৭. বাই-ভার্বালটি নিঃশব্দে

বাই-ভার্বালটি নিঃশব্দে মহাকাশযানের মাঝে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। প্রথমে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হল আর দেখা যাচ্ছে না। জানালাগুলি অন্ধকার করে দিয়ে বাইরের সাথে আমাদের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার বাধাধরা নিয়ম কানুন, কিছু করার নেই, কিন্তু আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। আমি সাধারণ মানুষ, আমার সাধারণ দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমি এক বিশাল ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি। এর থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসব তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। এখন যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ ঘটনাগুলি। এগুলি একটু মধুর হতে পারত কিন্তু হয় নি। বুড়ো লীয়ের হত্যাকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছি। আটটি ফুটফুটে শিশুর হত্যাকাণ্ড দেখতে হবে, আমার আর লেনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, জোর করে মাথা থেকে সবকিছু সরিয়ে দিলাম, এখন সুন্দর একটা কিছু ভাবতে হবে, মিষ্টি একটা কিছু ভাবতে হবে যেটি আমার বিক্ষিপ্ত মনটিকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শান্ত করে দিতে পারে। কী হতে পারে সেই জিনিস? আমার শৈশব? ফেলে আসা গ্রহটির বিশাল প্রান্তর? স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশ? একটু পর আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমি লেনের কথা ভাবছি।

আমি চোখ খুলে তাকালাম, সামনের সাড়িতে আটটি শিশুকে নিয়ে সে শান্ত মুখে বসে আছে–মুখে গভীর উদ্বেগের ছায়া। শিশুগুলি তাকে জড়াজড়ি করে ধরে রেখেছে, কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে দুজন, তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে একজন শিশু। সে হাত দিয়ে আকড়ে রেখেছে। সবাইকে। শিশুগুলির চোখে মুখে কোনো ভয় নেই, আতংক বা উদ্বেগ নেই। তাদের মুখে এক গভীর নিশ্চিন্ত বিশ্বাস। তারা জানে যতক্ষণ লেন তাদেরকে আকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ তাদের কোনো ভয় নেই, বিপদ নেই।

আমি এই অপূর্ব দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আর কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পর আমারও মনে হতে থাকে এই আটটি নিস্পাপ শিশুর কোনো ভয় নেই, কোন বিপদ নেই!

ঠিক এরকম সময় বাই-ভার্বালে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম এবং সাথে সাথে ভিতরের সব রবোটেরা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ঘিরে দাড়াল। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছি।

বাই-ভার্বালের গোল দরজা দিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম। স্বচ্ছ মেঝে, স্বচ্ছ দেয়াল, উপরে স্বচ্ছ ছাদ প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে বুঝি কোথাও পড়ে যাব। সাবধানে হেঁটে হেঁটে আমরা দ্বিতীয় একটি ঘরে হাজির হলাম। সেখানে জোর করে শিশুগুলিকে লেনের কাছ থেকে আলাদা করা হল। শিশুগুলি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে কিন্তু এবোটগুলি তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। লেন জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে শিশুগুলিকে অভয় দিয়ে, বলল, তোমরা যাও, আমি এক্ষুনি আসছি।

তারা কী বুঝল কে জানে! একজন একজন করে কান্না থামিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তখন আমাকে আর লেনকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে পাশের একটা ঘরে নিয়ে আসা হল। আমাদের বিবস্ত্র করা হল এবং আমাদের কাছে যা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হল। আমি দেখতে পেলাম খাবারের ক্যাপসুলগুলি সরিয়ে নিল প্রাচীন ধরনের একটি রবোট। তথ্য ক্রিস্টালগুলি আধুনিক ধরনের কিছু রবোট, কমিউনিকেশান্স মডিউলটি যে পরীক্ষা করতে শুরু করল তাকে একজন মানুষের মতো দেখাচ্ছিল, যদিও আমি মোটামুটি নিশ্চিত সেও একজন রবোট।

আদের বিবস্ত্র অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে হল না। কিছুক্ষণের মাঝেই নূতন এক প্রস্ত নিও-পলিমার দিয়ে আমাদের আবৃত করা দেয়া হল। সত্যিকার পোষাক নয় তবে পোষাকের কাজ চলে যায়।

এতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাদের সাথে একটা কথাও বলে নি আমরাও কিছু বলি নি। আমি এবারে আমার প্রথম কথাটি উচ্চরণ করলাম, স্পষ্ট গলায় জোর দিয়ে বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই।

সাথে সাথে ঘরটিতে একটি নীরবতা নেমে এল। যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমি শুনতে পেলাম বিশাল এই ভবনে দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ সময় সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। আমি এবার আরো স্পষ্ট গলায় বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই। মহামতি গ্রাউল, যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি এই বিশাল মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। যার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই। যিনি সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন।

আমরা সমানে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা তখনো নিঃশব্দে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুনতে পেলাম অনেকে এই ঘরের দিকে ছুটে আসছে। ঘরের দরজা খুলে গেল এবং বেশ কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা ভেতরে ঢুকে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকি, কেন জানি মনে হয় এদের কেউই সত্যিকারের মানুষ নয়। হয় পুরোপুরি রবোট কিংবা রবোটের দেহে আটকে পড়ে থাকা কোনো একজন হতভাগ্য মানুষ।

বয়স্ক ধরনের একজন কয়েক পা এগিয়ে এসে ভীত গলায় বলল, তুমি কী বলছ?

আমি প্রায় ধমক দেয়ার মতো করে বললাম, আমি জানি আকি কী বলছি। আটটি শিশুকে কেন আনা হয়েছে আমি তাও জানি। মহামান্য গ্রাউলের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির নিয়ম মাফিক পরিবর্তন করার কথা। আটটি সুস্থ সবল হৃদপিণ্ড দরকার। আটটি শিশু থেকে সেই আটটি হৃদপিণ্ড নেয়া হবে।

বয়স্ক ধরনের মানুষটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, তুমি এসব কী বলছ? কোথায় শুনেছ এই সব?

আমি কোথায় শুনেছি সেটা তোমার জানার দরকার নেই। আমি এই মুহূর্তে মহামতি গ্রাউলের সাথে কথা বলতে চাই। এই মুহূর্তে–

কিন্তু সেটা তো অসম্ভব।

অসম্ভব?

হ্যাঁ।

বেশ। তুমি জান আমি কী করতে পারি?

কী করতে পার?

আমি তোমাদের পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারি।

সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আমি হিংস্র গলায় বললাম, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? ঠিক আছে আমি তোমাদের আমার ক্ষমতা দেখাব।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, আমি ধ্বংস করে দেব সব।

নির্দিষ্ট সময় পর পর দুটি মিথ্যা কথা উচ্চারিত হওয়া মাত্র খাবার ক্যাপসুলে রাখা বিস্ফোরণটি প্রচন্ড শব্দ করে বিস্ফোরিত হল। প্রাচীন ধরনের রবোটের আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটগুলিও ছিটকে উঠল উপরে, তারপর ঘুরতে ঘুরতে নিচে এসে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। হল ঘরটি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, জঞ্জাল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

আমাদের যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন কী একটা বলতে চাইছিল আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমার কথা বিশ্বাস হল?

কেউ কোনো কথা বলল না। আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি তোমাদের আরো একটি সুযোগ দেব। দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, সুযোগ গ্রহণ না করলে ধ্বংস করে দেব সবকিছু।

সাথে সাথে তথ্য ক্রিস্টালের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হল। এটি ছিল আরো শক্তিশালী। পুরো হল ঘর প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ছিন্ন ভিন্ন রবোটের ধ্বংসাবশেষ উপর থেকে নিচে পড়তে শুরু করল। মনে হল বুঝি এখানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমি তার মাঝে চিৎকার করে বললাম, এই মুহূর্তে আমাকে মহামতি গ্রাউলের কাছে নিয়ে যাও। শুধু তিনিই আমার সাথে কথা বলতে পারবেন, আর কেউ না।

এবার আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলির মাঝে এক ধরনের চাঞ্চল্যের চিহ্ন লক্ষ করা গেল। আমি যেভাবে হাস্যকর ছেলেমানুষি যন্ত্র দিয়ে বড় বড় দুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি কতক্ষণ সেটি তাদের কাছে গোপন রাখতে পারব জানি না, সময় আমার কাছে খুব মূল্যবান। যে কোনো মুহূর্তে আমি ধরা পড়ে যেতে পারি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মহামতি গ্রাউলকে নিশ্চয়ই অচিন্ত্যনীয় প্রতিরক্ষা দিয়ে আগলে রাখা হয়, আমি নিজে থেকে সেখানে কখনোই যেতে পারব না।

আমার সামনে দাড়ানো মানুষগুলি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। একজন একটু এগিয়ে এস বলল, তুমি কেন মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাও?

আমি গলায় অধৈর্যের স্বর ফুটিয়ে বললাম, আমি তোমাকে সেটা বললে তুমি বুঝবে না। তোমার কিংবা তোমাদের কারো সেই মানসিক পরিপক্কতা নেই।

কথাটি সত্যি নয়, তাই তিন সেকেন্ড পর যখন বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না–তখন তৃতীয় বিস্ফোরণটি ঘটল।

ভয়ংকর বিস্ফোরণের ধাক্কাটা কমে যেতেই উপস্থিত মানুষেরা ছোটাছুটি শুরু করে এবং কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি আমাকে এবং লেনকে একটা ভাসমান যানে তুলে দেয়। সেটি অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গে ছুটে যেতে থাকে। বিশাল বিশাল কিছু গেট নিজে থেকে খুলে যায় আবার আমাদের পিছনে বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য ধরনের যন্ত্রপাতি আমাদের পরীক্ষা করে তারপর ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়।

এক সময় আমি আর লেন একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছালাম। তার ধবধবে সাদা দেয়াল, উঁচু ছাদ এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মেঝে। ঘরটিতে হালকা নরম একটি আলো, যদিও কোথা থেকে সেই আলো আসছে বুঝতে পারছি না। ভিতরে একটু শীতল, আমি আর লেন কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। কেউ কিছু বলে দেয় নি কিন্তু আমার মনে হল এখানেই মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা হবে।

আমি আর লেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথাও কোন চিহ্ন নেই কিন্তু তবু আমাদের মনে হতে থাকে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হঠাৎ এক ধরনের আতংক অনুভব করতে থাকি। বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে আমি লেনের দিকে তাকালাম, ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে একজন ভারি গলায় বলল, তোমরা কেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?

আমি আর লেন চমকে উঠে চারিদিকে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মহামতি গ্রাউল। আপনার ভবনে আমি আহাম্মকের মতো তিনটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি, আমি–

হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি। আমি অনুভব করছি তোমার করোটিতে একটা ছোট ট্রান্সমিটার বসানো আছি। তুমি নিশ্চয়ই তোমার মস্তিষ্ক তরঙ্গ ব্যবহার করে সেটা দিয়ে কাছাকাছি রাখা বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ।

আপনি সত্যিই অনুমান করেছেন মহামতি গ্রাউল। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার এই ছলনাটুকু করতে হয়েছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

আমার কর্মচারীদের ধোকা দেয়া খুব সহজ। তারা নির্বোধ।

আমি ক্ষমা চাই মহামতি গ্রাউল।

আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।

আপনার প্রতি আমার অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা।

তুমি কেন এসেছ আমার কাছে?

আমার বলতে খুব দ্বিধা হচ্ছে মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন না করে কথাটি কীভাবে উচ্চারণ করব বুঝতে পারছি না।

তুমি অসংকোচে বলতে পার কিহা।

তার আগে আমি কি একটা অনুরোধ করতে পারি?

কী অনুরোধ?

আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?

মহামতি গ্রউল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে কেউ কখনন দেখে নি। যে মানুষ বেঁচে থাকবে সে আমাকে কখনো দেখবে না।

আমি আপনাকে সশরীরে দেখতে চাই নি মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার একটা রূপ দেখতে চাইছি। আমি কাউকে না দেখে ভাল করে কথা বলতে পারি না মহামান্য গ্রাউল। না দেখে কথা বললে মনে হয় আমি তার উপাসনা করছি।

বেশ। তুমি আমাকে কী রূপে দেখতে চাও? পুরুষ না রমণী?

আপনার যা ইচ্ছে।

প্রায় সাথে সাথেই ঘরের মাঝামাঝি সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধকে দেখা গেল। শরীরে আলগোছে একটি চাদর জড়ানো, সেখান থেকে এক ধরনের নরম আলো বের হচ্ছে। মাহমতি গ্রাউলের এই রূপটি দেখে আমার প্রাচীন গ্রন্থের দেবদূতের কথা মনে পড়ল। এটি সত্যিকারের কোনো মানুষ নয় কিন্তু রূপটি এত জীবন্ত যে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি আর লেন মাথা নত করে অভিবাদন করে বললাম, আপনাকে অভিভাদন। আমাদেরকে একটি শান্ত সমাহিত রূপে দেখা দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

তুমি এখন কী বলতে চাও বল।

আমার কথাটি বলার আগে আমার একটু ভূমিকা দেয়ার প্রয়োজন। আপনার সময় অত্যন্ত মূল্যবান কিন্তু তবুও আমি একটু সময় ভিক্ষা চাইছি।

সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ মানুষটি আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি। তুমি বল।

আপনি এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। এর মূল নক্সা আপনার, খুঁটিনাটি সব কিছু আপনার। দীর্ঘ সময় নিয়ে এটি মহাকাশে তৈরি হয়েছে। একসময় এটি পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে। মানুষ যখন কিছু একটা সৃষ্টি করে তার এক ধরনের আনন্দ হয়। সাধারণ মানুষ সৃষ্টি করে সাধারণ জিনিস তার আনন্দটুকু হয় সাধারণ। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনার সৃষ্টিও তাই সাধারণ নয় এবং সেটা সৃষ্টি করে আপনি যে আনন্দটুকু পেয়েছেন সেই আনন্দও নিশ্চয়ই অসাধারণ। আপনার সেই তীব্র আনন্দের অনুভূতি আমরা কল্পনাও করতে পারব না।

এই মহাকাশযান যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে আপনি সেখানে স্থান করে নিয়েছেন। এই মহাকাশযানের সৌভাগ্য, মহাকাশ অভিযাত্রীদের সৌভাগ্য আপনি তার নেতৃত্ব দিতে রাজি হয়েছেন। সেই নেতৃত্বটুকু এসেছে গোপনে। সাধারণ মানুষের কাছে আপনার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। তাদের ধারণা মূল তথ্যকেন্দ্র এই মহাকাশযানকে চালিয়ে নিচ্ছে মহাকাশ দিয়ে। বহুদূরে পৃথিবীতে।

যখন মহাকাশযান পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ করে আপনি আবিষ্কার করলেন আপনার আর কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ শীতল ঘরে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে পারে, আপনার ঘুমানোর সুযোগ নেই। আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড আপনার জটিল বহুমুখী মস্তিষ্ক স্তরের নানা অংশে রক্ত সঞ্চালন করে। আপনি প্রতি মুহূর্তে সজীব, প্রতি মুহূর্তে কর্মক্ষম। সাধারণ মানুষের চোখ রয়েছে। কান রয়েছে, নাক, মুখ, ইন্দ্রিয় রয়েছে। শারীরিক বা আধা শারীরিক আনন্দের সুযোগ রয়েছে। আপনার সমস্ত কার্যকলাপ বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে। আপনি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন আপনি নিঃসঙ্গ।

আমি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে বললাম, আমি কি ভুল বলেছি মহামান্য গ্রাউল?

মহামতি গ্রাউল এক মুহূর্ত নীরব থেকে বললেন, না। তুমি ভুল বল নি কিহা।

আমি কি আরো একটু বলব?

বল।

আমাদের, সাধারণ মানুষের নিঃসঙ্গতা সাধারণ। সেটা দূর করার জন্যে আমরা সাধারণ কাজ করি। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনি তাই সাধারণ কাজ করতে পারেন না। আপনি ঠিক করলেন সময় কাটানোর জন্যে একটা কৌতুক করবেন। কিছু বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের সাথে বুদ্ধির কোনো একটা খেলা খেলবেন। এমনি-এমনি আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বেছে নিতে চাইলেন না। আপনি ঠিক করলেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিবেন। তাই একদিন। মহাকাশযানের সব মানুষকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করলেন। তাদেরকে হানাহানি শুরু করতে দিলেন, তাদেরকে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ করতে দিলেন। আপনি ঠিক করলেন যারা সবচেয়ে উপরে উঠে আসবে আপনি তাদের বেছে নিবেন।

মহামতি গ্রাউলের মুখ ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছিল, আমি হঠাৎ বুকের ভিতরে ভয়ের এক ধরনের কম্পন অনুভব করি। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তুমি কেমন করে এসব জান?

আমি কিছু জানি না মহামতি গ্রাউল। সব আমার অনুমান। আমার অনুমান ভুল। হতে পারে। যদি হয় আপনি আমার ভুল ধরিয়ে দেবেন মহামতি গ্রাউল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, আমার অনুমান কী ভুল হয়েছে মহামতি গ্রাউল?

হয় নি। বল তুমি কী বলতে চাও। তোমার দীর্ঘ ভূমিকা তুমি শেষ কর। আমার ভূমিকা প্রায় শেষ মহামতি গ্রাউল। আমি এক্ষুনি বলব আমি কী চাই। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আশা আকাঙ্খ সাধারণ। আমাদের স্বপ্নও সাধারণ। আপনি সাধারণ নন, আপনার আশা আকাঙ্খও সাধারণ নয়। আপনার কল্পনাও সাধারণ নয়। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। সেটা কল্পনা করতে পারি না। আপনার ছোট একটি খেয়ালে মাহকাশযানে শত শত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হাজার হাজার মানুষকে স্বার্থপর লোভীতে পাল্টে দেয়া হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে মহামতি গ্রাউল।

লেন হঠাৎ করে আমার কনুই খামচে ধরল। আমি সাবধানে তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহামতি গ্রাউলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তার মুখমণ্ডল ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠল, তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং একসময়ে থমথমে গলায় বললেন, তুমি কীভাবে এর অবসান ঘটাতে চাও?

আপনি এই মহাকাশযানটির কতৃত্ব মহাকাশযানের মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিন।

আর যদি না দিই?

আপনাকে দিতে হবে মহামতি গ্রাউল। মহাকাশযানের সমস্ত মানুষের কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে এটি পৃথিবীতে যাচ্ছে, কিন্তু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছি নক্ষত্রপুঞ্জ তার ঠিক জায়গায় নেই। ভেগা নক্ষত্র অনেক উপরে, কালপুরুষ বাম দিকে সরে রয়েছে। আপনি এই মহাকাশযানকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন।

মহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, তিনি সেই হাসি গোপন করার চেষ্টা না করে বললেন, আমি তোমার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তোমার বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই নিনীষ স্কেলে আট এর কম নয়।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন কিন্তু সেটার কোনো অর্থ নেই মহামতি গ্রাউল।

আমি যদি তোমার অনুরোধ মহাকাশযানের কতৃত্ব মানুষের হাতে না দিই তুমি কী করবে কিহা?

আমি বুকভরা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, আমি আপনাকে হত্যা করতে বাধ্য হব মহামতি গ্রাউল।

মহামতি গ্রাউল বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। লেন আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, হায় ঈশ্বর। হায় পরম করুণাময় ঈশ্বর।

মহামতি গ্রাউলের হাসি না থামা পর্যন্ত আমি চুপ করে রইলাম, তারপর নিচু গলায় বললাম, মানুষের স্বাভাবিক হিসেবে আপনি একজন উন্মত্ত দানব ছাড়া কিছু নন। আমি যদি আজ ব্যর্থ হই অন্য কোনো একজন আপনাকে হত্যা করবে। আপনাকে হত্যা করে এই মহাকাশযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

ঘরের মাঝামাঝি মহামতি গ্রাউলের যে প্রতিচ্ছবিটি ছিল সেটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করে, তার আকার আরো বড় হয়ে আসে এবং গায়ের রং পরিবর্তিত হতে থাকে, একটু আগে যেটিকে শান্ত সৌম্য একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে সেটা সত্যিই যেন দানবের রূপ নিতে শুরু করে। লেন শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখে আবার ফিস ফিস করে বলল, রক্ষা কর ঈশ্বর তুমি। রক্ষা কর। রক্ষা কর।

মহামতি গ্রাউলের গলার স্বরে একটা ধাতব প্রতিধ্বনি শোনা যেতে থাকে। তিনি খনখনে গলায় বললেন, কিহা, আমি তোমার সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সাহস পুরোপুরি মানবিক অনুভূতি। শুধুমাত্র মানুষ সাহস নামক ব্যাপারটি দেখাতে পারে। পশুরা পারে না। রবোর্টরাও পারে না। তার কারণ এটি পুরোপুরি যুক্তিহীন এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। তবে তোমার সাহসের একটি পুরস্কার আমি দেব। তোমাকে আমি আমার নিজেকে দেখতে দেব। দেখ আমি দেখতে কেমন!

সাথে সাথে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল এবং আমারা যে স্বচ্ছ মেঝের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে আলো জ্বলে ওঠে। সেখানে বিশাল একটি স্বচ্ছ পাত্রে এক ধরনের তরল পদার্থে থলথলে একটা জিনিস কিলবিল করতে থাকে সেখান থেকে শিরা উপশিরা বের হয়ে গিয়েছে। তাকে ঘিরে আটটি হৃদপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করে তার মাঝে রক্ত প্রবাহিত করে যাচ্ছে সেই রক্তের স্রোত পাশে পুষ্টি এবং অক্সিজেন ট্যাংকের ভেতর দিয়ে চলে আসছে। সমস্ত দৃশ্যটি একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো, দেখে লেন একবার আর্ত চিৎকার করে উঠল।

আমি মহামতি গ্রাউলের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমার দেহ–যদি সেটাকে দেহ বলতে চাও, যেভাবে রক্ষা করা আছে এর উপরে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালেও কিছু হবে না। তোমরা যে আটটি হৃদপিণ্ড দেখতে পাচ্ছ এখন আমরা সেগুলি পাল্টে দেব আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড দিয়ে। এই মুহূর্তে তার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে

না। আমি শক্ত গলায় বললাম, আপনি সেটা করবেন না মহামতি গ্রাউল। আটটি শিশুর হৃদপিণ্ডে আমরা বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছি। আমি সেগুলি যে কোনো মুহূর্ত বিস্ফারিত করে দিতে পারি কিন্তু আমি করব না। আমি মানুষ, মানুষ অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু শিশু হত্যা করতে পারে না। আপনি আপনার নিরাপত্তার জন্যে কখনই সেই হৃদপিণ্ড ব্যবহার করবেন না। প্রায় অদৃশ্য সেই বিস্ফোরক রক্তস্রোতে মিশে আপনার মস্তিষ্কে যেতে পারে। কিংবা কে জানে মহামতি হিংস্র গলায় বললেন, কে জানে কী?

কে জানে সেই বিস্ফোরকে ভয়ংকর কোনো ভাইরাস রয়েছে কী না সেই ভাইরাস আপনার রক্তকে দূষিত করে দেবে কিনা–

যেভাবে নিচে আলো জ্বলে উঠেছিল ঠিক সেভাবে আলো নিভে গেল এবং আবার আমরা আমাদের সামনে মহামতি গ্রাউলকে দেখতে পেলাম। তার চেহারায় এক ধরনের বিকৃতি হয়েছে ভয়ংকর একটা দৃষ্টিতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের অশুভ অসহায় আতংক অনুভব করতে থাকি। মহামতি গ্রাউল হিংস্র গলায় বললেন, তোমরা কীভাবে আমাকে হত্যা করতে চাও?

আমরা নই। আমি। আমি আপনাকে বুদ্ধি দিয়ে হত্যা করতে চাই।

বুদ্ধি দিয়ে?

হ্যাঁ মহামতি গ্রাউল। আমি জানি আপনি মিয়ারাকে এনেছেন। আমি জানি মহাকাশযানের অন্য ছয়জন নেতাও এখানে আছে। আপনি তাদের সাথে সময় কাটাবেন, কোন একটি বুদ্ধির খেলা খেলবেন। আমি চাই–আমি এক মুহূর্তের জন্যে থামলাম।

মহামতি গ্রাউল বললেন, তুমি চাও–

আমি চাই আপনি অন্য ছয়জনের সাথে আমাকে যুক্ত করবেন। আমিও আপনার সাথে সেই ভয়ংকর খেলায় অংশ নিতে চাই। অন্যদের সাথে আমিও আপনার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে চাই।

মহামাতি গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তিনি তীব্র চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বললেন, তুমি কেমন করে জান তারা আমার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত?

আমি জানি না মহামতি গ্রাউল, কিন্তু আমি অনুমান করছি। আমি জানি আপনার চোখ নেই, কান নেই, বাইরের জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। অন্য এক বা একাধিক মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগের আপনার একটি মাত্র উপায়, এক সাথে যুক্ত করে দেয়া। সেই মস্তিষ্ক আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ হয়ে থাকবে। আপনি তাকে পীড়ন করবেন। আমি জানি মহামান্য গ্রাউল। আপনি একজন দানব ছাড়া আর কিছু নন।

মহামতি গ্রাউল একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমার দুঃসাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তুমি স্বেচ্ছায় আমার মস্তিস্কের সাথে যুক্ত হতে চাও?

চাই মহামান্য গ্রাউল। আপনাকে আমি ধ্বংস করতে চাই।

তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?

আমি জানি না পারব কি না। কিন্তু আমাকে চেষ্টা করতে হবে। মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আপনি মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে তৈরী কিন্তু আমি জানি না আপনি মানুষ কী না।

তুমি কীভাবে আমাকে হত্যা করবে?

আমি আপনাকে এখন বলব না। যদি আপনি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হন। তাহলে আপনি জানবেন।

আর যদি না হই?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে আমার কিছু করার নেই। সম্ভবত আপনি তাহলে এখন আমাদের হত্যা করবেন। আমি একটু অপেক্ষা করে বললাম, যদি সত্যিই আমাদেরকে হত্যা করেন আমি আশা করব আপনি আমাদের কয়েক মুহূর্ত সময় দেবেন। আমি আমার সাথে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইব তারপর বিদায় নেব। এবং

এবং কী?

এবং তাকে বলব যদি সত্যিই আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে আমি তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলতাম, লেন তুমি কি আমাকে তোমার জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে?

মাহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে তিনি এক ধরনের কোমল গলায় বললেন, লেন তুমি তাহলে কী বলবে?

লেন কোন কথা বলল না, আমাকে শক্ত করে ধরে হঠাৎ হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল। আমি তাকে বুকে আকড়ে রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললাম, লেন, এক মুহূর্তের ভালবাসা আর এক যোজনের ভালবাসার কোন পার্থক্য নেই। ভালবাসা ভালবাসাই। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

মহামতি গ্রাউল এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর শান্ত গলায় বললেন, কিহা। আমি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলাম। তোমার মস্তিষ্ককে আমি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করব। তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমান। তোমার মরণ খেলাটি দেখার আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।

আমি খুব সাবধানে আমার বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম। এই মহাকাশযান মহামতি গ্রাউলের থাবা থেকে হয়তো শেষপর্যন্ত রক্ষা করা যাবে। বুড়ো লী যেভাবে বলেছিল সেভাবে, শক্তিশালী যন্ত্রের সাথে যেভাবে দাবা খেলতে তার নিয়মে। যন্ত্র প্রস্তুতি নেয় নিখুঁত একটি খেলার যেখানে কোন ভুল হয় না, তার সাথে খেলতে হয় নির্বোধের মতো যে নির্বুদ্ধিতা আসলে সুপরিকল্পিত। আমিও তাই করছি, যে বুদ্ধির খেলায় মহামতি গ্রাউল আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়েছে সেটি আমাকে খেলতে হবে না। কারণ আমার মস্তিষ্কে কিটুনিয়া ভাইরাসের ছোট একটা ক্যাপসুল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। মুক্ত এলাকা থেকে আমি দুই হাজার ইউনিট দিয়ে কিনেছিলাম। ক্যাপসুলটি নির্দিষ্ট সময় পরে নিজে থেকে ফেটে বের হয়ে আসবে, কিলবিল করে ছড়িয়ে যাবে মস্তিষ্কে, নিউরন সেলকে ধ্বংস করে বাড়তে থাকবে প্লাবনের মতো, দেখতে দেখতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমার মস্তিষ্ক! নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহামতি গ্রাউলের মস্তিষ্ক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মিয়ারার মস্তিষ্ক–অন্য সবার মস্তিষ্ক যারা যারা যুক্ত হয়েছে এই বিশাল মস্তিষ্ক স্তরে। মহামতি গ্রাউলকে ধ্বংস করার জন্যে যে পদ্ধতিটি আমি বেছে নিয়েছি সেটি আসলে বুদ্ধিহীন নির্বোধ একটা প্রক্রিয়া। বুদ্ধির খেলায় তাকে পরাজিত করার সেই দুঃসাহস কার আছে?

আমি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে লেনের দিকে তাকালাম। লেন আমার মস্তিষ্কের কিটুনিয়া ভাইরাসের কথা জানে না, সে তাই অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

বিশাল এই মহাকাশযানটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়ার একটি মাত্র উপায়, মহামতি গ্রাউল নামের দানবটিকে ধ্বংস করা। আমাকে তাই করতে হবে, আমার নিজের প্রাণ দিয়ে। সৃষ্টি জগতের ইতিহাসে সেরকম অসংখ্য আত্মত্যাগের কথা লেখা আছে একজন বা একাধিক মানুষ হাসিমুখে প্রাণ দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, বিশাল জনপদ নগর রক্ষা করেছে দেশকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এই মহাকাশযানের ইতিহাস যখন লেখা হবে সেই ইতিহাসে আমার কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করা হবে, কীভাবে আমি মহামতি গ্রাউল নামের একটি দানবকে ধ্বংস করে পৃথিবীর মানুষকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। সেটা অনেক বড় করে ব্যাখ্যা করা হবে। আমার বুকের ভেতর এখন আত্মত্যাগের এক মহান পরিতৃপ্তির অনুভূতি হওয়ার কথা।

কিন্তু আমার ভিতরে এক গভীর বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। এক ভয়ংকর শূন্যতা আমার বুকের ভিতর হুঁ হুঁ করে বইতে থাকল। আমার না দেখা পৃথিবী নয়, ফেলে আসা গ্রহটি নয়, বিস্ময়কর এই মহাকাশযানটি নয়, সৃষ্টিজগৎ এবং তার বিশাল রহস্য নয়, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চোখের একটি মেয়ের ভালবাসা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সেই গভীর বেদনায় আমার সমস্ত হৃদয় সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আসতে থাকে।

কিন্তু আমি আমার মুখে একটা আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটিয়ে রাখলাম, আমি জানি মহামতি গ্রাউল তার সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছেন।