সপ্তম পরিচ্ছেদ – পাখির ঠোঁটে খড়
রায়দিঘির ছাতিমগাছের নীচে দাঁড়িয়েছিল শরদিন্দু। জল তখন নেমে গেছে মাঠ থেকে। সরকারি টেস্ট রিলিফের মজুরেরা মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে খালটা গভীর করে রেল লাইনের পারে ক্যানেলের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। মাঠে বন্যার স্বাক্ষর এখন অস্পষ্ট। ফার্মের যন্ত্রপাতি অনেক নষ্ট হয়েছে, অনেক অক্ষত আছে। তবে মেরামত করে পার্টস বদলে নিয়ে আবার ঠিক হয়ে যাবে। ল্যাবরেটরির কিছুই পাওয়া যায়নি। মজুত মাল ছিল সামান্যই। কিছু উদ্ধার করা হয়েছিল।
শরদিন্দুর উদাস চোখে চেয়ে দেখছিল বিকেলের শান্তশীতল রোদ্দুরে ভরা মাঠের করুণ হাসি। ঝাব্বু সিং তলিয়ে গিয়েছিল। খুঁজে পাওয়া যায়নি তার দেহ। হয়তো কোথায় শেয়াল শকুনে তার অস্থিটুকুও অবশিষ্ট রাখেনি। কালের দেবতার বিচার বলে যদি কিছু থাকে, ঝাব্বু সিং যদি সেই শাস্তিই পেয়ে থাকে, কোনো সময় ভাবে শরদিন্দু (প্রমত্ত বন্যাজলের নীচে ঝাব্বুর প্রত্যেকটি রুদ্ধ—যন্ত্রণা অসহায়—স্পন্দন সে অনুভব করেছে। এলোকেশীকে ঠিক সেই যন্ত্রণাই ঝাব্বু দিয়েছিল।) তারও শাস্তি কি এভাবেই হয়ে গেল।
নদেচাঁদ একেবারে রেললাইনে গিয়ে উঠেছিল। উদ্ধারকারী নৌকো তাকে বাঁচায়। মুকুন্দ শরদিন্দুর পেছনেই উঠে এসেছিল। সে বাড়ি চলে গেছে। সম্ভবত আর ফিরে আসবে না।
নিঃসঙ্গ শূন্য জীবন। আর কিছু ভাবতে ভালো লাগে না। ওদিকে অর্ধেন্দু ইলেকশানের জন্যে ভয়ানক তোড়জোড় চালাচ্ছে। সব সময় ডেকে পাঠাচ্ছে তাকে। ভালো লাগে না শরদিন্দুর। টেস্টরিলিফ চলেছে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলব্যাপী। স্টেশন—সোনাডাঙা—হাইরোডের অনুমোদন এতদিনে এসেছে।
টেস্টরিলিফের মজুর দিয়ে উঁচু করে বাঁধানো হচ্ছে রাস্তাটা। বাঁধের দুপাশে পাথরের গাঁথুনি তোলা হচ্ছে। মাটির কাজ শেষ হলে আরম্ভ হবে পাথর খোয়া আর পীচ ঢালাই। হাইরোড থেকে ইলেকট্রিক লাইনের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে চণ্ডালিকা স্টেশন হয়ে ঝিকটিপোঁতা অবধি। ওখানে পাওয়ার স্টেশনটা মিউনিসিপ্যালিটি বন্ধ করে দেবে। মাঠে লম্বা লম্বা খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। কাঁটাতারে জড়ানো খুঁটির সঙ্গে একখানা করে লোহার ফলক বাঁধা। তাতে আঁকা একটা মড়ার মাথা—নীচে দুখানা আড়াআড়িভাবে অস্থি। লেখা আছে, এগারো হাজার ভোল্ট। সাবধান!
শরদিন্দুর কিছুই ভালো লাগে না।
সুঁদিপুর ভেসে গিয়েছিল। শ্রীনিবাসের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায়ই আসে সে। স্বভাবমতো অনেক আশা আর উৎসাহের কথা শোনায়। শরদিন্দু কান দেয় না। স্নায়ু থেকে সে—রাত্রির কদর্য স্মৃতি কিছুতেই ঘোচাতে পারে না সে। কো—অপারেটিভ গড়তে আর কোনো অসুবিধে নেই। কাজল জানিয়েছে—শরদিন্দুবাবু যা ভালো বোঝেন, করবেন। তবু শরদিন্দু কেমন নিরুৎসাহ বোধ করে।
মৃন্ময়ী এল। বন্যার পর ওরা দুজন অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। নিঃসংকোচ হয়েছে মৃন্ময়ী। শংকরীপ্রসাদও নির্বিকার। নির্বিকার চণ্ডালিকার মানুষ। বন্যা যেন তাদের রক্তের মধ্যে এক রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। ঐতিহাসিক এই বন্যা। মানুষের খানিক বিশ্বাস থাকা ভালো। কেননা, যারা শরদিন্দু—মৃন্ময়ীর কেচ্ছা গাইবে কিংবা শুনে সুখী হবে, তারা যেন শরদিন্দুর এই পরাজয় আর অসহায়তার দিকে চেয়ে বড় সমব্যথী। অহরহ সে—প্রমাণ পাচ্ছে সে। দিনমান আসে পরগনার চেনা—অচেনা লোকেরা। দুঃখ প্রকাশ করে যায়। অতি উৎসাহীরা মাঠে নেমে গিয়ে পুরনো ক্যাম্পের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পস্তায় তারা। মানুষের মানবিকতার পরিমাণটা হয়তো নব্বুই শতাংশ। শরদিন্দু অঙ্ক করে বের করেছে। তার কীর্তি সমগ্র মানুষের অখণ্ড কীর্তি বলে গ্রহণ করেছে জনসাধারণের অবচেতনা।
মৃন্ময়ী এল। খুশি হল ওকে দেখে সে। এই নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আর এই নির্জনতার ভার থেকে মৃন্ময়ী তাকে মুক্তি দিতে পারে না।
বলল শরদিন্দু, এসো। বড় একা বোধ করছিলুম।
—একেবারে ভেঙে পড়ছেন দিনে দিনে। মৃন্ময়ী বলল।
—কী জানি!
—বৈজ্ঞানিক মানুষ। এই সামান্য আঘাতেই সব শেষ? মৃন্ময়ী তামাশায় গলে পড়ে।
—তুমি পারতে?
—নিশ্চয়।
—মিনু!
—বলুন।
একটু পরে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল শরদিন্দু। বলল, বসো এখানে। বসল দুজনে। সেদিন তোমার কথা শুনিনি। আজ মনে হচ্ছে, সত্যি বাইরে চলে যাই।
—কেন? মৃন্ময়ী হেসে এলিয়ে পড়ল।
—তোমার হিতার্থে অবশ্যি নয়। স্বীয় হিতার্থে।
—হয়তো চলে। কিন্তু এ মাঠকে আর বিশ্বাস করতে পারছিনে।
—মাঠের তো প্রাণ নেই যে এত অবিশ্বাস। তাকে শায়েস্তা করুন।
—অত আমি জানিনে। দেখুন গে, নতুন বাঁধ হচ্ছে। নতুন পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ইলেকট্রিক আলো। আপনি আবার ক্যাম্প খুলে বসুন। নিশ্চিন্তে দুটো নন্দীভৃঙ্গী জোগাড় করে নিন আবার।
—ভরসা পাইনে।
—কেন?
—মনে হয় এ মাঠ থেকে যাদের আমরা বঞ্চিত করেছি, এ বুঝি তাদের কান্নার অভিশাপ।
উচ্ছ্বাসে লুটোপুটি খেল মৃন্ময়ী। বাব্বাঃ, স্রেফ একখানা কাব্য। বৈজ্ঞানিক বুঝি বানের জলে ডুবে মরেছেন।
—ডুবে মরাই উচিত ছিল মিনু।
মৃন্ময়ীর হাসি ফুরুলো। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল চোখে চোখ রেখে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল বুঝি। শরদিন্দু টের পেল সেটুকু। তাই কথার মোড় ফেরাতে চাইল সে। ওসব কথা থাক। তোমাদের খবর বলো। তোমরা তাহলে সত্যি চলে যাচ্ছ?
মিনুর সহজ মন ফিরে এসেছে। দুষ্টুমি করে চোখের পাতা নাচাচ্ছে সে। বলল, আটকাচ্ছে কে?
—যদি আমি আটকাই?
—কীসের জোরে? শারীরিক শক্তি দিয়ে, না আবার ঝামেলা বাধিয়ে?
মুখ একটু এগিয়ে আনল শরদিন্দু। ঝুঁকে পড়ল মৃন্ময়ীর মুখের কাছে। বলল, আমার অবশিষ্ট জীবনের মূল্য দিয়ে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়ী। আজকাল খুব কবিতা লিখছেন বুঝি। এগোল সে। সঙ্গে সঙ্গে শরদিন্দুও।
মৃন্ময়ী ঘুরে দাঁড়াল। বেড়ানো শুরু হয়ে গেল এরি মধ্যে?
—তোমার সঙ্গে যাওয়া কি অপরাধ?
স্মিত জাফরান রং পশ্চিম দিগন্তে। গোধূলির ছায়া ঘনিয়েছে পৃথিবীতে। সেই অস্পষ্ট আলোয় মৃন্ময়ীর চোখ। কী রহস্য সে চোখে? অদ্ভুত অজানা দৃষ্টি।
—মিনু! যেতে যেতে আবার ডাকল শরদিন্দু।
আকাশে বুনোহাঁসের পাখার স্পন্দনধ্বনি। মৃন্ময়ী শান্তচোখে তাকিয়ে আছে।
শরদিন্দু আরও এগিয়ে তার হাত ধরল।
—মিনু, এক সময় যখন ফসলের মাঠে সবুজ গুচ্ছ গুচ্ছ শিষের দিকে তাকিয়ে থাকল, কেন জানি না, শুধু একটি মেয়ের মুখই ভেসে আসত বারবার। কে সে, তাকে খুঁজতাম। সেই যেন ছিল আমার সব সাধনার শেষ লক্ষ্য। আজ মনে হচ্ছে, এতদিনে তাকে পেয়েছি। এবার ফের মাঠে নামতে আমার দ্বিধা নেই।
কলকাতার পথে পথে ঘুরে কাজল আর রতনের সন্ধান করছিল ছকুলাল। দিনের পর দিন রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকত। দিনে খুঁজে বেড়াত। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকত।
তবু খুঁজে পেল না। অনাহারে অনাদরে দিনে দিনে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল। একদিন হঠাৎ গভীর রাতে সে স্বপ্ন দেখল ওলাংকে। অনেকদিন পরে। তখনই সে আকুল হয়ে উঠল। ফিরে চলল দেশের পথে।
বিনোদীয়ায় নামল ছকুলাল। ধুঁকতে ধুঁকতে ঢুকল অম্বিকার বাড়ি। উঠোনে পা দিয়ে ডাকল, ওলাং। কোনো সাড়া নেই। আবার ডাকল, ও ওলাং, আমি এসেছি। আকস্মিক ঘূর্ণীবাতাসে একরাশ শুকনো পাতা ওর শরীর ছুঁয়ে গেল।
—কে, কে তুমি? রক্তচক্ষে ঘর থেকে বেরিয়েছে অম্বিকা। কে বটে তুমি?
—আমি, আমি ছকু হে অম্বিকেদা, তুমার সম্বন্দী। চণ্ডালিকের ছকুলাল।
—বেরোও, বেরোও বাড়ি হতে। স্বার্থপর, অমানুষ, পাপ! কীজন্যে এখানে এসেছ, কীজন্যে? ছুটে এসে টুঁটি চেপে ধরে অম্বিকা। ঝাঁকুনি দেয়। ছকুলাল হাঁসফাঁস করে।
—কেনে, কেনে অম্বিকেদা? আমি কোলকাতায় ছিলাম গো, সেই যে সেই কোলকাতায়। ছেলের সন্ধানে যেইছিলাম। কাজল বাসা বদল করেছে তা জানায়নি। ছাড়ো অম্বিকেদা, শরীলে দম নাই, ছাড়ো। এই, আঃ! আমাকে মেরোনা অম্বিকেদা! গতবছর সাঁতুই অঘ্রান যেয়েছিলাম। অনেকদিন ছিলাম। খুব কষ্ট পেলাম। খুঁজে না পেয়ে আবার চলে এলাম। অম্বিকার কঠোর হাতের মধ্যে আহত পাখির ডানার ঝাপটানি।
—ইবার এলাম আমি। ওলাংকে লিতে এলাম। আর ছেলার জন্যে ভাবব না অম্বিকেদা। আর ভাবব না। ইবার ওলাংকে লিয়ে চণ্ডালিকে যাব।
আস্তে আস্তে হাত শিথিল হয় অম্বিকার। ছকুলাল মুখ তুলে দেখে অম্বিকার গাল ভেসে যাচ্ছে নীরব অশ্রুতে।
—ওলাংকে ডাকো। ডেকে দ্যাও। এক্ষুনি যাব অম্বিকেদা। ওলাং, ও ওলাং!
অম্বিকা তাকায় ছকুলালের পানে। ভাই গায়েন!
—অমন কচ্ছ কেনে অম্বিকেদা? অমন কচ্ছ কেনে তুমি?
—ওলাং নাই ভাই গায়েন।
—নাই? কতি গেল? তুমার গায়ে পড়ি অম্বিকেদা। বিরূপ কথা করো না।
—গতবছর সাতুই অঘ্রান…
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, উদিন ওলাং লাইনে মাথা দিয়ে মরেছে ভাই গায়েন। অম্বিকা তাকে জড়িয়ে ধরে একবার সশব্দে কেঁদে ওঠে। ছকুলাল আস্তে আস্তে বসে পড়ে। শ্রীধর স্বর্ণকারের মেয়ে আর ওলাং। রেলপথের দুটো লাইন, বাসরের সেই মধুগন্ধ রাতে যা বলেছিল ওলাং।
—একটা পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছিল গত আশ্বিনে। অবিকল তুমার মতো চেহারা, অবিকল অমনি নাক মুখ চোখ। তুমার মতো লম্বা আঙুল। অমনি অক্তবন্ন শরীল। ম’ল কী বেধিতে কে জানে! মায়ের পেট হতে পড়ে তিনদিন বেঁচেছিল।
শান্তস্বরে বলে ছকুলাল, তুমি দেখেছিলা?
—হ্যাঁ। ছেলেটা বাঁচলে ও মত্তোনা, তাই মনে লাগে ভাই গায়েন।
খানিক নীরবতা। এবার ধুলোয় ঝড় এল দমকে দমকে। রাঢ় দেশের বিশুষ্ক রক্তাভ মৃৎচূর্ণ অঙ্গে মেখে গৈরিকবাস সন্ন্যাসীর মতো। বুকে হাত চেপে ধরে কাশে ছকুলাল। একটু রক্ত হাতে। অম্বিকা শিউরে ওঠে। গায়েন।
—রাজবেধি ভাই।
—তুমি থাকো ইখেনে। আমি তুমার চিকিচ্ছে করাবো। সিবার যে বড়ো ডাক্তোরকে লিয়ে যেইছিলাম, খুব ভালো ডাক্তোর গায়েন, উর কাছে চিকিচ্ছে করাবো তুমাকে।
কোনো কথা না বলে ওঠে ছকুলাল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। অম্বিকে এসে সুমুখে দাঁড়ায়। এই ওদবাতাসে ঘুরবা গায়েন? বিকেলের গাড়ি ধরিয়ে দেব। এখন চান—আহার করো। শান্ত হও!
—না ভাই। আমাকে আটকো না আর। কতকাল গাঁয়ের মুখ দেখিনি।
—গায়েন!
—না অম্বিকেদা।
খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকে ছকুলাল। তিনক্রোশ পথ। জীবনের স্ফটিকটুকু বুঝি হাতছাড়া হয়ে যায়। এত কাছে এসে আর খোয়াতে চায়না ছকুলাল। লাইনের পথ ধরে হাঁটতে থাকে খরার রোদ্দুর ঝাঁঝালো বাতাসের মধ্যে দিয়ে টলতে টলতে।
—তুমার চোখের ভুল গায়েন, চোখের ভুল তুমার।
—না বিন্দু, নিজের চোখ আমার। আপন চোখ।
বসন্তের নখাঘাতে বাঁ চোখটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। ডানচোখ চেপে ধরে বাড়ি ঢোকে ছকুলাল। রাত্রির অন্ধকারে শিমুলগাছে শকুনের পরিচিত শব্দ। ওরা যাবে না, ওরা অজর অমর অক্ষয় তার জীবনে। খুঁজে খুঁজে চাবিটা পায় চালের বাতায়। মাকড়সার জাল সরিয়ে তালা খোলে। আঃ কী চেনা মিষ্টি গন্ধ! নাথুলাল—আমোদিনী, তুফানী—সুবালতা—আদর—ওলাং সেই অন্ধকারে শুয়ে ঘুমুচ্ছে এসে। সেখানে লুটিয়ে পড়ল ছকুলাল।
দেয়ালে তারছেঁড়া একতারাটা এখনও ঝুলছে। হয়তো মাকড়সার জাল তাকে ঘিরে ধরে আছে নিবিড় সোহাগে।
ঘুমোবে ছকুলাল। ঘুমের—মৃত্যুর—শান্তির মাকড়সাটা এসে জাল বুনে বুনে ধূসরভাবে ঢেকে ফেলবে পাপী গায়েনের শরীরটা।
বাইরে অনেকদূরে একটা কুকুর ডেকে উঠেছে। সেই ঘেয়ো ভাগাড়চরাটা? ভাবতে ভাবতে ঘুমোয় ছকুলাল।
সকালে ভীড় জমাল পড়শীরা। অনেক দুঃখের অনেক আনন্দের সংবাদ আদান প্রদান হল। জমির কথা শুনে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল ছকুলাল। রাখোরাজার আদরের দাসদাসী ছিল বাবা—মা, তাদের ছেলেকে তো জমি দেবেই। মহাপুরুষ বটে। প্রণাম করে ছকুলাল।
ওলাং—এর সংবাদ এরা জানে। এলোকেশী বলল, এখন তুমি তো বড়লোক গায়েনদা। ইবার আনন্দ করে স্যাঙা করো। ঘরসংসার করো আর ভাবনা কী তুমার?
ছকুলাল নীরবে মাথা নাড়ল!
—সুদাংকে লিয়ে হারুদা নিজের দ্যাশে যেয়েছে গো।
—ভালো, ভালো।
—উদের বাড়িটা সুদ্ধু কিনে লাও বাছা। একই মেলান জায়গা। বড় করে বাড়ি বানাও একখানা।
—অতন বড় হচ্ছে উর। বিহা দিবে। ঘরে বউমা আসবে আঙা টুকটুকে।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা হবে বইকি বাছা।
—বিন্দু এসে তুমার খোঁজ লেয় মধ্যে মধ্যে।
—বিন্দু?
—হ্যাঁগো। তুমার উপর এখনও মমতা কত উল্লাস?
—এ্যাঁ। সত্যি নাকিন বাছা?
—বিন্দুর কাছে যাবে সে।
বন্যায় সুঁদিপুরের ঘরবাড়ি সব ভেঙে গিয়েছিল। নতুন করে বানানো হচ্ছে সব। কেবল বিন্দুর ভিটে একটু উঁচুতে বলে অক্ষত আছে। গাবগাথে বোশেখের অভ্ররোদ ঝকমক করছে। গতি বাড়ে পায়ে। স্পন্দন বাড়ে বুকে।
—বিন্দু, ও বিন্দু, বিন্দুবাসিনী!
—কে? দৌড়ে বেরোয় বিন্দু। অনেক শুকিয়ে গেছে। একেবারে বদলে গেছে চেহারা।
—আমি এসেছি বিন্দু। আমি এসেছি।
মায়ের কোলে হারিয়ে যাওয়া ছেলে ফিরে এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। বিন্দু তাকে ধরে ফেলে।
—এলাম বিন্দু, তুমার কাছে এলাম। ইবারে এট্টা ভয়ানক কথা বলতে এলাম, বুজেছ? ইকথা তুমি ছাড়া কারে বা বলি, কারে শোনাই বলো!
বিন্দু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সুখেশ্বরীও বিন্দুকে ধাক্কা দেয়, আ মর, হাত ধরে পাথর হলি যে দিদি! ঘরে লিয়ে যা! আহা, মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মারছে গো মানুষে আর বেধিতে!
বিন্দু হাত ধরে টানে—ঘরে এসো গায়েন। সব শুনব।
দুজনে সারারাত ধরে জেগে আছে। ছকুলাল তার কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়নোর কাহিনী শোনাচ্ছে। বিন্দু নীরবে শুনছে কিংবা শুনছে না। একসময় হঠাৎ সে গায়েনের চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠেছে। সেবার প্রদর্শনী মেলার রাতে শোনা অবিকল সেই কণ্ঠ। কী বলবে ছকুলাল?
—বিন্দু!
—বলো।
—জানো, এক অবাক কাণ্ড করেছিলাম? ওলাংয়ের জন্যে লালশাড়ি বেলাউজ কিনে বিলের জলে বেসজ্জন দেইছিলাম। চোখের ভুল আমার। তুমি ঠিকই বলেছিলে।
বিন্দু ঈষৎ নড়ে উঠে। বলে,—কোন ঠাঁইটাতে গায়েন?
দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে বিন্দু।
—কী হল বিন্দু?
জলভরা চোখ তুলে শান্তস্বরে বলে বিন্দু—সিগুলান আমি পেইছিলাম গো। নোংরা বলে ফেলে দিইছিলাম ঘেন্নায়।
লাফিয়ে উঠে ছকুলাল! বিন্দুর হাত ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে,—একখিলি পান ছিল দ্যাখোনি?
—আগে যদি জানতাম গায়েন….মৃদুকণ্ঠে বিলাপ করে বিন্দু।
—সিটায় কারুর ঠোঁট আঙা হল না বিন্দু!
আবার নীরবতা। সন্ধ্যার অস্পষ্ট আঁধারে দুটি নরনারী স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সুখেশ্বরীর দেওয়া শোলমাছটা হাঁড়ির ভেতর কেবল হৃৎপিণ্ডে রক্ত ছকে উঠার মতো সশব্দে নড়ে উঠেছিল।
হঠাৎ প্রচণ্ড কাশতে থাকে ছকুলাল। হাতভরে রক্ত নামে। প্রদীপের ম্লান আলোতে বিন্দু দেখেও দেখে না। রতিকান্ত, তুমারই নীলে ইটা। তুমিই আমার মনে ঘেন্না জন্মে দিইছিলে! রতিকান্ত তুমি কেনে অমন করছ? রতিকান্ত তুমি জীবনটা আমার কেবলই নিষ্ফল করে চলছো—কী সুখ পাও তুমি? নির্জনতার অদ্ভুত ভাষায় কী কথা বলছে রতিকান্ত। শোলমাছটা আবার লাফিয়ে উঠেছে। বিন্দু হঠাৎ বলে—কাল সকালেই তুমি কি চলে যাবে গায়েন? সত্যি বলছ?
—যাবো। আমি যে পাপ বিন্দু, যিখানে যাবো সব ভস্ম হয়ে যাবে। তাই মায়ের পেটের বোনও আমার মুখ দেখলে না। ছেলা আমাকে বাবা বললে না।
খুব ভোরেই উঠে পড়ে ছকুলাল। দ্যাও বিন্দু, একটি লাঠিগাছ দ্যাও। কাল দারুণ ওদ্দুরে হেঁটে শরীর কেলান্ত। বিন্দু নিঃশব্দে লাঠি এগিয়ে দেয়। চুপ করে থাকে সে।
টলতে টলতে এগোয় ছকুলাল। পেছন ফেরে একবার। বলে—চলি বিন্দু!
বিন্দু মুখ ফিরিয়ে বলে—এসো।
আবার হাঁটে ছকুলাল। আবার পেছন ফেরে হাসি মুখে—চণ্ডালিকে যাবে না বিন্দু কোনোদিন?
—যাবো।
—গেলে দেখা করে এসো। আসবে তো?
কথা বলে না বিন্দু। ছকুলাল চলতে থাকে। একমুহূর্ত। ওর শরীরটা পাঁচিলের আড়ালে মিশে যায়। বিন্দু নড়ে না। সকালের নির্মেঘ আকাশ। সবটুকু নীল এক জায়গায় জমে আছে। গাব গাছের পাতায় পরিচ্ছন্ন আলোর ঝিকিমিকি। বিন্দু কিছু দেখে না। শুধু ওই কথাটুকু বলতেই গায়েনের আসা? শুধু ওই তুচ্ছ কথাটুকু—বিন্দুকে যা না—শোনালে সে স্বস্তি পেত না? হতভাগিনী বিন্দু ফের একটা আশা করে বসেছিল—সে আশায় ফের ছাই দিয়ে চলে গেল ছকুলাল!
শত্তুর, শত্তুর! বিন্দু হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে—শত্তুর! কাকে বলে কে জানে!
অতটুকু পথ। তবু পৌঁছতে দুপুর। বারবার বসতে হয়েছে। কেশেছে। রক্ত উঠেছে। নিশ্বাস ঘন হয়েছে, রুদ্ধ হতে চেয়েছে। ফুসফুসটা ফেটে হৃৎপিণ্ড ভেঙে রক্ত গুঁড়ো গুঁড়ো ছিটকে পড়বে মনে হয়েছে। অথচ এ তো শুধু পথ। ঘর নয়। তাই, ওঠ, হাঁটো, পৌঁছাও। বিন্দুকে যা বলতে গিয়েছিল, যে গোপন খবরটি শোনাতে চেয়েছিল, তা বলা হয়ে গেছে। একজিবিশনের মেলায় নিভৃতে ডেকে যে কথা শুনিয়েছিল, তা মিথ্যে, নিতান্ত চোখের ভুল। এটুকু জানিয়ে দেওয়ার পর এবার মন ভারমুক্ত হয়েছে তার। তালা দেওয়া ছিল না। শেকল খুলে ঘরে ঢুকল ছকুলাল। মেঝেটা খড়িতে বিচিত্তির। একটু হাসল সে। কারা এসে বাঘবন্দি খেলে যায়। ঝাঁট দেয়, তালাই বিছিয়ে শুয়েও থাকে কেউ। আর হয়তো বনমালীরাও আসে, আসে টগরবালা—ওলাং বলে যাকে সে ভুল করেছিল।
দেয়ালে একতারাটা ঝুলছে। তাড়াতাড়ি পেড়ে নিয়ে ছেঁড়া তারটি বাঁধতে বসে ছকুলাল। বুকে জড়িয়ে ধরে বারে বারে। গুনগুনিয়ে সুর তুলতে চায়।
সুর তুলতে চায় বুকের ভেতর থেকে ফুলের মতো। হৃদয়ের বোঁটা থেকে রক্ত রাঙা সুরের ফুল। আর সুর আসে না, আসে রক্তের পিণ্ড। মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের উপর একতারাটা ধরে রাখে ছকুলাল। একমুহূর্ত থামে। কান পাতে উঠোনের শিমুলগাছে শকুনের ডানার শব্দ শুনবে বলে।
শোনে কিংবা শোনে না। আবার ঝংকার দেয়! বেসুরো ঝংকারে চরম গান গাইতে চায়। রক্তের নদী জেগে গানের পথে।
ও ওলাং, তুর জন্যে গান গাইব এট্টা।
ছকুলাল গায়েন ওলাংয়ের জন্যে গান বাঁধতে থাকে। আর ঠোঁটের দুপাশে গানের সুরের সঙ্গে রক্তের ধারা বয়ে যায়।
এত দীর্ঘ রাত্রি! কেন যে ফুরোয় না! যেন বুকের উপর শকুনের মতো নখ বাগিয়ে চেপে রয়েছে। ভাগ্যের ধন হাতে এসেছিল, কেন মুঠো চেপে ধরে রাখল না সে?
বিন্দু আর শুয়ে থাকতে পারল না। অলক পাশেই শুয়েছে আজ। উঠে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখল ছেলের মুখ। তারপর উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল।
ভোর হতে দেরি। অনেক দেরি। ভাগ্যের ধন হাতের মুঠোয় এসেছিল,—ধরে রাখতে পারল না, সেই হার—স্বীকারের জ্বালায় বিন্দু হঠাৎ অধীর।
ঝড়ের মাতন লাগে শরীরে। শরীর ঝড়েওড়া পাখির মতো কেঁপে উঠে। বিন্দু ছুটে চলে পথ বিপথ না মেনে। বাঁকী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভেজা কাপড়ে ভেজা শরীরে উড়ে চলে বিন্দুবাসিনী।
দরজা খোলাই ছিল।
—গায়েন ও গায়েন।
অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিন্দু।—আমিও এলাম গায়েন। আমি থাকতে পারলাম না।
অন্ধকার থেকে জেগে উঠে ক্ষুধিত স্বর।—বিন্দুবাসিনী!
তারপর বুকে বুক মিশিয়ে থাকে দুটি অন্তহীন ক্ষুধা। খানিক পরে বলে ছকুলাল—আমার অন্তিম ইচ্ছে বিন্দু।
—না, না। মুখে হাত চেপে ধরে বিন্দু। রক্তে হাত ভরে যায়।
—হ্যাঁ বিন্দু।
আবার গভীর মৌন। বাইরে অন্ধকার সরে গেছে। ফুটেছে ভোরের স্নিগ্ধ রক্তরাগ।
—গায়েন, হরিনাম করো।
ছকুলাল কথা বলে না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ। ঘরের মধ্যে অস্পষ্ট আলো জেগে উঠেছিল। বাইরে দূরে কোথায় সানাই বাজছিল।
—দরজা খুলে দ্যাও।
—খোলা আছে। ভয় পেয়ো না গো। আমি আছি গায়েন, ভয় পেয়ো না।
—তুমার কোলে মাথা আখতে দেবে?
বিন্দু তার জানুতে ছকুলালের মাথা তুলে নেয়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি ভাষাহীন। ছকুলাল বলে—দরজা খোলা আছে বিন্দু?
—হ্যাঁ, খোলা আছে।
খোলা আছে। খোলা ছিল এতদিন। শুধু পথ খুঁজে পায়নি। পেল এতক্ষণে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে। বিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছকুলাল বলল—জেবন আমার সার্থক বিন্দু।
সার্থক হয়েছে জীবন। একটি পুরুষের জীবন—যা নারীর জন্যে, নারীর প্রেমের মূল্যে পৌঁছায় তার অন্তিমে। নারীর জঠর থেকে পুরুষের প্রেমের স্বাক্ষর হয়ে বেড়ে ওঠা। বাইরে আসা, প্রতীক্ষা করা ওই একটি উন্মুক্ত দরজার জন্যে। শিশু হল কিশোর, কিশোর হল যুবা। প্রস্তুতির পর এল সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। নারীর প্রেম পেয়ে চলল নির্বাণের পথে। অথচ যখনই খুলল কপাট, স্পর্শ করল সেই গুপ্তধন, শরীর হয়ে উঠল গুরুভার। শরীর হল শীতার্ত পৃথিবীর মতো ধূসর, কুঞ্চিত, নীল। জরা এল। স্থবিরতা ঘনালো কুয়াশার মতো পাণ্ডুর আয়ুর সীমানায়। তখন আমি প্রৌঢ়। তারপর আমি বৃদ্ধ। নারীর ভালোবাসার ভারে ন্যুব্জ দেহে আয়ুষ্কাল অতিক্রম করলাম টলতে টলতে। এই তো পুরুষের জীবন। নারীর জন্যে—নারীর প্রেম পাবে বলে ফুলের মতো ফুটে ওঠা।
দরজা খোলা থাক। বুকের গহন থেকে শেষবারের মতো একটা রক্তাক্ত ফুল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। দূরে শংকরীপ্রসাদের বাড়ি থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে আসে। বিন্দু শোনে। শোনে আর গায়েনের ধূসর ঠান্ডা মুখের দিকে তাকায়।
সেই আশ্বিনের বিকেলে চণ্ডালি বিলের শরবনে খুঁজে পাওয়া রক্তাক্ত এই পুরুষের শরীর, কী রক্তাক্ত। ভার নামল এবার। রক্তের দাগ এবার নিঃশেষে মুছে যাবে অঙ্গের আবরণ থেকে। হালকা হয়েছে বিন্দুবাসিনী। প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।
মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। আর দেখল ভারমুক্ত নীল নিঃসীম আকাশের পথ বেয়ে চলেছে শালিক পাখিরা। তাদের হলুদ ঠোঁটে যেন স্বর্ণময় তৃণখণ্ড। চেতনার তীব্রতায় জরোজরো ক্ষুধিত সেই সব পাখিরা। আজ সবাই নীড়াভিমুখী।