কোনও বালব জ্বলছে না, টিউবলাইট জ্বলছে না, আলোর কোনও উৎসই নেই, অথচ ঘরটা স্নিগ্ধ একটা আলোয় ভরে আছে। সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু চোখে আলো লাগছে না। মাটির নীচে এ গুহার মতো বড় ঘরখানা আসলে একটা বেসমেন্ট। কিন্তু যেন প্রাগৈতিহাসিক। নীচে মাটি, দেওয়াল মাটির, কোনও আসবাবপত্র নেই। লম্বা, সবুজ অদ্ভুত চেহারার মানুষরা দেওয়ালের গায়ে পিঠ রেখে আসনসিঁড়ি হয়ে ধ্যান করার ভঙ্গিতে বসে আছে। তাদের মেরুদণ্ড সোজা। তারা এতটাই লম্বা যে, বসা অবস্থাতেও তাদের মাথা পাঁচ-ছ’ ফুট উপরে উঠে আছে। ঝিঝির শব্দে চারদিকে বাতাসে একটা ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
বিজয়বাবু চারদিকটা খুব ভাল করে লক্ষ করলেন। গুনে দেখলেন সবুজ মানুষরা সংখ্যায় এগারোজন। হয়তো আরও আছে। এগারোজনই তাকে স্থির চোখে লক্ষ করছে। তাতে অবশ্য বিজয়বাবুর ভয় হচ্ছে না।
ঝিঝির ডাকের ভিতর একটা পরিবর্তন ঘটল। টানা আওয়াজটা নানা টুকরো টুকরো স্কেলে ভেঙে গেল, চড়া হল আবার খাদে নামল। বিজয়বাবু হঠাৎ সেই শব্দের ভিতর থেকে কথা বা বার্তা টের পেতে শুরু করলেন। তাকে প্রশ্ন করা হল, “তুমি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। আমি আপনাদের সম্পর্কে জানতে চাই।”
“তোমাদের পক্ষে আমাদের অনুধাবন করা অসম্ভব। তোমাদের মস্তিষ্কের অত ক্ষমতা নেই। তোমরা শুধু এটুকু জানলেই চলবে যে, আমরা অনেক দূর গ্রহের লোক।”
“কত দুর?”
“জেনে লাভ নেই। তোমাদের ধারণার বাইরে।”
“আপনারা আমাদের গ্রহে কেন এসেছেন তা কি জানতে পারি?”
“পারো। আমরা তোমাকেই আমাদের মধ্যস্থ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলাম। তুমি একটু বিজ্ঞান জানো। তুমি একজন সদাশয় এবং ভাল লোক।”
“আমি সদাশয় এবং ভাল লোক সেটা কী করে বুঝলেন? আমাকে তো আপনারা চেনেন না?”
“চিনি। আমরা আমাদের চারদিকে গাছপালা, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু এবং মানুষেরও সব কিছু জানতে পারি। প্রত্যেকটা মানুষ, গাছপালা, এমনকী, কীটপতঙ্গেরও কিছু ভাষা আছে। তোমরা বুঝতে পারো না, আমরা পারি।”
“আপনারা কি খুব জ্ঞানী মানুষ?”
“তোমাদের তুলনায় হাজার গুণ।”
“আমি কি আপনাদের কোনও ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?”
“পারো। তোমার সাহায্যের উপরেই আমরা নির্ভর করছি। আমরা দস্যু বা লুটেরা নই। কিন্তু আমাদের একটু স্বার্থ আছে। তোমাদের কাছে আমরা কিছু চাই।”
“কী চান আপনারা?”
“খানিকটা জল, কয়েকটা কীটপতঙ্গ, কিছু গাছপালা আর কিছুটা বর্জ্য পদার্থ।”
“এসব কি আপনাদের নেই?”
“আছে। কিন্তু আমাদের গ্রহ তোমাদের গ্রহের চেয়ে পাঁচ গুণ বড়। আমাদের যথেষ্ট জল নেই, তোমাদের মতো এত প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ নেই। জীববৈচিত্র্য অনেক কম এবং প্রাকৃতিক বর্জ্য পদার্থ যৎসামান্য। আমাদের গ্রহ খুব সুন্দর, আমাদের সভ্যতা অনেক বেশি প্রাগ্রসর, কিন্তু তোমাদের মতো এত প্রাকৃতিক সম্পদ, যার মূল্য তোমরা আজও বুঝে উঠতে পারোনি, তা আমাদের নেই। তাই বন্ধুভাবে আমরা তোমাদের কাছে এসব জিনিস চাইছি। পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের সেটা বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব
আমরা তোমাকে দিতে চাই।”
“কতটা জল আপনাদের চাই?”
“পৃথিবীর সমুদ্রে যত জল আছে তার দশ ভাগের এক ভাগ।”
“সে তো অনেক জল! এত জল পৃথিবী থেকে সরে গেলে যে আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে! ঋতুচক্রের গোলমাল হবে, বৃষ্টিপাত হয়ে পড়বে অনিয়মিত। আর প্রায় গোটা একটা সমুদ্রই যদি লোপাট হয়ে যায়, তা হলে পৃথিবীর ওজন কমে যাবে, হয়তো বা আহ্নিক গতিও বদলে যেতে পারে।”
“তুমি খারাপ দিকটার কথা আগেই ভাবছ কেন? ভাল দিকটার কথাও ভাবো। পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে, ধীরে ধীরে জলস্তর উপরে উঠছে। আগামী চল্লিশ বছরের মধ্যেই নিচু এলাকাগুলো সমুদ্রের গ্রাসে চলে যেতে থাকবে। এই শতাব্দীর শেষে স্থলভূমির অনেকটাই নিমজ্জিত হয়ে যাবে, বহু দেশ মুছে যাবে মানচিত্র থেকে। সমুদ্রের মধ্যে এবং ধারে যেসব আগ্নেয়গিরি আছে, সমুদ্রের জল যদি তার মুখ পর্যন্ত উঠে যায়, তা হলে আগ্নেয়গিরির মধ্যে জল ঢুকে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটবে এবং সুনামির সৃষ্টি হবে তা এতই ভয়ংকর যে, উপকূলের বড় বড় সব শহর শুধু ভেসেই যাবে না, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। আমরা যদি তোমাদের একটা সমুদ্র নিয়ে যাই তা হলে অন্তত সেই ভয়টা থাকবে না। তার উপর তোমরা পেয়ে যাবে অনেকটা নতুন স্থলভূমি, পেয়ে যাবে একটা আস্ত মহাদেশও।”
“পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা আপনাদের প্রস্তাব মানবেন না।”
“তাদের বুঝিয়ে বলল, আমরা অকৃতজ্ঞ নই। যে জিনিস আমরা নিয়ে যাব তাতে তোমাদের সামান্য ক্ষতি হবে বটে, কিন্তু আমরা প্রতিদানও দিতে জানি। বিনিময়ে আমরা তোমাদের বাতাসের দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেব। ওজোন স্তরের ছিদ্র মেরামত করে দেব, আরও সবুজ করে দিয়ে যাব পৃথিবীকে।”
“এক সমুদ্র জল আপনারা কীভাবে নেবেন?”
“খুব সোজা। বঙ্গোপসাগরে নীচে আমাদের মহাকাশ ভেলা অপেক্ষা করছে, আর আকাশে এক লক্ষ মাইল দূরে রয়েছে আমাদের বড় মহাকাশযান। সমুদ্রের জল আমাদের নিজস্ব পাম্পে খানিকটা শূন্যে তুলে নিলেই তা বরফের চাঙড়ে পরিণত হবে। খুব সূক্ষ্ম একটা জ্যাকেটে মুড়ে তা আমাদের মহাকাশযানের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে দেওয়া হবে। এরকম অজস্র চাঙড় করে জল নিয়ে যাওয়া কঠিন ব্যাপার কিছু নয়।”
দুশ্চিন্তায় বিজয়বাবুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, উত্তেজনায় ঘাম হচ্ছে, বললেন, “আমি চেষ্টা করে দেখব।”
“কোনও প্রশ্ন আছে?”
“অনেক প্রশ্ন। আপনারা কোন ভাষায় কথা বলছেন? ভাষাটা আমি জানি না, কিন্তু সব বুঝতে পারছি কী করে?”
“আমরা ভাষা দিয়ে কথা বলি না। আমাদের কথা ধ্বনি-সংকেত। তোমার মস্তিষ্ক সেটা অনুবাদ করে নিচ্ছে।”
“পৃথিবীর চারদিকে অনেক উপগ্রহ ঘুরছে, সারাক্ষণ নানা জায়গা থেকে দূরবীক্ষণ আর রাডার দিয়ে আকাশের সর্বত্র নজর রাখা হচ্ছে। কোনও মহাকাশযানের পক্ষে এত সব নজরদারি এড়িয়ে পৃথিবীতে আসা সম্ভব নয়। আপনারা এলেন কী করে?”
“তোমাদের প্রযুক্তিকে ফঁকি দেওয়া কঠিন নয়। নামবার সময় আমরা কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের সন্ধানী যন্ত্রগুলোকে অন্ধ ও বধির করে দিয়েছিলাম, তবে তা মাত্র এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য। তাই সেটা নিয়ে খুব একটা হইচই হয়নি। আর নেমে পড়ার জন্য আমাদের ওটুকু সময়ই যথেষ্ট।”
“সমুদ্রের তলায় আপনাদের যে যানটি লুকনো আছে সেটা কি আমাদের সাবমেরিনগুলো খুঁজে পাবে না?”
“না। আমাদের যানটি থেকে কোনও বিকীরণ ঘটে না। সেটা অবিকল একটা তিমি মাছের মতো ঘুরে বেড়াতে পারে।”
“আমি শুনেছি আপনারা জীবজন্তু এবং পোকামাকড় খুবই ভালবাসেন। এমনকী, একজন লোক বন্দুক দিয়ে শেয়াল মারতে গিয়েছিল বলে আপনারা তাকে মেরে ফেলেছেন।”
“কথাটা সত্যি নয়। লোকটা ভয় পেয়ে মারা যায়। তবে আমরা তাকে ফের বাঁচাতে পারতাম। সেটা করিনি। কারণ, পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা সব জীবজন্তুর চেয়ে বেশি। একটা মানুষের চেয়ে একটা শেয়ালের প্রাণের দাম বেশি।”
“আপনারা পশুপ্রেমিক, তার মানে কি আপনারা মাছ-মাংস খান না?”
“মাছ-মাংসকে আমরা খাদ্যবস্তু বলেই মনে করি না।”
“আমাদের বৈজ্ঞানিক এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা যদি আপনাদের প্রস্তাবে রাজি না হন, তা হলে কী করবেন?”
“সেক্ষেত্রে আমরা জোর করেই তোমাদের সমুদ্র চুরি করব এবং কোনও প্রতিদানও পাবে না।”
“আপনারা কি এতটাই নিষ্ঠুর যে, আমাদের গ্রহটিকে বিপাকের মধ্যে ঠেলে দিয়ে চলে যাবেন?”
“তোমরা আমাদের চেয়েও অনেক নিষ্ঠুর, স্বার্থপর এবং বোকা।”
“একথা কেন বলছেন?”
“তোমাদের সৌরলোকে এই একটিই প্রাণবান গ্রহ। ঠিক তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক।”
“প্রাণীদের তিনটি আশ্রয়। জল, মাটি, অন্তরীক্ষ। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“সমানুপাত বোঝো?”
“একটু-আধটু।”
“এই তিনটি আশ্রয়ে যেসব প্রাণীকুল থাকে এবং সবকিছুকে পাহারা দেয় যে উদ্ভিদ, তাদের সমানুপাত না থাকলে গ্রহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রাণ বিপন্ন হয়ে পড়ে। জানো?”
“জানি।”
“তবে মানো না কেন? পৃথিবীকে খনন করে করে জ্বালিয়ে দিলে তেল-কয়লা, সমুদ্রে-নদীতে ঢেলে দিলে বিষ, বাতাসে ছড়ালে তেজস্ক্রিয় কণা, এ তোমাদের গ্রহ নয়? এ কি নয় তোমাদের বাড়িঘর? কত প্রাণীর প্রজাতিকে অবলুপ্ত করে দিলে, মেরে ফেললে কত পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ। মাটি ঢেকে দিয়ে কেবল বাঁধানো শহরে ভরে দিলে পৃথিবী। ভোগের বস্তুর জন্য কত কলকারখানায় কণ্টকিত করে দিলে চারদিক!”
“আমরা আপনাদের তুলনায় নির্বোধ, স্বীকার করছি। এই গ্রহের মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্মায় না। তারা ঠেকে এবং অভিজ্ঞতা থেকে আজ নিজেদের সর্বনাশ বুঝতে পারছে। বিপরীত প্রক্রিয়ায় সেই সর্বনাশ রোখার জন্যও আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা যদি আমাদের সমুদ্র এবং কীটপতঙ্গ সব নিয়ে যান, তা হলে আমাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হবে।”
“আমাদের উপায় নেই।”
“আপনারা আমাদের হিতৈষীর মতো কথা বলছেন। কিন্তু যা করতে চাইছেন তাতে পৃথিবীর মঙ্গল হওয়ার কথা নয়। প্রকৃত শক্তিমানরা দুর্বলের শক্তিহীনতার সুযোগ নেয় না।”
“প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেউ নয়। দুর্বলের অধিকার প্রকৃতির নিয়মেই সীমাবদ্ধ। বাঘ হরিণকে খাবে, এটাই নিয়ম।”
“বাঘ ও হরিণ ইতর প্রাণী। বুদ্ধিমান নয়। তারা পৃথিবী ও প্রকৃতি বা পরিস্থিতির নিয়ামক হতে পারে না। বাঘ একসময় মানুষকেও খেত। কিন্তু মানুষ যখন অস্ত্র আবিষ্কার করল, তখন বাঘ হয়ে পড়ল বিপন্ন। বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে শক্তিমান করেছিল, সে প্রকৃতির সব নিয়ম মেনে নেয়নি।”
“বাঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে কী লাভ হয়েছে তোমাদের বলো! আর কটা বাঘ অবশিষ্ট আছে পৃথিবীতে? শুধু অস্ত্রধারণ করলেই হয় না। নিয়ন্ত্রণও অধিগত করতে হয়। আত্মভুক কাকে বলে জানো? যে নিজেকে খেয়ে ফেলে। সমষ্টিগতভাবে তোমরাও আত্মভুক। নিজেদের প্রজাতিকে মারো, পশুপাখি মারো, গাছপালা মারো? ওরাও যে তোমাদেরই অস্তিত্বের বিস্তার তা জানো না।”
মাথা নিচু করে বিজয়বাবু বললেন, “মানছি।”
মানুষটা হঠাৎ তার দিকে একটা থান ইটের মতো ভারী জিনিস ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এই নাও।”
নিখুঁত লক্ষ্যে জিনিসটা বিজয়বাবুর কোলের কাছে এসে পড়ল। কিন্তু গায়ে লাগল না। তিনি জিনিসটা তুলতে গিয়ে দেখলেন, সোনার রঙের একখানা অত্যন্ত ভারী ইট। কয়েক কেজি ওজন। সবিস্ময়ে তিনি বললেন, “কী এটা?”
“সোনা! এটা বিক্রি করলে তুমি অনেক টাকা পাবে। তাই দিয়ে তুমি তোমার ল্যাবরেটরির জন্য অনেক আধুনিক সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক কিনতে পারবে।”
“এই সোনা আপনি কোথায় পেলেন?”
“সোনা আমরা সঙ্গে করে আনিনি। তোমাদের গ্রহেরই নানা ধাতুর পরমাণুর গঠন বদলে দিয়েছি মাত্র।”
“এটা কি ঘুষ?”
“ঘুষ কাকে বলে জানি না। তবে এটা আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন।”
“আমি শুনেছি আপনারা কাউকে কাউকে অনেক সোনা দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ। আমরা মানুষের বন্ধুত্বই চাই। ইচ্ছে করলে আমরা পৃথিবীর সব মানুষকেই রাশি রাশি সোনা উপহার দিয়ে যেতে পারি।”
“তাতে সোনার দাম শুন্যে নেমে যাবে এবং পৃথিবীর অর্থনীতিতে দেখা দেবে বিরাট বিপর্যয়।
“সেটা হয়তো একটা ভারী মজার ব্যাপারই হবে। লোভী মানুষ বুঝতে পারবে সোনা একটা সাধারণ ধাতু ছাড়া কিছুই নয়।”
“আমি আপনাদের দান প্রত্যাখ্যান করছি। সোনা আমি নেব না।”
“বেশ তো। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান কোরো না। তা হলে তোমাদের ভাল হবে না।”
“বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়। আমরা আপনাদের পণবন্দি মাত্র। তবু আপনারা যে সৌজন্য প্রকাশ করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি এটাও বুঝতে পারছি, আপনারা যা চাইবেন তাই হবে। আমাদের কিছুই করার নেই।”
“এই সত্যটা তাড়াতাড়ি বুঝেছ বলে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন তুমি যেতে পারো। তোমাদের রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধিরা উপরে অপেক্ষা করছেন। তোমার পিছন দিকে যে গুহামুখ দেখছ, ওইটেই বেরোনোর পথ। যাও।”
বিজয়বাবু উঠলেন। গুহামুখে পৌঁছে ফিরে একবার চেয়ে দেখলেন, দু’জন সবুজ মানুষের পাহারায় পাঁচজন লোক গুহায় এসে ঢুকল। লতাপাতা দিয়ে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। বিধ্বস্ত চেহারা। দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের উপর কিছু অত্যাচার হয়েছে। এদের মধ্যে অগ্নিকেও দেখতে পেলেন বিজয়বাবু। বোধহয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। তাই মারধর খেতে হয়েছে। বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে ঢালু বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। মানুষকে হয়তো এভাবেই তার দীর্ঘদিনের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। একটা সমুদ্র লোপাট হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হবে কীটপতঙ্গের বিরাট ঝক। আর কী কী নিয়ে যাবেন ওঁরা, জানেন না তিনি। তবে পৃথিবীর সামনে যে বিরাট দুঃসময় আসছে তাতে সন্দেহ নেই।
গভীর রাত। বিজয়বাবুর ল্যাবরেটরিতে গভীর দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে অঘোরখুড়ো, বীরেনবাবু, বিরাজজ্যাঠা, নীলকান্ত, অয়স্কান্ত, কৃষ্ণকান্ত, কানু, বটু, নব, হরেন সবাই হাজির। বিজয়বাবু বিপদের কথাটা তাঁদের বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলছিলেন। কথা শেষ হয়েছে। এখন সবাই গুম হয়ে বসা। কারও কথাটথা আসছে না।
ঠিক এই সময় উত্তরের বন্ধ জানলায় খুট খুট করে একটা শব্দ হল।
বিজয়বাবু নিচু গলায় বললেন, “কে?”
“আজ্ঞে, জানলাটা খুলুন। কথা আছে।”
বিজয়বাবু উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে দেখতে পেলেন, গামছায় মুখ ঢাকা একটা বেঁটেমতো লোক দাঁড়ানো।
“কে হে তুমি?”
“আমি বঙ্কাচোর।”
“চোর! অ্যাঁ! কী সর্বনাশ! চোর আজকাল সাড়া দিয়ে আসা ধরেছে?”
“আহা, অত উঁচু গলায় কথা কইবেন না। বাতাসেরও কান আছে। তারা আবার সবই শুনতে পান কিনা।”
“কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে, গুরুতর কিছু কথা নিবেদন করেই চলে যাব।”
“অ। তা ভিতরে এসো বাপু। ভয় নেই।”
“আজ্ঞে, ভয়ডর থাকলে কি আমাদের চলে? তা হলে বরং দরজাটা খুলে দিন। গুহ্য কথা কিনা, খোলা জায়গায় বলাটা ঠিক হবে না।”
বিজয়বাবু দরজা খুলে দিলেন। বঙ্কা ভারী সংকোচের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মশাইরা।”
বিজয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছে। এবার কথাটা হোক।”
বঙ্কা মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। পেটের দায়ে আমাকে চুরিটুরি করতে হয়। তা চুরি করি বলেই কিছু সুলুকসন্ধান জানা আছে। ইদানীং দেখছিলাম গাঁয়ের কিছু লোকের বেশ উন্নতি হতে লেগেছে। রামভরোসা নতুন দুটো মোষ কিনল, তার মা গিরিজাবুড়ি রুপোর বদলে সোনার বালা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দু’বেলা পোনা মাছের কালিয়া রান্না হচ্ছে বাড়িতে। তাই দেখেই একদিন সিঁধ দিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ। বুড়ি সারাদিন গোবর কুড়োয়, ঘঁটে দেয়, রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোর কথা। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি, বুড়ি উদুখলের ডান্ডাটা নিয়ে বসে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে। ঘা-কতক খেয়ে আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে প্রাণটা হাতে করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলুম, এই যা। ৮৮
তবে তক্কে তক্কে কয়েকদিন নজর রাখার পর লক্ষ করলাম, বুড়ি রোজই দুপুরের দিকে ঝুড়িভরতি খুঁটে নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। জঙ্গলে ঘুঁটের খদ্দের থাকার কথা নয়। পিছু পিছু গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!”
বিজয়বাবু ম্লান হেসে বললেন, “সবুজ মানুষ তো!”
“যে আজ্ঞে, যাদের ডেরায় আজ আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।”
“তারপর কী হল?”
“বুঝলুম, সোনাদানা ওই ডেরাতেই আছে। বুড়ি একঝুড়ি খুঁটে বেচে এক মোহর করে পায়। তাও সে ইয়া বড় মোহর, অন্তত ভরি পাঁচেক ছাচা সোনা! মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দিব্যি ডেরা বানিয়েছে। তা আজ মাঝরাতে ঢুকে পড়লাম মা কালীকে একটা প্রণাম ঠুকে।”
বীরেনবাবু বলে উঠলেন, “জব্বর সাহস তো তোমার?”
“আজ্ঞে না, সাহসের বালাই নেই। পেটের দায়ে প্রাণ বাজি রেখে ওসব করতে হয় আর কী। তবে কিনা একেবারে নির্যস প্রাণটাই যাওয়ার কথা। সুড়ঙ্গের অন্ধিসন্ধি তো জানা নেই। পড়বি তো পড় একেবারে দু-দুটো ঢ্যাঙা মানুষের সামনে। কিন্তু কী বলব মশাই, দু’জন যেন আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠে কুঁকড়ে লটকে পড়ে গেল।”
“বলো কী?”
“আজ্ঞে, এক বর্ণ বানিয়ে বলা নয়। মা কালীর দিব্যি।”
“তোমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কী হল?”
“আজ্ঞে, সেই কথাই বলতে আসা।”
“বলে ফেলো বাপু।”
“ইদানীং চোখে একটু কম দেখছি বলে রাতবিরেতে কাজের খুব অসুবিধে হচ্ছে। তাই ভেবেছিলুম, একজোড়া চশমা হলে বড় ভাল হয়। তা দেখলাম, আমাদের কানু রোজ অঘোরখুডোর চশমা চোখে দিয়ে বটতলায় বসে লোকের ভূতভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তা ভাবলুম ওরকম জোরালো চশমা হলে কাজের খুব সুবিধে। তা পরশু রাতে…!”
অঘোরখুড়ো হুংকার দিয়ে বললেন, “তাই চশমাজোড়া পাচ্ছি না বটে! এ তা হলে তোমার কাজ?”
বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “আস্তে খুড়ো, আস্তে।”
বঙ্কা বিগলিত মুখে হাত কচলে বলল, “যে আজ্ঞে, আপনার চশমার গুণ আছে বটে খুড়ো। অন্ধকারেও সব দিব্যি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। কী বলব মশাই, মোট বারোখানা মোহর সরিয়েছি, দিব্যি গটগট করে বেরিয়েও এসেছি। তাই বলছিলাম, ওই বিটকেল লোকগুলোর সঙ্গে এমনিতে পেরে ওঠার জো নেই বটে, তবে…!”
বিজয়বাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, “চশমাজোড়া কোথায়?”
বঙ্কা চশমাজোড়া খাপসুদ্ধ বের করে বিজয়বাবুর হাতে দিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কাজ হয়ে গেলে যদি চশমাজোড়া বখশিশ দেন তবে কাজকর্মের বড় সুবিধে হয়। বড় অনটন চলছে।”
“ওই লোক দুটোর কী হল দেখলে?”
“আজ্ঞে, দেখেছি। ফেরার সময় দেখলাম তখনও লটকে পড়ে আছে। তবে সাইজে যেন একটু ছোট লাগল।”
“ছোট! কিন্তু এসব হয় কী করে? তারা সাপের কামড়ে মরে না, দুনিয়ার কোনও কিছুকে ভয় পায় না!”
অঘোরখুড়ো বললেন, “ও একটা ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার খুড়ো?”
“বটুকবুড়ো আমাকে বলেছিল, চশমার অনেক রকম গুণ আছে।
সব গুণের কথা বটুকবুড়োর জানা ছিল না। মন্ত্রটন্ত্রের ব্যাপার আর কী।”
বিজয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তা হতে পারে না। একটা কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকতেই হবে। ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দে তো নব। দেখি, সত্যিই অন্ধকারে দেখা যায় কিনা!”
নব বাতিটা নিভিয়ে দেওয়ার পর চশমার ভিতর দিয়ে বিজয়বাবু দেখলেন, তিনি ঘরের সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। এমনকী, আলোর চেয়েও অনেক স্পষ্ট।”
বিজয়বাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “বঙ্কা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তা হলে হয়তো একটা উপায় আছে। আমি আজই ওই গুহায় আবার যেতে চাই।”
সবাই ‘না না করে আপত্তি জানাতে লাগলেন। বিজয়বাবু বললেন, “আমাদের ঘোর বিপদ, ওই গুহায় ওদের বারোজন আছে। আরও হয়তো আছে, আমরা জানি না। কিন্তু বারোজনের একজন হচ্ছে ওদের লিডার। নাঃ, আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বঙ্কা, তুমি চলো আমার সঙ্গে। একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকতে হবে বাপু। তুমি পথ দেখাবে।”
“যে আজ্ঞে। অন্ধিসন্ধি সব আমার জানা।”
নিশুত রাতে জঙ্গলে ঢোকার মুখেই একটা বাধা পড়ল। বিভীষণ চেহারার একটা লোক লাঠি হাতে পথ আগলে দাঁড়িয়ে। একটা হাঁক দিল, “কে রে?”
বিজয়বাবু বললেন, “নিমচাঁদ, আমি হে, বিজয়বাবু।”
নিমচাঁদ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “বিজয়কর্তা, এই নিশুত রাতে এই জঙ্গলে কী মনে করে? এখানে যে সব বিটকেল কিম্ভুত জীবের আস্তানা। তারা যে সব কাঁচাখেগো দেবতা। এইবেলা পালিয়ে যান কর্তা।”
“সেই উপায় নেই নিমচাঁদ। পালিয়ে গেলে দুনিয়া ছারখার হয়ে যাবে।”
“কিন্তু কী করতে চান আপনি? হাতে বন্দুক-পিস্তল নেই। লাঠিসোঁটা নেই। তারা যে অসুরের চেয়েও বড় পালোয়ান! আমাকে এক ঝটকায় সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলেছিল।”
“সেসব জানি। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। একটা চেষ্টা তো করতেই হবে।”
“তবে চলুন আমিও সঙ্গে যাই, আপনার সঙ্গে উটি কে?”
“এ হল বঙ্কা। পথ চেনাতে এসেছে।”
“খুব চিনি। পাকা চোর।”
বঙ্কা ভারী খুশি হয়ে বলল, “যে আজ্ঞে। বঙ্কার নাম পাঁচ গাঁয়ের লোক জানে।”
বঙ্কা জঙ্গলে ঢুকে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “গুহার অনেক মুখ। সব মুখ দিয়েই ঢোকা যায় বটে, তবে বিপদও আছে। ওই খালধারের মুখটাই ভাল।”
অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে চশমা-পরা বিজয়বাবু সবকিছু স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল, চশমা থেকে কোনও একটা বিচ্ছুরণ হয়। নইলে এমনটা সম্ভব ছিল না।
বিজয়বাবু ভারী অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ভাবতে ভাবতে। এই চশমা কোথা থেকে পেয়েছিলেন বটুকবুড়ো? কোন প্রযুক্তি বা অভিনব বস্তু দিয়ে এটা তৈরি তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে চশমাটি অভিনব তাতে সন্দেহ নেই। দুনিয়াতে কত বিস্ময়ই যে এখনও আছে।
অন্যমনস্কতার দরুন বার দুই হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন। নিমচাঁদ ধরে ফেলল। নিচু স্বরে বলল, “এঁরা মানুষ তেমন খারাপ নয় বিজয়কর্তা। একটু কেমনধারা এই যা।”
“সেটা আমিও জানি। তবু পৃথিবীর পক্ষে এঁরা বিপজ্জনক। যদি এঁরা কোনও কারণে বিগড়ে যান তা হলে এক লহমায় বোধহয় দুনিয়া লয় করে দিতে পারেন।”
নিমচাঁদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা পারেন কর্তা। এঁদের অসাধ্য কিছু নেই।”
খালধারের একটা ঢিবির সামনে এসে দাঁড়াল বঙ্কা। একটা শেয়ালের গর্তের মতো গর্ত দেখিয়ে বলল, “এইটে।”
বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এটা দিয়ে ঢুকব কী করে?”
“মাথা গলিয়ে দিয়ে দেখুন, ভিতরে অনেক জায়গা।”
বিজয়বাবুও দেখলেন, তাই। মসৃণ পথ নেমে গিয়েছে ঢালু হয়ে। অন্ধকার। বিজয়বাবু অবশ্য সবই দেখতে পাচ্ছেন।
হঠাৎ বঙ্কা হাত চেপে ধরে বিজয়বাবুকে থামাল, “ঝিঝির ডাক শুনতে পাচ্ছেন কর্তা?”
“হ্যাঁ।”
“এসে গিয়েছি। ধীরে পা টিপে টিপে চলুন।”
সামনেই গুহার রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে। তারপরই আশ্চর্য আলোকোজ্জ্বল ঘর। আলোর কোনও উৎস নেই, তবু ঘর আলোয় আলোময়। এসব স্বপ্নের প্রযুক্তি ওদের হাতে। ওরা শত্রু না বন্ধু তা এখনও বুঝতেই পারছেন না বিজয়বাবু। কিন্তু তাঁর হাতে কোনও বিকল্পও নেই।
একটু উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল, দশ-বারোজন সবুজ মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে, তাদের প্রায় বাহ্যচৈতন্য নেই।
দু’দিকে বঙ্কা আর নিমচাঁদ, মাঝখানে বিজয়বাবু ঘরের ভিতরে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তীব্র ঝিঝির আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু এবার ঝিঝির আওয়াজে কোনও কথা
বুঝতে পারছেন না বিজয়বাবু। চুপচাপ লোকগুলোর দিকে চেয়ে বিজয়বাবু মনে মনে শুধু বললেন, “আমাকে ক্ষমা করুন। আপনাদের ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু আমরা আমাদের মতো বেঁচে থাকতে চাই, যতদিন পারি।
হঠাৎ যেন তাঁদের উপস্থিতি এতক্ষণে টের পেয়ে সবুজ মানুষরা ফিরে তাকাল তাঁদের দিকে। তারপরই যেন স্তম্ভিত হয়ে কুঁকড়ে গেল। আর একের পর-এক ঢলে পড়ে গেল মাটির উপর।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বিজয়বাবু মাটিতে পড়ে থাকা লম্বা আর সবুজ মানুষগুলোকে অপলক চোখে দেখছিলেন। শরীরে কোনও স্পন্দন নেই, ছটফটানি নেই। কেমন যেন কুঁকড়ে দলা পাকিয়ে শুয়ে আছে।
চশমাটা খুলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি। সামনে পড়ে থাকা লোকটার কবজি ধরে নাড়ি দেখার চেষ্টা করলেন। নাড়ির স্পন্দনের মতো নয়, কিন্তু সেতারের মতো দ্রুত একটা ঝিনঝিন শব্দ হচ্ছে যেন।
একটু সময় লাগল। তারপর দেখতে পেলেন কুঁকড়ে-যাওয়া শরীর যেন আরও কুঁকড়ে ভিতরকার কোনও কেন্দ্রাভিগ টানে দলা পাকিয়ে আস্তে আস্তে গোল গোল হয়ে আসছে, অনেকটা বলের মতো।
বিজয়বাবুর কবজির ঘড়িতে যখন সকাল ছ’টা বাজে তখন দেখতে পেলেন, মেঝের উপর মানুষগুলোর আকার আস্তে আস্তে ছোট্ট পোকার মতো হয়ে যাচ্ছে। মানুষের পোকা হয়ে যাওয়ার একটা কাল্পনিক গল্প ফ্রাঞ্জ কাকা লিখেছিলেন বটে, কিন্তু এটা তো গল্প নয়। কী করে এই রূপান্তর ঘটল, কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, কিছুই বুঝতে পারলেন না বিজয়বাবু।
তবে একটা জিনিস দেখে এই দুঃখের ঘটনাতেও তিনি একটু খুশি হলেন। পোকাগুলো মৃত নয়। ছোট ছোট সবুজ গুবরেপোকার মতো আকারের সবুজ পোকারা একটু-আধটু নড়াচড়া করছে।
তিনি উঠে গুহাটা দেখলেন ভাল করে। এরা কি আসলে কোনওকালে পোকাই ছিল?মাটির নীচে থাকত? তারপর বিবর্তনের কোনও এক ধাক্কায় হয়ে গিয়েছিল লম্বা লম্বা মানুষ? এই চশমার কোনও রহস্যময় বিচ্ছুরণ কি আবার ওই বিবর্তনকে উলটো পথে চালিত করেছে? প্রশ্নগুলো জরুরি। কিন্তু জবাব কে দেবে?
নিমচাঁদ একটা থাবড়া তুলেছিল, “দেব নাকি নিকেশ করে?”
“না নিমচাঁদ। পৃথিবীতে নতুন প্রজাতির একটা পতঙ্গ হল। বেঁচে থাকতে দাও। পোকামাকড়কে যত বাঁচিয়ে রাখবে তো নিজেদের বাঁচার পথ প্রশস্ত হবে।”
বঙ্কা কাজের লোক, পোকামাকড় নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। ভিতরের কোনও উপগুহা থেকে দু’বস্তা সোনার চাকতি এনে বলল, “এই যে, দু’বস্তা। মেলা মোহর। কী করা যায় বলুন তো?”
“কিছু তুমি নাও, কিছু গাঁয়ের গরিব-দুঃখীকে দিয়ে। আর কিছু গাঁয়ের সংস্কারে কাজে লাগিয়ো৷”
ভিতরে আর-একটি প্রকোষ্ঠ থেকে পাঁচজন সংজ্ঞাহীন লোককে উদ্ধার করা হল, তাদের মধ্যে অগ্নিও। চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরতেই তাদের প্রশ্ন, “ওরা কোথায়?”
বিজয়বাবু শুধু বললেন, “চলে গিয়েছে।”
“আমাদের সমুদ্র?”
“আছে। চিন্তা নেই। ওরা আর আসবে না।”
বিজয়বাবু দেখতে পাচ্ছিলেন, পোকাগুলো মহানন্দে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেড়াক, ওরা এই নতুন জীবনও উপভোগ করুক।