বাড়ি ঢুকে গৌর একটু অবাক হয়ে দেখল দাদার ঘরের দাওয়ায় হ্যারিকেন জ্বলছে। দাদা আর বউদি বসে বসে মশা তাড়াচ্ছে। প্রথমে গৌর ভেবেছিল রাত হয়েছে, বোধহয় তার জন্যেই উদবেগে দাদা বউদি বসে আছে বারান্দায়। কথাটা ভেবে গৌর একটু খুশিই হয়েছিল। কিন্তু নিতাইগোপালের কথায় গৌরের ভুল ভাঙল।
গৌরকে দেখে নিতাই বলল, “কে রে, গৌর এলি নাকি?”
“হ্যাঁ দাদা।”
“তোর মাউ আর খাউদাদাকে দেখেছিস? তারা এখনও ফেরেনি।”
“তারা তো ন’পাড়ায় কাবাডি খেলতে গিয়েছিল।”
নিতাই ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, “সে-খবর শুনেছি। বেকায়দায় পেয়ে তুমি তাদের হেনস্থাও করেছ, কিন্তু তোমার বিচার পরে। তারা গেল কোথায়?”
“আমি তো তা জানি না।”
গৌরের বউদি কান্নাজড়ানো খনখনে গলায় বলল, “তা জানবে কেন? খেয়ে খেয়ে গতর হয়েছে, আমার ভাই দুটো খেলতে গিয়েছিল, ধরে সবাই মিলে মেরেছ, লজ্জা করে না? এখন সত্যি করে বলল, তাদের কী হয়েছে। মেরে পাঁকে পুঁতেচুঁতে দিয়ে আসোনি তো?”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “আমি মারব কেন?”
বউদিফুঁসে উঠে বলল, “কেন মারবে তা জানো না? দিনরাত তো হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছ! চোর গোবিন্দ, বুড়ো কবরেজ আর ভণ্ড ফকিরটার সঙ্গে সাঁট করে ওদের সরানোরও মতলব করেছ, সব জানি। ওরা নিজেরাই আমাকে বলেছে। এই বলে রাখছি, আমার ভাইরা যদি না ফেরে, তা হলে তোমাকে আঁশবটি দিয়ে আমি দু’খানা করে কাটব।”
নিত্যগোপালও রাগের গলায় বলল, “তোমার ব্যবহারে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। আবার সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ! লজ্জা করে না। মাউ আর খাউ কী এমন দোষ করেছিল যে, সবাই মিলে ওদের ওরকম মারধর করলে?”
গৌর এত অবাক জীবনে হয়নি। কিছুক্ষণ সে কথাই বলতে পারল না, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ওদের মেরেছি কে বলল?”
“বলবে আবার কে! গাঁয়ের লোকেরাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে গেছে। খেলতে একটু গুতোণ্ঠতি হয়েই থাকে। না হয় তোমাকে একটু ধাক্কাধাক্কিই করেছে তা বলে হাত ভেঙে দেওয়া! ছি!”
“গাঁয়ের লোক কী বলল? তারা কি বলল দোষটা আমার?”
বউদি খনখনে গলায় বলে ওঠে, “তা বলবে কেন? আমার ভাই দুটো এ-গাঁয়ে আছে বলে সকলেরই চোখ টাটায়। সব শত্রু! কী হিহি করে হাসি সকলের! আমার ভাইয়ের হাত ভাঙায় কী আহ্লাদ তাদের! গৌর ভারী বীরত্বের কাজ করেছে তো! কুটুম-মানুষের হাত ভেঙে দিয়েছে। যাও, এবার সোনার মেডেলটা তাদের দেখিয়ে এসো। হুঁ, বীর! মুখে নুড়ো অমন বীরের।”
নিতাই বলল, “অত কথায় কাজ নেই। হ্যারিকেনটা নিয়ে যা, যেখানে পাস খুঁজে নিয়ে আয়। আমরা শুতে যাচ্ছি। সকালের মধ্যে যদি তারা না ফেরে, তবে আমাকে পুলিশে খবর দিয়ে তোকে হাজতে পাঠাতে হবে।”
চোখের জল মুছে গৌর হ্যারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
গৌরের সন্দেহ নেই যে, মহাবীর থানের বটতলায় যারা তাকে আক্রমণ করেছিল, তাদের মধ্যে মাউ আর খাউ ছিল। খেলার মধ্যে কী হয়েছে তা সেই উত্তেজনায় গৌরের আর মনে নেই। তবে মাউ বা খাউ, কারও হাত ভেঙেছে বলে তার মনে হয় না। যদি ভেঙে থাকে, তা হলে অবশ্য লজ্জার কথা।
গৌর হারিকেন হাতে মহাবীর থানের দিকে হাঁটছিল। যদি ওদের পাওয়া যায় তবে ওখানেই পাওয়া যাবে।
রাত আরও গম্ভীর হয়েছে। আরও নিশুতি। চারদিক ছমছমে-থমথমে। কেমন যেন মনের মধ্যে ফের সুড়সুড়িটা টের পাচ্ছে গৌর। কী যেন একটা ঘটবে।
গৌর বটগাছটার ছায়ার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়াল। তার পা সরছিল না। দূর থেকেই সে গলা-খাঁকারি দিয়ে মৃদস্বরে ডাকল, “মাউদাদা! খাউদাদা!”
কেউ জবাব দিল না। গৌর আরও দু’পা এগোল। আবার ডাকল, এবারও জবাব নেই। একটা বিদঘুঁটে উত্তুরে হাওয়া কনকন করে বয়ে গেল, হ্যারিকেনটা দপদপ করে কয়েকবার লাফিয়ে ঝপ করে নিভে গেল। নিকষ্যি অন্ধকার গ্রাস করে নিল চারদিক।
কিন্তু সেই অন্ধকারে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। এমন কাণ্ড গৌর আর কখনও দেখেনি।
হ্যারিকেনটা নিভে যাওয়ার একটু পরেই হঠাৎ বটতলার অন্ধকারে দপ করে একটা নীলচে আলো জ্বলে উঠল। খুব উজ্জ্বল নয়, কিন্তু ভারী নরম, ভারী মায়াময় এক আলো। যেন জ্যোৎস্নার সঙ্গে আকাশের নীল রংখানা কে গুলে মিশিয়ে দিয়েছে। সেই অদ্ভুত আলোয় বটতলাটা যেন এক রূপকথার রাজ্য হয়ে গেল। কিছুই আর যেন চেনা যায় না। বুড়ে শিবের ভাঙা মন্দির, বাঁধানো চাতাল, বটের ঝুরি সব যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। নীল আলোর মধ্যে ফুটে উঠল একটা ধপধপে সাদা সিংহাসন।
গৌর পালাতে গিয়েও পারল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল সামনের দিকে। আঠাকাঠি দিয়ে যেমন পাখি ধরে, তেমনি করে কে যেন আটকে ফেলল গৌরকে। সে পিছোতে পারল না, ঘুরে দৌড় দিতে পারল না, বরং ধীরে ধীরে চুম্বকের টানে এক পা-এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল বটতলার দিকে।
এখানে এমন ধপধপে সাদা সিংহাসন এল কোত্থেকে? এমন অদ্ভুত আলোও তো জন্মে দেখেনি গৌর! বটতলায় হাজারটা ঝুরির ভিতরে বিচিত্র এক আলোছায়া। গাছের মোটা গুঁড়িটার কাছে ফাঁকা সিংহাসনটা কে রেখে গেল?
গৌর ধীরে-ধীরে সিংহাসনটার কাছে এসে দাঁড়াল, না, নিজের ইচ্ছেয় নয়। এতক্ষণ যেন এক অদৃশ্য সুতোর টান তাকে নিয়ে এসেছে এইখানে। একটা অদৃশ্য হাত যেন হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিল নির্দিষ্ট জায়গায়।
গৌরের চোখে পলক পড়ছে না। বুকের ভিতর সেই গুড়গুড়সুড়সুড়। হঠাৎ একটা সাদা আলোর ঝলকানি দেখতে পেল গৌর। তারপর নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না তার সিংহাসনে রাজা রাঘব বসে আছে। সেই অদ্ভুত লম্বা লোকটা। পরনে সাদা
একটা জোব্বা, মাথায় জরির কাজ করা সাদা একটা পাগড়ি।
রাজা রাঘব গৌরের দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, “খুব বাহাদুর ছেলে তুমি। বহোত খুব। আমি তোমার ওপর খুশি হয়েছি।”
গৌর জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “আপনি কি ভোজবাজি জানেন?”
রাজা রাঘব মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তা একরকম বলতে পারো। তবে ভোজবাজি মানেই হল বস্তুবিদ্যার সঙ্গে আত্মশক্তির প্রয়োগ। অতসব তুমি বুঝবে না। তবে তুমি যে আজ ন’পাড়ার সঙ্গে কাবাডি খেলায় ভোজবাজি দেখালে, সেটাও একটা বস্তুবিদ্যার কারসাজি।”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “বস্তুবিদ্যা? কই, আমি তো কিছু জানি না?”
রাঘব মাথা নেড়ে বলল, “তোমার জানার কথাও নয়। আর সেইজন্যই বস্তুটি তোমার পক্ষে বিপজ্জনক।”
“আমার তো তেমন কোনও বস্তু নেই?”
রাঘব মৃদু মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “আছে বই কী! কিন্তু বাঁদরের গলায় যেমন মুক্তোর মালা বেমানান, তোমার মতো আনাড়ির কাছে ওবস্তু থাকাও তেমন বিপজ্জনক। বস্তুটি আমি চাই।”
গৌর এক পা পিছিয়ে বলল, “আমার কাছে কিছু নেই।”
মুহূর্তের মধ্যে রাঘবের হাসিমুখ পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। চোখ দুটো ধকধক করে উঠল। হিংস্র গলায় রাঘব বলল, “পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। এই জায়গাটা আমি বন্ধন দিয়ে রেখেছি। আর-একটা কথাও মনে রেখো, যে বস্তুবিদ্যার জোরে আমার লোকদের হাত থেকে বেঁচে বেরিয়ে গেছ, তা দিয়ে আমায় ঠকাতে পারবে না।”
গৌর কী বলবে বুঝতে না পেরে শুধু অপলক চেয়ে রইল।
রাঘব ক্রুর চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “কবচটা কোমর থেকে খোলো।”
শুনে গৌরের মনে হল, এই আদেশ পালন না করে তার উপায় নেই। ওই কণ্ঠস্বর যেন দৈববাণী। তার একখানা হাত আস্তে-আস্তে কোমরের দিকে উঠে এল।
রাঘব বলল, “কবচটা খুলে নাও। তারপর জলার ধারে ওই চোরাবালিতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।”
গৌর কোমরের সুতলিটার গিট খুলল। তারপর কবচটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে জলার দিকে এগিয়ে গেল।
পিছন থেকে রাঘবরাজার গলা গমগম করে উঠল, “ফেলে দাও! ছুঁড়ে ফেলে দাও!”
গৌর কবচসুন্ধু হাতটা মাথার ওপর তুলল। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে সেটা ছুঁড়ে দিল জলার দিকে।
তারপর আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়াল সিংহাসনের দিকে। কিন্তু বটতলা নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেছে আবার। সেই আলো নেই, সিংহাসন নেই। শুধু অন্ধকার থেকে একটা গমগমে গলা বলে উঠল, “এবার বাড়ি যাও।”
শরীরটা দুর্বল লাগছিল গৌরের। এতক্ষণ যে নির্ভয়, নির্ভার মন ছিল, তা আর নেই। এখন তার ভয় করছে, শীত করছে, ঠকঠক করে কাঁপছে সে। তাহলে কি কোনও কার্যকারণে তার কবচটার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল? কবচের গুণেই কি সে ন’পাড়ার সাত-সাতটা দানবীয় খেলুড়েকে মোর করে দিয়েছিল দু’দুবার? আর জাগ্রত সেই কবচের জন্যই রাজা রাঘবের এত দুশ্চিন্তা?
গৌর আর ভাবতে পারল না। সে প্রাণপণে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটা বাঁশঝাড়। অন্ধকারে দেখতে পায়নি গৌর, একটা বাঁশ ঝুঁকে পড়েছিল রাস্তার ওপর। সেটায় পা বেধে ধমাস করে পড়ে গেল সে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। ভয়ে সিটিয়ে গেল হাত-পা। সে বুঝল যে, আর রক্ষা নেই। এবার শত্রুপক্ষ তাকে পিঁপড়ের মতো পিষে মারবে।
গৌর চেঁচাল, “বাঁচাও…”
একটা হোঁতকা হাত তার মুখটা চেপে ধরল অন্ধকারে। কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, “চেঁচাস না! খবরদার!”
গৌর একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “গোবিন্দদা!”
“এদিকে আয়, তফাতে গিয়ে দাঁড়াই। কথা আছে।”
কাঁপতে কাঁপতে গোবিন্দর পিছু পিছু সে বাঁশঝাড় পেরিয়ে একটা জংলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
হাঁপাতে হাঁপাতে গোবিন্দ বলল, “আর রক্ষে নেই। প্রাণ বাঁচাতে যদি চাস তো এক্ষুনি এখান থেকে পালা!”
গৌর সভয়ে বলল, “কোথায় পালাব গোবিন্দদা? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। আর পালিয়েই বা হবে কী? আমার বাঁচার ইচ্ছেও নেই।”
গোবিন্দ চোখ কপালে তুলে বলে, “কেন রে, বাঁচার ইচ্ছে নেই কেন?”
গৌরের চোখে প্রায় জল এসে গেল। “বেঁচে থেকে লাভ কী বলো? রাঘবরাজার তোশাখানা খুঁড়ে বের করবে বলে আমাদের ভিটেছাড়া হতে হবে। তার ওপর যদি প্রাণে কোনওরকমে বেঁচেও যাই, সারাজীবন দাদার শালাদের তাঁবেদারি করে মরতে হবে। খাউ-মাউ তো জুটেছেই, বোম্বেটে হাউও এসে জুটল বলে। বড় ভরসা ছিল কবচখানা। তার জোরেই আজ কাবাডিতে খুব লড়েছিলাম। তা সেটাও গেল রাঘবরাজার পাল্লায় পড়ে। বেঁচে থেকে আর লাভ কী?”
গোবিন্দ একটু মাথা নেড়ে বলল, “সবই জানি রে। তুই ভাবিস তুই বুঝি একা! তা নয় রে বোকা। আমরা কেউ-না-কেউ সবসময়ে তোকে চোখে-চোখে রাখছি। যা-যা ঘটেছে, সব স্বচক্ষে দেখেছি।”
গৌর অভিমানভরে বলল, “দেখেছ! তাও আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে না!”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “উপায় নেই! রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা টানতে পারি, আমাদের তেমন ক্ষমতা কোথায়? তোকে বশ করে ভেড়া বানিয়ে কবচ-ছাড়া করল, তাও মুখ বুজে হজম করতে হল। কিন্তু কাছে গেলে আমারও তোর মতোই দশা হত।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এতকাল কবচটার মহিমা বুঝতে পারিনি। ঘুমন্ত ছিল। আজই কিন্তু কবচটা জ্যান্ত হল। আমার শরীরটায় আজ ঝিলিক খেয়ে গেল বারবার।”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “দুর বোকা। কবচ জাগেনি।”
“জাগেনি? তাহলে এসব হল কী করে?”
“কবচ জাগলে তার লক্ষণ আমরা ঠিকই টের পেতাম। যোগেশ্বরবাবার তুক আছে। কবচ জাগলে আমরা যারা তাঁর চেলা, সবাই নীল আকাশে তিনবার বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পাব।”
“তা হলে কী করে এতসব কাণ্ড হল?”
“তুই বড় বোকা গৌর। যে ক্ষমতা আজ তুই দেখিয়েছিস, তা কবচের ক্ষমতা নয়, তোরই ক্ষমতা।”
গৌর বিস্ময়ে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “আমার? আমি সাতটা দানবকে ও-রকম গো-হারান হারিয়েছি? বলল কী গোবিন্দদা!”
“ঠিকই বলছি। আরে হাঁদারাম, যোগেশ্বরবাবার দেওয়া কবচ যদি জাগত তা হলে কি রাঘব অত সহজে তোকে হিপনোটাইজ করতে পারত?”
গৌর জিজ্ঞেস করে, “তা হলে কবচ জাগত কীসে? কেমন করে?”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “তা জানি না। সে-সব আমাদের যোগেশ্বরবাবা বলে দেননি। তবে এটুকু জানি, ঠিক সময়ে ঠিক যোগাযোগে কবচ জাগবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা। নইলে রাঘবরাজা গাঁয়ের পর গাঁ শ্মশান করে দেবে।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর ভরসা করে কী হবে? কবচ তো চোরাবালিতে ডুবে গেছে।”
“তা বটে। কিন্তু কবচ না থাকলেও তোর নিজের ক্ষমতাও যে কিছু কম নয়, তা তো আজ টের পেলি!”
“সে-ক্ষমতা দিয়ে কি রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে?”
“সে-ক্ষমতাটাও যে বড় ফ্যালনা নয় রে। আমরা যারা বুড়োহাবড়া, বয়সের গাছপাথর যাদের নেই, তারা অবধি মরার কথা ভাবি না, তুই ভাবছিস কেন? এখন তুই-ই যে আমাদের বড় ভরসা।”
গৌর অবাক হয়ে বলে, “আমি তোমাদের ভরসা? বলো কী? না হয় গায়ে একটু জোরই আছে, আর কাবাডিও মন্দ খেলি না, তা বলে রাঘবরাজার সঙ্গে পাল্লা দেব এমন সাধ্যি কী?”
গোবিন্দ চিন্তিতভাবে বলল, “গায়ের জোরটাও কিছু ফ্যালনা নয় রে। তাতেও মাঝে মাঝে কাজ হয়। তবে কিনা রাঘবের গায়ে অসুরের জোর। তার ক্ষমতাও অনেক বেশি। কিন্তু তা বলে নিজেকে ছোট ভাবতে নেই। যদি একবার ধরে নিস ‘পারব না’ তা হলে আর কিছুতেই পারবি না। অন্তত ‘পারব’ বলে একটা ধারণা রাখতে হয়।”
গৌর বলল, “তা হলে পালাতে বলছ কেন?”
“পালানো মানেও একটা কৌশল। এইমাত্র দেখে এলাম তোর বাড়িতে রাঘব জনাকয়েক যমদূত মোতায়েন রেখেছে। দুটো বসে আছে তোর ঘরের পিছনে আমবাগানে, আর দুটো কলার ঝাড়ে। ওরা কি তোকে ছাড়বে?”
গৌর অবাক হয়ে বলে, “মারতে হলে রাঘবরাজা তো বটতলাতেই আমাকে মারতে পারত। এমন হিপনোটাইজ করেছিল যে, আমার হাত-পা শরীর একদম অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তখন মারল না কেন?”
গোবিন্দ ঠোঁট উলটে বলল, “কে জানে রাঘবের কী লীলা। তবে তোকে যদি মেরে ফেলে তা হলে আর আমাদের রক্ষে নেই।”
গৌর একটু ভাবল। আশ্চর্য এই যে, মাঘবরাজা তাকে কবচ-ছাড়া করায় সে যেমন ভয় পেয়েছিল, এখন আর সেরকম ভয় করছে না। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে, গায়ে স্বাভাবিক জোরবলও যেন ফিরে এসেছে। তার চেয়েও বড় কথা, তার মাথায় একটু-আধটু বুদ্ধি-বিবেচনা খেলছে। সে মাথা নেড়ে বলল, “পালানোর কোনও মানেই হয় না। আমার যাওয়ার জায়গাও নেই। তবে আমার মনে হয় রাঘবরাজা আমাকে মারতে চাইছে না। চাইলে অনায়াসে মারতে পারত।”
গোবিন্দ বলল, “তা বটে। তা হলে কী করবি?”
“আমি বাড়ি যাব।”
“যদি যমদূতগুলো তোকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে?”
“দেখাই যাক।”
“তোর সাহস আছে গৌর। ঠিক আছে, আমিও পিছনে রইলাম। আড়াল থেকে নজর রাখব। তেমন বিপদ দেখলে অন্তত একটা পাবড়া বা বল্লম তো অন্তত ছুঁড়ে মারতে পারব।”
গৌর একটু হাসল। তারপর অন্ধকারে পথ ঠাহর করে করে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে।
সদরের দিক দিয়ে গৌর গেল না। একটু ঘুরে আমবাগানের পথ ধরল। এ-সব তার চেনা জায়গা, নখদর্পণে। অন্ধকারেও সে বলে দিতে পারে, কোন গাছটায় মৌচাক আছে, কোনটায় কাঠঠোকরার বাসা বা কোনটার প্যাঁচ-খাওয়া শরীরে আছে কুস্তিগিরের আকৃতি।
লোক দুটোকে অন্ধকারেও ঠিকই দেখতে পেল গৌর। কাঁচামিঠে আর বেগমপসন্দ দুটো গাছ একেবারে পাশাপাশি। ভারী ঝুপসি ছায়া। সেই ছায়ায় আরও গাঢ় দুটো ছায়া ঘাপটি মেরে আছে। হাতে কোনও অস্ত্র আছে কি? কে জানে!
গৌর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। একটা গাছ থেকে আর-একটা গাছের আড়ালে কোলকুঁজো হয়ে ছুটে যাচ্ছিল সে। কাবাডি খেলার দক্ষ খেলোয়াড়ের কাছে ব্যাপারটা খুবই সহজ। কিন্তু লোক দুটো বোকা নয়। অন্ধকারে যতই নিঃশব্দে গৌর এগোক না কেন, লোক দুটো কিন্তু ঠিক টের পেল। আচমকা ছায়া দুটো ছিটকে সোজা হল। তারপর সিটিয়ে গেল গাছের আড়ালে।
গৌর চারদিকটা একটু লক্ষ করল। তারপর কাঠবেড়ালির মতো একটা গাছ বেয়ে উঠে গেল খানিকটা ওপরে। এক গাছ থেকে আর-এক গাছে যাওয়া তার কাছে ছেলেখেলার মতো। লোক দুটো যে-গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, সে দুটো টপকে গৌর সোজা গিয়ে তার ঘরে পিছনটায় নেমে পড়ল। নামল খুবই সাবধানে, আড়াল রেখে। কেউই দেখতে পায়নি তাকে।
হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে তার ঘরের দাওয়ার পাশে হাজির হল।
কেউ কোথাও নেই। খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল গৌর। দাওয়ায় গা রাখল। উঠতে যাচ্ছে, ঠিক এই সময়ে লোহার মতো দু’জোড়া হাত এসে তার দুই বাহু চেপে ধরল।
গৌর একটুও চমকাল না, ভয়ও পেল না। ঘাড় ঘুরিয়ে লোক দুটোকে একটু দেখল। সাক্ষাৎ যমদূতই বলা যায়। কিন্তু গৌরের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। সে জানে, ইচ্ছে করলে বোধহয় এই যমদূতদের সঙ্গেও সে পাল্লা দিতে পারে।
তবে গৌর কিছুই করল না। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী চাও তোমরা?”
যমদূতদের একজন একটু অবাক হয়ে বলল, “ভয় পাচ্ছিস না যে! খুব তেল হয়েছে, না?”
“তেল হবে কেন? তেল তো দেখছি তোমাদের।” ঘাড়ে একটা রদ্দা মেরে যমদূতটা বলল, “কার কত তেল সেটা আজই বোঝা যাবে। চল!”
রদ্দা খেয়ে গৌরের মগজ নড়ে গিয়েছিল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে সরষেফুল। তবু শরীরটা ঝাঁকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তোমরা বাপু কথায় কথায় বড় গায়ে হাত তোলো। সবসময়ে কি হাত নিশপিশ করে নাকি?”
‘তা করে। তোর মতো চোরকে হাতে পেলে হাত নিশপিশ করবেই।”
“আমি চোর!” গৌর অবাক হয়ে বলে, “কী চুরি করলাম বলো তো!”
যমদূতটা আর-একটা রদ্দা চালিয়ে বলল, “ন’পাড়া থেকে যে সোনার মেডেল নিয়ে এলি, সেটা চুরি নয়? কবচের জোরে জিতেছিস। ওরকম জেতাকে চুরিই বলে!”
এই বলে যমদূতেরা গৌরকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। ৮৪।
বনবাদাড়, মাঠঘাট, কাঁটাঝোঁপের ভিতর দিয়ে যেখানে এনে হাজির করা হল তাকে, সে-জায়গাটা গৌরের খুব চেনা। সেই বটতলা, যেখানে একটু আগেই রাঘবরাজার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। এখন আর সিংহাসন নেই, সেই স্বপ্নের মতো আলো নেই। শুধু বাঁধানো চাতালে একটা পিদিম জ্বলছে। আধো-অন্ধকারে লম্বা পায়ে পায়চারি করছে রাঘব। তাকে দেখে বাঘের চোখে চাইল। সেই চোখ, যা দেখলে বাঘেরও বোধহয় রক্ত জল হয়ে যায়।
গৌর রাঘবের চোখের দিকে চেয়ে কেমন অবশ হয়ে গেল। সে টের পেল, রাঘবের সাঙ্গোপাঙ্গরা যতই সাংঘাতিক হোক, তারা কেউ রাঘবের হাজার ভাগের এক ভাগও নয়।
গমগমে স্বরে রাঘব বলল, “আমি কে তা জানিস?”
গৌর মাথা নেড়ে ক্ষীণস্বরে বলল, “জানি। আপনি রাজা রাঘব।”
“আর কী জানিস?”
গৌর একটা খাস ফেলল। তার মনটা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরোধ চলে যাচ্ছে। সে সম্মোহিত হয়ে পড়ছে। ক্ষীণস্বরে গৌর বলল, “আপনি আপনার রাজ্য আবার স্থাপন করতে চান। তার জন্য সৈন্যসামন্ত জোগাড় করছেন।”
“তা হলে সবই জানিস দেখছি। যোগেশ্বর নামে একটা শয়তান এখানে একসময়ে থানা গেড়েছিল। তার কয়েকজন শিষ্যসাবুদ এখনও এখানে আছে বলে খবর পেয়েছি। তারা নাকি আমাকে তাড়াতে চায়?”
“জানি।”
“লোকগুলোকে আমি চিনি না। শুনেছি তারা খুব গোপনে ষড়যন্ত্র আঁটছে। তুই জানিস তারা কারা?”
“জানি।”
“নাম আর ঠিকানা বলে যা।”
“আপনি কি তাদের মারবেন?”
“আমার কাজে যে বাধা দেবে, তাকেই সরিয়ে ফেলতে হবে। কোনও উপায় নেই।”
“আমাদের এই গ্রাম কি আর এ-রকম থাকবে না?”
“না। সব ভেঙে ফেলে দেওয়া হবে। বাড়িঘর, মন্দির, সব। আবার সব গড়ে তোলা হবে যেমন আগে ছিল।”
“আর মানুষজন?”
“এখানকার মানুষ একসময়ে শত্রুতা করে আমাদের তাড়িয়েছিল। এখনও তাদেরই বংশধরেরা এখানে বাস করছে। সুতরাং সবাইকে উচ্ছেদ করা হবে। এবার নামগুলো বল।”
“গোবিন্দদা, কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, সুবলদাদু।” রাঘব তার যমদূতদের দিকে তাকিয়ে চোখের একটা ইঙ্গিত করল। যমদূত দুটো চোখের পলকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
রাঘব গৌরের দিকে সেই ভয়ংকর চোখে চেয়ে বলে, “রাজা রাঘব বড় একটা ভুল করে না। কিন্তু তোর ব্যাপারে আজ আমার একটা মস্ত ভুল হয়েছে। কবচের জোরে নয়, নিজের ক্ষমতাতেই তুই আজ অনেক ভেলকি দেখিয়েছিস।”
গৌর চুপ করে রইল। রাজা রাঘব বলল, “আমি তোর ওপর খুশিই হয়েছি। যদিও তুই যোগেশ্বরের এক চেলার নাতির নাতি, তবু তোকে ক্ষমা করতে পারি। একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“আমার হয়ে কাজ করতে হবে। একটু বেচাল দেখলেই খুন করব। আর কথামতো চললে কোনও অভাব থাকবে না।”
“আমাকে আপনার দলে নিতে চান?”
“চাই। তবে আমার দলে আসতে গেলে শুধু গায়ের জোর থাকলেই হবে না। শক্ত কলজে চাই। যদি সেই পরীক্ষায় পাস করতে পারিস, তবেই দলে আসতে পারবি।”
“কী পরীক্ষা?”
“হাসতে হাসতে খুন করতে পারা চাই। রক্ত দেখে ভিরমি খেলে হবে না। গেরস্তের ঘরে আগুন দিবি, কিন্তু বুক কাঁপবে না। পারবি?”
“আপনি বললে চেষ্টা করতে পারি।”
“পরীক্ষা এখনই হবে। আমার লোকেরা ফিরে এল বলে।” বাস্তবিকই কয়েক মিনিট বাদে যমদুতের চেহারার কয়েকজন লোক পিছমোড়া করে বেঁধে টানতে টানতে চারজন লোককে এনে হাজির করল। গৌর দেখল, গোবিন্দদা, কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব আর সুবলদাদু। তিনজনেই ভয়ে জড়সড়, মুখে কথা নেই।
রাঘব চারজনকে খুব তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে গৌরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, “এই চারটে মর্কটের কথাই বলেছিলি তো।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“এখন এক-এক করে এদের ধরে নিয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আয়। খবরদার, চালাকির চেষ্টা করিস না। আমার লোক নজর রাখবে। ওদিকটায় জলার ধারে একটা ঢিবি আছে। ঢিবির ওপর এক-একটাকে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবি। যা। এইটাই তোর পরীক্ষা।”
গৌর বলল, “যে আজ্ঞে।” বলেই গৌর গিয়ে কবরেজমশাইয়ের হাত ধরল। কবরেজমশাই ফোঁত করে একটা শ্বাস ছেড়ে ঢোক গিলে বললেন, “বাবা গৌর, তোর মনে কি এই ছিল?”
পিছন থেকে এক যমদূত একখানা রদ্দা মারতেই কবরেজমশাই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। গৌর তাঁকে ধরে তুলল। তারপর হঠাৎ যমদূতটার ঘাড় ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এ শিকার আমার। স্বয়ং হুজুর সামনে রয়েছেন। এরকম বেয়াদবি আর করলে মুণ্ডু ছিঁড়ে দেব। খেয়াল রেখো।”
সকলেই অবাক হয়ে গৌরের দুঃসাহস দেখল। যমদুতেরা হয়তো সবাই মিলে লাফিয়ে পড়ত গৌরের ওপর। কিন্তু সেই সময়ে রাজা রাঘব চারদিক প্রকম্পিত করে বলে উঠল, “শাবাশ! এই তো চাই।”
কবরেজমশাই কাঁপতে কাঁপতে ঢিবির ওপর উঠলেন। অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র জপ করছেন, শুনতে পেল গৌর। তাদের দু’জনের দু’দিকে চারজন-চারজন করে আটজন বল্লম লাঠিধারী লোক।
কবরেজমশাই কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “গৌর, শেষে ব্রহ্মহত্যার পাতকী হলি? রাঘবের দলে গেলি? ওঃ, ভাবতে পারি না। আর কিনা তুই-ই ছিলি আমাদের শেষ ভরসা! নাঃ, এর চেয়ে মরণ ভাল।”
বলতে বলতেই কবরেজমশাই উচ্চৈঃস্বরে বীজমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে টিবি থেকে লাফ দিলেন। প্রায় হাত-দশেক নীচে চোরাবালি। গৌর ঝুঁকে দেখল, কবরেজমশাই বারকয়েক হাত-পা ছুড়লেন, তারপর তলিয়ে যেতে লাগলেন বালির মধ্যে।
এর পর সুবলদাদু। তিনি কোনও কথা বললেন না। কথা এমনিতেও কম বলেন। ঢিবির ওপর ওঠার সময় শুধু টাক থেকে একটুকরো সুপুরি বের করে মুখে দিলেন। ওইটেই তাঁর একমাত্র নেশা। তারপর গৌরের দিকে চেয়ে বললেন, “কুলাঙ্গার।”
এই বলে তিনিও লাফ দিলেন। ঠ্যালা ধাক্কা দিতে হল না। ফকিরসাহেব কেবল একবার রোষকষায়িত লোচনে গৌরের দিকে চেয়ে বললেন, “ফুঃ, আমাকে মারা কি অত সোজা রে? শরীরখানা ছেড়েই আরশিতে ঢুকে পড়ব। তারপর কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি। তোরা কাঁচকলা খা।” এই বলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফকিরসাহেব গিয়ে ঢিবির ধারে দাঁড়ালেন। তারপর চোখ বুজে একবার আল্লার নাম স্মরণ করেই মারলেন লাফ।
গোবিন্দ কোনও কথা বলল না, তাকালও না। চুপচাপ উঠে চলে এল ঢিবির ধারে। লাফ মারার আগে চাপা স্বরে শুধু বলল, “ঝিলিক দেখা গেছে। তারপরেই লাফিয়ে পড়ল চোরাবালিতে।
কথাটার অর্থ প্রথমে বুঝতে পারেনি গৌর। তারপর মনে পড়ল। গোবিন্দদাই তাকে বলেছিল যে, কবচ জাগলে বিনা মেঘেও আকাশে তিনবার ঝিলিক দেখা যাবে। কিন্তু গৌরের এখন সে-সব ভাববার সময় নেই। রাঘবরাজাকে খুশি করাই এখন তার জীবনের লক্ষ্য। তার বেশ আনন্দ আর উত্তেজনা হচ্ছিল মনের মধ্যে। সে লোকের ঘরবাড়ি জ্বালাবে, গ্রামের পর গ্রাম শ্মশান করে দেবে, একের পর এক মানুষ মারবে। কী যে মজা হবে! ওঃ! তার গা রীতিমতো গরম লাগছে। রক্তে যেন আগুন লেগেছে। আর বেশ নেশা-নেশা মাতলা-মাতলা ভাব।
গৌর বটতলায় ফিরে এসে রাঘবরাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলল, “খুশি তো হুজুর!”
হুজুর! গৌর যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে রাঘবরাজাকে ‘হুজুর’ বলছে! কিন্তু বলে বেশ ভালই লাগছিল তার। ইচ্ছে হচ্ছিল, রাঘবরাজার পায়ের ওপর মাথা রেখে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। আহা, রাঘবরাজার মতো মানুষ হয় না। মানুষও নয়, দেবতা। গৌরের চোখে আনন্দাশ্রু বইছিল।
রাঘবরাজা গম্ভীর মুখে তার বিশাল দক্ষিণ বাহুটি তুলে বলল, “নাঃ, বাহাদুর আছিস বটে! শাব্বাশ!”
“তা হলে পাস তো হুজুর? দলে নেবেন তো?”
“হ্যাঁ। এবার যা, গাঁয়ের গোটা দুই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আয়।”
গৌর সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। পথের ধারে দুটো খোড়ো ঘরে আগুন ধরিয়ে আবার দৌড়ে ফিরে এল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, লোকজন প্রাণভয়ে চেঁচামেচি, দৌড়োদৗড়ি করছে, আর গৌর তখন রাঘবরাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিগলিত মুখে বলছে, “দিয়ে এসেছি হুজুর। আর কী করতে হবে একবার হুকুম করুন।”
রাঘবরাজা মৃদু হেসে বলল, “আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে। কাল থেকে আমার সত্যিকারের কাজ শুরু হবে। কাল সকালে এসে এইখানে হাজির হবি। তোর যা এলেম দেখছি, তোকেই সর্দার করে দেব। এই নে আমার পাঞ্জা।”
রাঘবরাজা একখানা তুলোট কাগজ গৌরের হাতে দিল। তাতে একখানা প্রকাণ্ড হাতের ভুসো কালির ছাপ। গৌর কাগজটা নিয়ে কপালে ঠেকাল।
রাঘবরাজা বলল, “খুব সাবধানে রাখিস।”
“যে আজ্ঞে।”
“এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমো। কাল অনেক কাজ।”
গৌর হাতজোড় করে বলল, “হুজুর, একটা কথা। অভয় দেন তো বলি।”
“বল বল, অত সংকোচ কীসের?”
“আমার দুই কুটুমকে পাচ্ছি না। খাউ আর মাউ। তাদের খুঁজে নিয়ে না গেলে দাদা বাড়িতে ঢুকতে দেবে না বলেছে।”
একথায় রাঘবরাজার চোখ দুটো ঝলসে উঠল। পিদিমের ম্লান আলোতেও দেখা গেল, লম্বাটে মুখোনা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। চাপা হিংস্র গলায় বলল, “কে তোকে বাড়ি ঢুকতে দেবে না? কার এত বুকের পাটা? তোর দাদাকে যদি কড়াইয়ের মধ্যে পুরে আগুন দিয়ে বেগুনপোড়া না করি…”
“আজ্ঞে হুজুর, মায়ের পেটের ভাই। অতটা করার দরকার নেই।”
রাঘবরাজা কুটি করে কিছুক্ষণ গৌরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “খাউ আর মাউ কোনও কর্মের নয়। বরং ওদের বড়ভাইটা কাজের লোক। খাউ আর মাউকে বেঁধে বুড়ো শিবের মন্দিরে বন্ধ করে রেখেছি। ভেবেছিলাম কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেব। আমার রাজ্যে অপদার্থের স্থান নেই।”
“হুজুর, আমারও তাতে অমত নেই। বলেন তো নিজের হাতেই কাটব। তবে বউদি বড় কান্নাকাটি করবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাঘব বলে, “ঠিক আছে। তুই ওদের নিয়ে যা। একটু নজরে নজরে রাখিস। তোর মুখ চেয়েই ওদের ছেড়ে দিচ্ছি।”
আধমরা খাউ আর মাউকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে গৌর। তারপর খুব নিশ্চিন্তে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। ভারী নিশ্চিন্ত। কবচ হারানোর দুঃখ আর নেই। কবচের বদলে রাঘবরাজার পাঞ্জা পেয়ে গেছে সে। আর দুঃখ কীসের? কাল থেকে সে হবে রাঘবরাজার দলের সর্দার। গ্রাম জ্বালাবে, মানুষ মারবে, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। তারপর একদিন হবে রাঘবরাজার সেনাপতি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গৌর স্বপ্ন দেখছিল। সেনাপতি হয়ে সে ঘোড়ায় চেপে সৈন্যসামন্ত নিয়ে একটা রাজ্য জয় করে ফিরছে। তার বল্লমের আগায় গাঁথা একটা নরমুণ্ড। নরমুণ্ডটা ভারী চেনা-চেনা। কিন্তু ঠিক মনে পড়ছিল না মুখটা কার।
হঠাৎ আকাশ থেকে একটা ইগল পাখি শো করে নেমে নরমুণ্ডটা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছিল। গৌর কি কিছু কম যায়? সঙ্গে সঙ্গে ধনুক বাগিয়ে তির ছুড়ল। পাখিটা লাট খেয়ে পড়তে লাগল। আশ্চর্য! নরমুণ্ডটা এসে আবার বল্লমে গেঁথে গেল। আর ইগলটা নেমে এসে হঠাৎ দুটো থাবায় চেপে ধরল তার গলা।
গৌরের দম বন্ধ হয়ে এল। চোখ কপালে উঠল। কিন্তু কিছুতেই ইগলটা ছাড়ছে না তাকে। চোখের সামনে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা গেল বারকয়েক। আর সেই যন্ত্রণার মধ্যে গৌর বুঝতে পারল, বল্লমে গাঁথা নরমুণ্ডটা আসলে তারই মুখ। তাই অত চেনা।
ঘুম ভাঙতেই গৌর বুঝল, মস্ত একটা মানুষ অন্ধকারে প্রাণপণে লোহার থাবায় তার গলা চেপে ধরেছে। বুকে হাঁটু।
গৌর বুঝল, আর একটু পরেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তাই পা দু’খানা তুলে সে লোকটার গলায় লটকে একটা ঝটকা দিল। দড়াম করে লোকটা খসে গেল তার বুক থেকে। গৌর বিদ্যুদবেগে উঠে লোকটাকে একটা লাথি লাগাল কষে। তারপর অনায়াসে তার একটা হাত পিঠের দিকে ঘুরিয়ে অন্য হাতে গলা চেপে ধরল।
গৌরের এই বজ্ৰবাঁধনে লোকটা খাবি খাচ্ছে। গৌর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি হাউ। খাউ আর মাউয়ের বড়ভাই।”
গৌর অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো জেলখানায় ছিলে!”
“রাঘব আমাকে ছাড়িয়ে এনেছে। তারপর ন’পাড়ায় লুকিয়ে ছিলুম।”
“তা আমার ওপর তোমার রাগ কীসের?”
“আমার ভাইদের এই হেনস্থার জন্য তুই-ই দায়ী। তুই রাঘবরাজার নজরে পড়েছিস। এখন রাঘব আমাদের পাত্তা দিতে চাইছে না। তোকে খুন করা ছাড়া আমার অন্য উপায় ছিল না।”
“তুমি ন’পাড়ার কাবাডির দলে ছিলে?”
“হ্যাঁ। রাঘব হুকুম দিয়েছিল, খেলার মধ্যে যেন তোমাকে খুন করা হয়।”
“এখন যদি তোমার ঘাড়টা ভেঙে দিই।” হাউ কোনও জবাব দিল না। কিন্তু আচমকাই পিছন থেকে বেড়ালের পায়ে চার-পাঁচজন লোক ঘরে ঢুকল। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি, তলোয়ার, খাঁড়া।
গৌর কিছু করার আগেই তার মাথায় বিশাল একটা লাঠি সজোরে এসে পড়ল। ফটাস করে একটা শব্দ আর সেই সঙ্গে ছড়াক করে খানিক রক্ত ছিটকে পড়ল মেঝেয়। তারপরেই উপর্যুপরি ধুপধাপ লাঠি এসে পড়তে লাগল চারধার থেকে। গৌর নড়বার সময় পেল না। লাঠির ঘায়ে কাটা কলাগাছের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
হাউ লোকগুলোর দিকে চেয়ে বলল, “লাশ এখানে ফেলে রাখা চলবে না। রাঘব সন্দেহ করবে। রক্তটা ভাল করে মুছে দে। আর চারজন ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আয়। সর্দার হওয়া ওর বের করছি।”
নিশুত রাতে চারজন লোক গৌরের অচেতন দেহখানা চ্যাংদোলা করে বটতলার ঢিবিটার ওপর নিয়ে তুলল। তারপর দু’বার দোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল চোরাবালির মধ্যে।
বালির মধ্যে আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল গৌর। কেউ কিছু জানতে পারল না।
গৌরের চেতনা যখন ফিরল, তখন তার চারধারে বালি আর বালি। ওপরে বালি, নীচে বালি, চারধারে ঝুরঝুর করে ঝুরো বালির স্তর কেবল সরে যাচ্ছে, ঝরে পড়ছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! গৌরের তাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সে দম নিতে পারছে। সে অনুভব করছিল, বালির মধ্যে শক্তমতো ছোট একটা জিনিস বারবার তার হাতে, পিঠে, বুকে এসে ঠেকছে। গৌর হাত বাড়িয়ে জিনিসটা মুঠোয় নিল।
কবচটা না? হ্যাঁ, সেই কবচটাই তো মনে হচ্ছে! গোবিন্দদা কী যেন বলছিল? হ্যাঁ, বলেছিল যে ঝিলিক দেখা গেছে। তার মানে কি কবচটা জেগে উঠেছে।
কবচটা মুঠোয় চেপে শোয়া-অবস্থা থেকে গৌর উঠে দাঁড়ায়। কোনও অসুবিধে হয় না তার। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, আজ রাঘবরাজার হুকুমে তার চারজন অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষীকে এই চোরাবালিতে ডুবিয়ে মেরেছে। মনটা হায়-হায় করে ওঠে গৌরের। তার বুদ্ধিনাশ হয়ে গিয়েছিল। শোকে পাগলের মতো হয়ে গৌর চারদিকে বালির মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল ওঁদের। খুঁজতে খুঁজতে চোখের জল ফেলে সে বারবার বলছিল, “এ আমি কী করলাম! এ আমি কী করলাম!”
বেশি খুঁজতে হল না। প্রথমে কবরেজমশাইকে পেয়ে গেল সে। তারপর সুবলদাদু। একটু বাদেই হাত ঠেকল গোবিন্দদা আর ফকিরসাহেবের গায়ে।
একে-একে চারজনকেই টেনেহিঁচড়ে ওপরে নিয়ে এল গৌর। চোরাবালিতে একটুও কষ্ট হল না তার। শরীরটা যেন পালকের মতো হালকা।
চারজনকেই ঘাসজমিতে শুইয়ে একে-একে নাড়ি দেখবে বলে গৌর প্রথমে কবরেজমশাইয়ের কবজিটা ধরতেই কবরেজমশাই ঘেঁকিয়ে উঠলেন, “ওঃ, কী আমার ধন্বন্তরি এলেন যে! বলি নাড়িজ্ঞানটা আবার তোর কবে থেকে হল?”
গৌর আনন্দে কেঁদে ফেলে বলল, “আপনি বেঁচে আছেন কবরেজমশাই?”
“মারে কে? চোরাবালিতে পড়ার আগে একটা করে বিশল্যকরণীর বড়ি খেয়েছি না সবাই? মরা কি অত সোজা? তা ছাড়া, কবচ যে জেগেছে, সে-খবরও পেয়েছিলাম কিনা। যাকগে, তোকে ভাবতে হবে না। ওই তিনজনও বেঁচেই আছে। এক্ষুনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।”
গৌর অবাক হয়ে দেখল, সত্যিই তাই। কথা শেষ হতে না হতেই গোবিন্দদা, সুবলদাদু আর ফকিরসাহেব উঠে বসেছেন। একটা হাই তুলে ফকিরসাহেব বললেন, “বেশ ঘুম হল একখানা। ঘুমটার বড় দরকার ছিল।”
গোবিন্দদা গা থেকে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “এখন বসে গল্প করার সময় নেই গো। কবচ জেগেছে, কিন্তু যোগেশ্বরবাবার বলা আছে, মস্ত বিপদের দিনে কবচ জেগে উঠবে বটে, তবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। তারপর যেই ভোর হবে, অমনি চিরতরে নিভে যাবে। সুতরাং যা করার এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ওঠো সব, উঠে পড়ো।”