৭. টিউবে করে এপিং

॥ ৭ ॥

আপরা পরদিন টিউবে করে এপিং গিয়ে পৌঁছলাম বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। স্টেশন থেকে হেঁটে ওয়ারেনডেল স্কুলে পৌঁছতে লাগল কুড়ি মিনিট। বিশাল খেলার মাঠের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল বিল্ডিং—অন্তত দুশো বছরের পুরনো ত হবেই। ফেলুদার উদ্দেশ্য হল রঞ্জন মজুমদার ওখানে ছাত্র ছিল কি না, এবং পিটার ডেক্সটর ওর সঙ্গে পড়ত কি না সেইটে জানা।

ইস্কুলের সদর দরজায় পোর্টার দাঁড়িয়ে আছে, সে জিজ্ঞেস করল আমরা কার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ফেলুদা বলল সে চল্লিশ দশকের শেষ দিকের একজন ছাত্র সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানতে চায়। পোর্টার আমাদের একটা লাইব্রেরি জাতীয় হলে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘মিস্টার ম্যানিং দেয়ার উইল হেল্‌প ইউ।’

ম্যানিং ভদ্রলোকটি একটা ডেস্কে বসে পুরু কাচের চশমা পরে একটা খাতায় কী জানি লিখছিলেন, ফেলুদা তাঁর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে একটা মৃদু গলা খাঁকরানি দিল। ভদ্রলোক লেখা থামিয়ে চোখ তুলে বললেন, ‘ইয়েস?’

ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।

‘হুইচ ইয়ার ডিড ইউ সে?’

‘নাইনটীন ফর্টি এইট।’

মিস্টার ম্যানিং তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে পিছন দিকে গিয়ে একটা বইয়ের তাক থেকে বেশ বড় এবং মোটা একটা খাতা বার করলেন। তারপর সেটাকে এনে ফেললেন তাঁর ডেস্কে।

আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি, ভদ্রলোক খাতার পাতা উলটিয়ে একটা বিশেষ পাতায় এসে চশমার উপর দিয়ে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘হোয়াট নেম ডিড ইউ সে?’

‘আই হ্যাভ্‌ন্‌ট টোল্ড ইউ ইয়েট,’ বলল ফেলুদা। ‘দ্য নেম ইজ মজুমদার, অ্যান্ড দ্য ফার্স্ট নেম ইজ রঞ্জন।’

‘ম্যাজুমডা, ম্যাজুমডা,’ নামের তালিকার উপর দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে বিড়বিড় করতে লাগলেন মিস্টার ম্যানিং।

হঠাৎ আঙুলটা এক জায়গায় এসে থেমে গেল।

‘ইয়েস, আর. ম্যাজুমডা,’ বললেন মিস্টার ম্যানিং।

‘ওর সঙ্গে কি পিটার ডেক্সটর বলে কেউ পড়ত?

‘ডেক্সটর…ডেক্সটর…নো, নো ডেক্সটর ইন দ্য সেম ক্লাস।’

‘আই সী।’ ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেছে। বলল, ‘যদি অনুগ্রহ করে ফর্টি নাইনটাও একটু দেখে দাও। হয়ত পিটার ডেক্সটর পরের বছর এসেছে।’

দুঃখের বিষয় ফর্টি নাইনের খাতাতেও পিটার ডেক্সটরের নাম পাওয়া গেল না। অর্থাৎ এখানে আর আমাদের থাকার কোনো মানে হয় না।

‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি ভেরি মাচ,’ বলল ফেলুদা। ‘ইউ হ্যাভ বিন মোস্ট হেল্‌পফুল।’

ট্রেনে আসতে আসতে ফেলুদা বলল, ‘কেমব্রিজে গিয়ে খোঁজ করলেই ডেক্সটরের নাম পাওয়া যাবে। কিন্তু তাও আমার মনে হচ্ছিল যে এখানেও কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলে মন্দ হত না।’

‘কী বিজ্ঞাপন?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

‘টাইম্‌সের পার্সোন্যাল কলামে দেবো। নরফোকের পিটার ডেক্সটর সম্বন্ধে কারো কোনো ইনফরমেশন থাকলে সে যেন অমুক হোটেলের অমুক ঘরের অমুক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে।’

‘এতে কী ফল হতে পারে বলে আপনি আশা করছেন?’

‘কিসে ফল হয় আর কিসে না হয় সেটা ত সব সময় আগে থেকে বলা যায় না। কেমব্রিজের তালিকায় নাম পেলে ত শুধু নামটাই পাওয়া যাবে; লোকটা সম্বন্ধে ত কিছু জানা যাবে না। দিয়েই দেখি না একটা বিজ্ঞাপন।’

‘কিন্তু সে ত বেরোতে বেরোতে তিন-চার দিন লেগে যাবে।’

‘দু’দিনের বেশি সময় লাগার কথা না। একটা দিন যদি ফাঁক পাই তাহলে সেদিন আমরা লন্ডন দেখব। এখানে দেখার জিনিসের কি অভাব আছে? মাদাম ত্যুসোর নাম শুনেছেন?’

‘ম্যাডাম টুসড?’

‘আপনার উচ্চারণে তাই।’

যেখানে বিখ্যাত লোকেদের মোমের প্রতিকৃতি আছে ত?’

‘ইয়েস স্যার। অবশ্য দ্রষ্টব্য। তারপর আর্ট গ্যালারিগুলো আছে, পার্লামেন্ট হাউসে বিগ বেন আছে, সেন্ট পল্‌স ক্যাথিড্রাল আছে—কত চাই? হেঁটে হেঁটে আপনার পায়ের গোড়ালিতে ফোস্কা পড়ে যাবে। অথচ এগুলো না দেখলে লন্ডন দেখা হল বলা চলে না।’

‘আপনার বিজ্ঞাপনটা কবে দিচ্ছেন?’

‘আজই এক ঘণ্টার মধ্যেই। পরশু বেরিয়ে যাবে।’

‘তা হলে কালকের দিনটা আমরা শহর দেখছি?’

‘হ্যাঁ।’

মাদাম ত্যুসো (ফেলুদার উচ্চারণে) দেখে তাক লেগে গেল ঠিকই। প্রত্যেকটা ঘরের দরজার সামনে পোর্টার দাঁড়িয়ে আছে এমনভাবে যে সেগুলোকেও দেখলে মনে হয় মোমের তৈরি। তারপর চেম্বার অফ হররস—সত্যিই গায়ে কাঁটা দেয়।

মিউজিয়ম দেখার পর বাইরে বেরিয়ে আমরা ফেলুদাকে অনুসরণ করে চললাম। এবারে কোথায় যাচ্ছে সেটা আগে থেকে কিছুই বলল না।

এখানকার অনেক রাস্তার নাম বড় বড় পাথরের ফলকে লেখা থাকে। একটুক্ষণ চলার পর সেইরকম একটা ফলক চোখে পড়ায় ব্যাপারটা এক ঝলকে বুঝে নিলাম। রাস্তার নাম বেকার স্ট্রীট! ২২১ বি বেকার স্ট্রীটে যে শার্লক হোম্‌সের বাড়ি সে কে না জানে? ওই নম্বরে যদিও সত্যি করে কোনো বাড়ি নেই। কিন্তু কাছাকাছি নম্বর ত আছে। ফেলুদা সেইরকম একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি। আজ আমার লন্ডন আসা সার্থক হল।’

বিশ্বের গল্প সাহিত্যে যত চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে খ্যাতিতে যে শার্লক হোম্‌স নাম্বার ওয়ান সেটা ফেলুদা অনেকবার বলেছে। কন্যান ডয়েল একটা গল্পে তিনি হোম্‌সকে মেরে ফেলেছিলেন। কিন্তু পাবলিক অ্যায়সা হল্লা করে যে ডয়েল বাধ্য হয়ে হোম্‌সকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।

বেকার স্ট্রীটে না এলে লন্ডন দেখা সম্পূর্ণ হত না এটা বুঝতে পারলাম।