সপ্তম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–জিলেট মন্ত্র
পূজার পঞ্চমীর দিন ডমরুর যথারীতি বন্ধু-বান্ধবের সহিত প্রতিমার সম্মুখে বসিয়া আছেন। হাঁ করিয়া তিনি বলিলেন,–তোমরা একবার আমার মুখের ভিতরটা ভাল করিয়া দেখ। সকলে দেখিলেন। লম্বোদর বলিলেন,–তোমার মুখের ভিতর কি আছে? কিছুই নাই। ফোকলা মুখ। তিমির গিরিগরের ন্যায়। ডম উত্তর করিলেন,–তোমাদের পাপ চক্ষু তৈলপেষী বলদের ঠুলি দ্বারা আবৃত। তোমরা দেখিবে কেবল অন্ধকার।
গজানন জিজ্ঞাসা করিলেন,–তবে তোমার মুখের ভিতর কি আছে?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,–আমার জিহ্বা ও কণ্ঠে সরস্বতী দেবী অধিষ্ঠিতা আছেন। পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, আমি মা দুর্গার বরপুত্র। তাহার পর তাঁহার সঙ্গে যে দেবতাগুলি আগমন করেন, একে একে সকলের আরাধনা করিয়া আমি সিদ্ধিলাভ করিয়াছি। কার্তিকের বরে আমার কন্দর্পের ন্যায় হইয়াছে। মা সরস্বতীর বরে আমি এত বড় বিদ্বান হইয়াছি। মেঘনাদবধ কে লিখিয়াছে জান?
লম্বোদর উত্তর করিলেন,–কেন? মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
ডমরুর বলিলেন,–হাঁ, সকলের তাই বিশ্বাস। কিন্তু কলিকাতায় যখন আমি চাকরি করিতাম, তখন সন্ধ্যার পর সাহেবী পোষাক পরিয়া কে আমার নিকট আসিত? দুই ঘণ্টাকাল আমি যাহা বলিতাম, কে তাহা লিখিয়া লইত? সে লোকটি অপর কেহ নয়। সে লোকটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মেঘনাদবধ কাব্য আগাগোড়া আমার দ্বারা রচিত। মাইকেল আমাকে অধিক টাকা দিতে পারিতেন না। টাকা দিতেন বঙ্কিম। কোনদিন পাঁচ, কোনদিন দশ। যেদিন দুর্গেশনন্দিনী শেষ করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম, সেদিন তিনি আমাকে একেবারে এতশত টাকা দিয়াছিলেন। অন্যান্য পুস্তকের জন্যও তিনি আমাকে অনেক টাকা দিয়াছিলেন। মাইকেল ও বঙ্কিম অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন যে,মহাশয়! আপনি যে আমাদের পুস্তক লিখিয়া দিয়াছেন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে সে কথা প্রকাশ করিবেন না। সেই জন্য এতদিন চুপ করিয়াছিলাম। আর দেখ, এখন যত বড় বড় গ্রন্থকার জীবিত আছেন, অন্ততঃ সাধারণে যাঁহাদিগকে গ্রন্থকার বলিয়া জানে, তাহাদের সমুদয় পুস্তকের প্রণেতা এই শর্মা। হাসি পায়। নাম করিব না। নাম করিলে, তাহাদের মান-সম্রম একেবারে যাইবে। অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া নাম করিতে তারা আমাকে মানা করিয়াছেন। সেই জন্য চুপ করিয়া আছি। কিন্তু তাঁহারা যে গ্রন্থকার
বলিয়া লোকের নিকট পরিচয় দেন, তাই আমার হাসি পায়।
এই দেখ, আজকাল হোমরুল বলিয়া একটা হুজুগ পড়িয়াছে। সেই সম্বন্ধে বক্তৃত করিতেছেন। ইহা অপেক্ষা আমি শতগুণ বক্তৃতা করিতে পারি। আমার বক্তৃতা লোবে নানারূপ মুখভঙ্গী করিয়া অবাক হইয়া শ্রবণ করে।
আমার প্রতি মা সরস্বতীর সামান্য কৃপা নহে। সে বৎসর কার্তিকের ময়ুরে চড়িয়া আমি যখন আকাশ ভ্রমণে গিয়াছিলাম, তখন মায়ের কৃপায় আমার মুখ দিয়া মহামন্ত্র বাহির হইয়াছিল। এ তোমার হিড়িং বিড়িং মন্ত্র নহে। জিলেট মন্ত্র। আসল বীজমন্ত্র। এ মরে যে কি অদ্ভুত শক্তি, এতদিন তাহা আমি জানিতাম না? এইবার জানিতে পারিয়াছি। এই মন্ত্রের প্রভাবে আমি শুক্লাশ্বর ঢাককে ঘোর বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছি। প্রেতযোনি-প্রাপ্ত তাঁহার কন্যাকে উদ্ধার করিয়াছি। সমুদ্রযাত্ৰাজনিত পাপ হইতে তাঁহার জামাতাকে পরিত্রাণ করিয়াছি।।
লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–শুক্লাশ্বর ঢামমহাশয়ের কি হইয়াছিল?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ঢাকমহাশয়
ডমরুধর বলিলেন,—শুক্লাশ্বর ঢাকমহাশয় গুরুগিরি করেন। তাঁর অনেক শিষ্য আছে। গুরুগিরি করিয়া তাঁহার বিলক্ষণ দুপয়সা উপার্জন হয়। দোতলা কোঠা বাড়ীতে তিনি বাস করেন। মোকদ্দমা-মামলা সম্বন্ধে তাঁহার যেরূপ বুৎপত্তি, এরূপ ব্যুৎপত্তি প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না। নানা বিষয়ে ঢাকমহাশয় আমার সহায়তা করেন। তিনি আমার পরম বন্ধু। ঢাকমহাশয় অতি নিষ্ঠাবান পুরুষ। পূজা-আহ্নিক জপ-তপে তিনি অনেক সময় অতিবাহিত করেন। সেজন্য তাঁহার প্রতি আমার অগাধ ভক্তি। আজকাল ব্রাহ্মণেরা ত্রিসন্ধ্যা করে না। টিকিনাড়ারা সে উপদেশ কাহাকেও প্রদান করে না। কিন্তু ঢাকমহাশয় সে প্রকৃতি লোক নহেন। কাহাকেও চা বা বরফ খাইতে দেখিলে তিনি আগুনের ন্যায় জুলিয়া উঠেন। সন্ধ্যাআহ্নিকে যাহাতে লোকের প্রবৃত্তি হয়, সে বিষয়ে তিনি চেষ্টা করেন।
গত বৈশাখ মাসে একদিন ঢাকমহাশয় আমাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সূর্য অগ্নিবৃষ্টি করিতেছেন। রৌদ্রে পুড়িয়া যাইতেছে। আমি তাঁহার বাড়ী গমন করিলাম। ঘোরপিপাসায় কাতর হইয়া আমি কোৎ কোৎ করিয়া একঘটি জল খাইয়া ফেলিলাম। কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলে ঢাকমহাশয় আমাকে বলিলেন যে, তাঁহার কন্যা কুন্তলার প্রখর জ্বর হইয়াছে। কুন্তলার বয়স নয় বৎসর। আট বৎসর বয়সে ঢাকমহাশয় তাঁহার বিবাহ দিয়াছিলেন। বিবাহের দুই মাস পরেই সে বিধবা হইয়াছিল। দোতলার উপর যে ঘরে কুম্ভলা শুইয়াছিল, ঢাকমহাশয়ের সহিত আমি সেই ঘরে গমন করিলাম।
জুরে কুতলার কাঠ ফাটিতেছে। আগুনের ন্যায় শরীরের উত্তাপ হইয়াছে। ক্রমাগত এ পাশ ওপাশ করিতেছে। মা একটু জল দাও, মা একটু জল দাও, ক্রমাগত এই কথা বলিতেছে। মা! পিপাসায় আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। একটু জল দাও মা! একটুখানি দাও। কেবল মুখটি ভিজাইয়া দাও। একটু জল না খাইয়া আর থাকিতে পারি না। জল, জল, জল।
বিরস বদনে মা নিকটে বসিয়া আছেন। মাঝে মাঝে বাতাস করিতেছেন। মাঝে মাঝে চক্ষুর জল মুছিতেছেন।
ঢামহাশয় আমাকে চুপি চুপি বলিলেন,–আজ একাদশী। বিধবা। সেইজন্য জল দিতে বারণ করিয়াছি। কিন্তু জল দিতে আমার গৃহিণীর ইচ্ছা। এখন করি কি? সেইজন্য তোমাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছিলাম।
নীচে গিয়া আমি বলিলাম,—বাপ রে! জল কি দিতে পারা যায়? ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা। একাদশীর দিন জল খাইতে দিলে তাঁহার ধমটি একেবারে লোপ হইয়া যাইবে।
ঢাকমহাশয় তাহাই করিলেন। কন্যাকে জল দিলেন না। রাত্রিতে কন্যা পাছে নিজে জল চুরি করিয়া খায়, অথবা তাঁহার কষ্ট দেখিয়া মাতা, ভগিনী কি অপর কেহ পাছে তাঁহাকে জল প্রদান করে, সেজন্য সন্ধ্যার সময় কুন্তলাকে তিনি নীচের তালার এক ঘরে বন্ধ করিয়া চাবি দিয়া দিলেন। সমস্ত রাত্রি পীড়িতা কন্যা একেলা সেই ঘরে রহিল। ধর্ম্ম রক্ষা সম্বন্ধে ঢাকমহাশয়ের এমনি দৃঢ়পণ।।
প্রাতঃকালে যখন তিনি ঘরের চাবি খুলিলেন, তখন সকলে দেখিল যে, বালিকা পিপাসা হতজ্ঞান হইয়া ঘরের ভিজা মেঝের একধার হইতে অপর ধার পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি বার বার চাটিয়াছে। অবশেষে অজ্ঞান হইয়া ঘরের এককোণে পড়িয়া আছে। মাতা তাঁহাকে। কোলে তুলিয়া লইলেন। কিন্তু তাঁহার মাথাটি লুটিয়া পড়িল। সেদিন দ্বাদশী। মাতা তাঁহার মুখে জল দিলেন, কিন্তু সে গিলিতে পারিল না। দুই কল দিয়া জল বাহিরে আসিয়া পড়িল। সে আর কথা কহিল না। শেষকালে একবারমাত্র বলিল,–জল-জল। এই কথা বলিয়া সে প্রাণত্যাগ করিল।
এই ঘটনার কথা যখন চারিদিকে প্রচারিত হইল, তখন দেশশুদ্ধ লোক ঢাকমহাশয়কে ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। সকলে বলিল,—কি দৃঢ় মন! কি ধর্মের প্রতি আস্থা এরূপ পুণ্যবান লোক কলিকালে হয় না। তাঁহার প্রতি লোকের এত ভক্তি হইল যে, এক মাসের মধ্যে তাঁহার এক শতের অধিক নূতন শিষ্য হইল।
কন্যার মৃত্যুতে ঢাকমহাশয়ের আনন্দ হইল। তিনি বলিলেন, বিধবা হইয়া চিরজীবন দুঃখে যাপন করা অপেক্ষা মরাই ভাল। কিন্তু মৃতকন্যা তাঁহাকে অধিক দিন আনন্দভোগ করিতে দিল না। একদিন রাত্রি দুই প্রহরের সময় সহসা জল, জল। হা জল! হা জল! এইরূপ ভীষণ চীৎকার করিয়া সে বাড়ীর চারিদিকে ছটফট করিয়া বেড়াইল। সকলের নিদ্রাভঙ্গ হইল। সকলে ঘোর ভয়ে ভীত হইল। ইহার চারিদিন পরে ঢাকমহাশয়ের পুত্রটি মরিয়া গেল। এইবার ঢাকমহাশয় শোকে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। পনের দিন পরে আবার কুন্তলার ভূত সেইরূপ জল জল করিয়া চীৎকার করিল। এবার মাতঙ্গিনী নামক দাসীর মৃত্যু হইল। * ফলকথা, যখনই কুন্তলার ভূত চীৎকার করিত, তখনই বাড়ীর একটা না একটা লোক মরিতে লাগিল। দাসীর মৃত্যুর পর ঢাকমহাশয় গয়াতে পিশু দিবার জন্য লোক পাঠাইলেন। কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। কারণ, কিছুদিন পরে পুনরায় যখন চীৎকার হইল, যখন ঢাকমহাশয়ের ছটু নামক চাকর মরিয়া গেল। বিধবা হইয়া একাদশীর দিন ভিজা মেঝে চাটা পাপটি সামান্য নহে। গয়াতে হাজার পিণ্ড দিলেও ইহা ক্ষয় হয় না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ–মোল্লা জামাতা
কুন্তলাকে কি উপায়ে উদ্ধার করা যায়, সেই সম্বন্ধে ঢাকমহাশয় আমার সহিত অনেক পরামর্শ করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে কিছু বলিতে পারিলাম না।
ঢাকমহাশয়ের এক বালক দৌহিত্র আছে। তাঁহার নাম ভুলু। ভুলু ঢাকমহাশয়ের প্রাণস্বরূপ। এক মুহূর্ত তাঁহাকে চক্ষুর আড় করিয়া ঢাকমহাশয় থাকিতে পারেন না। বিশেষতঃ পুত্রহীন হইয়া তাঁহার যত স্নেহ মমতা ভুলুর উপর পড়িয়াছিল। পাছে কুন্তলার চীৎকারে ভুলুর কোন অনিষ্ঠ হয় সেজন্য ঢাকমহাশয় ঘোরতর ভীত হইলেন।
বিপদের উপর বিপদ। ঢামহাশয়ের জামাতা, ভুলুর পিতা, যাহার নাম কেশব, বোগদাদে গিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত ঢাকমহাশয়ের সদ্ভাব ছিল না। ঢাকমহাশয় আশা করিয়াছিলেন যে, তিনি লড়াইয়ে মারা পড়িবেন। ভুলু ও ভুলুর মাতা চিরকাল তাঁহার নিকট থাকিবে। ভুলুর মাতার নাম কালিকা। বাল্যকাল হইতে তাঁহাকে আমি কোলে-পিঠে করিয়াছি। কন্যার ন্যায় তাঁহাকে আমি স্নেহ করি। এত চুল কখন আমি কাহারও দেখি নাই। কিছুদিন পূর্ব্বে দোতলার ঘরে জানালার ধারে সে চুল এলো করিয়া বসিয়াছিল। সে যে কি অপূর্ব্ব শোভা হইয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে আর কি বলিব।
ঢাকমহাশয়ের জামাতা, কালিকা দেবীর স্বামী। ভুলুর পিতা কেশব লড়াইয়ে মারা যান নাই। তিনি দেশে ফিরিয়া আসিলেন। দেশে আসিয়া তিনি কালিকা ও ভুলুকে লইতে পাঠাইলেন। ঢাকমহাশয়ের মাথায় ঠিক যে বজ্রাঘাত হইল। তিনি বলিলেন,–কিছুতেই আমি আমার কন্যাকে ও দৌহিত্রকে তাঁহার বাড়ী পাঠাইব না। সে সমুদ্র পার হইয়া বিদেশে গমন করিয়াছে। তাঁহার জাতি গিয়াছে।
কিন্তু ঢাকমহাশয়ের কয়েকজন শিষ্য যাহারা বি-এ, এম-এ পাশ করিয়াছে, তাঁহারা বলিল যে,—মহাশয়! এমন কাজ করিবেন না। আপনার জামাতা রাজকার্যে বিদেশে গমন করিয়াছিলেন। মহাসংগ্রামে পৃথিবী টলমল করিতেছে। জর্মণদিগকে যদি সম্পূর্ণ পরাজিত করা না যায়, তাহা হইল ভবিষ্যতে পৃথিবীর ঘোর অনিষ্ট ঘটিবে। আমাদেরও সর্ব্বনাশ হইবে। ইংরেজের প্রতাপে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করিতেছি। আমাদের প্রাণপণে ইংরেজের সাহায্য করা উচিত। আপনি যাহা মনস্থ করিয়াছেন, তাহা করিলে রাজার বিরুদ্ধে কাজ করা হইবে। এমন কাজ কখন করিবেন না।
এইরূপ কথা শুনিয়া ঢাকমহাশয় আমাকে ডাকিতে পাঠালেন। আমি গিয়া বলিলাম, ইংরেজ প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করিবেন না। সাগর অতি ভয়ানক বস্তু। জগন্নাথে গিয়া আমি দেখিয়াছি তিনটা ঢেউ খাইয়া আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়াছিল। সে সাগর-পারে কেই যাইলে হিন্দুধর্মের গ্রন্থটি পর্যন্ত তাঁহার গায়ে থাকে না।
আমি পুনরায় বলিলাম,—আর দেখুন, ঢাকমহাশয়! বিলাতে গেলে বরং নিষ্কৃতি আছে। বিলাত গেলে সাহেব হয়, সাহেবি পোষাক পরে, সাহেবি খানা খায়। তা এখন বিলাত না গিয়াও লোকে এই কাজ করিতেছে। কিন্তু বোগদাদে গমন করিলে লোকে মোল্লা হয়। মোল্লা হইয়া পীরের গান করে। বলে,–
হুঁকো বন্দিলাম, কল্কে বন্দিলাম, আর বন্দিলাম টিকে।
আর তালগাছে বন্দিলাম প্রভু চামচিকে।
তাহার পর সে আরব্য উপন্যাসের দেশ। জিন, দৈত্য, ও দানবীতে পরিপূর্ণ। গুজব এই যে, আপনার জামাতা একটা দৈত্য সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। অতএব এরূপ লোকের সহিত কোন সংস্রব রাখিবেন না। তাঁহার বাড়ীতে আপনার কন্যাকে পাঠাইবেন না। ঢাকমহাশয় তাহাই স্থির করিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ–সন্দেশের হাঁড়ি
কিন্তু ঢাকমহাশয়ের কন্যা কালিকা তাহাতে সম্মত হইলেন না। তিনি শ্বশুরবাড়ী যাইবার নিমিত্ত মাতার নিকট কাঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর নিকট তাঁহাকে পাঠাইবার নিমিত্ত মাতা ঢাকমহাশয়কে অনেক অনুরোধ করিলেন। কিন্তু ঢাকমহাশয় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন যে,—সে পতিত পাপিষ্ঠ সমুদ্রপ্রত্যাগত নরাধমের নিকট পাঠাইয়া আমি কন্যার ইহকাল পরকাল নষ্ট করিতে পারি না। হতাশ হইয়া কালিকা স্বামীকে পত্র লিখিলেন। পত্র পাইয়া একদিন সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে কেশব আসিয়া ঢাকমহাশয়ের খিড়কির নিকট এক বন্য জামতলার স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। জামতলায় অল্প বন ছিল। সেই বনের আড়ালে দাঁড়াইয়া দুইজনে কথাবার্তা করিতে লাগিলেন। বনা জামগাছ। অসময়ে ইহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলা জাম হইয়াছিল। এখন কেষ্টা ছোঁড়া জাম গাছে উঠিয়া জাম খাইতেছিল। কেশব ও কালিকা তাঁহাকে দেখেন নাই। পতি-পত্নীর সকল কথা কেষ্টা শুনিতে পায় নাই। তবে, বুধবার সন্ধ্যায় সময়, ইত্যাদি গোটা কতক কথা কেবল শুনিয়াছিল। যখন স্ত্রী-পুরুষের পরামর্শ শেষ হইবার উপক্রম হইল, তখন গাছ হইতে কেষ্টা বলিয়া উঠিল,ঢাকমহাশয়কে বলিয়া দিব।
দুইজনেই চমকিত হইলেন। একটু স্তব্ধ থাকিয়া তাঁহাকে বলিলেন,–না, দাদা! তা কি বলিতে আছে? লক্ষ্মী দাদা! কাহাকেও কিছু বলিও না।
কেশবকে লক্ষ্য করিয়া কেষ্টা জিজ্ঞাসা করিল,—তুমি ইংরেজি জান?
কেশব উত্তর করিলেন,—হাঁ, একটু আধটু জানি। বিএ পাশ করিয়াছি।
কেষ্টা বলিল,–শীঘ্রই আমাদের পূজার ছুটী হইবে। পূজার সময় তুমি কি করিয়াছ এই মর্মে মাস্টার আমাদিগকে একটা প্রবন্ধ লিখিতে দিবেন। আমার এত কাজ যে, আমি লিখিতে অবসর পাইব না। তুমি যদি আমাকে লিখিয়া দাও, তাহা হইলে আমি বলিয়া দিব না।
কেশব স্বীকার করিলেন। কেষ্টা তাঁহাকে তিন সত্য করিতে বলিল। কালিকাকেও সত্য করিতে হইল। তখন কেষ্টা গাছ হইতে নামিয়া চলিয়া গেল। কেশবও আপনার গ্রামে চলিয়া গেলেন।
বুধবার সন্ধ্যার সময় এইরূপ দুই একটি কথা কেষ্টা সেদিন শুনিতে পাইয়াছিল। বুধবার সন্ধ্যাবেলায় কেষ্টা ভাবিল,—যাই, গিয়া দেখি, আজ তাঁহারা কি করে। এইরূপ মনে করিয়া সে সেই জামগাছে উঠিয়া বসিয়া রহিল। সন্ধ্যার পূর্ব্বে সে দেখিল যে, কালিকা শরা-ঢাকা এক নূতন হাড়ী লইয়া ঘর হইতে চুপি চুপি বাহির হইলেন। জামতলার বনের ভিতর হাঁড়ীটি লুকাইয়া রাখিয়া প্রস্থান করিলেন। কালিকা চলিয়া গেলে, কেষ্টা গাছ হইতে নামিল ও দেখিল যে, হাঁড়ীর মুখে শাখানি কালিকা ময়দা দিয়া আঁটিয়া দিয়াছেন। কিন্তু ময়দা কাঁচা ছিল না। শরা একটু উঠাইয়া কেষ্টা দেখিল যে, হাঁড়ীটি সন্দেশে পরিপূর্ণ। কেশববা আসিয়া কালিকা দিদির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। সেই কথা ঢামহাশয়কে বলিয়া দিব না, আমি এই অঙ্গীকার করিয়াছি। সন্দেশ খাইব না,আমি এরূপ অঙ্গীকার করি নাই। অতএব আমি এই সন্দেশগুলি খাইব। এইরূপ মনে করিয়া কেষ্টা সন্দেশের হাড়ী লইয়া বন হইতে বাহির হইল। পথে দাঁড়াইয়া সে দেখিল যে, সম্মুখ দিকে দুইজন গ্রামের লোক আসিতেছে। পরবর্তী কে চাহিয়া দেখিল যে, প্রেম চাকি ধান বোকই গরুর গাড়ী লইয়া আসিতেছে। কেষ্টা ভাবিল যে, উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে দিই, তা না করিলে আমি ধরা পড়িব। এইরূপ মনে করিয়া সে সন্দেশের হাড়ীটি গাড়ীওয়ালাকে দিয়া বলিল,–প্রেমখুড়ো! কালিকা দিদি আমাকে সন্দেশ দিয়াছেন। আমি একলা খাইব না। তোমাতে আমাতে দুইজনে খাইব। তুমি ঘোষেদের গঙ্গার ঘাটে গিয়া গাড়ী রাখ। একটু পরে আমি যাইতেছি। (কলিকাতার দক্ষিণে এই সমুদয় ঘটনা ঘটিয়াছিল। এ স্থানে প্রাচীন গঙ্গার গর্ভ ললাকে ভাগ করিয়া লইয়াছে। এই ঘোষেদের গঙ্গা, বসুদের গঙ্গা ইত্যাদি) প্রেমচাকি সন্দেশের হাঁড়ী লইয়া গঙ্গার ঘাটে চলিল। কেষ্টাও অন্য পথ দিয়া সেই দিকে চলিল। প্রেমচাকি ঘাটে উপস্থিত হইয়া হাঁড়ীটি একটু খুলিয়া দেখিল যে, সন্দেশে পরিপূর্ণ। সে ভাবিল যে, আমার ছেলেদের জন্য সন্দেশ লইয়া যাইব! কেষ্টাকে ভাগ দিব না। কিন্তু এই সময় দেখিল যে, দূরে কেষ্টা আসিতেছে। অড়াতাড়ি হাঁড়ীটির মুখ পুনরায় বন্ধ করিল। গাড়ী হইতে একটি ঝুড়ি লইয়া হাঁড়ীটি ঝুড়ি চাপা দিয়া তাঁহার উপর সে বসিয়া রহিল। কেষ্টা আসিয়া সন্দেশের ভাগ চাহিল, আমি সব সন্দেশ খাইয়া ফেলিয়াছি। দুইজনে ঝগড়া বাঁধিয়া গেল। এমন সময় কেষ্টা দেখিল যে দুরে গজরাজ আসিতেছে। তাঁহাকে দেখিয়া কেষ্টা সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
এদিকে কালিকার মন সুস্থির নাই। জামতলায় সন্দেশের হাড়ী ঠিক আছে কি না, তাহা দেখিবার নিমিত্ত তিনি আর একবার বনের ভিতর গমন করিলেন। সে স্থানে গিয়া দেখিলেন যে, বনের ভিতর সন্দেশের হাঁড়ী নাই। কালিকা কাঁদিয়া উঠিলেন। আমার হাড়ী কে লইয়া গিয়াছে, এই বলিয়া ক্রমাগত কাঁদিতে লাগিলেন।
সেদিন বৈকালবেলা আমি ঢাকমহাশয়ের বাড়ী গিয়াছিলাম। ঢাকমহাশয় বলিয়াছিলেন যে, আমি নানা বিপদে পড়িতেছি। মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিতেছেন না, অতএব আর আমি দুর্গার পূজা করিব না। কথা শুনিয়া আমি থাকিতে পারিলাম না। আমি তাঁহাকে বুঝাইতে যাইলাম। আমি বলিলাম যে, দুর্গা পরম দয়াময়ী। যাহা হইবার, তাহা হইয়া গিয়াছে। ভক্তিভাবে ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করুন। তাহা হইলে আমাকেও যেরূপ তিনি নানা বিপদ হইতে রক্ষা করেন, আপনাকেও তিনি সেইরূপ নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন।
কিন্তু প্রথম তিনি আমার কথায় কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তাহার পর যখন আমি বলিলাম যে, পূজা বন্ধ করিলে, শিষ্য-সেবক যে বার্ষিক প্রদান করে, তাঁহার কি হইবে? তখন কি হইবে? তখন তিনি পূজা করিতে সম্মত হইলেন। আমাদের দুইজনে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কালিকা কান্নার শব্দ আমাদের কানে প্রবেশ করিল। আমরা সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,—কি হইয়াছে?
কালিকা উত্তর করিলেন যে,—আমার সন্দেশের হাঁড়ী কে লইয়া গিয়াছে।
আমি বলিলাম,—গোটা কত সন্দেশের জন্য এত কান্না কেন? ঢাকমহাশয় তোমাকে অনেক সন্দেশ কিনিয়া দিবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – উড়ুখ্খ্ হাঁড়ী
ক্রমে সকল কথা প্রকাশ পাইল। পিতার অগোচরে কালিকা ঘর হইতে পলায়ন করিবেন, স্বামীর সহিত এইরূপ পরামর্শ করিয়াছিলেন। বুধবার সন্ধ্যাবেলা কেশব ঘোড়ার গাড়ীতে কাটিগঙ্গার ঘাটের নিকট লুক্কায়িত থাকিবেন। একটু অন্ধকার হইলে কালিকা ভুলুকে লইয়া সেই স্থানে গমন করিবেন। তাহার পর ঘোড়ার গাড়ীতে রেলস্টেশন যাইবেন। সে স্থান হইতে রেলগাড়ীতে কেশব স্ত্রী-পুত্র লইয়া আপনার গ্রামে গমন করিবেন? বাক্স লইয়া গেলে পাছে কেহ জানিতে পারে, সেজন্য কালিকা আপনার গহনাগুলি হাঁড়ীতে রাখিয়া তাঁহার উপর সন্দেশ চাপা দিয়া বনে রাখিয়াছিলেন। যাইবার সময় লইয়া যাইবেন, এইরূপ মানস করিয়াছিলেন।
যখন এইসব কথা প্রকাশ হইল, তখন একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। কে সে হাঁড়ী লইয়া গেল, তাঁহার অনুসন্ধান হইতে লাগিল। দুইজন গ্রামের লোক বলিল যে, সন্ধ্যার সময় তাঁহারা জামগাছের নিকট দিয়া যাইতেছিল। প্রেমা চাকি গরুর গাড়ী লইয়া সেই পথ দিয়া আসিতেছিল। কেষ্টা তাঁহাকে একটা হাঁড়ী দিল। ইহা তাঁহারা দেখিয়াছে।
তৎক্ষণাৎ একজন লোক প্রেম চাকির বাড়ীতে দৌড়িল। আর একজন লোক কেন্টার বাড়ীতে গেল। আমার চাকর গজরাজকে আমি গঙ্গার ঘাটে পাঠাইলাম। আমি তাঁহাকে আদেশ করিলাম যে,—সেস্থানে যদি তুমি প্রেমা চাকিকে দেখিতে পাও, তাহা হইলে গাড়ীশুদ্ধ তাঁহাকে ধরিয়া আনিবে।
গজরাজ তাহাই করিল। প্রেম চাকির গাড়ী আমরা অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম। হাঁড়ী পাইলাম না। কিন্তু যখন সে শুনিল যে, হাঁড়ীতে কেবল সন্দেশ ছিল না, তাঁহার ভিতর অনেক গহনা ছিল, তখন সে বলিল যে, যেস্থানে সে গাড়ী রাখিয়াছিল, তাঁহার নিয়ে ভূমিতে ঝুড়িচাপা সেই হাঁড়ী আছে। তখন আমরা সকলেই গঙ্গার ঘাটের দিকে দৌড়িলাম।
একদিকে সন্ধ্যার সময় কেশব রেলষ্টেশন হইতে ঘোড়ার গাড়ী করিয়া কাটিগঙ্গার ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটু দূরে ঘোড়ার গাড়ী রাখিয়া তিনি ঘাটের নিকট গমন করিলেন। তখনও সে স্থানে কালিকা ও ভুলু আসে নাই। কিন্তু দেখিলেন যে, একটা বুড়ি উপুড় হইয়া রহিয়াছে। ঝুড়িটি তুলিয়া দেখিলেন যে, নিম্ন একটি হাঁড়ী রহিয়াছে। হাঁড়ির ভিতর সন্দেশ। কেশব মনে করিলেন যে, গাড়ীতে ভুলু খাইবে, সেই জন্য কালিকা এই সন্দেশগুলি কাহারও হাতে গোপনে পাঠাইয়া দিয়াছেন। হাঁড়ীটা কোলে লইয়া তিনি কালিকা ও ভুলুর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
অল্পক্ষণ পরে কেশব দেখিলেন যে, কিছুদূরে অনেক লোক ঘাটের দিকে আসিতেছে। ব্যাপারটা কি জানিবার নিমিত্ত তিনি অন্য পথে দ্রুতবেগে ঢাকমহাশয়ের বাড়ীর দিকে গমন করিলেন। সে স্থানে উপস্থিত হইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। গোয়ালের কোণে হাড়ীটি রাখিয়া তিনি গোয়ালের পশ্চাতে লুকাইয়া রহিলেন।
সকলে গঙ্গার ঘাটে গিয়া গাড়ি দেখিতে পাইল। কিন্তু ঝুড়ি তুলিয়া দেখিল যে তাঁহার নিম্নে হাঁড়ী নাই। হতাশ হইয়া সকলে ঢামহাশয়ের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল। ক্রমে বিলক্ষণ একটা জনতা হইয়াছিল। কালিকাও সকলের সঙ্গে ঘাটে গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময় তিনি একটু পশ্চাতে পড়িয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া কেশব লুক্কায়িত স্থান হইতে বাহির হইয়া গোলমালের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। কালিকা মুখে সকল বিবরণ শ্রবণ করিয়া তিনি বলিলেন,–কেন! হাঁড়ী আমি লইয়া আসিয়াছি। গোয়ালের কোণে তাহা আমি রাখিয়া দিয়াছি।
আহ্লাদিত হইয়া কালিকা মাতা-পিতার সঙ্গে গোয়ালে প্রবেশ করিলেন। আঁতিপাতি করিয়া গোয়ালের সকল কোণ, গোয়ালের সকল স্থান অন্বেষণ করিলেন। কিন্তু হাঁড়ী পাইলেন না। কালিকা পুনরায় কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন। তখন বিন্দি নামক ঢাকমহাশয়ের ঝি বলিল যে,–সে প্রতিদিন সকলের পাতের খাবার কুড়াইয়া তাঁহার বোনঝির নিমিত্ত গোয়ালের কোণে রাখিয়া দেয়। সন্ধ্যাবেলা তাঁহার বোনঝি লইয়া যায়। সে হয়তো হাঁড়ী লইয়া গিয়াছে।
বিন্দির বোঝিকে খুঁজিতে লোক দৌড়িল। সে অধিক দূর যায় নাই। হাঁড়ী সহিত সকলে তাঁহাকে ধরিয়া আনিল। ব্যস্ত হইয়া কালিকা হাঁড়ী খুলিয়া দেখিলেন। হরি হরি! তিনি দেখিলেন যে, সন্দেশের নিয়ে তিনি যে ভাবে গহনাগুলি সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন, সেইরূপ আছে। হাঁড়ী লইয়া আনন্দে তিনি মাতা ও ভুলোর সহিত দোতলায় আপনার ঘরে গমন করিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – আরব্য উপন্যাসের জিন
কেশব আর লুক্কায়িত হন নাই। ভিড়ের অন্য লোকের সহিত দাঁড়াইয়া তিনি সমুদয় ঘটনা দেখিতেছিলেন। ঢাকমহাশয়ের দৃষ্টি তাঁহার উপর পড়িল। ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া তিনি তাঁহাকে গাল দিতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন,–দূর হঃ, দূর হঃ! বোগদাদি মোল্লা আসিয়া আজ আমার হিন্দুধর্ম্ম নষ্ট করিল। এইরূপ বলিতে বলিতে তাঁহার রাগ দাবানলের ন্যায় আরও জুলিয়া উঠিল। কেশবকে তিনি একপাটি জুতা ছুড়িয়া মারিলেন।
কেশব ধীরে ধীরে বলিলেন,–আপনি আমার পিতৃস্থানীয় গুরুজন। আমি প্রত্যুত্তর করিব না। চারিদিন পরে আপনার কন্যাকে ও আমার পুত্রকে আমি লইতে পাঠাইব, পাঠইয়া দিবেন। না পাঠাইলে আপনাকে অনুতাপ করিতে হইবে।
এই কথা বলিয়া কেশব চলিয়া গেলেন। কেশব তখনও বাড়ীর বাহির হন নাই। এমন সময় ঢাকমহাশয়ের সম্মুখে মাথায় পাগড়ী, বুক পর্যন্ত দাড়ি, ইজের পরা প্রকাণ্ড এক জিন আসিয়া দাঁড়াইল। জিন ঠিক দৈত্য নহে। আমাদের দেশে যেরূপ যক্ষ রক্ষ অপ্সর কিন্নর গন্ধর্ব আছে, বোগদাদ অঞ্চলে সেইরূপ জিন নামক এক প্রকার ভৌতিক বায়বীয় জীব আছে। জিনকে দেখিয়া সকলে ভয়ে রুদ্ধশ্বসে পলায়ন করিল। কেবল আমি ডমরুধর ভয় পাইলাম না। অনেক ভূত-প্রেতের সহিত আমি কারবার করিয়াছি। ঢাকমহাশয়ের নিকট গট্ হইয়া বসিয়া রহিলাম।
জিনটির কথা আমি এইরূপ শুনিলাম। একদিন কেশব ছিপ ফেলিয়া তাইগ্রিস নদীতে মাছ ধরিতেছিলেন। হঠাৎ তাঁহার বঁড়শীতে কি লাগিয়া গেল। সাবধানে উপরে তুলিয়া দেখিলেন যে, তাহা এক তাম্র-নির্ম্মিত হাঁড়ী। তামার ঢাকনা দ্বারা হাঁড়ীর মুখ বন্ধ। সেই ঢাকনের উপর হিজিবিজি লেখা আছে ও তাঁহার উপর সিলমোহর আছে। হাঁড়ীর ভাব দেখিয়া তাঁহার আরব্য উপন্যাসে বর্ণিত ধীবরের কথা স্মরণ হইল। তিনি ভাবিলেন যে, ঢাকনা খুলিলে হয় তো হাঁড়ীর ভিতর হইতে প্রথম ধূম বাহির হইবে। তাহার পর সেই ধূম জিনের আকার ধারণ করিবে, তাহার পর জিন আমাকে বধ করিতে চাহিবে। এই ভয়ে তিনি তিনদিন হাঁড়ীর ঢাকনা খুলিলেন না। ইচ্ছা তাঁহার মনে অতিশয় প্রবল হইল। ছুরি দিয়া অতিকষ্টে তিনি ঢাকনা খুলিলেন। তাহার পর যে ভয় করিয়াছিলেন, তাহাই হইল। হাঁড়ী হইতে প্রথম ধূম বাহির হইল; ধূম গাঢ় হইয়া প্রকাণ্ড জিনে পরিণত হইল। কেশব ঘোতর ভীত হইল। কিন্তু জিন তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আলাদিন কোথায়? প্রদীপের সে জিন কোথায়। আলাদিনের নিমিত্ত মুণিমুক্তাখচিত অট্টালিকা প্রস্তুত করিতে প্রদীপের জিন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিল। মজুরি হিসাবে তাঁহার নিকট আমার এক সহস্র দিনার বা টাকা পাওনা আছে। সেই কথা লইয়া তাঁহার সহিত আমার বিবাদ হইয়াছিল। সেজন্য প্রদীপের জিন আমাকে তামার হাড়ীতে বন্ধ করিয়া সিলমোহর করিয়া তাইগ্রিস নদীতে নিক্ষেপ করিয়াছিল। এখন তাঁহার নিকট হইতে আমি আমার টাকা আদায় করিব।কেশব বলিলেন,—আমি বিদেশী লোক। আরব্য উপন্যাসের সে আলাদিন কোথায়, তাঁহার সে প্রদীপের জিন কোথায়, তাহা আমি জানি না।
জিন বলিল,—আমি আলাদিনকে ও প্রদীপের জিনকে খুঁজিয়া বাহির করিব। কিন্তু প্রথম আমি তোমার উপকার করিব। কারণ, তুমি আমাকে জল হইতে তুলিয়াছ; হাঁড়ি হইতে বাহির করিয়াছ। তোমার সহিত তোমার দেশে আমি যাইব। নানা বিপদ হইতে তোমাকে আমি রক্ষা করিব। তাহার পর তোমাকে লইয়া এ দেশে পুনরায় ফিরিয়া আসিব। সেই হাজার দিনার আদায় করিয়া তোমাকে আমি দিব। কেশবের সহিত জিন সেই জন্য বঙ্গদেশে আসিয়াছে।
জিন ঢাকমহাশয়ের দিকে ভয়ঙ্কর কোপদৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তাঁহার চকু দুইটি হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হইতে লাগিল। অবশেষে সে বলিল,–নরাধম কাফের! তুই আমার বন্ধুকে অপমান করিয়াছিস। একচক্ষু কাণা দামড়া গরুর আকৃতি ধারণ কর। তৎক্ষণাৎ ঢাকমহাশয় একচক্ষুহীন দামড়া গরু হইয়া গেলেন। সেই মুহূর্তে জিন অদৃশ্য হইয়া গেল।
ঘোর বিপদ দেখিয়া আমি দৌড়িয়া গিয়া পথে কেশবকে ধরিলাম। দুর্ঘটনার বিবরণ শুনিয়া তিনি বলিলেন,—শ্বশুরমহাশয়কে পুনরায় মানুষ করি, সে ক্ষমতা আমার নাই। জিন কেবল মাঝে মাঝে আমার নিকট আগমন করে। পুনরায় কবে আসিবে, তাহা জানি না। এইবার যেদিন আসিবে, তাঁহার হাতে-পায়ে ধরিয়া শ্বশুরমহাশয়কে ভাল করিতে চেষ্টা করিব।
এই কথা বলিয়া কেশব আপনার গৃহে চলিয়া গেলেন। এ স্থানে ঢাকমহাশয়ের বাড়ীতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। কালিকা কাঁদিতে লাগিলেন, সকলেই কাঁদিতে লাগিল। ঢাকমহাশয় হাঁ করিয়া দেখাইলেন যে, তাঁহার মুখ শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। আমি একহাড়ী ভাতের ফেন আনিয়া তাঁহার সম্মুখে ধরিলাম। ঢাকমহাশয় চো চো করিয়া তাহা খাইয়া ফেলিলেন। তাহা খাইয়া তাঁহার শরীর কিঞ্চিৎ সুস্থ হইল। আমরা তাঁহাকে ঘরের ভিতর লইয়া যাইতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তিনি পৈঠা উঠিতে সম্মত হইলেন না। অগত্যা তাঁহাকে গোয়ালে লইয়া যাইতে হইল। তাঁহার মুখের ভঙ্গী দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, তিনি আর সকলকে বলিয়া যাইতে বলিতেছেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দর দর ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। আমি তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া বলিলাম,–কিছু ভয় নাই, শীঘ্রই পুনরায় আপনি মনুষ্য-শরীর পাইবেন। আর যতদিন না পুনরায় আপনার মনুষ্য-শরীর হয়, ততদিন আপনাকে আমি ছাড়িয়া যাইব না।
রাত্রি নয়টার সময় আমি নিজহাতে খড় কাটিয়া তাঁহাকে জাব দিলাম। তার পর গোয়ালের দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া আমি ক্রমাগত মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম যে,–মা! তুমি আমাকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ। আমার বুকে তুমি এ বিপদ হইতে রক্ষা কর। ইনি পূজা করিবেন না বলিয়াছেন। কিন্তু মা! ভাবিও না; যাহাতে ইনি এ বৎসর ঘটা করিয়া তোমার পূজা করেন, আমি সে ব্যবস্থা করিব।
সপ্তম পরিচ্ছেদ–আবার এলোকেশী
মা দয়াময়ী। মা আমার কান্না শুনিলেন। রাত্রি তিনটার সময় গোয়ালে অন্ধকারে বসিয়া আমি একটু চক্ষু বুজিয়াছি, এমন সময় মা আমাকে দর্শন দিলেন।
মা বলিলেন,–ডমরুধর! তুমি আমার বরপুত্র, কিছু ভয় নাই। সরস্বতীর কৃপায় তোমার মুখ হইতে জিলেট মন্ত্র বাহির হইয়াছিল, সেই মহামন্ত্রের প্রভাবে তুমি ঢাকের পশুত্ব মোচন কর। কুন্তলাকে উদ্ধার কর, কেশবকে সমুদ্রযাত্রাজনিত পাপ হইতে মুক্ত কর। সমুদ্রযাত্রা তো সামান্য কথা। জিলেট মন্ত্র প্রভাবে মানুষের সকল পাপ দূর হয়। এই মহামন্ত্রের মহিমা অপার। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।
এইরূপ উপদেশ দিয়া মা অন্তর্ধান হইলেন। প্রাতঃকালে উঠিয়া আমি প্রথমে স্নান করিলাম, শুচি হইয়া গোয়ালে প্রবেশ করিয়া একচক্ষুহীন দামড়া গরুর অর্থাৎ ঢাকমহাশয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া আমি জিলেট মন্ত্র পাঠ করিতে লাগিলাম।
জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ, সাতবার এই মহামন্ত্র পাঠ করিতেই ঢাকমহাশয়ের দামড়া রূপ ঘুচিয়া পুনরায় মনুষ্যরূপ হইল।
তাহার পর জিলেট মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে আমি ঢাকমহাশয়ের বাড়ী তিনবার প্রদক্ষিণ করিলাম। তৎক্ষণাৎ আকাশ হইতে পুষ্পক বথ নামিয়া আসিল। সেই রথে চড়িয়া কুন্তলা স্বর্গে গমন করিলেন। জিলেট মন্ত্রের এমনি প্রভাব।
জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিশ।
ঢাকমহাশয়ের পুনরায় মা দুর্গার প্রতি অসীম ভক্তি হইল। তিনি প্রতিমা গঠনের নিমিত্ত আদেশ করিলেন ও মহাসমারোহে পূজার আয়োজন করিতে লাগিলেন। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।
জামাতা কেশবকে তিনি ডকিতে পাঠাইলেন। জিলেট মন্ত্রে তাঁহার গায়ে হাত বুলাইয়া আমি তাঁহাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিলাম। শ্বশুর-জামাতায় অক্ষুণ্ণ অপরিসীম স্নেহমমতা ও সদ্ভাব হইল। জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।
দুই চারিদিন পরে জিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সে বলিল,–এই যে ডমরুমহাশয়, মনুষ্য মধ্যে ইনি রত্নবিশেষ। ইনি জিলেট মন্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছেন। সেই মহামন্ত্রবলে ইনি না পারেন, এমন কাজ নাই। আজ রাত্রিতে ইহাকে আমি শাহাজাদি দিনারজাদি নাচ দেখাইব। পুস্তকে লেখা আছে যে, শাহারজাদি গল্প বলিয়া বাদশাহকে বশ করিয়াছিলেন। সে মিথ্যা কথা। দুই ভগিনীর নাচ দেখিয়া বাদশাহ বশ হইয়াছিলেন।
সেই রাত্রে আমি পুনরায় ঢাকমহাশয়ের বাড়ী গমন করিলাম। রাত্রি নয়টার সময় দুইজন পরমা সুন্দরী রমণীর সহিত জিন আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই দুইটি রমণী আমাদের সম্মুখে নানা ভাব-ভঙ্গী করিয়া নাচিতে লাগিল। কেবল ঢাকমহাশয়, কেশব ও আমি সে নাচ দেখিয়াছিলাম। রমণী দুইটির অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য ও অদ্ভুত নাচ দেখিয়া আমার মুণ্ডু ঘুরিয়া গেল। দুর্লভী বাগদিনীকে আমি ভুলিয়া যাইলাম।
নাচ সমাপ্ত হইলে জিন বলিল,–আজ রাত্রিতেই আমরা বোগদাদে গমন করিব। ডমরুমহাশয় ও কেশবকে সঙ্গে লইয়া যাইব। বায়ুরূপে উডিয়া মুহূর্ত মধ্যে আমরা সে স্থানে পৌঁছিব। সে স্থানে গিয়া ডমরুমহাশয়ের সহিত শাহারজাদির নিকা দিব ও দিনারজাদির সহিত কেশবের বিবাহ দিব। সে প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। কিন্তু আমি বলিলাম যে, এলোকেশীর মত না লইয়া আমি যাইতে পারিব না। কারণ, তাঁহাকে যদি না বলিয়া যাই, তাহা হইলে পৃথিবী খুঁজিয়া তিনি আমাকে বাহির করিবেন। আর মাথার টাক হইতে পায়ের অঙ্গুলি পর্যন্ত তিনি আমাকে ঝাঁটা পেটা করিবেন।
জিন এলোকেশীকে ডাকিতে পাঠাইল। ঝাঁটা হাতে করিয়া নিবিড় তিমির দ্বারা গঠিত শরীরে জবাকুসুমসম লোহিত লোচনে এলোকেশী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই জিনের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার পর শাহারজাদির সহিত আমার নিকার প্রস্তাব শুনিয়া যখন এলোকেশী জিনকে ঝাঁটা পেটা করিতে দৌড়িলেন তখন জিন, শাহারজাদি ও দিনারজাদির শবীর গলিয়া ধূমে পরিণত হইল। ধূম বাতাসে মিশিয়া গেল। সেইদিন হইতে তাঁহারা কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা কেহ জানে না। কেশবের নিকট জিন আর আসে না।
যাহা হউক, ঢাকমহাশয় এ বৎসর ঘোর ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব করিলেন।
লম্বোদর বলিলেন,—আচ্ছা আজগুবি গল্প তুমি বানাইতে পার।
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—সকলই মহামায়ার মায়া।
জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।