সেইদিনই দ্বিপ্রহরে।
আহারাদির পর শিউশরণ একটা জরুরী তদন্তে বাইরে বের হয়েছে। সুব্রত একটা নভেল নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।
কিরীটী একটা আরামকেদারার ওপরে একটা বা চুরুট ধরিয়ে ঐদিন সকালে তদন্তের সময় মৃত অতুলের সুটকেসে প্রাপ্ত ডায়েরীটা নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টে চলেছে।
এক জায়গায় লেখা:
মাঝে মাঝে ভাবি মণি কি ধাতুতে গড়া! সত্যিই কি ওর মনের মধ্যে কোন নারীমন আছে? না দেহেই শুধু ও নারী! মনের দিক দিয়ে ও নপুংসক! এই দীর্ঘ পরিচয়ের মধ্যে আমাদের তিন পুরুষ বন্ধুর কেউই কি ওর মনে কোন আঁচড়ই কাটতে পারিনি!
.
আবার এক পাতায় লেখা:
বাবা মা এত করে বলছেন বিবাহের জন্য। কিন্তু কেমন করে তাঁদের বলব বিবাহ করলে আমি সুখী হতে পারব না। সমস্ত মন আমার আচ্ছন্ন করে রয়েছে সে। অথচ নিজের মনে নিজেই যখন বিশ্লেষণ করি অবাক হয়ে যাই। কি আছে ওর? রূপ তো নয়ই। ওর মত মেয়েরও বাংলাদেশে অভাব নেই। আচ্ছা ও কি কোন জাদু জানে! নচেৎ এমন করে আমাদের প্রত্যেককে ও আকর্ষণ করে কেন?
***
মাঝে মাঝে ভারি জানতে ইচ্ছে করে আমাদের সম্পর্কে ওর মনোভাব কি? যে যাই বলুক ও তো মেয়েমানুষই! নিশ্চয়ই ওর মনের মধ্যে কারও সম্পর্কে কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকা সম্ভব। সুকান্ত ও রণেনকে জিজ্ঞাসা করব খোলাখুলি! না না, ছিঃ! কি ভাববে ওরা! যদি হাসে! ব্যঙ্গ করে! না না, সে হবে মর্মান্তিক। কিন্তু এমন করে মনের সঙ্গেই বা কতকাল যুদ্ধ করা যায়? এর চাইতে স্পষ্টাস্পষ্টি একদিন সব কিছুর মীমাংসা করে নেওয়াই তো ভাল।
.
I dont believe Sukanta! বিশ্বাস করি না ওকে আমি। তলে তলে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে সুকান্তর কোন বোঝাপড়া হয়েছে।
কিন্তু তাই যদি হয়, বন্ধু বলে ক্ষমা করব না সুকান্তকে।
একজন আমরা ওকে পাব বাকি দুজন পাবে না, না—এ হতে পারে না।
তার চাইতে এ অনেক ভাল।
বহুবল্লভাই ও থাক।
ও আমাদের দ্রৌপদী!
.
কিরীটী পাতার পর পাতা উল্টে চলে—সবই প্রায় একই ধরনের কথা। সেই একটি মেয়ের জন্য মনোবিকলন। কখনও রাগ, কখনও অভিমান, কখনও হিংসা। লেখার প্রতিটি কথার মধ্য দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
কিরীটী দু-এক লাইন করে পড়ে আর উল্টে যায়।
হঠাৎ মাঝামাঝি একটা পাতায় এসে ওর মন সচেতন হয়ে ওঠে যেন নতুন করে।
***
উঃ! চোখ যেন ঝলসে গেল আমার। আগুনের একটা হঠাৎ ঝাপ্টা যেন চোখের দৃষ্টি আমার কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দিয়ে গেল। মূর্তিমতি অগ্নিশিখা যেন। আলোর একটা শিখা যেন ঊর্ধ্বে বঙ্কিম হয়ে উঠেছে।
কি নাম দিই ওর? অগ্নিশিখা! না বহ্নিশিখা?
.
আবার এক জায়গায়।
না, আমার মনের ভুল নয়। ওর চোখের দৃষ্টিতেই ও ধরা পড়েছে। দুপুরবেলায় সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম হঠাৎ চোখাচোখি হল একেবারে সামনাসামনি।
কি যেন ও নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছিল। হঠাৎ এমন সময় উপরে মণির গলা শুনতে পেলাম। দুরদুর করে উঠল বুকের ভিতরটা।
ছিঃ ছিঃ—মণি যদি জানতে পারে লজ্জায় যে তার কাছে আর এ জীবনে মুখ দেখাতে পারব না। বলবে, এই তোমার ভালবাসা! এই চরিত্রের তুমি গর্ব কর!
মণির অসুখ। রাত্রে শিয়রে বসে আছি মণির মাথায় আইস্-ব্যাগটা ধরে। বোধ হয় একটু তামত এসেছিল। হঠাৎ একটা আগুনের মত তপ্ত স্পর্শে চমকে চোখ খুলে তাকালাম। আমার বাঁ হাতটা চেপে ধরেছে।
চাপা গলায় বললে, বাইরে চল! কথা আছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতই উঠে বাইরে এলাম। সাপের চোখের সম্মোহন দৃষ্টি যেন তার ছিল।
আমি আর পারছি না অতুলবাবু—
এসব কি বলছেন আপনি!
এ জীবনে কোন দিনই বলবই না ভেবেছিলাম, কিন্তু পারলাম না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এ কদিনে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছি–
ছিঃ ছিঃ! এ-কথা আপনারও যেমন বলা মহাপাপ, আমার শোনাও মহাপাপ!
পাপ!
হ্যাঁ। তাছাড়া ভুলে যাচ্ছেন আপনার সত্য পরিচয়।
ক্রুদ্ধা ভুজঙ্গিনীর মতই মুহূর্তে সে গ্রীবা বেঁকিয়ে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলে, কি বললেন?
আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ নন, ঘরে যান।
দেখ অতুলবাবু,আর যে-ই চরিত্রের বড়াই করুক তোমরা কেউ অন্তত করো না। তোমাদের সম্পর্কের কথা পরস্পরের মধ্যে আর কেউ না বুঝুক আমার চোখে চাপা দিতে পারবে না।
এসব কি বলছেন আপনি! সকলকে নিজের মত ভাববেন না। রাগে তখন আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় অন্য দিকে মুখ ফেরালাম।
সব চরিত্রবান যুধিষ্ঠিরের দল। বলতে বলতে চলে গেল সে। হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম আমি সেখানে।
.
তারপরই লেখা:
যাক। ও সুস্থ হয়ে উঠেছে।
উঃ! কি সাংঘাতিক ঐ বহ্নিশিখা! সাপের চেয়েও সাংঘাতিক মেয়েমানুষ! এ কদিন সর্বদা আমার একটা ভয় ছিল হয়ত আমার নামে মণির কাছে ও অনেক কিছু বানিয়ে বলবে। কিন্তু বলেনি।
.
তারপর আবার এক জায়গায় লেখা:
দাজিলিংয়ের ব্যাপারটা যে কি হল বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ সুকান্ত কাউকে না বলে-কয়ে রাতারাতি দাজিলিং হতে উধাও হয়ে গেল কেন!
মণি যতই চুপ করে থাক আমার স্থির বিশ্বাস নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে।
আর যার দৃষ্টিকেই ওরা এড়িয়ে যাক না কেন ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের হাবভাব,চোখে চোখে নীরব ইশারা স্পষ্ট আমার কাছে।
আমার কেন জানি মনে হয় আমাদের মধ্যে সুকান্তর ওপরেই মণির দুর্বলতা একটা আছে।
শেষ পর্যন্ত ভাগ্যলক্ষ্মী সুকান্তর গলায়ই করবে মাল্যদান!
.
তারপর শেষ পাতায়:
আবার কাশী। আবার সেই তপ্ত অগ্নিশিখার সম্মুখীন হতে হবে।
না বলতেও তো পারব না।
মণির আমন্ত্রণ। যেতেই হবে।
***
না। ও নিষ্ঠুর।
হৃদয় বলে ওর কোন বস্তু নেই।
সত্যি কি তাই!
***
আশ্চর্য ব্যবহার বহ্নিশিখার! এবার যেন মনে হচ্ছে ও একেবারে সম্পূর্ণভাবে বদলে গিয়েছে। অবশ্য নিজেও আমি মনের দিক দিয়ে কোন ক্ষীণতম আকর্ষণও অনুভব করছি না।
আচ্ছা এরই বা কারণ কি! ওর দিকে তাকালে আকর্ষণের বদলে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণাই বোধ করি।
ও রূপে মনের তৃষ্ণা তো মেটেই না, স্নিগ্ধও হয় না মন। বরং মনের মধ্যে জ্বলতে থাকে।
আর মণি!
দিন-দিনই যেন আকর্ষণ বাড়ছে।
ওকে দেখার তৃষ্ণা বুঝি এ জীবনে মেটবার নয়।
কিন্তু হায় রে তৃষ্ণা! ও যে মরীচিকা! মিথ্যা! মায়া!