৭. সদাশিববাবুর নাতি আর নাতনি

সদাশিববাবুর নাতি আর নাতনিকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েও নবীন স্বস্তি পাচ্ছিল না। অনু আর বিলুকে সে খানিকটা চেনে। দুজনেই ভারী একগুঁয়ে আর জেদি। সদাশিববাবুরই তো নাতি আর নাতনি। তার ওপর ওদের শরীরেও ডাকাতের রক্ত আছে।

সুতরাং নবীন ফের সদাশিববাবুর বাড়ির দিকে ফিরল। কথাটা সদাশিববাবুকে জামানো দরকার।

সদাশিববাবুর মনটা বিশেষ ভাল নেই। সিদ্ধিনাথের মতো পুরনো আর বিশ্বাসী লোককে এভাবে ঘায়েল করল কে, তা-ই ভেবে তিনি ভীষণ উদ্বেগ বোধ করছেন। বাইরের ঘরে শাল মুড়ি দিয়ে বসে তিনি এই সবই ভাবছিলেন।

নবীনকে দেখে বললেন, “এসো হে নবীনচন্দ্র, কেটেরহাট যে আবার বেশ বিপদের জায়গা হয়ে উঠল।”

“তা-ই দেখছি।”

“ডাকাতের আমলে এখানে খুন-জখম হত বটে, কিন্তু সে তো অতীতের কথা। ইদানীং তো কেটেরহাটের মতো নিরাপদ জায়গা হয় না।”

“যে আজ্ঞে।”

“তা হলে এ সব হচ্ছেটা কী?”

“আমিও ভেবে পাচ্ছি না।”

“তার ওপর বাঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে।”

নবীন একটা চেয়ারে বসে বলল, “ব্যাপারটা সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে সদাশিববাবু। এমনকি, অনু আর বিলু অবধি জঙ্গলে যেতে চাইছে।”

সদাশিববাবু একটু চমকে উঠে বললেন, “জঙ্গলে? খবরদার না। কে ওদের এই বুদ্ধি দিয়েছে?”

“আপনি উত্তেজিত হবেন না। ছেলেমানুষ তো! ভারী অ্যাডভেঞ্চারের শখ। আমি ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছি। আপনিও একটু নজর রাখবেন, যেন হুট করে বেরিয়ে না পড়ে। বেরোলে বিপদ হতে কতক্ষণ?”

“বটেই তো! ওরে ও বচন, অনু আর বিলুকে ডাক তো। বল, এক্ষুনি আসতে।”

বচন এসে বলল, “ওনারা তো যাত্রা শুনতে গেছেন।“

“তাই তো! আমাকে তো বলেই গেছে।”

নবীন একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলল, “না, যাত্রা শুনতে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আমি ওদের ফের ফিরিয়ে ফটক অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছি। বচন, ভাল করে খুঁজে দ্যাখো তো?”

বচন গিয়ে একটু বাদে এসে বলল, “বাড়িতে নেই।”

সদাশিববাবু উত্তেজনায় উদ্বেগে খাড়া হয়ে উঠলেন, “বলিস কী? বাড়িতে নেই মানে?”

বুদ্ধিমান নবীন অবস্থাটা বুঝে চোখের পলকে সামলে নিল পরিস্থিতিটা। বলল, “আপনি উত্তেজিত হবেন না। যাত্রার লোভ আমি নিজেও সামলাতে পারি না। ও বড় সাঙ্ঘাতিক নেশা। আসলে হল কী জানেন, আমি ওদের যেতে বারণ করলেও ওরা মানতে চাইছিল না। আমার মনে হয়, ওরা ফের যাত্রাতেই গেছে। আমি গিয়ে দেখে আসছি।”

সদাশিব খানিকটা শান্ত হয়ে বসলেন। বললেন, “সেটাই সম্ভব। তবু বচনকে সঙ্গে নিয়ে যাও। খবরটা না পেলে আমার হার্ট ফেল হয়ে যাবে।”

নবীন বেরিয়ে এসে বচনকে আড়ালে নিয়ে বলল, “দ্যাখো, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকছে। তুমি যাত্রার আসরটা দেখে এসো তো! কিন্তু যদি সেখানে ওদের না দেখতে পাও, তবে কতাবাবুকে এসে সেই খবরটা দিও না। ব’লো, ওরা যাত্রা দেখছে। আমি একটু জঙ্গলটা খুঁজে আসছি।”

নবীন বাড়ি ফিরে তার টর্চ বাতিটা আর লাঠিগাছ সঙ্গে নিল। লাঠিটা বোধহয় দুশো বছরের পুরনো। শোনা যায়, এই লাঠি তার কোনও পূর্বপুরুষ ব্যবহার করতেন। প্রতিটা গাট পেতল দিয়ে বাঁধানো। মহাদেব আজও এটাকে খুব পরিচর্যা করে বলে এখনও মজবুত আর তেল-চুকচুকে আছে। গায়ের চাঁদর ছেড়ে নবীন একটা ফুলহাতা সোয়েটার আর বাঁদুরে টুপি পরে নিল। ধুতির বদলে পরল প্যান্ট। পায়ে বুট জুতো।

তার পর বেরিয়ে পড়ল।

জঙ্গলের মধ্যে স্বাভাবিক পথে ঢুকে কোনও লাভ নেই। অনেকটা ঘুরতে হবে। নবীনের একটা শর্টকাট জানা আছে। ঝিলের পশ্চিম ধার দিয়ে গেলে জঙ্গলের কালীবাড়ি কাছেই হয়।

নবীন সেই পথই ধরল। আসলে পথ বলে কিছু নেই। ঝোঁপঝাড় ভেদ করেই হাঁটতে হয়। তবে দিনের বেলা এখান দিয়ে কিছু লোক কাঠ কুড়োতে যায়। গরিবেরা আসে জঙ্গলের ফল-পাকুড় পাড়তে। দুষ্টু ছেলেদেরও আনাগোনা আছে। তাই সামান্য একটু পথের চিহ্নও আছে।

নবীন দ্রুত সেই পথ ধরে এগোতে লাগল।

তার পথ ভুল হওয়ার ভয় নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই সে কালীবাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। চার দিক অন্ধকারে ডুবে আছে। শেয়াল ডাকছে। ঝিঝি ডাকছে। পেঁচা ডাকছে।

নবীন চার দিকটা সতর্ক পায়ে ঘুরে দেখল। কোথাও অনু বা বিলুর কোনও চিহ্ন নেই। নবীন এই জায়গায় দিনে-দুপুরে বহু বার এসেছে। ছেলেবেলা থেকেই এই জায়গা তার চেনা। মাঝে-মধ্যে এক সাধু এসে এখানে থানা গাড়তেন। ফের কিছু দিন পর চলে যেতেন। তাঁর নাম অঘোরবাবা। লোকে বলে, অঘোরবাবা গত আড়াইশো বছর ধরে প্রতি বছর এক বার করে আসেন। ছেলেবেলায় নবীন অঘোরবাবার কাছে এসেছে। অঘোরবাবা কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। আপন মনে খুনি ৭৬

জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন চোখ বুজে। লোকে ফল-মূল চাল-ডাল দিয়ে যেত মেলাই। সবই পড়ে থাকত। মাঝে-মধ্যে হয়তো এক-আধটা ফল খেতেন।

অঘোরবাবাকে নবীন মৌনী সাধু বলেই জানত। কিন্তু এক দিন সেই ভুল ভাঙল। বছর তিনেক আগে অঘোরবাবা যখন সকালে ধ্যানে বসেছিলেন, তখন নবীন এসে প্রণাম করে সামনে বসতেই অঘোরবাবা চোখ মেলে চাইলেন।

নবীনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “এ-জায়গাটার নাম কী রে?”

নবীন ভীষণ চমকে উঠল গমগমে সেই গলা শুনে। ভয়ে-ভয়ে বলল, “ঝিলের ও-পাশটা কেটেরহাট। তবে এ-দিকটার নাম হল চাঁপাকুঞ্জ। লোকে বলে ‘চাঁপার বন’”।

অঘোরবাবা তাঁর বিপুল গোঁফদাড়ির ফাঁকে একটু হেসে বললেন, “বড্ড ফাঁকা জায়গা। ভিতরটা একেবারে খোল।

কথাটার মানে নবীন বুঝতে পারেনি। অঘোরবাবাও আর ব্যাখ্যা করেননি।

অঘোরবাবার সেই কথাটা আজ মনে পড়ল নবীনের। তা হলে কি চাঁপাকুঞ্জের তলায় মাটির নীচে কোনও গুহা আছে?

নবীন ঘুরতে ঘুরতে যাদের কাছে চলে এল। এখানেই ভুজঙ্গকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল। নবীন খাদের ভিতরে নেমে চার দিক ঘুরে দেখল। কোথাও অনু-বিলুর কোনও চিহ্ন নেই।

হঠাৎ একটু শিরশিরে বাতাস বয়ে গেল, পাতায়-পাতায় শব্দ উঠল ফিসফিস। আর নবীনের গায়ে হঠাৎ কেন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল।

তার পর নবীন সেই আশ্চর্য অশরীরী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, “চলো দক্ষিণে..দক্ষিণে… ভারী বিপদ।”

নবীন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু চট করে দুর্বলতা কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার পর দক্ষিণ দিকে এগোতে লাগল।

চলতে চলতে চাঁপাকুঞ্জের চেনা ছক হারিয়ে গেল। সে শুনেছে, দক্ষিণের জঙ্গল গিয়ে মিশেছে সুন্দরবনে। এ-দিকটা সাঙ্ঘাতিক দুর্গম। লোকবসতি একেবারেই নেই।

“এগোও…ভয় পেয়ো না…এগিয়ে যাও।”

আবার সেই কণ্ঠস্বর।

নবীন প্রাণপণে এগোতে লাগল। ক্রমে লতাপাতা কাঁটাঝোঁপ এত ঘন হয়ে উঠল যে, চলাই যায় না।

কিন্তু সেই অশরীরীর কণ্ঠস্বর তার কানে কানে বলে দিতে লাগল, “বাঁ দিক ঘেঁষে চলো..নিচু হও…ডাইনে ঘোরো…”

নবীন ঠিক-ঠিক সেই নির্দেশ মেনে চলতে লাগল।

আশ্চর্যের বিষয়, মিনিট পনেরো হাঁটবার পর সে একটা বেশ ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে গেল। সামনে একটা বিশাল বটগাছ। তার তলাটা বাঁধানেনা।

নবীন টর্চ জ্বালল। শিশিরে-ভেজা নরম মাটিতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল দু জোড়া কেডসের ছাপ।

“পায়ের ছাপ ধরে এগোও…কুয়োর মধ্যে…”

নবীন কণ্ঠস্বরের নির্দেশ অনুযায়ী এগোতে লাগল। টর্চের আলোয় একটু বাদেই সে দেখতে পেল, একটা ভাঙা মস্ত উঁচু ইদারার মুখ।

এই কি সেই কুখ্যাত ফাঁসিখানা? এ-অঞ্চলের লোকের মুখে-মুখে ফাঁসিখানার কথা শোনা যায় বটে। নবীন ভেবেছিল, নিতান্তই আজগুবি গল্প। কিন্তু এ তো সত্যিকারের ফাঁসির মঞ্চ বলেই মনে হচ্ছে।

নবীন সিঁড়ি বেয়ে ইদারার ধারে উঠে পড়ল। ভিতরে টর্চ ফেলে দেখল, অগাধ গহ্বর। কিন্তু তলা থেকে বিস্তর লতাপাতা উঠে এসেছে ওপরে। সরু সিঁড়িটায় টর্চের আলো ফেলল সে। অনু আর বিলু কি এই সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে? সাহস বটে বাচ্চা দুটোর।

এর পর কী করতে হবে, নবীনকে তা আর বলে দিতে হল। সে নির্দ্বিধায় সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামতে লাগল। টর্চের আলোয় তলাটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইদারার গা বেয়ে নামতে নামতে নবীনের গায়ে ফের কাঁটা দিচ্ছিল। সে চাঁপাকুঞ্জের ফাঁপা অভ্যন্তরের সন্ধান পাবে কি?

সিঁড়ির শেষ ধাপটায় দাঁড়িয়ে পড়ে নবীন টর্চের আলোয় দেখতে পেল, পরের সিঁড়িটা যে সদ্য ভেঙে পড়েছে, তার সুস্পষ্ট দাগ রয়েছে ইদারার দেওয়ালে। দুই ভাই-বোন কি পড়ে গেছে ৮০

এখান থেকে? পড়ে গেলে বেঁচে আছে কি এখনও?

নবীন একটা মোটা লতা ধরে ঝুলে পড়ল নীচে। তারপর ধীরে-ধীরে নামতে লাগল।

লতা খুব জোরালো নয়। মাঝে-মাঝে হড়াস করে খসে যাচ্ছে। নবীন সঙ্গে-সঙ্গে অন্য লতা ধরে ফেলছে চট করে।

বেশিক্ষণ লাগল না। নবীন মাটিতে নেমে দাঁড়াল। তলাটা ভেজা-ভেজা, গোড়ালি অবধি ডুবে গেল নরম কাদায়।

নবীন টর্চ জ্বালতেই দেখতে পেল, অনু আর বিলু দুটো ডল-পুতুলের মতো পড়ে আছে মাটিতে। নবীন নাড়ি দেখল, নাকে হাত দিয়ে দেখল। চোট খুব বেশি লাগেনি বলেই মনে হচ্ছে। ভয় আর শক-এ অজ্ঞান হয়ে গেছে।

নবীন ধীরে-ধীরে দু’জনকে সোজা করে শুইয়ে দিল। তার পর নাক টিপে ধরল। চোখে ফুঁ দিল, এ সব অবস্থায় কী করতে হবে, তা জানা না থাকায় এবং কাছে হোমিওপ্যাথির ওষুধও নেই বলে সে দু’জনকে একটু কাতুকুতুও দিয়ে দেখল।

কয়েক মিনিট পরে প্রথমে চোখ মেলল অনু। “অনু, ভয় পেয়ো না। আমি নবীনদা।”

“নবীনদা, বিলু কোথায়?”

“এই তো! ভয় নেই, এখনই জ্ঞান ফিরবে। তোমার তেমন চোট লাগেনি তো?”

অনু একটু হাত-পা নাড়া দিয়ে বলল, “ডান হাতটায় ব্যথা লেগেছে। মাথাতেও। তবে তেমন কিছু নয়।”

একটু বাদেই বিলুও বড় করে শ্বাস ছেড়ে হঠাৎ কেঁদে উঠল, “দিদি! দিদি!”

অনু তার ভাইকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, “এই তো আমি। তোর তেমন ব্যথা লাগেনি তো? এই দ্যাখ, নবীনদা এসেছে।”

বিলু কান্না থামিয়ে নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “নবীনদা, তুমি কী করে বুঝলে যে, আমরা এখানে পড়ে গেছি?”

“সে অনেক কথা। কিন্তু আপাতত এখান থেকে বেরোবার উপায় করতে হবে।”

নবীন চার দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল। ইদারার দেওয়ালে পুরু শ্যাওলা জমে আছে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নানা আকারের শামুক। ফটফট করে ব্যাং ডাকছে। একটা কাঁকড়া বিছেকেও দেখা গেল টুক করে গর্তে ঢুকে যেতে। ইদারার মাঝখানটায় মেলা গাছপালা থাকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আর ইদারাটা তলার দিকে আরও অনেক বড়। প্রায় একটা হলঘরের মতো।

নীচে কাদা থাকায়, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল তিনজনকে।

অনু বলল, “নবীনদা, এখান থেকে বেরোনোর তো আর উপায় নেই। লতা-পাতা বেয়েই উঠতে হবে..”

বিলু বলল, “আমার কনুইতে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। আমি লতা বেয়ে উঠতে পারব না।”

নবীন একটু হেসে বলল, “ঘাবড়িও না। এখান থেকে বেরোনোর কোনও একটা উপায় হবেই। কিন্তু আমি বারণ করা সত্ত্বেও তোমরা জঙ্গলে এসে ভাল কাজ করোনি। যে অবস্থায় পড়েছিলে, তাতে ভাল-মন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারত।”

অনু একটু লজ্জিত হয়ে বলল, “আমরা ভেবেছিলাম, তুমি আমাদের ছেলেমানুষ ভেবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছ।”

“তোমরা তো ছেলেমানুষই। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে। এখন দেখা যাক, আমাদের ভাগ্যটা কেমন।”

তারা ইদারাটার চারধারে বার-দুই চক্কর দিল। দেওয়ালে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না।

নবীন দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “অঘোরবাবা বলেছিলেন, চাঁপাকুঞ্জের তলাটা ফাঁপা। যদি সেকথা সত্যি হয়ে থাকে, তবে একটা পথ পাওয়া যাবেই।”

লাঠিটা দিয়ে নবীন ইদারার গায়ে ঘা মারতে লাগল ফাঁপা শব্দ শোনার জন্য। কিন্তু পাথরের গায়ে তেমন কোনও শব্দ পাওয়া গেল না।

বিলু একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। বলল, “ইশ, সত্যিই যদি একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়, তা হলে কী দারুণ ব্যাপার হবে!”

তিনজনেই কাদায় মাখামাখি হয়েছে। জুতোয় কাদা ঢুকে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। হাঁটাই শক্ত। বিলুর খিদে পেয়েছিল অনেক আগেই। এখন তেষ্টাও পেয়েছে।

হঠাৎ বিলুই চেঁচিয়ে বলল, “নবীনদা, দ্যাখো ওটা কী?”

টর্চের আলোয় একটা মস্ত ছুঁচোকে দেখে নবীন হেসে বলল, “ভয় পেয়ো না। ছুঁচো।”

বিলু বলল, “ভয় পাচ্ছি না। ছুঁচোটাকে ফলো করলেই বোঝা যাবে কোনও গর্ত আছে কি না।”

ছুঁচোটা ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিল। কিন্তু আরও দু’ একটাকে দেখা গেল, এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে।

বিলু চেঁচিয়ে উঠল, “নবীনদা! ওই যে! ওখানে একটা ছুঁচো ঢুকে গেল!”

নবীন জায়গাটা লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে আগাছা সরাতেই দেখতে পেল একটা গর্ত। গর্তটা বাস্তবিকই বেশ বড়। পাথরের জোড়ে একটা ফাটল। আগাছায় ঢেকে ছিল।

নবীন গর্তের মুখে লাঠিটা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল। ভয় হল, বেশি চাপ দিলে যদি লাঠি ভৈঙে যায়!

নবীনের কানে কানে কে যেন বলে উঠল, “লাঠি ভাঙবে না। লাঠিতে আমি ভর করে আছি।”

নবীন প্রাণপণে চাপ দিতে লাগল। আর খুব ধীরে-ধীরে পাথরটা সরতে লাগল। তার পর হঠাৎ খাঁজ থেকে খসে চৌকো পাথরটা ধপাস করে পড়ে গেল কাদার মধ্যে।

পাথরের পিছনে যে রন্ধ্র-পথটা উন্মোচিত হল, তা সঙ্কীর্ণ বটে, কিন্তু হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়।

বিলু হাততালি দিয়ে চেঁচাল, “হুঁররে!” বিলুর চিৎকারের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আচমকা ওপরে ইদারার মুখ থেকে একটা ভীষণ শব্দ এল। দুম। ইদারার পরিসরে এবং গভীরে সেই শব্দ বোমার মতো ফেটে পড়ল। আর সেই সঙ্গে একটা আগুনের ফুলকির মতো কী একটা যেন ঝিং করে এসে বিধল ইদারার পাথরে।

তিনজনেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনায়।

অনু বলল, “কেউ আমাদের তাক করে গুলি চালিয়েছে।” কথাটা শেষ হতে-না-হতেই ওপর থেকে পর পর কয়েকটা গুলির শব্দ হল! লতাপাতা ভেদ করে বিদ্যুৎ-গতিতে কয়েকটা বুলেট কাদায় গেঁথে গেল।

নবীন হ্যাঁচকা টানে অনু আর বিলুকে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “পালাও, ওরা নেমে আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পালাতে হবে।”

তিনজনে গর্তের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল। অনু টর্চ নিয়ে আগে-আগে। তার পর বিলু, সব শেষে নবীন।

নবীন বলল, “গর্তের মুখটা খোলা রইল। ওরা আমাদের সন্ধান ঠিকই পেয়ে যাবে।”

বিলু অবাক, গলায় বলল, “ওরা কারা নবীনদা? গুলি করছে কেন?”

নবীন চাপা গলায় বলল, “বুঝতে পারছি না। গতকাল এরাই বোধহয় সিদ্ধিনাথ আর ভুজঙ্গকে মেরেছিল। ওদের প্রাণে মারেনি, কিন্তু আমাদের হয়তো প্রাণে মারবে।”

“কেন নবীনদা? আমরা কী করেছি?”

“হয়তো না-জেনে এমন কিছু করে ফেলেছি, যাতে ওদের স্বার্থে ভীষণ ঘা লেগেছে।”

সুড়ঙ্গ-পথে হামাগুড়ি দিয়ে এখোনো মোটেই সহজ কাজ নয়। সুড়ঙ্গটা ভীষণ নোংরা। চোখে-মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে যাচ্ছে। হাত-পায়ের ওপর দিয়ে ইঁদুর আর ছুঁচো দৌড়ে যাচ্ছে বার বার। নীচে নুড়ি পাথরে বার বার হড়কে যাচ্ছে হাঁটু। ছড়ে কেটে যাচ্ছে হাতের তেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনজনেই হাঁপিয়ে পড়ল।

অনু জিজ্ঞেস করল, “একটু বসব নবীনদা?” নবীন তাড়া দিয়ে বলল, “বিশ্রাম পরে হবে। এখন প্রাণ বাঁচানোটা আগে দরকার।”

অনু সখেদে বলল, “নীচে পড়বার সময় আমার বন্দুকটা যে কোথায় ছিটকে পড়ল, কে জানে! বোধহয় কাদার মধ্যে তলিয়ে গেছে। বন্দুকটা থাকলে জবাব দিতে পারতাম।”

নবীন বলল, “বন্দুক থেকেও লাভ ছিল না। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এক্সপার্ট। চলো, এগোও।”

আবার তিনজনে হামাগুড়ি দিয়ে বদ্ধ গুহার মধ্যে এগোতে লাগল। চার দিকে সঁতসেঁতে। বাতাসে কেমন একটা গুমোট। পচা গন্ধও নাকে আসছে। মরা ইঁদুরই হবে।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, ক্রমেই সুড়ঙ্গটা ওপরে উঠছে। চড়াইতে উঠতে গিয়ে বিলু হড়কে গড়িয়ে পড়ল নীচে। তার ধাক্কায় অনু আর নবীনও। কিন্তু তার পরই ধুলো ঝেড়ে আবার উঠতে লাগল ওপরে।

পালাতেই হবে। পালাতেই হবে। চড়াইটা পার হয়ে ওপরে উঠতেই তিনজন অবাক।