খেয়েদেয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে এইসব ঘটনা ভাবতে লাগল হরি। ভেবে কোনও কূল-কিনারা পেল না। মাথা গরম হয়ে গেল।
হঠাৎ তার নজর গেল দেওয়ালের ছবিটার দিকে। ওর পিছনে একটা গুপ্ত দরজা আছে। হরি আর দেরি করল না। জানালার পাল্লা ভাল করে এটে পদা টেনে দিল, যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায়। তারপর টেবিলটা দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে তার ওপর চেয়ার তুলল। চেয়ারের ওপর দাঁড়াতেই ছবি তার নাগালে এসে গেল।
ছবিটা একটু ঠেলতেই সরে গেল। পিছনে ফোকর। টর্চ পকেটে নিয়ে বুক ঘষটে, হাতে ভর দিয়ে সে উঠে পড়ল সুড়ঙ্গের মুখে। তারপর ছবিটা টেনে গর্তটা ঢেকে দিল।
টর্চ জ্বেলে চারধারটা দেখল সে। খুবই সঙ্কীর্ণ একটা গলির মতো জায়গা। মাথা নিচু না করলে ছাদে মাথা ঠেকে যায়। টর্চ ফেলে কয়েক পা এগোল হরি। গলিটা তার ঘরের সমান্তরাল খানিকদূর গিয়েই একটা সিঁড়ির মুখে শেষ হয়েছে। খাড়া সিঁড়ি। ধাপগুলো বেশ উঁচু-উঁচু।
পটল দাস এই পথে আনাগোনা করে, সুতরাং ভয় পাচ্ছিল না হরি। সে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। নামতে নামতে মনে হল সে পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছে। তার ঘরের মেঝের অনেক নীচে।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হল সেটা একটা অপরিসর ঘর। ঘরে কিছুই নেই। শুধু একধারে একটা মাদুর পড়ে আছে। মাদুরের ওপর একটা দেশলাই আর কয়েকটা বিড়ি। হরি বুঝল, পটল দাস মাঝে-মাঝে এখানে বিশ্রাম করতে আসে।
সিঁড়ির উলটো দিকের দেওয়ালে আর-একটা দরজা দেখা গেল। লোহার দরজা, বেশ মজবুত। তবে হুড়কো বা ছিটকিনি নেই। হরি দরজাটা খুলে আর-একটা গলি দেখতে পেল।
গলি ধরে বেশ অনেকটা সমতলে হাঁটল হরি। তারপর আচমকাই টের পেল, গলি ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে।
নামতে নামতে ফের আরও দু-তিনতলা নেমে এল হরি। গলিটা শেষ হল একটা গোল ঘরের মধ্যে। কোনও দরজা, জানালা, ফোকর কিচ্ছু নেই। চারদিকে নিরেট দেওয়াল আর ছাদ। আগে হয়তো টাকাকড়ি সোনাদানা লুকিয়ে রাখা হত এখানে।
হরি টর্চ জ্বেলে খুব ভাল করে চারদিকটা দেখল। বিড়ির টুকরো দেখে বুঝল, পটল দাস এখানেও আসে। সুতরাং এখানে নতুন কিছু আবিষ্কার করার আশা বৃথা।
ফিরে আসবে বলে হরি যখন ওপর দিকে উঠছে তখন মাঝপথে সে বাঁদিকে আরও একটা ফোকর আবিষ্কার করল। দেওয়ালের খাঁজে খুবই সঙ্কীর্ণ একটা ফাটলের মতো, নামবার সময় চোখে পড়েনি।
হরি তাতে মুখ বাড়িয়ে দেখল, ভিতরে খুব সরু একটা গলিপথ। এ-পথও পটল দাসের চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়ই। সে সন্তর্পণে ভিতরে পা দিল।
এ-পথটাও নীচে নেমেছে। হরি হাঁটতে লাগল।
বেশ খানিকটা হাঁটার পর পথ আবার ওপরে উঠতে লাগল। অবশেষে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে হরি যেখানে এসে দাঁড়াল, সেটা একটা বন্ধ দরজা। ঠেলল। দরজাটা খুলল না।
একটু ভাবল হরি। দরজা? নাকি তার ঘরের মতোই এখানেও ছবি?
সন্তর্পণে দরজাটাকে পাশের দিকে ঠেলল হরি। নিঃশব্দে দরজা সরে গেল। সামনেই একটা ঘর। তবে প্রায় দশ ফুট নীচে তার মেঝে। হরি ঠিক তার ঘরের ছবির পিছনকার মতোই একটা গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তবে নীচের ঘরটা তার নয়। অন্ধকার হলেও বুঝতে পারছিল হরি। তার মনে হল, এটা দুখিরামবাবুর গ্রিন ভ্যালির কোনও ঘরও নয়।
তবে কি কুসুমকুঞ্জ? গায়ে একটু কাঁটা দিল হরির।
দম চেপে কিছুক্ষণ নীচের অন্ধকার ঘরটার দিকে চেয়ে রইল সে। টর্চটা জ্বেলে দেখতে তার কেমন যেন সাহস হল না। তার মনে হচ্ছিল, ঘরটা জনশূন্য না-ও হতে পারে। কেউ যদি ঘাপটি মেরে থেকে থাকে তবে মুশকিল হবে।
অন্ধকার হলেও আবছাভাবে হরি দেখতে পাচ্ছিল, ঘরে কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। উলটো দিকে একটা জানালা দিয়ে বাইরের খুব মৃদু আলোর আভাস আসছে। তাই দিয়ে যতটা দেখা যায় তাতে হরির মনে হল, ঘরটা ফাঁকাই।
সাহস করে এবার টর্চটা জ্বালল সে।
সাধারণত বড়মানুষদের বসবার ঘর যেমন হয় তেমনি সাজানো। সোফাসেট, একটা ডিভান, টেবিল। তবে আসবাবগুলো বড্ড পুরনো আর ভাঙাচোরা। দেওয়ালে নোনা লেগেছে, ঘরের কোণে-কোণে ঝুল জমেছে মেলা। তবে মেঝেয় তেমন ধুলোর আস্তরণ দেখতে পেল না সে।
তবে কি এখানে লোকজনের আনাগোনা আছে? হঠাৎ বাইরে থেকে একটা শব্দ এল। মনে হল জানালার ওপাশে কে যেন মাটিতে আছাড় খেল ধপাস করে। তারপর একটা চেনা গলার আর্তনাদ, “ওরে বাবা রে!”
টপ করে টর্চটা নিবিয়ে দিল হরি। বাইরে কিছু-একটা হচ্ছে। কে যেন চাপা গলায় বলল, “চল ব্যাটা, সত্যি কথা না বললে আজ তোকেই কবর দেব।”
“আমি কিছু জানি না।”
“জানিস কি না জানিস সেটা বোঝা যাবে ওষুধ পড়লে।”
“উঃ, ঘাড় ভেঙে যাবে যে…”
“ভাঙবার জন্যই তো রদ্দা দেওয়া হচ্ছে।”
“ছেড়ে দাও বাবারা, আমি বুড়ো মানুষ।
“বুড়ো! বর্টে! কিন্তু তোমার বুড়ো হাড়ে যে ভেলকি খেলছিল বাবা একটু আগে! আমাদের তিন-তিনটে মরদকে যে তুমি ঘায়েল করেছ বুড়ো শয়তান! এখন আবার ন্যাকার মতো বুড়ো সাজা হচ্ছে?”
“আ হা হা, হাতটা যে গেল! অত জোরে মোচড়ায় নাকি রে! এ কি বাপু ইস্টিলের জিনিস?”
পটাং করে একটা শব্দ হল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
তারপর একটা ভারী জিনিসকে হেঁচড়ে আনার শব্দ হল। কে যেন চাবি বের করে তালা খুলছে ঘরের।
হরি ছবিটা খুব সন্তর্পণে টেনে গর্তটা ঢেকে দিল। শুধু চুলের মতো একটু ফাঁক রাখল।
বাঁ ধারে একটা দরজা কাঁচকোঁচ করে খুলে গেল। চারজন লোক পঞ্চম আর-একটা লোককে হেঁচড়ে টেনে এনে ঘরের মেঝের ওপর ফেলে দিল।
মেঝেয় পড়ে থাকা লোকটা যে পটল দাস তাতে সন্দেহ নেই হরির। কিন্তু পটল তো খিচুড়ি খেতে বাড়ি গেল। তাকে এরা পেল কোথায়?
আর লোক গুলোই বা কারা?
লোকগুলো একটা মোমবাতি ধরিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। সেই আলোয় হরি দেখতে পেল, চারজনের একজন গদাধর। আর তিনজনই অচেনা। তবে তাদের চেহারা এবং চোখমুখ দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে, এরা ভাল লোক নয়।
পটল দাস মেঝের ওপর পড়ে গোঙাচ্ছিল।
কোমরে ভোজালিওলা বেঁটে এবং ভারী জোয়ান একটা লোক বলল, “এ, এই উটকো বুড়োটার জন্য বহুত পরেসানি গেছে। কে জানত যে ব্যাটা কুংফু-কারাটে জানে।”
হাতে একটা ছোট লাঠিওলা কালো ডাকু চেহারার লোক বলল, “আমি তো ভাবলুম এটা মানুষই নয়। ভূতফুত হবে। নইলে রাজু, দিপু আর অনিলকে ওভাবে শুইয়ে দেওয়া কি যার-তার কাজ!”
বেঁটেটা বলল “ওদের কী হল? কে দেখছে ওদের?”
“চালু আছে। চোট তেমন সাঙ্ঘাতিক নয়। শক্ত ছেলে। উঠে পড়বে।”
বেঁটেটা কিছুক্ষণ পটল দাসের দিকে চেয়ে থেকে গদাধরের দিকে চোখ তুলে বলল, “গদাই, তা হলে এই লোকটাই?”
“হ্যাঁ, হরিবন্ধুর ঘরে একেই দেখেছি। এর নাম পটল দাস। একসময়ে নাম-করা চোর ছিল।”
“চোর! ভেরি গুড। চোরেরাই সব অন্ধিসন্ধির খবর রাখে।”
গদাধব ওরফে গদাই বলল, “পটল দাস হরিবন্ধুকে বলছিল, পাগলা-সাহেবের কবর খুঁজে বার করার সঙ্কেত ও জানে।”
বেঁটেটা ডাকু লোকটাকে বলল, “বাইরে বাগানের কল থেকে একটু জল এনে চোরটার মুখে-চোখে ঝাঁপটা দে। পেট থেকে কথা বের করতে হবে।”
জলের ঝাঁপটা দেওয়ার কথাতেই কি না কে জানে, পটল দাস একটু ককিয়ে উঠে বলল, “পেটে কি আর কথা আছে বাপু? এখন যে নিজের বাবার নামটাও ভুলে বসে আছি। না বাপু, মাথায় গাঁট্টা মারাটা তোমাদের উচিত হয়নি।”
একথায় চারজনই পরম্পর একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
বেঁটেটা দাঁত কড়মড় করে বলল, “ওরকম চোরের মার খেয়েও তোমার কিছু হয়নি দেখছি। বেশ শক্ত ধাতের লোক তো তুমি। কিন্তু তার চেয়েও শক্ত ওষুধ আমাদের কাছে আছে তা জানো?”
পটল দাস ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কিছু হয়নি মানে? কে বলল কিছু হয়নি? ঘাড়টা টনটন করছে, মাজা ঝনঝন করছে, হাত কনকন করছে, চোখে সর্ষেফুল দেখছি! তবু বলছ কিছু হয়নি? আর আমি তো চোর নই যে, চোরের মার হজম করতে পারব।”
বেঁটে লোকটা ভোজালির বাঁটে হাত রেখে বলল, “আমরা যা জানতে চাই তা যদি সাফ-সাফ না বলো, তা হলে জানে খতম হয়ে যাবে, তা বুঝতে পারছ? তিনটে আনাড়িকে ঘায়েল করেছ বলে যে আমাদেরও জব্দ করবে সে আশা কোরো না। এবার আর রদ্দাফদ্দা নয়, স্রেফ গলা ফাঁক করে দেব।”
“অত ভয় দেখাতে হবে না। ভয় আমি পেয়েই আছি। কিন্তু জানলে তো বলব বাবারা! আমি তো সাতে-পাঁচে থাকি না। আমার ছেলে প্যালারাম রেলে চাকরি পেয়ে গেছে। সে টাকা পাঠাতে শুরু করলেই আমরা বুড়োবুড়ি কাশীবাসী হব। আর এ-তল্লাটে নয়। বুড়োবয়সে বড় হেনস্থা হতে হচ্ছে গো।”
“এঃ, একেবার ধর্মের ষাঁড়! কাশীবাসী হবেন। কাশী তোমাকে এখানেই বাস করাচ্ছি।”
এই বলে বেঁটে লোকটা পটলের ঘাড়টা ধরে টেনে দাঁড় করাল। তারপর পটাস করে গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাশীবাসী বুড়ো, তা তুমি যদি এতই ধাম্মিক তা হলে আমার দলের তিনটে ছেলেকে অমন গুণ্ডার মতো মারধর করলে কেন?”
চড় খেয়ে পটল দাস গালে হাত বোলাতে-বোলাতে অবাক গলায় বলল, “দুধের বাছাদের আমি আবার মারলুম কখন? আমবাগানের ভিতর দিয়ে পেটে খিদে নিয়ে যাচ্ছিলুম বাবারা, আমার দোষঘাট নিও না। পেটে তখন চোঁচা খিদে। ওদিকে বাড়িতে আজ ফুলকপি আর ভাজা-মুগের ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। সেই অবস্থায় তোমরা সব এসে আমাকে ঘিরে ধরলে। তখন কি খিদের চোটে মাথার ঠিক ছিল বাপ! বুড়োমানুষ, খিদে আর ভয়ে বেমক্কা হাত-পা ছুঁড়েছি হয়তো, তাইতেই দুধের বাছাদের একটু লেগেছে। তবে ইচ্ছে করে কিছু করিনি বাবারা।”
বেঁটেটা দু’কোমরে দু’হাত রেখে বুক চিতিয়ে বলল, “তা আমরাও তোমার গায়ে ইচ্ছে করে হাত তুলছি না বুড়ো-ঘুঘু। আমাদের হাত আপনা থেকেই উঠে যাচ্ছে। এখন বলো তো বাছাধন, তোমাদের পাগলা-সাহেবের কবরটা কী করে খুঁজে পাব?”
পটল দাস কানে হাত চাপা দিয়ে সভয়ে বলল, “রাম রাম, রাম রাম। রাতবিরেতে ওসব নাম উচ্চারণ করতে নেই। উনি কুপিত হবেন।”
গদাধর গর্জন করে বলল, “ব্যাটা ইয়ার্কি করছে। একটু আগেই হরিবন্ধুকে বলছিল, আমি নিজের কানে শুনেছি।”
বেঁটেটা চতুর্থজনের দিকে ফিরে বলল, “তুই গিয়ে হরি ছোঁড়াটাকে ধরে নিয়ে আয় তো। দু’জনের মধ্যে যখন এত ভাব, তখন দু’জনের পেট
থেকেই কথা বার করা যাক।”
চতুর্থজন এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। চারজনের মধ্যে সেই সবচেয়ে লম্বা আর চওড়া। একখানা দানব বললেই হয়। নিঃশব্দে ঘাড়টা একটু কাত করে চলে যাচ্ছিল। পিছন থেকে গদাধর বলল, “ওবাড়িতে একটা দরোয়ান আছে। বিশাল চেহারা। সে খুব ঘুমোয়। যদি হঠাৎ জেগে যায় তবে চপারটা চালিয়ে দিস।”
লোকটা চলে গেল।
ভয়ে হরির হাত-পা হিম হয়ে এল। সে যতদূর জানে, জগুরাম এ-সময়টায় তুলসীদাসের দোহা পড়ে। একটু রাতে ঘুমোতে যায়। হয়তো এখনও ঘুমোয়নি। কী হবে তা হলে?
হঠাৎ সে তাকিয়ে দেখল পটল দাস কেমন অদ্ভুত চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। না, পটলদা নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু কিছু একটা আন্দাজ করেছে। ছবিটা যে একটু সরানো, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। বোধহয় অনুমান করছে যে, ছবির আড়াল থেকে কেউ দেখছে তাদের।
পটল হঠাৎ ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠে বলল, “কপালে এত দুঃখুও ছিল রে প্যালারাম! কোথায় রে প্যালা, কোথায় পালিয়ে রইলি বাপ! প্যালা! প্যালা! প্যালা রে!”
“চোপ!” বেঁটেটা গর্জন করে উঠল। কিন্তু হরির আজকাল বুদ্ধি খুলেছে। হয়তো বিপদে পড়লেই মানুষের বুদ্ধি খোলে। পটলদা যে কৌশলে তাকে পালিয়ে যেতে বলছে, এটা বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। একমাত্র পটলই বোধহয় বুঝতে পেরেছে, ছবির পিছনে কে।
হরি দ্রুতপায়ে যে পথ ধরে এসেছিল সেই পথে ফিরে চলল। কিন্তু মুশকিল হল টর্চটা জ্বলছে না। ব্যাটারি কমজোরি হয়ে পড়েছিল। এখন একেবারেই গেছে। সামনে ঘুটঘুটি অন্ধকার। হরি তবু সিঁড়ি ভেঙে নেমে গলিটা পেয়ে হাঁটতে লাগল, অন্ধকারে যতদূর সম্ভব দ্রুতবেগে।
কিন্তু হঠাৎ তার মনে হতে লাগল, সে ভুল পথে যাচ্ছে।
আসার সময় সে অবশ্য একটা গলি ধরেই এসেছিল। অন্য কোনও সুড়ঙ্গ তার নজরে পড়েনি। কিন্তু নিবুনিবু টর্চের আলোয় গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গে সে আর কতটুকুই বা দেখেছে! আন্দাজে সে বুঝল, এতক্ষণে তার গলির মুখে পৌঁছে যাওয়া উচিত। কিন্তু পৌঁছয়নি। ওদিকে গুণ্ডাটা গেছে তাকে ধরে আনতে। জগুরাম বাধা দিলে খুন হয়ে যাবে। তারপর গুণ্ডাটা তার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর চেয়ার দাঁড় করানো দেখে সন্দেহ করবে। সুড়ঙ্গের পথ খুঁজে বের করতে তার মোটেই দেরি হবে না। হরি যদি তাড়াতাড়ি ঘরে পৌঁছতে পারে এবং লাঠিটা বাগিয়ে ধরতে পারে তা হলে হয়তো শেষরক্ষা হয়।
কিন্তু অন্ধকারে আরও মিনিট-দুই জোর কদমে হেঁটেও কোথাও গলির মুখ পেল না হরি। পথটা যেন বড্ড গড়িয়ে নামছে এবার। মাটির সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে।
হরি একটু দাঁড়াল। মাটির তলাটা ভীষণ নিস্তব্ধ। কবরের মতো নিথর। অন্ধকার এত জমাট যে, মনে হয় অন্ধ হয়ে গেছি।
হরির এবার ভয় করতে লাগল। এই অন্ধকার থেকে তাকে বেরোতেই হবে। যেমন করে হোক। সে হঠাৎ প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।
আর বিপদটাও ঘটল সঙ্গে-সঙ্গে। দড়াম করে একটা হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ল সে। তারপর ঢালু বেয়ে অনেকটা গড়িয়ে গিয়ে ফের ধাক্কা খেল একটা কাঠের তক্তায়। মাথায় চোট পেল। কনুই ছড়ে গেল, হাঁটুতেও বেশ লাগল তার। মাথাটা ঝিমঝিম করায় কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল সে।
তারপর চোখ খুলল।
আশ্চর্য! সুড়ঙ্গের ভিতরে একটা নীলচে আলো না! হরি তাকিয়ে দেখল, তার পিছনেই একটা ছোট্ট চৌকো কপাট একটু ফাঁক হয়ে আছে। ভারী নরম নীল একটা আলো ঠিকরে আসছে ওপাশ থেকে।
হামাগুড়ি দিয়ে গর্তের মধ্যে সাবধানে মুখ বাড়াল সে। তারপর বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেল। যা দেখল তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দেখল, ফোকরের নীচে চমৎকার একখানা ঘর। সাধারণ ঘর নয়। কুয়োর মতো গোল হয়ে নেমে গেছে। অনেক নীচে, প্রায় বিশ ফুট গভীরে ঘরখানা দেখা যাচ্ছে। নীল আলোয় ভরে আছে ঘরখানা। সেই ঘরে কিছুই প্রায় নেই। একধারে লম্বা একটা কাঠের বাক্স। অন্য ধারে একটা ডেকচেয়ার।
প্রথমটা ভাল দেখতে পাচ্ছে না হরি। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর তার মনে হল, ডেকচেয়ারের ওপর রোগা একজন মানুষ শুয়ে আছে। খুব রোগা, সাদা চুল, ধপধপে ফসা রং। পরনে নীল রঙের একটা ড্রেসিং গাউন।
লোকটা কে? ও ঘরটাই বা কোন বাড়ির? হরির মনে হল, এটা গ্রিন ভ্যালি বা কুসুমকুঞ্জ নয়। সুড়ঙ্গ ধরে সে ভুল পথে অন্য কোনও বাড়িতে চলে এসেছে।
সে যাই হোক, এখন তার সাহায্য দরকার। যেমন করেই হোক, এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে তাকে গ্রিন ভ্যালিতে ফিরতে হবে। ওই রোগা লোকটাকে তার শত্রুপক্ষের বলে মনে হচ্ছিল না। আর যদি হয়ও তো, কীই বা করার আছে!
সে দেখতে পেল, লোকটা ডেকচেয়ারে শুয়ে একটা বই পড়ছে যেন। হরি ডাকল, “শুনছেন! আমাকে একটু সাহায্য করবেন?”
ডাক শুনে লোকটা তার দিকে তাকাল।
এত দূর থেকেও হরির মনে হল, ঘরের নীল আলোটা যেন ওর দু’খানা উজ্জ্বল নীল চোখ থেকেই বেরিয়ে আসছে। এমন সুন্দর চোখ সে কখনও দ্যাখেনি।
লোকটা কুয়োর ভিতর থেকে গমগমে গলায় বলল, “কী চাও? এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমি বাইবেল পড়ছি।”
“আমি গ্রিন ভ্যালিতে যাব। ভুল পথে এসে পড়েছি এখানে। আমার খুব বিপদ।”
লোকটা রোগা হাতে নিজের সাদা চুল মুঠো করে চেপে ধরে বলল, “কেন যে বিরক্ত করো আমায়। যে পথে এসেছ সেইপথে ফিরে যাও। কুড়ি পা হাঁটবার পর ডান দিকে ঘুরে যেও। ঠিক কুড়ি পা, গুনতে যেন ভুল না হয়। দরজাটা টেনে দাও। বিরক্ত কোরো না।”
লোকটা একটু রাগী ঠিকই। কিন্তু খারাপ নয়। পটলদা নিশ্চয়ই চিনবে। পরে জেনে নিলেই হবে।
হরি দরজাটা টেনে দিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠিক কুড়ি পা হাঁটল, তারপর ডান দিকে ফিরল।
আশ্চর্যের বিষয়, ডান দিকে দশ পাও হাঁটতে হল না, সে পৌঁছে গেল সিঁড়ির গোড়ায়। চটপট সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে এসে দাঁড়াল ছবির পিছনে। তারপর নিঃশব্দে ছবিটা সামান্য সরিয়ে নীচে তাকাতেই সে নিজের ঘরখানা দেখতে পেল।
ঘরে আলো জ্বালানোই ছিল। ছবির নীচে টেবিলের ওপর চেয়ার তেমনি দাঁড় করানো। আর টেবিলের সামনেই সেই দানবের মতো লোকটা দাঁড়িয়ে হাঁ করে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল।
হরি একটু সরে গেল ভিতর দিকে। অপেক্ষা করতে লাগল।
লোকটা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সন্তর্পণে টেবিলের ওপর উঠল। তারপর চেয়ারের ওপরে। হাত বাড়িয়ে ছবিটাকে নাড়াবার চেষ্টা করল। বল বিয়ারিং-এর প্যানেলে ছবিটা নিঃশব্দে পাশের দিকে সরে যেতে লাগল।
হরি এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। হাতের টর্চটা বাগিয়ে ধরাই ছিল তার। হামাগুড়ি দিয়ে বসে টর্চটা দিয়ে সে প্রচণ্ড জোরে লোকটার মাথায় মারল।
লোকটা মাথাটা চেপে ধরল, কিন্তু একটা চাপা গর্জন ছাড়া তেমন কোনও শব্দ করল না।
আতঙ্কিত হরি টর্চটা আবার তুলল মারার জন্য। কিন্তু সেই সুযোগ হল।লোকটা বিদ্যুৎ-বেগে হাত বাড়িয়ে টর্চসুষ্ঠু তার হাতটা চেপে ধরল।
তারপরই হুড়মুড় করে টেবিল, চেয়ার, হরি এবং লোকটা ছয়ছত্রখান হয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
চোট যে খুব বেশি লাগল তা নয়। হরি পড়েছিল লোকটার ওপর। পড়েই সে লাফ দিয়ে উঠে লাঠিটা নেওয়ার জন্য যাচ্ছিল।
লোকটা বাহাদুর বটে, ওভাবে পড়ে গিয়েও দমেনি। শোওয়া অবস্থাতেই একটা ল্যাং মেরে ফেলে দিল হরিকে।
তারপর দুজনেই দুটো ক্রুদ্ধ বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল দু’জনের ওপর।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হরি বুঝল, এর সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। এর গায়ে হাতির মতো জোর।
“জগুরাম!” বলে একবার চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করল হরি। কিন্তু অস্ফুট চিৎকারটা গলা দিয়ে বেরোবার আগেই লোকটা তার মুখে একটা প্রচণ্ড ঘুসি মারল।
ঘুসিটা খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মেঝের ওপর পড়ে গেল হরি। তারপর আর জ্ঞান রইল না।