০৭.
টুপুর আর মিতিন বাসন্তী পৌঁছোল সকাল নটা নাগাদ। পথে অনেকবার যান বদল করতে হলেও কষ্ট হয়নি বিশেষ। কাল ঝড়বৃষ্টি হয়ে সকালটাও আজ বেশ মনোরম। ফুরফুরে হাওয়া বইছে, যেন বসন্তকাল।
ঘাটে নেমে টাটকা মেজাজে সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল মাসি-বোনঝি, কাছাকাছি এসে হঠাৎই হকচকিয়ে গেছে দুজনে। গেটের সামনে অত ভিড় কেন? কীসের এত গুলতানি হচ্ছে? কী ঘটল রে বাবা?
জটলার সামনে আসতেই দু-চারটে বাক্য উড়ে এল টুপুরের কানে।
আহা, বেঘোরে মারা গেল রে বেচারা! একেই বলে মা মনসার লীলা, বুঝলে! দিনরাত যে সাপের সেবা করে, তাকেই কিনা সাপের ছোবল খেতে হল!
বড় ভাল ছিল গো ছেলেটা? কী মিষ্টি ব্যবহার, সদাসর্বদা হাসিমুখ…।
নিয়তির লিখন হে, নিয়তির লিখন! কার কপালে কীভাবে যে মৃত্যু থাকে!
টুপুর আর মিতিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। টুপুর অস্ফুটে বলল, কাকে সাপে কেটেছে? নীলাম্বরদাদাকে?
মিতিন নিচু গলায় বলল, তাই তো মনে হচ্ছে।
স্থানীয় মানুষদের কিছু জিজ্ঞেস করল না মিতিন। ভিড় পেরিয়ে, গেট টপকে ঢুকে পড়ল কম্পাউন্ডের ভিতরে। তখনই চোখে পড়ল নীলাম্বরের কাদামাখা দেহটাকে আমগাছের তলায় শোয়ানো। পরনে হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। চার-পাঁচটা অল্পবয়সি ছেলে বসে আছে মৃতদেহের পাশে।
টুপুরের বিশ্বাস হচ্ছিল না। আটচল্লিশ ঘণ্টাও হয়নি যার সঙ্গে অত গল্প করে গেল, কালও যার খবর পেয়েছে, আজ আর সে নেই? এই লোকটাকে নিয়েই না কাল রাতে তারা কত জল্পনাকল্পনা করেছে।
ঘোর-লাগা পায়ে মিতিনের সঙ্গে আমগাছের কাছে এগোচ্ছিল টুপুর। একটা কুড়ি-একুশ বছরের ছেলে নীলাম্বরের পাশ থেকে উঠে এল আচমকা। থমথমে গলায় মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, দিদি, আপনারা তো পরশুই এসেছিলেন, তাই না?
হুঁ। মিতিন আপাদমস্তক জরিপ করল ছেলেটাকে। ভারী গলায় বলল, কেন বলুন তো?
না… আপনাদের সেদিন দেখেছিলাম… সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন…
আপনার পরিচয় কিন্তু এখনও পাইনি।
আমি রতন। রতন হেনরি মণ্ডল। এই তো, সামনেই চার্চে কাজ করি। নীলাম্বরদা আমাদের চার্চে খুব যেত। ফাদার, ব্রাদার সকলের সঙ্গেই পরিচয় ছিল নীলাম্বরদার। আমরা প্রত্যেকেই এই দুর্ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি।
ও। মিতিন স্থির চোখে তাকাল, তা দুর্ঘটনাটা ঘটল কখন?
মনে হয় শেষ রাতে। কিংবা কাকভোরে। রতনের স্বর ধরাধরা, চার্চের পিছনভাগে গাঙের পারে পড়ে ছিল দেহটা। প্রথম দেখতে পান ফাদার ম্যাথু। তখন সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছটা হবে। রোজকার মতো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন, তখনই… ঘাবড়ে গিয়ে ফাদার চেঁচামিচি শুরু করে দেন। আমরাও পড়িমরি করে গিয়ে দেখি, উপুড় হয়ে পড়ে আছে নীলাম্বরদা।
তখনও কি প্রাণ ছিল?
না দিদি। শরীর তখনই বরফের মত ঠান্ডা। মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে।
তা সাপে কেটেছে বুঝলেন কী করে?
ডান গোড়ালিতে দাঁতের দাগ আছে দিদি। নীলাম্বরদার স্যার তো দেখে বললেন চন্দ্রবোড়া।
পুলিশে খবর দিয়েছিলেন?
ফাদার তো তখনই চার্চ থেকে ফোন করলেন থানায়। আর আমি ছুটে এলাম এ-বাড়ির স্যারকে খবর দিতে। উনি তখন ঘুমাচ্ছেন। খবরটা শুনে উনি প্রথমটা তো একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আমিই স্যারকে প্রায় ধরেধরে গাঙপারে নিয়ে গেলাম। বড় ভেঙে পড়েছেন স্যার। কান্নাকাটি করছেন।
কথার মাঝেই নীলাম্বরের পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছে মিতিন।
পরখ করছে পায়ের ক্ষতটাকে দেখতে দেখতেই জিজ্ঞেস করল, এখানে বডি আনল কে? পুলিশ?
সঙ্গে পুলিশের লোক ছিল। তবে আমরাই ধরাধরি করে…
ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া গিয়েছে?
চেম্বার খুললে ডাক্তারবাবু গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছেন।
কোন ডাক্তার? কোথায় চেম্বার?
সামন্ত ডাক্তার। ফেরিঘাটের কাছেই বসেন। বাজারটায়।
নীলাম্বরের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে?
পুলিশ মেসেজ পাঠিয়েছে। স্যারও বোধহয় ফোন করেছেন ন্যাজাটে। নীলাম্বরদার বাপ-দাদা এসে দেহ দাহ করবে। নীলাম্বরদার এক মেসো আছে সুধন্যখালিতে, তার কাছেও লোক চলে গিয়েছে। রতন নাক টানল, কী একটা বাজে ব্যাপার হয়ে গেল বলুন তো দিদি। নীলাম্বরদার রোজগারপাতির উপরে বাড়ির লোকরা অনেকটা ভরসা করে থাকত, ওরাও কী বিপদে পড়ে গেল ভাবুন।
মিতিন উঠে পড়ল। শুকনো গলায় বলল, সে আর কী করা যাবে! দুর্ঘটনার ওপর তো কারও হাত নেই।
রতন নিচু স্বরে বলল, একটা কথা বলব দিদি? কী? স্যারের সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই খুব চেনাজানা। স্যারকে একটু বলবেন,নীলাম্বরদার ফ্যামিলির কথাটাও তিনি যদি একটু ভাবেন…
বলব।
আর কথা না বাড়িয়ে টুপুরকে নিয়ে মোরাম বিছানো পথ পার হল মিতিন। বারান্দায় উঠে খানিক ইতস্তত করে ঢুকে পড়েছে অন্দরে।
সুমন্ত্ৰ সান্যাল বাইরের ঘরেই ছিলেন। সোফায়। পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ থেকে হাত সরিয়েছেন। ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, একী? আপনারা? কী করে খবর পেলেন?
মিতিন ঠান্ডা গলায় বলল, হঠাৎই কিছু কৌতূহল নিরসনের জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখি এইসব কাণ্ড ঘটে বসে আছে।
বিস্ময়টাকে যেন খানিকটা সামলে নিলেন সুমন্ত্ৰ। কষ্টের গলায় বললেন, তাই বলুন। আমি তো ভাবছিলাম এ দেশের পুলিশ ডিটেকটিভ এত প্রমপ্ট হল কবে থেকে, যে মানুষ মরতে না-মরতে কলকাতা থেকে বাসন্তী পৌছে গেল! ..বসুন।
সোফায় বসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মিতিন। তারপর মৃদু গলায় বলল, শুনলাম আপনি খুব ভেঙে পড়েছেন…
হুঁ। সুমন্ত্ৰ একটা শ্বাস ফেললেন, ছেলেটা আমার বড় আপন হয়ে গিয়েছিল। ওকে আমি নিজের ভাইয়ের মতো দেখতাম।
বুঝতে পারছি। মিতিন সামান্য ঝুঁকল, আমি কি আপনাকে একটা-দুটো প্রশ্ন করতে পারি? অ্যাবাউট দিস মিসহ্যাপ?
করুন।
নীলাম্বর ভোরবেলা হঠাৎ পুরন্দরের ধারে গেল কেন?
কী জানি, আমিও তো ভেবে পাচ্ছি না। আমি বরাবরই লেট রাইজার। অনেক রাত অবধি জাগি তো, সাড়ে সাতটা-আটটার আগে ঘুমই ভাঙে না, সুমন্ত্ৰ গলা ঝাড়লেন, তবে নীলাম্বর খুব সকাল সকালই উঠত। ঘরের টুকটাক কাজকর্ম সারত, বাগানের দেখভাল করত…. কে জানে, হয়তো রাস্তাঘাটে একটু হেঁটেও আসত। কিংবা হয়তো আজই বেরিয়েছিল নিয়তির টানে।
হুঁ, বড় প্যাথেটিক ডেথ।
আমার মনটাও রিয়্যালি ডিস্টার্বড হয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। ভাবছি এখানে আর কাজকর্ম করব না। ওই যে অ্যাস্ট্রোলজির ভাষায় কী যেন বলে… এখানে শনির দশা লেগেছে। একের পর এক মিসহ্যাপ। প্রথমে আমার কুকুরটা গেল, তারপর কোথা থেকে কিছু নেই হঠাৎ চোরের উৎপাত, আর লাস্টলি এই নীলাম্বর। দিস ইজ টু মাচ। বেটার আই শুড গো ব্যাক টু মিশিগান এগেন। দেশের মাটিতে বসে দেশের জন্য কাজ করা আমার কপালে নেই। মিশিগানেই আমি প্রোজেক্ট কমপ্লিট করব। বউ-মেয়েও খুশি হবে, আমারও শান্তি।
একটু অনধিকারচর্চা করব স্যার?
বলুন?
আপনার কাজটা এখন ঠিক কোন পর্যায়ে আছে?
সুমন্ত্ৰ সোজা হয়ে বসলেন। সামান্য বিরক্ত স্বরেই বললেন, কেন বলুন তো?
না মানে… আপনি যদি প্রোজেক্টের প্রায় লাস্ট স্টেজে চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে হারানো কি আমাদের একটা জাতীয় ক্ষতি নয়? আজ থেকেই তো আই জি সাহেব সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট জোগাড় করে আপনি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করুন না।
না ম্যাডাম, এখানে আর নয়। অ্যাট লিস্ট এইরকম রিমোট জায়গাতে তো নয়ই। কাজ এখনও প্রচুর বাকি। দেশেই যদি রয়ে যাই, তবে বাঙ্গালোর টাঙ্গালোর কোথাও চলে যাব।
স্টিল… একটু ভাবুন।
সুমন্ত্ৰ উত্তর দিলেন না। বসে আছেন গুম হয়ে। হঠাৎই বলে উঠলেন, আপনি যেন কী সব কৌতূহল নিরসনের কথা বলছিলেন?
হ্যাঁ… পরশু রাতে চোর আসা সম্পর্কে একটু বিশদ জানার ইচ্ছে ছিল।
কেন? এতক্ষণে সুমন্ত্রর ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি, আপনি চোর ধরবেন?
উহুঁ। আমি চোরের মোটিভটা বুঝতে চাই।
মানে?
আপনার বাড়িতে তো স্যার সোনাদানা, মণিমুক্তো তেমন নেই, তবু চোর এল কেন?
শুধু মণিমুক্তোর আশাতেই কি চোর আসে? এখানকার গরিব লোকরা বাসনকোসন কাপড়চোপড় পেলে বৰ্তে যায়। কুকুরের ভয়ে এতদিন সাহস পায়নি, এবার তাদের বুকের পাটা বেড়েছে।
তাই হবে হয়তো। তবু আপনার মতো এক নামী মানুষের বাড়িতে ছিঁচকেবৃত্তি..! চোরটা স্যার কত রাতে এসেছিল?
চোর ভেগে যাওয়ার পর ফের শোওয়ার সময় ঘড়ি দেখেছিলাম। দুটো কুড়ি।
আপনি তো আগে টের পাননি?
না। আমি সবে আধঘণ্টাটাক আগে কম্পিউটার অফ করে এসে শুয়েছিলাম। ভালই ঘুম এসে গিয়েছিল। নীলাম্বরের হাউমাউ শুনে চমকে জেগে উঠি। ব্যাটা আমার দরজার সামনে দিয়েই গেল বটে, তবে ধরতে পারলাম না।
মানে, আপনি তাকে দেখেছিলেন?
একঝলক। বেঁটেখাটো চেহারা। গাট্টাগোট্টা। তাড়াও করেছিলাম ব্যাটাকে। নীলাম্বরের সঙ্গে। কিন্তু সে ওস্তাদ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ফার্স্ট। উঠোনের দরজাটা তো খোলাই থাকে, ওই পথেই বেরিয়ে খরগোশ-পায়ে পাঁচিল টপকে পগারপার, গুছিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎই থমকেছেন সুমন্ত্ৰ, এবার আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি ম্যাডাম?
অবশ্যই।
সামান্য একটা লোকাল চোর নিয়ে আপনি এত ভাবিত হয়ে পড়েছেন কেন? আই জি সাহেব কি ব্যাপারটা আলাদা করে ইনভেস্টিগেট করতে পাঠিয়েছেন?
না, না, আমি অন মাই ওন এসেছি। নীলাম্বরের মুখে শুনেছিলাম আপনার কাছে মাসদুয়েক আগে নাকি তিনটে লোক এসেছিল। তাদের সঙ্গে আপনার মনোমালিন্য মতোও হয়। তারপরই আপনার রজার হারাল, বাড়িতে চুরির অ্যাটেপ্ট… এগুলোকে একটু লিংক করার চেষ্টা করছিলাম আর কী। কেন যেন মনে হচ্ছিল, এর থেকে আপনার কোনও বিপদ ঘটতে পারে।
সুমন্ত্রর শুকনো মুখে এতক্ষণে একটা স্পষ্ট হাসি ফুটেছে। মিলিয়েও গেল হাসিটা। ভুরুতে আলগা ভাঁজ ফেলে বললেন, আপনারা গোয়েন্দারা পারেন বটে। তিলকে তাল বানিয়ে ফেলেছেন। নীলাম্বর যাদের কথা বলেছিল, যত দূর মনে পড়ছে, তারা ছিল গভর্নমেন্টের লোক। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মন্ত্রকের তিনটে বোকা আমলা। আমার রিসার্চ নিয়ে কিছু সিলি কমেন্ট করেছিল। আমিও ওদের একটু বকাঝকা করেছিলাম। ওই তুচ্ছ ঘটনাকে জটিল করার মনে হয় কোনও প্রয়োজন নেই।
হুম। মিতিন মাথা দোলাল, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। এই অসময়ে অহেতুক আপনাকে খানিক জ্বালাতন করলাম।
না না, ঠিক আছে। সুমন্ত্ৰ নড়েচড়ে বসলেন, সরি, আপনারা এত দূর থেকে এলেন, আজ কিন্তু কোনও খাতিরযত্ন করতে পারলাম না। জলটল খাবেন?
নো থ্যাঙ্কস। ব্যস্ত হবেন না, মিতিন ঘড়ি দেখল, নীলাম্বরের বাড়ির লোকজন কখন আসছে?
কী করে বলি। খবর তো গিয়েছে অনেকক্ষণ। তবে মনে হয় না দুপুরের আগে তারা পৌঁছোত পারবে, বলতে বলতে আচমকাই ঘাড় নুইয়েছেন সুমন্ত্ৰ। চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কী যে হয়ে গেল! আমার আর ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না।
টুপুরও ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, সত্যি, কী বিশ্রী ব্যাপার। শেষে কিনা চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মরতে হল নীলাম্বরদাদাকে!
সুমন্ত্রর ঘাড় আরও ঝুঁকে গেল।
মিতিন গলা নামিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা স্যার, সাপটা যে চন্দ্রবোড়াই ছিল, এটা বোঝা গেল কী করে?
প্লেন অ্যান্ড সিম্পল। সুমন্ত্ৰ চোখ তুললেন, যতটা জায়গা জুড়ে সোয়েলিং হয়েছে, তাতে ধরাই যায় সাপ অনেকটাই বিষ ঢেলেছে। কেউটে বা কালাচ একবারে যে পরিমাণ বিষ ঢালতে পারে, তার চেয়ে ঢের বেশি প্লাস, নাক-চোখ-মুখ দিয়ে রক্তও বেরিয়েছে। যা একমাত্র চন্দ্রবোড়ার বিষ শরীরে গেলেই হয়।
চন্দ্রবোড়ার বিষে মানুষ কতক্ষণ পরে মারা যায়?
এক-দেড় ঘণ্টা সময় তো লাগেই।
তার মানে ছোবল খাওয়ার পর নীলাম্বরও ঘণ্টাদেড়েক বেঁচে ছিল?
থাকার তো কথা। আমার তো সেটাই অবাক লাগছে। নীলাম্বর ছোবল খেয়েই বাড়িতে দৌড়ে এল না কেন! আমার ল্যাবরেটরিতে তো অ্যান্টিভেনম মজুতই থাকে। ইঞ্জেকশনটা পড়লে বেঁচে যেত, সুমন্ত্র একটুক্ষণ থেমে থেকে ফের বললেন, আসলে কী হয় জানেন? বিষধর সাপে কাটলে বহু মানুষই নার্ভাস হয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলে। নীলাম্বরও বোধহয়… যদিও আমি ওকে সাহসী বলেই ভাবতাম।
বাইরে হঠাৎ একটা ড়ুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ। তাড়াতাড়ি বাইরে এল টুপুর আর মিতিন। পিছন পিছন সুমন্ত্রও। বারান্দা থেকেই দেখতে পেল বছরপঞ্চাশের ধুতিশার্ট পরা এক গ্রাম্য মানুষ নীলাম্বরের বুকে হাত রেখে গলা ছেড়ে কাঁদছে।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, উনি কে? নীলাম্বরের বাবা?
সুমন্ত্ৰ কোনও জবাব না দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে নেমে গেলেন লোকটার কাছে। তাঁকে দেখেই লোকটার কান্না আরও বেড়ে গেল, এ কী সব্বোনাশ হল বাবু! আমি এখন নীলুর বাবাকে মুখ দেখাব কী করে! কী কুক্ষণে ওকে আমি কাজে দিয়েছিলাম!
সুমন্ত্ৰ হাত রাখলেন লোকটার কাঁধে শান্ত হতে বলছেন।
টুপুর ফিসফিস করে বলল, ওই লোকটাই বোধহয় মঙ্গল।
মিতিন বলল, হুঁ।
ডেকে কথা বলবে?
না থাক। চল, আমরা এগোই।
ধীর পায়ে গেট অবধি গিয়েও মিতিন দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ কুঁচকে কী যেন ভাবছে। হাতের ইশারায় ডাকল রতনকে।
দৌড়ে এসেছে রতন, কিছু বলছেন দিদি?
নীলাম্বরের বডিটা কোথায় পড়ে ছিল আমায় একবার দেখাবেন?
যাবেন? চলুন।
গেট পেরিয়ে বিশ-পঁচিশ পা গেলে ডাইনে এক সরু মেঠো পথ। দুধারে ইতস্তত খেজুর, বাবলা আর কাঁটাগাছের ঝোপ। মাঝেমাঝে ছোটবড় বাঁশঝাড়। শুরুতেই দুচারটে মাটির বাড়ি পড়ল। তারপর আর বিশেষ বসতি নেই। কাল রাতের বৃষ্টিতে রাস্তার দশাও ভারী বেহাল। এঁটেল মাটি গলে কাদাকাদা হয়ে আছে। কাদায় অজস্র পায়ের ছাপ। সকালে নিৰ্ঘাত এই পথে অনেক মানুষ নীলাম্বরকে দেখতে আসা-যাওয়া করেছে।
সাবধানে পা টিপে টিপে হাঁটছিল টুপুর। মিতিনও একখানা গর্ত লাফ দিয়ে টপকে মিতিন বলল, এ রাস্তা দিয়ে পুরন্দর পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগে?
মিনিটপাঁচেক। রাস্তাটা গাঙের ধারে গিয়ে বাঁ দিক পানে ঘুরে গিয়েছে। শেষ হয়েছে আমাদের গির্জার পিছনটায়।
জায়গাটা এত ফাঁকা কেন?
সবই গির্জার জমি দিদি। এমনিই পড়ে আছে।
পাঁচ নয়, ধীরেসুস্থে চলতে গিয়ে প্রায় দশ মিনিট লেগে গেল। রতন যেখানে এসে থামল, তারপর আর এগোনোর জো নেই। সামনে থকথকে কাদা। হাতপনেরো দূরে পাড় ঢাল হয়ে নেমে গিয়েছে পুরন্দরে।
রতন বলল, ওই কাদার মুখটাতেই পড়ে ছিল নীলাম্বরদা।
উবু হয়ে বসে জায়গাটা দেখছিল মিতিন। ঘুরে ঘুরে সন্ধানী চোখে তাকাচ্ছিল চারদিকে। রতনকে জিজ্ঞেস করল, নীলাম্বর শুধুহাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরেই বেরিয়ে পড়েছিল?
তাই তো দেখলাম দিদি।
ঘড়ি ছিল হাতে?
নাহ।
পকেটে টাকাপয়সা?
উহুঁ।
কোনও কাগজপত্র? বা দেশলাই ফেসলাই? বা আর কিছু?
না দিদি, কিছুই ছিল না পকেটে। পুলিশ এসে আমাদের সামনেই তো হাতড়ে হাতড়ে দেখল। দুটো পকেটই বিলকুল ফরসা।
আপনি শিয়োর?
একশো ভাগ। স্বচক্ষে দেখেছি।
মিতিন আর কিছু বলল না। বেজায় গম্ভীর সহসা। পুরন্দরের পারে আর দাঁড়ালও না। মুখে কুলুপ এঁটে ফিরল মেটে পথটুকু। সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়ির সামনে এসে ছেড়ে দিল রতনকে। ছেলেটা ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর টুপুরকে বলল, চল, একবার থানায় যাই।
থানা? কেন?
ও সি-কে বলতে হবে নীলাম্বরকে এখন দাহ করা যাবে না। বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানো দরকার।
সে কী? সাপে কাটলে পোস্টমর্টেম হয়?
সত্যি-সত্যি সাপের কামড়ে মরলে প্রয়োজন হয় না। কিন্তু নীলাম্বরকে সাপে কাটেনি। কেউ তাকে খুন করেছে!
.
০৮.
শনিবার সারাদিনটা মিতিনমাসির টিকি দেখতে পাওয়া গেল না। সকাল নটার মধ্যে নাকেমুখে গুঁজে সেই যে বেরিয়ে গেল মিতিনমাসি, ফিরল সেই সন্ধের মুখেমুখে। কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কিছুই বলল না টুপুরকে। প্রশ্ন করলে একটাই জবাব – কাজ ছিল। এমনই দুচারটে কথা বলে ঢুকে গেল স্নানে, বেরিয়ে সোজা স্টাডিরুম। সাপের উপর বই কিনে এনেছে খানদুয়েক, দরজা ভেজিয়ে ড়ুবে গেল বইয়ের পাতায়।
রাতে খেতেও বসল একটা বই নিয়ে। পড়তে পড়তেই খাচ্ছিল, হঠাৎ মুখ তুলে পার্থমেসোকে বলল, কাল একটু ভাল করে বাজার কোরো তো। দিদি আর অবনীদাকে দুপুরে খেতে বলেছি।
পার্থ অবাক, হঠাৎ?
আমার ইচ্ছে। দিদি-জামাইবাবুকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াব, তাতে আবার হঠাতের কী আছে?
পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, কী আনব? চিকেন? না মটন?
উহুঁ। ইলিশমাছ। দিদি ইলিশমাছটা বড় ভালবাসে। মনে করে পুঁইশাকটাকও এনো। কাঁটাচচ্চড়ি হবে। আর ভাল হিমসাগর আম। সঙ্গে মিষ্টি দই।
ও কে।
টুপুর চুপচাপ শুনছিল। বেজার মুখে বলল, কালই মা-বাবাকে না ডাকলে চলছিল না?
মিতিন চোখের কোণ দিয়ে দেখল টুপুরকে, কেন, তোর কী অসুবিধে হল?
মা তো এসেই হোমওয়ার্ক নিয়ে পড়বে। এখনও বইখাতা খুলিনি শুনলে রক্ষে রাখবে?
তা হোমওয়ার্কগুলো করছিস না কেন? আজ সারাদিন বসে কী ভ্যারেন্ডা ভাজছিলি?
টুপুর একটু আহত হল, তবে মুখ ফুটে বলল না কিছু। সারাদিন আজ গড়াগড়ি খাওয়া ছাড়া কিছুই করেনি বটে, কিন্তু কেন যে কিছু করেনি, কিংবা করতে মন লাগেনি, তা তো মিতিনমাসি একবার জিজ্ঞেস করল না।
কালকের দিনটাই বারবার ঘুরে এসেছে টুপুরের চোখে। নীলাম্বরের নিষ্প্রাণ দেহ, পুরন্দরের নির্জন পাড়, রতন হেনরি মণ্ডল, সুমন্ত্ৰ সান্যালের নিঝুম বসে থাকা…। আচ্ছা, মিতিনমাসি কী করে নিশ্চিত হল, নীলাম্বর খুন হয়েছে? এটা অবশ্য ঠিক, সাপের ছোবল খেয়ে তার বাড়িতে ছুটে আসাটাই স্বাভাবিক ছিল। বিশেষ করে যখন সে জানে তার স্যারের কাছে সাপের বিষের ওষুধ থাকে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল? উহুঁ, নীলাম্বরের তো সাপদের সঙ্গেই নিত্য ওঠাবসা। অবশ্য ডক্টর সান্যালের যুক্তিটাও ফ্যালনা নয়। বিপদের সময় আচ্ছা আচ্ছা সাহসী লোকেরও বুদ্ধিভ্রম ঘটতে পারে। আর কী পয়েন্ট খুঁজে পেল মিতিনমাসি? কাকভোরে পুরন্দরের পারে হাঁটতে যাওয়াটা কি মিতিনমাসির অস্বাভাবিক ঠেকেছে? উহুঁ, ফাদার ম্যাথুও তো ওই পথে হাঁটতে যান। নীলাম্বরের পকেট থেকে কিছু পাওয়া গেছে কিনা বারবার জিজ্ঞেস করছিল মিতিনমাসি। কেন?
ভেবেভেবে তল পায়নি টুপুর। তবে দিনটা তো চলেই গিয়েছে। এবং মা-ও এসে কাল চেঁচাবেনই।
পরদিন সকালে অবশ্য টুপুরকে ঝাড় খেতে হল না। সহেলি আর অবনী যখন মিতিনদের ফ্ল্যাটে ঢুকলেন, ঠিক তখনই ইলিশমাছ ছাড়া হয়েছে কড়ায়। মনোলোভা আঁশটে গন্ধে ম-ম করছে চারদিক। ব্যস, সঙ্গেসঙ্গে সহেলি দুনিয়া ভুলেছেন।
জোরে জোরে শ্বাস টেনে সহেলি বললেন, মাছটার কোয়ালিটি খুব ভাল মনে হচ্ছে!।
পাৰ্থর মুখ হাসিতে ভরে গেল, কে এনেছে দেখতে হবে তো। খোদ পদ্মার মাছ। দুকিলো একশো ওজন। পেটে হাল্কা ডিমের ছাঁচ আছে।
অবনী মৃদু স্বরে বললেন, ইলিশমাছ কিন্তু হজম করা কঠিন। বেশি খেলে পেটের গন্ডগোল হয়।
তোমায় একটাও খেতে হবে না। সহেলি ঝামরে উঠলেন, তুমি পেঁপের ডালনা খেয়ো।
উত্তম প্রস্তাব। পেঁপের মতো উপকারী সবজি আর কটা আছে। জানো, পেঁপের আঠা থেকে পেপটিক আলসারের ওষুধ তৈরি হয়?
আর ইলিশ খেলে হার্ট ভাল থাকে। কোলেস্টেরল কমে যায়।
পার্থ ফুট কাটল, এবং চিত্ত প্ৰফুল্ল হয়।
বলো, বলো। বেরসিক লোকটাকে বোঝাও। কী যে একটা পেটরোগা লোকের সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন।
নানাবিধ চাপানউতোর আর হাসি-মশকরার মাঝে চাপা পড়ে গেল টুপুরের হোমটাস্ক। শুরু হয়েছে মাথামুন্ডুহীন গুলতানি। অবনী ইদানীং সামাজিক হয়েছেন কিছুটা। মোটামোটা বই ছেড়ে আড্ডাটাড্ডাও মারছেন মাঝেমধ্যে।
শ্যালিকার পিঠে একটা চাপড় মেরে অবনী জিজ্ঞেস করলেন, তা মিতিনবাবু, তোমার থার্ড আই চলছে কেমন? নতুন কেসটেস কিছু জুটল?
পাৰ্থ জবাব দিল, মিতিনের এখন ডাল সিজন। লড়ে লড়ে একটা কেস জোগাড় করেছে বটে, তবে তাতে আদৌ রহস্য আছে কিনা বলা কঠিন।
বাজে বোকো না তো! যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং কেস, মিতিন চোখ পাকাল, এবং ওই কেসের সঙ্গে আমাদের দেশের স্বার্থও জড়িত।
বলো কী! ব্যাপারটা তো তা হলে শুনতে হয়!
সংক্ষেপে সুমন্ত্ৰ সান্যালের গল্পটা বলল মিতিন। রজার হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নীলাম্বরের মৃত্যু পর্যন্ত।
মন দিয়ে শুনে অবনী বললেন, হুম, মিষ্ট্রি একটা থাকলেও থাকতে পারে।
সহেলি ফ্রিজ থেকে একখানা বোতল বার করে ঠান্ডা জল খাচ্ছিলেন। কিছুই শোনেননি তিনি, তবু ফস করে আলটপকা মন্তব্য ছুড়লেন, মিষ্ট্রি মাথায় থাকুক। সাপটপের ব্যাপারে মিতিনের যাওয়ার কোন দরকার নেই।
দিদি, থাম তো। তুই বরং গিয়ে ভারতীকে একটু গাইড কর রান্নায়। মিতিন ফের ফিরল প্রসঙ্গে, বুঝলেন অবনীদা, ওই নীলাম্বরের মৃত্যুটাই আমায় টেনশনে ফেলে দিয়েছে।
টুপুরেরও তো একই টেনশন। সুযোগ পেয়েই টুপুর প্রশ্নটা উগরে দিল, একটা কথা বলব মিতিনমাসি? তুমি কেন মানতে চাইছ না, নীলাম্বরকে সাপে কেটেছে?
একটা মেজর কারণ তো চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। নীলাম্বরের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে কখন? ভোর সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছটায়। রতন হেনরি মণ্ডলের বক্তব্য অনুযায়ী, তখন নীলাম্বরের বডি স্টিফ। তার মানে রিগর মর্টিস তখন স্টার্ট হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যু হয়েছে কম করে আরও ঘন্টাচারেক আগে। দ্যাট মিল্স, রাত একটা-দেড়টার পরে নয়। তা অত রাতে নীলাম্বর বেরিয়ে পুরন্দরের ধারে গেল কেন? কেউ তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল কি? নাকি নীলাম্বরই কারও সঙ্গে ওখানে রাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল? আর এখানেই খুনের একটা আশঙ্কা এসে যায় না কি? তবে নীলাম্বরের মৃত্যুটা যে খুন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ… মিতিন আচমকা থেমে গেল।
পার্থ উত্তেজিতভাবে বলল, কী? বড় প্রমাণটা কী?
ওটা এখন সাসপেন্স থাক। পরে বলব। মিতিন গাল ছড়িয়ে হাসল। অবনীর দিকে ফিরে বলল, আপনার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা ছিল।
বলে ফ্যালো।
আপনার বয়স তো এখন চুয়াল্লিশ চলছে। তাই না? যদি না আপনি বিয়ের সময় বয়স ভাঁড়িয়ে থাকেন…
ফাজলামি মেরো না। ওসব দুনম্বরি অভ্যেস আমার নেই।
ভেরি গুড। তা আপনি এম এ পাশ করেছেন কদ্দিন আগে?
বছরকুড়ি।
বায়োকেমিস্ট্রিতে এম এসসি, আপনার সমসাময়িক, এমন কারও সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
অবনী ভুরু কুঁচকোলেন, আমাদের সময় কি ইউনিভার্সিটিতে আদৌ বায়োকেমিস্ট্রি ছিল? উহুঁ। ওটা বোধহয় পরে এসেছে।
তবে কী ছিল তখন?
পিয়োর কেমিস্ত্রি, অ্যাপ্লায়েড কেমিষ্ট্রি। ওখান থেকেই অনেকে পরে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করত।
ও। মিতিন যেন সামান্য দমে গেল, কেমিষ্ট্রির কেউ চেনা আছেন?
অনেকেই আছে। আমাদের কলেজের দেবেশই তো আমার ইয়ারে এম এসসি করেছে।
দু-এক পল কী ভাবল মিতিন। বলল, দেবেশবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলা যায়?
স্বচ্ছন্দে। যদি চাও তো তাকে এখানেই হাজির করতে পারি।
আহা, উনি কষ্ট করে আসবেন কেন? আমিই যাব।
আরে না না, তোমার আমন্ত্রণে সে খুশিই হবে। আমার মুখে তোমার কীর্তিকাহিনী শুনে শুনে সে তে রীতিমতো তোমার ফ্যান। কাছেই থাকে। সেলিমপুর। দাঁড়াও, এখনই দেবেশকে একটা ফোন লাগাই।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়লেন দেবেশ। ফরসা দোহারা চেহারা, মাথাজোড়া টাক, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, পরনে ছুটির দিনের ঢিলেঢালা পাজামা-পাঞ্জাবি। মিতিনকে দেখামাত্র এমন গদগদ সুরে কথা বলতে লাগলেন যে, রীতিমতো কুঁকড়ে গেল মিতিন। স্তুতিবাক্যের কী ঘটা! মিতিন যেন শার্লক হোমসের মহিলা এডিশন।
চটপট দেবেশকে চা-ফ্ৰেঞ্চটোস্ট ধরিয়ে দিয়ে মিতিন সরাসরি কাজের কথায় এল, বাই এনি চান্স, এম এসসি পড়ার সময় সুমন্ত্ৰ সান্যাল বলে কাউকে আপনি চিনতেন?
সুমন্ত্র…. সুমন্ত্ৰ…?
হ্যাঁ। লম্বা মতো… রোগা মতো… বিশাল খাড়া নাক…?
ওহো, আপনি লম্বুর কথা বলছেন? আমেরিকায় ছিল? এখন দেশে ফিরে রিসার্চ করছে?
চেনেন?
আরে, ও তো কলেজেও আমার ব্যাচমেট ছিল। এম এসসি-তে সুমন্ত্ৰ স্পেশ্যাল পেপার নিল অরগ্যানিক, আমি ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রি। এককালে ওর সঙ্গে ভালই দোস্তি ছিল।
সুমন্ত্ৰবাবুকে নিয়ে রিসেন্টলি একটা খবর বেরিয়েছিল পড়েছেন?
কবে বলুন তো?
এই তো, মঙ্গলবার।
উহুঁ। মিস করে গিয়েছি। পার্ট-ওয়ানের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে তো, সকালে খবরের কাগজ দেখার সময়ই পাই না। কী করেছে সুমন্ত্ৰ? কোনও প্রাইজটাইজ পেয়েছে বুঝি?
না। উনি নিখোঁজ হয়েছিলেন।
অ্যাঁ? দেবেশের মুখ হাঁ, সুমন্ত্ৰ… নিখোঁজ..?
এখন ফিরে এসেছেন। ইনসিডেন্টালি, ওঁকে খোঁজার কাজে আমি সামান্য জড়িয়ে পড়েছিলাম।
তাই বলুন।
সুমন্ত্ৰবাবু সম্পর্কে আমি আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। ..সুমন্ত্ৰবাবু মানুষটা কেমন?
এখনকার সুমন্ত্রর কথা বলতে পারব না। আমার সঙ্গে দীর্ঘকাল কোনও যোগাযোগ নেই। দেশে ফেরার পর সুমন্ত্ৰও আর সম্পর্কটা রিভাইভ করেনি, আমিও কনট্যাক্ট করিনি।
বেশ তো, আগের সুমন্ত্ৰবাবুর কথাই বলুন।
সুমন্ত্র ছিল একটু আত্মকেন্দ্রিক। নিজেকে নিয়ে, নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসত। তবে খারাপ ছেলেও নয়। কথাবার্তায় খুবই ভদ্ৰ, সভ্য। প্লিজিং পার্সোনালিটি। মেধার দিক দিয়ে মাঝামাঝি, তবে অসম্ভব স্টুডিয়াস আর সিস্টেমেটিক। ব্রিলিয়ান্ট ছিল ওর ভাইটা। জয়েন্টে হাই র্যাঙ্ক করে মেডিক্যালে অ্যাডমিশন পেয়েছিল। কিন্তু কী বলব, পরে অসৎ সঙ্গে পড়ে একেবারে বখে গিয়েছিল ছেলেটা। কলেজে পড়ার সময় এক-দুবার গিয়েছি সুমন্ত্ৰদের মল্লিকপুরের বাড়িতে। তখনও ছেলেটা মেডিক্যাল কন্টিনিউ করছে। কিন্তু তখনই দিনরাত ড্রাগে চুর হয়ে থাকত। সুমন্ত্র ছিল তুলনায় অনেক ব্যালান্সড। ফ্যামিলির অবস্থা ভাল নয় বলে প্রাণ দিয়ে খাটত। বি এসসি-তে হাই ফার্স্ট ক্লাস পেল সুমন্ত্ৰ, আর ভাইটি থার্ড ইয়ারেই লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে কী এক ইংরজি গানের ট্রুপ খুলে বসল। কী যেন নাম ছিল ভাইটার? …হ্যাঁ হ্যাঁ, সুধন্য। এমন নেশার কবলে পড়েছিল যে, নিজের বাড়ির ঘটিবাটি বেচে দিত। চুরির কেসে বোধহয় ধরা পড়েছে বারকয়েক। এম এসসি পড়ার সময় দেখেছি, ভাইকে নিয়ে সুমন্ত্ৰ ভারী ওয়ারিড থাকত।
কিন্তু তিনি তো শুনলাম এখন বাঙ্গালোরে চাকরি করছেন?
তাই নাকি? আমি যেন অন্যরকম শুনেছিলাম। কী এক মেডিক্যাল ফার্মে কাজ পেয়েছে, ওষুধটষুধ বেচছে। …তা বাইরে গিয়ে সেটেলড হয়ে থাকলে তো আরও ভাল। সুধন্য বিয়ে-থা করেছে?
তা তো বলতে পারব না।
অবনী পাশ থেকে হেঁকে উঠলেন, দেবেশ, প্রশ্ন কার করার কথা, আঁ?
দেবেশ লজ্জিত মুখে বললেন, না না, সুধন্যর কথা উঠল, তাই… বলুন ম্যাডাম, আর কী জিজ্ঞাস্য আছে?
আপনার কথা শুনে তো বুঝতেই পারছি সুমন্ত্ৰবাবু দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে আপনার আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি!
একটি বারের জন্যও না। ইনফ্যাক্ট, ও যে আবার দেশে ফিরেছে, সুন্দরবনের দিকে কোথায় গিয়ে যেন কাজকর্ম করছে… এও তো জানলাম মাত্র বছরখানেক আগে। আমাদের আর-এক ব্যাচমেট পরিমল, সে এখন দিল্লির সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মিনিস্ট্রির হোমরাচোমরা। তার কাছেই ইনফর্মেশন পেলাম। …পরিমলের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও একটা নাটকের মতো। লাস্ট সামারে বউ-ছেলে নিয়ে গোয়া বেড়াতে গিয়েছি, হঠাৎ কালাংগুটে বিচে সুইমিং কস্টিউম পরা এক লোমশ জলহস্তী ইয়া ভুড়ি নিয়ে। আমায় জড়িয়ে ধরল, আরে দেবু, তুই এখানে পাক্কা পাঁচ মিনিট টাইম লেগেছিল আমার পরিমলকে চিনতে। ইউনিভার্সিটির শুটকো পরিমল যে কোন ম্যাজিকে…?
অবনী গলাখাঁকারি দিলেন, তুমি ভুল ট্র্যাকে ঢুকে পড়েছ, দেবেশ।
সরি। সরি। দেবেশ জিভ কাটলেন, এই আমার এক বদভ্যাস। ক্লাসেও এরকম হয় জানেন। শুরু করলাম হয়তো গ্যাসের গতিতত্ত্ব, পড়াতে পড়াতে তাপগতিবিদ্যায় চলে গেলাম। হয়তো চাপের সমীকরণটা বার করছি… মানে প্রেশার আর গ্যাস। মলিকিউলের ভেলোসিটির রিলেশন…
ফের বেলাইন? কপাল ভাল, আমার শ্যালিকার হাতে পড়েছ, পুলিশের খপ্পরে নয়। স্টেটমেন্ট দেওয়ার সময় এমন ফালতু বকবক করলে তারা তোমার ঠোঁট সেলাই করে দিত।
আহা, উনি ওঁর মতো করেই বলুন না। মিতিন হাসছে, গল্প শুনতে শুনতে কত কিছু তো জানাও হয়ে যাচ্ছে। …দেবেশবাবু, ডক্টর সান্যালের বাবা-মা বেঁচে আছেন কিনা জানেন?
নেই। পরিমলের মুখেই শুনলাম, সুমন্ত্ৰ আমেরিকায় থাকাকালীনই ওর মা গত হন। দেশে ফেরার পর ওর বাবা।
তা হলে মল্লিকপুরের বাড়িতে নিশ্চয়ই এখন আর কেউ নেই?
ভাই যদি বাঙ্গালোরে চলে গিয়ে থাকে, তা হলে আর কে থাকবে। হয়তো তালাবন্ধ। অনেক কালের পুরনো বাড়ি তো, হয়তো বেচেও দিয়ে থাকতে পারে। বাড়ির লাগোয়া বেশ খানিকটা জমিও ছিল। প্রোমোটাররা লুফে নেবে। অবশ্য বাড়িটা স্টেশন থেকে অনেকটাই ভিতরে। রিকশায় তেঁতুলতলা না, তেঁতুলগাছি কোন একটা মোড়ে গিয়ে যেন নামতে হয়। সেই কবেকার কথা, অত কী আর মনে থাকে? বলতে বলতে দেবেশ হঠাৎই থমকেছেন। চোখ পিটপিট করে বললেন, আচ্ছা, এসব ইনফর্মেশন তো সুমন্ত্ৰই আপনাকে দিতে পারে। আপনি তো বললেন, নিখোঁজ হওয়ার পর ও আবার ফিরে এসেছে!
আলতো হেসে মিতিন এড়িয়ে গেল কথাটাকে।
দেবেশের ভুরুতে ভাঁজ, সুমন্ত্র কি কোনও গন্ডগোল পাকিয়েছে?
এবারও মিতিন এড়িয়ে গেল কায়দা করে। বলল, গন্ডগোল একটা পেকেছে বটে। সেটা উনিই পাকিয়েছেন কিনা জানি না। তবে গন্ডগোলটা ওঁকে ঘিরেই। ..বাই দ্য বাই, সুমন্ত্ৰবাবুর টাকাপয়সার ব্যাপারে বেশি আসক্তি ছিল কি?
না না না। চিপ্পুস টাইপ ছিল। মেপেজুপে খরচ করত। তা বলে টাকার জন্য মোটেই হ্যাঙ্কারিং ছিল না। তা ছাড়া ম্যাডাম, সুমন্ত্ৰ যদি লোভীই হবে, তা হলে কি আমেরিকার ঐশ্বর্য ছেড়ে এখানে কাজ করতে চলে আসে? বউ-মেয়ে সব ফেলে?
তা ঠিক। আমারও ধারণা উনি সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ।
সুমন্ত্রকে নিয়ে আর কথা হল না বিশেষ। আধঘণ্টাটাক আরও গল্পগুজব করে উঠলেন দেবেশ। দুপুরে ভোজনপর্বটি বেশ ভালই হল। সহেলির পীড়াপীড়িতে দই ইলিশ খেয়ে সারাটা দুপুর চোঁয়া ঢেকুর তুললেন অবনী। সহেলি চুটিয়ে পরনিন্দা পরচর্চা করলেন মিতিন আর পার্থর সঙ্গে।
বিকেলে যাওয়ার সময় সহেলি ধরেছেন টুপুরকে, কী, এখনও তো বইখাতা ছোঁওয়া হয়নি মনে হচ্ছে?
টুপুর বলল, এই… কাল থেকে বসব।
গৃহে পদার্পণ করছ কবে?
এখনও তো অনেক দিন ছুটি বাকি আছে মা।
তা হোক। চোখের আড়ালে থাকলে তুমি ডানা মেলে উড়বে। একটা কথা মাথায় রেখো, মাসির সঙ্গে গোয়েন্দাগিরি করলেই শুধু চলবে না। ভুলে যেয়ো না, তোমার মাসিও স্কুল-কলেজ পাশ করে তবে এ লাইনে এসেছে। ছেলেবেলা থেকেই কারও ল্যাংবোট হয়ে নেচে বেড়ায়নি।
বাড়ি ফাঁকা হল। সন্ধে নেমেছে। আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে মেঘ জমেছে অল্প অল্প। হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক হানছে বিদ্যুৎ। আজ আবার কালবৈশাখী আসবে কি? টুপুরের মনে হল, এখন একটা ঝড়বৃষ্টি হলে মজাই হয়। দিনভর যা চিটপিটে গরম গেল!
পার্থমেসো বুমবুমকে নিয়ে সামনের দোকান থেকে ভিসিডি আনতে গেল। হ্যারি পটার দেখবে বলে বায়না ধরেছে বুমবুম। কী যে সব আজগুবি দেখে বসে বসে। এই ছিল মানুষ, এই হয়ে গেল পাখি! শূন্যে ছেলেমেয়েরা উড়তে উড়তে খেলে বেড়াচ্ছে। ইন্দ্ৰজালের স্কুলে মেয়েরা তালিম নিচ্ছে ডাইনি হওয়ার টুপুরের। তো দেখলেই হাসি পায়। মিতিনমাসির সঙ্গে থেকে থেকে সে এখন অযৌক্তিক কিছু ভাবতেই পারে না।
ব্যালকনি ছেড়ে টুপুর ঘরে এল। মিতিনমাসি শুয়ে পড়েছে। বিছানায়। চোখ বন্ধ, কী যেন চিন্তা করছে।
টুপুর মাথার পাশে এসে বসল, কী গো, দেবেশকাকুর সঙ্গে কথা। বলে কিছু লাভ হল?
তা একটু হয়েছে বই কী।
কীরকম?
মিতিন সরাসরি জবাব দিল না। চোখ থেকে হাত সরিয়ে সুর করে বলল, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন?