ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৭. শুভ সন্দেশ

৭. শুভ সন্দেশ

স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্ষুদ্রক বলল, কুমার! তোমার ধনুর্বাণ কোথায় গেল? আমার ধনুক ও তুণ নদীর পাড়ে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম নদীগর্ভে বিপদগ্রস্ত এক রমণীকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু তোমার পিঠে ধনুক ও তুণ না থাকার কারণ কি? সঙ্গে ধনুর্বাণ থাকলে অনায়াসে বানবর্ষণ করে তুমি শত্রুদের তাড়িয়ে দিতে পারতে।

একহাতে ভারী চামড়ার থলেটি চেপে ধরে অপরহাতে সবেগে জলে টানতে টানতে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নিদ্রার আবেশ কেটে গেল প্রবল ক্ষুধার প্রকোপে। অতএব কিছু সুমিষ্ট ফলের সন্ধানে অরণ্যে প্রবেশ করলাম। গাছে উঠে যখন ফল সংগ্রহ করছি, সেই সময় গাছের তলায় আত্মপ্রকাশ করল এক মাংসলোপ ব্যাঘ্র! আমি গাছের উপর থেকে তীর ছুঁড়লাম। ধূর্ত শ্বাপদ সরে গিয়ে কয়েকটি তীরকে ব্যর্থ করে দিল, অন্যান্য তীরগুলো তার দেহে বিদ্ধ হলেও মর্মভেদ করতে পারল না। আমার তুণে যে কয়টি তীর ছিল, সবগুলোই তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লাম। আহত শার্দুল ধরাশায়ী হল না, তীরবিদ্ধ দেহে ছটফট করতে করতে বনের ভিতর প্রবেশ করল। আমি জানতাম তার মৃত্যু নিশ্চিত রক্তের চিহ্ন ধরে অনুসরণ করে তার দেহে বিদ্ধ তীরগুলোকে উদ্ধার করতে যাব, এমন সময়ে কানে ভেসে এল তোমার শিঙার সংতে। তারপর যা ঘটেছে তা তোমার অজানা নয়।

বুঝেছি, ক্ষুদ্রক বলল, কিন্তু কতক্ষণ এই ভয়ংকর স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে পারব জানি না। বোধহয় নদীগর্ভেই আজ আমার সলিলসমাধি ঘটবে। আমার হাত অবশ হয়ে আসছে, আমি আর পারব না, পারছি না…

তরঙ্গের পর তরঙ্গ আঘাত করছে, উচ্ছ্বাসিত জলরাশি সগর্জনে ডুবিয়ে দিতে চাইছে, ভাসিয়ে দিতে চাইছে তবু হার মানছে না ক্ষুদ্রক আচ্ছন্ন দৃষ্টি মেলে সে দেখতে পারছে তার প্রিয় নেতা তার পাশেই লড়াই করছে তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে কিন্তু আর বুঝি সে পারে না, ক্ষীণকণ্ঠে একবার কিছু বলেই সে তলিয়ে গেল..

মাথায় প্রচণ্ড আকর্ষণের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল ক্ষুদ্রক, কে যেন চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তুলল জলের উপর! সঙ্গেসঙ্গে তার আচ্ছন্ন চেতনায় আঘাত করল চন্দ্রগুপ্তের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, ক্ষুদ্রক! লড়াই করো, হাল ছেড়ে দিও না। আমরা যোদ্ধা- গ্রীক দস্যুদের শোণিতলোলুপ অসিকে আমরা ফাঁকি দিয়েছি, রাক্ষসী নদীর ক্ষুধার্ত তরঙ্গকেও আমরা পরাস্ত করতে পারব… মাভৈঃ! ক্ষুদ্রক!… হাত চালাও, আমরা পাড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি..

অবশেষে ক্ষুদ্রক শিলাকীর্ণ ভূমির কঠিন স্পর্শ অনুভব করল তার পায়ের তলায়। আচ্ছন্ন দৃষ্টি ক্রমে পরিষ্কার হতেই সে দেখতে পেল নদীর পাড়ের কাছে অগভীর জলে সে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছেন চন্দ্রগুপ্ত। হঠাৎ চন্দ্রগুপ্তের হাতের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল, কুমার! তোমার দেহের পেশি আর স্নায়ু নিশ্চয় লোহা দিয়ে তৈরি! ওই ভারী থলিটা নিয়ে একহাতে দুরন্ত স্রোত ঠেলে তুমি ছাড়া অন্য কোনো মানুষ বোধহয় এই ভয়ংকর নদী পার হতে পারত না।

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আমাদের এখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তুমি যখন বললে এই চামড়ার থলিটা স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ, তখন ওটাকে ফেলে যাওয়া অনুচিত বিবেচনা করলাম।

থলির মুখ একটু ফাঁক করে দেখে নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত সহাস্যে বললেন, হা, তোমার কথা সত্য বটে। প্রচুর স্বর্ণ আছে ওইখানে। কিন্তু এই থলিটি তুমি সংগ্রহ করলে কেমন করে?

বিদর্ভরাজ ও তার কন্যার সংবাদ সবিস্তারে পরিবেশন করল ক্ষুদ্রক, তারপর হৃষ্টচিত্তে বলল, এইবার আমরা স্বচ্ছন্দে আমাদের পরিকল্পিত গন্তব্য অর্থাৎ কাঞ্চনরাজ্য অভিমুখে পদচালনা করতে পারি। অবশ্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিয়ে আমি এক পাও চলতে পারব না।

শুষ্কস্বরে উত্তর এল, তাহলে চিরবিশ্রামের জন্য প্রস্তুত হও। সচমকে মুখ তুলে ক্ষুদ্রক দেখল চন্দ্রগুপ্তের মুখ পাথরের মতো জড়বৎ নিষ্প্রাণ! তিনি যেদিকে তাকিয়েছিলেন সেইদিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্রকের মুখও অন্ধকার হল– নদীর বুকে তিনটি ডিঙ্গি ভাসিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে একদল গ্রীকসৈন্য!

ক্ষুদ্রক বলল, কুমার! আমাকে এইখানে রেখে তুমি পালাও।

কঠোর হাস্য করে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ক্লান্ত ও অবসন্ন সঙ্গীকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পলায়নের শিক্ষা আমি পাই নি। প্রস্তুত হও ক্ষুদ্রক– আমরা মরব, কিন্তু মেরে মরব।

না, সুবন্ধু, পিছন থেকে ভেসে এল হাস্যতরল বামাকন্ঠ, তোমার বন্ধুরা তোমায় ভালোবাসে। এত শীঘ্র তারা তোমায় মরতে দেবে না।

সবিস্ময়ে পিছন ফিরে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ছায়া! বাহ্লিকরাজ্যের মহারাণী ছায়া!

হ্যাঁ, আমি, হাতের তরবারি আন্দোলিত করে আগের মতোই লঘুস্বরে মহারাণী বললেন, আমি যখন এসে পড়েছি, তখন মরার কথা ভুলে যাও সুবন্ধু।

চন্দ্রগুপ্তের মুখ আবার অন্ধকার হল, বজ্র আর ভানুকে তোমার কাছে আমি পাঠিয়েছিলাম। বুঝেছি, তাদের কাছে সংবাদ পেয়েই তুমি ছুটে এসেছ। আমি জানি অসিচালনায় তুমি বহু পুরুষযোদ্ধাকে লজ্জা দিতে পারো, কিন্তু বিশ-পঁচিশটি রণকুশল গ্রীকসৈন্যকে আমরা তিনজন মিলিত হয়েও পরাস্ত করতে পারব না

চন্দ্রগুপ্ত নদীবক্ষে অঙ্গুলিনির্দেশ করে মহারাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য! গ্রীকসেনাদের নৌকা তিনটি আর অগ্রসর হচ্ছে না!

ছায়া কলকণ্ঠে হেসে উঠলেন, ওদের আমি দেখেছি। ওরা আর এগিয়ে আসবে না। সুবন্ধু! তুমি এবার পিছন ফিরে তাকাও।

পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত দুর অরণ্য ভেদ করে দলে দলে এগিয়ে আসছে ভারতীয় সৈন্য! তাদের হাতে হাতে দুলছে আর উড়ছে অর্বুদরাজ্য ও বাহিকরাজ্যের পতাকা! আর্যশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্ধর্ষ অনার্যবাহিনী! চন্দ্রগুপ্ত বুঝলেন যথাসময়ে যথাস্থানে সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে বজ্র ও ভানু বিদ্রোহী মঘবার দুই বিশ্বস্ত অনুচর!

নদীর মাঝখানে তখন গ্রীকসৈন্যরা তিনটি নৌকো আবার ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে ওপারের দিকে। চন্দ্রগুপ্ত চিৎকার করে তাদের যুদ্ধে আহ্বান জানালেন। অরণ্যভেদ করে যে বিশাল শত্রুবাহিনী আত্মপ্রকাশ করেছে, তার সম্মুখীন হওয়া যে আত্মহত্যারই নামান্তর সেকথা বুঝতে তাদের কিছুমাত্র বিলম্ব হয়নি।

ছায়াকে সম্বোধন করে ক্ষুদ্রক বলল, মহারানী! আপনার আশ্চর্য বীরত্বের কথা আমরা কুমার চন্দ্রগুপ্তের কাছে শুনেছি। তবে কুমারকে আর ছদ্মনামে ডাকার দরকার নেই। গুপ্তঘাতকের দল আর কুমারের কেশস্পর্শ করতে পারবে না।

ছায়া ভ্রূ বাঁকিয়ে বললেন, চন্দ্রগুপ্ত! কে চন্দ্রগুপ্ত? চন্দ্রগুপ্ত নামে কোনো ব্যক্তিকে আমি চিনি না। আমার প্রিয় বন্ধুকে আমি চিরকাল সুবন্ধু বলেই ডাকব। কী বলল সুবন্ধু?

মহারাণী ছায়া! গভীর স্বরে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, তুমি যে নামে ডাকো সেই নামই আমার কানে সুধাবর্ষণ করে। কিন্তু এখন আমরা স্থানত্যাগ করব। সমগ্র ভারত আজ ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগ্রত করতে হবে। তোমার মতো বান্ধবী এবং শতানীক ক্ষুদ্রক, বজ্র, মঘবা প্রমুখ বীরের দল যার সহায়- গুরু বিষ্ণুগুপ্ত (চাণক্য) যার মন্ত্রণাদাতা- সে অসাধ্যসাধন করতে পারে। তুমি দেখে নিও ছায়া, আমার স্বপ্নকে আমি একদিন সফল করে তুলব। তোমদের স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা আর বীরত্ব একদিন খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারতকে অখণ্ড ভারতবর্ষে পরিণত করবে আগামী দিনের সেই সোনার ভারতের ছবি আমি মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

চন্দ্রগুপ্তের স্বপ্ন সফল হয়েছিল। সেদিনের সেই অখ্যাত যুবক কেমন করে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নামে খ্যাতিলাভ করেছিলেন, কেমন করে স্থাপন করেছিলেন মৌর্যবংশ এবং ঐক্যবদ্ধ ভারতের বুক থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রীকবাহিনীকে সেকথা লেখা আছে ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে, আমাদের কাহিনি এখানেই শেষ।