৭. আমি রীণা

আমি রীণা।

শিখা বিহ্বল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, বাঃ, তুমি দেখতে বেশ সুন্দর তো! এখনও আর একবার বিয়ে দিয়ে আনা যায়।

আপনি কি কিছু কম সুন্দর! লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মুখ। আমি কি আপনাকে একটা প্রণাম করতে পারি?

তুমি কেন এসেছ তা জানি। প্রণাম করতে হবে না।

বোসো। রীণা বসল। মাথাটা উদ্ভ্রান্ত। বুকের ভিতরে একটু গুড়গুড়। হয়তো অপমানিত হতে হবে। হয়তো উনি বের করে দেবেন।

শিখা প্রায় নিষ্পলক চোখে তাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, লজ্জা পাচ্ছ?

রীণা মুখ নত করে বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে বলল, উনি আপনার খুব প্রশংসা করতেন।

শিখা মৃদু একটু হেসে বললেন, তাই নাকি? আমার আবার কীসের প্রশংসা? লেখাপড়া তেমন শিখিনি, গুণও বিশেষ কিছু নেই। সেইজন্যই তো–

বলে কথাটা আর শেষ করলেন না শিখা।

গরিব-দুঃখী-পঙ্গু-আতুরদের ওপর আপনার খুব মায়া, শুনেছি।

ও কিছু নয়। যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ছিলাম তখন অনেক গরিব-দুঃখী আসত বটে। তেমন কিছুই করে উঠতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, কাউকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েও দিতাম না। এলে দু’দণ্ড জিরোতে দিতাম, সুখ-দুঃখের কথাও বলতাম। জানো তো, অনেক দুঃখী আছে যারা ঠিক টাকাপয়সা বা ভিক্ষের জন্য আসে না, দুটো মনের কথা বলে জুড়োতে আসে।

রীণা শিখার দিকে একটু অবাক চোখে চেয়ে থাকে। ইনি কি একজন সত্যিকারের মহীয়সী মহিলা?

শিখা একটা সুস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আটতলার ফ্ল্যাটে এসে দেখো কেমন বাক্সবন্দি হয়ে গেছি। কোনও দুঃখী আতুর কি এখানে আসতে পারে? আমার একদম ইচ্ছে ছিল না, উনি জোর করে এলেন। সারাদিন আমার যে কী একা লাগে তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সারাদিন লোকজন না দেখে হাঁফিয়ে পড়ি।

রীণার বিস্ময় বাড়ছে। সে এঁরই স্বামীকে একদা কেড়ে নিয়েছিল প্রায়। গর্ভে ধারণ করেছিল তার সন্তান। সে এসেছে পাঁচ লাখ টাকার দাবি নিয়ে। তবু এই মহিলা তার সঙ্গে এমন বন্ধুর মতো কথা বলছেন কী করে?

শিখা বললেন, আমি তো নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। এবার তোমার কথা বলো।

 রীণা মাথা নিচু করে বলল, আমার তো বলার কিছু নেই। আমি শুধু আপনাকে দেখতে এসেছি।

আমাকে দেখতে এসেছ! আমাকে দেখার কিছু নেই। তোমার কথা বলো।

আমার তো আপনার মতো কোনও গুণ নেই। বরং আমার অনেক দোষ অনেক পাপ। শিখা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর খুব ধীর স্বরে চাপা গলায় বললেন, তুমি আমার সতিন হলে এক কথা ছিল। কিন্তু এ তো তা নয় ভাই। জানি এ যুগে মেয়েরা কিছু মানতে চায় না। কিন্তু সেটা কি ভাল?

এখন মনে হয়, ভাল নয়।

এখন মনে মনে কত কষ্ট পাচ্ছ তুমি। তোমার জন্য আমার মায়া হচ্ছে। মনের কষ্টের মতো কষ্ট নেই।

এইসব মায়াভরা কথায় রীণার চোখে জল আসছিল। সে মুখ তুলে শিখার দিকে চাইতে পারছিল না।

শিখা খুব নরম গলায় বলল, উনি মারা যাওয়ার পর তুমি কি তোমার ছেলেটাকে অশৌচ পালন করিয়েছ?

রীণা মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বলল, না। ও তো সম্পর্কটা জানত না তাই সাহস পাইনি। তবে কয়েকদিন নিরামিষ খেয়েছিল।

আমি কিন্তু ওসব খুব মানি। আমার বয়স উনষাট। তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। তা ছাড়া শুনেছি তুমি বড়লোকের বউ। তুমি কি আর অত আচার বিচার মানতে পারো? তবু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বলব?

বলুন।

উনি তোমার ছেলের নামে যে লাইফ ইনশিয়োরেন্স পলিসিটা রেখে গেছেন সেটার কথা জেনে আমার দুই ছেলে খেপে গেছে। এতটাই খেপেছে যে তারা ঠিক করেছে বাপের শ্রাদ্ধ করবে না। অনেক বুঝিয়েছি, চোখের জল ফেলেছি, কাজ হয়নি। ওদের ধনুক ভাঙা পণ। একেই তো বাপকে বিশেষ পছন্দ করত না, তার ওপর আবার এই ব্যাপার। ওরা না করলেও শ্রাদ্ধটা হয়তো আমিই করব। কিন্তু কী মনে হয় জানো, শ্রাদ্ধাধিকারী তো বড় ছেলে। নিদেন ছোট ছেলেও করতে পারে। তোমার ছেলেকে দিয়ে ওঁর শ্রাদ্ধটা করাবে?

আপনি যদি বলেন, করাব।

বেশি আয়োজন করতে হবে না। লোকজন নেমন্তন্ন করার তো কথাই ওঠে না। যদি কালীঘাটে নিয়ে করাও তা হলেও হবে। একটা ছেলের হাতের জলটুকু যদি পান তা হলেই অনেক।

ঠিক আছে। করাব।

পলিসিটা তুমি নিয়ে যাও। কিন্তু টাকা আদায় করা খুব সহজ হবে না। ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর আরও কীসব লাগবে যেন। সেসব ওই অফিস থেকেই বলে দেবে। শুনেছি অনেক ঝামেলা।

আমিও শুনেছি।

শিখা উঠে ভিতরের ঘরে গেলেন। একটু বাদেই পলিসিটা এনে রীণার হাতে দিয়ে বললেন, উনি এটা আমাকে কেন দিয়েছিলেন জানো? যাতে তুমি একদিন আমার কাছে আসতে বাধ্য হও। উনি একটু অদ্ভুত মানুষ ছিলেন, তা তো জানোই!

জানি।

টাকাটা আদায় করো, তারপর ছেলেটাকে ভালভাবে মানুষ করো। কেমন হয়েছে তোমার ছেলেটা?

চুপচাপ থাকে। খেলাধুলো নিয়েই থাকে বেশি।

বাপের মতোই।

আমি কিন্তু এবার আপনাকে একটা প্রণাম করব।

কেন, এখনই চলে যাবে? কিছু মুখে দেবে না? অন্তত একটু চা বা শরবত?

না থাক। আপনাকে আর উঠতে হবে না।

আমার কাজের লোক আছে, ভয় নেই।

শিখা একজন মাঝবয়সি কাজের মেয়েকে ডাকলেন। সে এসে দাঁড়ালে বললেন, রোদে তেতেপুড়ে এসেছে ওকে একটু ঘোলের শরবত দে। রীণা, তুমি ঠান্ডা খাও তো!

খাই।

তা হলে বরফ দিস বাতাসী। একটুকরো।

রীণা পলিসির সার্টিফিকেটটা তার ব্যাগে পুরল। কৃতজ্ঞতায় তার মনটা ভরে যাচ্ছিল।

শিখা নরম গলায় বললেন, সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ো না। মাঝে মাঝে এসো। আমি তো একা থাকি।

আসব দিদি।

ঘোলের শরবত এল ঝকঝকে কাঁচের গেলাসে। ঘোলের ওপর সবুজ লেবুপাতার টুকরো ভেসে আছে, আর বরফের কুচি। চমৎকার স্বাদ।

শিখা হঠাৎ বললেন, আমি শুনেছি তোমার বর তোমাকে খুব ভালবাসেন!

রীণা মাথাটা নোয়াল।

লজ্জা কীসের? স্বামীর ভালবাসা যে পাচ্ছ সেটা ভগবানের দয়া বলে মনে কোরো। তোমার বর খুবই ভাল লোক বলতে হবে।

হ্যাঁ, উনি ভীষণ ভাল।

আমার স্বামী ভালবাসতে জানতেন না। বরং অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেতেন। এ ধরনের লোককে বোধহয় স্যাডিস্ট বলে, না?

তাই হয়তো হবে।

সেজন্যই ওঁর সত্যিকারের নিজের লোক কেউ হল না। ছেলেরা নয়, মেয়ে নয়, কেউ নয়। শুধু আমি ছিলাম। কষ্ট আমাকেও কিছু কম দেননি। কিন্তু আমার তো উপায় ছিল না।

রীণা মুখ তুলতে পারছে না। ভয় হচ্ছিল, পুরনো কথা যদি উঠে পড়ে।

শিখা উদাস গলায় বললেন, এখন তো শুনছি ওঁর মৃত্যুটাও এমনি হয়নি। পুলিশ নানারকম সন্দেহ করছে। কী জানি বাপু, সত্যিকারের কী হয়েছিল।

ঘরের আবহাওয়াটা একটু ভারী হয়ে যাচ্ছিল। রীণা আর বসে থাকতে পারছে না। সে উসখুস করছিল।

শিখা বললেন, উঠবে? এসো তা হলে। ওঁর ডেথ সার্টিফিকেটটার কপি দরকার হলে আমাকে জানিয়ো। জেরক্স করিয়ে রাখব।

রীণা ঘাড় হেলিয়ে উঠে পড়ল। এত সহজে এবং অল্প আয়াসে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে বলে সে ভাবেনি। সে সত্যিকারের শ্রদ্ধার সঙ্গে শিখাকে একটা প্রণাম করে বেরিয়ে এল। বাসুদেব ভুল বলেনি। শিখা সত্যিই খুব ভাল মহিলা।

বাড়ি ফিরতে বেলা একটা হয়ে গেল। রীণা এসি চালিয়ে বাইরের ঘরে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল।

পরমা এসে বলল, কোথায় গিয়েছিলে মা? তোমার একটা ফোন এসেছিল।

কার ফোন?

চিনি না। মোটা গলা। আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করছিল।

কী কথা?

তোমার কথা।

কী কথা?

প্রথমে জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায় গেছ। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা, বাপির সঙ্গে তোমার ঝগড়া হচ্ছে কিনা, তুমি কেমন মানুষ।

ও মা! এসব আবার কী কথা! কে লোকটা?

নাম বলেনি। তবে দেড়টার সময়ে আবার ফোন করবে।

ঠিক আছে। তুমি স্নান করতে যাও।

সামান্য নার্ভাস লাগছিল রীণার। এ হয়তো সেই লোকটাই যে আরও একদিন ফোন করেছিল। যে-ই হোক, লোকটা অনেক খবর রাখে।

দেড়টা নয়, লোকটা ফোন করল দুটোর পর। সেই ভারী, মোটা গলা।

মিসেস বোস?

হ্যাঁ।

আপনার মতো লাকি উওম্যান আমি আর দেখিনি। কংগ্রাচুলেশনস।

তার মানে?

এটা যে কলিযুগ তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। কলিযুগে যারা পাপটাপ করে তাদেরই রবরবা। আপনি এত কিছু করেও দিব্যি সুখে আছেন। শুনছি আপনার ছেলেটির জন্য নাকি বাসুদেব সেনগুপ্ত পাঁচ লাখ টাকা আর একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও করে গেছে। মিসেস বোস, একেই বলে গাছের খাওয়া আর তলার কুড়োনো।

আপনি ভদ্রলোক নন?

আজ্ঞে না। ভদ্রলোক হলে আপনার সঙ্গে এসব রসালাপ করতে পারতাম কি?

আমি ফোন ছাড়ছি।

সেটা আপনার ইচ্ছে। তবে কথা বললে আলটিমেটলি আপনার হয়তো লাভই হবে।

দেখুন, আমার জীবনটা আমার একারই। আপনি হয়তো জানেন না, আমি আমার স্বামীর কাছে ডিভোর্সও চেয়েছিলাম। উনি দেননি। সুতরাং আমার খুব একটা দোষ নেই। আপনি অকারণ বিবেকের ভূমিকা নিচ্ছেন কেন? আপনি কে?

বাঃ, এই তো দেখছি, মানসিকভাবে অনেকটা সামলে উঠেছেন। নিজের ফেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে যুক্তিও খাড়া করছেন। তবে সেদিন ওরকম মিউ মিউ করছিলেন কেন?

আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

কথার কি শেষ আছে ম্যাডাম? শুধু বলি, আপনি ভাগ্যবতী মহিলা বটে, কিন্তু আপনার স্বামী শঙ্কর বসু একটি আস্ত পাঁঠা। অ্যাডাল্টারাস উওম্যান জেনেও আপনাকে মহারানির মতো লোকটা পালপোষ করছে কীভাবে? ওর গায়ে কি মানুষের চামড়া নেই?

প্লিজ! আপনি এসব বন্ধ করুন।

লোকটা একটা ঘিনঘিনে হাসি হেসে বলল, বিবেকের দংশন হচ্ছে নাকি?

প্লিজ!

আপনি আগের দিন আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। আমাকে বিবেক বলেই জানবেন।

আপনি আর দয়া করে ফোন করবেন না। বিশেষ করে আমার দুধের বাচ্চা মেয়েটার কাছে আপনি যেসব কথা জানতে চেয়েছেন তা অন্যায়।

আপনার মেয়ে কি একদিন তার মায়ের কথা জানতে পারবে না?

হয়তো জানবে। বড় হোক, আমিই জানাব।

আপনার মতো মহিলা আমি সত্যিই দেখিনি মিসেস বোস। আপনার ভাগ্য অন্য মেয়েদের কাছে ঈর্ষণীয়।