॥ ৭ ॥
পরদিন সকালে ফেলুদা বলল, ‘তোরা বরং দিলখুশাটা দেখে আয়। আমার একটু চিন্তা করার আছে, তা ছাড়া দু’-একটা টেলিফোন করারও আছে। সুকিয়াসের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। ইনস্পেক্টর পাণ্ডেকেও একটা ফোন করব।’
আমরা দু’জনে আজ ট্যাক্সির বদলে একটা টাঙ্গা নিয়ে বেরোলাম। লালমোহনবাবুর ভীষণ শখ টাঙ্গা চড়ার কারণ উনি জানেন বাদশাহী আংটির সময় আমরা টাঙ্গা চড়েছিলাম।
টাঙ্গা রওনা হবার পর লালমোহনবাবু বললেন, ‘দিলখুশার ইতিহাসটা একটু জেনে নিই।’
আমি বললাম, ‘দিলখুশা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নবাব সাদাত আলির তৈরি একটা বাগানবাড়ি ছিল। এর আশেপাশে হরিণ চরে বেড়াত। এখন শুধু ব্যাপারটার ভগ্নাবশেষ রয়েছে, তবে তার পাশে একটা সুন্দর পার্ক রয়েছে যেখানে লোকে বেড়াতে যায়। দিলখুশার উত্তরে বিখ্যাত লা মার্টিনিয়ার ইস্কুল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্লড মার্টিনের তৈরি। মার্টিন ছিলেন মেজর জেনারেল। দিলখুশা থেকে এই স্কুলটা দেখতে পাবেন।’
টাঙ্গাতে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল—সত্যি, লখ্নৌ-এর মতো বাহারের শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। লালমোহনবাবু অবশ্য বার বারই বলছেন, ‘ইতিহাস চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’
দিলখুশার ভগ্নাবশেষ দেখতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমরা সে কাজটা শেষ করে পার্কটায় একটু বেড়াতে গেলাম, আর সেখানে গিয়েই একটা বিশ্রী ঘটনায় আমাদের জড়িয়ে পড়তে হল।
প্রথমে মনে হয়েছিল পার্কে কোনও লোকজন নেই। লোক সচরাচর হয় বিকেলের দিকে। আমরা ফুলবাগানের মধ্যে দিয়ে খানিকদূর হাঁটার পর একটা গাছের পিছনে একটা বেঞ্চির খানিকটা অংশ দেখলাম, আর সেই সঙ্গে মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম। গাছটা পেরোতেই যে দৃশ্যটা দেখলাম তাতে আমাদের বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
দেখি কি, প্রসেনজিৎ আর দুটি তারই ধাঁচের ছেলে বেঞ্চিতে বসে কী যেন খাচ্ছে। তিনজনেরই চুল উস্কো খুস্কো আর চোখ ঘোলাটে। ওরা যে নেশা করছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই, আর এই নেশা বড় সহজ নেশা নয়। এ হল ড্রাগের ব্যাপার, যা খেয়ে মানুষ সম্পূর্ণ হুঁশ হারিয়ে খুন পর্যন্ত করতে পারে।
প্রসেনজিৎ এতে মশ্গুল ছিল যে সে আমাদের প্রথমে দেখতেই পায়নি। তারপর যখন দেখল তখন তার মুখে এক অদ্ভুত ক্রূর হাসি ফুটে উঠল।
‘ডিটেকটিভের চেলাদের দেখছি, ডিটেকটিভ কোথায়?’ প্রশ্ন করল সে জড়ানো গলায়।
‘তিনি আসেননি’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘আহা, এমন একটা দৃশ্য দেখতে পেলেন না।’
আমরা চুপ।
‘চোর ধরা পড়ল?’ বিদ্রুপের সুরে প্রশ্ন করল প্রসেনজিৎ।
‘এখনও পড়েনি।’
‘আমাকেই ত সকলে সন্দেহ করছে, তাই না? কারণ আমার টাকার অভাব। লোকের কাছে ধার চাইতে হয় ঘণ্টাখানেক স্বর্গবাসের জন্য। শুনুন—আই ক্যান টেল ইউ দিস—হার চুরি করার মতো বোকা আমি নই। আমার লাক্ খুলে গেছে। আমি বেশির ভাগ টাকা পাই জুয়া খেলে। মাঝে মাঝে লোকের কাছে ধার করতে হয়, কারণ এ জিনিস একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না। আপনি ধরলে আপনিও আর ছাড়তে পারতেন না, মিস্টার থ্রিলার রাইটার। একবার ট্রাই করে দেখুন না—আপনার লেখা অনেক ইমপ্রুভ করে যাবে। মাথার মধ্যে গল্পের প্লট ভিড় করে আসবে। কী, মিস্টার রাইটার—কী বলেন?’
আমরা দু’জনেই নির্বাক। এরকম একটা দৃশ্যের সামনে পড়তে হবে ভাবতেই পারিনি।
‘তবে একটা কথা বলে রাখি’—হঠাৎ তড়াক্ করে দাঁড়িয়ে উঠে খস্খসে ধারালো গলায় বলল প্রসেনজিৎ। তারপর তার জীনসের পকেট থেকে একটা ফ্লিক্ নাইফ বার করে খ্যাঁচ করে বোতাম টিপে ফলাটা বার করে সেটা আমাদের দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘আজকের কথা যদি ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারে তা হলে বুঝব সেটা আপনাদের কীর্তি। তখন বুঝবেন এই ছুরির ধার কত। নাউ ক্লিয়ার আউট ফ্রম হিয়ার!’
বেগতিক ব্যাপার। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়, আর কোনও প্রয়োজনও নেই। যা দেখার তা দেখে নিয়েছি, আর এ দৃশ্য শুধু আমরাই দেখেছি, আর কেউ দেখেনি। আমরা দু’জনে আবার টাঙ্গা করে হোটেলে ফিরে এলাম। সারা পথ দু’জনের মুখে একটিও কথা নেই।
হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের ঘরে শীলা বসে আছে, তার হাতে অটোগ্রাফ খাতা। আমাদের দেখে শীলা উঠে পড়ল। বলল, ‘আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করে গেলাম। এনিওয়ে, সই-এর জন্য ধন্যবাদ। আশা করি আপনার ডিটেকশন সফল হবে।’
শীলা চলে গেলে পর লালমোহনবাবুকেই বলতে দিলাম ফেলুদাকে দিলখুশার ঘটনাটা। ফেলুদা সব শুনে বলল, ‘আমার ওর চোখের চাহনি দেখেই সন্দেহ হয়েছিল ও ড্রাগ ব্যবহার করে। ও ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’
‘কিন্তু তা হলে ওই কি কণ্ঠহার চোর?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ফেলুদা কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ভালো কথা, আপনাদের আরেকবার একটু বেরোতে হবে।’
‘হোয়াই স্যার?’
‘সুকিয়াসের টেলিফোন খারাপ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়নি। আমিই বেরোতাম, কিন্তু শীলা এসে পড়ল। ওঁর বাড়িতে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। চট্ করে বেরিয়ে পড়লে এখনও ওঁকে বাড়িতে পাবার চান্স। আমার মাথায় একটা জিনিস দানা বাঁধছে তাই আমি বেরোতে চাচ্ছি না। যা তোপ্শে, ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়।’
লালমোহনবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জেরা শুনতে শুনতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল, এবার তবু একটা কাজ পাওয়া গেল।’
আমরা দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। সাত নম্বর লাটুশ রোড বলতেই ট্যাক্সি আমাদের সোজা গন্তব্যস্থলে নিয়ে গেল। আমরা ট্যাক্সিটাকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বললাম।
বেশ বড় একতলা বাড়ি, গেটের গায়ে মাৰ্বল ফলকে লেখা ‘এস. সুকিয়াস’। গেট দিয়ে ঢুকে দু’দিকে বাগান। তাতে ফুল নানা রকমের। বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ গাড়িবারান্দায় পৌঁছেছে। বাড়ির বয়স অন্তত পঞ্চাশ বছর ত হবেই।
আমরা কলিং বেল টিপতে একজন বেয়ারা এসে দরজা খুলে দিল।
লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিঃ সুকিয়াস হ্যাঁয়?’
‘জি হাঁ হুজুর—আপকা সুভনাম?’
‘জারা বোলিয়ে মিঃ মিটারকে পাস সে দো আদমি আয়ে হ্যাঁয় এক মিনিট বাৎচিৎকে লিয়ে।’
হিন্দিতে কটা ভুল হল জানি না, কিন্তু বেয়ারা ব্যাপারটা বুঝে নিল। আমাদের এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলে সে ভিতরে চলে গেল।
এক মিনিট পরে যে বেয়ারা বেরিয়ে এল তার চেহারাই পালটে গেছে। দৃষ্টি বিস্ফারিত, হাত পা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে, মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।
‘কেয়া হুয়া?’ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
‘আপলোগ…অন্দর আইয়ে…’ কোনওরকমে বলল বেয়ারা। আমরা বেয়ারার পিছন পিছন ভিতরে ঢুকলাম। বেয়ারা সেইভাবেই কাঁপতে কাঁপতে বৈঠকখানা পেরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ঢোকালো আমাদের।
ঘরটা হল যাকে বলে স্টাডি। চারিদিকে নানারকম শিল্পদ্রব্য আর বইয়ে ঠাসা আলমারি। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার পিছনে একটা রিভলভিং চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন মিঃ সুকিয়াস, পরনে সাদা শার্ট, তার পিঠ রক্তে লাল। এরকম বীভৎস দৃশ্য আমি কমই দেখেছি।
‘কী হরিব্ল ব্যাপার!’ বললেন লালমোহনবাবু। তারপর বেয়ারার দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি শেষ কখন দেখেছ তোমার মনিবকে?’
বেয়ারা আমতা আমতা করে যা বলল তাতে বুঝলাম মিঃ সুকিয়াস সকালে ব্রেকফাস্ট করে এই ঘরে চলে আসেন কাজ করতে। তিনি নিজেই সব করেন, তাঁর সেক্রেটারি নেই, বা বাড়িতে অন্য কোনও লোক নেই। বেয়ারা এই সময়টা প্রয়োজন না হলে তাঁকে ডিসটার্ব করে না। আজও সেই একই নিয়ম মানা হয়েছে।
‘সকালে কোনও লোক ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
বেয়ারা মাথা নাড়ল।
‘নেহি হুজুর। কোই নেহি আয়া।’
আমি বুঝতেই পারছিলাম যে বাইরে থেকে সামনের দরজা দিয়ে লোক আসার কোনও দরকার নেই, কারণ সুকিয়াসের চেয়ারের পিছনেই হাট করে খোলা একটা জানালা, তাতে শিক নেই। খুনি যে সেই জানালা দিয়েই ঢুকেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
‘তোমাদের টেলিফোন ত খারাপ, তাই না?’ লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
‘হাঁ হুজুর—দো রোজসে খারাপ হ্যাঁয়।’
‘কিন্তু—’
আমি বললাম, ‘পুলিশের কথা ভুলে গিয়ে চলুন ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়ে ফেলুদাকে নিয়ে আসি। যা করার ওই করবে।’
‘তাই চলো।’