বেলা একটা নাগাদ খেয়ে নিয়ে আমি অভ্যাসমতো একটুখানি ভাত-ঘুম দিচ্ছিলুম। কর্নেল আর হালদারমশাই বারান্দায় বসে কথা বলছিলেন। আজ বেজায় গরম। তাই এয়ারকন্ডিশনার চালু করে দিয়েছিলুম। সেই সঙ্গে ফুল স্পিডে পাখাও ঘুরছিল। হঠাৎ ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল।
চোখ খুলে দেখি, গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজিতভাবে আমার কাঁধে চাপ দিচ্ছেন। আর ডাকছেন ওঠেন জয়ন্তবাবু! শিগগির ওঠেন! জয়ন্তবাবু!
উঠে বসে বিরক্ত হয়ে বললুম, কী ব্যাপার হালদারমশাই!
হালদারমশাই বললেন, ডেডবডি! একখান ডেডবডি!
কোথায় ডেডবডি? কার ডেডবডি?
পাঁচুর ভাই কিনুরে মার্ডার করছে কোন হালায়। হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন। বডি ফার্মের পিছনের জঙ্গলে ছিল। পাঁচুর বউ ডিসকভার করছে। গোপালবাবু সাইকেলে আইয়া খবর দিলেন। কর্নেলস্যার জিপে গেলেন। আমারে নিষেধ করলেন। কইলেন, তখন আমি পাঁচিল পার হইয়া অরে তাড়া করছিলাম। পুলিশ ট্যার পাইলে আমারে টানাটানি করতে পারে। মফস্বলের পুলিশেরে আমি চিনি। কর্নেলস্যার ঠিক কইছেন। এখন আমার যাওয়া উচিত হইবে না।
হতবাক হয়ে শুনছিলুম। বললুম, কিনুকে কে মারল? কীভাবে তাকে মারা হয়েছে জানেন?
গোপালবাবু তো কইলেন, বাঘে মারছে। মাথায় পিছনে মারছে। পিঠেও মারছে।
তা হলে মার্ডার কেন বলছেন আপনি?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ ক্ষুব্ধভাবে বললেন, গোপালবাবুরে জিগাইলাম, বাঘ মারলে তো গর্জন করে। বাঘের গর্জন শোনেন নাই? উনি কইলেন, আমরা আসবার পর ফার্মে পাওয়ারটিলার মাটি কাল্টিভেট করতাছিল। তাই গর্জন শুনবেন ক্যামনে?
কিন্তু আপনি বলছেন কেউ কিনুকে মার্ডার করেছে!
হালদারমশাই এবার চাপাস্বরে বললেন, বাঘ মাইনষেরে মারলে অন্তত একটুকখানি মাংস খায়। গোপালবাবু যে ডেসক্রিপশান দিয়া গেলেন, তাতে বুঝলাম মাংস খায় নাই। তাই আমার সন্দেহ, কেউ ছ্যামড়ারে আচমকা পিছনথনে ধারাল কিছু দিয়া আঘাত করছে।
কিনুর মতো ছিঁচকে চোরকে কারও খুন করার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?
গোয়েন্দাপ্রবর আবার শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে উত্তেজিতভাবে বললেন, মুখ বন্ধ করছে। কিন্তু কিছু সিক্রেট ইনফরমেশন ট্যার পাইছিল। তাই তার মুখ বন্ধ করছে।
শীত করছিল। ফ্যান বন্ধ করে বাইরে গেলুম। হালদারমশাই বারান্দার চেয়ারে বসে গোঁফে তা দিতে থাকলেন। প্রায় তিনটে বাজে। আকাশ মেঘলা। কিন্তু জোরে বাতাস বইছে। আমাদের দেখে চৌকিদার এসে বলল, গোপালবাবু আসলেন। কর্নির্লসাব মোহন সিংকে ডেকে জিপে তুরন্ত চলে গেলেন। কুছু খারাপ খবর আছে মালুম হলো।
হালদারমশাই বললেন, হঃ! রামভরোসা! তুম দো কাপ চায় পিলাউ। জয়ন্তবাবু, চা না কফি খাইবেন কন?
বললুম, চা।
চৌকিদার চলে গেল। হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে বললেন, চা খাইয়া দুইজনে ফার্মে যামু। কী কন?
দেখা যাক। তো আপনাকে কাল রাত থেকে নস্যি নিতে দেখিনি। ব্যাপার কী?
হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, নস্যির কৌটোসুদ্ধ নদী জোব্বার অর্ধেক খাইয়া ফেলছিল। সকালে বাজারে গেলাম। তখন নস্যির কথা মনে ছিল না। তবে ফার্মের লোকে আমারে নস্যি টানতে দেখলে সন্দেহ করত। যা হয়, তা ভালোর জন্য হয় জয়ন্তবাবু! তখন লাঞ্চের পর আপনি ঘরে ঢুকলেন। আমি চৌকিদারেরে নস্যির কথা কইলাম। সুশীলবাবু নস্যি লন। তিনিই এটা প্রেজেন্ট করছেন।
হেকিমসাহেব সেজেও নস্যি নিতেন?
হঃ! তবে বুঝলেন না? যে স্টাইলে আমি নস্যি লই, তা কারও চোখে পড়ার কথা নয়। রিস্ক না লওয়াই ভালো।
চৌকিদার চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। চা খাওয়ার একটু পরে কেয়ারটেকার সুশীলবাবু এসে বললেন, নমস্কার স্যার! মিঃ চৌধুরির ফোন আছে। কর্নেল সায়েব কথা বলতে চান।
সুশীলবাবুকে অনুসরণ করলাম। হালদারমশাইও আমার পিছনে হন্তদন্ত এগোলেন। অফিসঘরে ঢুকে রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, জয়ন্ত! আমি আহিরগঞ্জ পোলিস স্টেশনে আছি। মোহন সিং জিপ নিয়ে গেছে। হালদারমশাইকে নিয়ে তুমি চলে এস। হা–হালদারমশাইকে তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে আনতে বলবে।
কর্নেল! এক মিনিট! কিনু কি বাঘের আক্রমণে মারা গেছে?
আপাতদৃষ্টে তা-ই। তবে বডির পোস্টমর্টেম হলে জানা যাবে বাঘ না অন্য কিছু। ছাড়ছি।…
হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার কী কইলেন?
চলুন! বলছি।
সুশীলবাবু এবং অফিসের দুজন ক্লার্ক একগলায় বলে উঠলেন, বাঘে মানুষ মেরেছে?
বললুম, হ্যাঁ। অট্টহাসের জঙ্গলে কিনু নামে একটা লোক বাঘের মুখে প্রাণ হারিয়েছে।
সুশীলবাবু বললেন, কিনু? সেই সিঁদেল চোর কিনু? কী সর্বনাশ! অট্টহাসের জঙ্গলে ব্যাটাচ্ছেলে কি গাছের গুঁড়িতে সিঁদ কাটছিল?…
আমাদের ঘরের সামনে এসে হালদারমশাইকে কর্নেলের কথাটা বললুম। উনি সটান নিজের ঘরে ঢুকলেন। আমি আমাদের ঘরে ঢুকে প্যান্টশার্ট পরে রেডি হয়ে নিলুম। সঙ্গে আইডেন্টিটি কার্ড আর রিপোর্টারস নোটবুক নিলুম।
মিনিট পনেরো পরে গেটের নিচে মোহন সিংয়ের জিপ এসে পৌঁছুল। আমরা এগিয়ে গেলুম।..
আহিরগঞ্জ থানার অফিসার-ইন-চার্জের ঘরে কর্নেল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আলাপ করিয়ে দিলেন। ওসির নাম বীরেন্দ্র রক্ষিত। একজন সাব-ইন্সপেক্টরও ঘরে ছিলেন। তাঁর নাম নরেন্দ্র ব্যানার্জি। ইনিই চারজন সশস্ত্র কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে সুদর্শন সিংহরায়ের ফার্মে চোর ধরতে গিয়েছিলেন।
বীরেন্দ্রবাবু হালদারমশাইকে বললেন, আপনার পরিচয় এবং কীর্তিকলাপ কর্নেলসায়েবের কাছে শুনেছি। আজ সকালে আপনি ফার্মের পাঁচিল ডিঙিয়ে কিনুকে তাড়া করেছিলেন শুনলুম!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, ইয়েস! তাড়া করছিলাম কইলে ভুল হইবে। কিনু জঙ্গলে ভ্যানিশ হইয়া গেল। বড় কাটা। তাই আবার পাঁচিল টপকাইয়া ফার্মে ঢুকছিলাম।
তার পরনে কী ছিল?
হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। জাস্ট এইটুকখানি দেখছি। পায়ে জুতা ছিল কিনা দেখি নাই।
বীরেন্দ্রবাবু কর্নেলকে বললেন, তা হলে আপনার পয়েন্টটা ঠিক। ফার্মে কারও সঙ্গে তার দেখা করার কথা ছিল। তাড়া খেয়ে পালিয়ে সে ফার্মের পিছনের জঙ্গলে অপেক্ষা করছিল। বডির পজিশন দেখে আমারও মনে হয়েছে, সে বসে ছিল। আচমকা পেছন থেকে আক্রান্ত হয়। এখন দেখা যাক, ডাক্তার কী বলেন?
হালদারমশাই বললেন, বাঘ অ্যাটাক করলে দুই-এক কামড় মাংস খাইবেই মিঃ রক্ষিত। আমি যখন নদীয়ার করিমপুর থানার চার্জে ছিলাম, তা দশ বৎসর আগের কথা–ঠিক এইরকম কেস ডিল করছিলাম। দ্যাট ওয়াজ এ রিয়্যাল টাইগার।
আচ্ছা মিঃ হালদার, দেখুন তো এই লোকটাকে চিনতে পারেন কি না, বলে বীরেন্দ্রবাবু টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ফটো এগিয়ে দিলেন।
দেখামাত্র গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, চিনছি। নাম কইছিল ভবেশ ঘোষ।
বীরেন্দ্রবাবু কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ কটাক্ষ করে হাসলেন। ভদ্রলোক ন্যাটা। বাঁ হাতে লেখেন। চায়ের কাপ ধরেন বাঁ হাতে। এভরিথিং ওঁর বাঁ হাতে।
হালদারমশাই বললেন, বটুক ঘোষ?
বীরেন্দ্রবাবু বললেন, না। তবে বটুক ঘোষের মতো দেখতে। এই ভদ্রলোক বটুক ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এঁর নাম রাজেন হাজরা। অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করেন। সেভেনটিজে কলেজে পড়ার সময় নকশাল মুভমেন্টে জড়িত ছিলেন। মিঃ সিংহরায়কে তার বাবা বিদেশে পাঠিয়ে দেন। আর রাজেন হাজরা মুচলেকা দিয়ে হাজত থেকে ছাড়া পান। এই দেখুন! পুরনো রেকর্ডের ফাইল হাতড়ে বের করেছি।
আমি এস আই নরেন্দ্র ব্যানার্জিকে বললুম, রিপোর্টার হিসেবে আপনার কাছে কিছু কথা জানতে চাইছি।
নরেন্দ্রবাবু বললেন, বলুন কী জানতে চান? আপনাদের সিউড়ির সংবাদদাতা তো কার কাছে কী সব শুনে গালগল্প লিখেছিলেন। আশা করি, আপনি লিখলে ঠিকঠাক লিখতেন।
রিপোর্টারস নোটবুক বের করে বললুম, আপনারা কি চোরকে দেখতে পেয়েছিলেন?
নাহ। কিন্তু ভেতরে থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছিল চোর চোর বলে। আমরা তখন টর্চ জ্বেলে ফার্মের চারদিকের পাঁচিল দেখছিলুম। সেই সময় হঠাৎ বাঘের গর্জন শুনলুম। প্রচণ্ড গর্জন। দুজন কনস্টেবল পেছনের জঙ্গলের দিকে দুরাউন্ড করে ফায়ার করেছিল। তারপরই গর্জন থেমে গিয়েছিল। পরে ফার্মের ভেতর তন্নতন্ন খুঁজে চোরকে দেখতে পাইনি। কিন্তু চোর নিশ্চয় ঢুকেছিল। তার প্রমাণ সিংহরায় সাহেবের জাফরানখেতে অনেকটা জায়গা কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে হেঁটে ফেলেছিল। টাটকা কাটা ডালপালা আর পাতা। কয়েকটা গাছ ওপড়ানোর চিহ্নও লক্ষ্য করেছিলুম। চোর সম্ভবত গোডাউনের পাশে পাঁচিল টপকে ঢুকেছিল। অবশ্য চোর লিখবেন না। কোনো বজ্জাত লোক। সিংহরায়। সায়েবের শত্রুতা কেউ করতেই পারে।
চোর চোর বলে কে চিৎকার করেছিলেন?
ইনটেলিজেন্ট কোয়েশ্চন! ওসি বীরেন্দ্রবাবু বললেন, বলুন ব্যানার্জিবাবু!
নরেন্দ্র ব্যানার্জি বললেন, প্রথমে একজন, তারপর ফার্মের আরও অনেকে চিৎকার করেছিল। তবে প্রথমে লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলেন ম্যানেজার গোপাল বোস। গার্ড শেষপ্রান্তে একটা চালাঘরে থাকে। সে টর্চ জ্বেলে খুঁজেছিল। কিন্তু ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থাকায় তার টর্চের আলো জাফরানক্ষেতে পৌঁছয়নি।
বললুম, তা হলে গোপালবাবুরই প্রথমে চিৎকার করার কথা।
হ্যাঁ। কিন্তু অত ডিটেলসে যাওয়ার দরকার মনে করিনি।
এইসময় একজন সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকে সেলাম ঠুকে বললেন, রাজেনবাবু মর্নিংয়ে সিউড়ি গেছেন বটুকবাবুর সঙ্গে। আর একটু কেশে তিনি বললেন, কিনুর ঘরের তালা ভেঙে কেউ ঢুকেছিল। তালাটা শুধু আটকানো ছিল। সার্চ করে তেমন কোনো জিনিস পাওয়া গেল না।
ওসি হাসলেন। বক্রেশ্বরের জলে ফেলে দিতেই পারে। যাই হোক, আপনি রাজেনবাবুর বাড়ির কাছে তোক মোতায়েন করেছে তো?
হ্যাঁ স্যার!
ঠিক আছে। আপনি বিমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেলরিকশ করে সিংহরায় সায়েবের ফার্মে চলে যান। ওখানে আমাদের রেডিওভ্যান আছে। কালাম সাহেবকে অ্যালার্ট করা আছে। আমরা একটু পরে যাচ্ছি।
সাদা পোশাকের অফিসার বেরিয়ে গেলেন। ওসি বোতাম টিপে একজন। কনস্টেবলকে ডেকে কফি আর বিস্কুট আনতে বললেন।
হালদারমশাই কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, কর্নেলস্যার কি সেই কথাটা–
কর্নেল দ্রুত বললেন, কোন্ কথাটা?
মানে–অট্টহাসের থানে–
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, আপনি বাঘের মুণ্ডু দেখেছিলেন। সে-কথা জানিয়েছি। চিন্তা করবেন না। আগে কফি খাওয়া যাক। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।
বুঝলুম হালদারমশাই অট্টহাসের মন্দিরে মিঃ সিংহরায় আর গোপালবাবুর খোঁড়াখুঁড়ির ঘটনাটা বলতে যাচ্ছিলেন। হালদারমশাইও কর্নেলের মনোভাব আঁচ করে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, বাঘটা অবশ্য আমারে তাড়া করে নাই। গর্জনও করে নাই। স্ট্রেঞ্জ টাইগার!
নরেন্দ্র ব্যানার্জি বললেন, গর্জন করলে নার্ভের বারোটা বেজে যেত মিঃ হালদার! ওহ! সে কী ভয়ঙ্কর গরগর গর্জন। মনে হয়েছিল যে বাজ পড়ছে। মুহূর্মুহূ! নিঝুম জঙ্গলে রাতদুপুরে আচমকা বাঘ যদি কাছাকাছি কোথাও গর্জন করে ওঠে, মাথা ঠিক রাখা কঠিন হয়। বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের বইয়ে পড়েছি। তাছাড়া মিঃ সিংহরায়ও নাকি একসময় নামকরা শিকারি ছিলেন। তরুণ বয়সে বাঘ মেরেছিলেন!
জিজ্ঞেস করলুম, উনি গর্জন শুনে কী বলেছিলেন?
উনিও মিঃ হালদারের মতো বলেছিলেন স্ট্রেঞ্জ টাইগার!
ট্রেতে কফি-বিস্কুট এসে গেল। ওসি বললেন, কফি খান কর্নেলসায়েব! এ কফি আপনার উপযুক্ত নয়। সিউড়ি থেকে পুলিশ সুপার আমেদসায়েব আমাকে টেলিফোনে বলেছিলে. কর্নেল সায়েবের জন্য ভালো কফি আনিয়ে রাখবেন। উনি কফির ভক্ত।
হালদারমশাই হাসলেন। এস পি সায়েব আরও কিছু কইছিলেন সম্ভবত!
হ্যাঁ কর্নেলসায়েব অট্টহাসের জঙ্গলে বাঘ ধরতে যাচ্ছেন বলেছিলেন। আমি তৈরিই ছিলুম। তবে হঠাৎ একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল!
কর্নেল আস্তে বললেন, কিনু এত বোকা আমি চিন্তাও করিনি। সিঁদেল চোর বা ছিঁচকে চোররা নাকি ধুরন্ধর হয়।
ঠিক বলেছেন। আমার অভিজ্ঞতায় কথাটা জানি। তবে আজকাল এই। বিশেষ প্রজাতির চোর সর্বত্র দুর্লভ হয়ে উঠেছে। আহিরগঞ্জে দৈবাৎ একজন ছিল। সেও অক্কা পেল। এখনকার চোরেরা ফায়ার আর্মস নিয়ে চুরি করে।
টেলিফোন বাজল। ওসি রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর শুধু হু বলতে থাকলেন। শেষে বললেন, ওকে থ্যাঙ্কস্! তিনি রিসিভার রেখে গম্ভীর। মুখে কর্নেলকে বললেন, ডাক্তারবাবু বললেন, বাঘের থাবা বলেই তার ধারণা। মাথার পেছনকার খুলি তিন জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। পিঠে চার-পাঁচ ইঞ্চি গভীর আঁচড়ের দাগ আছে। গেঞ্জি ছিঁড়ে গেছে। তবে আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাঠাবেন।
কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ডাক্তারের প্রাথমিক মতামত পাওয়া গেল। এবার চলুন! মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে যাওয়া দরকার।
ওসি উঠলেন। চলুন! যা মনে হচ্ছে, ওটা রাজেন হাজরার পোষা বাঘ! বলে তিনি জোরে হাসলেন।
হালদারমশাই আপনমনে বললেন, কিনুর ঘরে তালা ভাঙল কে? ভাঙলই বা ক্যান? হেভি মিস্ট্রি!
ওসি ঘর থেকে বেরিয়েছেন, এমন সময়, আবার টেলিফোন বাজল। তিনি ঘরে ঢুকে গেলেন। আমরা থানার সামনে লনে এগিয়ে যাচ্ছি, তখন ওসি বীরেন্দ্রবাবু দ্রুত এসে গেলেন। সহাস্যে বললেন, রাজেন হাজরা এইমাত্র বাড়ি ঢুকেছে। ব্যানার্জিবাবু! আপনি কজন কনস্টেবলকে সিভিল ড্রেসে সঙ্গে নিয়ে যান। অ্যারেস্ট করে লকআপে ঢুকিয়ে রেডিও অপারেটরকে মেসেজ দিতে বলবেন। সিংহরায় সায়েবের ফার্মের কাছে আমার রেডিওভ্যান আছে। খবর। পেলে খুশি হব।
নরেন ব্যানার্জি আমাদের সঙ্গ ছেড়ে ব্যস্তভাবে থানায় গিয়ে ঢুকলেন।
ওসি আর কর্নেল পুলিশজিপের সামনে বসলেন। পেছনের দিকে বসলুম। আমি এবং হালদারমশাই। জিপে স্টার্ট দিয়ে ওসি একটু হেসে পিছনে ঘুরে বললেন, মিঃ হালদারকে কষ্ট করে আবার একবার থানায় আসতে হবে। রাজেন হাজরাকে মুখোমুখি শনাক্ত করবেন।
হালদারমশাই বললেন, করব। কিন্তু আমারে নদীতে ফ্যালাইছিল কোন হালায়? তারে পাইলে– রুষ্ট ভঙ্গিতে হঠাৎ থেমে তিনি একটিপ নস্যি নিলেন। জিপ থানার পাশ দিয়ে ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তায় পৌঁছুল। বুঝলুম, শর্টকাটে যেতে চান বীরেন্দ্রবাবু। রাস্তায় কাদা আছে। কিন্তু পুলিশের জিপ জলকাদা গ্রাহ্য করে না। আমরা দুজনে পরস্পরের গায়ে পড়ে বিপর্যস্ত হচ্ছিলুম।…
মিঃ সিংহরায়ের ফার্মের সামনে পুলিশের বেতার ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। ওসি জিপ থেকে নামলে একজন অফিসার তাঁকে সেলাম ঠুকে বললেন, এভরিথিং ওকে স্যার!
ওসি বীরেন্দ্র রক্ষিতকে দেখে গেটের একটা অংশ খুলে দিল ফার্মের গার্ড। তারপর যথারীতি সেলাম ঠুকে একপাশে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকতেই কুকুর দুটোর গর্জন শোনা গেল। কিন্তু তাদের দেখতে পেলুম না। বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে সুদর্শন সিংহরায় ম্যানেজার গোপালবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তার হাতে দোনলা বন্দুক। আমাদের দেখে তিনি গার্ডকে ডেকে অফিসঘর থেকে কয়েকটা চেয়ার আনতে বললেন।
কর্নেল বললেন, এখানে চেয়ার আনার দরকার নেই মিঃ সিংহরায়। চলুন! আমরা আপনার অফিসেই যাই। আসুন গোপালবাবু! আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার আছে।
গোপালবাবু হাসলেন। হাজারটা প্রশ্ন করুন। যা জানি, তা বলব।
মিঃ সিংহরায় বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গোডাউনের দিকে ঘুরে পাশের অফিসের তালা খুলে দিলেন। তার ম্যানেজার গোপালবাবু জানালাগুলো খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। দিনের আলো তখন ধূসর হয়ে উঠেছিল। গোপালবাবু বললেন, পাঁচু আর তার বউ হাসপাতালের মর্গে আছে। তাদের জিজ্ঞেস করলে হয়তো অনেককিছু জানা যেত। পাঁচুর বউই কিনুর ডেডবডি দেখতে পেয়েছিল।
ও সি বললেন, তাদের দুজনকেই জেরা করা হয়েছে। তিনি একপাশে বিছানা পাতা খাটিয়াটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি অফিসেই বসবাস করেন গোপালবাবু?
গোপালবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি স্যার সাদাসিধে মানুষ। আমার কোনোরকম বিলাসিতা নেই।
আপনি এক্স সার্ভিসম্যান শুনেছি।
হ্যাঁ স্যার। ডিফেন্স অ্যারোনটিক্যাল ডিপার্টমেন্টে রেডিও অপারেটর ছিলুম। কর্নেলসায়েব আমার সব কথা জানেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে রিটায়ার করার নিয়ম। তো আহিরগঞ্জে ফিরে মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে ঢুকেছিলুম। সায়েব আমাকে নিজের হাতে ফার্মিংয়ের কাজ শিখিয়েছেন।
হালদারমশাই খাটিয়ার তলা থেকে একটা প্রকাণ্ড কঁচি টেনে বের করে বললেন, এটা কোন কামে লাগে?
মিঃ সিংহরায় বললেন, গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়।
ওসি বললেন, মিঃ সিংহরায় এই ঘরটা আমরা সার্চ করতে চাই।
করুন। কোনো আপত্তি নেই।
গোপালবাবুও সহাস্যে বললেন, নিশ্চয় করবেন। সায়েবের কাজ-কারবারে কোনো বেআইনি ব্যাপার নেই।
কর্নেল একটা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। হঠাৎ আসছি বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। গোপালবাবু বললেন, পাখিটাখি দেখেছেন কর্নেলসায়েব।
সেই পুলিশ অফিসার আর দুজন কনস্টেবল এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওসি-র আদেশে তারা সার্চের কাজে ব্যস্ত হলেন। খাটিয়ার বিছানা ওলটপালট করে র্যাকের ফাইলগুলো সরিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে সার্চ চলতে থাকল। তারপর ওসি বললেন, মিঃ সিংহরায়! আলমারিটা খুলে দিন।
সুদর্শন সিংহরায় আলমারি খুলে লকারও খুলে দিলেন। ওসি নিজে আলমারির ভেতর থেকে একগাদা ফাইল বের করলেন। তারপর লকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই আলমারির চাবি কি মিঃ সিংহরায় নিজে রাখেন?
মিঃ সিংহরায় বললেন, না। গোপালবাবুর কাছেই থাকে। আজ আমি চাবিটা নিয়েছিলুম ওঁর কাছে। একটা ইমপর্ট্যান্ট ফাইল দেখার দরকার ছিল।
ওসি লকারের দিকে হাত বাড়ালেন। হালদারমশাই র্যাকের মাথা থেকে একটা পকেট ট্রানজিস্টার তুলে নিয়ে বললেন, এইটুকখান ট্যানজিস্টার!
গোপালবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, মাঝে মাঝে কখনও গান শুনি। ওটা মিলিটারি ক্যান্টিন থেকে শস্তায় কিনেছিলুম। তবে ওটা ট্রানজিস্টার-কাম টেপরেকর্ডার।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ খুদে যন্ত্রটার পেছনদিক দেখে বলে উঠলেন, এই ফুটাটা ক্যান?
গোপালবাবু বললেন, ওটা ইলেকট্রিক কানেকশনের প্লাগ-হোল। দরকার হলে—
তার কথার ওপর ওসি বীরেন্দ্র রক্ষিত বললেন, দরকার হলে ইলেকট্রিক কারেন্টেও চালানো যায়। কিন্তু ওটার প্লাগপয়েন্ট লকারের ভেতর কেন গোপালবাবু? হুঁ–নেগেটিভ-পজেটিভ তারটুকু ছেঁড়া। আমেদসায়েব! আর কিছু সার্চের দরকার নেই। মিঃ সিংহরায়! আপনি এটা দেখেই অবাক হয়েছিলেন তা হলে?
সুদর্শন সিংহরায় গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ। কর্নেল সায়েবের থিয়োরি যে ঠিক, তার তৃতীয় প্রমাণ এটা। প্রথম প্রমাণ টেবিলের তলায় ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছিঁড়ে গুটিয়ে ফেলা আমার ফার্মের নেমপ্যাডের মাথার দিকের অর্ধেক অংশ। এই নিন! আর দ্বিতীয় এবং মোক্ষম প্রমাণ সম্ভবত কর্নেল সরকার আবিষ্কার করে তা আনতে গেছেন।
ওসি বীরেন্দ্র রক্ষিত এস আই আমেদকে কী বলতে যাচ্ছিলেন, মিঃ সিংহরায় হঠাৎ হুঙ্কার দিলেন, ইউ স্কাউন্ডেল! মার্ডারার! তারপর ম্যানেজার গোপালবাবুর শার্টের কলার ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। তিনি আর কিছু করার আগেই দুজন কনস্টেবল গোপালবাবুর দুটো হাত পেছনে থেকে টেনে হাতকড়া পরিয়ে দিল। আমি অবাক। হালদারমশাইয়ের চোখ গুলিগুলি এবং গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপছিল। গোপালবাবু মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওসির নির্দেশে আমেদসায়েব এবং কনস্টেবলদ্বয় গোপালবাবুকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন। তখন গোপালবাবু ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কোর্টে সুদর্শন সিংহরায়ের কুকীর্তি ফাঁস করে দেব। নকশাল হয়ে সে তারক দত্তকে খুন করেছিল। পুলিশের ইনফরমার বলে তারক দত্তের ভাই শ্যামলকে খুন করে অট্টহাসের মন্দিরের কাছে পুঁতে রেখেছিল। আমাকে দিয়ে গত মাসে তার হাড়গোড় খুঁড়ে বের করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। লোক জানে, শ্যামল সাধু হয়ে তারাপীঠে চলে গেছে। কিন্তু এবার ভেতরকার কথা আমি ফাস করে দেব।
গেটের বাইরে গোপালবাবুর চিৎকার মিলিয়ে গেল ক্রমশ।..
.
উপসংহার
কর্নেল ফিরে এলেন এতক্ষণে। তার হাতে কালো প্লাস্টিকের একটা ছোট মোড়ক। তিনি বললেন, আজ ভোরে মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে বাইনোকুলারে লক্ষ্য করেছিলুম, গোপালবাবু নিচু জমিটার দক্ষিণে উঁচু ঝোঁপঝাড়ের ভেতর কী একটা করছেন। একটু পরে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে তিনি পাঁচুর বাড়ির ভেতর দিয়ে ঢুকে এলেন। তখন ভেবেছিলুম জৈবকৃত্য করতে গেছেন। কিন্তু কাছাকাছি জল নেই। তা হলে? সন্দেহবশে সেই ঝোপে গিয়ে ঢুকলুম। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, একটা পাথরের তলা থেকে এই মোড়কের একটু অংশ বেরিয়ে আছে। সেটা উদ্ধার করে অন্য এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলুম। মিঃ সিংহরায়কে তার ম্যানেজারবাবুর কীর্তি ফাস করে একটু লক্ষ্য রাখতে বলেছিলুম।
মিঃ সিংহরায় বললেন, গোপাল ব্যাটাচ্ছেলে গিয়ে জিনিসটা খুঁজছে, জানালায় উঁকি মেরে তা লক্ষ্য করেছিলুম। তারপর সে জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়েছিল। সম্ভবত তখনই গিয়ে সে কিনুকে আচমকা খুন করে। কি সম্ভবত পাওনা টাকা আদায়ের জন্য আজ তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিল।
হালদারমশাই বললেন, জিনিসটা কী আনলেন কর্নেলস্যার?
দেখাচ্ছি। চলুন। মিঃ সিংহরায়ের বসার ঘরে যাওয়া যাক। হালদারমশাই! যন্ত্রটা আনুন।
জানালা বন্ধ করে অগোছাল তছনছ অফিসঘরে তালা এঁটে মিঃ সিংহরায় তার সেই বসার ঘরে গেলেন। ওসি বীরেন্দ্র রক্ষিত বললেন, জিনিসটা যে একটা ক্যাসেট, তাতে সন্দেহ নেই। তাই তো কর্নেলসায়েব?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। চলুন। স্বকর্ণে শুনবেন।
সোফায় বসে তিনি কালো মোড়ক থেকে একটা খুদে টেপ বের করে হালদারমশাইয়ের কাছ থেকে ছোট্ট টু-ইন-ওয়ান যন্ত্রটা নিলেন। টেপটা তার ভেতর ঢুকিয়ে বললেন, ব্যাটারিতে এটা চলে। সাউন্ডের কোনো তারতম্য হয় না।
এবার তিনি তাঁর কিটব্যাগ থেকে সেই জাপানি খুদে মাইক্রোফোনটি বের করে টেপরেকর্ডারের পেছনের প্লাগপয়েন্টে লকারে পাওয়া তারের সকেট ঢোকালেন। তারপর মাইক্রোফোনের পেছনের নেগেটিভ-পজিটিভ তারটুকুর সঙ্গে সকেটে ঢোকানো তারের নেগেটিভ-পজেটিভ অংশ জোড়া দিলেন। মধ্যিখানে একটুকরো কাগজ ভাজ করে নেগেটিভ ও পজিটিভ তারদুটোকে আলাদা রাখলেন। তারপর ট্রানজিস্টার-কাম-টেপরেকর্ডারের সুইচ অন করে দিলেন।
প্রায় আধমিনিট পরে আমাদের চমকে দিল কুদ্ধ বাঘের গর্জন। ক্রমাগত গর্জন আর হুঙ্কার। এত কাছে থাকায় কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। কর্নেল সুইচ অফ করে বললেন, জন্তুজানোয়ারের গর্জনের টেপ বিদেশে কিনতে পাওয়া যায়। এই জাপানি মাইক্রোফোনটি ক্ষুদে হলেও প্রচণ্ড সেন্সিটিভ। বটুক দত্তের সাহায্যে এটা ওরা যোগাড় করেছিল। যাই হোক, গতরাতে মিঃ সিংহরায় বাসকঝোপের ওধারে পাঁচিলের মাথায় বাঘ দেখেছিলেন। তাঁর টর্চের আলো পড়তেই ভড়কে গিয়ে কিনু–হ্যাঁ, বাঘের মুখোশপরা কিনু পালাতে গিয়ে তার একহাতে ধরে রাখা এই খুদে মাইক্রোফোনটা ছিঁড়ে পাঁচিলের এধারে পড়ে গিয়েছিল। মধ্যিখানে একটুকু তার কাঁটাতারে আটকে ছিল। ওই অবস্থায় প্রাণের দায়ে কিনু পালিয়ে যায়।
ওসি বললেন, এ সব কথা আপনি আমাকে বলেছেন। এবার স্বকর্ণে শুনলুম। কিন্তু কিনুকে গোপালচন্দ্র খুন করল কী দিয়ে?
কর্নেল বললেন, বাঘনখ নামে একরকম প্রাচীন অস্ত্রের কথা শুনে থাকবেন। লোহার থাবার মাথায় ধারালো নখের মতো ইস্পাতের ফলা বসানো থাকে। অস্ত্রটা গোপালবাবু নদীতেই ফেলে দিয়েছেন। কারণ ঝোপের ওপর দিয়ে রক্তের যে ছোপ বিকেলে দেখেছিলুম, তা বাঁধের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আর খুঁজে পাইনি। বাঘের মুখোশ কিনু নিশ্চয় তার ঘরে রেখেছিল। তাই তার ঘরের তালা ভেঙে ওটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সম্ভবত এ কাজটা রাজেনবাবুই গোপালবাবুর পরামর্শে করেছিলেন।
সুদর্শন সিংহরায় জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, তারক দত্তকে আমি খুন করিনি। তাঁকে যে নকশাল স্কোয়াড বোমা মেরে খুন করেছিল, সেই দলে রাজেন ছিল। এক বিকেলে আমাদের দলের গোপন বৈঠক ডাকা হয়েছিল অট্টহাস মন্দিরের কাছে। আমার যেতে দেরি হয়েছিল। গিয়ে দেখি, মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের কাছে তারক দত্তের ভাই শ্যামলের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। সে সাধুসন্ন্যাসীর অনুরাগী ছিল। কিন্তু সে পুলিশের ইনফরমার বলে আমরা সন্দেহ করতুম। তো আমি ওই অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে রাজেন আর পাশের গ্রাম হাজিপুরের মৈনুল নামে এক যুবক কোদাল নিয়ে এল। সন্ধ্যার আগের ঘটনা। তারা বলল, শ্যামলকে ভুলিয়ে ডেকে এনে খতম করা হয়েছে। ওর বডি নদীতে ফেলার সময় নেই। নদীতে ফেললেও জানাজানি হবে। এখানেই পুঁতে দেওয়া হোক।
ওসি বললেন, বডি ওখানেই পুঁতলেন আপনারা?
হ্যাঁ। ওপরে আস্ত ঝোঁপ আর ঘাস শেকড়সুদ্ধ কোদালে তুলে এনে বসানো হলো। সুদর্শন সিংহরায় একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, সে বহু বছর আগের ঘটনা। শ্যামল সাধু হয়ে গেছে বলে রটেছিল। আমি বিদেশ থেকে এসে এখানে ফার্ম করলুম। তারপর মাস দুই আগে একটা উড়ো চিঠি পেলুম। ওটা কর্নেল সরকারের কাছে আছে। চিঠিটা প্রথমে গ্রাহ্য করিনি। পরে মনে হলো, কেউ কি শ্যামলের লাশের কথা টের পেয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে এতদিনে? গোপাল দাশকে বিশ্বাস করতুম। তাকে সব কথা বলে একদিন অট্টহাসের জঙ্গলে গিয়ে শ্যামলের হাড়গোড় সব তুলে নদীতে ফেলে দিয়ে এলুম। কিন্তু আমি জানতাম না গোপাল এর পর রাজেনের পাল্লায় পড়েছিল। একটা কথা। কর্নেল আজ বলেছিলেন, অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কি জানি! ওঁর কথাটা শুনেই আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
একজন কনস্টেবল এসে সেলাম ঠুকে ওসি-কে বলল, স্যার! রেডিও মেসেজ!
ওসি বেরিয়ে গেলেন। মিঃ সিংহরায় ডাকলেন, হরিঠাকুর! কফি-টফি আনো শিগগির!
একটু পরে ওসি বীরেন্দ্রবাবু এসে সহাস্যে বললেন, রাজেন হাজরার বিছানার তলায় বাঘের মুখোশ পাওয়া গেছে। রাজেন এখন লক-আপে। আমি আমেদ সায়েবকে বললুম, তার সঙ্গীকে নিয়ে পাশের খাঁচায় রাখুন। বোঝা গেল, রাজেনই কিনুর ঘরে তালা ভেঙে বাঘের মুখোশ নিয়ে গিয়েছিল।
কর্নেল বললেন, মিঃ সিংহরায়কে ওরা জঙ্গলের ভেতর অট্টহাসের মন্দিরে ডেকেছিল। উদ্দেশ্য ছিল মোটা টাকা দাবি করে একটা রফায় আসা। শ্যামলের বডি নেই। কিন্তু গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন আছে। দু-এক টুকরো হাড় বা কোনো চিহ্ন ওখানে মাটির গর্তে পড়ে থাকতেই পারে। বাঘের মুণ্ডু দেখিয়ে আর গর্জন শুনিয়ে। মিঃ সিংহরায়ের ওপর ওরা আরও চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
মিঃ সিংহরায় বললেন, ইদানীং গোপাল আমার কাছে চাপ দিয়ে মাইনে বাড়িয়ে নিয়েছিল।
ওসি বললেন, বোঝা যাচ্ছে ওই বড় কাঁচি দিয়ে গোপালই আপনার জাফরান ক্ষেতের অনেকটা জায়গা তছনছ করেছিল। তাকে আপনার কুকুর দুটো চেনে। তাই চুপ করে ছিল।
হালদারমশাই এতক্ষণে ফুঁসে উঠলেন। হঃ! এই হালায় আমারে ধাক্কা দিয়া নদীতে ফেলছিল। অর বডি এতদিন লক্ষ্য করি নাই। আজ লক্ষ্য করলাম। স্ট্রং অ্যান্ড স্টাভট!
হরিঠাকুর ট্রেতে কফি আর বিস্কুট এনে সেন্টার টেবিলে রেখে আবার আড়চোখে হালদারমশাইকে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলেন। আমার মনে হলো, ঠাকুরমশাই সম্ভবত হেকিমসাহেবকে হালদারমশাইয়ের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন….