টেকো আর কালো গুণ্ডাকে ছেড়ে দিয়ে ডিআইজি সেলিম তরফদার যে ভুল করেননি এটা তিনি তখন উপলব্ধি করলেন, যখন বনি বিনিকে ফিরে পাওয়ার আশা এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। ওদের বাবা মা অবশ্য বনি বিনির হারিয়ে যাওয়ার এক মাস পরও হাল ছাড়েননি। বাবা এর ভেতর দুবার চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। প্রত্যেকটা পাড়ায় দুবার, তিনবার করে ঘুরেছেন এই আশায় যদি কোথাও ছেলে মেয়ে দুটো ওঁর নজরে পড়ে। বায়েজিদ বোস্তামির মাজারে গিয়ে ভিখিরিদের দঙ্গলের ভেতরও ওদের খুঁজেছেন তিনি। রেল স্টেশন আর বন্দরে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছেন। ওদের ছবি হাতে নিয়ে একবার কক্সবাজার পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
বনি বিনির মা কখনো পীর ফকিরের কেরামতি বিশ্বাস করতেন না। পাড়ার মহিলারা এসে তাকে যখন বললেন, নয়াটোলার হুজুর আয়না পড়া জানেন। আয়না দেখে তিনি বলে দিতে পারবেন বনি বিনি কোথায় গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে মা ছুটলেন নয়াটোলার হুজুরের কাছে।
হুজুর কালি মাখা একটা আয়নায় কী দেখলেন তিনিই জানেন। বললেন, দুটো গরু জবাই করে সদকা দে বেটি । তোর ছেলেমেয়েদের খুব বিপদ!
মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওরা কোথায় আছে, কিসের বিপদ, দয়া করে বলুন।
হুজুর তখন ধ্যানে বসে গেছেন। মুরিদরা বললো, হুজুর এখন কারো সঙ্গে কথা বলবেন না। আপনি সদকা দিন। তিনি বাচ্চাদের জন্য দোয়া খায়ের করবেন।
পরদিন মা গাবতলিতে লোক পাঠিয়ে দুটো গরু কিনে এনে দরবারে দিয়ে এসেছেন। হুজুর একবার বলেন, ওরা একটা বন্ধ ঘরে আছে। একবার বলেন, ওরা ঘুমোচ্ছে। আবার বলেন, ওরা মা মা বলে কাঁদছে। এর বেশি কিছু বলেননি তিনি।
আরেক দিন এক প্রতিবেশী খবর আনলেন, মোহম্মদপুরে এক জিন্দা পীর এসেছেন বিহার শরীফ থেকে। তাঁর নাকি দুটো পোষা জ্বীন আছে। জ্বীনরা সব খবর এনে দিতে পারে।
প্রতিবেশী মহিলাকে নিয়ে মা তখনই ছুটলেন জ্বীন পোষা হুজুরের কাছে। সেই হুজুরও ঘাবড়াও মৎ! লাড়কি, লাড়কা জরুর মিলেগা, বলে ধ্যানে বসলেন।
মা বার বার কব মিলেগা, কঁহা মিলেগা, বলে কোনো উত্তর পেলেন না।
অমল কাকুরা মাত্র দুসপ্তাহের ছুটিতে এসেছিলেন। ছুটি ফুরোতেই ওঁরা কলকাতা ফিরে গেছেন। যাবার আগে রিনা কাকী আর মা গলা জড়াজড়ি করে সে কী কান্না! পঁয়ত্রিশ দিন পর ডিআইজি সেলিম বনি বিনিদের বাড়িতে এসে বাবা মাকে বললেন, আবদুল মালেকের সন্ধান পেয়েছি।
বাবা সেদিনই তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছেন। তাঁর গাল ভেঙে গেছে, চোখে অনেক দিন না ঘুমোনোর ক্লান্তি, চুল উসকো খুসকো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ের শার্টে ক্রিজ নেই–সেলিম তরফদারের কথা শুনে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন–কোথায়?
উত্তেজিত হোস নে। টেকো গুণ্ডা খবর এনেছে। ও কলুটোলা মসজিদে ইমামতি করতে দেখেছে আবদুল মালেককে।
অ্যারেস্ট করেছিস?
না। খবর পেলাম সন্ধ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে থানার ওসিকে আর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চকে বলেছি কী করতে হবে।
বাবা অসহিষ্ণু গলায় বললেন, প্লীজ সেলিম, ওকে অ্যারেস্ট কর! ও ঠিক বলতে পারবে আমাদের বনি বিনি কোথায়!
ডিআইজি সেলিম গম্ভীর হয়ে বললেন, ওকে দুদিন পর অ্যারেস্ট করা হবে। ওর গতিবিধির ওপরে নজর রাখা দরকার। কোথায় যায়, কার কাছে যায়, ওর কাছে কারা আসে এসব আগে জানা দরকার।
যদি ও পালিয়ে যায়?
আমার ওপর এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারিস। এবার ও আমার হাত থেকে পালাতে। পারবে না।
আমার বিনি, আমার বনি, বলে মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
দুদিন অপেক্ষা করেও গোয়েন্দারা আবদুল মালেক সম্পর্কে তেমন কোনো খবর দিতে পারলো না। লোকটা সারাদিনই মসজিদের পাশে ইমামের ঘরে থাকে। একটা ফুটফুটে চেহারার ছোকরা চাকর আছে। রান্না বান্না থেকে যাবতীয় ফুট ফরমাশের কাজ সেই করে। রাতে আবদুল মালেকের কামরায় ঘুমোয়। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষের সঙ্গে গত দুদিনে ওর যোগাযোগ হয়নি।
সেলিম তরফদার বললেন, ছোকরা যখন বাজার করতে যাবে তখন ওকে গ্রেফতার করার জন্য। দারোগা তাই করলেন। ছোকরাকে জেরা করে জানা গেলো, এই নতুন ইমাম এসেছে মাত্র পঁচিশ দিন আগে। বাইরে খুব কমই যায়। তবে গেলে কখনো গোটা রাতই বাইরে কাটায়। ফজরের ঠিক আগে ফিরে আসে। ইমামের কাছে কেউ আসে না। এমনিতে ইমাম লোক ভালো। ওকে অনেক আদর করে। আগের ইমামটা নাকি খুব খারাপ ছিলো। ছোকরাটা বছর দুয়েক ধরে এ মসজিদে ইমামের কাজের লোক হিসেবে আছে। মসজিদ কমিটি ওকে বেতন দেয়।
এরপরই গ্রেফতার করা হলো আবদুল মালেককে। প্রথমে ও কিছুই স্বীকার করেনি। আল্লাহর কসম বলে কোরাণ শরীফ ছুঁয়ে সে বলেছে জীবনেও সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলো না। বনি বিনি নামের কাউকেই সে চেনে না। টেকো কালো গুণ্ডাকেও চেনে না। থানায় জেরা করার সময় নিয়ম মাফিক যে সব মার দেয়া হয় তাতেও ওর কিছু হয়নি। প্রথমে যা বলেছে, অনেক মারার পরও তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
শেষে টেকো আর কালোকে ওর সামনে হাজির করতেই পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেলো। দারোগা প্রথমে মোলায়েম গলায়ই বলেছিলেন, আবদুল মালেক সাহেব, দেখুন তো এই দুজন লোককে চেনেন কি না?
এক ঝলকের জন্য টেকো কালোকে দেখে মাথা নিচু করে আবদুল মালেক বলেছে, না, ওদের চিনি না।
এ রকম জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা শুনে টেকোর চোখ কপালে উঠলো। কালোকে বললো, আবে কাউলা, হুজুর হালায় কয় কী? আমগোরে বলে চিনে না? অই হুজুর, গত মাসে ক্যাঠায় আমাগো তিরিস হাজার টাকা দিছে? ক্যাঠায় কইছে বনি বিনিরে ম্যালার থনে উঠায়া টেরেনে কইরা পাহাড়তলী দিয়া আইতে?
মিথ্যা কথা! ঘাড় মোটা করে বললো আবদুল মালেক।
টেকো গুণ্ডা এবার রেগে গেলো। একটা কুৎসিৎ গালি দিয়ে বললো, শরম করে না, দাড়ি রাইখা মিছা কতা কইতে! আবার বলে মজ্জিদে ইমামতিও করে! আমার লগে বেসি তেরিবেরি করবা না। সিদা সিদা কও কলতা বাজারে আমার ঘরে গিয়া তিরিস হাজার ট্যাকা দিয়া আহ নাই? মোড়ের ইসকান্দর পানঅলারে তুমি আমার নাম ঠিকানা জিগাও নাই?
এরপর টেকো থানার দারোগাকে বললো, স্যার এমনে ওইবো না। দস নম্বরি দসটা নখের ভিতরে হান্দায়া দ্যান। দ্যাখেন, বাপ বাপ কইরা কবুল করবো।
দশ নম্বর সূচ মাত্র আনা হয়েছে–নখে ঢোকাবার আগেই মুখ খুললো আবদুল মালেক। গড় গড় করে পুরো ইতিহাস বলে গেলো রোবটের মতো।
একাত্তরে ও আলবদর ছিলো ঠিকই এবং বাহাত্তরে গ্রেফতারও হয়েছিলো। জেল থেকে বেরিয়ে আর পার্টি করেনি, ছোট খাট ব্যবসা নিয়ে ছিলো। বছর দুই আগে ওকে খবর দেয়া হলো একাত্তরের আল বদর বাহিনী আবার গঠন করা হচ্ছে। পুরোনোদের ভালো বেতন দেয়া হবে। কয়েক বছর ধরে ওর ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিলো। তাই নতুন করে আবার নাম লিখিয়েছে আল বদরে। এবারের সংগঠন পুরোপুরি গোপন। কারা আছে কিছুই সে জানে না। তার সঙ্গে একজন মাত্র যোগাযোগ রাখে। কী করতে হবে বলে। মাসের পয়লা তারিখে বেতনের টাকাটা হাতে ধরিয়ে দেয়।
দলের নির্দেশেই আবদুল মালেক বনি বিনিকে চুরি করেছে। ওর কাজ ছিলো ওদের পাহাড়তলী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। টেকো আর কালোকে এ জন্য সে ভাড়া করেছিলো। ওদের দলের নেতারা আরব দেশে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পাঠানোর ব্যবসা করে। বেশি ছোটদের উটের দৌড়ে ব্যবহার করা হয়। একটু বড়রা শেখদের বাড়িতে নফর আর বাদী হিসেবে থাকে। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের বাদীদের খুব চাহিদা আছে আরব শেখদের বাড়িতে। মেয়ে হিন্দু, খৃস্টান হলেও ক্ষতি নেই, তবে ছেলেদের অবশ্যই মুসলমান হতে হবে।
শেষ চালান মাশকাত যাওয়ার কথা। মাশকাতে আবার ভদ্রলোকদের ছেলে মেয়েদের চাহিদা বেশি। ওরা সবাই যে মাশকাত থাকবে তা নয়। ওখানে অন্য সব আরব দেশের শেখরাও ছেলে মেয়ে কিনতে আসে।
আবদুল মালেক যতটুকু তথ্য দিয়েছে তার ভিত্তিতে সেলিম তরফদার প্রথমে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের পুলিস ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এক থেকে দেড় মাস আগে ইন্ডিয়া থেকে একশ আশি জন ছেলে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে, আর পাকিস্তান থেকে পঁয়ত্রিশ জন। এদের বয়স তিন থেকে বারোর মধ্যে। এরা সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে, এদের চেহারাও সুন্দর। ডিআইজি সেলিম তাঁর আশঙ্কার কথা জানালেন ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের পুলিস ডিপার্টমেন্টকে। সবাই মিলে ঠিক করলেন তারা এ ব্যাপারে ইন্টারপোলের সাহায্য নেবেন। আরো ঠিক করলেন প্রত্যেকে তাঁদের একজন তুখোড় গোয়েন্দাকে গোপনে মাশকাত পাঠাবেন। মাশকাতে তিন দেশের দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলবেন।
আরব শেখরা উটের দৌড়ে বাচ্চাদের ব্যবহার করে–এ খবর পশ্চিমের সাংবাদিকরা এর আগেই জেনেছিলো। ইউরোপ আমেরিকায় বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে এ ধরনের অমানবিক ঘটনার প্রতিকার করা। পশুদের কষ্ট দূর করার জন্যও পশ্চিমে অনেক সংগঠন আছে। আর মানুষের বাচ্চাদের এরকম অমানুষিকভাবে খুন করা হবে, এটা ওদের ধারণার বাইরে। গরিব দেশগুলোর বিপদ হচ্ছে তাদের অনেকে আরব দেশের টাকার ভরসায় বাজেট করে। সে জন্য ওরা শেখদের এসব অত্যাচারের কথা জেনেও না জানার ভান করে।
বিনিদের যে শেখের বাড়িতে আনা হয়েছিলো রেস খেলার জন্য ওর দশটা উট আছে। শহরের পশ্চিম সীমানায় বিশাল প্রাসাদ ওর। শিকারী বাজ পাখি আছে ডজন খানেক, তেজী ঘোড়া আছে পনেরোটা আর বিয়ে করা বিবি চৌদ্দটা। চৌদ্দ বিবি থাকে প্রাসাদের চোদ্দ মহলে, ওদের বাদী আর খেদমতগারের কোনো হিসেব নেই। শেখের বড় বিবির ছেলে মেয়ে নেই, তাই ও বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের চারটা ছেলে মেয়ে পুষ্যি নেবে ঠিক করেছিলো। মালয়েশিয়ারটা আগেই জোগাড় হয়ে গিয়েছিলো। নতুন চালানে বাকি তিন দেশের তিনটা এসেছে। ওরা সবাই একই জাহাজে মাশকাত এলেও আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছিলো বলে আগে পরিচয় হয়নি।
বিনির সঙ্গে মালয়েশিয়ার ফাতিমা, ইন্ডিয়ার আফজাল আর পাকিস্তানের দিবার পরিচয় হয়েছে শেখের বাড়িতে বড় বিবির এক নম্বর মহলে। বড় বিবির সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ওদের রাখা হয়েছিলো মহলের একটা ছোট কামরায়। ফাতিমা এসেছে দুদিন আগে। ওকেই বিনি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, ওদের এখানে কেন আনা হয়েছে ও কিছু জানে কি না।
ফাতিমা বয়সে বিনির বছর দুয়েকের বড় হবে। বললো, শুনেছি শেখের বড় বিবির বাদী বানাবে আমাদের।
তুমি দেখেছো বড় বিবিকে?
না, আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে।
এখানকার লোক জনের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে? ওরা কেমন?
আমাকে এক বয়স্ক মহিলা খাবার দিয়ে যায়। খুবই বদমেজাজী। সারাক্ষণ সবাইকে গালাগালি করে। আমার সঙ্গেও সব সময় ধমক দিয়ে কথা বলে।
মহিলা কোন দেশের?
সম্ভবত পাকিস্তানের। ইন্ডিয়ারও হতে পারে। আরবি ছাড়া উর্দু বলতে পারে।
তুমি আরবি বলতে পারো?
হ্যাঁ পারি? তুমি?
আমিও কিছু কিছু পারি।
আফজাল আর দিবা উর্দু আর ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না। বিনি ওদের শিখিয়ে দিলো বিপদে কাজ চালাবার মতো কয়েকটা আরবি কথা। জাহাজে তানিয়াদের সঙ্গে পালাবার যে পরিকল্পনা করেছিলো ফাতিমাদের সব খুলে বললো। ফাতিমা বললো, তুমি ভালো বুদ্ধি বের করেছে। যেভাবেই হোক আমাদের এখান থেকে পালাতেই হবে।
তার আগে কয়েকদিন এদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে জানতে হবে আমাদের সঙ্গে অন্য যারা এসেছে ওদের কোথায় রাখা হয়েছে।
বিনির কথা শুনে দশ বছরের আফজাল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বিনি জিজ্ঞেস করলো, কাঁদছো কেন আফজাল, কী হয়েছে?
কাঁদতে কাঁদতে আফজাল বললো, আমার সঙ্গে ওরা আমার চার বছরের ছোট বোন সীমাকেও ধরে এনেছে। বন্দরে ওকে যখন আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ও খুব কাঁদছিলো।
আফজালের পিঠে হাত রেখে বিনি বললো, ভাইয়া কেঁদো না। ওরা আমার ছোট ভাই বনিকেও আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। ওদের উদ্ধার না করে আমরা দেশে ফিরে যাবো না।
আফজাল আর বিনির কথা শুনে ফাতিমা দিবার চোখেও পানি এসে গেলো। দিবা বললো, বাড়িতে আমার একটা ছোট বোন আছে। আমাদের মা নেই। ছোট বোনটা আমাকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে চায় না।
ফাতিমা বললো, আমরা যদি এখান থেকে পালাতে না পারি বিষ খেয়ে মরবো।
ম্লান হেসে দিবা বললো, এখানে কে তোমাকে বিষ দেবে?
আমার সঙ্গে আছে। গলায় ঝোলানো লকেটটা দেখিয়ে ফাতিমা বললো, আমাদের বংশের নিয়ম মেয়েরা বড় হলে সব সময় বিষ রাখে সঙ্গে। বিপদে পড়লে ইজ্জত বাঁচাবার জন্য ওরা বিষ খেয়ে মরে।
বিনি বললো, আমরা মরবো না ফাতিমা। আমরা ওদের মারবো। বিষটুকু সাবধানে রাখো। এ নিয়ে আর কিছু বোলো না। মনে রাখবে আমরা শত্রু পুরিতে আছি।
.
০৮.
শেখ আবদুল খালেক বিন মোত্তালেবের বড় বিড়ি জোহরা খাতুন সন্ধ্যেবেলা নিজের খাস মহলে বসে তখন ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখছিলো। ছবি হিন্দি হলেও আরবি সাব টাইটেল ছিলো। নতুন চারটা ছেলে মেয়েকে তার কাছে সামনে হাজির করে বলা হলো এই চালানের সেরা মাল এগুলো।
তীক্ষ্ণ চোখে আপাদমস্তক ওদের দেখে জোহরা খাতুন বললে, খালি চেহারা সুরত ভালো হলে তো চলবে না, আদব কায়দা জানে কি না সেসব দেখতে হবে।
বাঁদী নুসরাত বললো, এরা সবাই ভালো খানদানের ছেলে মেয়ে।
এ্যাই তোদের নাম কী? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানতে চাইলো জোহরা খাতুন।
ওরা সবাই নাম বললো। বিনি আর দিবা নাম দুটো জোহরা খাতুনের পছন্দ হলো না। বললো, এসব নাসারা নাম আমি শুনতে চাই না। বিনির দিকে আঙুল তুলে বললো, তোর নাম খোদেজা। তারপর দিবাকে দেখিয়ে বললো, তোর নাম জোলেখা। ঠিক আছে?
বিনি আর দিবা মাথা নেড়ে সায় জানালো। বাঁদী নুসরাতের দিকে তাকিয়ে জোহরা খাতুন বললো, এগুলোকে এখন নিয়ে যা। আরবি শেখানোর ব্যবস্থা কর। আর গান্ধা পোশাক পরে আমার সামনে যেন না আসে।
তাই হবে বিবি সাহিবান! বলে নুসরাত ওদের চারজনকে জোহরা খাতুনের খাস মহল থেকে বের করে নিয়ে গেলো।
ওদের চারজনের জন্য একটা কামরা দেয়া হয়েছে। নুসরাত বললো, তোমাদের পুরোপুরি তৈরি করা হলে প্রত্যেককে আলাদা কামরা দেয়া হবে।
কী ভাবে আমাদের তৈরি করা হবে? জানতে চাইলো দিবা। নুসরাত ওদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলছিলো।
প্রথমে ভাষা শেখানো হবে। তারপর বিবিজির যত্ন কেমন করে নিতে হবে, কী ভাবে বিবিজির মন ভালো করা যাবে, সে সব আস্তে আস্তে শেখানো হবে।
আমরা কি বিবিজির বাঁদী?
ঠিক বাঁদী নও। কারণ তোমাদের কাজ করার জন্য লোক থাকবে। তবে বিবিজির কাছে তোমরা বাদীর মতোই। তিনি যা হুকুম করবেন তোমাদের মুখ বুজে তামিল করতে হবে। এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো নুসরাত। কী মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়ালো। বললো, সব সময় মনে রাখবে তোমরা হলে বড় বিবিজির বড় মহলের বাসিন্দা। অন্য মহলের বাসিন্দারা আমাদের হিংসা করে। ওদের সঙ্গে কক্ষণো কথা বলবে না। বড় বিবিজি জানতে পারলে জানে মেরে ফেলবেন।
নুসরাত চলে যাওয়ার পর ফাতিমা বললো, আগের মহিলার চেয়ে নুসরাতকে ভালো মনে হচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে ও বিবির খুব বাধ্য।
বিনি বললো, দুতিন দিন যাক। তারপর দেখ না নুসরাত বিবিকেও পটিয়ে ফেলবো।
ওর কথা শুনে সামান্য হেসে দিবা বললো, বড় বিবির চেহারা দেখেই ঘেন্না হচ্ছে আমার। যেন একতাল পচা মাংসের পিণ্ড। ওর থাকা উচিৎ ছিলো ডাস্টবিনে!
আফজাল বললো, আমি ওর কাছে ছিলাম। তোমরা টের পাওনি। কথা বলার সময় ভক ভক করে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিলো ওর মুখ দিয়ে।
দিবা ফোড়ন কাটলো-বদমাশটা বলে কি না আমরা গান্ধা!
বিনি বললো, নুসরাত যাওয়ার সময় যে কথাটা বলে গেলো এ নিয়ে কিছু ভেবেছো?
কোন কথা? অন্য মহলের লোকরা এ মহলের লোকদের হিংসা করে।
হ্যাঁ!
হিংসা তো করতেই পারে। দিবা বললো, আমাদের ভারি দায় পড়েছে অন্য মহলের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে!
বিনি গম্ভীর হয়ে বললো, আমি ঠিক এর উল্টোটা বলতে চাই।
ফাতিমা একটু অসহিষ্ণু হয়ে বললো, কী বলবে খুলে বলো না!
শোন সবাই। অন্য মহলের লোকরা বড় বিবিকে পছন্দ করে না। আমরাও করি না। আমাদের এই পছন্দের কথাটা ওদের কোনো ভাবে জানাতে হবে। ওরা যদি বড় বিবিকে। জব্দ করতে চায় আমাদের পালাবার সুযোগ করে দিক। অন্য মহলে আমাদের বয়সী যদি কাউকে দেখো, ভাব জমাবার চেষ্টা করো। আমার ধারণা এতে কাজ হবে।
ফাতিমা ওকে সমর্থন করলো বিনি, ঠিকই বলেছো। নুসরাতকে দিয়ে কাজ হবে না। আমাদের অন্য মহলের বাসিন্দাদের সাহায্য নিতে হবে। দেখতে হবে বড় বিবির ওপর কার রাগ বেশি।
আফজাল বললো, অন্য মহলে সেরকম যদি বন্ধু খুঁজে পেলে সীমা বনিদের খবরও ওরা এনে দিতে পারে।
বিনি বললো, সীমা বনির খবর না নিয়ে আমরা এখান থেকে বেরোচ্ছি না।
বনিদের রাখা হয়েছিলো শেখ আবদুল খালেক বিন মোত্তালেবের বড় ভাই শেখ আবদুল জালাল বিন মোত্তালেবের প্রাসাদে। শেখ জালালের প্রাসাদ এর চেয়েও বড়। তার বিবির সংখ্যা ষোল, রেসের উট পঁচিশটা, বাজ পাখি একুশটা আর ঘোড়া পঞ্চাশটা। ষোল বিবির ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেয়াল্লিশটা, যাদের ভেতর ছেলের সংখ্যাই বেশি।
দুই প্রাসাদের ছেলেমেয়ের চাকর নফরদের মধ্যে যাতায়াত থাকলেও রেষারেষিও কম ছিলো না। আবদুল মালেকদের দল দুই শেখকেই তোয়াজ করে পয়সা আদায় করে। ওদের দলের নেতারা গিয়ে বলে, শেখরা দয়া না করলে বাংলাদেশের গরিব মুসলমানরা না খেয়ে মরে যাবে, গির্জার পাদ্রী আর এনজিওরা ওদের খৃস্টান বানিয়ে ফেলবে–এমনি সব বানানো কথা! এক শেখ বলে, আমাদের কোরবানির উট আর দুম্বার গোশত পাইয়ে দেবো তোমাদের। আরেক শেখ বলে, ভালো ভালো বাচ্চা পাঠাও আমাদের রেসের জন্য। তোমাদের পার্টি চালাবার পুরো খরচ আমরা দেবো।
আগের চালানের দুটো ছেলে কোন ফাঁকে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো, সেজন্য শেখ জালালের প্রহরীরা বনিদের হাত বেঁধে দিয়েছে। বনিকে যে ঘরে রাখা হয়েছে সেখানে আরো সাতজন ছেলে ছিলো। দুজন ওর বয়সী, অন্যরা চার থেকে ছয় বছরের। পাকিস্তানী ছেলে ইমরান এখানে আসার পর থেকে সামনে কাঁদছে। বেচারা উর্দু ছাড়া কিছু বলতে পারে না, বনি উর্দু বুঝলেও বলতে পারে না। ও ছাড়া অন্য ছেলেরা উর্দু বলতে পারে। ওরা সবাই ছিলো ইন্ডিয়ান।
এখানে এসে বনিরও প্রথম দিকে খুব মন খারাপ ছিলো বিনির জন্য। প্রথমে কারো সঙ্গে কথা বলেনি। ওর অল্প বড় ইন্ডিয়ার আসলাম ভালো ইংরেজি বলতে পারে । আসলামই ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, মেয়েদের মতো কান্নাকাটি করলে চলবে না। এখান থেকে কী ভাবে পালানো যায় এসো সেই প্ল্যান করি।
জাহাজে বসে বিনি যেভাবে পালাবার কথা বলেছিলো বনি সেটা আসলামদের বললো। আসলাম বললো, হ্যাঁ এটা খুব ভালো আইডিয়া। এসো, আমরা সবাই মিলে আবার কথাগুলো মুখস্ত করে ফেলি। আমি আমার নাম দেশের কথা বলবো, এভাবেইস মী আসলাম। আনা আসকুন ফিল ইন্ডিয়া। বনি, ওরা আরবিতে ইন্ডিয়াকে অন্য কিছু বলে নাতো?
জানি না। ইন্ডিয়া বললেও বুঝবে। ইমরান তুমি বলতে কীভাবে বলবে?
ইমরান প্রথমে বলতে পারলো না। কয়েক বার বলার পর সেও শিখে নিলো–ইস মী ইমরান। আনা আসকুন ফিল পাকিস্তান।
অন্য যারা ছিলো ওরাও বনির শেখানো আরবি কথাগুলো মুখস্ত করে ফেললো। বনি বললো, আমরা যে এসব কথা জানি শেখদের লোকরা যেন টের না পায়।
বনির কথা শেষ না হতেই দরজা খোলার শব্দ হলো। আরবদের পোশাক পরা দুই পাকিস্তানী এসে ঘরে ঢুকলো। চেহারা দেখে বনিরা অবশ্য আরবই ভেবেছিলো। ওরা যখন পশতু টানে উর্দু বললো তখন আসলাম বুঝে ফেললো ওরা পাকিস্তানী । ওদের একজনের মুখ চ্যাপটা আরেকজনের মুখ লম্বা। দুজনের চোখেই কালো চশমা।
চ্যাপটা মুখ কফ মেশানো ঘড়ঘড়ে গলায় জানতে চাইলো, এখানে তোমাদের ভেতর পাকিস্তানের কোনো ছেলে আছে?
ইমরান ওদের দেখেই ভয়ে ফোঁপাচ্ছিলো। আসলাম ওকে দেখিয়ে বললো, ওর নাম ইমরান। ও পাকিস্তানী।
ইমরান পাকিস্তানী শুনে লম্বমুখোর মায়া হলো। ইমরানের পাশে বসে আদর করে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, তুমি কাঁদছো কেন ইমরান। পাকিস্তানী ছেলেরা খুব বাহাদুর হয়। হিন্দুস্তানীদের মতো বুজদিল নয়।
লম্বামুখোর কথা শুনে আসলামের খুব রাগ হলেও মুখে কিছু বললো না। ইমরান ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, আমি আমার আব্দু আম্মির কাছে যাবো।
লম্বামুখো উঠে চ্যাপটামুখের কাছে গিযে চাপা গলায় বললো, একে শেখ বশীরের বাড়ি থেকে বদলে আনা যায় না? এখানে থাকলে শিগগিরই মারা পড়বে।
দু এক দিন যেতে দাও। চেষ্টা করলে হয়তো পারা যাবে। চিন্তিত গলায় চ্যাপটামুখো বললো, শেখ জালাল যদি টের পায়, আমাদের তলোয়ার দিয়ে এক কোপে দু টুকরো করে ফেলবে।
আসলাম লম্বমুখোকে বললো, চাচা, আমাদের কি শিগগিরই মেরে ফেলা হবে?
লম্বমুখো চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তোরা নোংরা হিন্দুস্তানী! তোদের যদি এক্ষুণি মেরে ফেলতো, আমি খুশি হতাম।
বনিকে দেখিয়ে আসলাম বললো, ও হিন্দুস্তানের নয়, বাংলাদেশের।
আগের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে লম্বমুখো বললো, হিন্দুস্তান আর বাংলাদেশ দুটোই আমার কাছে এক! পাকিস্তান ভেঙেই তো বাংলাদেশ বানিয়েছে হিন্দুস্তান।
চ্যাপটামুখো তার সঙ্গীকে বললো, চলো, মিটিঙে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের চামচারা এসেছে শেখ জালালের টাকা খসাবার জন্য।
আগের মতো দরজা বন্ধ করে চলে গেলো চ্যাপটামুখো আর লম্বমুখো দুই পাকিস্তানী। ওরা বেরিয়ে যেতেই দাঁতে দাঁতে চেপে আসলাম বললো, শয়তান! যদি হাতটা ভোলা থাকতো তাহলে বুজদিল বলার মজা টের পাইয়ে দিতাম।
বনি বললো, রাতে খাবার সময় ওরা নিশ্চয় হাত খুলে দেবে। তখন বলবো আর যেন হাত না বাঁধে।
আসলাম বললো, এ কথাটা ইমরান বললে ভালো হয়। ও পাকিস্তানী শুনে ওদের প্রাণে ওর জন্য দয়া হয়েছে। কী ইমরান, বলতে পারবে না ভাইয়া?
ইমরান মাথা নেড়ে সায় জানালো–হ্যাঁ, পারবো।
রাতে লম্বমুখোই ওদের খাবার নিয়ে এলো। রুটি আর দুম্বার কাবাব। সবার আগে ও ইমরানের হাত খুলে দিলো। তারপর অন্য সবার হাত খুলে বললো, ঝটপট খেয়ে নাও। আমার অন্য কাজ আছে।
ওদের সবারই খুব খিদে পেয়েছিলো। পেট ভরে ওরা রুটি কাবাব খেলো। যদিও এরকম শক্ত রুটি বনি ওদের বাড়িতে থাকলে ছুঁয়েও দেখতো না। এমনকি ছোট ইমরানও দুটো রুটি খেলো।
খাওয়া শেষ করার পর লম্বামুখো যখন আগের মতো দড়ি দিয়ে ওদের হাত বাঁধতে যাবে ইমরান কেঁদে ফেললো–চাচা, আপনার আল্লার কসম! আমাদের এভাবে বাঁধবেন না। আমাদের খুব তকলিফ হয়।
লম্বামুখো একটু ভেবে বললো, ঠিক আছে, তুমি সবার ছোট, তোমারটা আমি বাঁধবো না। অন্য সবাই খুব পাজী আছে। ওদের হাত বাঁধবো। এই বলে প্রথমেই ও আসলামের হাত বাধলো।
ইমরান বললো, এরা সবাই খুব ভালো চাচা। আমাকে ওরা খুব আদর করে।
ওর কথায় কোনও কাজ হলো না। লম্বামুখো বাকি সবার হাত শক্ত করে বেঁধে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বললো, চুপচাপ ঘুমাবে। কোনো রকম শয়তানি করলে পাশে আমাদের জুলুমখানা আছে! ওখানে ঢুকিয়ে দিলে জীবনে আর ভুলেও বেচাল হবে না।