৭. বৃত্ত

৭. বৃত্ত

রিহান মোটরবাইকটি নিয়ে পাথুরে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। মরুভূমির উত্তপ্ত বাতাসের হলকা চোখে–মুখে এসে লাগছে, ম্যাপ অনুযায়ী সামনে একটা উঁচু পাহাড় আসবে সেটা ঘুরে ডান দিকে যেতে হবে। কমিউনগুলো কোথায় সেটা সে কনট্যুর মেপে বসিয়ে নিয়েছে, একটার পর আরেকটা কমিউন খুঁজে খুঁজে যেতে হবে।

মোটরবাইকে ছুটে যেতে যেতে রিহান বুঝতে পারে কিছু একটা ব্যাপার তাকে খানিকটা বিচলিত করে রেখেছে কিন্তু সেটি কী সে ঠিক ধরতে পারছে না। যাকে সবাই ঈশ্বরী প্রিমা হিসেবে জানে সে যে খুব দুঃখী অসহায় বাচ্চা একটি মেয়ে সেটি রিহান ছাড়া আর কেউ জানে না। এই মুহূর্তে সে মাথা থেকে সেটি সরিয়ে রেখেছে। সে যখন প্রভু ক্লডের

কমিউনে হাজির হবে তখন তাকে যে হত্যা করা হবে কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে সেটাও তাকে সেরকম বিচলিত করছে না। একটু আগে সবাই মিলে তাকে যেভাবে অপমান এবং লাঞ্ছনা করেছে সেই গ্লানিটুকুও এই মুহূর্তে তার মাথার মাঝে নেই। সবকিছু ছাপিয়ে অন্য একটি বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটেছে বলে তার মনে হচ্ছে কিন্তু সেটা কী রিহান ঠিক ধরতে পারছে না। তার পকেটে রাখা ম্যাপের মাঝেই বিস্ময়টুকু লুকানো আছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে কিন্তু সেটি কোথায় ঠিক বুঝতে পারছে না। রিহান অন্যমনস্কভাবে মোটরবাইকটি ছুটিয়ে নিতে নিতে পাহাড়ের ঢালে একটা ছায়া ঢাকা জায়গা দেখে থেমে গেল। কোমরে ঝোলানো পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে সে পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে আবার সেই ম্যাপের দিকে তাকাল। বেশ বড় একটি নিখুঁত কনট্র্যর ম্যাপ, এই পুরো এলাকাটি খুব চমৎকারভাবে দেখানো রয়েছে। রওনা দেবার আগে সে বেশ কয়েকটি কমিউনের অবস্থান ম্যাপের মাঝে বসিয়ে নিয়েছে, মোটামুটি আধবৃত্তাকারভাবে ছড়িয়ে আছে। রিহান কিছুক্ষণ ম্যাপটির দিকে তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে অন্য কমিউনের অবস্থানগুলো বের করে ম্যাপের মাঝে বসাতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিহান তার। বিস্ময়ের কারণটুকু বুঝতে পারে। সবগুলো কমিউনের অবস্থান একটা নিখুঁত বৃত্তের উপর। কী আশ্চর্য!

রিহান হতচকিত হয়ে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকে, এটি কেমন করে সম্ভব? একটি কমিউন কিছুক্ষণ এক জায়গায় থেকে স্থান বদল করে অন্য জায়গায় যায়। সব সময়েই সবাই ভেবে এসেছে এই স্থান বদলগুলোতে কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু সেটা সত্যি নয় তারা নিখুঁত একটা বৃত্তের উপর থাকে। রিহান তার হাতের তালিকাটি দেখল, বিভিন্ন কমিউন আগে কোথায় ছিল সেগুলোও এখানে দেওয়া আছে। রিহান ধৈর্য ধরে সেগুলোও ম্যাপে বসাতে থাকে এবং বিস্মিত হয়ে দেখে সেগুলোও এই বৃত্তের মাঝে! কখনোই বৃত্তের বাইরে নয়। যার অর্থ গত অর্ধশতাব্দী থেকে সবগুলো কমিউন বৃত্তাকারে ঘুরছে। কী আশ্চর্য!

রিহান ম্যাপটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বুঝতে পারে এটি বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা নয়, এবং হঠাৎ করে এটি ঘটে নি এর পেছনে একটা কারণ আছে। রিহানকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু সে জানে কারণটি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। রিহান আকাশের দিকে তাকাল, সূর্যটা ঢলে পড়তে শুরু করেছে। বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছাতে হলে তার এখনই আবার রওনা দেওয়া উচিত, কিন্তু এই বিচিত্র রহস্যটির একটা কিনারা না করে সে কেমন করে যাবে? সে তো এ জীবনে আর কখনো এই রহস্যটি সমাধান করতে পারবে না।

রিহান আবার ম্যাপের দিকে তাকাল, এই এলাকায় অসংখ্য কমিউনের মানুষেরা জানে না তারা একটি বিশাল বৃত্তের পরিধি বরাবর ঘুরছে। সেই বৃত্তটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তার মনে হল এই বৃত্তটির একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র রয়েছে, আর সেই কেন্দ্রটিতেই নিশ্চয়ই রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। কমিউনের সব মানুষ যে কেন্দ্রটিকে নিয়ে ঘুরছে সেই কেন্দ্রটি নিশ্চয়ই সাধারণ জায়গা নয়–নিশ্চয়ই সেটি একটি অসাধারণ জায়গা, নিশ্চয়ই এই জায়গাটির একটা অস্বাভাবিক গুরুত্ব আছে।

রিহান ম্যাপটির ওপর ঝুঁকে পড়ল, বৃত্তের পরিধিকে সমান দুভাগে ভঁজ করে বৃত্তের একটা ব্যাস বের করে নেয়। দ্বিতীয়বার অন্য একটি অংশে ভাঁজ করে দ্বিতীয় একটা ব্যাস বের করে নেওয়ার সাথে সাথে দুটি ব্যাসের সংযোগস্থলে বৃত্তের কেন্দ্রটি বের করে ফেলল। কেন্দ্রটি পড়েছে সামনে যে পাহাড়ের সারি আছে তার ভেতরে কোনো একটি ছোট পাহাড়ের উপর। আলাদা করে সেটিকে বোঝার কোনো উপায় নেই, এর কোনো বিশেষত্ব আছে সেটাও বোঝার উপায় নেই, শুধুমাত্র এই ম্যাপটির দিকে তাকালে এই জায়গাটার গুরুত্বটা ভয়ানকভাবে চোখে পড়ে।

রিহান ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রাখে, তাকে এই জায়গাটি আগে খুঁজে বের করতে হবে, এই রহস্যের সমাধান না করে সে মারা যেতে পারবে না।

ঘণ্টাখানেক মোটরবাইকে গিয়ে রিহান পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছাল, এখান থেকে বাকিটা তার হেঁটে যেতে হবে। এবড়োখেবড়ো পাথরে পা দিয়ে সে পাহাড়ে উঠতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে গরমে ঘেমে ওঠে। পানির বোতলে পানি কমে আসছে। সে সাবধানে দুই এক চুমুক খেয়ে বাকি পানিটুকু বাচিয়ে রাখতে চেষ্টা করল, তাকে কতদূর যেতে হবে কে জানে। ঘণ্টাখানেক উপরে উঠে সে তার ম্যাপটি খুলে তাকাল, পথ ভুলে সে অন্য কোনোদিকে চলে যাচ্ছে না এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্যে। কনট্র ম্যাপে দেখানো আছে সামনে একটা ছোট পাহাড় ডান দিকে খাড়া নেমে যাবার কথা, রিহান তাকিয়ে সামনের ছোট পাহাড় এবং ডান দিকে খাড়া ঢালুটি দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল। সামনের ছোট পাহাড়টি পার হবার পর একটা ঢালু জায়গা থাকার কথা, তারপর হঠাৎ খাড়া উপরে উঠে গেছে, সেই খাড়া বেয়ে উঠে গেলেই নির্দিষ্ট জায়গাটা পেয়ে যাবে। রিহান সূর্যের দিকে তাকাল, যদি কোনো ঝামেলা না হয় সূর্য ডুবে যাবার আগেই সে সেই রহস্যময় জায়গায় পৌঁছে যাবে।

রিহানের হঠাৎ একটা বিচিত্র কথা মনে হল, এমন যদি হয় যে সে গিয়ে দেখে যে জায়গাটি এই বিচিত্র বৃত্তের কেন্দ্র সেটি আসলে পুরোপুরি বিশেষত্বহীন একটা জায়গা তা হলে কী হবে? রিহান জোর করে চিন্তাটি মাথা থেকে সরিয়ে দেয়–এটি হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত রিহান যখন নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছে তখন সে কুলকুল করে ঘামছে। পাহাড়ের উপরে বেশ খানিকটা জায়গা তুলনামূলকভাবে সমতল, রিহান সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে ঘুরে তাকাল। অনেকটুকু উপরে উঠে এসেছে, সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ে দূরে মরুভূমির এই এলাকাটিতে এক ধরনের লালচে আভা, হঠাৎ দেখে মনে হয় এটি বুঝি পৃথিবীর কোনো অংশ নয়–মনে হয় এটি কোনো পরাবাস্তব জগতের অংশ। রিহান পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে শুরু করে। তার ভেতরে এক ধরনের আশা ছিল যে এখানে সে কোনো একটা ঘর বা দালান দেখবে, কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নেই। সে প্রায় আশা হারিয়ে ফেলছিল কিন্তু হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল জায়গাটি আসলে বৈশিষ্ট্যহীন নয়, এর একটা বৈশিষ্ট্য আছে–জায়গাটি তুলনামূলকভাবে সমতল এবং হঠাৎ করে প্রকৃতিতে এত বড় সমতল আর মসৃণ জায়গা পাওয়া যায় না। শুধু যে সমতল তাই নয়, জায়গাটি বৃত্তাকার, মনে হয় বেশ যত্ন করে এই অংশটুকু এভাবে তৈরি করা হয়েছে।

রিহান বৃত্তাকার জায়গাটির ঠিক মাঝামাঝি জায়গাটুকু খুঁজে বের করে নিচে তাকাল এবং হঠাৎ করে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সেখানে একটা গোলাকার ধাতব ঢাকনা। রিহান উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কোনোভাবে ধাতব অংশটুকু টেনে তোলা যায় কি না চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু মসৃণ ধাতব অংশটুকু পাথরের সাথে মিশে আছে, এটাকে টেনে তোলার কোনো উপায় নেই। রিহান তখন ধাতব অংশটিতে হাত দিয়ে থাবা দিল সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো একটা শব্দ ভেসে এল। রিহান নিশ্বাস বন্ধ করে আবার একবার থাবা দিতেই আবার প্রতিধ্বনির মতো শব্দটি শোনা গেল। রিহান এবারে দ্রুত দুবার থাবা দেয় সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ শোনা যায় এবারে শব্দটি আসে চারবার। রিহান নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে সে সত্যি সত্যিই রহস্যময় জায়গাটি খুঁজে পেয়েছে। সে এবারে তিনবার থাবা দিল সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো শব্দ আসতে থাকে পরপর নয়বার শব্দ হয়ে থেমে গেল। সে যতবার শব্দ করছে তার বর্গ সংখ্যক শব্দ ফিরে আসছে। ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সে চারবার শব্দ করল, ভেতর থেকে এবার যোলবার প্রতিধ্বনি ফিরে আসার কথা। সত্যি সত্যি মোলবার প্রতিধ্বনি ফিরে এল। রিহান নিজের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে, এই রহস্যময় জায়গাটির সাথে যোগাযোগ করার একটি পথ হয়তো সে খুঁজে পাবে। কী করবে যখন ঠিক করতে পারছে তখন হঠাৎ করে ভেতর থেকে একবার শব্দ ভেসে এলএবার তাকে কেউ পরীক্ষা করছে। রিহান পাল্টা একবার শব্দ করল। ভেতর থেকে এবার দুবার শব্দ হল, রিহান দুয়ের। বর্গ চারবার শব্দ করল। ভেতরে কী আছে সে জানে না, কিন্তু সেটি এবারে তিনটি শব্দ করল। রিহান গুনে গুনে নয়বার শব্দ করল। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, এবারে ভেতর থেকে চারটি শব্দ হল, রিহান গুনে গুনে পাল্টা ষোলটি শব্দ করল।

সাথে সাথে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকে, পুরো এলাকাটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। রিহান চমকে উঠে দাঁড়ায় তারপর লাফ দিয়ে পিছনে সরে যায়। সে বিস্ফারিত চোখে দেখে পাথরের মাঝখান একটা চতুষ্কোণ জায়গা যেন ফেটে বের হয়ে উঠে আসতে শুরু করেছে। ভোঁতা একটা শব্দ করে এক মানুষ উঁচু একটা চতুষ্কোণ ধাতব অংশ বের হয়ে হঠাৎ করে থেমে যায়। রিহান নিঃশব্দে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে ঢোকার কোনো জায়গা আছে কি? রিহান চারপাশে একবার ঘুরে দেখল, কোনো দরজা নেই, কিন্তু এক পাশে একটা সবুজ বোতাম। খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে বোতামটা স্পর্শ করে। কিছু হল। না দেখে বোতামটা চাপ দিল সাথে সাথে একটা যান্ত্রিক শব্দ করে তার সামনে একটা দরজা খুলে গেল, ভেতরে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।

রিহান একটা নিশ্বাস ফেলল, ঠিক কেন জানা নেই হঠাৎ কৌতূহল ছাপিয়ে তার ভেতরে একটা চাপা ভয় উঁকি দেয়। কী আছে ভিতরে? সে যদি ভেতরে আটকা পড়ে যায়, যদি আর কোনোদিন বের হতে না পারে? সে যে সবাইকে কথা দিয়ে এসেছে প্রভু ক্লডের কাছে ধরা দিয়ে ঈশ্বরী প্রিমাকে মুক্ত করে আনবে?

মাথা থেকে সব চিন্তা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রিহান ধীরে ধীরে সিঁড়িতে পা দিলে সাথে সাথে পেছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। সে কি আর কখনো বের হতে পারবে? রিহান একমুহূর্ত অপেক্ষা করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। প্রায় চল্লিশটি ধাপ নিচে একটা চতুষ্কোণ জায়গা। একপাশে অধস্বচ্ছ কাচের দরজা। ভেতর থেকে হালকা নীলাভ আলো বের হয়ে আসছে। রিহান কান পেতে শুনল খুব হালকা এক ধরনের যান্ত্রিক গুঞ্জন, এ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সে সাহস সঞ্চয় করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঠল। বড় একটি ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ার, চেয়ারে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে আছে। রিহানকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে মানুষটি মাথা তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস কল, কে?

ভয়ংকর আতঙ্কে রিহান ছুটে বের হয়ে যাচ্ছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

মানুষটি তাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে উঠে দাঁড়াল, তারপর দুই পা এগিয়ে এসে সহৃদয়ভাবে বলল, এস, ভেতরে এস।

রিহান অনেক কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করে ভেতরে ঢুকল। মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী ছেলে?

রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, রিহান।

রিহান?

হ্যাঁ।

চমৎকার। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি রিহান। আমি তোমার জন্যে দুই শ তিরিশ বছর থেকে এই চেয়ারে বসে আছি।

রিহান একটা আর্ত শব্দ করে বলল, দুই শ তিরিশ বছর?

হ্যাঁ। আমার জন্যে সেটি কোনো সমস্যা নয়। কারণ আমি সত্য মানুষ নই। আমি একটা হলোগ্রাফিক ছবি। মানুষটি হাত তুলে দুই পাশে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখো দুই পাশ থেকে লেজারের আলো এসে সুষম উপস্থাপন করে আমাকে তৈরি করেছে।

রিহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, যে মানুষ নিজে দাবি করছে সে সত্যি নয় তার সাথে কথা বলা যায় কি না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।

হলোগ্রাফিক মানুষটি বলল, তুমি খুব অবাক হচ্ছ? আমার হিসাব অনুযায়ী তোমার অবাক হবার কথা। আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার খোলাখুলি কথা বলা দরকার।

রিহান তবু কোনো কথা বলল না। হলোগ্রাফিক মানুষটি একটু হেসে বলল, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই রিহান। তুমি এখানে খুব নিরাপদ। আমি সবকিছু জানি, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।

আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

হ্যাঁ। রিহান তুমি এই চেয়ারটায় বসো। হলোগ্রাফিক মানুষটা ঘরের অন্যপাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে পার।

রিহান তবু দাঁড়িয়ে রইল। হলোগ্রাফিক মানুষটি বলল, এস রিহান। তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার।

রিহান সাবধানে হেঁটে হলোগ্রাফিক মানুষটার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল, দেখল সত্যিই সেখানে কিছু নেই, তার হাতে শুধু রঙিন আলো এসে পড়ছে।

মানুষটি হেসে বলল, দেখেছ? ভয়ের কিছু নেই। যাও, তুমি গিয়ে বস।

রিহান জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?

আমি তোমাকে বলব। এর মাঝে অলৌকিক কিছু নেই–এটি বিজ্ঞানের ব্যাপার। সহজ বিজ্ঞান। এস।

রিহান সত্যি সত্যি মানুষটার ভেতর দিয়ে হেঁটে ঘরের অন্যপাশে একটা চেয়ারে বসল। এখনো পুরো ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। মানুষটি তার সামনে একটা চেয়ারে বসে কথা বলতে শুরু করে।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল দুই শ তিরিশ বছর আগে। পৃথিবীতে তখন ছয় বিলিয়ন মানুষ, ইকুয়িনা নামে ভয়ংকর একটা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সব মানুষ কয়েক সপ্তাহের মাঝে মরে শেষ হয়ে গেল। ভাইরাসের সংক্রমণ হবার পর মারা যেতে দুই সপ্তাহের মতো সময় নেয়। পৃথিবীর কিছু বিজ্ঞানী তাদের জীবনের শেষ দুই সপ্তাহের সময়ে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে এটা তৈরি করে গিয়েছিলেন।

এই প্রজেক্টটি তৈরি করা হয়েছিল আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ ভ্রমণের জন্যে। মানুষ যখন আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণে যাবে সেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যেতে পারে। এই দীর্ঘ সময়ে কী হবে কেউ জানে না, বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা থাকলে ভালো কিন্তু কোনো কারণে সেই মহাকাশচারীরা যদি নিজেরা যুদ্ধবিগ্রহ করে মারা যায়, যদি শুধু কিছু ছোট শিশু বেঁচে থাকে তখন কী হবে? তারা বড় হয়ে পৃথিবীর এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছুই পাবে, নিঃসঙ্গ একটি মহাকাশযানে বিচিত্র একটি পরিবেশে বড় হবে। পৃথিবীর পুরো জ্ঞানভাণ্ডার কি আবার গোড়া থেকে আবিষ্কার করতে হবে? সেটি তো হতে পারে না। এ ধরনের। পরিবেশে সেই শিশুদের সাহায্য করার জন্যে আমাদের তৈরি করা হয়েছে।

হলোগ্রাফিক মানুষটি তার চারপাশে দেখিয়ে বলল, এখানে যে যন্ত্রটি আছে প্রাথমিকভাবে এটাকে বলা হত কম্পিউটার। বিংশ শতাব্দী থেকে এটা তৈরি শুরু হয়, প্রতি বছর এর ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যেতে রু করল। একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম মানুষের সমান ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করা হল। তারপর আরো এক শতাব্দী কেটে গেল, পৃথিবীর বুকে এমন কম্পিউটার তৈরি হল যা মানুষের পুরো সভ্যতাকে নিজের ভেতরে ধরে রাখতে পারে। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও সেই কম্পিউটার ধ্বংস করা যাবে না, সাইক্লোন টাইফুন ভূমিকম্প তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা তার জন্যে এমন ইন্টারফেস তৈরি করা হল যেটি যে কোনো মানুষের যে কোনো ধরনের বুদ্ধিমত্তায় কাজ করতে পারে। কেন জান?

কেন?

হলোগ্রাফিক মানুষটা নিজেকে দেখিয়ে বলল, কারণ ইন্টারফেসটা এরকম। একজন সহৃদয় মানুষ কথা বলছে। যে কোনো ভাষায় যে কোনো পরিবেশে। যে কোনো মানুষের। সাথে! যে কোনো বিষয়ে।

যাই হোক, তোমাকে যেটা বলছিলাম–দুই শ তিরিশ বছর আগে যখন পৃথিবীর সব মানুষ ইকুয়িনা ভাইরাসে মারা যেতে শুরু করেছিল, তখন কিছু বিজ্ঞানী তাদের জীবনের শেষ দুই সপ্তাহে পৃথিবীর পুরো সভ্যতা, পুরো জ্ঞানবিজ্ঞান ঢুকিয়ে এই পাহাড়ের মাঝে রেখে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলে তো হবে না, যদি কিছু মানুষ বেঁচে যায় তাদেরকে এর কাছে। আনতে হবে, এটি দিয়ে পৃথিবীর লক্ষকোটি বছরের জ্ঞানবিজ্ঞান সভ্যতা শিক্ষা দিতে হবে। সেটা করবেন কী দিয়ে? কেউ কি বেঁচে থাকবে শেষ পর্যন্ত?

বিজ্ঞানীরা কিছু জানতেন না। তাই সারা পৃথিবীতে অসংখ্য যোগাযোগ মডিউল ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। উপগ্রহ ব্যবহার করে সেগুলো সারা পৃথিবী থেকে সরাসরি এখানে যোগাযোগ করতে পারত। ছোট চৌকোনা বাক্সে একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু ছবি! প্রথম কয়েক মাস কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর হঠাৎ করে এই ইন্টারফেসে যোগাযোগ। হতে শুরু করল–আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যারা যোগাযোগ করছে তারা ছোট ঘোট শিশু!

আমরা সেই যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করে তাদের সাথে কথা বলতাম, তাদের সান্তনা দিতাম, সাহস দিতাম। বিপদে সাহায্য করতাম। ধীরে ধীরে শিশুগুলো বড় হতে লাগল, তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব জন্ম হতে শুরু করল, দেখতে পেলাম তারা নিজেদের মাঝে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করছে। তুচ্ছ কারণে খুনোখুনি শুরু করছে। তাদেরকে যে আবার সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে সেটা তারা জানে না, সেটা তারা বুঝতে পারছে না।

তখন ধীরে ধীরে সেখানে নেতৃত্ব গড়ে উঠতে শুরু করল, পুরো দলের ভেতর সবচেয়ে যে কর্মক্ষম মানুষ সে পুরো দলটির দায়িত্ব নিতে শুরু করল, দলের মাঝে শৃঙ্খলা ফিলে এল! দলগুলো তখন গুছিয়ে নিয়েছে, বেঁচে থাকার নিয়মগুলো ধরে ফেলেছে। সারা পৃথিবীতে ছয় বিলিয়ন মানুষের সম্পদ ব্যবহার করছে কয়েক হাজার মানুষ তাদের প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই।

দেখতে দেখতে এই নেতৃত্ব তখন একটি ভিন্ন ধরনে পাল্টে যেতে রু করল। একটি দলে বা একটি কমিউনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলের এই হলোগ্রাফিক ইন্টারফেস। দলের নেতারা সেই ইন্টারফেসটা নিজেদের মাঝে কুক্ষিগত করে ফেলল। বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে জরুরি জিনিস হচ্ছে তথ্য, সেই তথ্যটি পেতে পারে শুধুমাত্র দলের নেতা। কাজেই যারা নেতা তাদের ক্ষমতা আকাশচুম্বী হতে রু করল। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করে দিল।

আগে নেতৃত্ব দিত যারা সত্যিকারের নেতা তারা। একবার নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করার পর সেই ব্যাপারটি আর তা থাকল না–একজন ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে কে হবে পরের ঈশ্বর। নেতৃত্ব আসতে শুরু করল অযোগ্য মানুষের ওপর। মানুষের সমাজে কমিউনগুলোতে তখন সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে প্রু করল, স্বার্থপর হয়ে যেতে লাগল।

আমরা ইচ্ছে করলে সে জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারতাম কিন্তু করি নি। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছি। তবে একটা ব্যাপার করেছি। পৃথিবীর যত মানুষের যত দল আছে, যত কমিউন আছে তাদেরকে ধীরে ধীরে এই এলাকায় নিয়ে আসতে শুরু করেছি। ধীরে ধীরে তারা এখানে এসে জড়ো হয়েছে।

রিহান জিজ্ঞেস করল, তাদেরকে কীভাবে এখানে এনেছ?

হলোগ্রাফিক মানুষটি হেসে বলল, যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল করে দিতাম, ভালো সিগন্যালের জন্যে ছোটাছুটি করত– যেখানে আনতে চাই সেখানে আসার পর পুরো সিগন্যাল পাঠাতাম।

ঈশ্বরেরা কিছু বুঝতে পারত না?

না। তারা জানে পুরো ব্যাপারটা ঐশ্বরিক। পুরো ব্যাপারটা অলৌকিক।

রিহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তা হলে ঠিকই অনুমান করেছিলাম।

হ্যাঁ। তুমি ঠিকই অনুমান করেছিলে। আমরা তোমার মতো একজন মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যে নূতন করে নেতৃত্ব নেবে। সার্বিকভাবে নেতৃত্ব নেবে।

নেতৃত্ব? রিহান অবাক হয়ে হলোগ্রাফিক মানুষটির দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। নেতৃত্ব।

আমি নেতৃত্ব দেব?

হ্যাঁ। তুমি নেতৃত্ব দেবে। যে মানুষ আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে সে হচ্ছে সঠিক মানুষ।

না।

হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে বলল, না!

আমি তো নেতৃত্ব দিতে আসি নি।

তুমি কেন এসেছ?

আমি একটা মেয়েকে উদ্ধার করতে এসেছি। মেয়েটির নাম প্রিমা। বাচ্চা একটি মেয়ে, অসহায় দুঃখী একটা মেয়ে। তাকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেছে।

হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান মানুষটির দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, আমার এখন নিজেকে ধরা দিতে হবে। নিজেকে ধরা দিয়ে প্রিমাকে মুক্ত করতে হবে।

হলোগ্রাফিক মানুষটি তখনো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল, তারপর সোজা হয়ে বসে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

মানুষটি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি কী রকম সাহায্য চাও রিহান? এখানে সবকিছু আছে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার মানুষের জন্যে এখানে রাখা আছে। বলো তুমি কী চাও? বলো–

রিহানকে কেমন জানি অপ্রস্তুত দেখাল, সে নিচু গলায় বলল, আমাকে কিছু খেতে দিতে পারবে? খুব খিদে লেগেছে–সারা দিন কিছু খাই নি আমি।