দোলের দিনটা এগিয়ে এল যেন ঘোড়ায় চেপে।
হাবু গুণ্ডা যে ছাড়া পাবে, সে-খবর পাঁচকান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কারো আর জানতে বাকি নেই।
হাবু যত পাজিই হোক, এ শহরে কিছু লোক আছে যারা হাবুর পরম ভক্ত। তারা মনে করে-হাবুর যে সব অলৌকিক শক্তি দেখা গেছে, সেরকমটা শুধু বড় বড় মহাপুরুষদের থাকে। কাজেই হাবু চুরি-ডাকাতি যাই করুক, এসব লোকদের কাছে সে সাক্ষাৎ ভগবানের ছোট ভাই।
এইরকমই একজন হল পাঁচকড়ি আঢ্য। একসময়ে সে ‘হাবু ওস্তাদের পাঁচালি’ নামে একখানা চটি-বইও বের করেছিল। তাতে ছিল, “প্রথমে বন্দনা করি দেব মহেশ্বর। তার পরেতে বন্দি আমি সর্ব চরাচর ॥ বড় সুখে পূজি আমি বাগদেবীর চরণ। মাতাপিতার চরণে দেই সর্ব প্রাণমন ॥ উত্তরেতে হিমালয় দক্ষিণেতে বন। তার মধ্যে কত গ্রাম গঞ্জ অগণন ॥ গঞ্জের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ভ্যাটাগুড়ি ধাম। যেথায় বসতি করেন হাবু পুণ্যবান ॥“
এরপর পাঁচালিতে পাঁচকড়ি আরও লিখেছিল, “গুণাকর হাবুর গুণের নাই শেষ। পলকে মনুষ্যে ধরি করি দেয় মেষ ॥ ব্যাঘ্র বাহন আর ভূতপ্রেতের সঙ্গ। নিশি দারোগা ভাগে রণে দিয়া ভঙ্গ। অয়স্কান্ত বীরত্ব দেখাতে এসেছিল। হাবু ওস্তাদ কৌশলে তারেও তাড়াইল ॥ অবশেষে হেলেদুলে আসিল গদাই। গুণাকরের কোপে শেষে তারও রক্ষা নাই।“
একসময়ে এই পাঁচালি হাটে-বাজারে বয়ে ফিরত পাঁচকড়ি। গদাই দারোগার হাতে হাবু জব্দ হওয়ার পর সে কিছু মিইয়ে যায়।
বহুদিন বাদে আবার হাবু ফিরে আসছে শুনে তার একগাল হাসি দেখা গেল। রাম কবিরাজের সঙ্গে একদিন দেখা করে বলল, “কবরেজমশাই, শুনেছেন নাকি! হাবু দেবতা আবার ফিরে আসছেন। যারা তাঁকে হাজতে পাঠিয়েছিল, এবার তারা ঠ্যালা বুঝবে, কী বলেন ঠাকুর?”
রাম কবিরাজের সঙ্গে হাবু কী জানি কেন কোনোদিন তেমন ঝামেলা করেনি। কিন্তু কবিরাজমশাই নিজে গিয়ে যখন হাবুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন, তখন হাবু আদালতেই বলে উঠেছিল, “কাজটা ভাল করলেন না রামদা।”
কথাটা কবিরাজমশাইয়ের মনে আছে। তিনি তেতো মুখ করে পাঁচকড়িকে বললেন, “মানুষকে খামোকা দেবতা বানাচ্ছ কেন? হাবু আর যাই হোক, মানুষই বটে।”
পাঁচকড়ি জিভ কেটে বলে, “ছি ছি, ওকথা বললে পাপ হয়। তাঁর ক্ষমতা স্বয়ং ভগবানের মতো।”
“তাই যদি হবে তো জেল থেকে বেরোতে পারল না কেন মন্ত্রের গুণে?”
“সে তার লীলা। আমি একবার হাজতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে কী দেখলাম জানেন? তাঁর কপালে সিঁদুরের ত্রিশূল, অ্যাই বড় জটা হয়েছে চুলে, চোখ রক্তবর্ণ। আর সেপাই থেকে শুরু করে জেলার সাহেব পর্যন্ত দিনরাত তাঁর সামনে হাত জোড় করে আছেন। শয়ে-শয়ে লোক এসে তাঁর . ভোগের জন্য মণ্ডা মেঠাই, তরিতরকারি, মাছ-মাংস দিয়ে যায়। জেলের সবাই তাঁর প্রসাদ পায়। আমাকে বললেন, “ওরে পাঁচকড়ি, হাজতে ক’দিন থেকে একটু চিত্তশুদ্ধি করছি।”
“ভগবানেরও তাহলে চিত্তশুদ্ধির দরকার হয় বলছ?”
পাঁচকড়ি রেগে গিয়ে বলে, “অবিশ্বাস করছেন? এই বলে রাখছি কবিরাজমশাই, আপনারা কেউ নিস্তার পাবেন না।”
পাঁচকড়ি বিদায় হলে রাম কবিরাজ নিজের মনে খানিক চিন্তা করলেন। তারপর বোধহয় থানামুখো রওনা দিলেন।
থানায় নতুন দারোগা এসেছে। অল্পবয়সী ছোঁকরা, কথায়-কথায় ফটাফট ইংরিজি বলে ফেলে। ছোঁকরা খুব একটা খারাপ মানুষ নয়, তবে কিনা কাজেকর্মে এখনো তেমন পোক্ত হয়ে ওঠেনি।
কবিরাজমশাই হাবুর কথা তুলতেই ছোঁকরা দারোগা শম্ভুচরণ বলে ওঠে, “ওঃ, দ্যাট ফেমাস রোগ? না, এবার আর তার কোনো জারিজুরি খাটবে না।”
রাম কবিরাজ হেসে বললেন, “তেড়েমেড়ে ডাণ্ডা, করে দেবে ঠাণ্ডা? না হে বাপু, কাজটা অত সহজ নয়।”
বাবুরাম সাপুড়ের সেই কবিতা বোধহয় শম্ভুচরণ পড়েনি। যাই হোক, সে একটু ডাঁটের সঙ্গে বলল, “নাকে তেল দিয়ে ঘুমোন গে কবিরাজমশাই, হাবুকে কাবু করতে আমার দু’দিনও লাগবে না। অবশ্য সে যদি গোলমাল করে।”
দোলের কয়েক দিন আগে গঞ্জে কিছু কিছু সন্দেহজনক চেহারার লোকের আনাগোনা হতে লাগল। তারা আড়ে আড়ে চায়, গোমড়ামুখ করে ঘোরে ফেরে, কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না।
হরিহরবাবু সাইকেলে চেপে তিস্তাঘাটে গিয়েছিলেন। সন্ধের মুখে ফিরবার সময় গঞ্জের উত্তর দিকের শাল-জঙ্গলের মধ্যে বাতাস শুকে বাঘের গন্ধ পেলেন। এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, দু’-চাকার গাড়িখানা শেষমেশ চাকায় ভর দেওয়া ছেড়ে যেন পাখনায় ভর করল। বাজারের কাছে এসে “বাঃ…বাঃ” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন সাইকেলসুদ্ধ।
লোজন ভিড় করে এল। একজন বলতে লাগল, “উনি ‘বাঃ বাঃ’ বলে কাকে যেন বাহবা দিচ্ছিলেন এইমাত্র। তবে পড়লেন কেন?”
অন্যজন বলল, “উনি এত জোরে সাইকেল চালিয়েছিলেন যে, নিজের এলেম দেখে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছিলেন।”
একটা বাচ্চা ছেলে তার বাবাকে জিগ্যেস করল, “সাইকেলটাও কি অজ্ঞান হয়ে গেছে বাবা?”
সনাতনবাবুর বড় দাবার নেশা, সারাদিন দাবাড় খুঁজে বেড়ান। তা, গঞ্জে ভাল দাবাড় আর ক’জনই বা আছে? যারা আছে, তাদেরও তো সব সময়ে পাওয়া যায় না। সনাতনবাবু আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে হ্যারিকেন উসকে দাবার ছক পেতে বসেন। তখন সঙ্গীসাথী আর পাবেন কোথায়, তাই একা একাই খুঁটি সাজিয়ে দু দিকেই চাল দেন। এরকম এক রাতে খেলতে বসেছেন। হঠাৎ দেখেন, তাঁর উল্টো দিকের খুঁটি আপনা থেকেই চলছে। আর কী অসাধারণ সব চাল! খেলা শুরু হতে হতেই বারো চালের মাথায় ঘোড়া আর গজের মুখে মাত হয়ে গেলেন। খেলা যখন চলছিল, তখন দাবার নেশায় অত খেয়াল করেননি। খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ “বাপরে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ভয়ে তাঁর দাঁত-কপাটি লাগল।
তবে একথা ঠিক যে, গঞ্জে বাঘের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল এবং অলৌকিক সব কাণ্ডও ঘটতে শুরু করেছিল।
রাম কবিরাজের দোকানে সবাই খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন সন্ধেবেলায়।
কমলাক্ষবাবু কস্ফটার জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হয়ে বললেন, “আর বোলো না। দামি শালটা–”
“শালটা কী হল?”
রামবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করেন। “নিয়ে গেল।”
“কে?”
“আর কে!”
সবাই মুখের দিকে চেয়ে আছেন, কিন্তু কমলাক্ষবাবু এর বেশি বলতে রাজী হলেন না।
রাম কবিরাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “নিয়তি কে ন বধ্যতে।”
মন্মথবাবুও সেই কথায় সায় দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “সেকথা ঠিক। আমরা যতই না কেন সাবধান হই, নিয়তি মারলে কিছু’করার নেই।”
রামবাবু কটমট করে তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “আমি আমাদের কথা বলিনি। আমাদের নিয়তি ঠিক আছে। আমি হাবু গুণ্ডার নিয়তিটাই দেখছি।”
মন্মথবাবু চারপাশ চোরা চোখে দেখে নিয়ে বললেন, “ও নাম মুখে এনো না। কে কোথায় শুনতে পাবে।”
কমলাক্ষবাবুও বললেন, “কবরেজ, তোমার সাহসটা একটু কমাও। সাহস ভাল, কিন্তু অতি সাহস ভাল নয়।”
সারা-রা-রা ঢেক চলি যা ঢেক চলি যা ঢেক চলি যা…। সারারাত দেহাতীদের বস্তিতে দোলের সঙ্গে গান হয়েছে। ভোর হলেই দোল।
ছেলেমেয়েরা পিচকিরি রঙ, আবির সব দু-তিন দিন আগে থেকে জোগাড় করে রেখেছে। রং খেলার জন্য যার যা ছেঁড়া পুরনো জামাকাপড় আছে, তা বের করা হয়েছে বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে। পচা ডিম জোগাড় করা, বেলুন-বোম তৈরি করা শেষ। আলু আধখানা করে কেটে তাতে ব্লেড দিয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে উল্টো করে “গাধা” লেখা হয়ে গেছে অনেকেরই। দু-চারজন বড়লোকের বাড়িতে আবার দোলের দিন রং দিতে গেলে খাওয়ায়। এবার কে কী খাওয়াবে তাই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে।
মন্মথবাবুর নাতি ভুতুম মহা ডানপিটে দুষ্ট ছেলে। সে তার আবিরের মধ্যে চুপি চুপি লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে রেখেছে। ডিমের খোলা জোগাড় করে তার মধ্যে ভেঁও আর লাল পেটওয়ালা কাঠপিঁপড়ে ধরে এনে ভরেছে। তারপর আটা গুলে ডিমের খোলা জুড়ে নিয়েছে। যার গায়ে ছুঁড়বে তার গায়ে রং লাগবে না বটে, কিন্তু পিঁপড়ের কামড়ে তিড়িং তিড়িং লাফাবে। তা ছাড়া তার রঙের বালতিতে কাঁচা গোবর মেশানো আছে, আর আছে আলকাতরার কৌটো।
ভুতুমের সঙ্গে রং খেলা দূরে থাকুক, এমনিতেই কেউ খেলতে চায় না। তার মতো দুষ্টু ছেলে গঞ্জে নেই। শুধু পরান নামে একটি ছেলে আছে, যে ভুতুমের মতো অতটা না হলেও বেশ দুষ্টু। সেই পরান হল ভুতুমের প্রাণের বন্ধু। ভুতুম কিন্তু পরানকেও ছাড়ে না। একবার তার জামার পকেটে খুঁয়োপোকা ছেড়ে দিয়েছিল।
বুরুনের এবার রং খেলা বারণ ছিল। তার বাবা বলে দিয়েছেন, “সামনের বছর অল সাবজেক্টে ভালভাবে পাশ করলে আর অঙ্কে লেটার পেলে আবার নরম্যাল লাইফ ফিরে পাবে।”
বুরুনের বাবা ইস্কুলে প্রায়ই খোঁজখবর করে বুরুনের কতটা উন্নতি বা অবনতি হচ্ছে তা জেনে নেন। মাস্টারমশাইরা একবাক্যে বলেন, বুরুনের উন্নতি অসাধারণ। সে শুধু ফাঁইনালে ফাস্টই হবে না, আরো অনেক কিছু করবে। যেমন, অলিম্পিক থেকে অন্তত বারোটা সোনার মেডেল আনবে, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভাঙবে, ফুটবলে গোষ্ঠ পালকে ছাড়াবে।
বুরুনের বাবা এসব কথায় তেমন গুরুত্ব দেন না। তবে শুনে একটু-আধটু খুশি যে না হন, তা নয়। কিন্তু খুশি হয়ে রাশ আলগা করেন না। ছেলেকে কড়া শৃঙ্খলায় রাখেন।
দোলের দিন সকাল হতে-না-হতেই রাস্তা থেকে ছেলেদের হল্লা ভেসে আসছিল। ছেলেরা রং নিয়ে একে-ওকে তাড়া করছে। খুব হাসছে। চেঁচাচ্ছে।
বুরুন তখন নিজের পড়ার ঘরটিতে বসে দাঁতে দাঁত চেপে অঙ্ক কষে যাচ্ছে। আজকাল দিনে গড়পড়তায় কুড়িটা করে কঙ্ক কষতে হয়। কালীবাবুর দেওয়া বোমার মতো অঙ্ক সব। দাঁত বসানোই শক্ত। পরশু পর্যন্ত এসব অঙ্ক জলের মতো সহজে করে ফেলেছে বুরুন। না, ঠিক বুরুন করেনি-বুরুনের হাত দিয়ে সেগুলো কষে দিয়েছে আসলে নিধিরাম। কিন্তু কাল থেকে নিধিরামের পাত্তা নেই। এমন কী, যে সব নতুন শিক্ষার্থী ভূত নিধিরামের দূত হয়ে আশেপাশে থাকত, তাদেরও কারো টিকি দেখা যাচ্ছে না। অনেক ডাকাডাকিতে কাল দুপুরবেলা কয়েক মুহূর্তের জন্য নিধিরাম এসেছিল। তার সারা গায়ে মাটি মাথা, চোখ দুটো করুণ, ঘাম হচ্ছে খুব। বলল, “আর বোলো না, গোঁসাইবাগানের জঙ্গল সাফ করছি, হাবু ওস্তাদ এসে গেছেন কিনা। এসেই হুকুমের পর হুকুম চালাচ্ছেন। কাজ কি সোজা! বিছুটি-বন কাটতে হলে বুঝতে পারতে।”
বুরুন কান্না-কান্না মুখ করে বলে, “তুমি না থাকলে আমার অঙ্ক কি ট্রানস্লেশন কে করে দেবে বলো তো নিধিদা?”
নিধিরাম গম্ভীর হয়ে বলে, “দ্যাখো বুরুন, যা করেছি তা করেছি। এখন ওসব ভুলে যাও। আমাকে আর বড় একটা পাবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো এবার।”
বুরুন তখন লোভ দেখিয়ে বলে, “আমি ঠিক তোমাকে ভয় খাব এবার থেকে, দেখো।”
নিধি হেসে বলে, “এখন আর ভয় দেখানোর সময় নেই যে। স্বয়ং গোঁসাইবাবা পর্যন্ত হাবুর ঘর ঝাঁট দিচ্ছেন। দম ফেলার ফুরসত নেই। তুমি আর কতটুকুই বা ভয় খাবে? আমরা হাবুকে যা ভয় খাচ্ছি, সে আর বলার নয়।”
বুরুন বলল, “হাবু হুকুম দিলে সব কিছু করতে পারো, নিধিদা?”
নিধিরাম হেসে বলে, “সব কি পারি রে ভাই? আমাদের হল গিয়ে হাওয়া-বাতাসের শরীর। তা সেই হাওয়া-বাতাসের জোর দিয়ে যা করা যায় সেসব পারি।”
বুরুন বলে, “আমার দাদু রাম কবিরাজের ঘাড় যদি মটকাতে বলে হাবু, মটকাবে?”
নিধি কবিরাজমশাইয়ের নাম শুনেই সাঁত করে মিলিয়ে গেল বাতাসে। বুরুন অবাক। পরে ভেবেচিন্তে দেখল, নিধিরামের সামনে দাদুর নামটা উচ্চারণ করা ঠিক হয়নি। ‘রাম’ নামকে কোনো ভূত সহ্য করতে পারে?
সেই যে গেছে নিধিরাম, অনেক ডাকাডাকিতেও আর আসেনি। তাই কাল থেকে বুরুনকে তার অঙ্ক ট্রানস্লেশন সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। কাল করালীবাবুর বাড়িতে পড়তে গিয়ে বুরুন খুব বিপদে পড়েছিল। করালীবাবু যা-ই জিগ্যেস করেন, তা-ই বলতে না পেরে বুরুন হাঁ করে থাকে। কালীবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “সে কী বুরুন? আমি যে ভেবেছিলাম, তুমি আইনস্টাইনের মতো একজন কেওকেটা হবে! কালও তো তুমি সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক সব অঙ্ককে ঘায়েল করে গেছ!”
কাল ইস্কুলে ট্রানস্লেশনও পারেনি বুরুন, ভূগোল ক্লাসে ভুল করেছে। ছুটির পর খেলতে গিয়ে শূন্য রানে আউট হয়েছে, বলও করেছে যাচ্ছেতাই। তার অবনতি দেখে গেম টিচার পর্যন্ত অবাক।
আজ তাই বুরুনের বড় মন খারাপ। পড়ার টেবিলের সামনেই জানালা। সেটা দিয়ে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়। একটাও অঙ্ক না মেলাতে পেরে বুরুন খুব অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। আজ দোল। সবাই রং খেলছে। সে খেলবে না। তার ওপর নিধিরাম ছেড়ে গেছে তাকে। হাবু গুণ্ডা এসেছে দাদুকে জব্দ করতে।
কত কী ভাবছিল বুরুন। ঠিক এসময়ে জানালা দিয়ে একটা রঙ-মাখা মুখ উঁকি দিল। বুরুন সাবধান হওয়ার আগেই একমুঠো ঝাল আবির উড়ে এল তার চোখেমুখে। অঙ্কের বই-খাতা ভাসিয়ে গোবর-গোলা ম্যাজেন্টা রঙ ছড়িয়ে পড়ল। আর ভেঁও আর কাঠপিঁপড়ে বোঝাই একটা ফাঁপা ডিমের খোলা তার কপালে লেগে ভেঙে গিয়ে পিঁপড়ে বাইতে লাগল সবাঙ্গে!
লঙ্কার জ্বলুনি আর পিঁপড়ের কামড়ে মুহূর্তের মধ্যে বুরুন তিড়িং তিড়িং লাফাতে থাকে। রাগে তার পিত্তি জ্বলে যায়। “নিধিদা, নিধিদা,” বলে বারকয়েক ডেকে খেয়াল করে যে, নিধিরাম হাবুর বেগার খাটছে, আসবে না। তখন ভুতুমকে ধরার জন্য বুরুন দুই লাফে ঘর থেকে রাস্তায় পড়ল।
ভুতুম দৌড়ে পালাচ্ছে। বুরুন তাকে ধাওয়া করতে-করতে ভাবে, কতক্ষণ দৌড়বে। এই ধরলাম বলে।
কিন্তু স্পোর্টসে সে যেরকম বিশ্বরেকর্ড-ভাঙা দৌড় দৌড়েছিল, এখন তার দৌড়ের বহর সেরকম তো নয়ই, উপরন্তু ভুতুমকে ধরতে খানিক দৌড়ে সে হাঁফিয়েও উঠল। রাস্তার ছেলেমেয়েরা খুব চেঁচিয়ে বুরুনকে সাবাশ দিচ্ছিল। তারা ভাবছিল গঞ্জের চ্যাম্পিয়ন স্পোর্টসম্যান, যে কিনা একদিন অলিম্পিক থেকে একাই এক ডজন সোনার মেডেল আনবে বলে সবাই জানে, এক্ষুনি ভুতুমকে ধরে ফেলবে।
কিন্তু আজ মোটেই তা হল না। ভুতুম অনায়াসে দৌড়ে অনেক দূর চলে গিয়ে পিছু ফিরে দু হাতে কাঁচকলা দেখাতে লাগল বুরুনকে। মুখে হি-হি হাসি।
গোমড়ামুখে বুরুন ফেরত আসছিল, কিন্তু মাঝপথে একপাল ছেলে তাকে ধরে আচ্ছাসে রঙ মাখায়। বুরুন গায়ের জোর খাঁটিয়ে সব কটাকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখল যে, সে একটাকেই কায়দা করতে পারছে না। অথচ পরশুদিন পর্যন্ত তার গায়ে সাতটা হাতির জোর ছিল, কোনো ছেলে লাগতে সাহস পেত না।
রঙ-মাখা বুরুন অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আর এক পাল ছেলে এসে পিচকারিতে তাকে ভিজিয়ে দেয়। পচা ডিম ছুঁড়ে দেয় কে যেন। তাই বুরুন আর বাড়ি ফিরল না। ছেলের দলের সঙ্গে মিশে পাড়ায়-পাড়ায় রঙ খেলতে বেরিয়ে পড়ল।
আবির দিয়ে দোলখেলা শুরু হয়েছিল। সেইসঙ্গে গোলা রঙ। শেষে আলকাতরা, কাদা আর গোবর। রঙে রঙে ভূত হয়ে যেতে লাগল সবাই। শেষে এমন অবস্থা হল যে, কে কোন লোক তা আর চিনবার জো রইল না। রাস্তাঘাটে সবাই সঙ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কাউকেই চেনা যাচ্ছে না।
বুরুন রঙ-মাখা ছেলেদের মধ্যে ভুতুমকে খুঁজছিল। আর কিছুর জন্য নয়, ভুতুমকে পেলে তার কানদুটো আচ্ছাসে মলে দিয়ে মাথায় দুটো চাঁটি দেবে। বড্ড বেয়াড়া হয়েছে ছেলেটা।
অনেক খুঁজে বকুলতলার কাছে ভুতুমকে দেখতে পেল বুরুন। নর্দমার পাঁক তুলে রাস্তার লোকের গায়ে ছুঁড়ছে। বুরুন গিয়ে তাঁর একটা কান পাকড়ে মাথায় একটা রাম চাঁটি দিয়ে বলে, “খুব যে সকালে লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া আবির দিয়েছিলি! এখন?”
ভুতুম ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে বলে, “দাঁড়াও দাদাকে ডেকে আনছি। কালও তুমি চাঁটি দিয়েছিলে বিশুদা, আর মার্বেল কেড়ে নিয়েছিলে…”
বুরুন ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটে। ভুতুম নয়, ক্লাস ফোরের ছিচকাঁদুনে ফুচু। অবশ্য ফুচুও তাকে চিনতে পারেনি, বিশু বলে ভুল করেছে। বুরুন তাড়াতাড়ি সরে পড়ল।
কুমোরপাড়ায় অবশেষে বুরুন ভুতুমকে পেয়ে যায়। রঙের বালতিতে কেরোসিন মেশাচ্ছে। বুরুন গিয়ে তাকে হাত চেপে ধরে বলে “ভুতুম! এবার কোথায় পালাবি? সকালে যে বড়–”
ভুতুম অবাক হয়ে চেয়ে বলে, “দ্যাখ মোনা, ফের ইয়ার্কি করবি তো সেদিনের মতো গুলতি মারব। আমাদের পাড়ার ছেলেকে ল্যাং মেরে মার খেয়েছিলি সেদিন, তবু লজ্জা নেই?”
বলে ভুল-ভুতুম টক করে প্যান্টের পকেট থেকে গুলতি বের
করতেই বুরুন ভোঁ-দৌড়। পিছন থেকে একটা ছুটন্ত গুড়ল তার পিঠের হাড়ে ঠং করে এসে লাগল। আগে হলে নিধিদা ঠিক গুড়লটা অন্য দিকে উড়িয়ে দিত। কিন্তু নিধিরাম তো এখন আর নেই।
ভুতুমকে খুঁজতে গিয়ে বারকয়েক এরকমভাবে ভুল-ভুতুমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বুরুনের। অবশ্য তারাও কেউ বুরুনকে চিনতে পারেনি।
খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে বুরুন রথতলায় একটা জামগাছের নীচে শান্তশিষ্ট একটি ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ভারি শান্তভাবে রঙিন ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কোনো পিচকিরি না খারাপ রঙ নেই। শুধু একটু আবির। বুরুন তাকে গিয়ে জিগ্যেস করল, “হ্যাঁ খোকা, নোয়াপাড়ার ভুতুমকে এদিকে কোথাও দেখেছ?”
ছেলেটা হাসি-হাসি মুখ করতেই তার দাঁতে লাল নীল রঙ দেখা গেল। ছেলেটা খুব ভাল গলায় বলে, “হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু তুমি কে বলো তো?”
“আমি বুরুন।”
“ও, চ্যাম্পিয়ন? তুমি হলে শহরের গৌরব। আমাদের বাসায় তোমাকে নিয়ে খুব আলোচনা হয়। এসো, তোমাকে একটু আবির দিই! দেব তো? মনে কিছু করবে না তো?”
ছেলেটার এরকম ভদ্র আর সুন্দর ব্যবহারে বুরুন মুগ্ধ হয়ে গিয়ে বললে, “কেন আবির নষ্ট করবে ভাই? আমার গায়ে আর রঙ দেওয়ার জায়গাই নেই যে।”
ছেলেটা করুণ স্বরে বলে, “কিন্তু ছুটে কারো সঙ্গে পারি না বলে আজ যে আমি কারো গায়ে রঙ দিতে পারিনি!”
বড় মায়া হল শুনে, তাই বুরুন মুখটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে দাও।”
ছেলেটা হুশ করে হাতের আবির বুরুনের মুখে ছুঁড়ে দিয়েই দৌড়। আর লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো ঝাল আবিরে বুরুনের চোখ-মুখ জিভ জ্বলে যেতে লাগল। ছেলেটা দৌড়তে দৌড়তেই চেঁচিয়ে বলল, “দুয়ো! দুয়ো! আমিই ভুতুম। ধরতে পারলে না!”
রাগে বুরুনের মাথার ঠিক রইল না। সে চোখ মুছতে মুছতেই শব্দ লক্ষ করে ভুতুমকে ধাওয়া করে যেতে লাগল। পায়ের শব্দে আর গলার স্বরে বুঝতে পারল যে, ভুতুম যাচ্ছে গোঁসাইবাগানের দিকে। শহরের সবচেয়ে ভাল পুকুরটা ওই দিকেই। গোঁসাইবাগানের কাছে বিশাল পুকুরটাকে লোকে বলে সমুদ্রদিঘি। সারা বছর টলটলে জলে ভরা থাকে। ওরকম ভাল জল আর কোথাও নেই। কিন্তু অনেকটা দূরে বলে আর ভয়ের জায়গা বলে। লোকে সেখানে বড় একটা স্নান করতে যায় না।
বুরুন পরিষ্কার শুনতে পেল ভুতুম দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রদিঘিতে ঝাঁপ দিয়ে চেঁচাল, “দুয়ো! ধরতে পারল না!”
বুরুনও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়ে দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জলে কিছুক্ষণ নাকানি-চোবানি খাওয়ার পর চোখ পরিষ্কার হয়ে আসে। তখন চারদিকে চেয়ে সে ভুতুমকে খোঁজে।
.
কিন্তু পুকুরে জনপ্রাণী নেই। চারিদিকে ঠাণ্ডা নিস্তরঙ্গ জল। কোথাও একটা ভুরভুরিও দেখা যায় না। তবে দিঘিটা এত বিশাল যে, সবটা নজর করা মুশকিল। বদমাশ ভুতুম নিশ্চয়ই ডুব-সাঁতার দিয়ে কোথাও ভেসে উঠবে ভেবে বুরুন অনেকক্ষণ জলে সাঁতরে বেড়াল। কিন্তু ভুতুম কোথাও ভেসে উঠল না। ডুবে গেল নাকি ছেলেটা? কিন্তু ডোববার ছেলে তো ভুতুম নয়! চৌপর দিন সে তার বাড়ির পাশের পুকুরটায় পড়ে থাকে। চিত, ডুব, কাত–কোনো সাঁতারই তার অজানা নয়। দমও আছে অনেক। তবে ভুতুমের হল কী?
খোঁজাখুঁজি করতে করতে বুরুন দক্ষিণের ভাঙা ঘাটের কাছে চলে এল। ডুবে-ডুবে পা দিয়ে দিঘির তলায় খুঁজতে লাগল। যদি ভুতুম ডুবে গিয়ে থাকে, তবে ওর শরীরটা তো থাকবে নীচে।
হঠাৎ ঘাটের ওপর থেকে একটা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন এল, “তুমি ওখানে কী করছ?”
বুরুন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে জটাওয়ালা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল চেহারা, গায়ে টকটকে লাল রঙের চাঁদর আর কাপড়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মুখে রাজ্যের দাড়িগোঁফ।
বুরুন ঘাটের একটা ডুবো-সিঁড়িতে গলা-জলে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে, “একটা ছেলে বোধহয় জলে ডুবে গেছে, তাই খুঁজছি।”
লোকটা কোনো সাধুটাধু হবে, গম্ভীর গলায় বলল, “এ দিঘির জলে মায়ের পুজো হয়, তাই কারো নামা বারণ, তুমি উঠে এসো।”
বুরুন একটু ভয় খেয়েছিল। আস্তে-আস্তে জল থেকে উঠে ঘাটে দাঁড়াতেই লোকটা ফের জিগ্যেস করল, “তুমি কে?”
বুরুন ভেজা গায়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি বুরুন, ভেলু ডাক্তারের ছেলে, রাম কবিরাজ আমার দাদু।”
শুনে লোকটার মুখ একেবারে পাকা আমের মতো মিষ্টি হয়ে গেল। হেসে বলল, “তাই বলো! এসো এসো, আজ দোলের দিন তোমাকে মিষ্টিমুখ করাব। তোমার বাবা আর দাদুর সঙ্গে আমার খুব খাতির কিনা। এসো এসো।”
এই বলে লোকটা নিজেই এগিয়ে এসে বুরুনকে নড়া ধরে তুলে নিল। বুরুন টের পেল, লোকটার গায়ে অসুরের মতো জোর।
গোঁসাইবাগানের ঝোঁপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু রাস্তা। দিনের বেলাতেও আলো নেই। কেমন আবছা ভুতুড়ে ছায়া চারিদিকে। সেই রাস্তা দিয়ে লোকটা বুরুনের হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুরুনের ভাল লাগছে না। সে বলল, “আপনি কে?”
“আমি!” হা হা করে হেসে লোকটা বলে, “আমি একজন সাধু মানুষ। ভয় পেও না। একসময়ে এই গঞ্জে সবাই আমাকে ‘হাবু ওস্তাদ’ নামে চিনত। এখনো কেউ কেউ চেনে। তোমার দাদু আর বাবা তো খুব চিনবে।”
বুরুন যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেঁপে উঠল। এই তবে হাবু ওস্তাদ!
গোঁসাইবাগানের পোড়ো বাড়ির চারপাশের জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। ঘরদোর সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরে পাঁচ-সাতজন ষণ্ডা চেহারার লোক শুয়ে বসে আছে। তাদের চোখ রক্তবর্ণ, আর মাঝে-মাঝে “শিব স্বয়ম্ভু” বলে বিকট গলায় তারা হাঁক পাড়ছে। হঠাৎ মাটি কাঁপিয়ে “ঘ-ড়-ড়-ড়-ড়া-ম” করে কাছেই একটা বাঘ ডেকে উঠল। এত বিকট ডাক বুরুন জীবনে শোনেনি।
সে কেঁপে উঠতেই হাবু ওস্তাদ বলে, “ভয় নেই। ও আমার পোষা বাঘ। এত দিন জঙ্গলে ছিল, আমি ফিরে এসেছি খবর পেয়ে বাঘটাও ফিরে এসেছে।”
এত ভয় বুরুন জীবনে পায়নি। কাঁপা গলায় সে বলে, “আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।”
হাবু হেসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “যাবে যাবে! তোমাকে একটু মিষ্টিমুখ করাই, জায়গাটা একটু ঘুরেটুরে দেখ। হয়তো এ জায়গা তোমার এত ভাল লেগে যাবে যে, আর নিজের বাড়িতে ফিরতেই ইচ্ছে করবে না।”
বুরুন হাবুর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, “না না। আমি বাড়ি যাব।”
হঠাৎ হাবু তার চোখে হাত বুলিয়ে দিয়ে খুব আলতো গলায় বলল, “এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে কোথায় যাবে?”
বুরুন চোখে হাত বোলাবার সময় চোখ বন্ধ করে ছিল। চোখ চাইতেই সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
কোথায় সেই পোড়ো বাড়ি? কোথায়ই বা সেই জঙ্গল? সে দেখতে পেল, কী সুন্দর বাগান! অজস্র, অসংখ্য ফুল ফুটে আছে, সুগন্ধে ম-ম করছে চারধার। গাছে-গাছে দোয়েল শ্যামা কোকিল ডাকছে। ফুলে-ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট প্রজাপতির মতো পরী। একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে তরতর করে। বাঁধানো ঘাটে একটা রঙিন নৌকো বাঁধা। সব কিছুই খুব ছোট-ছোট, খেলাঘরের মতো। কিন্তু ভারি সুন্দর। এখানে আকাশের রঙ সবুজ। রঙের বাক্সে যত রকম রঙ দেখা যায়, তো রকম রঙের ছোট বড় গোল চৌকো আর নানান আকৃতির মেঘ আকাশে ভাসছে। কোনো কোনো মেঘ খুব নিচু হয়ে প্রায় মাথা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মেঘগুলোর ওপরে চমৎকার ছোট ছোট বসবার গদি রয়েছে। একটা মেঘ তার কাছে এসে বলে উঠল, “চড়বে নাকি বুরুন? চলো তোমাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বুরুন উঠে পড়ল মেঘের কোলে। সাবানের ফেনার মতো নরম গদিতে বসে আস্তে আস্তে ওপরে উঠল। খুব ওপরে নয়, খুব বেশি হলে তিন তলার ছাদের সমান উঁচু হয়ে আস্তে আস্তে মেঘটা তাকে নিয়ে চলে।
অল্প দূরেই একটা ছোট পাহাড়, তার চূড়ায় বরফ জমে আছে। পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবছে। কী আশ্চর্য! এই সূর্যের চেহারা অবিকল আহ্লাদী মানুষের মুখের মতো। তার ঠোঁট, নাক, কান, চোখ সব আছে। বুরুনকে দেখে সূর্য বলে উঠল, “তোমার হুকুম পেলেই আমি উঠব বা ডুবব।”
বুরুন অবাক হয়ে দেখল। তারপর বলল, “তুমি একটু থাকো, আমি সব দেখে নিই ভাল করে। তারপর ডুবো।”
মেঘটা বলে উঠল, “সূর্য ডুবলেও এখানে কখনো অন্ধকার হয়। চাঁদমামা আছে, তারা আছে, স্বপ্নের আলো আছে।”
একটা ছোট্ট রেল স্টেশনের ধারে তাকে নামিয়ে দিল মেঘ। স্টেশনের ঘরটা নানা রঙে রঙিন, প্ল্যাটফর্মে হলুদ মোরাম! ছোট বাতিদানে সবুজ-লাল-নীল আলো জ্বলছে। খুদে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে শাস টানছে। কামরার জানালায় অদ্ভুত মজার মজার সব মুখ দেখে বুরুন। একটা জানালায় ডোনাল্ড ডাককে দেখতে পায়, অন্য জানালায় টিনটিন আর ক্যাপটেন মুখোমুখি বসে একটা গুপ্তধনের প্ল্যান দেখছে, টিনটিনের কুকুর কুটুস একটা ডাইনী বুড়িকে তাড়া করে অন্য কামরায় উঠিয়ে দিয়ে এল। একটা কামরার জানালায় দেখল, ভুতুম বসে আছে। কিন্তু ভুতুমের সঙ্গে ঝগড়া বলে তার দিকে ভাল করে তাকাল না বুরুন।
টিং টিং করে মিষ্টি ঘণ্টা বাজতেই গার্ডসাহেব হুইসল দিয়ে গাড়ি ছাড়ার সঙ্কেত দিলেন আর বুরুনের দিকে চেয়ে বললেন, “উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি!” গার্ডের মুখ দেখে বুরুন তো অবাক। এ যে অরণ্যদেবের সেই বেঁটে সঙ্গী গুরান!
একটা কামরায় উঠে পড়ে বুরুন। জানালায় বসে দেখে, রূপকথার দেশের মতো অলৌকিক সুন্দর এক দেশের ভিতর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। সব কিছুই ছোট-ছোট, সব কিছুই খুব সুন্দর রঙের।
যে কামরায় বুরুন উঠেছে, তাতে অজস্র পুতুল বসে-বসে বিস্কুট খাচ্ছে আর চিকন সুরে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। পুতুল-কুকুর ঘুরে ঘুরে ‘পুফ পুফ করে ডাকছে, বাঘ-পুতুল বলছে ‘হালুম হুলুম’, হাতি-পুতুল একটা বানর-পুতুলকে খুঁড়ে নিয়ে দোল দিচ্ছে।
একটা জঙ্গলের ধারে গাড়ি এসে ছোট্ট একটা স্টেশনে থামল। স্টেশনের নাম ‘চড়ইভাতি’। গুরান এসে সবাইকে বলল, “নেমে পড়ো, নেমে পড়ো। এখানে আজ চড়ইভাতি হবে।”
নেমে বুরুন সকলের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে থাকে। ভারি সভ্য-ভব্য জঙ্গল। কোথাও কাঁটাগাছ নেই, বিছুটি পাতা নেই। সুন্দর সুন্দর সব গাছ, ফুল, পাখি। ছোট ছোট বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রঙের সাপ চলেছে নিজের কাজে। তাদের দেখে একদম ভয় করে না। একটা বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল বুরুন। একটা সাপকে তুলে একটু আদর করে ছেড়ে দিল।
দিনের আলো ফুরোচ্ছে না। সূর্য আটকে আছে পাহাড়ের পিছনে। আর সেই সুন্দর নরম আলোয় জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি। আলোছায়ায় ডোনাল্ড ডাক, টিনটিন, গুরান, ডাইনী বুড়ি, পুতুল আর জীবজন্তু মিলে কী যে হই-হুঁল্লোড় করে চড়ইভাতি হতে লাগল, তা বলে ফুরোয় না। ভুতুম এসে কাকুতি-মিনতি করে বলল, “বুরুনদা, কাল আবির দিয়ে খুব অন্যায় কাজ করেছি। আর হবে না, কান ধরছি।”
বুরুন গম্ভীর হয়ে বলে, “আর পিঁপড়ে?”
“সেও অন্যায়। এই দেখ, দশবার ওঠবোস করছি। এবার ভাব করবে তো?”
ভুতুমের এত ভাল স্বভাব হয়েছে দেখে খুশি হল বুরুন। ভাব করে ফেলল।
এত সুন্দর দেশ ছেড়ে আর কোথাও কখনো যাবে না বুরুন। মনে-মনে এ কথা সে ঠিক করে ফেলল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। বুরুন আর ভুতুমকে খুঁজতে যে সব লোককে চারদিকে পাঠানো হয়েছিল, তারা ফিরে এসে খবর দিল–না, কোথাও তাদের পাওয়া গেল না।
এ খবর শুনে মন্মথবাবু শয্যা নিলেন। আর রামবাবু ঘন-ঘন তামাক খেতে লাগলেন। দু বাড়িতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল।
সন্ধের শেষ ডাউন রেলগাড়িটা ইস্টিশান ছেড়ে চলে গেল। তার কু-ঝিক-ঝিক শব্দ মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই চারদিক কাঁপিয়ে বাঘের ডাক উঠল–ঘ্রা-আ-আ-ম্! এক বার। দু বার। তিন বার। আর তখন চারদিকে হলুদ আলোর বান ডাকিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে পড়ল আকাশে। কিন্তু সেই জ্যোৎস্নাতেও চারদিকটা আজ বড় ভুতুড়ে দেখাতে লাগল।
রাস্তাঘাট ফাঁকা, জনশূন্য। পথে কুকুর-বিড়াল, পর্যন্ত নেই। সব দরজায় খিল পড়ে গেছে। হাড়কাঁপানো শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
রাম কবিরাজ একা তাঁর দোকানঘরে বসে আছেন। আড্ডাধারীরা কেউ আজ আসেনি। চারদিক নিঃশব্দ। রাম কবিরাজ বসে বসে ভাবছেন আর তামাক খাচ্ছেন। ভাবতে-ভাবতে এক সময়ে হঠাৎ আপন মনে বলে উঠলেন, “হুঁ। তাহলে এই হল ব্যাপার!”
যেই কথাটা বলেছেন, অমনি তাকের উপর শিশি-বোতলগুলো ঠনঠুন করে নড়ে উঠল। রাম কবিরাজ অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। ভাবলেন, মনের ভুল। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ই। তাহলে এই হল ব্যাপার!”
বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার শিশি-বোতলের ঠুনঠুন শব্দ। রাম কবিরাজ জানেন, ঘাবড়ে গেলে বা উত্তেজিত হয়ে পড়লে কোনও দিন কোনও কাজ হয় না। এমনিতেও তিনি ভিতু মানুষ নন। কারণ, যারা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, তাদের ভয়ের কিছুই নেই। মনটাকে শক্ত করে তিনি ইষ্টনাম জপ করতে লাগলেন। জপ করতে করতেই বললেন, “কী চাও?”
কপাটের আড়াল থেকে খোনা সুরে কে যেন বলে, “জপ বন্ধ করুন, নইলে কাছে আসি কী করে? আমার সময় নেই, কাজের কথাটা বলেই চলে যাব।”
রাম কবিরাজ জপ থামিয়ে বলেন, “এবার বলো।”
খোনাসুর কপাটের আড়াল থেকে ঘরের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু রামবাবু কাউকে দেখতে পান না। বাতাসের ভিতর থেকে স্বরটা বলে, “ভয় পাবেন না। আমরা সব বুরুনের বন্ধুলোক। আমার নাম খোনাসুর।”
“বুরুন কোথায়?”
“গোঁসাইবাগানের পাতালঘরে। সমুদ্রদিঘির দক্ষিণের ঘাটে জলের তলায় ছয় নম্বর সিঁড়ির গায়ে যে ফাটল আছে, সেইটেই হল সবচেয়ে সোজা রাস্তা। জলে ডুব দিয়ে ফাটলে ঢুকে দশ কদম হাঁটলেই পথ পাওয়া যাবে, যে পথ সোজা পাতালঘরে গেছে। সেখানে বুরুন আর ভুতুম দুজনেই আছে।”
“সেখানে যাওয়া যায় না?”
“তা যাবে না কেন? কৌশলে সব হয়। কিন্তু গিয়ে কিছু লাভ নেই। তারা সেখান থেকে আসতে চায় না।”
“সে কী?”
“আজ্ঞে সেই খবরটাই দিতে এলাম। হাবু তাদের বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে আটকে রেখেছে। আমাদেরও মন্ত্রের জোরে বশ করে দিনরাত খাটাচ্ছে। একটুও জিরোতে পাই না। গা-গতরে ব্যথা। তা কবিরাজমশাইয়ের কাছে গাব্যথার কোনো ওষুধ আছে নাকি?”
“আছে। তবে সে মানুষের জন্য। তোমাদের কি আর সে ওষুধে কাজ হবে?”
“তাহলে শিগগির শিগগির আমাদের জন্যও ওষুধপত্র বের করে ফেলুন।”
রাম কবিরাজ চিন্তিত হয়ে বললেন, “কাজটা বড় সহজ নয় হে। প্রথমে ভেবে দেখতে হবে, তোমাদের যখন শরীরই নেই, তখন অসুখটা হয় কোথায়। নাড়ীর গতি দেখে যে কিছু বুঝব তারও কিছু উপায় নেই। তারপর ধরো, তোমাদের পেট নেই, কাজেই ওষুধ পেটে গিয়ে ক্রিয়া করবে না। তোমাদের গায়ে মালিশও চলবে না। কাজেই তোমাদের জন্য বায়বীয় ওষুধ বের করতে হবে। সে কাজ ভারি শক্ত। তবে আমি চেষ্টা করব।”
খোনাসুর খুশি হয়ে বলে, “বড় উপকার হবে তাহলে কবিরাজ মশাই। আমাদের কথা তো কেউ ভাবে না। এই হাবু বদমাশটার কথাই ধরুন না। এখানে আসা ইস্তক কী অভৌতিক খাটানটাই না খাটাচ্ছে! বিছুটি-বন পরিষ্কার করো, কাঁটা-গাছ ওপড়াও, ঘর পরিষ্কার করো, দিঘির কচুরিপানা তোলো, এটা আনো, সেটা নিয়ে যাও, অমুককে খবর দাও, তমুককে ধরে আনন, কাজের শেষ নেই। তিন-ধা-নাচন নেচে মরছি। বাগে পেলেই হাবুর ঘাড় মটকাব।”
উৎসাহিত হয়ে রাম কবিরাজ বলেন, “সত্যি মটকাবে?”
“তবে আর বলছি কী? অবশ্য হাবুর ঘাড় মটকানো সহজ কাজ নয়। সে আমাদের মন্ত্রের জোরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারি না। তা বলে ভাববেন না যেন, আমরা সবাই হাবুর হুকুম খুশি হয়ে তামিল করছি। সুযোগ বুঝলেই আমরা কাজে ফাঁকি দিই। এক লহমার কাজ করতে তিন দিন লাগিয়ে দিই, তিন দিনের কাজ সারতে তিন মাস কাটাই। আরবারে হাবুর কালীপুজোয় ফটিকবাবু চাঁদা দেননি বলে হাবু রেগে গিয়ে আমাকে ডেকে বলল, যা তো, ফটিকের গোঁফ জোড়া উপড়ে নিয়ে আয়। আমি করলুম কী, ফটিকবাবুর গোঁফের বদলে তাঁর ছাগলের দাড়িগাছটা ছিঁড়ে নিয়ে গেলাম। হাবু প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, পরে টের পেয়ে সে কী মার আমাকে! আমি মাথা চুলকে বললাম, আজ্ঞে অন্ধকারে ঠিক ঠাহর পাইনি। তখন আরও মারে দেখে বললাম, আজ্ঞে কানে ভাল শুনতে পাচ্ছি না। বুড়ো হচ্ছি তো, তাই ফটিক শুনতে ফটিকের ছাগল আর গোঁফ শুনতে দাড়ি শুনেছি। কিন্তু মানুষের উপকার করতে নেই কবিরাজমশাই। এই যে ফটিকবাবুর একটা উপকার করেছিলাম, তার জন্য বরং ফটিকবাবুই উল্টে কত না শাপ-শাপান্ত করেছেন। বলেছেন, যে-আমার ছাগলের দাড়ি ছিঁড়েছে তার ওলাউঠা হোক, সে নরকে যাক, নরকে যেন যমদূতেরা তাকে দশ হাজার বছর ধরে সেদ্ধ করে আরো দশ হাজার বছর ধরে ভাজে, তারপর আরও দশ হাজার বছর রোদ্দুরে ফেলে রেখে শুকোয়।”
কবিরাজমশাই সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “আহা, বুঝতে পারেনি ফটিক। আমি তাকে বুঝিয়ে বলবখন। তুমি রাগ কোরো না বাবা খোনাসুর।”
এই বলে কবিরাজমশাই উঠে একটা কাগজের পুরিয়াতে একটু কর্পূর, গন্ধক, কালোজিরে, এলাচের গুঁড়ো, হিং এবং আরও কয়েকটা চূর্ণ মিশিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “এটা নিয়ে যাও। গায়ে-গতরে ব্যথা হলে বা হাঁফিয়ে পড়লে শুকে দেখো। এক শিশি কবিরাজী নস্যও নিয়ে যাও, ওই তাকে আছে। এতে যদি কাজ হয়, তবে আমি ভূতদের জন্য আরও নানা রকম ওষুধ বানাতে শুরু করব। আর সেই নতুন চিকিৎসাবিদ্যার নাম দেব ভৌত আয়ুর্বেদ।”
বাতাসের হাত বাড়িয়ে থোনাসুর পুরিয়াটা তুলে নিল। কবিরাজ মশাই দেখলেন পুরিয়াটা শূন্যে ভাসছে। খুব জোরে একটা শ্বাস টানার শব্দ হল। তারপর এক প্রবল হাচ্ছো। খোনাসুর বলে ওঠে, “আঃ! খুব কাজ হচ্ছে মশাই। গায়ের ব্যথাটা যেন হাঁচির সঙ্গে বেরিয়ে গেল। জব্বর ওষুধ।”
রাম কবিরাজ খুশি হয়ে বললেন, “ওষুধের জন্যে আর ভেবো না। লোকে আজকাল আর কবিরাজের কাছে আসতে চায় না, হাতুড়ে অ্যালোপ্যাথের দোরে গিয়ে ধরনা দেয়। সেইজন্য মানুষের চিকিৎসা করতে আর রুচি হয় না। এবার থেকে নাহয় ভূতেদের চিকিৎসা করে দেখব।”
খোনাসুর আর একবার হাঁচি দিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে।”
রামবাবু গলায় আদর মাখিয়ে বললেন, “এবার বলো তো বাবা খোনাসুর, ছেলে দুটোকে উদ্ধার করি কোন উপায়ে?”
খোনাসুর ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “ও বাবা! উদ্ধার করা বড় কঠিন কাজ কবিরাজমশাই। যদি বা কোনও রকমে উদ্ধার করতে পারেন, তবে বাঁচাতে পারবেন না।”
রামবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, “তাহলে উপায়?”
“যদি কোনও রকমে বুরুন নিজের মনের জোর খাঁটিয়ে বশীকরণের মন্ত্র কাটাতে পারে, একমাত্র তবেই সে উদ্ধার পাবে। এ বাইরের লোকের কাজ নয়। যা করবেন ভেবেচিন্তে করবেন…হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁচ্ছো…আঃ, আপনার ওষুধে খুব কাজ হচ্ছে মশাই।”
রামবাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, “তা আর হবে না! আমি হলাম ডাকসাইটে রাম কবিরাজ, মড়া বাঁচাতে পারি”।
কিন্তু কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই কবিরাজ মশাই টের পেলেন যে, পুরিয়া সমেত শোনাসুর সাঁ করে পালিয়ে গেল। রামবাবু বার বার ডাকাডাকি করেও আর তার সাড়া পেলেন না। “কী হল রে বাবা” বলে কবিরাজমশাই ভাবতে লাগলেন। তারপর তাঁর খেয়াল হল, অন্যমনস্কভাবে তিনি খোেনাসুরের সামনে নিজের নামটা উচ্চারণ করে ফেলেছেন। ও নাম ওদের সহ্য হয় না। মনে মনে তিনি ঠিক করলেন, ভূতেদের চিকিৎসা যদি করতেই হয়–তবে ওদের সামনে নিজের নামটা ভুলেও মুখে আনা চলবে না।