শেষ রাতে পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়েছে, পুলিশ এসেছে। বাড়ি গিজগিজ করছে লোকে। মন্মথ ডাক্তার এসে হরিকৃষ্ণের ক্ষতস্থান ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে নতুন করে ব্যান্ডেজ বাঁধছে। সকলেই আতঙ্কিত।
এই গণ্ডগোলে পুতুল আর অবু চুপিসারে নীচে নেমে এসে গজাননের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পুতুলের হাতে একটা ডল পুতুল।
“গজাননদাদা!”
“কী বাবা?”
“তুমি জেগে আছ?”
“হ্যাঁ বাবা, আমার ঘুম আসছে না।”
“তুমি তো জানো না গজাননদাদা, আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল।”
গজানন ধীরে ধীরে আরামকেদারায় উঠে বসল। বলল, “জানি বাবা। আমার দুতেরা আমাকে খবর দিয়ে গেছে।”
পুতুল কান্না চাপতে-চাপতে বলল, “কর্তাবাবাকে, দাদুকে, আমার বাবা আর জ্যাঠাকে খুব মেরেছে। কর্তাবাবাকে ছুরি মেরেছে, গলাও কাটতে যাচ্ছিল।”
গজানন মাথা নেড়ে বলল, “হায় হায়! তোমাদের বড় বিপদ হল তো!”
“হ্যাঁ গজাননদাদা। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। ওরা ভীষণ খারাপ লোক।”
অবু বলল, “গজাননদাদা, ওরা কেন এসেছিল জানো? তোমার সেই কৌটোটা কেড়ে নিয়ে যেতে।”
গজানই মাথা নেড়ে বলল, “হায় হায়। সেটা গেলে আমার আর কিছু করার থাকবে না! আমি যে বড় দুর্বল হয়ে যাব।”
“কৌটোটা ওরা নিয়ে গেছে গজাননদাদা।” গজানন ফের ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। বলল, “তা হলে আমার আর কিছু করার নেই। কিছু করার নেই।”
অবু বলল, “কেন গজাননদাদা, তোমার কী হবে?”
গজানন মৃদুস্বরে বলে, “জানি না বাবা। আমার কৌটোটার জন্য তোমাদের কত বিপদ গেল। তোমরা কত কষ্ট পেলে।”
পুতুল এক-পা এক-পা করে কাছে গিয়ে গজাননের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “শোনো গজাননদাদা, আমরা কিন্তু বোকা নই। আমরা আন্দাজ করেছিলাম তোমার কৌটোটা আমাদের স্টোর রুমের সিন্দুকেই আছে। কারণ পুরনো জিনিসপত্র সব ওখানেই থাকে। তাই আমি আর মেজদা মিলে বুদ্ধি করে গভীর রাতে উঠে কর্তাবাবার তোশকের তলা থেকে চাবি নিয়ে গিয়ে সিন্দুক খুলি। তোমার কৌটোটা একটা পুরনো পুঁথির সঙ্গে লাল শালুতে জড়ানো ছিল। কৌটোটা আমি এনে আমার পুতুলের বাক্সে লুকিয়ে রেখে দিই। ভেবেছিলাম সকালে তোমাকে এনে দেব। কিন্তু মাঝরাত্রে ডাকাত পড়ল। আমরা ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম ডাকাতরা সবাইকে কীরকম নিষ্ঠুরভাবে মারছে। কৌটোটার জন্য ওরা আমাদের সবাইকে কেটে ফেলবে বলেও ঠিক করেছিল। তখন আমি গিয়ে কৌটোটা বের করে ওদের দিয়ে দিই।”
“ভালই করেছ বাবা। প্রাণের চেয়ে তো আর কৌটোটা বড় নয়!”
“না গজাননদাদা, আমি অত বোকা নই। আমি তার আগে কৌটোটা খুলে ফেলি। দেখি তার মধ্যে তোমার কালো নস্যির গুঁড়ো রয়েছে। আমার একটা ফাঁপা পুতুল আছে, যার মুণ্ডুটা ঘোরালে খুলে যায়। ভেতরটা কোটোর মতো। আমি পুতুলের ভেতরে গুঁড়োটা ঢেলে নিই। তারপর ঠাকুমার কালো মাজনের খানিকটা কৌটোয় ভরে মাণ্ডুককে দিয়ে দিই। সে একটুও বুঝতে পারেনি।”
গজানন উজ্জ্বল হয়ে বলল, “তোমার আশ্চর্য বুদ্ধি বাবা!”
ডল পুতুলটা বাড়িয়ে দিয়ে পুতুল বলল, “এই নাও তোমার নস্যি।”
পুতুলটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল গজানন। তার মুখে এক আশ্চর্য আলো ফুটে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
“তুমি কাঁদছ কেন গজাননদাদা?”
“একটা দুষ্ট লোকের জন্য কাঁদছি। সে কিছুতেই ভাল হতে চায় না। তাকে আমি মারতে চাইনি কখনও। কিন্তু কী যে করি!”
“কেঁদো না গজাননদাদা। তোমার নস্যি তো পেয়ে গেছ। আমাদের কাছে থাকো। আমরা তোমাকে খুব ভালবাসব।”
“জানি বাবা, জানি। তোমরা বড় ভাল। কিন্তু দুষ্টু লোকটা কি তোমাদের শান্তিতে রাখবে? খুঁজতে খুঁজতে সে এল বলে!”
“সে কি আবার আসবে?”
“হয়তো আসবে। কে জানে কী হবে!”
“এই দুষ্ট লোকটার নাম মাণ্ডুক। তুমি ওকে চেনো?” মাথা নেড়ে গজানন বলে, “না বাবা, চিনি না। কিন্তু সে ভাল লোক নয়। তার বুকে মায়াদয়া নেই, শুধু জ্বালা আছে।”
পুতুল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “সে যদি আবার এসে আমাদের মারে?”
“না বাবা, সে তোমাদের মারবে না। সে এবার আর একজনকে মারবে। তোমরা গিয়ে ঘুমোও, নিশ্চিন্তে ঘুমোও।”
.
শাসন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে যখন পৌঁছল তখন রায়বাড়ির ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। দু-একজন ছাড়া কেউ নেই। সদর দরজা ভাঙা দেখে বিস্মিত শাসন ওপরে উঠে চারদিকে অবস্থা দেখে বুঝল কী হয়েছে।
গন্ধর্ব বলল, “শাসনবাবু যে!”
“মহাশয়, এসব কী?”
“কাল রাতে সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে।”
“মহাশয়, বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করুন।”
গন্ধর্ব ঘটনাটা সংক্ষেপে বিবৃত করে বলল, “গজাননের কৌটোটা আমার মেয়ে যদি বের করে না দিত তা হলে আমাদের সবাইকে কেটে ফেলত লোকটা।”
“মহাশয়, ঘটনাটা সাধারণ নহে। একটি প্রাচীন কৌটার জন্য এত হিংস্রতা অস্বাভাবিক। কিছু বুঝিতেছেন?”
মাথা নেড়ে গন্ধর্ব বলে, “না। কৌটোটার মধ্যে কী ছিল তাও জানি না। লোকটা একবার কৌটোটা খুলেছিল। দুর থেকে মনে হল কালোমতো কী যেন। হিরে-জহরত নয়। কিন্তু আপনাকেই বা এমন ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন?”
শাসন তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বলল, “মহাশয়, বিপদ এখনও কাটে নাই।”
“কেন ওকথা বলছেন?”
“আমার মনে হইতেছে বাতাসে একটা দ্বৈরথের আয়োজন ও প্রস্তুতি চলিতেছে। ক্ষেত্র প্রস্তুত হইতে আর বিলম্ব নাই।”
“কীসের দ্বৈরথ! কার সঙ্গে কার?”
“এক প্রাচীন কিংবদন্তির সহিত এক জিঘাংসার।”
“এ তো হেঁয়ালি!”
“না মহাশয়, হেঁয়ালি নহে।”
“একটু বুঝিয়ে বলুন।”
“বলিলেও আপনার বিশ্বাস হইবে না। আপনার কন্যাটিকে একবার ডাকিয়া পাঠাইলে ভাল হয়। দুই-একটা প্রশ্ন করিব।”
গন্ধর্ব পুতুলকে ডাকিয়ে আনল। একটু ভয়ে-ভয়ে সে এসে দাঁড়াল।
শাসন তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, “তুমি গত রাত্রে সকলের প্রাণরক্ষা করিয়াছ। মা, কৌটাটি তুমি কোথায় পাইলে?”
“সিন্দুকে ছিল।”
“কৌটাটি কাহার, তাহা জানো?”
“জাদুকর গজাননের!”
“কীরূপে জানিলে?”
“শুনেছি।”
“জাদুকর গজানন কে, তা জানো মা?”
“সে একজন ভাল লোক।”
“ভাল লোক! মা, তুমি কি তাহাকে দেখিয়াছ?”
“না তো!”
“তবে কীরূপে জানিলে যে, সে ভাল লোক?”
পুতুল গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার মনে হয়।”
“মা, গজানন নামে এক ব্যক্তি এই স্থানে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়ায়। সে সম্ভবত আসল জাদুকর গজানন নহে। সম্ভবত ছদ্মবেশী কোনও অসাধু লোক।”
পুতুল মাথা নেড়ে বলল, “আমি তাকে চিনি না। আমাদের গজানন ভাল লোক।”
শাসন বিস্মিত হয়ে বলে, “তোমাদের গজানন?”
পুতুল জিভ কেটে চুপ করে গেল।
“তোমাদের গজানন কীরূপ? শ্মশ্রুগু আছে কি?”
পুতুল ফিক করে হেসে এক ছুটে পালিয়ে গেল।
শাসন কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে রইল।
গন্ধর্ব বলল, “কী বুঝলেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাসন বলল, “মহাশয়, যাহা বলিতেছি তাহা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করুন।”
“বলুন, শুনছি।”
“আমার অনুমান, পুতুল গজাননের সন্ধান জানে। সম্ভবত এই বাড়ির শিশু, বালক-বালিকারা সকলেই জানে। কিন্তু তাহারা কিছুতেই গজাননের সন্ধান আমাদিগকে দিবেনা। মহাশয়, আপনারা দয়া করিয়া প্রাপ্তবয়স্কেরা উহাদের উপর চাপ দিয়া কোনও কথা আদায় করিবার চেষ্টা করিবেন না। শুধু চতুর্দিকে নজর রাখিবেন।”
গন্ধর্ব বলল, “গজাননকে ওরা কোথায় পেল? আমরা তো তার দেখা পাচ্ছি না।”
“এমনও হওয়া বিচিত্র নহে, এই বাড়ির কোনও চোর কুঠুরিতেই সে এখন অবস্থান করিতেছে। কিন্তু মহাশয়, তাহাকে না উত্তেজিত করাই মঙ্গল। শিশুরাই তাহার সহিত যোগাযোগ রক্ষা করুক।”
“বলছেন কী মশাই! যদি সে কোনও জোচ্চোর হয়?”
মাথা নেড়ে শাসন বলল, “না মহাশয়, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কহিতেছে আপনার শিশুকন্যা ভুল করে নাই।”
“আপনি কি বলতে চান এই গজাননই সেই গজানন? লোকটা দুশো বছর বেঁচে আছে?”
“মহাশয়, যাহা ঘটে তাহা বিশ্বাস না করিবেন কেন?”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“তাহা হইলেও কোনও অবিমৃশ্যকারিতা করিবেন না। মনে রাখিবেন মাণ্ডুক এক ভয়ানক ব্যক্তি। তাহার হাত হইতে আমাদের নিস্তার নাই। কারণ, সে গজাননকে না-পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হইবেনা। সম্ভবত মাণ্ডকই মেঘনাদবাবু। যদি তাহার হাত হইতে রক্ষা পাইতে চান তাহা হইলে গজাননই একমাত্র ভরসা। কথাটা মনে রাখিবেন।”
“আপনি তো চিন্তায় ফেলে দিলেন মশাই!”
“চিন্তা ও উদ্বেগেরই বিষয়।”
“শাসনবাবু!”
“আজ্ঞা করুন।”
“আমি বলি, আপনার এখন নিজের বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ নয়। কাল আপনার বাড়িতে হামলা হয়েছে। আপনি বরং দু-একদিন আমাদের বাড়িতে থাকুন। আমাদের ঘরের অভাব নেই।”
শাসন একটু হাসল, “প্রস্তাবটি উত্তম। আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, অতিথি হইতে বিশেষ আপত্তি নাই। প্রস্তাবটি গ্রহণ করিলাম।”
শাসনকে নীচের তলার বৈঠকখানায় থাকতে দেওয়া হল। দুপুরে খাওয়ার পর সে বাগানটা দেখতে বেরোল। সঙ্গে গন্ধর্ব।
পেছনের পাঁচিলের কাছে এসে গন্ধর্ব বলল, “পাঁচিলের ওই জায়গায় নাকি গজানন উঠে বসে ছিল। আমার বাবা দেখেছে।”
“এই সু-উচ্চ প্রাচীর, তাহাতে আবার লৌহশলাকা ও কাঁচ প্রোথিত। ইহার উপর কোনও স্বাভাবিক মনুষ্যের উপবেশন অসম্ভব। মহাশয়, লেভিটেশন বলিয়া একটা কথা আছে।”
“জানি। ওসব গাঁজাখুরি।”
“প্রাচীনকালে সাধকরা বায়ুবন্ধন করিয়া শূন্যে কিছুদূর উখিত হইতে পারিতেন বলিয়া শুনা যায়। কত বিদ্যাই চর্চার অভাবে বিনষ্ট হইয়াছে।”
“ওসব বিশ্বাসযোগ্য নয়।” শাসন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজিকালি কেহই কোনও কথা বিশ্বাস করিতে চাহে না।”
খুব ভোর রাত্রে শাসন চুপিচুপি উঠল। সদর দরজা নিঃশব্দে খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ধীর পায়ে বাড়িটি পরিক্রমা করতে লাগল। চোখে শ্যেন দৃষ্টি। সে প্রত্যেকটা জানলা লক্ষ করতে করতে এগোচ্ছিল। যদি কোনও আভাস পাওয়া যায়!
আচমকা একটা খোলা জানলার পাশে থমকে দাঁড়ায় সে। নীচের তলায় কেউ থাকে না বলে সব জানলাই বন্ধ, শুধু একটাই ভোলা। কাছে গিয়ে সন্তর্পণে ভেতরে উঁকি দিল শাসন। প্রথমে অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে যাওয়ার পর সে লক্ষ করল ঘরের ভেতরে একটা আরামকেদারা। তার ওপর সামান্য উচ্চতায় শুন্যে ভেসে একজন শুয়ে আছে।
চমকৃত শাসন কিছুক্ষণ নড়তে পারল না। তারপর হঠাৎ তার দু’চোখ ভরে জল এল। সে বিড়বিড় করে বলল, “আমার প্রণাম গ্রহণ করুন হে জাদুকর। আমরা সামান্য মনুষ্য, আপনার মর্ম কী বুঝিব?”
হঠাৎ কয়েকটা হনুমান হুপ-হুঁপ করে গাছে-গাছে লাফঝাঁপ করতে লাগল। চমকে উঠে শাসন যেই পেছন ফিরতে যাবে অমনি একটা ভারী শক্তিমান হাত তার ডান কাঁধের ওপর এসে পড়ল।
একটা চাপা হিংস্র গলা বলল, “এবার কে তোকে বাঁচাবে?”
শাসন ফিরেই রাক্ষসের মুখটা দেখতে পেল।
শাসনের কেন যেন একটুও ভয় হল না। সে পিছু ফিরে লোকটার মুখোমুখি হয়ে চোখের জল হাত দিয়ে মুছে একটু হেসে বলল, “আপনি মেঘনাদবাবু, মাণ্ডুক?”
লোকটা মুখোশের আড়াল থেকে তাকে দেখছিল। বলল, “তাতে তোর কী দরকার?”
“মহাশয়, যেই হউন, আপনি মন্দ লোক। মন্দ লোকেরা তাহাদের কার্যের জন্য শাস্তি ভোগ করিবেই। আপনারও রক্ষা নাই মহাশয়। সময় থাকিতে এখনও সতর্ক হউন, জিঘাংসা পরিহার করুন।”
হনুমানগুলো প্রচণ্ড শব্দ করতে লাগল। কয়েকটা ঢিল এসে পড়ল তাদের আশপাশে।
বিশালদেহী লোকটা হয়তো শাসনকে ছিঁড়ে ফেলত, কিন্তু হঠাৎ জানলার দিকে চেয়ে সে স্থির হয়ে গেল। শাসন ফিরে তাকিয়ে দেখল, জানলায় জাদুকর গজানন এসে দাঁড়িয়েছে। মুখটায় যেন আলো জ্বলছে। বিড়বিড় করে গজানন বলছে, সেই মুখ, সেই চোখ, সেই আকৃতি! রাজা মঙ্গলের মতো। হুবহু। কিন্তু তা কী করে হবে? কী করে হবে?
লোকটা একটা বিশাল রণহুঙ্কার দিয়ে উঠল। তারপর বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল, “জাদুকর গজানন!”
ভভারের আলো ফুটিফুটি করছে। কাক ডাকছে। পাখিরা উড়াল দেওয়ার মুখে। হনুমানদের তীব্র চিৎকারে চারদিক মথিত হতে লাগল।
মাণ্ডুক বা মেঘনাদ ফের রণহুঙ্কার দিয়ে বলল, “জাদুকর গজানন, এইবার ঋণ শোধ করো। বহুঁকাল ধরে অপেক্ষায় আছি।”
দুটো প্রবল হাতের টানে জানলাটা ফ্রেম থেকে উপড়ে এনে ফেলে দিল মাণ্ডুক। কোষবদ্ধ তলোয়ার বের করে ফের বজ্রনির্ঘোষে বলল, “এসো কাপুরুষ!”
বাড়ির লোকেরা জেগে দ্রুত নেমে আসছে। ঘুম ভেঙে লোকজন ছুটে আসছে চারদিক থেকে। কাল রায়বাড়িতে ডাকাত পড়ায় তারা সতর্কই ছিল।
জানলা দিয়ে ধীরে বেরিয়ে এল গজানন। ভেসে-ভেসে এল। এসে দাঁড়াল মাণ্ডুকের সামনে। ডান হাতটা তুলে সে বিড়বিড় করে বলল, “না, তুমি মঙ্গল নও।”
“আমি তার বংশধর। রাজা মঙ্গলের ঋণ শোধ নেওয়ার জন্যই আমি জন্মেছি। আমি মাণ্ডুক।”
হতাশায় ভরা মুখে গজানন বলল, “দুই-ই এক। আমার আর ইহজীবনে শান্তি হল না।”
মাণ্ডুক তার তলোয়ারটা তুলে আড়াআড়ি বিদ্যুতের গতিতে চালিয়ে দিল গজাননের গলায়।
গজানন শুধু মাথা নাড়ল। তার গলার ভেতর দিয়ে তলোয়ার চলে গেল বটে, কিন্তু কিছুই হল না।
বিস্মিত মাণ্ডুক ক্ষণেক বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে বিদ্যুৎ গতিতে গজাননকে খণ্ড খণ্ড করে দিতে তরোয়াল চালাতে লাগল।
কিন্তু কিছুই হল না।
এবার তলোয়ার ফেলে মাণ্ডুক লাফিয়ে পড়ল গজাননের ওপর। গলা টিপে ধরল। গজানন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু। বিস্মিত মাণ্ডুক তার চোখ উপড়ে নেওয়ার জন্য চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। মুগুরের মতো দুই হাতে অজস্র ঘুসি মারল।
চারদিকের লোক প্রথমে ভয়ে চিৎকার করছিল। কিন্তু তারাও বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেছে।
মাণ্ডুক হাঁফাচ্ছে। তার চোখ বড় বড়। রাগে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।
“মরো গজানন, মরো।”
গজানন শান্ত কণ্ঠে বলে, “আমার কি মরণ আছে?”
“তোমাকে মরতেই হবে!”
মাণ্ডুক কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে গজাননকে পরপর দু’বার গুলি করল। কিছুই হল না। গজাননকে ছুঁয়ে গুলিগুলো গিয়ে পেছনের দেয়ালে বিধল।
হঠাৎ গজাননের চোখে একটা নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল যেন! একটু দুলে সে শূন্যে ভেসে রইল একটুক্ষণ। তারপর সমস্ত শরীরটা হঠাৎ ঋজু হয়ে একটা বল্লমের মতো তীব্রগতিতে গিয়ে পড়ল মাকের ওপর।
মাত্র একবারই। মাণ্ডুক মাটিতে পড়ে একটু ছটফট করে নিথর হয়ে গেল।
গজানন সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর চারদিকে চেয়ে বিস্মিত মুখ আর বিস্ফারিত চোখগুলি দেখল সে। সবাই হাঁ করে তার দিকে চেয়ে আছে।
গজানন মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, “এর শেষ নেই। এর কোনও শেষ নেই। বারবার শেষ হয়, আবার হয়ও না।”
সে চারদিকে ফের চেয়ে দেখল। তারপর বলল, “চলি বাবারা।”
হঠাৎ পুতুল ছুটে এসে তার হাত ধরল, “কোথায় যাচ্ছ গজাননদাদা? আমার কাছে থাকবে না?”
“না খুকি, আমাকে ঘরে রাখতে নেই।”
“তুমি কোথায় যাবে গজাননদাদা?”
একটু ম্লান হেসে গজানন বলল, “কোথাও কোনও পাহাড়ের গুহায় গিয়ে শুয়ে থাকব, হয়তো কয়েকশো বছর। কে জানে! আবার হয়তো ডাক আসবে। না বাবা, আমি জানি না। আমি জানি না।”
গজানন ধীরে ধীরে হেঁটে, একটু ভেসে-ভেসে চলে যেতে লাগল। ফটক ডিঙিয়ে, মাঠ পেরিয়ে ঢেউয়ের মতো চলে যাচ্ছিল সে। অনেক দূর থেকে একবার হাত তুলল। তারপর হাওয়ায় ভেসে-ভেসে কাটা ঘুড়ির মতো টাল খেতে-খেতে ক্রমশ বিন্দুর মতো ছোট হয়ে গেল। তারপর মুছে গেল যেন। কোনও চিহ্নই আর রইল না তার।
গন্ধর্ব বিড়বিড় করে বলল, “মহাশয়, আপনাকে প্রণাম করি।”