৭. উত্তর কলকাতায় শ্যামপুকুর পার্ক

বনানী থাকে উত্তর কলকাতায় শ্যামপুকুর পার্কের কাছে। কিন্তু ঠিকানার এই সূত্রটা দিয়েই সারা পথ সে চুপচাপ পিছনের সিটে বসে ছিল। সামনের সিটে কর্নেল তেমনি নির্বিকার ভঙ্গিতে চুরুট টানছিলেন। তিনিও কোনও কথা বলছিলেন না। আমি তার দিকে বারবার তাকাচ্ছি লক্ষ্য করে একবার শুধু মুখ খুললেন। তুমি নিশ্চিত হতে পারো জয়ন্ত, আর সেই লাল মারুতিটা তোমার গাড়িকে ফলো করবে না।

একথায় ওঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক ছিল না। কাজেই বুঝতে পারলাম, উনি গুরুতর চিন্তাভাবনায় ডুবে থাকতে চান। বরাবর দেখে আসছি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী তুম্বো মুখে চুরুট কামড়ে ধরে থাকলে একশোবার কোনও প্রশ্ন করেও জবাব পাব না।

বনানীর পক্ষে হতবাক হয়ে থাকা স্বাভাবিক। অপ্রত্যাশিত ঘটনার ধাক্কা নিশ্চয় সে সামলাতে পারছিল না। শ্যামপুকুর পার্কের কাছাকাছি গাড়ি পৌঁছুলে সে আস্তে বলে উঠল–আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।

গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললাম–অসুবিধে হবে না তো?

নাহ্। কাছেই। বলে গাড়ি থেকে সে নেমে কর্নেলের কাছে গেল। উদ্বিগ্নভাবে বলল–কর্নেল সরকার! লোকটাকে যে চিঠিটা দেওয়া গেল না, এতে বাবার কোনও বিপদ হবে না তো?

কর্নেল গলার ভেতর বললেন–না। উনি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

–আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে কর্নেল সরকার!

–অস্বস্তির কারণ নেই। বরং চিঠিটা যে তুমি ফিরিয়ে আনার সুযোগ পেয়েছ, এটা আমার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। লোকগুলো বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে বলেই অবশ্য সুযোগটা পেয়েছ তুমি।

–আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ওরা কারা?

–ওরা যারাই হোক, তা নিয়ে চিন্তা কোরো না।

–ডঃ সুন্দরমকে এসব কথা বলা উচিত হবে কি? কর্নেল আমাকে অবাক করে বললেন–অবশ্যই বলবে। তবে গোপনে। ঘটনাটা ওঁর জানা দরকার।

বনানী যেন আরও কিছু বলতে চাইছিল। কর্নেল আমাকে ইশারায় এগিয়ে চলার নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পরে বললাম–ঘটনাটা বনানী বুঝতে না পারলেও আমি সম্ভবত বুঝতে পেরেছি।

কী বুঝতে পেরেছ?

–লোকটার ওপর যাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে বনানী, তারা সাদা পোশাকের পুলিশ।

এতক্ষণে কর্নেল একটু হাসলেন।–হ্যাঁ, পুলিশ। তবে স্বয়ং ডি সি ডি ডি-র নির্দেশ বলেই তাদের তর সয়নি। বর্ণনা অনুসারে একটা লোক এক যুবতীর দিকে এগিয়ে এসে সম্ভাষণ করতেই তারা তাকে ধরে ফেলেছে। বনানীর সঙ্গে কথা বলা এবং চিঠিটা সে পাওয়ার পর ধরা পড়লে ডঃ সুন্দরম ঝামেলায় পড়তেন।

–ডঃ সুন্দরম ঝামেলায় পড়লে আপনার কী?

–ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে যখন আমার এই ফাঁদ পাতার প্রস্তাব দিই, তখন পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। পরে যখন এল, তখন আর কিছু করার ছিল না।

আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কিন্তু!

 একটু চুপ করে থেকে কর্নেল বললেন–ডঃ সুন্দরমের সাহায্য আমার দরকার।

–কিন্তু উনি তো আপনাকে পছন্দ করেন না। অফিস থেকে প্রায় ধমক দিয়েই তাড়িয়ে দিলেন সেদিন।

–সেই কারণেই বলছি, শেখসায়েবের মুক্তো উদ্ধার এবং ইন্দ্রজিতের হত্যা রহস্যের একটা যোগসূত্র ডঃ সুন্দরমের কাছে পাওয়া আশা করছি।

–ওঃ বস্! আর হেঁয়ালি অসহ্য লাগছে।

–আমাদের প্রতি ডঃ সুন্দরমের অমন অদ্ভুত আচরণের কথা চিন্তা করো জয়ন্ত! ওঁর হাবভাব, রিঅ্যাকশন খুঁটিয়ে স্মরণ করো! এ কি সেই ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনি হয়ে গেল না?

কর্নেল জোরালো হেসেই হঠাৎ বলে উঠলেন ব্যস! তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনে। আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। ট্যাক্সি করে ফিরব। আর ডার্লিং! তোমার এবার বিশ্রাম দরকার।

গাড়ি দাঁড় করালাম। কর্নেল ব্যস্তভাবে নেমে গেলেন। তারপর ওঁকে একটা খালি ট্যাক্সির দিকে প্রায় দৌড়ে যেতে দেখলাম। অনেক প্রশ্ন মাথার ভেতর ভনভন করছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে?

সেই বজ্জাত লাল মারুতি সম্পর্কে কর্নেলের আশ্বাসবাণী সত্ত্বেও অস্বস্তিটা কাটছিল না। সল্ট লেকে ফেরার পথে কল্পিত বা বাস্তব কয়েকটা লাল মারুতি আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল। কিন্তু কোনোটাই আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেনি।

খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে ঘুমের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অসংখ্য প্রশ্ন মাছির মতো মাথার ভেতর বেজায় রকমের ভনভন করতে থাকল। অগত্যা টেবিল বাতি জ্বেলে আমার প্রিয় লেখক জর্জ সিমেনোর একটা গোয়েন্দা অমনিবাসের পাতায় চোখ রাখলাম।

কয়েক পাতা পড়ার পর সবে ঘুমের টান এসেছে, এমন সময় বিরক্তিকর টেলিফোনের শব্দ। আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। শুয়ে পড়ার পর টেলিফোন বাজলেই রিসিভার তুলে ধরে বলি–রং নাম্বার।

ঠিক তা-ই বলতাম। কিন্তু কর্নেলের কথা ভেবে সংযত হলাম। ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার কথা। এখনও ফেরেননি দেখে উদ্বিগ্ন ষষ্ঠী টেলিফোন করছে না তো?

কিন্তু সাড়া দিতেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের অনবদ্য কণ্ঠস্বর ভেসে এল।জয়ন্তবাবু! একটু ডিসটার্ব করলাম। কর্নেল স্যারেরে পাইলাম না। অলওয়েজ এনগেজড সাউন্ড! কাজেই আপনারেই ধরলাম। এস টি ডি-তে ধরছি। বুঝলেন তো?

–কোথা থেকে ধরলেন হালদারমশাই? চোরডিহা তো জঙ্গল শুনেছি।

–ফ্রম আসানসোল জয়ন্তবাবু! আউয়াইয়া আইতে হইল।

–বলুন হালদারমশাই!

–চোরডিহারে জঙ্গল কইলেন? পুরা জঙ্গল না। টাউনও আছে, জঙ্গলও আছে। তো কথা হইল গিয়া–চন্দ্র জুয়েলার্সের কুঞ্জবাবুরে টাকা লইয়া আইতে কইছিলাম। কিন্তু উনি আইবেন কি না, জানা দরকার। ওনাদের লাইন পাইলাম না। আপনি কিছু জানেন?

-জানি। কুঞ্জবাবু টাকা নিয়ে সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা হয়ে গেছেন। কর্নেল ওঁকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন।

কী কাণ্ড! সন্ধ্যার ট্রেন মানে তো ছটা পাঁচ। ফ্রম আসানসোল গয়া প্যাসেঞ্জার ছাড়ার টাইম হইল গিয়া সওয়া এগারোটা। খাইছে! বারোটা কুড়ি বাজে। সর্বনাশ!

ফোন ছেড়ে দিলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম উনি স্টেশনের দিকে বুনো ঘোড়ার মতো দৌড়ে চলেছেন। কিন্তু ওঁকে বলার সুযোগ পেলাম না, কুঞ্জবাবুর সঙ্গে সাদা পোশাকের কজন পুলিশও গেছে। কাজেই হালদার মশাইয়ের দুর্ভাবনার কারণ নেই।

কর্নেলকে টেলিফোন করে হালদারমশাইয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে দেব ভাবলাম। পরে মনে হল, এ খবর সকালে গিয়ে মুখোমুখি জানালেও চলবে।

কিন্তু হালদারমশাইকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হল না যে! যে গাড়িতে হরনাথবাবুকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং হালদারমশাই যার পেছন-পেছন ধাওয়া করে বনেটে উঠেছিলেন, সেটা লাল মারুতি কি না।

ঘুম ভাঙল সাড়ে আটটায়। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেখি, ড্রয়িং রুমে কর্নেলের মতোই লম্বা-চওড়া এবং টাই-সুটপরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। পায়ের কাছে একটা ব্রিফকেস। কর্নেল ইসারায় আমাকে বসতে বললেন। ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে আমাকে দেখে থেমে গিয়েছিলেন। আমার দিকে উনি সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকালে কর্নেল ইংরেজিতে বললেন–আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। আর জয়ন্ত, ইনি মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মিঃ গণেশলাল প্রসাদ।

উত্তেজনা চেপে রেখে নমস্কার করলাম। ইনিই সেই প্রসাদজি এবং এঁকে তাহলে শেষ পর্যন্ত কর্নেলের কাছে আসতে হয়েছে!

প্রসাদজি গম্ভীর মুখে আমাকে নমস্কার করে কর্নেলকে বললেন–একটা অনুরোধ কর্নেল সরকার। আমি খবরের কাগজের খবর হওয়া পছন্দ করি না। অবশ্য খবরের কাগজে আমার কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিতে হয়। কিন্তু

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন–আপনি আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন মিঃ প্রসাদ! আপনাকে নিয়ে জয়ন্ত কোনও খবর করবে না। তাছাড়া আপনি যদি ভাবেন, আমাকে যা বলছেন, তা জয়ন্ত জানবে না, সে-ও ভুল হবে। আপনি যা বলছিলেন, তা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।

একটু ইতস্তত করে প্রসাদজি বললেন–ডঃ সুন্দরমকে আপনি বলেছেন আমি নাকি ইন্দ্রজিৎকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলাম, আপনার এই ধারণা ঠিক নয়। শেখসায়েব আমার সাথে দেখা করেছিলেন এবং তার এক কর্মচারী শংকর হাজরা মুক্তো চুরি করে পালিয়ে এসেছে, একথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না শংকর হাজরাই ইন্দ্রজিৎ রায়। কাজেই ইন্দ্রজিৎকে ফাঁদে ফেলার প্রশ্নই ওঠে না।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–শংকর হাজরাকে আপনি চেনেন বা চিনতেন?

-নাহ। তার নামও শুনিনি কখনও। শেখ সায়েবের মুখে প্রথম শুনেছি।

ইন্দ্রজিৎ আপনাদের ট্রেডিং ইনফরমার ছিল?

প্রসাদজি একটু হাসলেন।–ডঃ সুন্দরমের সঙ্গে ওর বন্ধুতা ছিল। আমার কোম্পানি গালফ এলাকার শুধু মুক্তো নয়, সবরকম ব্যবসা-বাণিজ্যেরই খবর সংগ্রহ করে। তা ছাড়া আমরা এসব ব্যাপারে কমিশন-এজেন্টও রাখি। ইন্দ্রজিৎকে একজন সেইরকম এজেন্ট বলতে পারেন।

–আচ্ছা মিঃ প্রসাদ, আপনি কি মহাজাতি সদনে ম্যাজিক শোয়ের দুটো টিকিট হরনাথ চন্দ্রকে দিয়েছিলেন? গত রবিবার নাইট শোয়ের টিকিট?

প্রসাদজির মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।–ম্যাজিক শোয়ের টিকিট! আমি হরনাথ চন্দ্রকে সম্পূর্ণ অসম্ভব, কর্নেল সরকার! চূড়ান্ত অসম্ভব।

-কেন অসম্ভব মিঃ প্রসাদ?

–চন্দ্র জুয়েলার্স আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে গালফ এলাকায় এখন আমার কোম্পানির একনম্বর শত্রু। প্রতিযোগী বলছি না লক্ষ্য করুন। শত্রু।

–শত্রু! কেন?

 প্রসাদজি ঘড়ি দেখে বললেন–সে অনেক কথা। সংক্ষেপে বলছি। চন্দ্র জুয়েলার্স আমার কোম্পানির মাধ্যমেই গালফ এলাকায় ঢুকেছিল। পরে টের পেলাম হরনাথ আমাদের পিঠে ছুরি মারার চেষ্টা করছেন। চোরাপথে পাচার হয়ে আসা জুয়েলার্স লাক্সারি গুডস হার্ড কারেন্সি এসব নিয়েও আমরা কারবার করি। অনেকেই করে। তো হঠাৎ দফায়-দফায় কাস্টমসের হানায় আমরা জেরবার হচ্ছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এর পেছনে হরনাথের হাত আছে। বোম্বেতে ওঁর ব্রাঞ্চ খোলর উদ্দেশ্যও বুঝতে পারলাম। উনিই একই কারবারে নেমেছেন। তখন বাধ্য হয়ে ওঁর বোম্বে ব্রাঞ্চের পেছনে গুণ্ডা লাগাতে হল। সেই ব্রাঞ্চের একটা লোকের প্রাণ গেল।

তারই নাম ছিল শংকর হাজরা।

 প্রসাদজি একটু চমকে উঠলেন। বলেন কী! আমি অবশ্য তার নাম নিয়েই মাথা ঘামাইনি।

–যাই হোক, আপনি নিশ্চয় জানেন ইন্দ্রজিৎ রায়, চন্দ্র জুয়েলার্সের কর্মচারী ছিল?

–জানতাম বলেই ওকে গুরুত্ব দিতাম।

–ওই ঘটনার পর ইন্দ্রজিৎকে চন্দ্র জুয়েলার্স বোম্বে ব্রাঞ্চের চার্জে পাঠিয়েছিল।

জানি। তবে ইন্দ্রজিৎ আমাদের এজেন্ট। তাই তার কোনও ক্ষতি যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা করেছিলাম। তারপর ইন্দ্রজিৎ চন্দ্র জুয়েলার্সের চাকরি ছেড়ে কী করে গালফ এলাকায় চলে গেল জানি না।

–মিঃ প্রসাদ। ইন্দ্রজিৎ যে আপনাদের এজেন্ট, হরনাথ টের পেয়েছিলেন। তাই তার চাকরি গিয়েছিল। তখন সে মৃত শংকর হাজরার পাসপোর্ট জাল করেই গালফে গিয়েছিল।

প্রসাদজি মাথা নেড়ে বললেন–আমি জানি না। তবে সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। শুধু এটুকু বলতে পারি।

–আপনি জানতেন না ইন্দ্রজিৎ মানামায় থাকে এবং শেখসায়েবের ফার্মে চাকরি করে?

–মানামা থাকে জানতাম তবে সে শেখসায়েবের ফার্মেই চাকরি করে, তা জানতাম না।

–বনানী সেনের সঙ্গে ইন্দ্রজিতের সম্পর্কের কথা কি জানতেন?

–ডঃ সুন্দরম বলেছিলেন। ইন্দ্রজিতের সুপারিশে মিস সেনকে চাকরি দিয়েছিলাম।

–হরনাথবাবুর ভাই কুঞ্জনাথকে আপনি চেনেন?

নামে চিনি মাত্র। প্রসাদজি আবার ঘড়ি দেখে বললেন–এবার বলুন, আপনার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে বলেছেন কেন? দেখা করলে আমি নাকি লাভবান হব, তাও বলেছেন। এর অর্থ কী?

–মিঃ প্রসাদ! হোটেল কন্টিনেন্টালের অন্যতম মালিক আপনি। শেখসায়েবকে ওভাবে হোটেল ছাড়া করে স্বদেশে পাঠাতে ব্যস্ত হলেন কেন?

প্রসাদজির মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে বললেন–ওঁর নিরাপত্তার জন্য। ওঁর ক্ষতি হলে আমার কোম্পানির ক্ষতি হবে। উনি জেদি হঠকারী মানুষ। উনি হরনাথের পাল্লায় পড়েছিলেন। তাই ওঁকে বাঁচানোর জন্য ওঁর পাসপোর্ট চুরি করিয়েছি। তবে দিল্লিতে গিয়েই উনি পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে যাবেন।

–কিন্তু আপনি যে নিজেও বিপন্ন, মিঃ প্রসাদ।

তার মানে?

–শেখসায়েবের মুক্তো উদ্ধারের চেষ্টা করছেন আপনি। এই চেষ্টা না করাই আপনার পক্ষে নিরাপদ। ধরে নিচ্ছি, মুক্তো উদ্ধার করে শেখসায়েবকে ফেরত দেওয়াই হয়তো আপনার উদ্দেশ্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে আপনি বিপজ্জনক ফঁদে পা দিচ্ছেন। আপনি এ চেষ্টা থেকে সরে দাঁড়ান মিঃ প্রসাদ!

প্রসাদজি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন কর্নেল সরকার! আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। তবে আমি কী করব বা না করব, সেজন্য অন্যের পরামর্শের আমি মুখাপেক্ষী নই। আপনি অকারণে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করলেন।

বলে সশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন গণেশলাল প্রসাদ।…

প্রসাদজি চলে যাওয়ার পর কর্নেলকে গত রাতে আসানসোল থেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের এস টি ডি করার কথা বললাম। কর্নেল একচোট হেসে নিয়ে বললেন–ওঁর গতিবিধি থেকে বুঝতে পারছি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। বুঝতে না পেরে বললাম–কী উদ্দেশ্য?

তুমি ভুলে গেছ জয়ন্ত। শেখসায়েবের মুক্তোচুরির কেস নিয়ে হরনাথ আমার কাছেই এসেছিলেন। কিন্তু আমি সেই কেস নিজে নিইনি। হালদারমশাইয়ের কাছেই ওঁদের পাঠিয়েছিলাম। তিনি লড়ে যাচ্ছেন।

একটু অবাক হয়ে বললাম–তা ঠিক। কিন্তু শেষপর্যন্ত তো আপনিও সেই কেসে লড়তে নেমেছেন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না বস্!

ষষ্ঠী কফি আনল। তারপর আকৰ্ণ হেসে বলল–আজ লাঞ্চোতে দাদাবাবুকে বাংলাদেশের ইলিশ খাওয়াব।

বললাম–না ষষ্ঠী! আজ আর তোমার বাবামশাইয়ের লাঞ্চো খাব না। অফিসে মুখ না দেখালে চাকরি খাবে। এ বেলা অফিসের ক্যান্টিনেই খেয়ে নেব।

ষষ্ঠীচরণ কর্নেলের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে দাড়িতে হাত বোলাচ্ছিলেন। একটু পরে চোখ খুলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন-জয়ন্ত কী বলছিলে যেন?

বাংলাদেশের ইলিশ!

 কর্নেল আমার কৌতুকে মন দিলেন না। বললেন–তুমি বলছিলে আমিও সেই কেসে লড়তে নেমেছি। নাহ্ জয়ন্ত! আমার কেস ইন্দ্রজিতের হত্যারহস্য। আমার মক্কেল শেখসায়েব বা হরনাথ নন। আমার এক পুরনো বন্ধু পরমেশ রায়চৌধুরি।

–কিন্তু মুক্তোচুরির সঙ্গে ইন্দ্রজিতের হত্যারহস্য জড়িয়ে আছে। তাই না?

–আছে। তবে আবার বলছি, শেখসায়েব বা হরনাথ আমার মক্কেল হোন, এটা শুরুতেই আমি চাইনি। কেন চাইনি যদি বলো, তা হলে বলব– সম্ভবত আমার ইনটুইশন আমাকে সতর্ক করেছিল। কিংবা কেন যেন আমার মনে হয়েছিল এর মধ্যে কোনও আন্তর্জাতিক চোরাচালানিচক্র জড়িত আছে। বনানী সেন আসার পর মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে আমার উঁকি মারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল সেটা ঝালিয়ে নেওয়া। কিছুক্ষণ আগে প্রসাদজির মুখে স্পষ্টত সেটা তুমিও শুনেছ! স্মাগলারদের পেছনে ছোটাছুটির কোনও অর্থ হয় না।

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ কফিতে মন দিলেন। আমি কফি শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে বললাম–গতরাতে মেট্রো সিনেমার সামনে যাকে ধরা হয়েছে, তার পরিচয় পাওয়া গেছে?

কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন–প্রসাদজি সম্পর্কে তোমার কী ধারণা হল, আগে শুনি।

–লোকটা একগাদা মিথ্যা আওড়ে গেল।

–যেমন?

–শেখসায়েবকে নাকি তার নিরাপত্তার জন্য প্রসাদজি স্বদেশে ফেরত পাঠাতে চেয়েছেন। কিন্তু সেজন্যই হোটেল তার স্যুইটে ড্যাগার হাতে লোক ঢোকানোর ব্যাপারটা বীভৎস নয়? মুখে বুঝিয়ে বললে–

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–শেখসায়েব জেদি মানুষ। তার চেয়ে বড় কথা, উনি প্রসাদজির ওপর ভরসা করতে না পেরে গোপনে হরনাথের কাছে গিয়েছিলেন। হরনাথের সঙ্গে প্রসাদজির শত্রুতা আছে। কাজেই হরনাথের খপ্পর থেকে ওঁকে সরাতে প্রসাদজি সত্যি একটা বীভৎস পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন।

বললাম–শুধু তাই নয়, প্রসাদজি হরনাথকে কিডন্যাপও করেছেন। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। কিডন্যাপ করে কয়েক লক্ষ টাকা দাও মারার বাড়তি মওকাও পাওয়া যাবে।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–কুঞ্জনাথের সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশ গেছে। হালদারমশাইও এখানে আছেন। কাজেই কিডন্যাপার যেই হোক, তার বিশাল দাও মারার মওকা ফস্কে যাবে। এবার বলো–আর কী মিথ্যা বললেন। প্রসাদজি?

–প্রসাদজি বললেন, হরনাথ তার শত্রু। এটা ডাহা মিথ্যা। কারণ কুঞ্জনাথ বলেছেন, মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির সঙ্গে তাদের কারবারি সম্পর্ক আছে। শত্রুতা থাকলে কুঞ্জনাথের কথায় আভাস পাওয়া যেত। তা ছাড়া কুঞ্জনাথ বলেছেন, প্রসাদজিই হরনাথকে ম্যাজিক শোয়ের দুটো টিকিট দিয়েছিলেন।

হরনাথ ভাইকে মিথ্যা বলে থাকতে পারেন। মনে করে দেখ জয়ন্ত, কুঞ্জনাথ বলেছেন, তাঁদের কারবারের বহু ব্যাপার সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ। তার দাদা হরনাথ সম্পর্কে কুঞ্জবাবুর উক্তি কি মনে পড়ছে?

–হ্যাঁ। কুঞ্জনাথ বলছিলেন, তাঁর দাদা বড় প্যাচালো মানুষ। কী সব করেন, কুঞ্জনাথ বুঝতে পারেন না।

কর্নেল আবার চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিলেন। একটু পরে বললেন– ম্যাজিক শোয়ের দুটো টিকিট একটা ভাইটাল পয়েন্ট। শুধু এটুকুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, কুঞ্জনাথের হাত থেকেই বনানী টিকিট দুটো পেয়েছিল।

–আচ্ছা কর্নেল, এমন তত হতে পারে, কুঞ্জনাথই আগাগোড়া মিথ্যা বলেছেন।

–কেন?

–হরনাথ এবং কুঞ্জনাথ সভাই। হরনাথের অজ্ঞাতসারে প্রসাদজির সঙ্গে কুঞ্জনাথের একটা গোপন বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে!

–কিসের বোঝাপড়া?

–ইন্দ্রজিতের চুরি করে আনা মুক্তো হাতানো।

কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন–হুঁ, তুমি একটা পয়েন্ট তুলেছ বটে।

উৎসাহিত হয়ে বললাম–প্রসাদজি এবং কুঞ্জনাথ চক্রান্ত করে হরনাথকে কিডন্যাপ করে থাকতে পারেন। কারণ কুঞ্জনাথের এতে একটা বড় স্বার্থ আছে। সত্তাই বেঘোরে মারা পড়লে

–হুঁ, বলে যাও!

মনে করে দেখুন, কুঞ্জনাথ টাকা নিয়ে চোরডিহা যেতে চাইছিলেন না। আপনি প্রায় জোর করে সঙ্গে পুলিশগার্ড দিয়ে ওঁকে পাঠিয়েছেন। এ থেকে মনে হচ্ছে, কুঞ্জনাথ চাইছিলেন, হরনাথের প্রাণ যাক। তাহলে চন্দ্র জুয়েলার্সের একা মালিক হতে পারবেন কুঞ্জনাথ।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–সমস্যা হল জয়ন্ত, মানুষের জীবনে সবসময় দুয়ে-দুয়ে চার হয় না। গণিতের নিয়ম মেনে মানুষের জীবনে ঘটনা ঘটে না।

জোর দিয়ে বললাম কিন্তু এক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা থেকে প্রসাজির সঙ্গে কুঞ্জনাথের গোপন চক্রান্তের সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে হচ্ছে না কি? প্রসাদজি যে কত মিথ্যাবাদী, তার আর একটা প্রমাণ, ইন্দ্রজিতের সুপারিশে নাকি বনানীকে চাকরি দিয়েছিলেন। কিন্তু বনানী বলেছে, সে-ই ইন্দ্রজিৎকে প্রসাদজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। প্রসাদজি মহা ধড়িবাজ মিথ্যাবাদী।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন-জয়ন্ত! হরনাথকে অপহরণ এবং খতম করায় কুঞ্জনাথের স্বার্থ থাকতেই পারে এবং সেই স্বার্থ হল, চোরাই মুক্তো উদ্ধারে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরানো। কিন্তু তা যদি হয়, তা হলে প্রসাদজির মতো কোটিপতি স্মাগলার টাকার দাবিতে কিডন্যাপের পথে যাবেন কেন? টাকা দাবি না করে খতম করলেই কার্যসিদ্ধি হত। কিডন্যাপিংয়ের ঝামেলা প্রসাদজির মতো লোকের পক্ষে পোষায় না। তা ছাড়া হরনাথকে কিডন্যাপের রিস্ক আছে প্রচণ্ড।

আমার যুক্তি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। প্রসঙ্গ বদলে বললাম।

কাল রাতে ধরাপড়া লোকটা কে?

–টেলিফোনে ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি শুধু জানিয়েছে, লোকটার মুখে নকল দাড়ি এবং মাথায় নকল চুল অর্থাৎ পরচুলা ছিল। তাকে জেরা করা হচ্ছে। এখনও নাকি জানা যায়নি।

–তার লাল মারুতিটা কাছাকাছি থাকার কথা। পুলিশ আটক করেনি?

–কোনও সন্দেহজনক লাল মারুতি কাছাকাছি ছিল না। তা ছাড়া রাত নটায় ওখানে অনেক লাল মারুতির চলাচল সম্ভব। পুলিশ কি তাদের পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়াবে?

তা হলে তার স্যাঙাত অপেক্ষা করছিল গাড়িতে। বেগতিক দেখে কেটে পড়েছে।

–ঠিক বলেছ। বলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখ জয়ন্ত! পরমেশবাবুর বাগানে তোমার কুড়িয়ে পাওয়া চিঠি আর বনানীর বাবাকে লেখা চিঠিগুলোর হস্তাক্ষর এক। কাগজের সাইজও এক।

কর্নেল চিঠিগুলো আমাকে দিলেন। পরীক্ষা করে দেখে বললাম–আশ্চর্য তো! একই লোকের লেখা। কর্নেল! কাল রাতে ধরাপড়া ছদ্মবেশী লোকটাই ইন্দ্রজিতের খুনী! অবশ্য তার একজন সঙ্গীও ছিল।

–খুন করলেও চোরাই মুক্তো সে হারাতে পারেনি।

 –একথা আপনি আগেও বলেছেন। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বলছেন?

–সে ইন্দ্রজিৎকে খুন করে মুক্তো হাতাতে পারলে ডঃ সুন্দরমকে কিছু টাকার জন্য ব্ল্যাকমেল করতে যতীনবাবুর লুকিয়ে রাখা চিঠি সংগ্রহে হন্যে হত না বা এত ঝুঁকিও নিত না। এদিকে পর পর দুদিন সন্ধ্যায় পরমেশবাবুর বাড়ি চোর ঢোকার ঘটনাও লক্ষ্য করো। তার মানে

কর্নেলের কথার ওপর বললাম–তার মানে, চোরাই মুক্তো পরমেশবাবুর বাড়িতেই লুকোনো আছে বলে তার ধারণা। তবে এখন সে ধরা পড়েছে। তার সঙ্গে এবার হয়তো একা মুক্তো খুঁজবে।

এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁকলেন–ষষ্ঠী!

চিঠিগুলো কর্নেল আমার হাত থেকে নিয়ে ড্রয়ারে ঢোকালেন।

 তারপর হন্তদন্ত ঘরে ঢুকতে দেখলাম ডঃ সুন্দরমকে।