০৭.
সিকোরস্কিটা মোয়ান্ডা বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করল, তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। কমিলগ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার হ্যাঁলিডে, ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার ক্লার্ক আর হাউট ওগোউয়ি প্রদেশের প্রিফেক্ট মিস্টার কোয়েলি অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দেরি হয়েছে আসতে। স্বভাবতই তাঁরা উদবিগ্ন হয়ে পড়েছেন। হেলিকপ্টারটাকে আকাশে দেখামাত্রই তাঁরা বাইরে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রাথমিক পরিচয় বিনিময়ের পর মিস্টার হ্যাঁলিডে বললেন, চলুন। গাড়ি তৈরিই আছে। সারাদিন যে ধকল গেছে, আগে একটু রেস্ট নিয়ে রিফ্রেশড হওয়া দরকার, তারপর সন্ধেবেলায় আমরা মিট করব। কোম্পানি গেস্ট হাউসেই আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
গাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই সুজন মিস্টার কোয়েলির কাছে ঘেঁষে এল। কোয়েলিকে পরিষ্কার ইংরেজিতে কথা বলতে শুনেছে বলেই সুজন চুপিসারে তাঁকে আহ্বান জানাবার সুযোগ পেল, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, একটু বাদে আমাদের ওখানে যদি আসতে পারেন, আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু গোপন কথা ছিল।
ভদ্রলোকের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল, কিন্তু মুখে কোনও শব্দ করলেন না তিনি। মাথাটাকে সামান্য একটু নড়তে দেখেই সুজন বুঝল, তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
দুখানা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মার্কিন গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটে চলল। পিয়ের মিস্টার ক্লার্ককে বলল, আপনাদের একটা জিনিস আমার খুব ভালো লাগে।
মিস্টার ক্লার্ক বাকি কথাটুকু শোনবার জন্যে হাসিমুখে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন।
আপনারা যেখানেই যান–একেবারে আমেরিকা সমেত হাজির হন।
মিস্টার ক্লার্ক কথাটার ঠিক মানে ধরতে পারেন না। তাঁর হাসিটা একটু শুকিয়ে আসে। ইউ মিন—
মানে, এই ধরুন, এই যে গাড়িটা চড়ে চলেছি, এখন কি মনে হচ্ছে যে, আমরা আফ্রিকার খনি অঞ্চলের ছোট্ট একটা শহরে এবং বিষুবরেখার খুবই কাছে?
মিস্টার ক্লার্ক স্বস্তি পান বোধহয়। ইতিমধ্যেই গাড়িটা নিচু পাঁচিল-ঘেরা বিরাট একটা বাগানের খোলা গেট গলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সামনেই একতলা অধিবৃত্তাকার গেস্ট হাউস। মাথায় টালির চাল। মাঝখানে একটা ফোয়ারা রয়েছে। তার তিন ধার ঘিরে বারান্দা। সারি সারি বেঁটেখাটো চেহারার চেয়ার পাতা। বারান্দার ছাত থেকে পিতলের শিকলিতে ঝোলানো কয়েকটা টব থেকে মানিপ্ল্যান্টের মতো এক ধরনের লতা উঠেছে। বারান্দার গোলাকার স্তম্ভগুলোকে জড়িয়ে।
এই দেখুন–আবার এখানে আমেরিকা। পিয়ের গেস্ট হাউসের দিকে আঙুল দেখাল।
মিস্টার ক্লার্ক হাসিমুখে দরজা খুলে দিল নামবার জন্যে। পিয়ের আর সুজন নামতেই তিনি বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন সঁসিয়ে, দেশ ছেড়ে এত দূরে প্রাণপাত করছি, এইটুকু আরাম না পেলে চলে
পিয়ের সিঁড়িতে দু-ধাপ উঠেছিল, পেছনে মুখ ফিরিয়ে বলল, কী বললেন, আরাম? কথাটা ভুল বললেন কিন্তু। এইসব বাড়িতে, গাড়িতে ঢুকে দম তো বন্ধ হয়ে যায়। বরং বলুন দাপট আমেরিকান চমক, তাই না?
ক্লার্কের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য পিয়ের আর দাঁড়াল না।
.
সকলেই স্নান সেরে বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে। কাপে করে কোকো দিয়ে বেয়ারাটা সরে যেতেই সুজন বলল, আমি মিস্টার কোয়েলিকে এখানে আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। বলেছি, আমরা তাঁর সঙ্গে কিছু আলোচনা করতে চাই।
ডক্টর সেনশর্মা বললেন, খুব ভালো করেছ সুজন। আমি চাই না আমাদের এক্সপিডিশনের সময় এরা আমাদের পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকুক। এই গাড়িতে করে আসার সময়েই ওরা আমার মগজধোলাই করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল।
পিয়ের রোজারের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা রোজার, এই প্রিফেক্ট ব্যাপারটা কী বলো তো? দেখে তো মনে হচ্ছে উনি বেশ হোমরাচোমরা লোক।
আজ্ঞে হ্যাঁ–ঠিকই বলেছেন। গ্যাবন দেশটাকে ন-টা প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এই মোয়ান্ডা হচ্ছে হাউট ওগোওয়ি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এই ন-টি অঞ্চলের ন-জন আঞ্চলিক প্রধান আছেন। তাঁদের প্রিফেক্ট বলা হয়। প্রিফেক্টের ক্ষমতা গ্যাবনের প্রেসিডেন্টের ঠিক পরেই।
রোজারের কথা শুনে ডক্টর সেনশর্মা সুজনের পিঠে হাত রাখলেন, তোমার দূরদৃষ্টি আছে ব্রাদার। ঠিক লোককেই তুমি পিক আপ করেছ দেখছি।
ডক্টর সেনশর্মা কথা শেষ করার আগেই ছোট্ট একটা গাড়ি দেখা গিয়েছিল রাস্তার মোড়ে। গাড়িটা গেটের কাছে একবার থেমেই চলে গেল। তারপরেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা মুখটা দেখা গেল।
রোজার তাড়াতাড়ি চেয়ার ঠেলে উঠে গেল। মিস্টার কোয়েলি বারান্দায় পা দিতেই সবাই তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। গাড়িটাকে রাস্তা থেকেই বিদায় দেবার মধ্যে একটা আন্তরিকতা আছে, যা সবার মনে রেখাপাত করেছে।
মিস্টার কোয়েলি একবার বারান্দার ওপর চোখ বুলিয়েই বললেন, আমরা বরং ভেতরে গিয়ে বসি, কী বলুন?
সেই ভালো। সুজন উঠে দাঁড়াল।
আর কিছু নয়। আমরা যে আলোচনায় বসছি, সেটা গোপন করার কোনও কারণ নেই, গোপন রাখা দরকার শুধু আলোচনার বিষয়টা।
মিস্টার কোয়েলির কথাই তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
ঘরে ঢুকে ইন্টারকমে মিস্টার কোয়েলির জন্য আরেক কাপ কোকোর অর্ডার দিল রোজার। গোল টেবিলটার ধারে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে সবাই।
সুজন বলল, আমরা কেন এসেছি, সে নিয়ে কোনও আলোচনা করার প্রয়োজন নেই বোধহয়।
মিস্টার কোয়েলি ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
সুজন বলল, তাহলে সরাসরি আসল প্রশ্নটাতে আসি। কারা প্রথম এই বিস্ফোরণের কথা জানতে পারে?
মোউনানাতে একটা ইউরেনিয়ামের খনি আছে, জানেন নিশ্চয়? একটা ট্রেমর পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। জায়গাটা ভূমিকম্পের বেল্টের মধ্যে পড়ে না, তাই ওখানকারই একটা খনিজ পদার্থসন্ধানী প্রসপেক্টিং টিম হেলিকপ্টারে করে অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। তারাই প্রথম অস্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করে।
মিস্টার কোয়েলি থামতেই ডক্টর সেনশর্মা চেয়ারের সামনে এগিয়ে বসে প্রশ্ন করেন, এ অবধি কেউ জায়গাটায় নেমে অনুসন্ধান করেছে?
আজ্ঞে না। তবে কিছু অঞ্চল থেকে অধিবাসীদের সরিয়ে আনা হয়েছে।
পিয়ের জানতে চায়, আপনাদের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কাছে কোনওরকম খবর আছে। কি? এরকম একটা বিস্ফোরণ তো এমনি এমনি হতে পারে না। বম্বিং করতে তো আকাশপথে আসতে হবে। কাজেই একেবারে কারও চোখে পড়বে না এটা বিশ্বাস করা যায় না।
প্রিফেক্ট কোয়েলির মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে, আপনার প্রত্যেকটি কথাই যুক্তিসংগত, তবু হার্ড রিয়ালিটি এটাই যে, কোনও খবরাখবর জোগাড় করা যায়নি। কেন যায়নি, তার কারণগুলো এক-এক করে বলছি। গ্যাবনে বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর আছে। প্রায় পঞ্চাশটার মতো। তার মধ্যে বেশির ভাগই প্রাইভেট। মানে, কোম্পানির এয়ারপোর্ট। খনি বা বনজ সম্পদ আহরণের জন্য এইসব কোম্পানি এখানে কাজ করছে। এখানে তেমন উন্নত ধরনের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক নেই। এই অঞ্চলে একটিমাত্র রাডার ইউনিট আছে, কিন্তু সেটিও কমিলগ কোম্পানির। এদের কারও কাছ থেকেই কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত।
খুবই স্বাভাবিক। এরা নিজেরাই যদি এর মধ্যে জড়িত থাকে তাহলে খবর পাওয়া যাবে কী করে? সুজন বলে।
রোজার জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে, গ্যাবনের কোনও প্লেন থেকেই বোমাটা ফেলা হয়েছিল?
ডক্টর সেনশর্মা বলেন, আমার মনে হয় না সেটা সম্ভব। অনেক হাঙ্গামা আছে, একটা পারমাণবিক বোমা ফেলা খুব সোজা ব্যাপার নয়।
পিয়ের প্রশ্ন করে, পিপলস রিপাবলিক অব কঙ্গোর সীমানা তো এখান থেকে খুব দূরে নয়, ওদের কাছ থেকে কোনওরকম খবর নেবার…
না, ওরাও কোনওভাবে আলোকপাত করতে পারেনি।
পিয়ের প্রশ্ন করল, কঙ্গোর সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কীরকম?
ভালোই। আমাদের সমস্ত ইউরেনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ আকর তো কঙ্গোর পয়েন্টে-নয়রে বন্দর থেকেই বিদেশে রফতানি হয়।
সুজন আবার বলল, কিন্তু এখানেও সেই স্বার্থের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। ওরা জানলেও খবর দেবে কি না, সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
পিয়ের বলল, কিন্তু যদি ধরা যায়, বম্বিং অপারেশনটা কঙ্গো থেকে হয়েছে বা ওদের জ্ঞাতসারে, তাহলে নিশ্চয় আমেরিকানরা ছেড়ে দিত না। কিছু খবরাখবর থাকলে নিশ্চয় জানাত।
মিস্টার কোয়েলি ঘাড় নেড়ে পিয়েরকে সমর্থন করলেন, তা ঠিক।
তবে এটাও ঠিক যে–মিস করার একটা সম্ভাবনাও যে-কোনও ক্ষেত্রেই থাকতে পারে। হয়তো সত্যিই রাডারে ধরা পড়েনি। অনেকরকম ডিসটার্বেন্স হয় জানেন তো আবহাওয়ার কারণে…
ডক্টর সেনশর্মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সুজন প্রশ্ন করল, কিন্তু আপনাদের নিজস্ব কোনও ইন্টেলিজেন্স নিশ্চয়…
মিস্টার কোয়েলি হাতটা উঁচু করে সুজনকে বাধা দিলেন। গ্যাবনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে ন-শোজনের এক সামরিক বাহিনী, পঞ্চাশজনের নৌবাহিনী, একটিমাত্র টহলদারি জাহাজ আর বিমানবাহিনীর একশো ষাটজন কর্মী। আরও শুনতে চান? গ্যাবনে অসামরিক পুলিশের সংখ্যা কত জানেন? ন-শোজন।
পিয়ের চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চুপ। পিয়ের ঘাড় ফিরিয়ে খুব চাপাস্বরে প্রশ্ন করল, আপনি কি মনে করেন, আপনাদের ইউরেনিয়ামের সঞ্চয়টা ধ্বংস করার জন্যে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে?
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মিস্টার কোয়েলি ফিরে তাকান, হোয়াট ডু ইউ মিন?
খুব সোজা কথা। আপনাদের সমস্ত ইউরেনিয়ামের একমাত্র ক্রেতা ফ্রান্স। কাজেই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে…।
মিস্টার কোয়েলি বলেন, কিন্তু বিস্ফোরণটা তো ঘটেছে ওকলোয় আর ইউরেনিয়ামের খনি আছে মোউনানায়।
ডক্টর সেনশর্মা হাত বাড়িয়ে মিস্টার কোয়েলির হাতটা টেনে নেন, উই অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর অ্যাটিচিউড মিস্টার কোয়েলি। আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। আপনাদের বিদেশমন্ত্রকের সেক্রেটারি মিস্টার বানিন আমাদের বিশ্বাস করেই কথাগুলো বলেছেন।
এতক্ষণে মিস্টার কোয়েলি একটু ধাতস্থ হন। গুড, গুড–আমি চমকে গিয়েছিলাম।
বিশেষ করে সাক্ষাৎ ফ্রান্সের একজন প্রতিনিধি যখন উপস্থিত, তা-ই না? পিয়ের হাসে।
সুজন হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা ডক্টর, এমনও তো হতে পারে যে এরিয়েল বোম্বিং করা হয়নি?
তাহলে? মিস্টার কোয়েলি প্রশ্ন করেন।
হতেও তো পারে। এই ধরুন, ব্যালিস্টিক মিসাইল উইদ অ্যাটমিক ওয়ার হেড!
সুজনের কথায় ঘরে যেন বজ্রপাত ঘটে। সম্ভাবনাটা এ অবধি কারও মাথায় আসেনি।
পিয়ের বিড়বিড় করে বলে, আটলান্টিক উপকূল থেকে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র সমেত ডুবোজাহাজের পক্ষে কাজটা মোটেই অসম্ভব নয়।
মিস্টার কোয়েলি বলেন, সেক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যেতে পারে, এটা হয় আমেরিকা, নয় রাশিয়ার কীর্তি।
সে তো বটেই। আমেরিকার পোলারিস কি পসাইডন আর না হলে রাশিয়ার স্যান্ডেল, স্কিন, সাসিন কি স্যাভেজ–এ ছাড়া তো আর কারও মিসাইলবাহী সাবমেরিন…
দরজায় টুক টুক ধাক্কা পড়তেই সুজন চুপ করে যায়। বেয়ারা কোকো রেখে যাবার পর ডক্টর সেনশর্মা বলেন, মিস্টার কোয়েলি, যা বুঝতে পারছি, সরেজমিনে তদন্ত ছাড়া আর এগোনো যাবে না। আপনার কাছে এই ব্যাপারে আমি কিছু সাহায্য চাই।
বলুন।
আমি চাই না কাল আমাদের সঙ্গে কোনও প্রাইভেট কোম্পানির লোক ওকলোয় যাক। বিশেষ করে কমিলগ কোম্পানির কেউ। কারণটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ফিল্ড ইনভেস্টিগেশনের সময়ে ওখানকার ইউরেনিয়ামের খনির কথা ওরা জেনে যেতে পারে। তা ছাড়া অনুসন্ধানের ফল যা-ই হোক-না, সেটা এই মুহূর্তে জানাজানি হতে দিতে আমি রাজি নই। খুব ভালো হয় যদি মোউনানা থেকে আপনি বিশ্বাসযোগ্য কাউকে আমাদের সঙ্গে দিতে পারেন। ওখানে নিশ্চয় কিছু গ্যাবনিজ দায়িত্বপূর্ণ পদে আছে, যারা ওকলোর ইউরেনিয়ামের কথা জানে।
হ্যাঁ তা আছে। আমার মনে হয়, আমি পারব—
আপনি একটু চেষ্টা করুন। আরও ভালো হয় যদি প্রসপেক্টিং-এর কাজ-জানা কেউ আসে। মানে যারা খনিজ পদার্থের অনুসন্ধান করে।
মিস্টার কোয়েলি বলেন, তাহলে একটা কাজ করলেই তো হয়। আমি জানি, মোউনানায় একটা স্পেশালি ডিজাইড হেলিকপ্টার আছে প্রসপেক্টিং-এর কাজের জন্যে। আমি আজই রেডিয়ো মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি, কাল ওরা একেবারে হেলিকপ্টার নিয়ে চলে আসবে। তাতেই আপনারা রওনা হয়ে যাবেন।
এক্সেলেন্ট।
মিস্টার কোয়েলি উঠে দাঁড়ান। আমার বোধহয় এবার উঠে পড়াই ভালো। কারণ সন্ধেবেলায় কমিলগ কোম্পানি আপনাদের আপ্যায়নের ভালোই ব্যবস্থা করেছে। আপনারা বরং তৈরি হয়ে নিন।
ডক্টর সেনশর্মা পকেট থেকে ডট পেন বার করে একটা কাগজের ওপর খসখস করে কী যেন লিখে মিস্টার কোয়েলির দিকে বাড়িয়ে দিলেন, আপনি যখন রেডিয়ো মেসেজ পাঠাবেন, এই জিনিসগুলো আনবার জন্যে বলবেন একটু। অবশ্য এমনিতেও আনার কথা, তবু–নামগুলো পড়ে দিই? সিন্টিলোমিটার, গামা রে স্পেক্টোমিটার আর রেডন মনিটার। তা ছাড়া কোর স্যাম্পল সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও চাই।
মিস্টার কোয়েলি খুব মন দিয়ে শুনলেন। ও.কে. ডক্টর, আমি আপনার নির্দেশ পাঠিয়ে দেব। চলি তাহলে এখন–উইশ ইউ বেস্ট অব লাক।
সিকোরস্কির তুলনায় আকারে অনেক ছোট একটা আলুয়েত হেলিকপ্টার ওদের জন্য ঠিক ভোর পাঁচটায় এসে পৌঁছে গেল। রাইভ নামে একটি তরুণ গ্যাবনিজ এসেছে মোউনানা থেকে। রেস্ট হাউসের বারান্দাতেই প্রাথমিক পরিচয় সেরে তারা হেলিপ্যাডের দিকে বেরিয়ে পড়ল। দুপুরের প্রচণ্ড গরমটা এড়াবার জন্যে সকালের দিকেই কাজ সারতে চান ডক্টর সেনশর্মা।
চারদিকে কাচের জানলা-ঘেরা তেজস্ক্রিয়তা নিরোধী ককপিটের মধ্যেই যাত্রীদের বসবার জায়গা। চতুর্থারে ইলেকট্রনিক মিটার আর যন্ত্রপাতির ছড়াছড়ি। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হেলিকপ্টারটায় এতগুলো মানুষের বসবার কথা নয়। সবারই একটু অসুবিধে হচ্ছে। রোজার বলেছিল, সে না-হয় থেকে যাবে। কিন্তু কেউই। তার কথা শোনেনি।
মোয়ান্ডার আকাশ পেরোতেই চারধারে তৃণভূমি অঞ্চল চোখে পড়ল। শুধু মাঝে মধ্যে দু চারটে গাছ যেন মাথা উঁচু করে পাহারা দিচ্ছে। একটিও জনবসতি দেখা যায় না। কারওরই মুখে কোনও কথা নেই। আর দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই তারা এমন কিছুর সম্মুখীন হতে পারে, যা হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে এক ভয়ংকর অধ্যায়ের সূচনা করবে। সুজন ভাবে, যদি জানা যায় কারা এই দুষ্কর্মের মূলে, তাতেও কি কোনও লাভ হবে? আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেও কি ক্ষমতার লালসাকে নিবৃত্ত করা সম্ভব?
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতির রূপ পালটায়। তৃণভূমি অঞ্চল শেষ হয়ে এবার মালভূমিরা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রানাইটের জমিটাকে একটা রাক্ষুসে জন্তু যেন তার লোহার নখ আর দাঁত দিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে রেখে দিয়েছে। কোথাও গহ্বর, কোথাও বড় বড় দাঁতওয়ালা পাথুরে শিরা আর সমস্ত জায়গাটাই অসমান। এবড়োখেবড়ো। আরও কিছু দূর এগোতেই হলুদ-মাখা ধূসরবর্ণ পাথুরে জমির মধ্যে লাল লাল ছোপ দেখা দিতে শুরু করল। রাইভ বলল, এখানে কয়েকটা অঞ্চলে ল্যাটেরাইট পাথরও দেখা যায়। একটু বাদেই একটা ম্যাঙ্গানিজ খনি পড়বে।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই নির্জন প্রান্তরে প্রথম প্রাণের পরিচয় চোখে পড়ল। মালবোঝাই ট্রাকের সারি পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। হেলিকপ্টারটা হঠাৎ যেন খনিটার ওপরে এসে পড়েছে। দু-মিনিট আগেও বোঝা যায়নি এখানে এরকম বিপুল কাণ্ড চলেছে। পাহাড় খুঁড়ে থাকে থাকে মাটির নীচে নেমে গেছে বিরাট একটা গহ্বর। তারই তলায় অসংখ্য মানুষ-পোকা কিলবিল করছে আর মালভূমির ওপর থেকে চুলের কাঁটার মতো বারবার বাঁক নিয়ে গহ্বরের ঢালু গা বেয়ে একটা রাস্তা খনির নীচ অবধি চলে গেছে। সারি সারি ট্রাক খনিজ পদার্থ নিয়ে আনাগোনা করছে।
সুজন বলল, একটু দূর থেকেও কিছু বোঝা যায়নি। আসলে খনি বলতেই আমার ধানবাদ-আসানসোলের কথা মনে পড়ে, যেখানে বহু দূর থেকেই কয়লাখনির মাথায় হেডগিয়ার আর গোল গোল চাকা দেখা যায়।
রাইভ বলল, এখানেও অনেক জায়গায় ওইরকম হেডগিয়ার দেখতে পাবেন। তবে এখানে বেশির ভাগ খনিই ওপন পিট ধরনের। তার মানে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকতে হয় না। খনিজ পদার্থ জমির কিছুটা তলা থেকেই পাওয়া যায়।
ডক্টর সেনশর্মা জিজ্ঞেস করলেন, ওকলো অঞ্চল এখান থেকে আর কতটা দূর?
আরও ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।
তাহলে একটা কাজ করা যাক। তোমাদের ইন্সট্রুমেন্টগুলো–প্রসপেক্টিং-এর কী কী সুবিধে রয়েছে–এই ফাঁকে বরং দেখে নিই।
আসুন ডক্টর
রাইভ ডক্টর সেনশর্মাকে নিয়ে উঠে গেল। পিয়ের সিটে ঠেস দিয়ে বাঁ হাতে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে। রোজার আর সুজন একদৃষ্টে জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
.
হেলিকপ্টারটা নীচে নামতে শুরু করেছে। তাহলে কি সেই জায়গাটা এসে গেল। কিন্তু বিস্ফোরণের কোনও চিহ্ন তো চোখে পড়ছে না। ডক্টর সেনশর্মা আর রাইভ কানে হেডফোন লাগিয়ে যন্ত্রের কাঁটার ওপর চোখ সেঁটে উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন। সুজন আর থাকতে পারে না, নিচু গলায় ডাকে, ডক্টর, আমরা কি নামব এবার?
ডক্টর সেনশর্মা ঘাড় ফিরিয়ে বলেন, না–আমরা এখন রেডিয়েশনের মেজার নিচ্ছি। জায়গাটা কয়েক মাইলের মধ্যেই পড়বে। তোমরাও খুব ভালো করে নজর রাখো।
কথার শব্দে পিয়েরের তন্দ্রা কেটে যায়। সবাই জানলার কাঁচে চোখ ঠেকিয়ে বসে। হেলিকপ্টারটা মাটি থেকে বড়জোর দেড়শো ফুট উঁচু দিয়ে ফড়িঙের মতো এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে রাইভ নির্দেশ দিচ্ছে, চেঞ্জ কোর্স-সাউথ টোয়েন্টি ডিগ্রি অমনি পাইলটের হাতে লিভারে টান পড়তেই অতি বাধ্যের মতো মুখ ফেরাচ্ছে উড়ন্ত পাখিটা। প্রায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ডান বা বাঁদিকে একটুও না হেলেই শুধু ল্যাজটা ঘুরিয়ে নিয়ে নির্দেশিত দিক বরাবর আবার শুরু করছে যাত্রা। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট নাগাড়ে অনুসন্ধান চালাবার পর হঠাৎ রোজার চেঁচিয়ে ওঠে, ওটা কী ওখানে?
রাইভকে সে আঙুল তুলে দেখায়। একটু দূরে হলদে ছোপওয়ালা সবজে পাথরের রাজ্যে হঠাৎ একটা কালো ছোপ দেখা যাচ্ছে। নজর করতেই বোঝা যায় ওটা একটা বিরাট গহ্বরের মুখ। সঙ্গে সঙ্গে আলুয়েতটা ধেয়ে যায়। ডক্টর সেনশর্মা চেঁচিয়ে ওঠেন, এই তো… বোধহয় মাইলখানেক জুড়ে বিশাল একটা গহর মুখ হাঁ করে বসে আছে। গহ্বরের মুখের চারদিকে পাকার হয়ে পড়ে রয়েছে অজস্র ছোটবড় পাথরের চাঁই, গুড় গুঁড়ো টুকরো আর ধুলো। হেলিকপ্টারটা গহ্বরের ঠিক মাথার ওপরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ফিল্ড গ্লাসে চোখ লাগিয়ে দেখছেন ডক্টর সেনশর্মা।
সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করে গহ্বরের ভেতর দিকের ঢালু পাহাড়ের গা-টা একেবারে মসৃণ। শিরীষ কাগজ ঘষে-মেজে একটা কাঠকে যেন একেবারে পালিশ করে দিয়েছে।
আশ্চর্য ব্যাপার! ডক্টর সেনশর্মার মুখ দিয়ে একটাই কথা বেরোয়।
রিয়ালি ডক্টর! আরও খোলামেলাভাবে বিস্ময় প্রকাশ করে রাইভ, এই জন্যেই ওরা বিস্ফোরণের সাইটটা আগে আবিষ্কার করতে পারেনি। আমার মনে হচ্ছে, ওরা হয়তো এর ওপর দিয়ে উড়ে গেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি।
ডক্টর সেনশর্মা রাইভের দিকে ঘুরে তাকান। তুমি বুঝতে পেরেছ, আমি কী সন্দেহ করছি?
ইয়েস ডক্টর। আমি আগেও একটা আনডারগ্রাউন্ড টেস্ট সাইট একবার দেখেছি।
তাহলে তুমি আমার সঙ্গে একমত যে এটা আন্ডারগ্রাউন্ড এক্সপ্লোশন?
ইয়েস ডক্টর। তবে আমার মনে হয় কিছু রিডিং নেওয়া উচিত, যাতে কেউ আর এ নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে না পারে। একেবারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ডক্টর সেনশর্মা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলেন, হেলিকপ্টারটা সুধু গর্তের নীচের দিকে। নামতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত না?
রাইভ বলল, তা ছাড়া তো আর উপায় নেই। ক্যাপটেন–আমরা এই গর্তটার মধ্যে কিছু দূর নামতে চাই
দ্যাট উইল বি টু রিস্কি। ক্যাপটেন ইতস্তত করে।
যতই বিপজ্জনক হোক, নামতেই হবে। রাইভের কণ্ঠে উত্তেজনা থমথম করে।
নাচার হয়ে ক্যাপটেন ঘাড় নাড়ে। হেলিকপ্টারকে প্রথমে আরও ওপরে তুলে চার ধারটা পর্যবেক্ষণ করে নেয়। তারপর মোটামুটিভাবে গহ্বরটার ঠিক কেন্দ্রের ওপর এসে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হেলিকপ্টারটা জমির উপরিতল ছেড়ে গহ্বরের মধ্যে নেমে এল। নতুন করে দেখার কিছু নেই। এখন শুধু রেডিয়েশন মিটারের চোখ দিয়ে রেডিয়েশনের মাত্রা দেখা। আরও কয়েকশো ফুট নীচে নামার পর হেলিকপ্টারের অবরোহণ বন্ধ হল। ক্যাপটেন বলল, আর নীচে নামতে আমি সাহস পাচ্ছি না।
ডক্টর সেনশর্মা বললেন, না না, এবার ওপরে উঠুন। আর দরকার নেই। কী বলো রাইভ?
হ্যাঁ স্যার। যা ডাটা পাওয়া গেছে, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এখানে বিশাল আকারে আন্ডারগ্রাউন্ড নিউক্লিয়ার টেস্ট করা হয়েছে।
আন্ডারগ্রাউন্ড টেস্ট? অবিশ্বাসে প্রায় চিৎকার করে ওঠে পিয়ের, সে কী?
ঠিক তা-ই। ইয়ারফোনটা খুলে নামিয়ে রেখে ডক্টর সেনশর্মা রিভলভিং চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন।
তার মানে এত দিন আমরা যা যা ভেবেছি, সব ভুল। ভূগর্ভে কেউ যদি পারমাণবিক পরীক্ষা করে থাকে, তাহলে তারা নিশ্চয় স্থানীয় লোক। এই আশপাশের কোনও কোম্পানি বা তাদের সাহায্য নিয়েই নিশ্চয়…
হ্যাঁ পিয়ের। এখানে আনডারগ্রাউন্ড টেস্টই করা হয়েছে। নিশ্চয় আরেকটু খুঁজলেই তার অন্য প্রমাণগুলোও চোখে পড়বে। আন্ডারগ্রাউন্ড নিউক্লিয়ার টেস্ট খুব সোজা ব্যাপার নয়। তার জন্যে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়। টানেলিং কন্ট্রোল টাওয়ার বসানো–কী বলল রাইভ?
আজ্ঞে হ্যাঁ ডক্টর।
আলুয়েতটা ওপরে উঠেই আবার তন্নতন্ন অনুসন্ধান শুরু করে দিল। রাইভ একটানা নির্দেশ দিয়ে চলেছে পাইলটকে। সবাই উদবিগ্ন দৃষ্টি মেলে নীরবে অপেক্ষা করছে। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। দেড় ঘণ্টা। কিন্তু কোনও নিদর্শনই দেখা যায় না। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে নাগাড়ে সারা জায়গাটা চষে ফেলার পর ক্যাপটেন বলল, এই দেখুন ম্যাপটা–পুরো অঞ্চলটার মধ্যে আর এক স্কোয়্যার মিটার অঞ্চল বাদ নেই, যার ওপর দিয়ে আমরা উড়ে যাইনি।
রাইভ আপন মনে বলে, এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, আনডারগ্রাউন্ড টেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু তার কোনও প্রমাণ নেই! এ কখনও হতে পারে? লিট শ্যাফট কোথায়? মাটির তলায় সুড়ঙ্গ কেটে বিস্ফোরণের কেন্দ্র অবধি তার তো টানতেই হবে।
ডেক্টর সেনশর্মা চশমাটা ডান হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে চোখ বুজে গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেছেন।
পিয়ের বলল, এমনও তো হতে পারে যে, সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছে?
অসম্ভব! মাত্র এই ক-দিনের মধ্যে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করা অত্যন্ত শক্ত ব্যাপার। তুমিই বলোনা, কয়লাখনির কাছে হেডগিয়ার তো দেখেছ? মাথার দিকে গোল গোল চাকা ঘুরছে, লিফ্ট শ্যাট দিয়ে লোহার খাঁচা ওঠানামা করছে। এরকম জিনিস একেবারে লোপাট করা এত সোজা? তা ছাড়া
এরিয়াল বম্বিং এক কথা আর আনডারগ্রাউন্ড টেস্ট অন্য কথা। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল, আমরা তার কিছুই জানতে পারলাম না–আমি ভাবতেই পারছি না। পুরো ব্যাপারটাই যেন ভৌতিক।
রাইভের কথা শুনে ডক্টর সেনশর্মা অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নাড়েন।
ক্যাপটেনের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, আমাদের কিন্তু আর খুব বেশিক্ষণ ওড়ার মতো ফুয়েল নেই।
ডক্টর সেনশর্মা চশমাটা চোখে লাগিয়ে সিধে হয়ে বসেন, ওকে রাইভ, তুমি হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং-এর ব্যবস্থা করো। আমি কয়েকটা কোর স্যাম্পল জোগাড় করতে চাই।
হেলিকপ্টারটা একটা সমতলভূমি দেখে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল। প্রায় নভশ্চারীদের মতো পোশাক পরে ওঁরা আলুয়েত থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বিশেষভাবে নির্মিত এই পোশাক ওঁদের তেজস্ক্রিয়তার বিপদ থেকে রক্ষা করবে। মাটিতে পা রেখেই উবু হয়ে বসে পড়লেন ডক্টর সেনশর্মা। মুখ নিচু করে সবজে পাথরের গায়ে হলদে ছোপগুলো দেখছেন। দেখো রাইভ–অস্কিডাইজড ইউরেনিয়াম।
জানি ডক্টর। এখানে প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের ইউরেনিয়ামের সঞ্চয় আছে। বেশ কয়েকটা স্তর প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে মাটির ওপর থেকে নীচের দিকে বিস্তৃত। আমরা আগেও এই অঞ্চলে প্রসপেক্টিং করেছি। এই দেখুন-নকশাটা আমি এনেছি।
ওয়ান্ডারফুল–দেখি—
মাটির ওপরেই নকশা বিছিয়ে দু-জনে তার ওপর ঝুঁকে পড়ল।
ভাগ্যিস নকশাটা ছিল। কাজের অনেক সুবিধে হয়ে গেল। লাল পেনসিল দিয়ে চারটে জায়গায় ঢ্যাঁড়া চিহ্ন বসিয়ে দিলেন ডক্টর সেনশর্মা, এই ক-টা স্যাম্পল হলেই চলবে।
র্যাডন ডিটারমিনেশন ইকুইপমেন্টটা কি সেট আপ করব? আমাদের ফিল্ড ক্যাম্প বসাতে একটুও সময় লাগবে না। একেবারে আধুনিক ফোল্ডিং ধরনের জিয়োডেসিক ডোম রয়েছে।
না না, তার কোনও দরকার নেই রাইভ। শুধু স্যাম্পল অ্যানালিসিস করলে চলবে না। আমার দরকার মাস স্পেকট্রোসকোপি অ্যানালিসিস রিপোর্ট। সেটা তো আর এখানে করা যাবে না।
তা ঠিক। ডিফিউশন প্ল্যান্টে ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।
.
মোয়ান্ডায় ফেরার পথে পিয়ের বলল, বৃথাই আমাদের এত কাণ্ড। এ তো প্রায় দিনেদুপুরে ডাকাতি। এখন দেখছি একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সংস্থার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অবশ্য তাতেও কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।
কারও মুখে কোনও কথা নেই। আলোচনা করার মতো প্রসঙ্গ আছেই বা কী! প্রায় নীরবেই সারাটা পথ পেরিয়ে এসে ঠিক মোয়ান্ডায় নামার মুখে ডক্টর সেনশর্মা হঠাৎ রাইভকে প্রশ্ন করলেন, তুমি আর্কানসাস ইউনিভার্সিটির ডক্টর কুরোডার নাম শুনেছ?
রাইভ ঘাড় নেড়ে জানাল, শোনেনি।
মোউনানায় গিয়ে তোমাদের লাইব্রেরিতে একবার দেখো তো, আমার মনে হচ্ছে, একটা লেখায় উনি আফ্রিকার ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে কয়েকটা মূল্যবান অভিমত দিয়েছিলেন। আর হ্যাঁ–তুমি মোউনানায় ফিরেই ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের পিয়েরলেটভিলের ডিফিউশন প্লান্টের ইন-চার্জকে একটা রেডিয়ো মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়ো, আমি কালকেই ফ্রান্সভিল থেকে রওনা হচ্ছি। ওরা যেন আমাকে রিসিভ করে।
আপনি কি স্যার স্যাম্পল টেস্টিং-এর জন্যে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ রাইভ।
আলুয়েতটা ওদের ক-জনকে নামিয়ে দিয়ে রাইভকে নিয়ে মোউনানার দিকে যাত্রা করল। একটা গাড়ি ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কমিলগ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ওরা ফিরলেই যেন ওদের কোম্পানির হেড অফিসে নিয়ে আসে। কিন্তু ওরা গেস্ট হাউসেই ফিরে এল। শোফারকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিল, সারাদিনের খাটুনির পর ওরা এখন অত্যন্ত ক্লান্ত। কাল সকালের আগে দেখা হওয়া সম্ভব নয়।
গেস্ট হাউসে ঢুকতে-না ঢুকতেই ফোনে ডাক পড়ল। বিরক্তভাবে রিসিভারটা তুলে নিল পিয়ের, ইয়েস–ও–মিস্টার কোয়েলি! আমি ভেবেছিলাম কমিলগের কেউ। ইয়েস-ইয়েস –প্লিজ কাম ডাউন, এই ধরুন–ঘণ্টাখানেক বাদে
ডক্টর সেনশর্মা হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে এলেন, আমি কথা বলব।
মিস্টার কোয়েলি, লাইনটা একটু ধরুন, ডক্টর সেনশর্মা কথা বলবেন।
হ্যালো–মিস্টার কোয়েলি! সেনশর্মা বলছি। আপনাকে একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে কাইন্ডলি। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কালই ফ্রান্সে যেতে চাই। পিয়েরলেটভিলে। হ্যাঁ হ্যাঁ সো কাইন্ড অব ইউ।
ফোনটা ছেড়ে চেয়ারে এসে বসেই ডক্টর সেনশর্মা আবার তলিয়ে গেলেন নিজের চিন্তার জগতে। তাঁকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করতে কারও ইচ্ছে যায় না। তা ছাড়া একটা হতাশা তাদের গ্রাস করেছে। আর বোধহয় কিছু করার নেই। ওদিকে প্রচণ্ড গরমে প্রাণটা যে। বেরিয়ে যাবার উপক্রম করছে। গায়ে খানিকটা জল ঢেলে নেবার এই সুযোগ, একটু বাদেই তো মিস্টার কোয়েলি আসবেন।
চান সেরে পোশাক বদলে সকলে যখন আবার জড়ো হলেন, ডক্টর সেনশর্মা একইভাবে বসে রয়েছেন। সুজন তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ডক্টর, শরীর খারাপ করছে না তো?
না না, একটা ফোন এক্সপেক্ট করছি। আবার চোখ বুজে ফেললেন ডক্টর সেনশর্মা।
মিনিট দশেক বাদে বাইরে থেকে গাড়ির হর্ন শোনা যেতেই রোজার উঠে গেল।
মিস্টার কোয়েলি ঘড়ি ধরে ঠিক এক ঘণ্টা বাদে এসে হাজির হয়েছেন। রোজার তাঁকে সারাদিনের ঘটনার বিবরণ দিল। চুপ করে শুনে গেলেন তিনি। তারপর রোজার চুপ করলে বললেন, এটা শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ নয়, একটা নিখুঁত ক্রাইম।
আবার সবাই চুপচাপ। মিস্টার কোয়েলিই আবার নীরবতা ভঙ্গ করেন, জানি না, এ অবস্থায় আর কী করা যেতে পারে। আমি তো আগেই বলেছি, আমাদের এখানে প্রতিরক্ষা বা তদন্তের বিপুল সুযোগ-সুবিধার কথা!
পিয়ের বলে, না না, একমাত্র আন্তর্জাতিক কোনও সংগঠনই হয়তো…
ফোনটা ঝনঝন করে উঠতেই ডক্টর সেনশর্মা লাফিয়ে ওঠেন।
হ্যালো–কে, রাইভ? আমি তোমাকেই এক্সপেক্ট করছিলাম… খবর পাঠিয়ে দিয়েছ তো, তাহলেই হল… কী বললে, মিস্টার কুরোডার রিপোর্টটা পড়েছ? কোন রিপোর্টটার কথা বলেছিলাম, বুঝতে পেরেছ?… হ্যাঁ হ্যাঁ… অত উত্তেজিত হোয়ো না এখনই… হ্যাঁ, আমারও এরকম একটা সন্দেহ হচ্ছে, কিন্তু মাস স্পেকট্রোস্কোপিক বিশ্লেষণের আগে কোনও কথা বলা উচিত হবে না… কিপ ইট এ সিক্রেট… নিশ্চয়, নিশ্চয় জানাব… তোমার সাহায্যের কথা কোনও দিন ভুলব না… গুডবাই
ডক্টর সেনশর্মা রিসিভারটা নামিয়ে ক্লান্ত পায়ে আবার চেয়ারের কাছে ফিরে এসে বসে পড়লেন। তাঁর কথা শুনে সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল কোনও সূত্র পাওয়া গেছে ভেবে। কিন্তু ডক্টর সেনশর্মার হাবভাবে তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। কয়েক মিনিট নীরবে প্রতীক্ষা করার পরেও তিনি যখন মুখ খুললেন না, পিয়ের আর জিজ্ঞেস না করে পারল না।
ডক্টর, ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি কিছু আন্দাজ করেছেন?
কথাগুলো যেন খুব ধীরে ধীরে ডক্টর সেনশর্মার মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছোল। তিনি ক্লান্ত চোখ দুটোকে খুলে বললেন, কিছু না।
মানে আপনি রাইভের সঙ্গে…
ডক্টর ডান হাতটা একটু উঁচু করে বাধা দিলেন, তার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য একটা টেকনিক্যাল বিষয়ে কথা হচ্ছিল।
এরপর আর আলোচনা করার কিছু থাকে না। মিস্টার কোয়েলি উঠে দাঁড়ান। বিদায়পর্বটা আগেভাগেই সেরে ফেলা হয়। কাল সকালেই পিয়ের আর ডক্টর সেনশর্মা ফ্রান্সভিল হয়ে পাড়ি দেবেন ফ্রান্সে। সুজনও ওদের সঙ্গে প্যারি অবধি যাবে। তারপর বম্বের কানেক্টিং ফ্লাইট ধরবে। রোজারও কাল ভোরেই লিবেরভিলে ফিরে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয় ওঁদের মধ্যে, তবু সমস্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও বিদায়বেলার বিষণ্ণতা মনটাকে ভারী করে। ওঁদের আন্তরিকতাই ওদের বন্ধন।
কলকাতা ফিরে এক মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে ছিল সুজন। জীবনের একটা ব্যর্থ অধ্যায়ের কথা পুরোপুরি ভুলে যেতে চায় ও। কিন্তু ভুলতে চাইলেই কি আর ভুলতে পারা যায়? খবরের কাগজে ঘরোয়া খবরদের প্রায় ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বাগবিতণ্ডা। এমনকী প্রতিবেশী অনেক দেশের মধ্যে এত দিন যে রেষারেষি শুধু ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বৃহৎ শক্তিদের প্ররোচনায় ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ইউরোপে বৃহৎ শক্তিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তৈরি ন্যাটো (ন্যাশনাল অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন)-র দুর্বলতা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিম জার্মানি তো ঘোষণাই করে দিয়েছে যে, তারা ন্যাটো-র ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স প্রতিশ্রুতিমতো সামরিক সাহায্য দিচ্ছে না ন্যাটো-কে৷ কাজেই, সোভিয়েত রাশিয়ার অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে ন্যাটো-র শক্তি যদি ছারখার হয়ে যায়, কে বাঁচাবে পশ্চিম জার্মানিকে? আমেরিকা পশ্চিম জার্মানির পেছনে আছে বলছে ঠিকই, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা অন্য দেশের মাটিতে শুরু হোক (মানে পশ্চিম জার্মানিতে), তাদের এই অভিসন্ধির কথা কে না জানে।
সকালবেলায় খবরের কাগজটা তুলে চোখ বোলাচ্ছিল সুজন। নানা পণ্ডিতের নানা মতের মধ্যে একটা কথাই শুধু দগদগে ঘায়ের মতো দৃষ্টি আকর্ষণ করে–তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা।
এরকম আলস্য কোনও দিন অনুভব করেনি ও। আসলে একটা ধাঁধার উত্তর ও আগেভাগে জেনে ফেলেছে, আর সেই জন্যেই এ নিয়ে আর চিন্তাভাবনা বা পরিশ্রম করার উৎসাহ নেই। একদিন-না-একদিন পৃথিবীর সকলেই এই ভয়াবহ ধাঁধার ভীতিপ্রদ উত্তর পাবে এবং খুব শিগগিরই পাবে। কাগজের বড় বড় হরফের গরম গরম সংবাদকে তাচ্ছিল্য করে শেষ পর্যন্ত অতি নগণ্য দশ লাইনের একটা খবর সুজনকে প্রায় হুমড়ি খাইয়ে কাগজের ওপর টেনে আনল।
পশ্চিম জার্মানির ব্যাভেরিয়ায় নাতসি পার্টির সদস্য নির্বাচিত। সুজন কাগজটা পাট করে রেখে চোখ বুজিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। এই সংবাদটুকুর জন্যেই বোধহয় মনে মনে অপেক্ষা করছিল সে। জার্মানিতে বহু দিন ধরেই গোপনে নাতসি শক্তি সংগঠিত হচ্ছিল। এবার তারা আত্মপ্রকাশ করেছে। আর নাতসি শক্তির আত্মপ্রকাশ মানেই অচিরে জার্মানির হাতে নিউট্রন বোমা! সোভিয়েত রাশিয়া এরপর আর কত দিন চুপ করে থাকবে? আর সোভিয়েত রাশিয়া নড়াচড়া করা মানেই আমেরিকার হুংকার।
ভাবতে ভাবতে একসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সুজন, আর তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক মার্কিন জেনারেল। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মহাগর্বে হাত নেড়ে বক্তৃতা জুড়ে দিয়েছে, বুঝলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে অস্ত্রে অস্ত্রে যুদ্ধ হবে। মানুষে মানুষে নয়! ইলেকট্রনিক কম্পিউটার এখন আমাদের মিসাইল মারণাস্ত্রগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে দেশের পর দেশ, সাগরের পর সাগর পার করে ঠিক লক্ষ্যস্থলে।
সুজন ব্যঙ্গভরে বলে, একেবারে লক্ষ্যভেদী বাণ বলুন?
ঠিক তা-ই। এবার আর অকারণে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে মানুষের প্রাণ যাবে না, বাড়িঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। একেবারে মোক্ষম অস্ত্র এই নিউট্রন বোমা, যে বোমা ফাটবে নিঃশব্দে– আলো ঝলসাবে না, প্রচণ্ড বিস্ফোরণও হবে না, শুধু অদৃশ্য মারণরশ্মি ছুটবে। লক্ষ্যস্থলের মধ্যে বারো ইঞ্চি মোটা ইস্পাতের চাদরে গা-ঢাকা দিয়ে বসে থাকলেও মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু ওই ইস্পাতের চাদরের গায়ে আঁচড়ও পড়বে না। হাঃ হাঃ হাঃ।
হয়েছে হয়েছে, অত আনন্দ করার কারণ নেই। আরেকজনের গলার স্বর শুনে ফিরে তাকাতেই সুজন দেখল, এক হোঁতকা চেহারার রুশ জেনারেল এসে হাজির হয়েছে, নিউট্রন বোমা ছুঁড়তে তো তোদের লস এঞ্জেলেস বা ওহিও সাবমেরিনকে এগিয়ে আসতে হবে। তখন আসবে আমাদের ডেল্টা সাবমেরিন, তোদের যম। তা ছাড়া বিমানবাহী কিয়েভ রণতরির কথা ভুলে গেছিস নাকি?
কথা শেষ না হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল এক জাহাজ। জাহাজের সমতল ডেকের ওপর থেকে গর্জন করে হঠাৎ যেন তুড়ি-লাফ খেয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে একের পর এক এরোপ্লেন। তারপর আকাশে উঠেই গোটানো ডানা মেলে ধরছে।
রাশিয়ান জেনারেল গর্জন করে ওঠে, একে বলে জাম্পিং জেট। আকাশে একেবারে লাফ মেরে ওঠে। ভার্টিক্যাল টেক অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং। বুঝলি, ইয়াক-৩৬ বিমান আমাদের গর্ব।
রাশিয়ার গর্ব ইয়াক-৩৬-রা আকাশে উঠতে-না উঠতেই উলটোদিক থেকে ছুটে এল আমেরিকার গর্বর–ফেয়ার চাইল্ড রিপাবলিক এ-টেন-এ, যার ডানার তলা থেকে ঝুলছে লম্বা লম্বা মিসাইল।
এ-টেন-এ-কে দেখে পালটা জবাব দিতে দেখা দিল মিকোয়ান মিগ টোয়েন্টি ওয়ান।
অতঃপর আমেরিকা নিয়ে এল এক-ফোরটিন টম ক্যাট আর ইগল ফিফটিন বিমান আর পাঁচ হাজার দু-শো মাইল দৌড়ের ক্ষমতাধারী এস-এস-এন-এইট্রিন মিসাইলবাহী ডেল্টা থ্রি সাবমেরিন। ভুস করে জল ঠেলে জেগে উঠল।
রাশিয়ান জেনারেল গর্জে উঠল, কিছুতেই কিছু হবে না। সব কটা আমেরিকান শহরকে আমরা রাশিয়ায় বসেই ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পাড়ি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল দেগে।
আমেরিকান জেনারেল সগর্জনে টেবিলে ঘুসি কষাল, আমেরিকান মিনিটম্যানের নাম শুনিসনি নাকি এখনও?
অমনি প্রচণ্ড গর্জন সমেত সাদা-কালো ধোঁয়ার পাহাড় তৈরি করতে করতে আকাশে উঠে গেল হোঁতকা চেহারার হাউইয়ের মতো মিনিটম্যান-টেন।
চমকে উঠে বসল সুজন। সারাটা গা ঘামে জবজব করছে। যুদ্ধের বিভীষিকা ঘুমের মধ্যেও তাকে তাড়া করতে শুরু করেছে। হঠাৎ কলিং বেলটা ঝনঝন করে ওঠে। সুজন। উঠে দাঁড়ায়। কলিং বেলটা আগেও বোধহয় একবার বেজেছিল। আর সেই জন্যেই তন্দ্রাটা কেটে গেছে। দোতলার বারান্দার গ্রিলের রেলিং-এর ওপর দিয়ে শরীরটা ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করে সুজন, কে?
টেলিগ্রাম আছে। এক হাতে সাইকেলটাকে ধরে ডাক ও তার বিভাগের কর্মী ওপরদিকে মুখ তুলে বলল।
তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল সুজন। দিদিও উঠে এসে দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছে। টেলিগ্রামটা খুলে পড়তে পড়তেই ওপরে উঠতে শুরু করে সুজন। দিদি জিজ্ঞেস করে, কার টেলিগ্রাম? কোনও উত্তর নেই। সুজনের পেছনে পেছনে দিদি ঘরে এসে ঢোকে, কার টেলিগ্রাম রে?
অ্যাঁ–ডক্টর সেনশর্মার।
ডক্টর সেনশর্মা? কোত্থেকে?
প্যারি থেকে টেলিগ্রাম করেছেন।
সুজনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে দিদিও টেলিগ্রামটার ওপর ঝুঁকে পড়ে : গ্লোবাল এমার্জেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স টু বি হেল্ড অন টোয়েন্টি থার্ড। মাস্ট বি প্রেজেন্ট ইন ডেলি৷ সারপ্রাইজ অ্যাওয়েটস্। গো থ্র পিটিআই রিলিজ টুমরো। –সেনশর্মা।
কী ব্যাপার বল তো, হঠাৎ এভাবে তোকে দিল্লিতে তলব করেছেন কেন? দিদির কণ্ঠে উদবেগ।
কিছু বুঝতে পারছি না।
তোকে তো তাহলে এখুনি ফ্লাইট বুক করতে হয়। অফিসে ফোন করে বলে দে৷ দিদি নিজেই রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে শুরু করে দেয়।
.
দিল্লিতে পৌঁছোবার আগেই সুজন গোটা পাঁচেক খবরের কাগজের ওপর চোখ বুলিয়েছে। সবারই মোটামুটি এক রিপোর্ট :
বিশ্বসংকট : বিজ্ঞানী সেনশর্মার জরুরি বৈঠক তলব। পিয়েরলেটভিল, ৭ জানুয়ারি। গ্যাবনে সাম্প্রতিক পারমাণবিক বিস্ফোরণের ব্যাপারে তদন্তকারী কমিটির অন্যতম, প্রখ্যাত এক পারমাণবিক বিজ্ঞানী আজ প্রেস কনফারেন্সে ঘোষণা করেছেন, সারা দুনিয়া এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ইউনাইটেড নেশনস-এর সহায়তায় এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আহ্বান করেছেন। বিশ্ব-পারমাণবিক শান্তি সংস্থাও এতে যোগ দিচ্ছে। সমস্ত উন্নত, উন্নতিশীল ও অনুন্নত দেশের বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা আগামীকাল দিল্লিতে এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। বিজ্ঞানী ডক্টর সেনশর্মাকে বিশ্বসংকটের কারণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সম্মেলনের আগে তিনি কিছু বলতে চান না। তাতে সংবাদ বিকৃত হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। এরকম একটি বিষয়ে (অনিচ্ছাকৃত হলেও) এতটুকু ভুল সংবাদ পরিবেশন, তাঁর মতে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চরম পরিচয় দেবে।
সুজন কাগজগুলো পাট করে ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রাখে। নানারকম সম্ভাবনা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। আর ভাবতে চায় না। একেবারে সম্মেলনেই যা শোনার শুনবে।
ডক্টর সেনশর্মা যখন মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন, বিশাল কনফারেন্স হলে সূচিভেদ্য নিস্তব্ধতা। বহু প্রতিনিধি কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে আছেন। এঁরা ইংরেজি জানেন না, তাই ইংরেজি বক্তৃতার প্রয়োজনমতো অনুবাদ পৌঁছোবে তাদের কাছে।
ডক্টর সেনশর্মা শুরু করেন, গুড আফটারনুন ডেলিগেটস। আমি প্রথমেই জানাতে চাই, আমি আপনাদের কাছে এখন যে রিপোর্ট পেশ করছি তা শুধু আমার ব্যক্তিগত অভিমত নয়। ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং আমেরিকান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন একই সঙ্গে এই রিপোর্ট সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করছেন। আজ এই কনফারেন্সে অনেক বিজ্ঞানী উপস্থিত আছেন, যাঁদের কাছে আমি এককথায় পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারি, কিন্তু আমার মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের অনুসন্ধানের ফলাফল ঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া, যাতে তাঁরা ভুল বোঝার কোনও অবকাশ না পান। বিশেষ করে আমি সাংবাদিকদের অনুরোধ করছি–তাঁরা যেন খুব সতর্কভাবে রিপোর্ট পেশ করেন, তা না হলে ভয়ংকর আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে। আপনারা জানেন। নিশ্চয়, পারমাণবিক ফিশন বা বিভাজনের জন্য ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হয়। এই ইউরেনিয়াম কিন্তু খনি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়াম নয়। খনি থেকে ইউরেনিয়ামের যে আকর পাওয়া যায়, তাকে বিশুদ্ধ করতে হয়। এবং এই বিশুদ্ধ করাটা এক দুরূহ কারিগরি ব্যাপার। যে জন্যে ইউরেনিয়ামের সঞ্চয় থাকলেও এবং পারমাণবিক বিভাজনের বৈজ্ঞানিক কৌশল আয়ত্ত করার পরেও বহু দেশের পক্ষেই পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ইউরেনিয়ামের আকরের মধ্যেই ইউরেনিয়াম-২৩৫ নামে একটি আইসোটোপ আছে, মানে ইউরেনিয়ামেরই একটি বিশেষ রূপ। এই ইউরেনিয়াম-২৩৫-টাই পারমাণবিক বিভাজনের কাজে লাগে। ইউরেনিয়ামের আকরের মধ্যে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর শতকরা পরিমাণ মাত্র দশমিক সাত সতাংশ (০.৭ শতাংশ), বাকি সবটাই প্রায় ইউরেনিয়াম-২৩৮। শুনলে অবাক হবেন, চাঁদের পিঠ থেকে যে ইউরেনিয়ামের আকর সংগ্রহ করা গেছে, তার মধ্যেও ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ ঠিক এইটুকুই। ইউরেনিয়াম-২৩৫-কে পারমাণবিক বিভাজনের জন্য ব্যবহার করতে হলে তার শতকরা পরিমাণ অনেক বাড়ানো দরকার আর তার জন্যেই বিরাট আয়োজন থাকে পারমাণবিক জ্বালানি সংশোধনী প্ল্যান্টে। এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। ১৯৫৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জর্জ ওয়েদারইল, শিকাগো ইউনিভার্সিটির মার্ক জি ইনঘ্রাম এবং ১৯৫৬ সালে আর্কানসাস ইউনিভার্সিটির পল কুরো কয়েকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করেন, কিন্তু কেউই তা নিয়ে খুব মাথা ঘামায়নি তখন। তাঁদের এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আজ থেকে দু-শো কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে আপনা হতেই পারমাণবিক বিভাজন ও বিস্ফোরণ ঘটেছিল। বিস্ফোরণ ঘটার কারণও তাঁরা দেখিয়েছিলেন। ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থের ধর্ম হিসেবেই আজ ইউরেনিয়ামের আকরে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর যে পরিমাণ রয়েছে, দু-শো কোটি বছর আগে সেই পরিমাণ তার পাঁচগুণ ছিল। কেন এরকম হয়, সেটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। তবে এটা আপনারা স্বীকৃত সত্য বলে ধরে নিতে পারেন। যে কথা বলছিলাম, ওঁরা তাঁদের রিপোর্টে আফ্রিকারই কিছু অঞ্চলের ইউরেনিয়াম আকর বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, তাতে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ বেশ কিছুটা কম এবং তার থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আজ থেকে দু-শো কোটি বছর আগে প্রকৃতিতে আপনা থেকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলেই ওই অঞ্চলের ইউরেনিয়ামে বর্তমানে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর শতকরা পরিমাণ কমে গেছে। তাঁদের এই রিপোর্ট প্রায় কারওই দৃষ্টি আকর্ষণ না-করার দুটি কারণ আছে। এক–দু-শো কোটি বছর আগের একটা ঘটনা মানুষকে তেমন ভাবায় না। দুই–বর্তমানে এরকমভাবে আপনা থেকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটা সম্ভবই নয়। কারণ বর্তমানে এভাবে বিস্ফোরণ ঘটতে পয়েন্ট সাত শতাংশ ইউ-২৩৫-এর জায়গায় দশ শতাংশ ইউ-২৩৫ দরকার। অ্যাবসার্ড
ডক্টর সেনশর্মা কথা থামিয়ে জলের গেলাসটা তুলে নেন। এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কনফারেন্স হল উত্তেজিত চাপা কণ্ঠস্বরের ঐকতানে গুঞ্জরিত।
ডক্টর সেনশর্মা গেলাসটা রেখে আবার শুরু করেন, আপনারা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি। আমেরিকা নয়, রাশিয়া নয়, ফ্রান্স, ব্রিটেন–কেউ নয়। কোনও মানুষ এই বিস্ফোরণ ঘটায়নি, ঘটিয়েছে স্বয়ং প্রকৃতি। ভাবলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে। যেতে হয়। আংশিকভাবে অক্সিডাইজড খনিজ ইউরেনিয়ামের দ্রাব্য দানাগুলোকে পাথরের বুক থেকে খসিয়ে খসিয়ে নিয়ে গেছে জলধারা। তারপর নদীর বুকে এসে জমেছে। সেখানে নীলচে সবুজ শ্যাওলারা ইউরেনিয়াম অক্সাইডকে আরও অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। তারপর কীভাবে যে ফ্লোরাইড তৈরি হয়েছে আর আরও সম্পৃক্ত হয়েছে ইউরেনিয়াম-২৩৫, সেটা এখনও রহস্যাবৃত। কিন্তু সম্পৃক্ত হয়েছে, এটা দেখা গেছে। আমার কাছেই তার পুরো রিপোর্ট রয়েছে। তারপর শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছে সেই ভয়ংকর ক্রিটিক্যাল মাস–শুরু হয়েছে চেন রিঅ্যাকশন–বিস্ফোরণ–পুরো গ্যাবনটাই যদি উড়ে যেত কিংবা আফ্রিকার সমস্ত পশ্চিম উপকূল, তাতেও অবাক হবার কিছু থাকত না। কারণ যে পরিমাণ ইউরেনিয়ামের সঞ্চয় আছে ওখানে, পুরো পৃথিবীটাই উড়ে যেতে পারত। কেন যে হয়নি, সেটাও বিচিত্র প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল, তারই বাহাদুরি। পারমাণবিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত করার জন্য মানুষের হাজার গবেষণা আর পরিশ্রম বিনা আয়াসে প্রকৃতি আয়ত্ত করে ফেলেছে। যাকে আমরা মডারেটার বলি, এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক জলের স্তরই নিপুণভাবে সেই মডারেটারের কাজ করে বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত করেছে। আর আমার বলার কিছু নেই। এবার আপনারাই স্থির করুন, এই পরিস্থিতিতে কী করবেন।
সুজনের দিদি বিকেলের বিশেষ সংবাদ বুলেটিন শুনছিল। গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষক বলে চলেছে, এক অভাবনীয় আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বিশ্বের পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন। দেশগুলি আজ একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, অবিলম্বে একটি আন্তর্জাতিক অভিযাত্রীদল গঠন করা হবে সারা দুনিয়াজোড়া অনুসন্ধান চালানোর জন্য। গ্যাবন রাজ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তা একটি ব্যতিক্রম মাত্র এবং আর কোথাও ঘটবে না, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তা ছাড়া সেই বিস্ফোরণের মাত্রা কী হবে তা-ও ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। সমস্ত পৃথিবীটাই হয়তো প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। তবে এরই মধ্যে আশার কথা, বিশ্বের সমস্ত প্রথম সারির শক্তি বোধহয় ইতিহাসে এই প্রথম একজোট হয়েছে। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের এবং বিজয়েরই কাহিনি। আজ প্রকৃতির আকস্মিক চ্যালেঞ্জের মুখে তাই দেখা যাচ্ছে, মানবজাতি আবার হাতে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলা করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সমস্ত বিজ্ঞানীমহলের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরা তিন মাসের মধ্যেই দুনিয়াজোড়া পর্যবেক্ষণ শেষ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। তাঁরা প্রকৃতির হাতে মানবসভ্যতাকে কিছুতেই লাঞ্ছিত হতে দেবেন না।
ক-দিন আগে এই রেডিয়োটাকেই প্রায় গুঁড়িয়ে ফেলেছিল সুজন। দিদির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। রেডিয়োটা বন্ধ করে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যায়, সুজন যে-কোনও মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। কোনও শুভসংবাদ থাকলে সুজন বাড়ি ফেরার জন্যে ছটফট করে। ড্রয়ারটা টেনে লাল আর নীল ফেল্ট পেনটা বার করে একটা সাদা কাগজের ওপর মোটা মোটা হরফে দিদি লিখে রাখে–সুস্বাগতম্ দিবিজয়ী।
[পপুলার লাইব্রেরী থেকে ১৯৭৯ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত।]