০৭. কেঁচো খুড়তে সাপ
পরদিন সকালে নাশতা খেয়েই ওরা সবাই পাহাড়ে বেড়াতে বেরুলো। নাশতার টেবিলে আতিক কাকু বার বার বলছিলেন, প্রজেক্টের এলাকার বাইরে যেন ওরা না যায়। তারপরও সিমি, রিমি, জয়দের পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পেরে ফরহাদকে সঙ্গে দিয়েছেন পাহারা দেয়ার জন্য।
পুরনো বাগান যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা নালা রয়েছে হাত ছয়েক চওড়া। পাথরের ওপর দিয়ে তির তির করে স্বচ্ছ পানির ধারা বয়ে যাচ্ছিলো। নালার ওপাশে একটু ফাঁকা জায়গা। তারপরই শুরু হয়েছে ঘন বন। নিকি ভেবেছিলো ওরা বোধহয় নালার ওপারে যাবে না। সবাইকে জুতো মুজো খুলতে দেখে ও অসন্তুষ্ট হয়ে বার দুই ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানালো। জয় হেসে বললো, পানি এ একদম পছন্দ করে না।
রিমি আর ফরহাদ পায়ের গোছ পর্যন্ত ভিজিয়ে আগে নালা পার হলো। ওদের পেছনে ছিলো সিমি, সুমন আর জয়। নিকি ছিলো সবার পেছনে। রিমির পিঠে স্কুলব্যাগ, যেখানে ছিলো দড়ি, ছুরি থেকে শুরু করে ওর যাবতীয় নিজস্ব সম্পত্তি। সুমন কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়েছে, ওতে পানির বোতল, চায়ের ফ্লাস্ক, বিস্কুট আর বড় একটা চাদর। চাচী বলেছেন পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করলে নাকি ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পায়।
নালার ওপারে গিয়ে রিমি ওর কেডস পরতে পরতে বললো, বাইরে এমন ঠাণ্ডা অথচ নালার পানিটা এরকম গরম হলো কী করে?
ফরহাদ বললো, এদিকে বেশ কয়েকটা নালা আছে, যার পানি বেশ গরম। মনে হয় কোনো হট স্প্রিং থেকে এসব নালার পানি এসেছে!
সিমি বললো, চোর, বদমাশদের পেছনে এভাবে না ঘুরে বরং হট স্পিংটা কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করতে পারলে দারুণ ব্যাপার হতো!
রিমি হাঁটতে হাঁটতে বললো, আমরা কেউ সখ করে খুঁজতে বেরোই নি। রাজেন সরকারকে উদ্ধার করার জন্য যাচ্ছি।
জয় বললো, তবে যে তুই বললি রাজেন সরকার ওদের ভয়ে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে?
তা পারে। রিমি স্বীকার করলো রাজেন সরকারকে না পেলেও ওদের আস্তানা তো খুঁজে বের করতে পারি!
জঙ্গলের কিনারে গাছপালা একটু ফাঁকা ছিলো। মিনিট দশেক হাঁটার পর গাছগুলো কাছাকাছি হতে লাগলো। অনেক গাছের গোড়ায় কাঁটা ঝোঁপ নয় তো অচেনা সব লতা পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। সূর্যের আলো অতি কষ্টে টুকরো টুকরো হয়ে এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে। চাচী ঠিকই বলেছিলেন। বহু গাছেই ওরা বিচিত্র সব রঙের অর্কিড ফুল দেখতে পেলো। কোনোটা দেখে মনে হয় লম্বা নীল সাদা ফুলের মালা, কোনোটা থোকা থোকা বেগুনি ঝুমকো ফুলের মতো। হলুদ কল্কে ফুলের মতো অর্কিডও ওদের চোখে পড়লো। সিমি বললো, ফেরার পথে চাচীর জন্য অর্কিড নিয়ে যাবো।
জঙ্গলের ভেতর তখনও কুয়াশা পুরোপুরি কাটেনি। মাটি থেকেও সোঁদা গন্ধভরা ভাপ বেরোচ্ছিলো। গাছে গাছে কাঠবেড়ালিদের ছুটোছুটি করতে দেখে নিকি বার বার ছুটে যাচ্ছিলো আর ধরতে না পেরে বোকা বোকা মুখ করে ফিরে আসছিলো। সিমি লক্ষ্য করলো ঢাকা শহরের রাস্তার পাশে কত যত্ন করে মেহগিনি আর সেগুন গাছ লাগানো হয় অথচ এই জঙ্গলে ওসব গাছের ছড়াছড়ি। শাল, বুনো ঝাউ, পাহাড়ী চাপার গাছও আছে অনেক। কোথাও গাছের তলায় শুকনো পাতা এত পুরু হয়ে জমেছে যে মনে হচ্ছিলো জাজিম বিছানো।
সিমি ফরহাদকে জিজ্ঞেস করলো, এদিকের জঙ্গলে কোনো হিংস্র প্রাণী নেই?
ফরহাদ বললো, জন্তু জানোয়ার দেখতে হলে আরও দক্ষিণে যেতে হবে। চিতাবাঘ আছে, হাতি আছে, বনগাই আছে, বুনো কুকুরও কম হিংস্র নয়। সবচেয়ে বেশি আছে সাপ। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সব সাপ। পাহাড়ী কেউটের একটা ছোবল খেলে বাঁচার কোনো পথ নেই। পাঁচ মিনিটেই পটল তুলতে হবে।
সাপের কথা শুনে সিমি ভয় পেয়ে ফরহাদের কাছে সরে গেলো। ফরহাদের হাতে ছিলো লম্বা ধারালো চাপাতি। মাঝে মাঝে লতা আর ঝোঁপ কেটে পথ তৈরি করে নিচ্ছিলো। জঙ্গলে ঢুকতে হলে কেউ চাপাতি নিতে ভোলে না। সিমিকে ভয় পেতে দেখে ফরহাদ ওকে আশ্বস্ত করলো সাপ শীতকালে বেরোয় না।
একটু দূরে অনেকগুলো পাখির ডানা ঝাপ্টানোর মতো ঝটপট শব্দ হতে সবাই থমকে দাঁড়ালো। নিকির কান খাড়া হয়ে গেলো। ফরহাদ বললো, ইশ একদম মনে ছিলো না। বন্দুকটা আনলে বনমোরগ শিকার করা যেতো।
হাঁটতে হাঁটতে রিমি গম্ভীর গলায় বললো, ফরহাদ ভাই, তোমারও কি মনে হচ্ছে রাজেন সরকারকে খুঁজে বের করাটা জরুরী কোনো কাজ নয়?
তা কেন মনে হবে?
তবে যে বড় শিকারের কথা বলছো?
বন্দুক আনলে শুধু শিকার নয় নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো।
ফরহাদের কথা শেষ না হতেই বহু দূরে পর পর কয়েকবার বন্দুকের শব্দ শোনা গেলো। ফরহাদ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর দেখাদেখি অন্যরাও দাঁড়ালো। রিমি বললো, ওটা কি বন্দুকের শব্দ?
বন্দুক তো বটেই। কিন্তু এখানে বন্দুকের শব্দ–
ফরহাদ মাথা নাড়লো–বনমোরগ শিকার করতে হলে রাঙ্গামাটির দু তিন মাইলের ভেতর চমৎকার সব জায়গা আছে, এখানে কেউ আসবে না!
তাহলে শব্দ করলো কারা?
সিমির কথার মাঝখানে আবার কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ হলো। রিমি বললো, আমার মনে হচ্ছে জঙ্গলে কেউ পথ হারিয়ে ফেলেছে!
সুমন বললো, শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কয়েকটা বন্দুক থেকে পর পর গুলি করা হচ্ছে ।
রিমি বললো, ওটাই নিয়ম। কয়েকজন একসঙ্গে হারিয়ে গেলে সঙ্গে যদি বন্দুক থাকে তাহলে থেমে থেমে এভাবে গুলি করে।
ফরহাদ বললো, চলো, গিয়ে দেখি।
আবার গুলির শব্দ হলো। শব্দ লক্ষ্য করে ওরা সেদিকে হাঁটলো জয় ফরহাদকে। জিজ্ঞেস করলো এখনও কি আমরা প্রজেক্টের এলাকার ভেতর আছি।
চারপাশে তাকিয়ে দেখে ফরহাদ বললো, হ্যাঁ, এটাও প্রজেক্টের এলাকা।
সিমি আস্তে করে জানতে চাইলো কিভাবে বুঝলেন এটা প্রজেক্টের এলাকা? ভেতরে বাইরে সব জঙ্গলের চেহারাই তো এরকম!
আমি এখানে এসে প্রথম তিন মাস আদমশুমারির মতো গাছশুমারি করেছিলাম। যতক্ষণ বড় গাছের গায়ে গুণচিহ্ন দেখবে, বুঝবে এটা প্রজেক্টের এলাকা।
জঙ্গলের ভেতর আরও মিনিট পনেরো হাঁটার পর ফরহাদ বললো, এখন আমরা প্রজেক্টের বাইরে।
সিমি হাতের ঘড়ি দেখে অবাক হয়ে বললো, বাব্বা, পুরো আড়াই ঘণ্টা লেগেছে প্রজেক্টের জঙ্গল পার হতে?
ফরহাদ একটু হেসে বললো, আমরা যদি লম্বালম্বি হাঁটতাম তাহলে প্রজেক্টের এলাকা পার হতে ছ ঘণ্টা লাগতো।
আড়াই ঘণ্টার কথা শুনে রিমি বললো, এবার বোধহয় আমরা চা বিস্কুট খাওয়ার জন্য বসতে পারি।
সুমন সঙ্গে সঙ্গে বললো, ঠিক বলেছো রিমি। আমার বোঝাটা হালকা হওয়া দরকার।
জঙ্গলের ভেতর একটু ফাঁকা জায়গা দেখে সুমন আর সিমি সেখানে চাদর বিছিয়ে দিলো। ধপাস করে চাঁদরে বসে জয় বললো, আমার পা ব্যথা করছে!
রিমি বললো, খেলাধুলো আর ছুটোছুটি না করার ফল হাতে নাতে পেয়ে গেলি। চাটগাঁ গিয়ে রোজ দু ঘণ্টা ব্যায়াম করবি। তবে যদি ফরহাদ ভাইর মতো ফিগার বানাতে পারিস।
জয় জানতে চাইলো–তুমি কয় ঘণ্টা ব্যায়াম করো ফরহাদ ভাই?
সময় পাচ্ছি কখন? ছুটির দিন শুধু দু তিন ঘণ্টা সাঁতার কাটি।
রিমি বললো, রেগুলার ব্যায়াম না করলে কখনও তোমার এত সুন্দর ফিগার হতো না।
কলেজ ইউনিভার্সিটিতে থাকতে করতাম । সিমি, আমাদের চা দেবে না?
চা দেয়ার আগে সিমি সবাইকে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট খেতে দিলো। তারপর কাগজের গ্লাসে পানি দিলো। সবার শেষে চা। এসব কাজে সিমি খুবই গোছালো।
চা খাওয়া শেষ হলে জয় ওর গ্লাসটা জঙ্গলে ছুঁড়ে দিতে যাচ্ছিলো–রিমি বাধা দিলো–খালি গ্লাস ব্যাগে রাখো সবাই। আমাদের কোনো চিহ্ন যেন কোথাও পড়ে না থাকে।
মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে ওরা আবার বন্দুকের গুলির শব্দ লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলো। আগের চেয়ে অনেক বেশী জোরালো হলো গুলি ছোঁড়ার শব্দ। রিমি গুনেছে, একবারে বারোটি শব্দ হচ্ছে পর পর। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি। হঠাৎ ওর মনে হলো হারিয়ে যাওয়া কারও বন্দুকের শব্দ এটা নয়। কেউ হারিয়ে গেলে এত সময় মেপে শব্দ করার মতো হুঁশ থাকতো না ।
শব্দের আরও কাছে যেতেই ওরা দেখলো ঘন জঙ্গলের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে আছে। সৈন্যদের ব্যারাকের মতো লম্বা টিনের ঘর তিনটা। দূরে আরও গোটা দশেক মাঝারি আকারের খড়ের ঘর । রিমি ব্যাগ থেকে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখলো–ফাঁকা মাঠে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন লোক দূরে নিশানা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। ওদের কাছ থেকে সামান্য দূরে এক দল লোক ড্রিল করছে। রিমি বললো, মনে হচ্ছে কোনো আর্মি ক্যাম্প।
ফরহাদ অবাক হলো, এখানে আর্মি ক্যাম্প? কিছুই তো জানি না!
তখনও ওরা জঙ্গল থেকে বেরোয়নি। দূর থেকে ঘন গাছ-পালার আড়ালে কেউ ওদের দেখতে পাবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তবু সাবধান হওয়ার জন্য রিমি চাপা গলায় বললো, সবাই বসে পড়ো। আমরা এখানে থেকে ক্রল করে ওই টিলাটার ওপর উঠবো। সেখান থেকে সব কিছু দেখা যাবে।
সুমন বললো, এটা যদি আর্মির কোনো সিক্রেট ট্রেনিং সেন্টার হয় আমাদের কাছে যাওয়া কি উচিৎ হবে?
কোনো ঘেরা নেই, নোটিস নেই, ওরা আর্মি কিনা তাও জানি না। কাছে গিয়ে দেখলে ক্ষতি কি!
ফরহাদ বললো, ওদের চোখে না পড়লে কোনো ক্ষতি নেই।
মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে দুহাতের কনুই দিয়ে ক্রল করে ওরা ধীরে ধীরে টিলার ওপর উঠলো। সবার দেখাদেখি নিকিও ক্রল করলো, যদিও তার কোনো দরকার ছিলো ্না। বড় দুটো সেগুন গাছ ছিলো টিলার ওপর। গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বন্দুক ছোঁড়ার দৃশ্যটা ওরা পরিষ্কার দেখতে পেলো।
এরা কেউ আর্মির লোক নয়। অবাক হয়ে বললো সুমন।
কী ভাবে বুঝলে? জানতে চাইলে রিমি।
ওরা আর্মি হলে মাথার চুল কাটার স্টাইল একরকম হতো!
অর্থাৎ বাটিছাট। হেসে ফেললো জয়।
সুমন বললো, দেখছো না ওদের একেক জনের চুল একেক রকম! একেবারে ডান দিকেরটার দিকে তাকিয়ে দেখ, কম লম্বা চুল! মনে হয় রিবন দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে।
তাহলে ও ঠিক কানকাটা রমজান হয়ে যাবে।
সিমি বললো, আমার মনে হয় ওরা শান্তিবাহিনীর লোক।
রিমি চাপা গলায় সুমনকে বললো, তোমরা এখানে থাকো। আমি আর ফরহাদ ভাই। আরেকটু কাছে গিয়ে দেখি ওরা কারা?
সুমন মাথা নাড়লো–না রিমি, যেতে হলে আমি আর ফরহাদ ভাই যাবো।
ওরা যদি শান্তিবাহিনীর লোক হয় তাহলে আমাদের নিশ্চয় ছেড়ে দেবে না।
ফরহাদও ওকে সমর্থন করলো–সমুন ঠিক বলেছে রিমি। আমরা যদি ধরা পড়ি তখন আমাদের উদ্ধারের পুরো দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে। আজই রাঙ্গামাটিতে এসপি হায়দার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
সুমনের কথায় রিমি একটু মনক্ষুণ্ণ হলেও ফরহাদ ওকে যেভাবে দায়িত্ব নেয়ার কথা বললো তাতে আর আপত্তির কোনো কারণ খুঁজে পেলো না। সুমন বললো, তোমরা যেভাবে এসেছো সেভাবে পিছিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাও। আমরা খবর নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো।
সিমি বললো, এখানে তোমাদের কাছে থাকলে কী হয়?
যদি ওদের হাতে ধরা পড়ি ওরা দেখতে চাইবে সঙ্গে আর কেউ আছে কিনা। তোমরাও যদি ধরা পড়ে তাহলে উদ্ধারের আর কোনো পথই খোলা থাকবে না।
রিমি সুমনের কথায় সায় জানালো–ওরা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি তাছাড়া ওদের বন্দুক আছে। এখানে ওদের চোখে পড়লে পালাতে পারবো না।
সুমন ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা জয়কে দিলো–এটা তোের কাছে রাখ। ওরা ধাওয়া করলে এটা নিয়ে দৌড়ানো যাবে না।
ফরহাদ বললো, তোমার আগে জঙ্গলে ঢোকো। তারপর আমরা এগুবো।
সিমি, রিমি আর জয় কথা না বাড়িয়ে নিকিকে সঙ্গে নিয়ে আগের মতো ক্রল করে জঙ্গলে ঢুকে গেলো। ফরহাদ ভালো মতো তাকিয়ে দেখলো–ওদের দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলে গাছের আড়াল থেকে রিমিরা অবশ্য ফরহাদ আর সুমনকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলো।
খোলা মাঠের ভেতর যারা এতক্ষণ বন্দুকের নিশানা ঠিক করছিলো তারা এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। যারা ড্রিল করছিলো এই শীতের সকালেও ঘামে ওদের শরীর চকচক করছে। সবার পরনে ট্র্যাকস্যুটের প্যান্ট ওপরে হাতাকাটা গেঞ্জি আর পায়ে সাদা ক্যানভাসের জুতো। টিলার ওপর থেকে ফরহাদ ড্রিল মাস্টারের গলা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলো ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর, ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর।
ড্রিল মাস্টারের বয়স চল্লিশের মতো হবে, পুরো ট্র্যাকস্যুট পরা, শরীরের গড়ন একটু ভারি, মুখের সাদা কালো দাড়ি কাচি দিয়ে ছাঁটা, গোঁফ কামানো, মাথার চুলও ছোট। চাপা গলায় সুমন বললো, দাড়িওয়ালা ড্রিল মাস্টারকে মনে হচ্ছে আর্মির লোক।
সুমন বললো, চলো আরেকটু সামনে যাই।
সামনে আর ডানে বায়ে তাকিয়ে ফরহাদ ভালো করে দেখলো জায়গাটাকে। ওরা আছে ব্যারাকের ওপর দিকে ব্যারাকের পুব দিকে। একটু দূরে দুটো টিনের ঘর । টিনের ঘরের দুই দিকেই গাছ পালা রয়েছে। ওর ভেতর একটা ছিলো ঝড়া ছাতিম গাছ। ফরহাদ বলো, আমরা ছাতিম গাছের ওপর থেকে ওদের ওপর নজর রাখবো।
টিলা থেকে টিনের ঘর পর্যন্ত কয়েকটা পুরনো গাছ ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ আর সুমন এক গাছের আড়ল থেকে আরেক গাছের আড়ালে ছুটে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। যখন দেখলো ওদের ওপর কারও চোখ পড়েনি তখন আবার সামনের গাছের আড়াল লক্ষ্য করে ছুটলো।
মিনিট দশেকের ভেতর ওরা ছাতিম গাছের তলায় পৌঁছে গেলো। গাছে উঠতে ওদের কোনো অসুবিধে হলো না। ছাতিম গাছের নিচের দিকেই মোটা মোটা ডাল ছিলো। ফরহাদ আর সুমনকে রিমিরা আর দেখতে পেলো না।
গাছে উঠে জায়গা মতো বসে ওরা লক্ষ্য করলো টিনের ঘর থেকে একজন মাঝ বয়সী লোক পরনে লম্বা কোর্তা আর উঁচু করে পরা লুঙ্গি লম্বা পায়ে হেঁটে গিয়ে ড্রিল মাস্টারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ওকে আসতে দেখেই ড্রিল মাস্টার ড্রিল করানো বন্ধ রেখেছিলো। সামনের ছেলেরা সবাই সারিবদ্ধভাবে সটান দাঁড়িয়ে আছে। আর্মি না হলেও ভাবভঙ্গি পুরোপুরি ওদের মতোই। ড্রিল মাস্টার চেঁচিয়ে বললো, নারা লাগাও! নারায়ে তকবীর!
সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বললো, আল্লাহু আকবর।
সুমনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ফরহাদ ভাই, এরা জামাতী! আগে শুনেছিলাম, হিল ট্র্যাক্টে ওদের গোপন ট্রেনিং সেন্টার আছে! চলুন পালাই! ধরতে পারলে জবাই করে দেবে।
ফরহাদ বললো, পালাবো কেন? চলো, জঙ্গলের ভেতর থেকে ওদের ওপর নজর রাখবো।
এক এক করে ওরা ছাতিম গাছ থেকে নামলো। নামার সময় বুঝি কোনো শব্দ হয়েছিলো, ওরা টের পায়নি। জঙ্গলের দিকে কয়েক পা এগোতেই পেছন থেকে কে যেন লোহার মতো শক্ত হাতে ওদের জড়িয়ে ধরে কফ জড়ানো গলায় চিৎকার করলো চিড়িয়া পাকড়া। জলদী আও!
.
০৮. শয়তানের আস্তানা
ফরহাদ আর সুমন কীভাবে ধরা পড়লো দূরের জঙ্গল থেকে সিমি, রিমি, জয় কিছুই দেখতে পেলো না। বেলা তখন প্রায় বারোটা। সব খবর নিয়ে যে কোনো সময়ে ফরহাদ আর সুমন ফিরবে সে আশায় গাছের নিচে বসেছিলো ওরা। ওদের চোখ ছিলো দূরের ফাঁকা জায়গাটার ওপর। রিমির তেষ্টা পেয়েছিলো। জয় ওকে বোতল থেকে কাগজের গ্লাসে পানি ঢেলে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি চা খাবে?
সিমি বললো, ফরহাদ ভাইরা ফিরে আসুক। একসঙ্গে খাবো।
রিমি দুটো বিস্কুট খেয়ে তারপর পানি খেলো। ওর পাল্লায় পড়ে জয়কেও খেতে হলো। হঠাৎ গরগর করে উঠলো নিকি। জয় বললো, কী হয়েছে নিকি?
নিকি তাকিয়েছিলো দূরের ছাতিম গাছটার দিকে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ওরা তিনজন সেদিকে তাকালো সিমি আর্ত চিৎকার করলো –এ কি!
রিমি চাপা রাগী গলায় বললো, ফরহাদ ভাই আর সুমন ভাইকে শয়তানগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে।
জয় ফিশফিশিয়ে বললো, এক্ষুণি বাড়ি চল। আব্বকে খবর দিতে হবে।
রিমি শক্ত গলায় বললো, ওদের সঙ্গে না নিয়ে আমি ফিরে যাবো না।
সিমি বললো, কী সব পাগলের মতো কথা বলছিস। ফরহাদ ভাই কী বলেছেন ভুলে গেছিস?
আমরা এখান থেকে চলে গেলে পর আর ওদের ট্রেস পাবো না।
ওখানে কম করে হলেও শ খানেক লোক আছে। অস্ত্র আছে ওদের। খালি হাতে আমরা কী ভাবে লড়বো ওদের সঙ্গে?
সাহস থাকলে অনেক কিছুই করা যায়।
নিকি সামনে গরগর করছিলো। জয়ের ধমক খেয়ে এখন চুপচাপ বসে আছে। রিমি চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখলো ফরহাদ আর সুমনের দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ওরা তিন ব্যারাকের মাঝখানটায় ঢোকালো। উত্তেজিত হয়ে ও বললো, দুপুরে খাওয়ার পর ওরা নিশ্চয় বিশ্রাম নেবে। তখন আমরা একবার চেষ্টা করে দেখবো।
সিমি আবারও বললো, চেষ্টা করতে গিয়ে আমরাও যদি ওদের হাতে ধরা পড়ি–কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না আমাদের কী হয়েছে।
রিমি তখনও রাগে আর উত্তেজনায় কাঁপছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললো, তুই যা করতে চাইছিস তাতে ফরহাদ ভাইদের আশা আমাদের ছাড়তে হবে।
জয় বললো, তা কেন হবে? রাঙ্গামাটি থেকে ফোর্স এনে আমরা শয়তানদের ঘাঁটি পুরোটা ঘিরে ফেলবো। দরকার হলে আর্মিকেও বলবো। জিওসি জেনারেল শরিফকে আল্লু ভালোভাবে চেনেন।
জেনারেল শরিফ নিজে এলেও কোনো অবস্থায় কালকের আগে আসতে পারছেন না। আমাদের বাড়ি ফিরতেই বিকেল হয়ে যাবে। রাঙ্গামাটি যেতে যেতে এরাও জেনে যাবে পুলিস আর আর্মিকে যে আমরা খবর দিয়েছি। বিপদ বুঝলে ফরহাদ ভাইদের ওরা খুন করে ফেলবে।
সিমি আপন মনে বললো, ওরা কারা সেটাই তো বুঝতে পারলাম না!
জয় বললো, কারা আবার, নিশ্চয় শান্তিবাহিনীর ডাকাতরা!
রিমি চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে বসেছিলো বললো, ওরা এখন গোসল করতে যাচ্ছে।
জয় রিমির হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে ব্যারাকের দিকে তাকিয়ে দেখলো ব্যারাকের পেছনে বড় একটা পুকুরের মতো, গাছপালার জন্য সবটুকু দেখা যাচ্ছে না। খালি গায়ে তেল মাখতে মাখতে অনেকে পুকুরের দিকে যাচ্ছে, দশ বারো জন সাঁতার কাটছে, অনেকে আবার গোসল সেরে ফিরছে।
রিমি বললো, জয় চা দে। মনে হচ্ছে দুপুরে আর কিছু জুটবে না। আপু, চা খেয়ে নে।
সিমি ম্লান মুখে বললো, তোরা খা, আমার ভালো লাগছে না।
দ্যাখ আপু, ফরহাদ ভাই আর সুমন ভাইর জন্য তোর মন খারাপ আর আমাদের কিছু হয়নি এ কথা ভাবছিস কেন? শয়তানদের খপ্পর থেকে ওদের উদ্ধার করতে হবে। না খেয়ে নেতিয়ে গেলে ফরহাদ ভাইদের জন্য সেটা ভালো হবে না।
চায়ের সঙ্গে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট খেলো ওরা চার পাঁচটা করে। নিকি শুধু বিস্কুট আর পানি খেলো। জয় বললো, একটা বাজে। আম্মু নিশ্চয় আমাদের ডাকার জন্য লোক পাঠিয়েছেন।
রিমি বললো, আমার মনে হয় না দুটোর আগে আমদের খোঁজা হবে।
সিমি বললো, যখনই খুঁজুক, কেউ ভাবতেও পারবে না আমরা এখানে আছি।
ঠিক তখন দু নম্বর ব্যারাকের নিচে মাটির তলার প্রায় অন্ধকার এক ঘরে বসে সুমন বললো, সিমিরা ভাবতেও পারবে না আমরা এখানে আছি।
এক ঘণ্টা আগে ওদের এই ঘরটায় এনে ঢোকানো হয়েছে। ব্যারাকটা টিনের হলেও মেঝে ছিলো পাকা। একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওদের নিচে নামানো হয়েছে। ঘরে তিন দিকের দেয়াল অর্ধেক ইটের, অর্ধেক কাঠের। দশ বাই বারো ফুটের ঘরে আলো বাতাসের একমাত্র উৎস হচ্ছে দক্ষিণের পাকা দেয়ালের ওপরের দিকে সিলিঙে লাগানো ভেন্টিলেটার। বেশি বড়ও নয় ভেন্টিলেটারটা। দুই বাই তিন ফুট, লোহার গ্রিল বসানো। মাঝে মাঝে ওটার দিকে অসহায়ভাবে তাকানো ছাড়া ফরহাদ আর সুমনের করার কিছু ছিলো না। ওদের দুজনের হাত তখনও পিছ মোড়া করে শক্ত ভাবে বাঁধা। নাইলনের দড়িতে এরই মধ্যে ফরহাদের হাত কেটে গেছে দু জায়াগায়। ঘরে ঢোকানোর পর একবার দড়ি খোলার চেষ্টা করেছিলো-তারই ফল।
যে লোক দুটো ওদের এ ঘরে এনে রেখে গেছে তাদের একজন যাওয়ার সময় বলেছে, চুপচাপ বসে থাকো। একটু পরে ছোট হুজুর আসবেন। যা যা জানো ঠিকমতো জবাব দেবে। উল্টাসিধা কিছু করলে জাহান্নামের টিকেট হাতে ধরিয়ে দেবো।
ঘরের একটাই দরজা, লোহার পুরু শিট দিয়ে বানানো, বাইরে থেকে আটকানো। দরজা বন্ধ করার পর ওরা তালা আটকানোর শব্দ ভেতর থেকে শুনতে পেয়েছে। ছাতিম তলা থেকে ব্যারাক পর্যন্ত আসতে আসতে সুমন লক্ষ্য করেছে বাইরে যে পরিমাণ লোক আগে দেখেছে ব্যারাকের এক নম্বর ছাউনিতে লোকজন তার চেয়ে কম হবে না। এক ঝলকের জন্য ওর চোখে পড়েছে লোকগুলো সারি বাঁধা কাঠের বাক্সে কী যেন ঢোকাচ্ছে। সুমন ওদিকে তাকাতেই পেছন থেকে একজন বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ওর পিঠে গুতো দিয়েছে–ডাইনে বামে তাকাবে না। মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটো।
একটা প্যাকিং বাক্সের গায়ে হেলান দিয়ে মাটিতে বসেছিলো ওরা। সুমন ফরহাদের কাছে জানতে চাইলো–ওরা জেরা করতে এলে কী বলবে?
তখনই দরজার তালা খোলার শব্দ হলো। ফরহাদ তাড়াতাড়ি বললো, যা বলার আমি বলবো। তুমি চুপ থেকো।
দরজা খুলে প্রথমে ঘরে ঢুকলো স্টেনগান হাতে এক লোক, পরনে কালো প্যান্ট, কালো গেঞ্জি। গায়ের রঙও কালো। লোকটা ঝটপট মাথা ঘুরিয়ে সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আরেকজন ঢুকে ফরহাদদের বললো, উঠে দাঁড়াও। ছোট হুজুর আসছেন।
ফরহাদ আর সুমন উঠে দাঁড়ালো। ঘরে ঢুকলো পাকিস্তানীদের মতো কোর্তা আর সালোয়ার পরা এক লোক। বয়স চল্লিশের কাছে, মাথায় কদম ছাট চুল, গায়ের রঙ ফরসা, থুতনিতে একটু খানি ছাগুলে দাঁড়ি, গোঁফ একেবারে কামানো, চোখে চশমা। চশমার কাঁচের নিচে চোখ দুটো মরা মানুষের মতো ভাবলেশহীন। লোকটার পেছন পেছন আরেকজন একটা চেয়ার হাতে ঢুকলো। ছাগুলে দাঁড়ি ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই চেয়ারখানা ওকে পেতে দেয়া হলো।
ফরহাদ আর সুমনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে ছাগুলে দাঁড়ি মিহি গলায় জিজ্ঞেস করলো, তারপর বলুন জনাব, এখানে কেন তশরিফ এনেছেন? নিজেদের পরিচয়টাও দিন।
আমার নাম ফরহাদ আহমেদ, হরিণছড়ির রবার প্রজেক্টের ম্যানেজার। এ আমার মামাতো ভাই সুমন। কাল বেড়াতে এসেছে। ওকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম। এদিকে আসতে আপনাদের লোক খামখা এখানে বেঁধে এনেছে।
মাশআল্লাহ! আমাদের বরকন্দজরা সহী আদমিকে এনেছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো ছাগুলে দাড়ি। একটু পরখ করে নিলে হয় না এই জনাব তার ইসমে শরিফ সহী ফরমালেন কিনা!
জ্বী হুজুর। বলে লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
ছাগুলে দাড়ি আঙ্গুল তুলে পশ্চিমের দেয়ালটা দেখিয়ে ফরহাদকে বললো, জনাব, মেহেরবাণী করে আপনি ওদিকে তাকান।
দেয়ালের অর্ধেক পাকা, বাকি অর্ধেক কাঠের। কাঠের মাঝখানে ছোট একটা ফুটো। ফরহাদ লক্ষ্য করলো সেই ফুটোয় চোখ লাগিয়ে কেউ ওকে দেখছে। কে সেটা বোঝার উপায় নেই। একটু পরে ছাগুলে দাড়ির চ্যালা এসে ওর কানে কানে কী যেন বললো।
ফরহাদের দিকে তাকিয়ে ছাগুলে দাঁড়ি বললো, আপনি আপনার পরিচয় সাচ বলেছেন। লেকিন বেড়ানোর কাহিনীটা ঝুট বলেছেন। আপনার অন্য কোনো ইরাদা ছিলো।
আপনি নিশ্চয় জানেন, দুদিন ধরে আমাদের অ্যাকাউন্টেন্ট রাজেন সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাগুলে দাঁড়ির চোখে চোখ রেখে ফরহাদ বললো, আমরা ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।
ফরহাদের কথায় ছাগুলে দাঁড়ির চেহারায় কোনো ভাবান্তর হলো না। নির্বিকার গলায় বললো, আপনার অ্যাকাউন্টেন্ট কোথায় গায়েব হলো, আমরা জানবো কী ভাবে? আজকাল মালাউনরা সব ইন্ডিয়া ভেগে যাচ্ছে।
ফরহাদ বললো, আপনি আমাদের পরিচয় জেনেছেন। আপনার নিজের পরিচয় তো দিলেন না। আপনারা কারা, এখানে কী করছেন জানতে পারি?
এত জলদি জানতে চান কেন? সকাল থেকে গাছে উঠে বসে সব দেখেছেন, নিজেরা কিছু মালুম করতে পারেন নি?
আপনারা কি জামাতে ইসলামীর লোক?
আমরা কারা সেটা জানার এখতিয়ার আপনার নেই। আপনারা বিনা এজাজতে আমদের এলাকায় ঢুকে জাসুসি করেছেন। এর জন্য আপনাদের কড়া সাজা দেয়া হবে।
ফরহাদ কোনো কথা বললো না। মনে মনে ভাবলো ছাগুলে দাড়ির কাছ থেকে ওদের কথা জানতে হবে। ওকে চুপ থাকতে দেখে ছাগুলে দাড়ি একটু হেসে বললো, বলুন জনাব, কী সাজা পেতে চান আপনারা?
আপনার যদি মনে হয় আমরা আপনাদের জায়গায় ট্রেসপাস করেছি, পুলিসে খবর দিন। কেস করুন।
খিক খিক করে হেসে ছাগুলে দাঁড়ি বললো, আমাদের এলাকায় স্রেফ আমাদের হুকমত চলে। এখানে পুলিসও আমরা, আদালতও আমরা।
আপনাদের এলাকা কতখানি জানতে পারি?
আপনাদের প্রজেক্ট আমাদের এলাকার মধ্যে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, কক্সবাজার, চিটাগাং–সবই আমদের এলাকার মধ্যে। এখানে আমরা যা বলবো সেটাই আইন।
আপনারা কি আমাদের মেরে ফেলবেন? আপনারা যদি ভুল করে স্রেফ ট্রেসপাস করতেন তাহলে অত কড়া সাজা দিতাম না। বেশি হলে পায়ের শিরা কেটে দিতাম। আপনারা জাসুসি করেছেন। জাসুসদের একটাই সাজা, সেটা হলো মউত।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যা কথা বলেন না। ইমানদার মুসলমান কখনো সত্য গোপন করে না। ঠিক কি না বলুন?
বিলকুল ঠিক। কী বলতে চান বলুন!
আমাদের মেরে ফেলার আগে আমি একটা কথাই জানতে চাই। রাজেন সরকারকে কি আপনারা কিডন্যাপ করেছেন?
হ্যাঁ এনেছি। ও বেঈমানি করেছে। তার জন্য ওকেও সাজা দেয়া হবে
কী ভাবে ও বেঈমানি করলো?
ও আমাদের দলে যোগ দিতে চেয়েছিলো। ওকে যখন কাজের দায়িত্ব দেয়া হলো ও ইনকার করলো। বুজদিল, বেঈমানদের আমরা মাফ করি না।
হঠাৎ সুমন বললো, প্রফেসর জাকারিয়াকেও তাহলে আপনারা আটকে রেখেছেন?
তার খবর আপনি কী করে জানলেন?
চিটাগাং-এর এসপি আমাদের আত্মীয় হন। তিনি বলেছেন।
তিনি কি বলেছেন এ কাজ আমরা করেছি?
তার ধারনা তাই।
কেন এরকম ধারণা করলেন?
আমি জানি না। প্রফেসরকে আপনারা কেন আটক করেছেন?
একটু ভেবে ছাগুলে দাঁড়ি আপন মনে হাসলো। বললো, আগামী কাল আপনারা যখন মরতে যাচ্ছেন তখন বলা যেতে পারে। প্রফেসর জাকারিয়ার বোকামির জন্য আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিটা কি সোনার বিস্কুট হাতছাড়া হওয়া।
আপনি তো অনেক কিছু জানেন! ছাগুলে দাঁড়ি একটু হেসে বললো, আর কী জানেন বলুন তো!
তিন দিন আগে আপনাদের ছেলেরা ইউনিভার্সিটিতে একটা ছেলেকে খুন করেছে।
এ আর এমন কী! আমাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের আমরা কড়া সাজা দিই।
ফরহাদ প্রশ্ন করলো, সত্যি করে বলুন তো আপনারা কী চান?
আমরা সৎ লোকের শাসন চাই। কোরানের শাসন চাই। এদেশে আমরা ইসলামী হকুমত কায়েম করতে চাই।
কোনোদিন কি পারবেন?
আমরা ইচ্ছে করলে কালই পুরা চিটাগং আমাদের কজায় নিতে পারি। রাজশাহীও আমাদের কজায় আছে। স্রেফ ঢাকা কজা করার বাকি আছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তো চেষ্টা করেছিলেন। ছিয়ানব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা সঙ্গে নিয়েও তা পারেন নি।
তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। তখন অ্যাসেম্বলিতে আমাদের কোনো সিট ছিলো না। এখন বিশটা সিট আছে। সামনের ইলেকশনে আমরা একশটা সিট পাবো। তামাম দুনিয়ায় ইসলামী হকুমত কায়েমের জোশ উঠেছে। যাক, বহুৎ বাতচিৎ হলো। আপনাদের মতো ওয়াকেবহাল লোকের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো। কাল বিকেলে আপনাদের ফাঁসি দেয়া হবে। আমার সঙ্গে আর আপনাদের দেখা হবে না।
কথা শেষ করে ছাগুলে দাঁড়ি উঠে দাঁড়াতেই সুমন বললো, ফাঁসিতে ঝোলার আগে পর্যন্ত আমাদের কি খেতে দেয়া হবে না?
জরুর দেয়া হবে। এই বলে ছাগুলে দাঁড়ি ওর চ্যালাকে বললো, গুলাম মুহাম্মদ, ইনাদের খানাপিনার কোয়ি তকলিফ যেন না হয়! এরপর ফরহাদদের বললো, আপনারা জোয়ান আছেন, খুন গরম আছে, তবু বলি–কোনো ঝুট ঝামেলা করবেন না। পাশের ঘর থেকে আপনাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
ছাগুলে ওর দলবল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওযার মিনিট পনেরো পর ওদের জন্য খাবার এলো। খাবার নিয়ে এসেছে একজন, সঙ্গে দুজন স্টেনধারী। আগের মতো ঘরের দুই কোনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালো কালো পোশাক পরা স্টেনধারীরা। বড় ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসা লোকটা প্যাকিং বাক্সের ওপর ট্রে রেখে ওদের হাতের বাঁধন খুলে দিলো বললো, ঘরের ওই কোনায় ড্রেন আছে। হাত ধুয়ে নাও। পেশাব এলে ওখানে করবে। কোনো রকম চালাকি করলে গুলি করে ছাতু বানিয়ে দেবো।
ফরহাদ আর সুমন জগের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে আটা রুটি দিয়ে ডাল-গোশতের রান্না পেট ভরে খেলো। এতক্ষণ বাঁধা থাকার জন্য ওদের হাত দুটো অসাড় হয়ে গিয়েছিলো। খেতে খেতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হলো।
খাওয়া শেষ করে সুমন দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে বললো, মেহেরবাণী করে এক জগ পানি রেখে যাবেন?
না। নির্বিকার গলায় লোকটা বললো, পানি যা খাওয়ার খেয়ে নাও। এরপর রাত আটটার সময় খানা আসবে। এখন তোমাদের হাত বাধা হবে।
হাত বাঁধলে আমরা পেশাব করবো কীভাবে?
যা করার এখন করে নাও। আবার আটটায় করবে। যাও জলদি করো।
সুমন যা ভেবেছিলো কিছুই করা সম্ভব হলো না। লোকটা আগের চেয়েও শক্ত করে ওদের দুজনের হাত বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঘটা করে তালা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো–ফরহাদ ভাই, মনে হচ্ছে বাঁচার আর কোনো আশা নাই।