঁ, এই সেই ব্যক্তি।
মিঃ টালাসকে সমাদরের সঙ্গে বিদায় দিয়ে টেরেল খুশী খুশী মনে বলে উঠলেন, এতক্ষণে আমরা একটু ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখতে পাচ্ছি। হেকে একবার ডাক জো।
হেস এলে তাকে টালাসের সব কথা পুনরুক্তি করে টেরেল বললেন, দ্বিতীয় মেয়েটার সম্বন্ধে একটু খোঁজ খবর নাও ফ্রেড। তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে নিশ্চয়ই নিউইয়র্ক ফ্লাইটে সে এখানে এসেছিল।
ফ্রেড, এই ব্যাপারে সবরকম খোঁজ খবরের দায়িত্ব আমি তোমাকে দিলাম। শুধু একটা কথাই। মাথায় ঢুকছে না, ফিল অ্যালগির জীবন ব্যাপী একজন প্রতারক থেকে হঠাৎ খুনীর জীবন বেছে নিল কেন?
মিয়ামি এয়ারপোর্টের এয়ার কন্ট্রোল অফিসে গিয়ে গতমাসের ১৭ তারিখের নিউইয়র্ক ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার্স লিস্ট চেক করতে করতে একটা নামের ওপর হেসের দু চোখের দৃষ্টি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুখ কঠিন, কুঁচকে গেল যুগল জ্ব। নামইরা মার্শ। তিনি ভাবতে লাগলেন :এটা কী কোন কাকতলীয় ব্যাপার? মুরিয়েল মার্শ…ইরা মার্শ…পদবীর ক্ষেত্রে এমন অদ্ভুত সব মিলের বহর..আত্মীয়তা আছে নাকি দুজনের মধ্যে?
তিনি এনকোয়ারিতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন ইরার সম্পর্কে। তারা জানাল : মেয়েটি ট্রাভেল করছিল একাকী। ঠিকানাও দেওয়া আছে : ৫৭৯, ইস্ট ব্যাটারি স্ট্রীট, নিউইয়র্ক।
ধন্যবাদ জানিয়ে এয়ার কন্ট্রোল অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন হেস। তারপর সোজা হেডকোয়ার্টার্সে। তার কাছ থেকে রিপোর্ট পাবার পর মিঃ টেরেলের মুখ হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, খোঁজ নাও ইরা মার্শ ডেভনের স্ত্রীর সম্পর্কে কোন আত্মীয় কিনা। এমনও হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে মিসেস ডেভনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের জন্য উপস্থিত হয়েছিল। একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে তা হল, সে ফিলের খপ্পরে পড়ল কীভাবে?
এমন সময়ে বেইগলার আর লেপস্কি হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন সে ঘরে। বেইগলার কিঞ্চিত উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, চী! একটা ব্যাপার ঘটে গেছে।
যে সব মেয়েরা অ্যাকিউট অ্যাসটিগম্যাটিজম চোখের রোগে কষ্ট পাচ্ছিল এবং তারজন্য ঐ। রকম পাওয়ারের লেন্স ব্যবহার করছে তাদের চশমায়–তাদের নামের লিস্টে আপনার বন্ধু মেল ডেভনের মেয়ে নোরেনা ডেভনের নামেরও উল্লেখ আছে।
কিন্তু টম জোর দিয়ে বলছে, গত এক মাসের মধ্যে কম করে হলেও পাঁচ/ছয় বার মিস ডেভনকে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছে বিনা চশমায়। আমি ওকে পাঠিয়ে ছিলাম ডঃ উইডম্যানের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায়ে। কারণ তিনি ঐ নামের লিস্ট পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে। সেখানে গিয়ে টম কী জানতে পেরেছে তা ওর মুখেই না হয় শুনুন।
বেইগলার চুপ করলে টম লেপস্কি বললেন, চী! ডাক্তার উইডম্যান জোর দিয়ে বলেছেন, নোরেনা ডেভন একজন উৎকট চক্ষুরোগের রুগীতার ডান চোখটা বা চোখের তুলনায় নাকি বেশী অ্যাফেকটেড।
টেরেল মুহূর্তের জন্য তার উত্মা প্রকাশ করে বলে উঠলেন, তোমরা যখন জানছ..দেখছ যে মিস ডেভন বহাল তবিয়তে এই শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে–তখন শুধু শুধু এই লোক দেখানো হয়রানির কী প্রয়োজন এসে উপস্থিত হয়েছিল এভাবে সময় নষ্ট করার?
লেপস্কি ধীরজ কণ্ঠে বললেন, সরি চীফ! আমি ভাবলাম ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটু গোলমালের গন্ধ পাচ্ছি। ডাক্তার লিখছেন নোরেনা ডেভন চশমা পরে কিন্তু আমি তাকে বিনা চশমাতেই চালকের আসনে বসে গাড়ি চালাতে দেখেছি। এ আবার কেমন ধারা কথা? ডাক্তারের রিপোর্ট, এই রোগের রুগী বিনা চশমায় অন্ধেরই সমান। অথচ
টেরেল কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকার পর বললেন, ঠিক আছে, টম আমি এ নিয়ে পরে আলোচনায় বসব মেল-এর সঙ্গে। তুমি আগে ফিল অ্যালগিরের ছবিটা নাও, হোটেলে হোটেলে সন্ধান কর তার। এখনও সে এই শহরের কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে কিনা খবর নাও চটপট।
লেপস্কি চলে যেতে টেরেল বেইল্লারকে বলে উঠলেন, আর তোমাকেও বলি জো, কী দরকার ছিল এইসব অদরকারী কাজে বৃথা সময় নষ্ট করার? আমার তো মনে হয়, এইসব বিশ্রী ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে সেই বুইক গাড়িটা নিয়ে তোমাদের একবার অনুসন্ধান করা খুব-ই উচিত ছিল।
–তারও সন্ধান নিয়েছি চী। ফিল অ্যালগিরই গাড়িটা ভাড়া করেছিল হ্যারী চেম্বার্স এই বেনামিতে।
–ঠিকানা পাওনি?
—হ্যাঁ, তাও পেয়েছিতবে ফল হয়নি কিছু। আজ সকালের দিকেই গাড়ি আর হোটেল সুইটের ভাড়া মিটিয়ে সে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। টেরেলের ভ্রূ যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত হল, নিজের ঘড়ি দেখে নিয়ে তারপর বললেন, আজ সকালে? তার মানে এখনও সে এই শহর ছেড়ে যায়নি। জো! তুমি চারদিকে ওর সন্ধানে লোক ছড়িয়ে দাও। রেডিও আর টিভিতে ওর চেহারার বর্ণনা আর ছবি দিয়ে ঘোষণার ব্যবস্থা করো।