ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৭. গুপ্তঘাতক

৭. গুপ্তঘাতক

মধ্যাহ্ন। শিলাকীর্ণ বন্ধুর পথ। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে অরণ্য কোথাও গভীর, কোথাও বা অগভীর হালকা। পূর্বোক্ত পথের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক অশ্বরোহী। ওই অশ্ব ও তার আরোহী আমাদের পরিচিত অঞ্জন নামক অশ্বের পৃষ্ঠে আসীন হয়ে সুবন্ধু চলেছে গ্রীকশিবিরের উদ্দেশে…

আচম্বিতে পাশ্ববর্তী অরণ্যের ভিতর থেকে একটি দড়ির ফাঁস উড়ে এসে সুবন্ধুর দুই হাত বেঁধে ফেলল তার দেহের সঙ্গে পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে সুবন্ধু অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতীর্ণ হল ভূমিপৃষ্ঠে।

মুহূর্তের মধ্যেই বিস্ময় ও আঘাতের ধাক্কা সামলে নিয়ে উঠে বসল সুবন্ধু এবং বাঁ হাত দিয়ে দক্ষিণপার্শ্বে আবদ্ধ কোষ থেকে ছুরিকা হস্তগত করতে সচেষ্ট হল। ফাঁসের দড়ি তার দুই বাহুকে দেহের সঙ্গে বেঁধে ফেললেও কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত তার দুই পুরোবাহু ছিল আংশিকভাবে মুক্ত। তাই তরবারি আকর্ষণ করতে না পারলেও ছুরিটাকে কোনোরকমে খাপ থেকে টেনে নিল সে। কিন্তু ছুরিটা ফঁসের দড়িতে ঠেকানোর আগেই জঙ্গল ভেদ করে পথের উপর আত্মপ্রকাশ করল তিন আশ্বারোহী!– তাদের মধ্যে একজনে ফাঁসের দড়ির অপরপ্রান্ত ধরে রেখেছে এবং তার দুই সঙ্গীর হাতে খোলা তলোয়ার জ্বলে জ্বলে উঠছে প্রখর সূর্যালোকে!

তিনমূৰ্ত্তির উদ্দেশ্য বুঝতে একটুও দেরি হল না সুবন্ধুর, সে তাড়াতাড়ি বাঁ হাতের ছুরিকে চালনা করল দক্ষিণহস্তের বন্ধন রঞ্জুর উপর। স্কুল ও কর্কশ রঞ্জু সহজে কাটতে চায় না– দড়ির ফাঁস ছুরির আঘাতে ছিন্ন হওয়ার আগেই এক অশ্বারোহী তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে সুবন্ধুর পাশে এসে তলোয়ার তুলল। কিন্তু ঘাতকের অস্ত্র সুবন্ধুর উপর নেমে আসার আগেই উপস্থিত সকলকে তীব্র চিৎকারে চমকে দিয়ে উদ্যত অসিহস্তে বনভূমির ভিতর থেকে অশ্বারোহণে ছুটে এল এক রমণী– মহারাণী ছায়া!

রমণীকণ্ঠের সেই ভয়ংকর রণনিনাদ মুহূর্তের জন্য ঘাতককে স্থান করে দিয়েছিল–সংবিৎ ফিরে পেয়ে আত্মরক্ষার সচেষ্ট হওয়ার আগেই তার কণ্ঠ বিদীর্ণ করে দিল শাণিত তরবার ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ঘাতকের প্রাণহীন দেহ!

পরিস্থিতি বুঝে দ্বিতীয় ঘাতক সুবন্ধুকে ছেড়ে তরবারি তুলল ছায়াকে লক্ষ্য করে, কিন্তু ততক্ষণে ছুরির ঘর্ষণে বন্ধনরঞ্জু হয়েছে ছিন্ন এবং উপবিষ্ট অবস্থা থেকে দন্ডায়মান হয়ে পিঠের ধনুবাণ হাতে নিয়েছে সুবন্ধু।

ছায়া তরবারি তুলে আততায়ীকে বাধা দিতে উদ্যত হল। দুটি তরবারির ধাতব ঝঙ্কার পরস্পরকে আলিঙ্গন করার আগেই শূন্যে বিদ্যুৎবর্ষণ করে উড়ে এল সুবন্ধুর বাণ, অস্ফুট আর্তনাদ করে তীরবিদ্ধ দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়ল দ্বিতীয় ঘাতক। তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। সঙ্গীদের অবস্থা দেখে তৃতীয় ব্যক্তি ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হল গভীর অরণ্যের গর্ভে…

ছায়ার দিকে ফিরে সুবন্ধু সবিস্ময়ে বলল, তুমি না এলে এতক্ষণে আমার রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানেই পড়ে থাকতো। কিন্তু দেবতার অভাবিত আশীর্বাদের মতো তুমি হঠাৎ এখানে উদয় হলে কোথা থেকে?

হঠাৎ নয়। ছায়া হাসল, নিহত দুই ব্যক্তি এবং তাদের পলাতক সহচর আজ প্রভাতে আমার প্রহরীদের কাছে তোমার বিষয়ে নানারকম প্রশ্ন করছিল। প্রহরীরা তাদের সন্দেহ করে নি, কিন্তু তাদের মুখ থেকে যখন জানতে পারলাম তিনটি সশস্ত্র আর্যযুবক তোমার খোঁজখবর নিতে নানাপ্রকার প্রশ্ন করছিল তখনই আমার সন্দেহ হল। তারা যদি তোমার মিত্র হয়, তাহলে তোমার সঙ্গে দেখা না করে তারা প্রহরীদের কাছে তোমার সম্পর্কে অনুসন্ধান করে ফিরে গেল কেন? এখান থেকে গ্রীকশিবিরে যাওয়ার একটি গোপনপথ আমি জানি তোমার অলক্ষ্যে এবং ঘাতকদের অজ্ঞাতসারে ওই পথে আমি তোমায় অনুসরণ করেছিলাম।

সুবন্ধু গাঢ়স্বরে বলল, মহারাণী! তুমি আমার প্রাণরক্ষা করেছ। আমার নিজস্ব ছুরিকা বহুপূর্বেই হারিয়েছি, তোমার উপহারের দান এই ছুরিকা আমার সাহায্য করেছে চরম মুহূর্তে।

ছায়া ভ্রু কুঞ্চিত করল, কিন্তু এই গুপ্তঘাতকেরা তোমাকে হত্যা করতে এল কেন?

মগধরাজ নন্দের সিংহাসন নিষ্কন্টক করার জন্যও নিযুক্ত হয়েছিল তিন গুপ্তঘাতক।

সুবন্ধু! দারুণ বিস্ময়ে চমকে উঠল ছায়া, তোমাকে হত্যা করলে মহারাজ নন্দর সিংহাসন নিষ্কন্টক হবে? অর্থাৎ তুমিই মগধ-সিংহাসনের এক দাবিদার?

সুবন্ধুর ওষ্ঠাধরে ফুটল রহস্যময় হাসি। সে নীরব রইল, ছায়ার প্রশ্নের উত্তর দিল না।

ছায়া আবার বলল, তোমার অনামিকার অঙ্গুরীতে রয়েছে মগধের রাজচিহ্ন, রাজবংশের মানুষ না হলে ওই অঙ্গুরীয় ধারণের অধিকার থাকে না।

অকস্মাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল ছায়া, পূর্বেই শুনেছি তোমার দেহে রাজরক্ত প্রবাহিত, প্রমাণ স্বরূপ তোমার হাতে রয়েছে মগধের রাজচিহ্ন অঙ্কিত অঙ্গুরীয়– এখন শুনছি সিংহাসন নিষ্কন্টক করার জন্য মগধের নন্দরাজ গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করেছেন তোমায় হত্যা করতে। সুবন্ধু আমিও জনরব শুনেছি যে, নন্দবংশের এক রাজকুমার মহারাজ নন্দের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে রাজপুরী থেকে পলায়ন করেছে তুমি কি সেই রাজপুত্র যার প্রাণদন্ডের আদেশ দিয়েছেন নন্দরাজা?

সুবন্ধু হাসল, জনরবে কর্ণপাত করা মহারাণীর উচিত নয়। আপাততঃ আমাকে বিদায় দাও। তুমি তো জানো সন্ধ্যার সময়ে গ্রীকশিবিরে সম্রাট আলেকজান্ডার আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

ছায়া সুবন্ধুর সঙ্গী হতে চাইল। কারণ, একটি গুপ্তঘাতক এখনও পলাতক। সুবন্ধু জানাল সে সতর্ক থাকবে, মহারাণীর সাহচর্য অনাবশ্যক। অতঃপর মহারাণীর কাছে বিদায় নিয়ে গ্রীকশিবিরের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সুবন্ধু…