ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

৭. ঘোরের মধ্যে সারাদিন

।। সাত ।। – ঘোরের মধ্যে সারাদিন

পরের দিন সকাল সাতটা।

একটা জিপ এসে দাঁড়াল। বুঝলাম প্রণবেশ এসেছে। ও এত সকালে এলে আমার কেমন ভয় করে। না জানি কী দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে।

খুব ব্যস্তভাবে ঢুকল প্রণবেশ। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম।

ও কোনো ভূমিকা না করে বলল, শিগগির আমার জিপে ওঠো।

ভয়—উদ্বেগ মেশানো গলায় বললাম, কেন?

কথা বাড়িও না। উঠে পড়ো।

তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে জিপে উঠে পড়লাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে জিপ এসে থামল ইস্টার্ন বাইপাসের মুখে। নেমে পড়লাম জিপ থেকে। রাস্তার মাঝখানে বেশ ভিড় জমে আছে। সশস্ত্র পুলিশও রয়েছে। খবরের কাগজের লোকেরাও এরই মধ্যে ছুটে এসেছে।

ভিড় ঠেলে প্রণবেশ আমাকে নিয়ে গেল জায়গাটায়। ভেবেছিলাম না জানি কী বড়োরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু সেরকম কিছু নয়। একটা কুকুর পড়ে আছে। মাথাটা তার থ্যাঁতলানো।

এ আর আশ্চর্য কী! রাত্তির বেলায় রাস্তার একটা কুকুর গাড়ি চাপা পড়েছে।

কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙল যখন প্রণবেশ একটা লাঠি দিয়ে মরা কুকুরটাকে চিত করে দিল। দেখলাম তার পেটটা কেউ যেন ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলেছে। নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে এসেছে।

বুঝতে পারলে কিছু? প্রণবেশ আমার দিকে তাকাল।

বললাম, এ তো গাড়ি চাপা পড়ে মরা নয়। কুকুরটার পেট চিরে কেউ মেরেছে। তারপর আক্রোশে মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে।

বুঝতে আর অসুবিধে হল না। শুধু বললাম, তাহলে সুব্বা সল্টলেকের মুখে ঢুকে পড়েছে।

হ্যাঁ। কুকুরটা বোধহয় অদ্ভুত কিছু দেখে তাকে বিরক্ত করছিল—তারই প্রতিফল।

কেমন একটা আচ্ছন্নের মতো বাড়ি এসে ঢুকলাম। তাহলে সত্যিই আর রেহাই নেই। এখন তাহলে দিন—রাত দরজা—জানলা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা। কিন্তু তাই বা সম্ভব কী করে? ডিউটি আছে। ভুতের ভয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকা তো যাবে না।

আশ্চর্য! সারা দিনটা যেন কেমন ঘোরের মধ্যে রইলাম। নোটন ইস্কুলে গেছে। আমার স্ত্রী গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে রান্নাবান্না করে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুলেন। সারা দুপুর একটা কাক বাড়ির ছাদে বসে কা—কা করে ডেকেই চলল। সামনের বাড়ির দেওয়াল থেকে একটা চাঙড় আচমকা ভেঙে পড়ল। ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে এসবই আমি দেখে যাচ্ছি। কিন্তু যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা।

হঠাৎ আমার মনে হল আমি যেন নেপালের কাঠমান্ডু থেকে জিপে করে চলেছি সেই পাহাড়তলিতে যেখানে সেই নিষ্ঠুর তান্ত্রিককে দেখেছিলাম। সেই পাইনগাছে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। জিপ কখনো উঠছে—কখনো নামছে…তারপরই দেখলাম সেই ছেলেটাকে কয়েকজন পাহাড়ি বিষ্ণুমতী নদীতে স্নান করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলি দেবার জন্যে। পাহাড়ের গুহা থেকে খাঁড়া হাতে বেরিয়ে এল সেই নিষ্ঠুর তান্ত্রিক—পেছনে গুহার গায়ে বাঁশের খুঁটোয় ঝুলছে চোদ্দো—পনেরো বছরের ছেলের সেই কঙ্কালটা….তান্ত্রিক বলি দেবার জন্য খাঁড়া তুলল…আমি বলে উঠলাম, প্রণবেশ—ফায়ার—

চমকে উঠলাম। কোথায় চলে গিয়েছিলাম আমি? এ তো শুধু ভাবা বা মনে করা নয়, সত্যিই যেন কেউ আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে নিয়ে গিয়েছিল কাঠমান্ডুতে। না, ভুল। এই তো আমি আমার ঘরেই বসে রয়েছি ইজিচেয়ারে। তাহলে এমন হল কেন?

হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখি এই বেলা চারটেতেই চারিদিকে যেন ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িগুলো যেন আর নেই। অদৃশ্য। তার জায়গায় শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। একটা কোনো মানুষজন নেই—ছেলেদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে না…কী হল? কোথায় গেল সব? আমি কেমন ভয় পেয়ে ডেকে উঠলাম, নোটন!

নোটনের মা ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

ওরকম করে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, না। ওকে দেখছি না যে?

ও তো এই মাত্র খেলতে গেল।

বললাম, চারিদিকে ধোঁয়া। এর মধ্যে ও বেরোল কেন?

নোটনের মা বললেন, ধোঁয়া! ধোঁয়া কোথায়? স্বপ্ন দেখছ নাকি?

স্বপ্ন! যাক নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু এরকম দেখলাম কেন?

আমার স্ত্রী তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ টেবিলের ওপর নজর পড়ল। চমকে উঠে বললাম, আচ্ছা, টেবিলে ওটা কী?

কোনটে?

ওই যে!

ওটা তো সিগারেটের প্যাকেট।

সিগারেটের প্যাকেট! ও আচ্ছা।

কী হয়েছে তোমার?

গা—ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। বললাম, না, কিছু হয়নি। আমি একটু ঘুরে আসি।

দাঁড়াও। চা করে দিই।

আমি চা খাইনি?

এই তো সাড়ে চারটে। এখনই তো চা খাও।

তবে দাও। বলে ফের ইজিচেয়ারে বসে পড়লাম।

চা খেয়ে বেরোতে যাচ্ছি স্ত্রী বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু। সন্ধে হয়ে না যায়।

বললাম, এখুনি ফিরব।

বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সারা দুপুর যে ঘোরের মধ্যে ছিলাম সেই ঘোরটাকে কাটাবার জন্যেই জোর করে বেরোলাম। বুঝতে পারছিলাম না আজ আমার মনটা কেন ওরকম হচ্ছিল।

একে সল্টলেক জায়গাটাই ফাঁকা। তার ওপর আমাদের এ. জে. ব্লকটা আরও ফাঁকা। কে বলবে এটা কলকাতা শহর। এখন এই পড়ন্ত বেলায় রাস্তাগুলো যেন বড়োই নির্জন বলে মনে হচ্ছে। অথচ অন্যদিন তেমন মনে হতো না। তবে কি জীবন্ত কঙ্কালের ভয়ে সবাই এরই মধ্যে বাড়ি ঢুকে গেছে? আশ্চর্য! এমন সাজানো—গোছানো সল্টলেক সিটি—এত সুন্দর বাড়ি—কল্পনা করা যায় গভীর রাতে এই পথেই হবে ভয়ংকর জীবন্ত কঙ্কালের আবির্ভাব?

অবশ্য—অবশ্য সল্টলেক না হয় আজই সুন্দরী সিটি হয়েছে কিন্তু আজ থেকে মাত্র ছত্রিশ বছর আগে এই জায়গাটা ছিল বিস্তীর্ণ জলাজমি। মাছ চাষের ভেড়ি। তখনকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চেষ্টায় ১৯৬২ সালে শুরু হল গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে সল্টলেক ভরাট করার কাজ। ১৯৬৪ সালে বালি দিয়ে ভরাট করে গড়ে ওঠে লবণহ্রদ। জোব চার্নকের পর এই প্রথম কলকাতা তার পূর্ববর্তী জলাভূমির নাগপাশ ভেদ করে নতুন রূপ নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল। তারপর আর চার বছরের মধ্যে সেই পরিত্যক্ত জলাভূমির জায়গায় দেখা দিল এক আদিগন্ত সমতলভূমি। চাঁদের পিঠের মতো রুক্ষ—প্রাণীশূন্য। লবণহ্রদের পাঁচ বর্গমাইল প্রান্তরে কোথাও এতটুকু ছায়া নেই—শুধু এদিক—ওদিক ছড়ানো—ছেটানো কনট্রাকটারদের টিনের চালা। এক ফোঁটা পানীয় জল নেই কোথাও—না আছে পাখি, না প্রজাপতি—না একটা ফড়িং। সেদিন তখনও রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি, যানবাহনের প্রশ্নই নেই। স্থানীয় থানার এক দারোগা খুন হয়েছিল এখানে। কাঁকুড়গাছি ছাড়িয়ে কেউ এদিকে আসতে সাহস পেত না। রাত্তিরে চাঁদের আলোয় ধু ধু সাদা বালি দেখে মনে হত এক বিচিত্র মরুভূমি।

হঠাৎ—হঠাৎই যেন গোঁ গোঁ করে কোথা থেকে ছুটে এল ধুলোর ঝড়। না, ধুলো নয়—বালি—শুধু বালি—বালির ঝড়। চমকে উঠলাম—এত বালি এল কোথা থেকে? তারপরেই দেখি ধু ধু সাদা বালির সমুদ্রে দিশেহারা পথিকের মতো আমি একা দাঁড়িয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম—কে আছো বাঁচাও!….

যখন জ্ঞান ফিরল দেখি একজনদের বাড়ির সিঁড়ির ওপর বসে আছি।

দু—চারজন ভদ্রলোক আমায় ঘিরে রয়েছেন। একজন বললেন, কেমন আছেন এখন?

অস্ফুট স্বরে বললাম, আমার কী হয়েছিল?

বোধহয় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনি কোথায় থাকেন?

আমি ঠিকানা বললাম। ওঁরা চমকে উঠলেন। বললেন, হেঁটে হেঁটে এত দূর এসেছিলেন!

তাঁরা যখন আমায় সাইকেল রিকশা করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে দরজা—জানলা বন্ধ করে দিলাম।

সাবধানের মার নেই—তাই ভালো করে ঘরের কোণ, খাটের তলা দেখে নিলাম। কেউ ঘরে ঢুকে লুকিয়ে নেই তো?

সমস্ত বাড়িটা যেন থমথম করছে। নোটন পর্যন্ত যেন কেমন বোবা হয়ে গেছে। সে পরিষ্কারভাবে কিছু বুঝতে না পারলেও বোঝা যাচ্ছে ভয় পেয়েছে।

স্ত্রীর মুখে হাসি তো নেইই, কথাও নেই। রাত নটার সময়ে শুধু বললেন, আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া উচিত। অর্থাৎ শুয়ে পড়লেই যেন নিশ্চিন্ত।

তাই হল। খাওয়া—দাওয়া সেরে যখন শুলাম তখন ঘড়িতে দশটা বেজেছে।

পাশের ঘরে নোটন আর নোটনের মা শোয়। এই ঘরে আমি একা। অন্যদিন আমরা আলো নিভিয়ে দিই। নোটনের মা আজ নাইট—ল্যাম্প জ্বেলে রাখলেন। আমি নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আজ এত ভয় পাচ্ছি কেন? নোটনের মাও তো দেখছি ভয় পেয়েছে। কিন্তু কীসের ভয়? ও—ও কি মনে করছে আজ রাত্তিরেই সুব্বা হানা দেবে?

ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল খুব গরম লাগছে। পাখা কি বন্ধ হয়ে গেছে? টর্চ জ্বাললাম। না, পাখা তো দিব্যি চলছে। তখন মনে হল জানলাগুলো সব বন্ধ। তাই—

জানলা খুলতে যাচ্ছিলাম, তখনই মনে হল—জানলা খোলা তো নিষেধ। কাজেই মশারির মধ্যে নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সবে চোখ বুজিয়েছি অমনি দুম করে একটা শব্দ—আমাদের বাড়ির মধ্যে। আমি চমকে উঠে বসলাম। পাশের ঘর থেকে আমার স্ত্রী চিৎকার করে উঠলেন, ওগো, শুনছো!

আমি তাড়াতাড়ি উঠে ও ঘরে গেলাম। তারপরে দুজনে মিলে ঘর—বারান্দা খুঁজলাম। কোথাও কিছু নেই।

একবার বাইরেটা দেখে আসব?

স্ত্রী কঠিন স্বরে বললেন, না। দরজা খুলবে না।

অগত্যা আবার বিছানায় গিয়ে ঢুকলাম। এবার রিভলভারটা নিয়ে রাখলাম বালিশের নীচে। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে বেজেছে।

ভোরে উঠেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম সেই ফুলগাছের টবটা ছাদ থেকে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে।